Saturday, November 12, 2022


মুজনাই সাপ্তাহিক
শিশু দিবস 
বিশেষ সংখ্যা
২০২২  

সম্পাদকের কথা

শিশুদের নিয়ে আমরা বড়রা খুব কিছু ভাবি বলে মনে হয় না। আমাদের নিজেদের ভাবনা, সৃজন ও প্রতিভা প্রকাশে আমরা যতটা উদগ্রীব ঠিক ততটাই অনীহা আমাদের শিশুদের বুঝতে ও চিনতে। চারদিকের বহু পত্র-পত্রিকা, অনুষ্ঠান, খেলাধুলা ইত্যাদিতে শিশুদের অংশগ্রহণের সংখ্যা দেখলে এরকমই মনে হয়। অথচ আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য হওয়া উচিত শিশুদের সামগ্রিক বিকাশ। আমাদের সকলের মধ্যে শিশুদের প্রতি এই উদাসীনতা আখেরে কিন্তু আমাদেরই ক্ষতি করছে। কেননা আজকের শিশু আগামীর নাগরিক। আমাদের মনে রাখা উচিত সেই আপ্তবাক্য `ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে`। 



মুজনাই সাপ্তাহিক 

শিশু দিবস ২০২২

বিশেষ সংখ্যা 

                                              রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক) 

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই সাপ্তাহিক 



শ্রদ্ধার্ঘ্য

''ননসেন্স ছড়া"র প্রবর্তক সুকুমার রায়
গৌতমেন্দু নন্দী 
 
নিয়মহারা, হিসেবহীনের ছন্দদোলার কবি

এঁকেছিলেন কতোই তিনি কল্পনার সব ছবি।


উদ্ভট আর আজগুবিতে মজার মজার ছড়া 
"আবোলতাবোল" ছন্দ দিয়ে খেয়ালরসে গড়া।

"গোঁফচুরি"তে বড়বাবুর গোঁফ করেছেন চুরি 
"খুড়োর কল"এ চন্ডীদাসের নেই যে কোন জুরি।

"কুমড়োপটাশ","হাঁসজারু"বা বোম্বাগড়ের রাজা
 অবাস্তবের শিল্পরসে পাই যে কতোই মজা।

 "সৎপাত্রে" পাত্র-গুনের  ব্যাঙ্গাত্মক  শ্লেষে
  গঙ্গারামের সব "গুনমান" ঘায়েল হয় শেষে।

"আবোলতাবোল"মানেই শিশুমনের এক খেয়াল
  কল্পনারই  সেই জগতে নেই নিষেধের দেয়াল।

 শিশু-কিশোর মনের কথা তাঁর জাদুতেই ঋদ্ধ 
  সেই জাদুতে মুগ্ধ আজও শিশু,কিশোর,বৃদ্ধ।


( ৩০ অক্টোবর সদ্য পেরিয়ে এসেছি সুকুমার রায়ের ১৩৫তম জন্মদিন। 
শিশুদিবস-এ তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এই ছড়া/কবিতা।)



 দুটি ছড়া 
ঋতুপর্ণা বসাক দাশগুপ্ত
 
খোকার ছড়া

খোকা ঘুমোল পাড়া  জুড়ালো  স্বপ্ন এলো ভেসে,
কত না রঙীন কল্পনাতে কোন মেঘ পরীদের দেশে।
সেথায় আছে পাহাড় বিশাল, নদী ও ঝর্ণা ধারা;
খোকা সেথায় পুতুল খেলে হয়ে আপনহারা। 
যেসব খেলা হয় নি খেলা এতগুলো দিন ধরে,
সেসব খেলতে পেরে খোকার আনন্দ না ধরে! 
নেই কো কোন ভূত পেত্নি দত্যি দানো আর রাক্ষস খোক্কস
সেসব শক্তিহীন ,যদি একবার  খুলে যায় মন-খোলস,
খোকাও পুতুল খেলতে পারে ইচ্ছে হলে প'রে-
গাড়ি ,বন্দুক, ডক্টর সেট থাক না সেসব পড়ে,
খেলতে খেলতে ঘুমে খোকার জড়িয়ে আসে চোখ,
পরীর দেশ মিলিয়ে যায়, এবার সকাল হোক।।


খুকুর ছড়া

স্বপ্নের মহল, মেঘের দেশ,
তারার বাতি, ঘুমের রেশ,
চাঁদের আলো, মৃদু মন্দ বায়-
রূপকথার রাজ্যে মন উড়ান দেয়,
সেথায় রাজকন্যা-কোটাল কন্যা -পরী বসত করে 
দেখে দেখে আশ মেটে না রূপ যেন না ধরে  !
আবার মনের  মানুষের অপেক্ষায় পথপানে চোখ  চেয়ে,
আশাপ্রদীপ জ্বেলে বসে রয় এক সাধারন মেয়ে।
নাইবা আসুক রাজার কুমার পক্ষীরাজে চড়ে,
মাটির ছেলেও ভালো যদি মূল্য বুঝে মান দিতে পারে।



সূয্যিমামা
শ্রাবণী সেন

হিমেল হাওয়া চলছে জোরে
শীতের  ছোঁয়া লাগে
সূয্যিমামার ঘুম ভেঙেছে 
এই তো খানিক আগে
লাল জামাটি পরে মামা
আড়মোড়াটি ভেঙে
সপ্ত ঘোড়ার রথে চাপেন
উষার রঙে রেঙে।
সাতটি ঘোড়া টগবগিয়ে 
দশটি দিকে ঘুরে
আলো দিয়ে ফেরেন মামা
আবার আকাশপুরে
সেই সে আলোর পরশ লেগে
মাটির পৃথিবীতে 
সবুজ ঘাসে ফুলে পাতায়
খুশির নৃত্যগীতে
নদীর জলে মেঘের পারে 
বৃষ্টি ধারার মাঝে
সজীব প্রাণের আনন্দ গান
মধুর সুরে বাজে।




