সম্পাদকের কথা
বিশ্ব উষ্ণায়ন যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার উদাহরণ এই বছরের শীত। আসি আসি করে সময়ের বেশ কিছুটা পরে এসে, দ্রুত বিদায় নিল সে। এই রাজ্যের উত্তর দক্ষিণের চাইতে বরাবরই শীতের আনুকূল্য বেশি পায়। কিন্তু এবার উত্তরেও সেভাবে জাঁকিয়ে শীত পড়েছে মাত্র কয়েকদিন। অবশ্য কোনও কোনও দিন তাপমাত্রা যথেষ্ট নেমেছে। সে বিষয়ে দ্বিধা নেই। কিন্তু শীতের স্থায়িত্ব সত্যি বলতে অনেক কমে গেছে এবার। আবহাওয়ার এই খামখেয়ালিপনায় অসুস্থতা বাড়ছে সর্বত্র। বোঝা যাচ্ছে আমাদের, মানুষে, অদূরদর্শিতা ও প্রকৃতির ওপর অত্যাচার এই অবস্থার জন্য অনেকাংশেই দায়ী। এভাবে চললে হয়ত সারা বছর গ্রীষ্ম ছাড়া আর কোনও ঋতু থাকবে না। শেষের শুরুকে যদি এখুনি রোধ না করা যায়, তবে দ্রুত সবকিছু ওলোটপালোট হবে সে কথা বলা বাহুল্য!
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৯
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রচ্ছদ ছবি- অসমের মানস নদী / শৌভিক রায়
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৯
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
রামাশিস চৌধুরী, মাথুর দাস, বেলা দে, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, সপ্তাশ্ব ভৌমিক,
আশীষ কুমার বিশ্বাস, উৎপলেন্দু পাল, অলকানন্দা দে, দেবর্ষি সরকার,
কুমার বিজয়, সাম্রাজ্ঞী রায়, বটু কৃষ্ণ হালদার, দেবদত্তা লাহিড়ী,
রীনা মজুমদার, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, আতিক এ রহিম, জনা বন্দোপাধ্যায়,
বিনয় বর্মন, সৈকত দাম, রূপক রায়, সারণ ভাদুড়ী, সঞ্জয় সাহা,
সুনন্দ মন্ডল, লীনা রায়, মজনু মিয়া,
বাবুল মল্লিক, আকাশলীনা ঢোল
আলোচনা
সবুজ হৃদয়ের আশাই যে কবিতার জন্ম দেয়: মাটির দেওয়ালের কবিদেবর্ষি সরকার
কবিরা নিতান্তই কবিতা লিখে চলেন না। তারা সৃষ্টি করে চলেন প্রতিনিয়ত বহু নব নব ইতিহাসের। যে ইতিহাস স্থান পায় না পাঠ্য বইয়ের কোন এক পৃষ্ঠায়, যে ইতিহাস স্থান পায় না নামজাদা কোন এক পরীক্ষার সিলেবাসে,সেই ইতিহাসোই তারা বহন করে চলেন। যদি বলা হয় কবিরা ঈশ্বর প্রদত্ত তবুও কম বিশেষনেই বিশেষিত করা হবে। কারণ ধর্মমতে ঈশ্বর আমাদের এই সৃষ্টি করেছিলেন তা কোন এক যুগের কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে। তারপর এই সৃষ্টির উপর দিয়ে বারিধারার মতো বয়ে গেছে বহু যুগ, বহু ক্ষন ও বহু সময়। কালের মুখ দ্বারা সময় যত গ্ৰাস হয়েছে তা অবসান ঘটিয়েছে এক একটি যুগের। যুগ যত এগিয়েছে তা সৃষ্টি করেছে প্রত্যেক ইতিহাসের। সেই যুগ এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত কিন্তু যুগের ইতিহাস আজোও অমলিন আছে ঠিক সূর্যের মতো, পূর্ণিমার চন্দ্রের মত, তারার মত ও সর্বোপরি সাহিত্যের মত। যুগে যুগে বহু লেখক জন্মেছেন, তারা আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন তাদের রচনাশৈলীর দ্বারা। আমাদের যুগিয়েছেন নতুন করে বাঁচবার রসদ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যতিক্রমীও হয়েছেন বটে। সেই ব্যতিক্রমী মানুষটিই আমাদের চিনিয়েছেন এই সবুজ গন্ধমাখা বসুন্ধরার আরেক রুপকে। যে রূপ চোখে পড়ে না ডাগর, ডাগর চোখ বিশিষ্ট কোন জনৈক্য ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলার। তাদের প্রকৃতপক্ষেই অন্ধ বলা চলে। তারা এই সৃষ্টির কড়িকাঠ হতে বঞ্চিত হয়ে কোন এক স্বপ্নপুরী তেই বিচরণ করছে অনিয়মিত।
আগেই বলেছি ইতিহাস সৃষ্টি হয় কালের ইচ্ছামত, কালের নিয়মে বাধা পরিসরে। সে কালেই বহু কবি এসেছেন তাদের মধ্যে জয়, শঙ্খ ,জীবনানন্দ এদের ছাড়িয়ে এক সম্পূর্ণ আলাদা ঘরানার লেখক ছিলেন কবি অমিও চক্রবর্তী। হয়তো নামটি অনেকে শুনে নাও থাকতে পারেন তবে জন্ম ভিটের মাটির প্রত্যেকটি রেনু যেমন আমাদের কাছে সাত রাজার ধনের সমান তেমনি কবির কবিতা আমাদের কাছে মহামূল্যবান সম্পদ। আজ আলোচনা করব কবি অমিয় চক্রবর্তীর চিরহরিৎ কাব্যময়তা নিয়ে যা ঝরে পড়েছে অনবরত তার সবুজ হৃদয়ের কোষ থেকে এই বাংলায়।
কবি অমিও চক্রবর্তী ছিলেন নিত্যান্তই একজন ঘাসফুলের কবি। তার কবিতার জগতে তিনি সম্পূর্ণ এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিষ্ঠা করলেও সে রাজ্যের রাজা ছিলেন তিনি। যামিনী রায় বলে গেছেন,"ছবি এঁকে চলি ,যদিও তা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তাও সে ছবি।"এই বেদ বাক্যটি হয়তো ১০০ শতাংশ খানি প্রযোজ্য হয় অমিও চক্রবর্তীর জীবনে। তিনি তৈরি করে গিয়েছিলেন ইট ,কাঠ, পাথর ঘেরা গৃহ নয়, সবুজ শ্যামলতায় মোরা এক বসতবাড়ি। যেখানে গ্রীষ্মে পানকৌড়ি ডাকে, বর্ষায় মালতিলতা দোলে, শরতে বউকথা কও হাকে, হেমন্তে উদাসী হাওয়া বয়ে চলে সুদূর দিগন্তে, শীতে আমলকি পাতা চরচর শব্দ করে, বসন্তের হলদে পলাশ ঝাঁক ধরে ফুটে থাকে। সে বাড়ি সুরকির তৈরি বাড়ির থেকেও বেশি শক্ত খানিকটা বেশি পোক্ত।
"বাড়ি ফিরেছি।
জারুলের বেড়া ,কাঁকর পথ থামবে দরজায়;" (ঘর)
তিনি ছুটে বেরিয়েছেন প্রচুর শ্বাপদসংকুল গহীন অরণ্য ঘেরা পথ ভেদ করে। সেই সময় তার বাহন ছিল একমাত্র তার সবুজ হৃদয়। যে হৃদয় সাক্ষী আছে বউ কথা কও এর ডাকের, যা সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে হলুদ পলাশের গন্ধের। তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন কেবল তার মনের ইচ্ছার বশীভূত হয়ে। এ সবুজ সংসার তার জন্য আঁচল পেতে বসেছিল যা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বহুকাল আগেই। তাই হয়তো আজ এই বিংশ শতকে এসে রবীন্দ্রনাথের গানের সেই পংক্তিটি মিলে যায় এক অভূতপূর্বভাবে।
"আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ"
কোথায় যেন গঙ্গা যমুনা সরস্বতীর মতো মিলে গেছে নব্য নব্য ধারার দার্শনিক চেতন। তিনি সবুজের পায়েই উৎসর্গ করেছেন তার জীবনের সকল সুখ, সকল দুঃখ,সকল অভাব,সকল অনটন,সকল পাওয়া ও সকল না পাওয়ার যাবতীয় বেদনা।তাই তিনি দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন মরু বিজয়ের কেতনের শুদ্ধতম মন্ত্র,
"আমার পৃথিবী
এইখানে শেষ।
অনেক দেশ
চোখের তৃষ্ণায় ঘিরেছি।" (ঘর)
কিম্বা,
"স্বর্গীয় যুগল, তারি পিছে পিছে মর্ত নর নারী
সংসার পেরিয়ে যাই,দান্তে আর তোমার নির্দেশে
চিরজ্বল হৃদয়ের পূর্ণ স্বাদ মন্দিরে দাড়াই মৃত্যুহীন।" (মিলনসাগর)
কিম্বা,
"গাছ চাই ,গাছ হবে ছায়া দেবে বাড়িতে বাগানে
শহরে শিল্পের সৌধে প্রাণ জাগে প্রাণে।" (মাটি)
কিম্বা,
"বীজ আনি, জল আনি ভাগ্যজয়ী খেলা তারও বেশি....
অচিন্ত্য বিস্ময় খুলে যাই
কিছু হয়,হয় না বা,এরি মাটি চাষি এসো ভাই।" (মাটি)
কবি অমিও চক্রবর্তীর জীবনে প্রেম এসেছিল তা সত্যি। তবে সে প্রেম আকড় মিলন গাথা প্রেম নয়। জাহাজে করে,স্টিমারে করে,নৌকায় করে,বাসে বসে বা দাঁড়িয়ে যাতায়াতের সময় প্রকৃতির প্রেম। তিনি ভালোবেসেছিলেন মাথার উপরকার অন্তহীন সমুদ্র কে।যাকে পূর্নিমা রাতে চাঁদ ভরিয়ে দেয় তার সাদা আলোয়। সূর্য ফেটে পরে তার উজ্জল আলোকছটা নিয়ে, ঠিক সেইরকম অদ্ভুত এক সমুদ্র,আকাশসাগর।
অত্নসলীলা, দিগন্তচুম্বনরত এক মানবীয় তরুণী সে তো ঘরের মেয়েই বটে। সে ঘুম থেকে উঠে কোন সাত সকালে, ঘরের বাসি কাজ সেরে সেও সূচি শুদ্ধ হয়ে ঠাকুর পূজোর ফুল তোলে। তারপর রান্না চাপিয়ে ছেলে,বর সবাইকে কাজে পাঠিয়ে খানিকটা বিশ্রাম সেও করে। এখানেই শত ভালবাসায় দূরের বন্ধুটিও আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে ওঠে আমাদের অজান্তেই। সেই নীলকেই আমরণ ভালোবাসার সম্পদে পরিণত করতে চেয়েছে কবি।
"নীল! নীল!
সবুজের ছোঁয়া কিনা,তা বুঝি না,
ফিকে গাঢ় হরেক রকম
কম - বেশি নীল!
