প্রবন্ধ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভাবনা
বিনয় বর্মন
ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর প্রথম ঘোষণা করেছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভাবনা l সে হিসাবে এ বছরে তার ২৪ তম বর্ষ উদযাপন হচ্ছে l এবারের থিম : Multilingual education - a necessity to transform education .
রাষ্ট্র সংঘ ২০০৮ সালকে ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অফ ল্যাঙ্গুয়েজ বলে ঘোষণা করে l
ভাষা শুধু আমাদের প্রকাশের মাধ্যম নয় , আমাদের আত্মপরিচয়ও l সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৭ হাজার ভাষার অস্তিত্ব আছে l কিন্তু প্রধান কিছু ভাষা বাদে বাকি বেশিরভাগ ভাষার অস্তিত্বই আজ সংকটের মুখে l কোন একটি ভাষা বহন করে যুগ যুগান্তর থেকে লালিত একটি জনগোষ্ঠীর জ্ঞান , মেধা ও সংস্কৃতির l একটি ভাষা গোষ্ঠীর ভাষার মধ্যে লুকিয়ে থাকে লোক-বিজ্ঞান লোক-ঔষধি ও কৃষিকর্ম ও তাদের কারু শিল্প ও চারু শিল্পের জ্ঞান l একটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে, সেই ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত যুগ বাহিত জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিলুপ্তি l
ভাষার বিলুপ্তি ঘটে মূলত সেই ভাষায় বাচকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় l কমতে কমতে কোন ভাষায় যখন বাচকের সংখ্যা শূন্য হয়ে যায় তখন তার অবলুপ্তি ঘটে l
কম সংখ্যক বাচক যুক্ত জনগোষ্ঠীর ভাষা গুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে l এর জন্য নানাবিধ অর্থনৈতিক , সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ যুক্ত l তথাকথিত উন্নত বা বৃহত্তর সংস্কৃতির আগ্রাসনে ক্ষুদ্র সংস্কৃতি যেমন হারিয়ে যাচ্ছে , তেমনি বৃহৎ সংখ্যক বাচক যুক্ত ভাষা গোষ্ঠীর আগ্রসনে স্বল্প সংখ্যক বাচক যুক্ত ভাষা গোষ্ঠীর ভাষা গুলো হারিয়ে যাচ্ছে l আমাদের জীবন যাপন সমাজ ব্যবস্থা যেমন রাজনীতিই নির্ধারণ করে , তেমনি কোন ভাষার ভবিষ্যৎ ও বহুলাংশে নির্ধারিত হয় রাজনীতির দ্বারা l রাজনৈতিক শক্তিশালী ভাষাগোষ্ঠীর দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে কত ভাষা l ভারতবর্ষে প্রায় ১৯ হাজার ৫৬৯ টি ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে l তার মধ্যে বেশির ভাগই প্রায় অবলুপ্তির দোরগোড়ায় l আমাদের এই উত্তরবঙ্গেও একসময় দেড়শ'রও বেশি ভাষা প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বেশিরভাগই বিলুপ্তির দোরগোড়ায় l এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে।
উত্তরবঙ্গের মুন্ডারী , আশুরী শবর , কুর ুক , মালপাহাড়ি , কয়া , রাউতিয়া , থারু , ধিমাল টোটো , তামাং , প্রভৃতি ভাষাগুলো আজ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে l
উত্তরবঙ্গের যে সমস্ত জনজাতিরা তাদের পরম্পরাগত ভাষায় কথা বলতেন আজ তাদের বেশিরভাগই বাংলা , হিন্দি , সাদরি , কিংবা নেপালিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন l
বিশ্বজুড়ে ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের দাবি উঠছে l তবে এ বিষয়টি সহজ নয় l রাজনীতি ও সংস্কৃতির আগ্রাসন রুখে দেওয়া সহজ কাজ নয়।