বিশু খুড়ো

মাথুর দাস


শিশু দিবসে বললো বিশু খুড়ো,

'আমিও শিশু, তোদের মতোই ঠিক,

ঘুরি ফিরি কাঁদি, হাসিও ফিক্ ফিক্,

ভুল করবি, ভাবিস্ যদি বুড়ো' ।


'খেলতে পারিস্ আমারও সঙ্গে ঢের,

এক্কাদোক্কা কাটাকুটি ছোঁয়াছুঁয়ি-বুড়ি,

লাটাই ধরে চল্ ওই মাঠে ওড়াই ঘুড়ি,

শিশুর মনে আমিও শিশুই হই ফের' ।


'ও শিশুরা, শিশু দিবসেই শপথটি নিস্ জোর

কখনো কেউ করবি না তো কর্মে অবহেলা,

তোদের কর্ম পড়াশোনা এবং কিছু খেলা,

আনতে পারিস্ ভবিষ্যতে তোরাই নতুন ভোর' ।


'চল্ পড়ি গে রাইমস্ ছড়া, অঙ্ক কড়াপাক,

বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকার আনন্দটি বেশ' !

বয়স তো ছার, শেখার কত আগ্রহ অক্লেশ,

শিশুর দলে বিশু খুড়ো শিশু হয়েই থাক ।




খেলাঘর 
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

ছোটরা সবাই এস পায়ে পায়ে
চলে যাই সেই দেশে
হাতে হাত ধরে মনের পেখমে
পাল তুলে ভালোবেসে।
হরেক খেলার পসরা সাজানো
রঙিন খুশির বাঁকে
উঁকিঝুঁকি দেওয়া ছেলেবেলা গুলো
হাতছানি দিয়ে ডাকে।

গোল হয়ে ওই দাঁড়িয়ে সবাই
পাড়ার খেলার মাঠে
ছোঁয়াছুঁয়ির গুনতি করতে
সুর করে ছড়া কাটে।
উঠে যেতে যেতে রয়ে গেল যে
সব ছেলেমেয়ের পরে
'চোর'  'চোর' বলে হাঁক দিয়ে তাকে
পালাবার পথ ধরে।

এদিক সেদিক লুকিয়ে সবাই
দেখি এবার খোঁজো
লুকোচুরির গোলকধাঁধায়
কেমন মজা বোঝো!

ওৎ পেতেছে কুমির ভায়া
নামো যদি জলে
ছুঁয়ে নিলেই কুমির তুমি
কুমিরডাঙার খেলে।

চোখে রঙিন রুমাল বেঁধে
আবোলতাবোল চলা
যাকে পাবে তাকে ছুঁয়েই
কানামাছির খেলা।

পেতে দেওয়া সব হাতের মেলায়
আঙুল সারিসারি
ইকির মিকির চাম চিকির
খেলায় মজা ভারি।

চোখ ধরেছে জুঁইফুল সই
বলতে পারো কাকে?
'আয়রে আমার গোলাপ' বলে
মিষ্টি করে ডাকে....

ওপেনটি বায়োস্কোপ, এলাটিং বেলাটিং,
মিউজিক্যাল চেয়ার বা লুডোর রাত্রিদিন।
কিতকিত, হা-ডু-ডু বা দাড়িয়াবান্ধার খেলা ,
ফুল ফল নাম দেশ, কাটাকুটির বেলা।
ডাংগুলিতে,লাট্টুতে আর
রংবেরঙের ঘুড়ির মেলায়
হঠাৎ হঠাৎ আড়ি ভাবের
রান্নাবাটি, পুতুলখেলায়।

শৈশব বাঁধা ছিল 
সে এক সোনার ডোরে 
হাসি হয়ে , সুখ হয়ে 
চারিদিক আলো করে ।

এমনি আরও কত নামের 
কতশত খেলা
বিকেল ছিল খুশির হাটে
 ইচ্ছেখুশির মেলা।

চাও যদি তবে খেলতে পারো
তোমরাও সব মিলে
না হয় একটু পড়া কম হলো
ফার্স্ট নাইবা হলে।
পড়ার সময় পড়া করে নিও
খেলার সময় ছুটি
ভিডিও গেমের ঘেরাটোপ ছেড়ে
চলে এস গুটিগুটি।

খেলাগুলো সব বলছে শোনো
'কেউ খেলেনা আর '
বিকেল হলেই পুরোনো দিন
মনে করে মুখভার।
এক ছুটে চলে এস
 খেলার বন্ধু হয়ে
রকমফেরের খেলার ছন্দে 
আনন্দ তান বয়ে।
খেলার আসন পাতা আছে
বন্ধু যদি করো
সবাই মিলে হিংসা ভুলে
খুশির ভুবন গড়ো।
আলোয় থাকো, ভালোয় থাকো 
ভালোবাসায় মুড়ে 
'শিশু' নামের ফুলটি হয়ে
সবার হৃদয় জুড়ে।