তার মাঝে শূন্যের আনমন হাসির সামিল
কটা গাঙ্গচিল।" (সাগর থেকে ফেরা)
কিম্বা,
"জল ছাড়া জল আর
শেষ তারা হাওয়া নিয়ে থাকা
সময়ের নীলে শুধু
উদ্দাম অবিরাম আলপনা আঁকা।" (সাগর থেকে ফেরা)
এবার আসি অমিও চক্রবর্তী এর প্রাকৃতিক কবিতাগুলির মধ্যে কিছু তাত্বিক দৃষ্টি ভঙ্গির বিশ্লেষণে। তিনি যে নিটল সবুজকে ভালোবেসে, তাকে আঁকড়ে ধরে সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন তা মোটেও নয়। তিনি একাধারে যেযন গ্রহণ করেছেন প্রকৃতির সহজবোধ্য রূপকে, তেমনি তাকে হাত পাকাতেও দেখা গেছে জীবনে আদর্শবাদের ক্ষয় হয়ে যাওয়া পানপাত্র কে পুনরায় ভরসা নামক সুধারসে পরিপূর্ণ করতে। হোক না সে ব্যতিক্রম, তা হোক কোন পুঁথি বাধা শিক্ষার গন্ডি ছাড়িয়ে দূরের এক ঠিকানা বাসি মানুষ তাও তো সেটা ধর্মই বা আদর্শ তাকেই তিনি গ্রহণ করেছেন সাদরে।
আসলে বলতে গেলে অমিয় চক্রবর্তী শরীরের শিরদারার মত কেবল চিরহরিৎ প্রকৃতিকে বাড়িয়েছেন তার কবিতার শিরদাঁড়া। এই বিশ্ব চরাচরে ব্যক্ত পদার্থ হল প্রকৃতি। সেই প্রকৃতির সদর্থক ও নঞর্থক গুনকেই তিনি স্বীকার করেছেন, তা প্রত্যক্ষ করেছেন প্রাণভরে। তিনি প্রত্যক্ষ করেছে যে এই চিত্ররুপময় প্রকৃতির মাঝেও আছে কঠিন পরিস্থিতিকে সামলে তোলবার আশা। একটি গাছের পাতা যখন ঝরে পড়ে তার পত্র শুন্য ডালগুলোও একটি আশায় থাকে, পুনরায় সজীবতা পাওয়ার আশা। কোন ধূলি ধূসর প্রান্তর সেই আশাকেই সঙ্গি করে আবার বুক বাঁধে তার বুকে সবুজের ধ্বনি শুনতে পাওয়ার কিংবা সেই ঘাস ফুলটি যে এক সময় গ্লানি, হিংসা, হানাহানি, কাটাকাটি ও মারামারি প্রভৃতিকে তুচ্ছ করে মাথা তুলে বেচে থাকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যে প্রতিজ্ঞা নেয় আলো বাতাস ঝড় সবকিছুকে সহজে বশীকরণ করে বেঁচে থাকবার সেও যখন মাথা নত করে প্রকৃতির পায়ে সে হয়তো সেই মুহূর্তে ক্ষয় পেয়ে যায়,তার হৃদয়ের ইচ্ছে গুলো হয়তো ধূসরতা পায় কিন্তু থেকে যায় সবুজের দূত সেই বৃন্তটি, যা পুনরায় ডানা মেলে বাঁচবার আশা, তার মধ্যে আছে এক আশা, যাকে কবি ভাষা দিয়েছেন তার যুগশ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোতে।
আগেই বলেছি অমিও চক্রবর্তীর কবিতা কেবল প্রকৃতির সাছেঢালা ভালবাসা নয়। তা কেবল ঝর ঝর বাতস, কুলকুল নদীর জলের সাহিত্য নয়। তিনি সুন্দরকে দেখেছেন সর্বদা এক অন্য চোখে, উপলব্ধি করেছেন সুন্দরকে এক আলাদা অনুভূতিতে। তাকে প্রকৃত সুন্দরের পূজারীও বলা চলে। এই তালমাটাল দিনগুলোতেও সুন্দর খেয়ে আঁকড়ে ছিলেন তিনি,তাই তার বৈশিষ্ট্য। তেমনি একটি বার্তা লিখেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী।
"মেলালেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর পোরো বাড়িটার ওই ভাঙ্গা দরজাটা
মেলালেন।" (সংগতি)
আসলে কবি এখানে এক বৈচিত্র্যময় দৃষ্টিকেই একসূত্রে সঙ্গতি সাধনের চেষ্টা করে গেছেন। তার একদিকে আছে যেমন তীব্র হতাশার পোরো বাড়িটা তেমনি আরেক দিকে আছে প্রবল উদ্দীপনার উদাহরণ স্বরূপ সে ঝোড়ো হাওয়া। এইসব কথার মূল্যেই আছে একটি আদর্শ ,আশার আদর্শ।
প্রত্যেক কবিরই যে জীবনের প্রকৃত ঘটনাই কাল্পনিকের মোড়কে মুরে ধরা দেয় পাঠকের কাছে সেই বিষয়ে অস্বীকার করবার জো নেই। ঠিক তেমনি সারাটা জীবন আশায় বুক বেঁধে থাকার সাহিত্যেই সৃষ্টি করে গেছেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। প্রকৃতির চিরহরিৎ রূপ, প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকা মানুষ, মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা সমাজ, সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠার রাষ্ট্র-রাজ্য সব কিছুই সিনেমার দৃশ্যের মতো একের পর এক ধারা দিয়েছে তার কবিতায় আজীবন।
পরিশেষে এটাই বলা যায়, কবি অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা তার ভাব ,তার আদর্শ ও তার কথামালা সবটাই পেঁয়াজের শল্কপত্রের মত, কেবল ছাড়িয়ে ভেতরটা দর্শনের ইচ্ছেই জাগে মনে, থামতে নয়।
বুদ্ধদেবের গল্পরা
অলকানন্দা দে
দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে তাঁর(বুদ্ধদেব গুহ)গল্পের পার্বণে মেতে আছি। একটি শেষ করলে অন্যটি মন টেনে নিচ্ছে তার অন্দরে। সেই অন্দরে প্রবেশ করলে নিরূপণ করতে পারছি না কোনটি সুসজ্জিত বেশি। তাঁর হাতে গড়া প্রকৃতিকে যখন পাঠ করছি, চোখের বিপরীতে ভেসে উঠছে সেই রঙ্গিলা পৃথিবী সেই বন্যফুল সেই লাল পাহাড় স্নিগ্ধ ঘাস বিছানো আকাশ আর তার উপরে সূর্যের হাসি! আছে মানুষের গল্প, জীবনপণ প্রেমের উপাখ্যান! আছে মনের মতো প্রেমচরিত্র, অবিশ্বাসীর পেশীবিক্রম, পাহাড় আইন, জঙ্গলের নাড়ী-নক্ষত্র এবং পরিস্থিতি প্রতিকূলে হলেও জীবনলোভে কিভাবে মানুষ বাঁচে সেই দুঃখ শিশির ঝরার গল্প। সহজিয়া সংস্কৃতি মাথায় করে কিভাবে গ্লানি ভোলা যায় তার কথাও জলের মতো সহজ করে বলা আছে, শুধু চোখ বিছানোর অপেক্ষা। দেশ বিদেশের প্রাকৃত বিজ্ঞান তাঁর নখদর্পণে। মুগ্ধ হচ্ছি বললে কিছুই বলা হয় না। আরও জোরালো ধারালো শব্দ চাই এই অনুভূতি প্রকাশের! আখররা ডুবে আছে জ্ঞানসমুদ্রে! মন্থন তরে তুলে আনতে হবে সেই অনুভবের ঘড়া, এটাই মনে হয় পাঠকের কাজ। সব ভালোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগছে তাঁর নিসর্গ দর্শন ও তাকে বর্ণনার পাণ্ডিত্য। স্বপ্নের বিশ্বকে ঘুরে দেখায় যেন হাত ধরে! তাঁর প্রেমের উদার আরতি তো নিয়ে যায় ভাবের অতলান্তে! কথার আলপনা দুহাতে ছড়ায় কোজাগরী আলো! পড়লাম পর্ণমোচী, সুখের কাছে, পরদেশিয়া, কোজাগর, ধূলোবালি, সাঁঝবেলাতে এবং বুদ্ধদেব গুহর প্রেমের গল্প।
আরও অনেক পড়া আছে বাকি। কাজের শেষের অবসর যখন বই হাতে আমন্ত্রণ করে তখন সব ভুলে যাওয়ার পালা! গল্প দিয়ে সাজানো সময় কৌতূহলে ঘেরা! পৃষ্ঠার ওপারে পৃষ্ঠার অভিযানে কি পাব সেই উত্তেজনায় সময় ছোটে খরশর স্রোতে। হাতে নিয়ে বই পড়া অনেক ক্লান্তকালকে উদ্ধার করে পরম যত্নে। চরিত্রদের সাথে বসবাস একাকীত্ব তাড়ায়। তাই বই পড়া এইযুগে আরও বেশি করে মনের টনিক। ই-বুক নয়, পৃষ্ঠার বই। যার গায়ে জড়ানো থাকে একটি অমর সৃষ্টির গন্ধ!
বর্তমান
টিয়া পাখিটার নাম মিঠু
আশীষ কুমার বিশ্বাস
আজ থেকে বছর পাঁচ আগের কথা বলছি , তখন আমার কাছে শনি বার , রবিবার বেশ আনন্দের । অফিস ছুটি মানে স্কুল জীবনের সেই শনি বার , রবিবার ।তবে স্কুল জীবনে ছুটির দিন গুলো খেলা-ধুলার মধ্যেই সময় কাটতো , আর এখন অর্থাৎ চাকরি জীবনে সময় কাটে বারান্দায় পায়চারী করে , রোজকার পেপার ,আর পুরানো পেপার পড়ে ।
আরো একটু বলি ,সেটা হলো নতুন পুরানো মিলে পেপারের কিছু অংশ কাঁচি দিয়ে কেটে জমা করা ।
তখন সকাল নটা হবে বোধহয় ,সবে পেপার নিয়ে পড়তে বসেছি । এমন সময় এক ভদ্রলোক সাইকেল থেকে নামলো আমার বাড়ির কাছে , নেমে এদিক ওদিক গাছের দিকে তাকাতে লাগলো , আমিও বারান্দা থেকে নেমে পড়লাম , এগিয়ে এলাম লোকটার ধারে । পরনে লুঙ্গি আর গায়ে গেঞ্জি সাটা , আগোছালো ভাবে বড়ো বড়ো দাড়ি ।
লোকটা ততক্ষনে মুখে নানান রকম সিস দিতে লাগলো , আবার মুখে " আয় , মিঠু আয় - - - মিঠু আয় - - - রাগ করিস না , আর এ রকম হবে না , ইত্যাদি ।"
আমি বললাম - কি হয়েছে , দাদা ?
প্রত্যুত্তরে ,আমার টিয়া পাখি টা উড়ে এসছে , ওর ডাক নাম মিঠু , সকালে বিস্কুট - চা দিতে দেরী হয়েছে , তাই রাগ করে উড়ে এসছে । কতো ডাকছি শুনছেই না ! উড়ে আর যাবি কোথায় ? দুপুরে ছোলা , পেয়ারা খাবি না ! তখন দেখবো, রাগ কোথায় যায়, এরে বলে আফিং এর নেশা !
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না ,দুপুরে খাওয়ার সাথে আফিং-এর কি সম্পর্ক ? আরো একটু খোলসা হওয়ার জন্য আবার জিজ্ঞাসা করলাম ।
এবার একটু থেমে থেমে উত্তর দিলো , বললো-
সকালে মিঠু যে চা-বিস্কুট খায় তাতে এক সর্ষে পরিমান আফিং মেশানো থাকে, ওটাই ওর নেশা, সেই রকম দুপুরেও তাই করি, এই ভাবে ওকে পুষে রাখি । ও খাঁচায় বেশি টাইম থাকে না, বাইরে উঠোনেই ঘুরে বেড়ায়, কখনো আমের ডালে, পেয়ারার ডালে বসে থাকে , ডাকলেই আবার চলে আসে । আফিং-এর নেশা মস্ত বড় নেশা ।
আমি বললাম , এটা তো ঠিক নয় , বনের পাখিকে পোষ মানতে আফিং - - -
কথাটা আর শেষ করতে পারলাম না , আস্তে গুটি গুটি পায়ে সাইকেল নিয়ে হাঁটা দিলো ।
আমরা তো জানি , সেই সুন্ধর কবিতার লাইন -
" বন্যেরা বনে সুন্ধর , শিশুরা মাতৃ ক্রোড়ে "
কিন্তু এ কি ঘটনা , এই রকম কত শত ঘরে এই ভাবে বা আরো কোনো ভয়ানক ভাবে পাখিকে পোষ মানাতে বাধ্য করছে !