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে দেখা গেছে আমাদের ভাষা বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্রে চারটি স্তর বিদ্যমান। সর্বোচ্চ স্তরে আছে ইংরেজি l উপনিবেশিক ঘোর (colonial hangover ) আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে না পারায় আমাদের প্রশাসনে কাজের ভাষা মূলত ইংরেজি রয়ে গেছে। পরবর্তীকালে শাসক গোষ্ঠীর হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান এই জাতীয়তাবাদী মনোভাব নেওয়ায় পরবর্তী স্তরের ভাষা হিসেবে হিন্দির আগ্রাসান সর্বব্যাপী l দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে এই হিন্দি l তৃতীয় স্তরে রয়েছে আঞ্চলিক ভাষাগুলো l যারা তাদের এলাকায় থাকা ছোট ছোট জনজাতির ভাষা গুলোকে গ্রাস করে ফেলছে l
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মানে শুধুমাত্র বাংলা ভাষার অধিকার ও বিকাশের দাবিতে সোচ্চার হওয়া নয়। প্রতিটি জনজাতির প্রতিটি ভাষা গোষ্ঠীর মানুষের ভাষার সুরক্ষা ও বিকাশ যেন নিশ্চিত হয় সে বিষয়ে সরব হওয়া।
দুর্ভাগ্যের বিষয় আর পাঁচটা বিষয়ের মত ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশও রাজনীতি শিকার l এই যে নানান ভাষার একাডেমি গড়া হচ্ছে , তা মূলত ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তোষণের ভাবনা থেকে l কোন ভাষার প্রকৃত উন্নয়ন ঘটাতে গেলে তাকে জীবনযাপনের সম্পৃক্ত করতে হবে l না হলে তা কেবলমাত্র প্রসাধনী উন্নয়ন (cosmetic change) হিসেবেই থেকে যাবে l যে ভাষা উচ্চশিক্ষা , গবেষণা , প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজের ব্যবহার , কিংবা কর্মসংস্থানের জায়গায় ব্যবহৃত হবে না , তা কি করে টিকে থাকবে এই প্রবল পূঁজি নিয়ন্ত্রিত বাজারে ?
ভাষার সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধি ঘটাতে গেলে তাকে হতে হবে "ফাংশনাল" l যে ভাষা পেটের ভাত যোগাতে পারবে না , এই প্রতিযোগিতা মূলক সমাজ ব্যবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মেই তা হারিয়ে যাবে জীবন থেকে l
অথচ একটি প্রায় মৃত ভাষাকেও কি করে বিকাশের চরম স্তরে নিয়ে যাওয়া যায় তার উদাহরণ আছে আমাদের সামনে l ইজরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর প্রায় মৃত হিব্রু ভাষাকে রাতারাতি রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করা হলো l সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে শিক্ষার মাধ্যম উচ্চশিক্ষার ও গবেষণার উপযোগী করে তুলেছিলেন।
এবারের আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মূল ভাবনা : মাল্টিলিঙ্গুয়াল এডুকেশন বা বহুভাষিক শিক্ষা l এই বিষয়ে ভাবনার অবকাশ আছে l বিশেষত আমাদের দেশে l আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এলিমেন্টারিস্তরে ত্রি ভাষা সূত্র অনুযায়ী পাঠদান করা হচ্ছে l আঞ্চলিক ভাষা ( ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ) , ইংরেজি ( সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ ) ছাড়া তৃতীয় ভাষা হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংস্কৃত অথবা হিন্দি শেখানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে তৃতীয় ভাষা ( থার্ড ল্যাংগুয়েজ ) হিসেবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাগুলোকে রাখা প্রয়োজন l তাহলে অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও ভাষাগুলোর সজীবতা বজায় থাকবে l
তথ্যসূত্র :
১ ) জনজাতিদের ভাষা .... প্রকাশক : মাতৃভাষা
২ ) আলিপুরদুয়ার জলপাইগুড়ির ভাষা পরিস্থিতি / অর্ণব সেন , (ইতিকথায় আলিপুরদুয়ার , প্রমথ নাথ সম্পাদিত )
৩ ) Wikipedia
৪ ) ইন্টারনেট
No comments:
Post a Comment