গানবাহার 
বুলবুল দে

ভরদুপুরে ধোবিঘাটে গান ধরেছে ধোপানী,
সারেগারে গাধাগাধানি পানিরেরে ধাপানি।
তাইনা শুনে আহ্লাদেতে ডিগবাজি খায় ধোপা-
বলে "কি গান আজ শোনালে গিন্নি আহা তোফাতোফা!"
তুলতুলিটা তুলছিল ফুল পাশের কুল তলাতে, 
ফুল ফেলে সে জুলজুলিয়ে সেইগানে কান পাতে। 
আহা কি তাহার সুর-তাল-লয় ছন্দে কি বাহার,
কর্ণ দিয়া মর্মে পশিল যেন করাতের ধার !
নদীর যত মাছ ছিল সব ডাঙায় উঠে লাফায়, 
গানের সুরে কাহিল হয়ে বেদম বেগে হাঁপায়।
বাঁকা-দাঁড়া ঐ কাঁকড়া গুলো উঠে ধোবিঘাটে,
আবেগ-তাড়িত চোখের জলে ধোপানীর পা চাটে।
এইনা দেখে মহা সোল্লাসে গান গেয়ে চলে ধোপানী,
গানের মোহে সাবমেরিনে ছুটে এল এক জাপানি।
সেও সাথে গায়- হোক্কাইদো,হনশু কিউশু শিকাকো,
মিতসুবিশি ইকেবানা, কিমোনো এন্ড টোবাকো।
গানের চাপে চিংড়ি গুলান নদীর তলে চিৎপটাং, 
চেংড়ি পুটি চ্যাংড়া রুইয়ের ল্যাজটি ধরে মারে টান।
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল ঐ পাড়ার ছোকড়া কানাই,
লম্ফ মেরে ওষ্ঠে ধরে আম আঁটির ভেঁপুসানাই। 
ধোপানী জাপানী কানাই সঙ্গতে জলসা উঠল জমে,
হিমালয় সহ ফুজিয়ামা কাঁপে পারগানবিক বোমে!!





বাবুর বাড়ির ভূত
বিপ্লব গোস্বামী


বাবুর বাড়ীর দীঘির পাড়ে
ভূত প্রেতের বাস,
রাত গভীরে বেজায় ক্ষেপে
সরবে ভাঙে  বাঁশ।

অমাবস্যার সন্ধ‍্যে-দুপুর
ভূতের বাড়ে বার,
মড়মড়িয়ে গড়গড়িয়ে
নুয়ায় বাঁশ ঝাড়।

বামুন পাড়ার হারুন মামা
কাটতে এলো বাঁশ,
সবাই বলে করিস না ভুল
হবে যে সর্বনাশ।

একঘেয়ে হারুন রগচটা যে
মানেনি কারো যে মানা,
বাঁঁশ কাটিয়ে সাফাই করে
ভাঙ্গল ভূতের থানা।

সেদিন হতে বাবুর বাড়ির
কাটল ভূতের ভয়,
সবাই বলে সাবাস হারুন
জয় হারুনের জয়।




মাছ বাজার

চন্দ্রানী চৌধুরী


ভোরবেলাতে চোখ কচলে দেখি আজব কান্ড

মগডালেতে মাছের ভীড় ঘুম হল আজ পন্ড।


গিন্নী বলেন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও 

মাছ আনতে এক্ষুনি গাছের আগায় যা 


শুনে আমি ভিরমি খেলুম এবার উপায় কি 

 কাজটি কক্ষনো যে করতে পারিনি 


গিন্নি শুনে ভয়ানক রেগে হলেন লা

বলেন হেঁকে গাছের আগায় পাতো তবে জাল।


ধুর্ ছাই কি বিপদ হল জাল পাতা কি যেসে কম্ম

থলে হাতে মাছ বাজারেই গেলাম শুধু  জন্ম 


কি করি আর কোথায় যাই ভেবে নাজেহাল 

এমন সময় দড়াম করে পড়ল বুঝি তা 


দেখি চেয়ে পায়ের কাছে পড়ল এসে কি

ওমা এযে কাতলা মাছ পিছলে গেল কি !


মাছ পেয়ে গিন্নী খুশি ফিরল ঘরে শান্তি

গাছে চড়ে মাছ না ধরে বাঁচল আমা প্রানটি।





পাট ও পাঠ  
সুনন্দ মন্ডল

শিশু মানেই সহজ সরল
যেন সাদা খাতা।
সারাদিনটা এদিক ওদিক
খেলাধূলায় মাতা।

পড়াশোনার ধার ধারে না
খাওয়া-দাওয়াতে নাকচ।
বন্ধু কেমন বোঝে না ওরা
তবুও সঙ্গী জোটার হুজুগ।

সারল্যে আর খুনসুটি চায়
কখনও মারামারি।
ভাগের জিনিস সামনে পেলে
নেই কিছু ছাড়াছাড়ি।

হঠাৎ যখন আঁধারবেলা
খেলাধূলার চুকল পাট।
চোখটা কেমন নিচের দিকে
তখন শুধু বইয়ের পাঠ।