প্রতিটি দেশে পাখি কমতে আরম্ব করেছে , পরিবেশ অনুযায়ী তাঁদের পক্ষে অনুকূল অবস্থা নেই ,বছর দু-তিন আগেও সাঁতরাগাছি ঝিলে যে পরিমান হাঁস পাখি আসতো ,ইদানিং সে রকম হাঁস পাখি আর আসছে না । গ্রামে চারিদিকে গাছ কাঁটা পড়ছে , জলাশয় বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে , শহরে ও তাই , ফলের গাছও তেমন ভাবে লাগানো হচ্ছে না । অনেক পাখি আছে , তাঁদের কাছে ফলই প্রধান ।
কিন্তু এ কথাও বলবো, বন উৎসব বা অরণ্য সপ্তাহ এ ছাড়াও অনেক উৎসব কে কেন্দ্র করে চারা গাছ বিলি করা হয় । বলা হয় , বেশি বেশি গাছ লাগান । একটি গাছ, একটি প্রাণ । সচেতনার প্রাধান্যে আমরা আজ বেশির ভাগ লোক জেনে ফেলেছি ।
আমাদের মধ্যমগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি এ বিষয়ে অগ্রণী বলা চলে , নেতাজী সুভাষ ময়দানে সাত দিন ধরে মেলা আয়োজন করে, বিভিন্ন ধরণের গাছ , তার গুনাগুন এবং পরিবেশে তার কি এফেক্ট পড়ে তা যাঁরা পরিবেশ মেলায় ঘুরতে আসে তাঁদের
কাছে তুলে ধরা হয় ।
আসলে বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে গাছ বা বনাঞ্চল এক বিরাট ভূমিকা পালন করে ।
আমার ক্ষুদ্র ধারনায়, এটা বার বার মনে হয় যে জলাশয়, গাছ-গাছালি, এবং প্রকৃতির অনুকূল পরিবেশ পেলে আমাদের পক্ষীকুল ভালো ভাবে বৃদ্ধি পাবে । অনেক পাখি আছে যাঁরা জলাশয় নির্ভর করে বাঁচে। যেমন হাঁস পাখি বা বালি হাঁস, পাতিহাঁস,রাজ হাঁস, মাছ রাঙা , পান কৌড়ি ,কুঁচে বক আরো অনেক রকম জীব।
একটু ভেবে দেখুন , যে পাখি গুলি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বিদেশের বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে আসছে , তাদের যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি , সেটা তো আমাদেরই অক্ষমতা ।
এর মধ্যে উপদ্রপ আছে চোরা শিকারির , বিভিন্ন বড় বড় জলাশয়ে জাল পেতে বা অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করে মারা হচ্ছে সেই সব পাখিদের, যাঁরা প্রতি বৎসর দল বেঁধে সূদুর সাইবেরিয়ার থেকে আমাদের বিভিন্ন জলাশয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ।
পরিশেষে বলি, আমরা আপননারা সবাই মিলে অঙ্গীকারবদ্ধ হই যে , আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টার মাধ্যমে পক্ষীকুল কে রক্ষার চেষ্টা করবো । অমানবিক ভাবে পাখিকে নেশার খাবার খায়িয়ে , অন্যায় ভাবে পাখি শিকার করার হাত থেকে রক্ষা করবো ।
সুতরাং পাখি শুট মোটেই নয় , তবে মোবাইল বা ফটো শুট করা যেতে পারে , তবে ওঁদের বিঘ্ন ঘটিয়ে নয়। মুক্ত বিহঙ্গ মুক্তই থাক।
মুক্তগদ্য
না লেখা চিঠি
সাম্রাজ্ঞী রায়
মন বলছে, মন বলছে। অনেকদিন পর কেন জানি না মন বলছে। মন বলছে, দেখা হবে আজ। মাঘের এই হিমেল হাওয়াও তাই যেন খানিক উষ্ণতার আভা দিয়ে যায় আমার মুখে। মৃদুমন্দ রোদ। তাকেও আজ তাই এত উজ্জ্বল লাগে।
আজ যে বিয়েবাড়িতে আমার আমন্ত্রণ, হয়তো দেখা হবে সেখানে। সর্ব শরীর, সর্ব অঙ্গ আজ তাই ছোঁয়া চায় প্রসাধনের। সেই যে যেরকম সাজে আমাকে দেখতে তুমি ভালবাসতে, অনেকদিন পর আবারও হুবহু সেরকমটাই। লেহেঙ্গায়। গহনায়। কাজলে। গোলাপে। তাকাও যদি একবারও, নাহয় নিছক ভুল করেই, তবুও নিশ্চিৎ জানি যে, আবারও ভুল বুঝবে। ভাববে সুখে আছি, ভাল আছি। সাজের আড়ালে যে ক্ষতবিক্ষত মন, তাকে তো দেখা যায় না। তাই দেখতে পাবে না।
আসলে আমি ভালোবাসাহীন মরুভূমির যাযাবর ছাড়া আর কেই বা হতে পারি! অথচ, একদিন তুমিই আমাকে কাব্যিকা বলতে! নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে। এরকমই এক মাঘ মাসে আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তারপর চলে গিয়েছে কত কত মাঘ! তবু এখনও তোমার জন্য অনন্ত প্রতীক্ষা করি। প্রতীক্ষা, আরও একটা মাঘ মাসের। এজন্মে না হোক পরজন্মে তো আসবেই।
কাব্যিকা
প্রবন্ধ
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসকে আমরা আজও মূল্যায়ন করতে পারিনি
বটু কৃষ্ণ হালদার
বর্তমানে আমাদের সমাজ ব্যাবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল রাজনীতি। রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত "নেতা" শব্দটি। রাজনীতির মধ্য দিয়ে উঠে আসেন প্রকৃত জননেতা।আর জননেতা তিনি হলেন যিনি শুধুমাত্র জনগণের দুঃখ দুর্দশার প্রকৃত বন্ধু। রাজনীতি হল জনসেবার অন্যতম মাধ্যম। সেই রাজনীতি বর্তমানে রাজার নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ভোটে দাঁড়ানোর পর যখন একজন নেতা হয়ে ওঠেন,সেই নেতা জনগণকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। জনগণ অনাহারে নিরাপত্তাহীনতায় থাকলেও,নেতা বিলাসবহুল রাজমহলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে ব্যস্ত। জনগণের করে টাকায় দেশে-বিদেশে ঠান্ডা গাড়িতে সপরিবারে পিকনিক করতে ব্যস্ত থাকেন। এমন নজির এই ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বহু আছে। তবে কি এই ভারতবর্ষের মাটিতে তেমন কোন প্রকৃত জননেতা ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল, তবে তাকে আমরা তেমনভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। তাঁর দেখানো পথের দিশায় আমরা চলতে ভুলে যাচ্ছি। যাঁর আদর্শকে একসময় আমরা হৃদয়ে ধারণ করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পেতাম,
অর্থের লোভে তার আদর্শকে তিল তিল করে বিকিয়ে দিচ্ছি সস্তা দরে।
বহু আগে একটা কথা প্রচলিত ছিল - ইংল্যাণ্ড নাকি ভয় পায় না, অন্যায় করেও নতি স্বীকার করে না, ক্ষমা চায় না ।কিন্তু একমাত্র নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সেই নেতা তিনি অন্ধদের চোখেও আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ইংল্যাণ্ডের গালে কষে চড় দিতে পারলে তবেই সে ভয় পায়,অন্যায়ের ক্ষমা চায়, তার আগে নয়।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন ভারত মায়ের এক অন্যতম বীর ও বিস্ময় কর সন্তান।তাঁকে বোঝা এত সহজ কাজ নয়।ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ দের ভীত নাড়িয়ে দেওয়া মহামানবটির নাম হলো নেতাজি সুভাষ।তিনি যেমন যেমন বিশ্বের দরবারে আজও বিস্ময় কর তেমনি এক নিষ্কলঙ্ক চরিত্র।পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় উকিল ও আইনজীবী।১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কটক মিউনিসিপ্যালিটির প্রথম বেসরকারি সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সরকারী প্লেডার নিযুক্ত হন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সংস্থার সদস্য হন এবং তাঁকে রায় বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে মতানৈক্যকের কারণে তিনি সরকারি উকিল ও পাবলিক প্রসিকিউটর পদে ইস্তফা দেন এবং ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে রায় বাহাদুর উপাধি ত্যাগ করেন।দাদা শরৎ চন্দ্র বসু ছিলেন বিখ্যাত ব্যারিস্টার।এক আর্থিক স্বচ্ছল পরিবারের মধ্য মনি ছিলেন নেতাজি সুভাষ।শুধু তাই নয় ব্রিটিশ সরকারের পদ লেহনকারী সুখ স্বচ্ছন্দ আয়েশ প্রমোদের চাকরি আই.সি.এস হাসতে হাসতে ত্যাগ করেন।নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আই.সি.এস. পরীক্ষায় পাশ করেও সরকারি অধিকারিকের চাকরিতে যোগদান না করায় মনোক্ষুণ্ন পিতা মেজ ছেলে শরৎকে চিঠি লিখলেন:_ "সুভাষের জন্য আমরা গর্বিত, তোমাদের সকলের জন্যই গর্বিত"।
চাইলে তিনি পায়ের উপর পা তুলে সারা জীবন সুখ ভোগ করতে পারতেন,কিন্তু তিনি তান না করে বিদেশ থেকে ফিরে এসেই অর্ত,অসহায়,অত্যাচারিতদের আহবানে রাস্তায় নামেন।ব্রিটিশদের অত্যাচার দেখে তাঁর হৃদয়ের ভিতরে আগুন জ্বলত।মনে মনে শপথ নেন এই দেশ থেকে বৃটিশ দের তিনি তাড়াবেন।তাই চুপ করে বসে না থেকে দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন এর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন।তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হবার পর দেশ জুড়ে আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল।সক্রিয় আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে জনগণের চোখের মনি হয়ে উঠলেন।
আর হবে নাই বা কেনো,তার ও কিছু কারণ তো নিশ্চয় আছে যার জন্য মানব রূপী ভগবান হয়ে উঠলেন।
একজন মানুষ যিনি নিজের বন্ধুদের মাথায় যাতে শাস্তির খাঁড়া নেমে না আসে তাই নিজের না করা অপরাধের দায়ও নিজে মাথা পেতে নিয়ে কলেজ থেকে বিতাড়িত হন।একজন মানুষ যিনি তাঁর অসামান্য মেধার জোরে নিজের যোগ্যতায় কঠিনতম আই.সি.এস. পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেও গোরাদের গোলামী করতে অস্বীকার করে তৎকালীন সময়ের লোভনীয় সরকারী চাকরির প্রস্তাব হেলায় প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। একজন মানুষ যিনি রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে তথাকথিত জাতির জনকের অগণতান্ত্রিক আচরণের শিকার হয়ে পরাধীন ভারতে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদ তথা ' রাষ্ট্রপতি ' নামাঙ্কিত কংগ্রেসের সভাপতি পদ ত্যাগ করতে পারেন।
একজন মানুষ যিনি ঘর - সংসার, পরিবার - পরিজন, দেশ - দেশের মানুষ ... কে ছেড়ে মাতৃভূমিকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে অজানা ভবিষ্যতের উদ্দ্যেশ্যে পাড়ি জমাতে পারেন।তিনি কেবলমাত্র মানুষ নন, তিনি প্রকৃত অর্থে,মহামানব আর, মহামানবের মুখেই মানায়। ত্যাগের মধ্যেই আনন্দ, সেবার মধ্যেই তৃপ্তি। যিনি জীবনের সর্বস্ব ত্যাগের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পান তিনিই তো মানব রুপী ভগবান।প্রকৃত জননেতা।তবে জননেতা বলতে বর্তমান সময়ের মত নয়।এখন নেতা রা নিজেদের স্বার্থে জনগন কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পিছ পা হন না।কিন্তু তিনি তেমন ছিলেন না।জনগণের জন্য নেতাজি সুভাষ নিজের মৃত্যু কে ভয় পেতেন না।
তাঁর জনসেবার বহু নজির আমরা পেয়ে থাকি।তবে এমন এক ঘটনা ঘটেছিল তৎকালীন সময়ে যা ছিল নজির বিহীন।সালটা ছিল ১৯৩৯, জননেতা ঘোরতর অসুস্থ ছিলেন। তখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেননি।ত্রিপুরা কংগ্রেসে চূড়ান্ত অসভ্যতা,ও ছদ্মবেশী বন্ধুদের থেকে পিঠে ছুরি মারার মতো বিশ্বাসঘাতকতা ও অসহযোগিতা পাবার পরেও ১০ মার্চ আপসহীন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের ডাক দিলেন সুভাষচন্দ্র বসু।তিনি অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় ফিরে নিজের বাড়িতে বিশ্রামে রয়েছেন।তিনি কলকাতার বাড়িতে রয়েছেন শুনে বহু কর্মী,সাধারণ ছেলেরা, তাদের প্রিয় নেতা'কে শুধু একবার দেখতে পাবার আশায় তাঁর বাড়ির সামনে এসে ঘণ্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় থাকতেন। কিন্তু তাঁর কাছে যাবার বা কমপক্ষে তাঁকে একবার চোখে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন না।এমন অবস্থায় সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে দেখা করতে এলেন বিপ্লবী অন্নদা চক্রবর্তী (পরবর্তী জীবনে স্বামী অসীমানন্দ সরস্বতী)। অন্নদা চক্রবর্তী বাড়িতে ঢোকার সময়ে লক্ষ্য করলেন- বহু কর্মী তাদের প্রিয় নেতাকে একবার চোখে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তিনি প্রথমে সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে দেখা করে প্রয়োজনীয় কথা সারলেন।তারপর বিছানায় শোওয়া অসুস্থ নেতা'কে বললেন, "আপনি যদি একটু খানির জন্য জানালার পাশে দাঁড়ান.."।
- কেন ? .. একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সুভাষচন্দ্র বসু।
অন্নদা চক্রবর্তী তখন বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মী-ছেলেদের কথা জানালেন।
অসুস্থ সুভাষচন্দ্র বসু এতক্ষণ শুয়ে শুয়েই কথা বলছিলেন, অন্নদা চক্রবর্তীর কথা শুনে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে উঠে বসলেন আর বললেন- "সত্য বক্সীকে ডাক।"সত্যরঞ্জন বক্সী এলেন, সঙ্গে আরো কয়েকজন। এবার সবার উপস্থিতিতে সুভাষচন্দ্র বসু বললেন, "দেখ.. আমি আজ কংগ্রেসের সভাপতি। আমার কত মানসম্মান। বড়লোকের ছেলে,পয়সার অভাব ছিল না। বিলেতে গেলাম, আইসিএস পাস করলাম, চাকরি নিলাম না। হু হু করে আমার নাম বেরিয়ে গেল। আর এই ছেলেরা গ্রামে বাস করে। কারো হয়তো ঠিকমতো খাবার জোটে না। আমাদের ডাকে এরা বেরিয়ে আসে। পুলিশের গুঁতো খায়, জেলে যায়, আর জেল থেকে ফিরে এসে দেখে কারো মা বা বাবা মারা গেছেন, কারো হয়তো জমিজমা বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু তাও এরা অভিযোগ করে না,একটি কথাও বলে না।আবার যখন ডাক দিই, হাসিমুখে এরা বেরিয়ে আসে.. 'না' বলতে জানে না। এদেরই জন্য আমাদের নেতৃত্ব। অথচ এরাই আজ আমার সাথে দেখা করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে।এর চেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরা ভাল ছিল।এখনি সবাইকে আমার কাছে নিয়ে এসো।"
সত্যরঞ্জন বক্সী বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সকল কর্মী-ছেলেদের বাড়ির ভেতরে একেবারে সুভাষচন্দ্র বসুর ঘরে নিয়ে এলেন। সুভাষচন্দ্র বসু সকল কর্মী-ছেলেদের বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন। তারপর তিনি যা বললেন, তা আমরা এই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতেও পারব না। সকল কর্মী-ছেলেদের সামনে অসুস্থ সুভাষচন্দ্র বসু হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেন আর বললেন, "অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্য আমি লজ্জিত, দুঃখিত.. তোমরা আমার অপরাধ ক্ষমা কর।"
এইসকল ঘটনা বিপ্লবী অন্নদা চক্রবর্তীর সামনেই ঘটে, তিনি লিখেছেন - বয়সে বড় বা গুরু-স্থানীয়দের পায়ে হাত দিয়ে বহু প্রণাম করেছি, কিন্তু জীবনে কারো পায়ে নিজের মাথা ঠেকাইনি, আজ এই প্রথম সুভাষচন্দ্রের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম।আজ.. সেই ঘটনার বহু বছর পরেও এক ও অদ্বিতীয় প্রকৃত দেশনায়ক তিনিই।এই হল নেতাজি সুভাষের চরিত্র।তিনি সেই মহান ব্যাক্তি যিনি সমগ্র ভারত জুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ তুলেছিলেন।তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন।তিনি এমন এক মহান চরিত্র ছিলেন যাঁকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যেত,সেই কারণে তাঁর ডাকে সাধারণ জনগন সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলেন।এমনকি বহু মা নিজেদের সন্তানকে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।সেই বিশ্বাসের জোরে তিনি বলেছিলেন :_“ আমরা বেঁচে থাকি বা না থাকি, আমরা স্বাধীন ভারত নিজের চোঁখে দেখতে পাই বা না পাই,কিন্তু আমরা আত্মবিশ্বাসী যে আমাদের জন্য ভারতবর্ষ স্বাধীন হবেই, পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হবেই।তিনি অখণ্ড ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয় নি।তাঁকে চক্রান্ত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করার প্রয়াস সার্থক হয়েছিল তৎকালীন সময়ে স্বার্থপর নেতাদের।আর তা আমরা মেনে নিয়েছি। বাঙালির আবেগ,প্রাণের ভগবানের সঙ্গে যারা এমন জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল তাদের কে ভগবান বলে মানা হয়।অন্যদের কথা বাদ দিলাম,আমরা বাঙালিরা কি তাঁকে বিশেষ ভাবে মূল্যায়ণ করতে পেরেছি এ যাবত? আমরা আজও তার জন্মদিনে পালন করি মদ আর মাংসের দোকানে লাইন দিয়ে।
যাঁকে এক বাক্যে চীন,জাপান,জার্মানি,রাশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রবাদী নেতারা যেমন হিটলার,তোজো, হো চি মিনরা সমীহ করে চলতেন। যিনি দাসত্ব নয় মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন। এমনকি বোবাদের মুখে ভাষা জুগিয়েছেন।যাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল দেশের মানুষ দাসত্ব থেকে মুক্তি পাক সেই মহামানবের মূর্তি ভাঙ্গাতে আমরা কোন প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারিনি। পশ্চিমবাংলার পানিহাটিতে রাতের অন্ধকারে একদল দুষ্কৃতী ভেঙে ফেললো নেতাজির মূর্তি।এ লজ্জা শুধু পশ্চিম বাংলার নয়, সেইসঙ্গে কালিমালিপ্ত হয়ে উঠল পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতি। এ লজ্জা আমাদের সমস্ত মানবজাতির লজ্জা।যে যুব সমাজকে নিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন,সেই শিক্ষিত সমাজের অর্জুনরা আজ নির্বিকার,অবিচল।তবে এই রাজ্যে দুষ্কৃতি,অপরাধীদের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে, তার নজির আমরা বিভিন্ন সময় পাচ্ছি।এই বাংলায় অপরাধীরা অপরাধ করেও সমাজের বুকে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।তাই মহামানবের মূর্তি ভাঙ্গা দুষ্কৃতীরা কবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে তার অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের।
যদি কোন দেশ অহংকার করে বলেন আমার দেশে মাদাম তুসোর মূর্তি,মোনালিসার ছবি, স্ট্যাচু অব লিবার্টি,হোয়াইট হাউস,পেন্টাগন হাউস,ঝুলন্ত সেতু, আছে তবে আমরা ভারতের বাঙালি হিসাবে মাথা উঁচু করে বলুন আমাদের কাছে একটা নেতাজি আছে।যিনি আমাদের পথপ্রদর্শক,যার আদর্শ আমরা শিরে ধারণ করি। যার নাম উচ্চারণ করলে গর্বে বাঙালির বুক ফুলে ওঠে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরে বাঙালি জাতি কতটা মূল্য দিতে পেরেছে?
"দেশবাসীর পক্ষ হতে, মানুষের নজরের আড়ালে থেকে তিলে তিলে জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে যাব। মাথার উপর যদি ভগবান থাকেন, পৃথিবীতে যদি সত্যের প্রতিষ্ঠা হয়, তবে আমার হৃদয়ের কথা দেশবাসী একদিন না একদিন বুঝবেই" - নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
কবিতা (পর্যায়- এক)
মৃত্যু
সপ্তাশ্ব ভৌমিক
যত বড় পাথর পুকুরে পড়ুক
একটু পরেই ঢেউ থেমে যাবে
শুধু মুহূর্তের উথাল পাতাল
জলজ বৃত্ত কিছু
ছুটে যাবে পাড়ের আশ্রয়ে
তারপর জল আর সময় নিথর
বিবশ পাথর ক্রমশ তলিয়ে যাবে
খুব ধীরে কাদার গভীরে
ব্রহ্মাস্ত্রের সন্ধানে
উৎপলেন্দু পাল
আমার অতি প্রিয় মানচিত্রটাকে
ছিঁড়ে খাবার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত
একদল ক্ষমতা লোলুপ হায়না ,
প্রতি রাতে দাঁত নখ শাণিত করে
ঝাঁপিয়ে পড়ে মানচিত্রের বক্ষদেশে ,
বাটোয়ারার আশায় জিভ লকলক
শৃগাল আর শকুণের বংশজদেরও ,
আসু রক্ত যাপনের মূক আশঙ্কায়
আমার ঘুমহীন প্রতিটা রাত্রি যাপন ,
প্রতিরোধে যুদ্ধক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ আমি
যেন শস্ত্রহীন এক নিধিরাম সর্দার ,
অন্তরের অদম্য প্রতিশোধ স্পৃহায়
কতগুলো তীক্ষ্মমুখ শব্দের অন্বেষণ
একটা ব্রহ্মাস্ত্র তৈরি করবো বলে ।
প্রগতিশীল
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বৈরাচারী, প্রতিক্রিয়াশীল, একনায়কতন্ত্র শব্দগুলো দিনে দিনে কোথায় যেন হারিয়ে যেতে বসেছে
আজকাল দেওয়াল লিখন আর কেউ পড়ে না
হ্যাঁ, তবে শ্রমজীবী, হাত ফাঁটা কৃষক, পথশিশু আজও আছে
আজ দিকে দিকে শুধুই কসমেটিক ডেভেলপমেন্ট
ঝাঁ চকচকে রাস্তা, ফ্লাডলাইট এর আলো, দামী গাড়ি এসব নিয়েই ভাবনা চিন্তা
দিকে দিকে ময়লার পাহাড় জমছে
পুতিগন্ধময় সেই স্তুপের কাছে গাড়ির জানলায় একটা হাত ছোঁয়ালেই জানলার কালো কাঁচ বন্ধ হয়ে যায়
চারিদিকে শুধুই প্রগতিশীল, উন্নয়ন এর প্রলেপ
আমগুড়ি, সাপটিবাড়ি, রাণীর হাটে যখন অভুক্ত দুধের শিশু কেঁদে ওঠে?
দিনবাজারের মসজিদের পাশে যখন কিছু মানুষ ভাতের গন্ধ খোঁজে?
অট্টালিকায় নরম সোফায় গা এলিয়ে দেয় চাকরির ফেরিওয়ালা
দূর থেকে শোনা যায়, চাকরি চাই ? চাকরি আছে, চাকরি বিক্রি আছে গো।
একা চাঁদ
কুমার বিজয়
জানি না কেন, এমনটাই হয়,
অযথা কেন,শক্তি ক্ষয়,
সে মগজের, না কি মানষিক প্রত্যয়,
অতীত বলতে পারি, বর্তমানও,
ভবিষ্যৎ কি কেউ জানো,
হা ! হা ! হা কেউ জানে না,মানো বা না মানো,
চাঁদ যেমন একলা ভাসে,
একাকী গল্পও তেমনই আসে,
শুধু সঙ্কীর্ণতা কেন এই, উদার আকাশে,
একলা একা, জানোতো তুমি,
ভরা জোছনাতেও বিষন্ন ভূমি,
আলোছায়া
জানিনা কেন, এমনটাই হয়,
পিছুটান বলে কিছু নয়,
আসলে হৃদয়ের ডাক,সব প্রীতিময় !
চাতকজল
দেবদত্তা লাহিড়ী
এক একটা হেমন্তের পাতাঝরা গোধূলিতে ওরা আসে
ঘাপটি দিয়ে আনাচে কানাচে কিসের অপেক্ষায়,
তারপর হিমহিম করে আসে আমার ।
চাদর মেনে নিয়ে মুড়ে নেই সবটাই।
নিশ্বাসে ঝুরি বরফ আর ধোঁয়া ধোঁয়া বুক কষ্ট
ওম আসতে দেরি আছে বলে হাত নেড়ে বরফ
বুড়ো পাইন গাছের ডাল পাতার ঝটপট অনি শোনায়।
বলিরেখা কমে যাওয়ায় তাদের খুব অসুখ।
শীত আসে ভেতর ঘরে রীনা মজুমদার
শীত পড়েছে বাইরে, তবুও
দিকভ্রান্ত শীত আমার কাছে
ঘুরপাক খায়, ভেতর ঘরে
শরতেও শীত জমে বুকে
তিস্তার পারে, মহালয়ার ভোরে
শীতে নদী মরেও জলের রেখা রাখে
নদীরও কি বুকে স্মৃতিচিহ্ন হুঁ হুঁ করে ওঠে?
বাইরের শীতের জন্য, ছোট্ট লাল টুকটুকে
একটা সোয়েটার পরিয়ে দিতে আগে,
বুকের ভেতর জমা শীতের জন্য তো
কিছু বলে গেলে না মা ! এখন
শীত আসে ভেতর ঘরে...
নবজাতক
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
আচমকা চীৎকার করে উঠল জগা পাগলা-
"তফাৎ যাও তফাৎ"-
সচকিত পথচারীরা পিছু হটল
থতমত সামলে মুখ খিস্তি করল কেউ কেউ।
নজর পড়ল -রাস্তার ধারের বটগাছতলায়
বাচ্চা বিইয়েছে অনাথিনী,
মাতৃত্বের রঙে রঙীন চারপাশ,
জগাপাগলা চেষ্টা করছে তার একটুকরো ন্যাতাকানি দিয়ে
সবটুকু বেআব্রুকে আব্রু দিতে।
ভদ্র বাবু,বিবিরা নাক সিঁটকে সরে পড়ল
দৌড়ে এলো ফুলউলি মাসি
"সর সর,দেখি দেখি-
ওমা, কি সুন্দর খোকা হয়েছে দেখ!