ফোবিয়া
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী

বুবলু, সোয়েটারের মাপটা নেব, এদিকে আয়।
ঠামা, আমাকে তো এই সেদিন একটা টুকটুকে লাল সোয়েটার বানিয়ে দিলে, সেটার মাপ তো ঠিকই হয়েছিল, পরেছিলাম তো--
ওরে বাবা, এটা টকটকে হলুদ সোয়েটারের মাপ! এরপর এই সোয়েটারের বেঁচে যাওয়া হলুদ উল আর আগের লাল উলটা দিয়ে একটা লাল-হলুদ ডোরাকাটা সোয়েটার বুনবো। তারপর----, কলিংবেলটা বাজলো না? এই সুমিতা, দেখ তো, কে এসেছে! --- ওমা দিদি, কি ভাগ্যি!  বসুন, বসুন।
সময়ই পাই না! নাতিডার জইন্য সোয়েডার বুনছি, একটা নতুন ডিজাইন করছি, মাপ নিমু—-
কই, দেখি দেখি! ওমা! কি সুন্দর হয়েছে! এই আকাশি রঙটা বুবলুকে খুব মানাবে।
হ, আরেকটা বাসন্তী রঙও কিনছি, ওইডা ফুল বানামু, সরস্বতী পূজায় পরবো অহন—
হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো হবে। বুবলু, এদিকে আয়, দিদুন সোয়েটারের মাপ নেবে। আমিও এই হলুদটা বুনছি, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, শুধু গলাটা শেষ করেই ওকে পরিয়ে দেখবো।
বুবলু সুনা, আসো, সোয়েটার পরায়ে দিই। —দেহি, হাত দ্যাও ত--
আ---আ---, খুব ব্যথা পাচ্ছি গলার কাছে, দিদুন---কি টাইট সোয়েটারটা!
আহাহা, ওরকম টানাটানি করবেন না দিদি, ছোটো মানুষ ব্যথা পাবে!
ইরকম হইলো ক্যান? গলাডা ত মাপমতোই করসি।
ও হতেই পারে, একটু খুলে বড়ো করলেই হবে। এই যে, আমারটা শেষ! বুবলু আয়, মাপ নেব। 
উ---উ----, কি শক্ত সোয়েটার ঠামা, সারা গা চুলকোচ্ছে!
দাঁড়াও, দাঁড়াও! গা চুলকোক, পাখাটা চালিয়ে দিচ্ছি, একটু দেখতে দাও না!
 খুলে দা আ আ ও!
ইঃ, এক্কেরে লাল হইয়া গেসে---আহা! ইস--
আচ্ছা আচ্ছা, পরতে হবে না, খোলো এখন। এই লালটা পরো, দিদুনকে মাপটা দেখাবো।
উঁ উঁ--- , আমি আর সোয়েটার পরবো না, ভীষণ গরম লাগে এ এ এ—
সবসময় দুষ্টুমি কোরো না, ভালো লাগে না, কথা শোনো। পরো, চকোলেট দেব। এ-এই তো, কেমন মিষ্টি দেখাচ্ছে!
দেহো দাদান, আমি একটা লাল টুপি বুনাইছি তুমার জইন্য। মাথায় দাও দেহি! বাঃ, বেশ হইসে। লাল সোয়েটার, লাল টুপি! উঁ উঁ---, খুইলো না, খুইলো না! পইরা থাকো। যাও, এখন খেলো গিয়া। আমি এই সোয়েটারের গলাটা খুইল্যা একটু বড়ো কইরা বুনায়ে লই, তারপর মাপ দেখুম। ---অই ত, নিরু আইয়া পড়ছে--
মা, তুমি আবার ওই হাওয়াই চপ্পল পরে এসেছো? সেদিনই তো জুতোটা কিনে দিলাম। পা ব্যথা কিন্তু কমবে না বলে দিলাম এরকম চটি পরে ঘুরে বেড়ালে! মণিমা, চা করবো? সিঙাড়া এনেছি।  বুবলু কোথায়? 
ওই তো, ওদিকে খেলছে। কি তার বায়না, সে সোয়েটারের মাপ দেবে না, কতো করে ভুলিয়েভালিয়ে----ওমা, নেই তো এখানে! দোতলায় গেছে বোধহয়!
বুবলু, বুবলু! অ্যাই বুবলু! বুবলু-----!! 

মা, মা, মণিমা,  বুবলু ওপরে কোত্থাও নেই! কোথায় গেল! দরজাটা তো খোলা ছিল, ছেলেটা আবার বেরিয়ে গেল না তো? ওমা, কি হবে!  সুমিতা, দেখ তো রাস্তায়--! নেই, না?--- হ্যালো শুনছো, গুবলুকে পাওয়া যাচ্ছে না, আমার ভীষণ ভয় করছে, তুমি এক্ষুণি চলে এসো! --কি? এক্ষুণি দিল্লি থেকে কি করে আসবে? ওসব আমি জানি না--! আসতে হবে! হে ভগবান, কি করি এখন---! মা, থানায় খবর দিতে হবে! ছোট্ট মানুষটা--—
কি কাণ্ড হইলো গো! গলার মাপডাও লইতে পারলাম না! তুই বিপুলরে ডাক দিয়া নে, তর লগে যাউক।
হে ভগবান, হলুদ সোয়েটারটা তো বুবলু পরলোই না, নতুন সোয়েটার! 
মা-আ-আ , মা-আ-আ--
এই তো! কোথায় ছিলি পাজি ছেলে, কতক্ষণ থেকে ডাকছি!
ছাতে, ভয়ে লুকিয়ে ছিলাম!
ওমা, কেন? বাড়িতে এতগুলো মানুষ! কিসের ভয়?
সোয়েটারের!
কি!!




রোডির কথা
বিনয় বর্মন


বুবলি ,
   রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলে বলে আমার নাম রেখেছিলে রোডি। রোড থেকে রোডি l আমার এখনো মনে পড়ে সেই দিনের কথা l আমি তখন খুবই ছোটো l রাস্তায় খেলছিলাম l হঠাৎ একটা সাইকেল বেপরোয়া চালিয়ে দিয়েছিল  আমার পায়ের উপর। আমি পরিত্রাহি চিৎকার করে উঠেছিলাম। তুমি কোথা থেকে ছুটে এসে আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলে l তারপর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অনেক যত্ন করেছিলে আমার। পায়ের মধ্যে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিলে l  গরম করে চুন হলুদ, তারপর ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলে। খেতে দিয়েছিলে  দুধ বিস্কুট । তারপর আমি ধীরে ধীরে সেরে উঠি। 

    তুমি আমার নাম রাখলে  রোডি l মনে পড়ে কি করে আমি তোমার খেলার সাথী হয়ে দাড়ালাম। তুমি বল ছুঁড়ে দিয়ে বলতে "রোডি ক্যাচ" l আমি ছুটে নিয়ে আসতাম l বলতে " রোডি গো " , "রোডি স্ট্যান্ড" ,  "রোডি সিট " , আমি আস্তে আস্তে তোমার কথা শিখতে লাগলাম l সকাল বেলা তোমার মা বেরিয়ে যেতো, তুমিও স্কুলে চলে যেতে l আমি একা থাকতাম। তারপর তুমি ফিরে এলে আবার তোমার সঙ্গে খেলতে লেগে যেতাম l      
  