প্রান্তিক মানুষেরা হাতে হাতে সামলাল নবজাতককে
সদ্যজাত-এই আবরণকেই নাও আভরণ করে।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা দিল নতুন সূর্য্য-
নতুন ভোর আনবে আগামীতে।
এইভাবেই এগিয়ে যাই
এক ক্রান্তিকাল থেকে আরেক ক্রান্তিকাল
আশাগুলি একজোট হয়,
খুঁজে ফেরে নিষ্পাপ সারল্য
দূরে আরো দূরে চলে যায়,
অস্পষ্ট হয়ে যায় সীমাবদ্ধতা ।
এইখানে সন্ধ্যা নামে
আতিক এ রহিম
এই খানে সন্ধ্যা নামে কুয়াশার ফাঁকে শীত আসে
গোধূলি বেলা পাখিরা নীড়ে ফিরে
পেছনের স্মৃতি দুঃস্বপ্ন হয়ে ভাসে।
এইখানে সন্ধ্যা নামে গাঁয়ের বঁধু নদীতে স্নান করে
উত্তরের বাতাসে সর্ষে ফুলে কাঁপন ধরে
স্বচ্ছ পানিতে বালিহাঁসেরা সাঁতার কাটে
পশ্চিম আকাশে এক ফালি চাঁদ জেগে ওঠে।
এইখানে সন্ধ্যা নামে নদীর পাড়ে জোনাক জ্বলে
পোড়াগঙ্গা নদীর জলে জাল ফেলে।
যুবক যুবতীরা সন্ধ্যার মনোরম আবেশে মেতে ওঠে
এইখানে সন্ধ্যা নামে পোড়াগঙ্গা নদীতে টিপটিপ আলো ফুটে।
রাতের আঁধারে জাল ফেলে মিন মারে
এইখানে সন্ধ্যা নামে পাখিরা সব নীড়ে ফিরে
সব মানুষেরা ফিরে ঘরে।
গল্প
বিনুর স্বদেশ প্রেম
বেলা দে
মাত্র আটের বিনু সদ্য বাবা হারানো, কিছুদিনের মধ্যেই যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেল। মাকে এখন লেখা পড়ার কথা একেবারে বলতে হয় না মন দিয়ে দুবেলা পড়া করে। মা মিত্রদের বাড়িতে রান্না করে সেখানে হাজার পাঁচেক টাকা পায় খেতেও দেয় ওরা মানুষ খুব ভালো, আর রেশন থেকে যা পায় বিনুর ভালভাবে হয়ে যায়, মিড ডে মিল তো আছেই। মা অনিতার অষ্টমশ্রেনি পর্যন্ত পড়াশোনা, বিনুকে ছোট্টবেলা থেকে পাঠ্যবই এর সাথে সাথেই স্বাধীনতার গল্প শোনায়, নেতাজী আর বালক ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের কাহিনী, ভারতবর্ষের বিশেষ বিশেষ দিনের বিশেষত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে সাহায্য করে, এব্যাপারে তারও খুব আগ্রহ আজ ২৬শে জানুয়ারি, সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে ধোঁয়া জামাপ্যান্ট পড়ে স্কুলে যায় বড় দিদিমণির গরম গরম দেশাত্মবোধক ভাষন আর গানের মধ্যে খুব সুন্দর ছবি এঁকে ফেলে মনে মনে সেও ক্ষুদিরামের মত ত্যাগের পথে হাটবে, এমনি ভাবতে ভাবতে স্কুল থেকে মিত্রদের বাড়ির দিকে চলেছে মায়ের থেকে ঘরের চাবি আনবে বলে, হঠাৎ যেন শিরশিরে বাতাসটা অনেক বেড়ে গেছে হাওয়ায় দুলছে সব কটি বাড়ির টাঙানো পতাকা, মিত্রবাড়ির সামনাসামনি হতেই সে দেখে ওদের পতাকাটা খসে পড়ে যাচ্ছে, বিনু দুদ্দাড় ছুটে গিয়ে বুকে চেপে ধরে মাটিতে পড়ার আগেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা, মিত্রবাড়ির সদস্যরা সবাই হতবাক ছোট্ট বিনুর দেশপ্রেম দেখে বাহবা দেয় মা অনিতাকে এমন নৈতিক শিক্ষায় গড়েপিটে তোলার জন্য।
মৃত্যুসংবাদ
রামাশিস চৌধুরী
দুঃসংবাদটা একেবারেই আশা করেনি জাগরি। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর ড্রয়িং রুমের সোফায় শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে সেই যে বসেছে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসলেও ওঠেনি। স্কুলে যে পোশাক পড়ে গিয়েছিল তা এখনও ছাড়েনি। ছাড়তে ইচ্ছাও করছিল না। মৃত্যু-সংবাদটা শোনার পর থেকে কোন কিছুই ভাল লাগছিল না জাগরির। অন্যদিন এতক্ষণে হাত-মুখ ধুয়ে, পোশাক বদলে, চা খাওয়া হয়ে যায়। জাগরি আবার বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেতে পারে না। চা-এর সাথে কখন শুকনো মুড়ি নয়ত বিস্কুট। কখন কখন দিনবাজারে কোনো কিছু কেনাকাটার জন্য নামলে, বিশ্বনাথের দোকান থেকে কচুরি বা গরম সিঙ্গারা নিয়ে এসে তা দিয়ে চা খেয়ে নেয়। সুজল আবার গরম গরম জিলাপি খেতে ভালোবাসে। মেয়েটা আবার চপ খেতে খুব পছন্দ করে। আজকে তাই দিনবাজারে নেমে, বিশালের পাশে, জলযোগ থেকে গরম গরম জিলাপি আর ভেজিটেবল চপ নিয়ে নিয়েছিল। সব-ই প্যাকেট-বন্দি হয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ে আছে।
ড্রয়িং রুমে বসে পশ্চিমদিকের জানলা দিয়ে বাগানের নারকেল আর সুপারি গাছগুলোর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল জাগরি। প্রতিদিন ঐ নারকেল আর সুপারি গাছের পিছনে সূর্যাস্তের দৃশ্য একবার না দেখলে ওর হয় না। আজ সেই সূর্যাস্ত-ও দেখতে ইচ্ছা করছিল না। সূর্যাস্তের ফলে ঘনিয়ে আসা অন্ধকারটাও আজ জাগরির কাছে অলক্ষুণে লাগছিল।
খবরটা পায় অমিতের কাছে। অমিত শহরেরই একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে। হাইস্কুলে। জাগরি ধূপগুড়িতে। ধূপগুড়ি শহরে নয়। একটু গ্রামের দিকে। জলপাইগুড়ি থেকে বাসে যাতায়াত করে। বাসে করে এসে কদমতলায় নেমে রূপমায়া সিনেমা হলের উল্টোদিকে টোটো ধরার জন্য দাড়িয়েছিল। গোমস্তাপাড়া যাবে। ঠিক সেই সময় অমিত-ও স্কুল থেকে ফিরছিল। সাইকেলে। জাগরিকে দেখে সাইকেল থেকে নামে।
-কিরে! স্কুল থেকে ফিরলি? জাগরিকে জিজ্ঞেস করে অমিত।
-হ্যাঁ। তুই-ও তো তাই! কেমন আছিস? বহুদিন বাদে তোর সঙ্গে দেখা হল।
-একদম ভালো নেই রে। আজ সকাল থেকেই মনটা একেবারেই ভাল নেই। সকালে খবরটা শোনার পর থেকে কোন কিছুই আর ভাল লাগছে না।
-কি খবর! তোর কোন-------
-কেন তুই কিছু শুনিস নাই!
-কি শুনব! অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে জাগরি জিজ্ঞেস করে।
-সাত্যকির মৃত্যুর খবর!
-নাতো! সেকি! কবে হল! কি করে হল ?
-গতকাল। রাত প্রায় আড়াইটার সময়। শিলিগুড়ি আনন্দলোক নার্সিংহোমে।
-আমি যাই বুঝলি। একটু তাড়া আছে। ওদের বাড়িতে একবার যেতে হবে।
অমিত সাইকেলে উঠে এগিয়ে যায়। কাজরি দাঁড়িয়ে থাকে। একটার পর একটা টোটো ওর সামনে দিয়ে চলে যায়। জাগরি কিছুই খেয়াল করে না। সম্বিৎ ফেরে এক পরিচিত টোটোওয়ালার ডাকে। দিদিমণি যাবেন নাকি ?
সাত্যকি, অমিত আর ও একসঙ্গে কলেজে পড়ত। কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে। ওরা কেউ-ই জলপাইগুড়র বাসিন্দা নয়। অমিত-এর বাড়ি ফালাকাটা, সাত্যকির বেলাকোবা। ওরা দুজনে জলপাইগুড়ি শহরে বাড়ি ভাড়া করে থাকত। জাগরি আসত ময়নাগুড়ি থেকে। ও-ই একমাত্র ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করত।
জাগরির বাবা ডব্লিউ বি সি এস। সাউথ বেঙ্গলের কোনো এক জেলায় বিডিও হিসাবে পোস্টেড ছিল। মা গৃহবধূ। জাগরি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ছোটো-খাটো। গায়ের রঙ অস্বাভাবিকভাবে ফর্সা। ঠোঁট দুটো টুকটুকে গোলাপী। মনে হত লিপস্টিক দিয়ে রাখে। কিন্ত জাগরি কোনো প্রসাধনী-ই ব্যবহার করত না। কলেজে আসার সময় তো নয়-ই। কথা বললে বা হাসলে দু'গালে টোল তৈরী হত। জাগরি কখনও জমকালো রঙিন শাড়ি পড়তে পছন্দ করত না। সব সময় হালকা রঙের শাড়ি পড়ে কলেজে আসত। হাসলে অসম্ভব ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়ত, যেটা জাগরিকে একটা আলাদা সৌন্দর্য্য এনে দিত। সব কিছু মিলিয়ে, এককথায় বলা যায়, জাগরি সুন্দরী।
-সাত্যকি বলত, জানিস তোকে হাসাই কেন ?
-কেন রে ?
-তোর দুই গালে দুটো টোল দেখব বলে।
-যাঃ। জাগরি প্রথম প্রথম বলত। তবে পরে আর বলত না। সাত্যকির মুখে ঐ কথাটা শুনতে খুব ভালোলাগত।
-এই বয়েসেই তোর অমন বুড়ি বুড়ি ভাব কেন রে! অমিত একদিন হাসতে হাসতে জাগরিকে বলেছিল।
-কেন বুড়ির কি ভাব তুই আমার মধ্যে দেখলি! জাগরি একটু রেগে গিয়ে জানতে চেয়েছিল।
-না, মানে এই বয়েসে অন্য মেয়েরা যখন বেশ রঙ-চঙে শাড়ি পড়ে আসে, তুই তখন একেবারেই সাদা- মাটা পোশাক পড়ে কলেজে আসিস তো,তাই বললাম।
-আচ্ছা আমি কি পোশাক, কেমন পোশাক পড়ে আসব, সেটা কি তোর পছন্দমত পড়ে আসব নাকি!একটু রাগ রাগ ভাব নিয়ে যেই জাগরি লাইব্রেরির বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, অমনি সাত্যকি সারেন্ডার করে।
- আচ্ছা তুই কি ইয়ার্কিও বুঝিস্ না। তোকে স্রেফ খেপিয়ে তোলার জন্য ও-সব বলছিলাম। সত্যি কথা কি জানিস, সব কিছুতেই তোর এই সিমপ্লিসিটি আমার খুব ভাল লাগে।
জাগরি ওর কথায় কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আবার চেয়ারে এসে বসে।
মনে আছে, প্র্যাকটিকাল ক্লাশ শেষ হতে হতে এক একদিন সন্ধ্যা হয়ে আসত, বিশেষভাবে শীতকালে। শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস ধরতে হত জাগরিকে। অনেকদিন এমন হত, স্ট্যান্ডে কোন বাস থাকত না। বাস আসলে, তারপর সেই বাসে রওনা হত। কলেজ থেকে হেঁটে শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার সময়, প্রায়ই সাত্যকি ওর সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে জাগরিকে শান্তিপাড়া পর্যন্ত সঙ্গ দিত। অনেকদিন প্র্যাকটিকাল শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে আসত। স্ট্যান্ডে এসে আর বাস পাওয়া যেত না। রিক্সায় চেপে দিনবাজার বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে হাট বাস ধরতে হত। তখন, জাগরিকে রিক্সায় চাপিয়ে নিজে সাইকেলে চেপে রিক্সার পাশে পাশে দিনবাজার পর্যন্ত যেত। বাস ছাড়লে, তবে সাত্যকি চলে যেত।
-একি ! মা, বাইরের ঘরের দরজাটা এখনও খোলা। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, তাও আলো জ্বালাও নি। ঘরের আলোগুলো জ্বালাতে জ্বালাতে মেয়ে সুমনা কথাগুলো পরপর বলতে থাকে। - এমা, দেখেছিস, একদম ভুলে গেছি। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে জাগরি আপন মনে কথাগুলো বলে ওঠে।
- কি হয়েছে মা ! এখনও বাইরের কাপড়-ও তো ছাড়োনি। সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে------। বাইরের ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে করতে সুমনা মাকে জিজ্ঞেস করে।
- ও কিছু না। শরীরটা একটু ক্লান্ত লাগছিল। আর-‐‐----
- আর কি ?