     এভাবে দিনগুলো তো ভালই  কাটছিল আমাদের । মাঝে মধ্যে তুমি ব্রাশ দিয়ে আমার লোম আঁচড়ে দিতে, আমাকে স্নান করিয়ে দিতে, শ্যাম্পু করিয়ে দিতে। মা অবশ্য বকাঝকা করতো তোমাকে যে ... " কি একটা রাস্তার কুকুর ছানা নিয়ে তুই এত আদিখ্যেতা করিস?"  কিন্তু তা হলেও তার প্রশ্রয় ছিল l কারণ তিনি জানতেন যে , তিনি তোমাকে সময় দিতে পারেন না। তুমি একা থাকো, আমি ছিলাম তোমার সঙ্গী। 

        এরপর একদিন তোমার বাবা ফিরে এলো। তোমার আর তোমার মায়ের গল্পেই শুনেছিলাম, তোমার বাবা থাকতেন বাইরে । বাইরে কোথাও তিনি চাকরি করতেন l তারপর আবার তিনি একেবারে স্থায়ী ভাবে ফিরে এলেন, চাকরির পালা শেষ করে। তোমরা মা এবং মেয়ে বলতে এবার নিশ্চই খুব মজা হবে। কিন্তু বাবা আসার পর থেকে দেখলাম যে  তোমাদের সঙ্গে তোমার বাবার  খিটিমিটি লেগেই আছে। তুমি এই পারো না, সেই পারো না, এটা কেনো করো ...? আর তোমার সঙ্গে রোজই ঝগড়া লেগে থাকতো। মাও তেমন কিছু বলে উঠতে পারতেন না .. বাবার কাছে বকুনি , মারধোর খেয়ে তুমি যখন একা ঘরে বসে বালিশে মুখ বুঁজে কাঁদতে , আমি তোমার পাশে গিয়ে দাড়াতাম। তোমার গাল চেটে দিতাম। তখন তুমি আমাকে কোলে নিয়ে খুব আদর করতে l আবার হাসিখুশি হয়ে পড়তে .....

আরো কত কথা মনে পড়ছে l মনে পড়ছে একদিন ঘরে সাপ ঢুকে গেছিল l খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল l কেউ দেখতে পায়নি l আমি দেখে চিৎকার করছিলাম l তারপর সবাই এসে সেটিকে তাড়িয়ে দেয় l তুমি সেদিন আমাকে খুব আদর করেছিলে l আরেকদিন রাত্রিবেলা ছাদের উপর চোর এসেছিল l কিন্তু আমার চিৎকারে সবাই জেগে ওঠে চোর পালিয়ে যায়। ...

কিন্তু এখন  হঠাৎ কি হল..!  তোমার বাবা আসার পর থেকেই বলে  যাচ্ছিলেন যে , " এই কুকুরটাকে দূর করে দে ! রাস্তার নেড়ী কুকুর! "  তোমার বাবা কে আমি খুব একটা পছন্দ না করলেও কখনো তার সঙ্গে খারপ ব্যাবহার করতাম না। আজকে যখন তিনি আমাকে স্কুটিতে তুলে বললেন" এই রোডি চল " । তখন আমি কিছু বুঝিনি l তারপর আমাকে স্কুটিতে তুলে অনেক দূর  চালিয়ে তিনি এক গ্রামে এসে দাড়ালেন। আমাকে একটা  বিস্কুট  ছুঁড়ে দিয়ে বললেন " যা নিয়ে আয়" l আমি ছুটে গেলাম l তারপর দেখি একি ... তিনি স্কুটি ঘুরিয়ে চলে  যাচ্ছেন। ... আমি তার পেছন পেছন ছুটতে লাগলাম l কিন্ত তিনি আরো জোরে চালাতে লাগলেন। আমি কিছুটা গিয়ে  হাফিয়ে গেলাম l আর দৌড়াতে পারলাম না। এখন আমি একা বসে আছি l 

একটু আগেই এক প্রস্থ রাস্তার কুকুরের সাথে মারপিট হয়েছে । তারা আমাকে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে.. আমি যন্ত্রণায়  কুঁই কুঁই করছি আর ভাবছি যে তুমি নিশ্চই এসে দাঁড়াবে l সেদিন যেমন দাড়িয়েছিলে ।  কিন্তু কই..? তুমি তো আসছো না l আমি জানি যে তুমি নিশ্চই খুঁজছো আমাকে l আমাকে না পেয়ে তুমি একা খুব কাদঁছো l আমি জানি তুমি ঠিক খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসবে l এসে আমাকে নিয়ে যাবে l .... প্লীজ আমাকে নিয়ে যাও.. আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি...। 
                                                                                                                                তোমার রোডি



জমিদারবাড়ির গোপন  কুঠরী 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

অবশেষে  আমরা  চার  বন্ধু  এসে  পৌছলাম নবগ্রাম জমিদারবাড়ির সিংহদুয়ারের সামনে। ট্রেন, বাস, ভ্যান রিক্সায় সারাটা দিন পার হয়ে গেল।  সন্ধ্যার  আগেই  আমরা পৌছে  গেলাম জমিদার  বাড়ির  পুরনো বৃদ্ধ  নায়েব   মশাই  ধরনীমোহন বাবুর অফিসে।  ধরনীমোহনবাবু  তাদের পুরনো গাইড, নিশিকান্ত কে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিলেন পুরনো জমিদার বাড়ির তিনতলায়।

 বাপী,বাবুয়া,ক্ষীরোদ ছোটবেলা থেকে  একই স্কুলে   পড়তাম।  স্কুল   থেকে   ফেরবার  পথে আমরা  চারজনই   পড়তাম   ইংরেজি  মাস্টার মশাই   তারাপদ  ঘোষের  কাছে।  ইংরেজি ছাড়াও বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতে ছিল তারাবাবুর অগাধ পান্ডিত্য।

মাথায় কাঁচা পাকা চুল,সারামুখে শ্বেতীর দাগ ছিল তারাবাবুর। পানের নেশা ছিল বলে তার ঠোঁট দুটো ছিল লাল। কথা বলার সময় জর্দার একটা  মিষ্টি  গন্ধ ঘরে  ছড়িয়ে পড়ত। পড়ানোর ফাঁকে  ফাঁকে  শোনাতেন  নানা  ধরনের  রহস্য রোমাঞ্চকর  কাহিনি।  তিনি   নিজেও  পড়তেন  নানারকম দেশী বিদেশি বই। 

 " তোরা  চলে  গেলে  পান  খাব, পান  খেয়ে পড়তে  বসব। "এই  ছিল  তাঁর   মুখের  কথা। রোজ তাঁর এই কথা   বারবার শুনতে শুনতে, আমরাও  তাঁকে  নকল করে  বলতাম,  " তুই   চলে  গেলেই  পান  খাব,  পান  খেয়ে পড়তে বসব।"

তিন তলার একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে নিয়ে আমাদের  নিয়ে  আসলেন   আমাদের  গাইড, নিশিকান্ত বাবু । গাইডের চোখ দুটো খুবই  চেনা কোনো  মানুষের মত লাগছিলো। কিন্তু কিছুতেই মনে আসছিল   না , যে  সে  ঠিক  কার    মতো দেখতে। আমরা চারজন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলাম।  মানুষটা যে বেশ   রহস্যময়, এবিষয়ে কোন সন্দেহই রইল না।  আমরা  চারজন  তাকে  অনুসরণ করতে লাগলাম। সে আমাদের সব ঘর গুলো ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলো।

হঠাৎই আমরা  লক্ষ করলাম নিশিকান্ত বাবু পান চিবোচ্ছেন।   অন্ধকারে  তার  চোখ  দুটো কেমন যেন  আলাদা  রকম  জ্বলজ্বল করছে। সব  ঘর গুলোই বেশ  পুরনো, এখানে  একমাত্র টুরিস্টরা এবং নানান  গবেষকরা এখানে ঘুরতে  আসেন, গবেষণার সুত্র সন্ধানে। সব ঘরেগুলোতেই  ঠিক  মিউজিয়ামের মতো  বহু   প্রাচীন   জিনিসপত্র  সাজানো। বাঘ, হরিণ, গন্ডারের মাথা সাজানো রয়েছে। আসবাবপত্রগুলোও একটু অন্য  একটু বিশেষ  ধরনের।  একটা ঘরের চার দেওয়ালে  পর পর চোদ্দ জন জমিদারের  (চোদ্দপুরুষের)  ছবি টাঙানো  রয়েছে । সব ঘরেই  চারিদিকে মাকড়সার জালের আঠা  আমাদের চোখে মুখে আটকে যাচ্ছে। ঘরময় একটা পুরনো ভ্যাপসা গন্ধ। কয়েকটা জোনাকি ইতস্তত ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছবি দেখে  বেশ  বোঝা গেল,   শেষ জমিদারই  ছিলেন সূবর্ণকান্তি মুখোপাধ্যায়। 

 নবগ্রাম জমিদার বাড়ির চুন সুরকি ওঠা বিশাল বাড়িটা নিয়ে কতই না  রহস্য, কত না কাহিনি।   এই জমিদার বাড়ির ঘিরে  নানা  রকম  কাহিনি, আজও  লোকমুখে শোনা যায়।   তারাবাবুর মুখে শোনা সেই সব রহস্যময় কাহিনির মুখোমুখি আমরা  আজ। তাই  রহস্য রোমাঞ্চের আর শেষ নেই। এর মাঝেই একটা হোতকা কালো বিড়াল আমাকে গুতো দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। 

জমিদার বাড়িতে  সোনার চালের একটা বাক্স ছিল।  তার  মধ্যে সব  জমিদারদের নাম লেখা একটা সোনার পদ্মফুল ছিল।  হঠাৎই একদিন   সেই চালের বাক্স থেকে সোনার পদ্মটি উধাও হয়ে যায়।  এই ঘটনায় বহু মানুষকে চোর সন্দেহ করে হেনস্তা করা হয়। চুরি যাওয়া পদ্মফুল নিয়ে শুরু হয় নানারকম অশান্তি। 

 জমিদার সূবর্ণকান্তি  মুখোপাধ্যায় জমিদারির প্রায় সব ধন নিঃশেষ করে ফেলেছিলেন, সেই সোনার   পদ্মফুলের  চোরকে   খুঁজতে। অবশেষে অনেক    সিপাহি,   পেয়াদা, গোয়েন্দা লাগিয়ে   সেই সোনার  পদ্মফুলসহ  বাক্স উদ্ধার করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এই কাজে তাঁর  ধনবল, লোকবল,  যৌবন সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। 

তারাবাবুর  কথায়,  জেনেছিলাম  "ওই সেকেলে  মেজতরফের   দোতালায়  একটা  ঘরেই   ছিল গোপন  একটা   কুঠরী।  সেই কুঠরী  ঘর থেকে ধড়  এবং মুন্ডু আলাদা করে ফেলে দেওয়া হতো অপরাধীদের। খুব অহংকারী ছিলেন এই শেষ জমিদার।  তাঁর  পর   পরই  নাকি  জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি  ঘটে। 