- ওই সাত্যকি, আমার কলেজের বন্ধু হঠাৎ কাল মারা গেছে। ওর মারা যাওয়ার খবরটা শোনার পর থেকে--------------।
- চল, চল, চল, আগে কাপড় ছাড়ো। কাপড় ছেড়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে তুমি আগে একটু শোও তো মা। আমি তোমার জন্য চা করে আনছি। সেই কখন সামান্য টিফিন খেয়েছো। এখনও কিছু খাওনি।
মা একটু ক্লান্তির কথা বললেই সুমনা অস্থির হয়ে পড়ে। মা যেন কখন ক্লান্ত হবে না। মায়ের বয়েসটা বোধ হয় এক জায়গাতেই থেমে আছে।
বাথরুমে ঢুকে চোখে-মুখে বেশ ভালো করে জলের ঝাপটা দেয় জাগরি। হাত-পা ধোয়। কাপড়টা পাল্টে ম্যাক্সি পড়ে।
তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টে মায়ের জন্য চা করে নিয়ে আসে সুমনা। নিজেও চা নিয়ে বসে মায়ের সামনে। সাথে মায়ের আনা চপ।
চা খেতে খেতে সুমনা টিভিটা অন করে। মেয়ের এই একটা অভ্যাস। কলেজ থেকে এসে প্রতিদিন টিভিটা অন করা। টিভিতে যা হচ্ছে তাই কিছুক্ষণ গোগ্রাসে গেলা। টিভি অন হতেই, কয়েকদিন ধরে ওই এক ঘ্যান ঘ্যানানি। কোন্ নেতার কলকাতায় কোথায় কোথায় ক'খানা করে ফ্ল্যাট আছে। কোন্ মন্ত্রীর আয় বহির্ভূত কোটি কোটি টাকার হদিস পাওয়া গেছে-কয়েকদিন ধরে টিভি খুললে ওই একই খবর। দিনরাত। ভাল লাগছিল না জাগরির। দু'দিন পরে দেখা যাবে এরাই সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে সকলে বেকসুর খালাস। মেয়েকে টিভিটা বন্ধ করে দিতে বলে জাগরি।
মা, সাত্যকি বলে তো তোমার কোন কলেজ-বন্ধুর কথা কোনোদিন শুনিনি! না, মানে তুমি বলোনি। টিভিটা বন্ধ করে দিতে দিতে বলে।
জাগরি মেয়ের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বাঁ হাতের ওপর মাথাটা রেখে বাঁ দিকে কাৎ হয়ে জানলার দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে। চাঁদটাকে আজ বেশ বড় দেখাচ্ছে। বোধ হয় পূর্ণিমা। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো বিছানায় লুটিয়ে পড়েছে। জানলার গ্রিল, বাইরের নারকেল, সুপারি গাছগুলো কেমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
প্রায় চল্লিশ বছর, হ্যাঁ চল্লিশ বছর আগেই। সালটা ১৯৮০। ময়নাগুড়ি থেকে বাবার সঙ্গে এসে কলেজে ভর্তি হওয়া।সিঁড়ি দিয়ে উঠে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বারান্দার একদম বাঁ দিকে টিচার্স রুম। তার আগে ডান দিকে প্রিন্সিপালের ঘর। প্রিন্সিপালের ঘরের সঙ্গে লাগোয়া অফিস ঘর, একেবারে ডান দিকে লাইব্রেরি। লাইব্রেরির কিছুটা আগে একটা ছোট্ট ঘরে কেমিস্ট্রি অনার্সের ক্লাশ হত। ওরা মোট ছয় জন ছিল।
সিঁড়ি দিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বারান্দায় উঠে বাঁ দিকে অফিস ঘরের আগে ডান হাতে ছিল কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল রুম। সাত্যকি প্র্যাকটিকাল খুব ভাল করত। বিশেষ করে অজৈব রসায়নের প্র্যাকটিকাল। জাগরি আবার সল্ট অ্যানালিসিস করতে খুব ভয় পেত। প্রথম প্রথম তো কোন ধাতব radical-ই বের করতে পারত না। অমিত-কে বললে, ও হেল্প করত ঠিক-ই, কিন্ত ওকে বলতে হত। সাত্যকি যেচে এসে বলত, কিরে কাঁদছিস কেন, কাঁদলে কি আর ধাতব radical বের হবে! এতো কেমিস্ট্র প্র্যাকটিকাল রে বাবা! অতো সোজা নয়। কি করেছিস বল তো। জাগরি সল্টের দ্রবণ বানানোর পর থেকে কোনটার পর কোন রিএজেন্ট মিশিয়েছে নির্দিষ্ট radicalটা পেতে, তা সাত্যকিকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে শুরু করত। সাত্যকি বলত, সব-ই তো বুঝলাম, কিন্ত দ্রবণের মিডিয়ামটা-ই তো তোর ক্ষারীয় রয়ে গেছে। আম্লিক করিসনি। অথচ তুই যে radiclটা চাইছিস, তার লবণ তো আম্লিক মাধ্যম ছাড়া অধঃক্ষিপ্ত হবে না। যা না কেঁদে, এখন ঠিক করে কর।
লাইব্রেরির দরজা দিয়ে ঢুকেই ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ার জায়গা। পরপর সার বেঁধে বড় বড় টেবিল, সাথে লো বেঞ্চ। ডানদিকে বই নেওয়া-দেওয়া করার কাউন্টার। কাউন্টারের পিছনে ছিল বই রাখার আলমারি। আলমারিগুলো এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে ছোট ছোট খোপ তৈরী হয়েছিল। মাঝখানে করিডর, দুই পাশে আলমারি-ঘেরা খোপ। ঐ খোপগুলোতে বসে পড়ার জন্য টেবিল-চেয়ারের ব্যবস্থা। অফ্ পিরিয়ডে ঐখানে বসে পড়াশোনা করত জাগরি। সাত্যকি-ও থাকত।
জাগরির খুব কথা বলার অভ্যাস ছিল। সাত্যকি সামনে থাকলে তো কথা-ই নাই। লাইব্রেরিতে বসে কখন যে গলার আওয়াজ উচ্চগ্রামে পৌঁছে যেত, ওর তা খেয়াল থাকত না।লাইব্রেরিয়ান যিনি ছিলেন, তিনি এসে বকাবকি করতেন। বলতেন, একদম কথা বলবে না। এটা কথা বলার জায়গা নয়। পড়াশোনা কর। লাইব্রেরিয়ানের মুখে কেউ কখন হাসি দেখেনি। যত রাজ্যের বিরক্তি সারা মুখটা জুড়ে। খুব strict ছিলেন। ওনার কাছে কত যে বকা খেতেন, তার ইয়ত্তা নেই। কথা বলার জন্য।
ক্লাশরুম, প্র্যাকটিকাল রুম, লাইব্রেরি করতে করতে কখন যে সাত্যকি-কে ভালোবেসে ফেলেছিল, জাগরি তা নিজেও টের পায়নি। সাত্যকি বেশ লম্বা। শ্যামলা রঙ। চোখ দুটো বেশ কালো। মনে হত কাজল দিয়ে এসেছে। সিগারেটটা একটু বেশি-ই খেত। ডানহাতের তর্জনি আর মধ্যমার মাঝখানে সিগারেট রেখে যখন টান দিত, তখন ও-কে বেশ ম্যানলি লাগত। তবে এ-সবের থেকেও সাত্যকির যে জিনিসটা জাগরি-কে সব থেকে বেশি আকর্ষণ করত, তা হল সাত্যকির কথাবার্তা। আদুরে আর সহানুভূতিমাখা। সেটা আসল না অভিনয় তা অবশ্য জাগরি সে সময় বুঝতে পারেনি। অবশ্য সে-সব বোঝার বয়স-ও তখন ওর হয়নি। ও সাত্যকি-কে মন দিয়ে ফেলেছিল। সাত্যকি দিয়েছিল কিনা -তা অবশ্য জাগরি সে-সময় ভেবে দেখেনি। মা'র আবার সাত্যকি-কে বেশ লাগত। ও বেশ কয়েকবার জাগরিদের ময়নাগুড়ির বাড়িতে গিয়েছিল।
কখন যে সুজল এসে ঘরে ঢুকেছে খেয়াল-ই করেনি জাগরি। কপালে হাতের স্পর্শে হুঁশ হয় ওর।
- শরীর বেশি খারাপ লাগছে না তো!
- না। উঠে বসে জাগরি।
- কখন এলে তুমি ?
- এই তো এলাম।
- জিজ্ঞেস করলে না তো, এই অসময়ে আমি শুয়ে আছি কেন, তুমি কি খবরটা জানো!
- হ্যাঁ, জানব না কেন! অমিতের সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা দেখা হল। ওর কাছেই শুনলাম।
অমিত আর সুজল ছেলেবেলার বন্ধু, সহপাঠী-ও। একই গ্রামের ছেলে ওরা। সবটা না হলেও, জাগরির জীবনে সাত্যকির আগমনের ব্যাপারটা অনেকটাই শুনেছিল। জাগরি-ই বলেছিল। বিয়ের পরে পরে। প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় নি। চুপ করে শুনে গিয়েছিল সুজল।
জাগরি উঠে রান্নাঘরের দিকে যায়। মা'র শরীরটা ভালো নয় বুঝতে পেরে মেয়েটা রান্না বসিয়ে দিয়েছে। সুজল সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরলে, অন্যদিন জাগরি-ই সুজল-কে চা করে দেয়। আজ মেয়ে-ই বাবাকে চা করে দিয়েছে।
পরের দিন স্কুল আছে ভেবে, অন্যদিনের মত খেয়ে-দেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেও , ঘুম আসে না জাগরির। একই বিছানায় শোয় সুজল। ও শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক চেষ্টা করেও ঘুম আসে না জাগরির। উঠে একবার বাথরুমে যায়। রান্না ঘরে ঢুকে জল খায়। মেয়েটা এখনও পড়ছে। ওর এবার অনার্স পার্ট টু। কেমিস্ট্রিতেই। পড়াশোনায় ভালো হয়েছে মেয়েটা। ভাল রেজাল্ট করেছে পার্ট ওয়ানে। পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সচেতন। ওর মত হয় নি।
আবার এসে শোয় জাগরি। শুয়ে বার বার এপাশ ওপাশ করে। কিন্তু ঘুম আসে না কিছুতেই। বার বার ফেলে আসা কলেজ-জীবনের তিনটা বছর ফিরে আসতে থাকে। পার্ট ওয়ানে অনার্সে কন্টিনিউয়েশন মার্ক ছিল। ভেবে ছিল পার্ট টু-তে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্ত হল না। কলেজের নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট দেখে যাওয়ার পর প্রায় মাসখানেক ঘর থেকে বের হয়নি জাগরি।
আশা করেছিল, সাত্যকি এসে একবার দেখা করে সান্ত্বনা দিয়ে যাবে। ওর মত করে বলবে, একবার পারিস নি তো কি হয়েছে ! আবার চেষ্টা করবি। আমি তোর পাশে থাকব। তোর জন্য অপেক্ষা করব ইউনিভার্সিটিতে।
কিন্ত সাত্যকি আসে নি। ফেল করে যতটা না খারাপ লেগেছিল, তার থেকে বেশি খারাপ লেগেছিল সাত্যকির না আসাটা। সেদিন-ই জাগরির কাছে পরিস্কার হয়ে যায়, প্রেমটা একপক্ষীয় ছিল। বুঝতে পারে, সাত্যকির মত পুরুষরা এরকম-ই হয়। এদের বাইরেটা একরকম, ভিতরটা অন্যরকম।
অনার্স না পেলেও বিএসসি পাশ করে জাগরি। পাশ করার দু'বছরের মধ্যে একটা স্কুলে চাকরিও হয়ে যায়। ধূপগুড়িতে। একটু গ্রামের দিকে। ময়নাগুড়ি থেকে ধূপগুড়ি যাতায়াতের পথে-ই পরিচয় হয় সুজলের সঙ্গে। কোলকাতা থেকে ওকালতি পাশ করে জলপাইগুড়ির নবাব-বাড়ি কোর্টে প্র্যাকটিস্ করত। পরিচয় থেকে ভালোলাগা। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা-ই পরিশেষে বিবাহে পরিণতি পায়।
বিয়ের দু'বছরের মধ্যে সুমনার জন্ম। স্বামী-মেয়ে নিয়ে সংসার, চাকরি- এসব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে জাগরি। ধীরে ধীরে সাত্যকিও হারিয়ে যায় জীবন থেকে। হারিয়ে যায় না বলে বরং হারাতে-ই চেয়েছিল বলা ভাল। ওর মৃত্যুর খবরটা আবার ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে ওর জীবনে। ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে ওর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান তিনটা বছর।
সাত্যকিরা দুই ভাই। সাত্যকি ছোট। বড় ভাই অধ্যাপক। বউদি সরকারি চাকুরে। বাবা সরকারি আধিকারিক। অর্থ এবং স্ট্যাটাস-দু'দিক থেকেই ওদের পরিবার সমাজে একটা স্থান করে নিয়েছিল। সাত্যকি-কে একটু অন্যরকম মনে হত। কিছুটা প্রগতিশীল লাগত। কিন্ত এই ঘটনার পর ভুল ভাঙ্গে জাগরির।
জীবন যত এগিয়েছে, জীবন থেকে অনেক কিছু শিখেছে জাগরি। সাত্যকির মত পুরুষেরা বাইরে প্রগতিশীল। চা-এর কাপে ঝড় তুলে ওরা অনেক কথা বলে। প্রগতিশীল কথাবার্তা। কিন্ত নিজের জীবনে প্রগতিশীলতাকে আত্তিকরণে ওদের প্রচন্ড অনীহা। একেবারেই পছন্দ নয়। তখন বড় হয়ে ওঠে অর্থ, স্ট্যাটাস। বড় হয়ে ওঠে সমকক্ষতা। এ-সব সম্বন্ধে ওরা যথেষ্টই সচেতন। তাই একটা মেয়ের আবেগ বা ভালোবাসার মূল্য দেওয়ার থেকেও স্ট্যাটাসটাই ওদের কাছে বড় হয়ে ওঠে। তাই অনার্স না- পাওয়া জাগরি স্ট্যাটাসচ্যুত হয়ে পড়ে সাত্যকির কাছে।
সাত্যকি পুরুষ মানুষ। অর্থবান পরিবারের ছেলে। সামনে শিক্ষার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার হাতছানি। ভালোবাসাটা ওর কাছে খেলার বস্তু ছিল। মেয়েরা খেলনা। প্রয়োজনে কাছে টেনে নেয়। সময় অতিবাহিত করে। অপ্রয়োজনে ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করে না। আগামীতে আরো ভালো কিছু পাওয়ার প্রলোভনে সাত্যকি পিছনে ফিরে তাকাতে রাজি নয়। তাই পিছিয়ে-পড়া জাগরি সাত্যকির জীবনে গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