শোনা যায় দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী জমিদার সূবর্ণকান্তি  ছিলেন অহংকারী ও দাম্ভিক প্রকৃতির মানুষ ।  এই জমিদারবাড়ির সামনে দিয়ে কোন প্রজা ছাতি মাথায় চলাচল করতে পারতেন  না। জমিদারীর খাজনা বাকী পড়লে কোন অন্যায় করলে,  লঘু পাপে গুরু দন্ড দেওয়া হত।  প্রজাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো।  তাই  জমিদারকে খুশি করবার জন্য সব  প্রজারা তাদের জমির ফলানো ফসল, শাক- সবজি,  পুকুরের মাছ, কচি পাঁঠা জমিদার মশাইয়ের  জন্য সদর সিংহদুয়ারের পাশে রেখে দিয়ে  যেত। 

তিনতলার একটা ঘরে অপরাধীদের বন্দী করে রাখা হত।  রাতেরবেলা  সবার অজান্তে, দু'জন   জল্লাদ  অপরাধীদের হত্যা করে, ফেলে দিত গোপন কুঠরীতে। সেই মৃতদেহ গিয়ে পড়তো সরাসরি যমুনা নদীর জলে। জোয়ার ভাটার টানে সেই সব মৃতদেহ চলে যেত বাংলাদেশের বিভিন্ন  নদীতে। 

সব  ঘরগুলো ঘুরে অবশেষে আমরা এলাম সেই অন্ধকার কালো কুঠুরিতে। সেখানে পা রাখতেই আমাদের এক অজানা আশংকায় রক্ত হীম হয়ে এল। দূরে কতগুলো শিয়ালের ডাক শোনা গেল। 

হঠাৎ  ভাঙা  জানালার  কপাট  দিয়ে  আবছা চাঁদের  আলোয়  আমরা  যা দেখলাম,  তাতে আমাদের  চারজনেরই  আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড় হল।  আমরা লক্ষ্য করলাম, গাইডের মুখে শ্বেতীর দাগ এবং   পান খাওয়া লাল ঠোঁট।  ঠিক যেন আমাদের ইংরেজি মাষ্টার মশাই তারাবাবু বসানো । আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে  ধীরে ধীরে অন্ধকার  নিকষকালো কুঠুরির সিঁড়ি ধরে নেমে গেলেন, এবং অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মুহূর্তের মধ্যে আমরা  কুয়োর জলে একটা ভারী বস্তা পড়বার মতো  শব্দ শুনতে   পেলাম।  আমরা পাড়ি কি মরি  চারজন, জীবন মরণ পন করে দৌড়ে ঘোরানো  সিঁড়ি দিয়ে চলে এলাম জমিদার বাড়ির সিংহদুয়ারে। নায়েব মশাই এর অফিসে তখন তালা ঝুলছে। 

পরদিন সকালে আমরা চার বন্ধু মিলে চললাম গড় পাড়ায়,   ইংরেজি মাস্টার মশাই তারা বাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।  সেখানে গিয়ে মাস্টারমশাই  এর  খোঁজ করতেই  পাশের বাড়ির এক মহিলা  নিচুস্বরে  বললেন,  " তারা মাস্টার কাল রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে মারা গেছেন।




রাজার পাখী

চিত্রা পাল

   গোপালের বাড়িতে ওর ছোট মামা এসেছে। ওর মা খুব খুশী ভাই এসেছে বলে।মায়ের সঙ্গে বাবাও। আর গোপালতো দ্বিগুণ খূশি, একতো মামা এসেছে বলে, দ্বিতীয়তঃ মামার কাছে গল্প শুনতে পাবে বলে। কারণ মামা খুব ভালো গল্প বলে। সন্ধ্যে বেলায় ওরা বসেছে গল্প শুনতে,গোপালের সঙ্গে ওর আরও তিন বন্ধুও আছে। গোপালের ছোটমামা বলে, আজ তাহলে একটা পাখির গল্প বলি, কেমন? গোপাল বলে, কি পাখি ছোটোমামা? ছোটমামা বললেন, এই পাখিটা একটা টিয়া পাখি। বলে মামা শুরু করলেন।

  অনেকদিন আগে আমি তখন ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ি, তখন আমার এক বন্ধু ছিলো ওর নাম রাজা। ও নামেও রাজা কামেও রাজা। গোপাল বলে, মানে? মামা বললেন, মানে ও যা বলবে তাই করবে। তো ওর একবার ইচ্ছে হলো পাখি পুষবে। ওর বাবাও ওর কথা শুনতো।মানে ফেলতো না। ওর মা তো শুনে থেকে বলছে, না,না ওসব পাখি টাখি পোষা হবে না। তাকে সময়মতো খেতে দাওরে, চান করাও রে,আবার বেড়াল ওকে কামড়ে না দেয় সেও দেখতে হবে। রাজা বলে, ওতো খাঁচায় থাকবে। ওর মা বললো,হ্যাঁ, সেও আর এক কাজ। আরে, খাঁচার তলার নোংরা  পরিষ্কার করতে হবে। রাজা বলে ওকে বেশ দাঁড়ে রাখবো। ও সবাইকে দেখতে পাবে, আর আমরাও ওকে দেখতে পাবো।  ওর মা বলে, না, না ওসবে কাজ নেই ছেড়ে দে।  রাজা বলে, যখন কথাবলবে, তখন কিভালো  লাগবে, কি লাগবে না? এই সব ছেড়ে তুমি লেখা পড়ায় মন দাও। বলে ওর মা চলে গেলো। রাজার বাবা মৃদু হেসে কাজে চলে গেলেন।  

  পরেরদিন বিকেলে উনি যখন কাজ থেকে ফিরলেন, তখন ওনার সঙ্গে এলো ওনার অফিসের বেয়ারা ,সঙ্গে একখানা খাঁচা সমেত টিয়া পাখি। এটা নাকি কথা বলা টিয়া পাখি। রাজার মা তোমরা যা পারো করোগে বলে সেখান থেকে রাগ করে চলে গেলেন, রাজা পড়লো ওই পাখিটা কে নিয়ে। রাজা রোজ নিয়ম করে ওকে জল দেয়, খাবার দেয়,কখনো ছোলা ভিজোনো, কখনো পেয়ারা, কখনও পাকা লংকা এসব। রাজার মাও এখন রাজার সঙ্গে ওকে দেখভাল করে। রাজা ওকে কথা বলা শেখায়, শিষ দেওয়া শেখায়। কিন্তু ওদের কাজের মাসিকে দেখলে কেন জানি  ও খুব ক্যাচ ক্যাচ করে, মানে বেশ বোঝাই যায় যে ওকে ও পছন্দ করে না। একদিন রাজা লক্ষ্য করলো, মাসী ওকে ঝ্যাঁটা দেখায়, বকাবকি করে, কেননা এখন ওই খাঁচার তলাটা পরিষ্কার করতে হয় তাই। আর পাখিটাও ওই রকম চেঁচামেচি করে। ও বলা হয়নি, রাজা পাখিটার নাম রেখেছে মণি। আসলে রাজার পাখি বলে ওর নাম রাখা হয়েছিলো মন্ত্রী। এখন  সেটা ছোট হয়ে মণি।

মণি  এখন বেশ বড় হয়েছে। ওর জন্যে এখন দাঁড়ের ব্যবস্থা হয়েছে। খায়দায় আর রাজা যখন শিষ দেয়, তখন ও ও শিষ দেয়, কিন্তু কথা এখনও বলেনি। ও যখন দাঁড়ে বসে ওর ঠোঁট চুলকোয় তখন ওর পায়ের শেকলের সঙ্গে দাঁড় লেগে কেমন ঝুমঝুম করে শব্দ হয়। সব ঠিক আছে, কিন্তু রাজার মা থেকে থেকেই বলেন,’ও কথা বলবে না ছাই, ওকে শিগগির বিদেয়  কর’। শুধু রাজা ওকে প্রায় জোর করেই রেখে দিয়েছে।  

 একদিন কটা হবে কে জানে,বেশ গভীর রাত। হঠাত্‌ মণি বলে উঠলো, রাজা নাকি, রাজা নাকি? ওর মা যেমন করে বলে তেমন। রাজার মা মণির কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। এই প্রথম ওর কথা শুনছে বলে।   ঘুম থেকে উঠে দ্যাখে, কে একটা লোক মণিকে ধরেছে নিয়ে যাবার জন্যে। আর মণি যাবে না, ছটফট করছে না যাবার জন্যে। তারপরে দিয়েছে বেদম জোরে এক কামড়। যাতে ওর হাত কেটে রক্ত পড়ছে টপটপ করে। রাজার মা চোর চোর করে খুব চেঁচামেচি করাতে লোকটা মণিকে ফেলে পালালো। বাড়ি শুদ্ধু লোক  যখন উঠে এলো চোর ধরবার জন্যে তখন চোর বাবাজী পগার পার।

 আজ থানায় ঢুকতেই থানার ওসি রাজাকে একটা ফুলের তোড়া আর চকোলেট দিয়ে সংবর্ধনা জানালেন। কারণ রাজার জন্যেই ওখানকার ভয়ানক দুষ্টু লোক রাম ডাকাতকে পুলিশ ধরতে পেরেছে। তাই এই  আপ্যায়ন। রাজা তখনও বুঝতে পারছে না, ওর জন্যে কি করে রাম ডাকাতকে ধরা গেলো। তখন ওসি স্যর বললেন ঘটনাটা। রাজাদের বাড়িতে চোর এসেছিলো বলে রাজার বাবা থানায় ডায়েরি করে, বা অভিযোগ জানায়। সেইজন্যে রাজাদের বাড়িতে পুলিশ আসে অনুসন্ধান করতে আর ওখানে খাঁচার চারপাশে যেসব রক্ত পড়েছিল তার কিছু নমুনা নিয়ে যায়। সেই রক্তর ডিএন এ  একজনের রক্তের ডিএন এর সাথে মিলে যায়।সে ছিলো রাম ডাকাতের দলের। আর চুরি করার জন্যে সে রাতে সেই এসেছিলো।  তাকে গ্রেপ্তার করে জেরা করে  দুর্ধষ রাম ডাকাত আর তার দলবলকে পুলিশ সহজেই ধরে ফেলতে পারে।  এতে এই  থানার ওসির সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।এদিকে তিনি মনে করেন তিনি এই দুরূহ কর্ম রাজার জন্যেই সমাধা করতে পেরেছেন। তাই  রাজাকে এই উপহার।এই প্রাপ্তিতে রাজার মা বাবা খুব খুশি। রাজা বাড়িতে গিয়ে আগে মণির খাবারের  বাটিতে চকোলেট দেয়, মণি তুই খুব ভাল কাজ  করেছিস্‌রে। ওই জন্যেই বলি,কথা বলা শেখ, তাহলে কেমন নিজেই বলতে পারতিস্‌।

ছোটমামা বলে, দেখলিতো পাখিটা কেমন কাজ করে দেখালো? আসলে রাজার পাখি বলে কথা। গোপাল বললো, আমাকে রকম একটা পাখি কিনে দেবে? ছোটমামা এবার কি করবে চিন্তায় পড়ে গেলো।        

          

                                                      


No comments:

Post a Comment