সাত্যকি-ই সিদ্ধান্ত নেবে। যেহেতু ও পুরুষ। এটা ওর, বিশেষভাবে বললে, পুরুষদের একার অধিকার। মেয়েরা শুধু মেনে নেবে। কষ্ট পাবে। এটা জাগরি পরবর্তিতে উপলব্ধি করেছে। ঘৃণা জন্মেছে সাত্যকির ওপর। সাত্যকির মত পুরুষদের ওপর।
তবে, ওর এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। ওর মৃত্যু , না চাইলেও, ঊনিশ বছর বয়েসের ওর আবেগ, ওর প্রথম প্রেমের স্মৃতিকে আবার ফিরিয়ে এনেছে ওর জীবনে। জীবনের ওই তিন তিনটা বছর, ভুলতে চাইলেও, কিছুতেই ভুলতে পারে না। নস্টালজিক হয়ে পড়ে জাগরি।
ভেন্টিলেটর দিয়ে আলো এসে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে। ভোর হয়ে এসেছে। সুজল এখনও ঘুমোচ্ছে। মেয়েটা হয়ত এতক্ষণে পূব দিকের জানলাটা খুলে পাশের ঘরের বিছানায় পড়তে বসে গেছে। এটা ওর বরাবরের অভ্যাস। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা। ও-কে একটু চা করে দিতে হবে। ভোরবেলা পড়তে বসার পর ওটা ওর চাই-ই। একটু পরে হয়ত বলবে, মা চা দিলে না! সুজল কোর্টে যাবে। সকাল দশটা বাজলেই ও বেরিয়ে পড়ে। ভাত খেয়ে-ই যায়। রান্না বসাতে হবে। মেয়ে, স্বামী নিয়ে জাগরির এখন সুখী সংসার। বাড়ি, গাড়ি কি নেই। সুজল যথেষ্ট কেয়ারিং।শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ইনকাম ট্যাক্স ল ইয়ার এখন ও। যা চেয়েছিল তার চেয়ে যথেষ্ট বেশি পেয়েছে। কেন ভাবছে এত! স্বার্থপর একটা পুরুষকে নিয়ে। কেন সময় নষ্ট করছে, স্বামী-সন্তানের কথা ভুলে, বহু পিছনে ফেলে-আসা অতীতের একটা ছোট্ট অংশকে নিয়ে।
আজ স্কুলে যেতে হবে। ছুটি নেওয়ার উপায় নেই। স্কুলে আজ থেকে তৃতীয় ফরমেটিভ পরীক্ষা শুরু হবে। মেয়েটা কলেজে যাবে। জাগরি উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। বিছানার মাথার দিকে পূব পাশের জানলাটা খুলে দেয়। সারাটা বিছানায় হেমন্তের হালকা মিষ্টি হলুদ রোদ ছড়িয়ে পড়ে। হালকা একটা ঠান্ডার অনুভূতি হয় জাগরির। সুজলের গায়ের থেকে সরে-যাওয়া চাদরটা ঠিক করে দিয়ে জাগরি এগিয়ে যায় বাইরের দরজাটা খুলবে বলে। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে ফেলে আসা ছোট্ট অতীত।
বহমান
জনা বন্দ্যোপাধ্যায়
মনোহালী গ্রামের মানদাসুন্দরীকে আশে পাশের গ্রামের লোকজন এক ডাকে চেনেন। তাঁর রক্ষা কালীর ভড় হয় প্রতি শনিবার। প্রায় চল্লিশ বছর বয়স, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ, কোমর পর্যন্ত চুল, শ্যামলা রঙ হলেও লাবণ্যময়ী, পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি--দেবী মূর্তিই বটে! মানদাসুন্দরীর পরিবার আগে হোগলা পাতার ঘরে থাকতেন। তাঁর স্বামী হরনাথ ভাগচাষী ছিলেন। প্রায় দিন তাঁর কাজ থাকতনা। মনোহালী গ্রামের পাশ দিয়ে পুনর্ভবা নদী বয়ে চলেছে। জঙ্গলের পর জঙ্গল ছিল এই এলাকায়। ঊনবিংশ শতকের শেষে ব্রিটিশ আমলে মনোহালী গ্রামে একটিই পাকা বাড়ি ছিল তারাচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত। তর্করত্ন, তর্ক বিশারদ, ন্যায়রত্ন ইত্যাদি উপাধি পেয়েছেন। এই গ্রামের জমিদার হিসাবে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য জনপ্রিয় হয়েছেন। বর্ধমানের রাজাই তাঁকে দক্ষিণ দিনাজপুরের এই গ্রাম শাসনের ভার দিয়েছেন।
কয়েক বছর আগে মনোহালী গ্রামে ডাকাতদের উপদ্রবের কথা সকলেই জানে। যদু ডাকাত একদিন তার দল নিয়ে মানদাসুন্দরীর ঘরে হানা দেয়। সময়টা ছিল বর্ষাকাল। আকাশে ক্রমাগত বিদ্যুৎ আর বজ্রপাত চলছে। মানদাসুন্দরীর স্বামী হরনাথ আর কিশোর পুত্র সুবল অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মানদাসুন্দরী সংসারের সব কাজ মিটিয়ে সবে মাত্র শুয়েছেন। যদু ডাকাত দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়। মশাল হাতে ঘরে ঢোকে যদু ডাকাত। মানদাসুন্দরীর ঘুম ভেঙে যায়।
"কে এত রাতে?"
উঠে দাঁড়ান তিনি। যদু ডাকাত মুহূর্তের জন্য দেখেন ঘরে যেন মা রক্ষা কালী দাঁড়িয়ে আছেন। যদু ডাকাতের দল বাইরে অপেক্ষা করছিল। যদু ডাকাত মশাল ঘরের কোণে রেখে হাত জোড় করে দাঁড়ায়। চোখের ভুল নাকি মনের ভুল এ কথা বিচার করার সময় পায়না। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। বাইরে বেরিয়ে এসে দলকে বলে, "মা নির্দেশ দিয়েছেন ডাকাতি ছেড়ে দিতে। চল তোরা ফিরে চল।"
মত্ত হাতীর মতো তেজী, কঠিন প্রাণ বিরাট চেহারার লোকটি মুহূর্তে কি করে এতটা বদলে গেল দলের কেউই বোঝেনা!
মানদাসুন্দরীর নিকোনো উঠোনের এক পাশে বটতলায় মা রক্ষা কালীর থান ও ঘট পাতা। প্রতি শনিবার আরতি করতে করতে মানদাসুন্দরী ঘেমে ওঠেন। জোরে জোরে শ্বাস পড়ে। এক সময় চোখ বুজে বসে পড়েন। ভক্তের দল ভিড় করে। একে একে সকলে তাঁদের সমস্যার কথা বলেন। ধূপ ও প্রদীপে ওই স্থান পবিত্র হয়ে ওঠে। মানদাসুন্দরী চোখ বন্ধ করেই সকলকে তাঁদের সমস্যা সমাধানের পথ বলে দেন। ধুনুচিতে ধুনো পোড়া তুলে রক্ষা কালীর আশীর্বাদ স্বরূপ ভক্তদের হাতে দেন। বিশ্বাস বড় ব্যাপার। যাঁরা আসেন, তাঁরা মানদাসুন্দরীর অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন। মানদাসুন্দরী ভক্তদের থেকে কোন প্রণামীর টাকা নেননা। কেউ কেউ ধূপ ও জবার মালা থানে দেন।
গ্রামের জমিদার মানদাসুন্দরীর স্বামী হরনাথকে চাষের জন্য জমি দেন । তাই তাঁদের হোগলাপাতার ঘরের পাশে একটি পাকা ঘর উঠেছে। গোলায় ধান, সংসারের অভাব মিটেছে।
আজ যদু ডাকাত মানদাসুন্দরীর সব থেকে বড় ভক্ত। যদু ডাকাত ও তার দল চাষের কাজের জন্য জমিদার তারাচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে জমি পেয়েছে। তারা সৎপথে উপার্জন করে। আগে ডাকাতির সময় তান্ত্রিক বিপিনচন্দ্রের ডেরায় মা কালীর আশীর্বাদ নিতে যেত। তাদের লুন্ঠিত ধনের ভাগ বিপিনচন্দ্রও পেত। কিন্তু এখন আর তারা বিপিনচন্দ্রের ডেরায় যায়না। বিপিনচন্দ্রের উপার্জনে টান পড়েছে। তাঁর ভিখিরি দশা। জমিদার তারাচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায় পন্ডিত ব্যক্তি। তাঁর সদুপদেশ শুনে যদু ডাকাতদের ভালোই হয়েছে।
গত দু বছরে মনোহালী গ্রামে চাষের ফলন বেশ ভালো। জমিদার মহাশয়ের উদ্যোগে গ্রামে মাইলের পর মাইল জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়েছে। চাষের জমি গ্রামের লোকেদের দানপত্রও করা হয়েছে। জমিদার তারাচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায় অল্প সুদে প্রজাদের অর্থ ধার দিতে শুরু করেন, যাতে গ্রামের প্রজারা কাঁচামাল কিনে স্বাবলম্বী হয়। এভাবে জমিদারের আয়ও বাড়ে। কেটে যায় বেশ কিছু বছর।
জমিদারের দুই পুত্র সুরেশচন্দ্র ও যোগেশচন্দ্র ধীরে ধীরে তরুণ হয়ে ওঠেন। তাঁরা ক্রমে জমিদারীর কাজ বুঝে নেন ও দ্বিতল প্রাসাদ নির্মাণ করেন। সুদৃশ্য দুর্গামণ্ডপটি যোগেশচন্দ্রর দিকে নির্মিত হয়। বাড়ি তৈরীর নির্মাণ সামগ্রী যেমন লোহার কড়ি বরগা ইংল্যান্ড থেকে নদী পথে আসে। পুনর্ভবা নদীর ঘাটে সেই সব মালপত্র নামানো হয়। জমিদার বাড়ির স্তম্ভের গায়ে, দেওয়ালে, খিলানে সুন্দর পঙ্খর কাজ চোখে পড়ার মতো। ছাদের বিমের জয়েন্টে মোটা মোটা শিলের ব্যবহার লক্ষিত হয়। সব মিলিয়ে সুন্দর জমিদার বাড়িটি গ্রামের লোকেদের গর্ব।
কুলদেবী মা ইচ্ছাময়ীর মূর্তিটি নির্মাণ করেন দাইহাটের নামী শিল্পী নবীন ভাস্কর। নবীন ভাস্কর দক্ষিনেশ্বরের ভবতারিণী মূর্তি নির্মাণ করে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। মনোহালী গ্রামের জমিদার বাড়ির কুলদেবীর মন্দিরটি ওই বাড়ির সংলগ্ন স্থানে নির্মিত। দুবেলা নিত্য পূজা করেন পুরোহিত নিতাইচরণ মুখুজ্জে। মায়ের বিগ্রহের ভুবনমোহিনী সালংকারা রূপ দেখার মতো। কালো কষ্টি পাথরের মূর্তি। বালা, বাউটি, চূড়, বাজুবন্ধ, সীতাহার মোটা বিছে হার ইত্যাদি অলংকারগুলি মাকে সুন্দর মানিয়েছে।
সময়টা হেমন্তের শেষ। পাতা ঝরা রুক্ষ হাওয়া, শীত বেশ ভালোই পড়েছে। একদিন সন্ধ্যেবেলা মায়ের পুজোর সময় তান্ত্রিক বিপিনচন্দ্র লুকিয়ে মায়ের বিগ্রহ লক্ষ্য করে অলংকারগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এক শনিবার অমাবস্যা দেখে চুরি করার ফন্দি আঁটে। সেই শনিবার সন্ধ্যারতির পর নিতাইচরণ মন্দির থেকে বেরিয়ে মন্দিরের দরজায় তালা চাবি দেন। তাঁর বয়স প্রায় বাষট্টি। এই গ্রামে কয়েকজনের বাড়িতে পুজো করেই সারা জীবন কেটেছে। মানুষটা সৎ ও অকৃতদার। অবশেষে জমিদার তারাচাঁদবাবু কুলদেবীর মন্দিরে পুজোর জন্য তাঁকে ডেকে পাঠান। কুলদেবীর পুজোর ভার দেন তাঁকে। শীর্ণকায়, বেঁটেখাটো, কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ নিতাইচরণের। মন্দির থেকে বেরিয়ে গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরেন তিনি। একটু পরেই তান্ত্রিক বিপিনচন্দ্র এসে দাঁড়ায় মন্দিরের সামনে। ফতুয়া ও ময়লা ধুতির ওপর শতচ্ছিন্ন চাদর। কাঁধে একটি ঝোলা। ঘাড় পর্যন্ত এলোমেলো লম্বা চুল, লম্বা দাড়ি, কুটিল মুখমন্ডল, ঘোলাটে দৃষ্টি, বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন হবে। চেহারায় অভাবের ছাপ স্পষ্ট।শীতকালের নিশুতি রাত। লোকচলাচল নেই। একটা বড় থান ইঁট দিয়ে তালা ভাঙতে বেশীক্ষণ সময় লাগেনা তার। রেখা দেউল মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে মোমের আলোয় মায়ের বিগ্রহের অলংকারগুলোর দিকে তাকিয়ে লোভে চোখ চকচক করে ওঠে বিপিনচন্দ্রের। মোমবাতির আলোয় সে লক্ষ্য করে মা কালীর মুখটা ঠিক যেন মানদাসুন্দরীর মতো। মানদাসুন্দরী উজ্জ্বল চোখে যেন চেয়ে আছেন বিপিনচন্দ্রের দিকে। উদ্ভাসিত আলো ছড়িয়ে পড়েছে মুখে। চমকে ওঠে বিপিনচন্দ্র। বিশ্বাস হয়না তার। কয়েক মিনিট এই ভাবে অতিক্রান্ত হলে মাটিতে পড়ে যায় বিপিনচন্দ্র। পরদিন তার মৃতদেহ মন্দিরের গর্ভগৃহে পাওয়া যায়। সকলে জানতে পারে স্ট্রোকে মারা গেছে বিপিনচন্দ্র। তার চুরির উদ্দেশ্য গ্রামের কারোর জানতে বাকি থাকেনা। ইদানীং মাঝে মধ্যেই বিপিনচন্দ্র গ্রামের লোকেদের থেকে টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দিতনা। অনেকেই বলে তার লোভের শাস্তি হয়েছে। মনোহালী গ্রামের জমিদার বাড়ি ও কুলদেবী ইচ্ছাময়ী মায়ের মন্দিরের কথা দূর দূরান্তের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে।
রম্য রচনা
লেখাপড়া
বিনয় বর্মন
১
বাণী বন্দনার দিনটা আমার কাছে আর পাঁচটা দিনের চেয়ে আলাদা নয় l রোজই আমার বাণী লাভ এবং বাণী বন্দনা দিয়ে দিন শুরু হয়। কারণ গিন্নির নামই বাণী !
রোজ সকালেই আমি তাকে প্রাতঃপ্রণাম করি , যিনি গিন্নির নামকরণ করেছিলেন l এমন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ব্যক্তি অবশ্যই প্রাতঃসরণীয় !
সকালবেলা ৩০ কেজি বাচ্চা মেয়ের পিঠে দশ কেজির স্কুল ব্যাগটা তুলে দেওয়ার সময় যখন বলি , "এত ভারী ব্যাগ ! " , গিন্নি ঝাজিয়ে ওঠেন l "এখন লেখাপড়া করতে হলে ওটুকু ভার বহন করতেই হবে l না হলে আমার মতো সারা জীবন এই ভার বহন করতে হবে ! ...." বলেই আমার দিকে কড়া চোখে তাকায় সে l
নিজের ভার নিয়ে ভারাক্রান্ত আমি ভারিক্কি গলায় বলি , "শুধু এই ভুঁড়িটুকু না থাকলে , এখনও আমি তোমার চেয়ে ফিট l সিক্স না হলেও কম বেশি কিছু প্যাক আমারও আছে ! ( যদিও নিন্দুকেরা বলে ওটা ফ্যামিলি প্যাক ! ) আর এসব কিন্তু লেখাপড়া করেও করেছি !
- লেখাপড়া !
শোনো , তোমাদের লেখাপড়া আর এখনকার লেখাপড়া এক নয়। শুধু ঘাড় গুজে পড়লেই চলে না এখন l স্মার্ট হতে হয় l চৌখস হতে হয় l দুনিয়াদারী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হয় l
- বটে !
সত্যিই তো পৃথিবীটা অনেক বদলে গেছে l আমিই শুধু ব্যাকডেটেড রয়ে গেছি l
২
সে এক যুগ ছিল অনুগল্প কিংবা পরমাণু কবিতারও আগে , যখন দুই মিনিটের একটা ভিডিওও স্কিপ না করে দেখার ধৈর্য আমাদের ছিল l লুকিয়ে বা প্রকাশ্যে কবিতা লেখেনি জীবনে , এমন স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে ( বাঙালি ) কমই আছে l
" তুই কিন্তু বেশ লিখিস " এমন বার খেয়ে দু চার লাইন লেখার অভিজ্ঞতা কম-বেশি হয়ত সবারই আছে!
*ফ্ল্যাশব্যাক টু ২০০১*
তখন বাণীর সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে সবে আলাপ হয়েছে l আলাপের সময়ও আমাদের গল্প জুড়ে আছে লেখালেখি l নতুন কোন লেখা প্রথমেই ওকে দেখাচ্ছি। "ও কি দারুন লিখেছো ! "
সবসময়ই পজিটিভ কমেন্ট প্রাপ্তি হচ্ছে l কিছুদিন নতুন কিছু না লিখলেই বলছে , " লিখছো না কেন ? লেখ লেখ l "
অবিশ্যি , তার ফাঁকে ফাঁকে তার নোটসগুলোও লিখিয়ে নিচ্ছে সে !
*কাট টু ২০২৩*
এখনো কিন্তু বাণী আমাকে লিখতেই বলে l
" লেখ , লেখ l চেকগুলো সাইন কর l ব্যাংকের ফর্ম গুলো লিখে ফেলো l ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্নটা লেখ l "
- আরে আমি একটা লেখা লিখছি ...
- পরে লিখবে ওসব ছাই পাস l এখন লেখালেখি বন্ধ কর তো l কি সব trash লিখতে থাকো ! নিজেও কি পড়ো ?
এইসব আজে বাজে কাজ বাদ দিয়ে মেয়েটাকে একটু পড়ালেও তো পারো l নাও ওর হোমটাস্কের অংকগুলো কর l
অতএব বেজার মুখে অংক নিয়ে বসি l ওয়ার্ড প্রবলেম l কিছুতেই আর উত্তর মেলেনা l মেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে , " মাম্মা , পাপার উত্তরগুলো মিলছে না l "
গিন্নি ঝাজিয়ে ওঠেন l
- কি ? একটা অংকও মেলাতে পারোনা !
বলি , " আসলে ঠিক পেনিট্রেট করতে পারছি না প্রবলেমটায় l"
- সে তুমি কোন খানেই পারো না ! ছাড়ো l ...
আর এই যে গাদা গুচ্ছের বই জমিয়েছো ওগুলো তাহলে কি জন্য ?
- ঘর সাজানোর জন্য l
নিজের নন্দনতত্ত্ব জাহির করি !
- এসব না পড়ে যদি শেয়ার , ইনভেস্টমেন্ট এসব নিয়ে একটু পড়াশুনা করতে ! ... আমার স্কুলের মাস্টারমশাইরা সব লাখপতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে শেয়ার এ ইনভেস্ট করে ...
মহাজন বলেছেন , লার্নিং ইজ এ লাইফ লং প্রসেস ... যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি l আর wife মানেই বাই ডিফল্ট wise ! অতএব , সে আর আমি , তুমি - কল্পনা কবিতার কম্বিনেশন পারমুটেশন বাদ দিয়ে এখন শেয়ার এর পেয়ার নতুন করে শুরু করা ছাড়া গতি কি !
সরস্বতীর হাঁস তো হওয়া হলো না , যদি লক্ষীর পেঁচা হওয়া যায় !
কবিতা (পর্যায়-দুই)
ভাঙ্গাচোরা পৌষ
সৈকত দাম
এখনো বুঝি বাসন কোশন থেকে উঠে আসে ,
চেনা পৌষের গন্ধ ?!
এখনো বুঝি সাত সকালে উনুন জ্বলে দাউ দাউ ?!
ভাবনারা শীতের গায়ে আঁচড় কাঁটে আর মনে পরে যায় আর তো কিছু নেই ......
হারিয়ে গেছে বাসন, নিভে গেছে উনুন কবে ,
ওখানে থাকলে হাজির হোতাম পিঠে পুলি উৎসবে .....
হয়তো হাত পেতেছি এক সাথে ,
ছেলে আর আমি, পিঠে পরতো এক পাতে .....
তাকিয়ে থাকতাম ভীষন অবাক দৃষ্টিতে ......
আমিও দিতাম তাকে পৌষের উপহার ,
পিঠের গন্ধে ভুলে যেতাম আসলে ভুল কার .....
আজ এখন মন্দির চত্বরে ,
প্রিয় জোৎস্না ঝরে পরে .....
আঁধো আঁধো ঘুমে চোখ ভিজে যায় কুয়াশায় ....
শেষ জীবনে এ কেমন ইচ্ছে হয় !
ক্ষীরের সাগর পার করে আসা মন ,
চাইছে কি আজ ? কিসের উত্তরণ ?
পুকুর ঘাটে জেগে ওঠে ঘ্রাণ ,
কিসের মন্ত্রে সঞ্জীবনী বলে ,
এতকাল পরে এতো ঘোলা ঘোলা জলে ,
স্বপ্নের এই ভাঙা আর গড়া চলে .......
শ্মশান-মশান
রূপক রায়
আমার মনের ভেতর
শিবের প্রলয় নৃত্য
ডমরু বাজিয়ে
সব ধ্বংস করে
জ্বালিয়ে দিচ্ছে আগুনে
সব স্মৃতি পুড়ে ছাই
মহাশ্মশানে ।
খুন,আত্মহত্যা নয়
জল-জ্যান্ত মার্ডার করে
লোপাট করে দিলো !
দিনের অন্ধকারে ,...
মানবিকতা বেঁচে আছে
সারণ ভাদুড়ী
আকাশ আজ মুক্ত হলো,
তাতে নেই কোনো প্রশ্নচিহ্ন
অসম্ভব কি তবে আজ সম্ভব হলো ?
অ্যাসিড বৃষ্টির জল ধুঁয়ে যাওয়া বাগানে
তবে কি আজ ফুল ফুটল?
তবে কি নেরোনিয়ানের আকাশবাণী আজ মিথ্যে?
হ্যাঁ, তা মিথ্যে!
তার ধারণা মিথ্যে
সমাজে এখনও বেঁচে আছে মানবিকতা - ভালোবাসা
তার স্বরুপেই আজ হয়তো ফুটেছে
সেই বাগানে গোলাপ........
অশনি সংকেত
সঞ্জয় সাহা (এস.সাহা)
শ্রাবনের অশ্রু ধারায়,
প্রকৃতি সেজেছে আজ অন্য রূপে |
করবী গাছের ফুল গুলো আজ
ফুঁটতে ভুলে গেছে |
আহা কী মিষ্টি সোনালি রঙের রোদ,
আজ ফিকে হয়ে গেছে |
সোনালী আভায় যে দিত রঙের ছটা,
আজ সে হাসতে ভুলে গেছে |
চলে গেছে সেই দিন,
নেই আজ আর কোকিল এর ছন্দ l
লোভের ছলনায় কে যেন দিচ্ছে ডাক,
বিদায় সুরের বেলায় l
ঝক্ ঝকে্ রোদে যেন আজ,
বিষ মাখানো কঠিন অসুখে মন খারাপের দিন,
শুনছি অশনি সংকেত.......
"বাজে বিদায় সুর" দুঃস্বপ্ন অন্তহীন |
অথচ তুমি এলে
সুনন্দ মন্ডল
কারও পৌষ মাস!
কথাটা কেমন যেন সত্যি হল।
কিন্তু চোখে দেখি না
তোমাকে।
তুমি খুব কাছে
মাঘের হিমানী মেখে বসন্ত
গন্ধ ছড়ায় এ রাজ্যে।
বসন্ত সখার মত ঘুম জড়ানো চোখে
আদর মাখা ফুলের সোহাগ হয়ে
ছুঁয়ে গেলে কপাল।
তবুও দেখি না তোমাকে।
অথচ তুমি এলে,
তুমি এলে আঁধার ঘরের আলো হয়ে
স্বপ্ন সুন্দরী হয়ে
নির্লিপ্ত হৃদয়ের উষ্ণতার পারদ হয়ে
একবিন্দু শিশির হয়ে
তুমি এলে
এত কাছে
অথচ দেখি না তোমাকে!
ছড়া
রোজ্ ডে
(৭ ফেব্রুয়ারী)
মাথুর দাস
"রোজ রোজ 'রোজ্ ডে'
কেন বলো হয় না !",
বলছিল গোলাপের পসারিণী
ও'পাড়ার ময়না ।
"রোজ্ ডে-তে ভোজ খাও
প্রেম-প্রেম নাটকে,
তারপর ঘোরতর কলহে
কেউ যাও ফাটকে ।
দিন ক্ষণ পালনে তবু
বাড়ে কিছু কারবার,
গোলাপের ফুল বেচে
হয় ভালো রোজগার ।
রোজ রোজ 'রোজ্ ডে'
আহা কেন হয় না !"
আক্ষেপে বিহ্বল
গোলাপের পসারিণী ময়না।
অর্থ বদল
লীনা রায়
দু' দুটো দিন পেরিয়ে গেছে
ভীড়ের মাঝে একলা হয়ে,
নতুন শাড়ী গয়না -গাটি
সিঁদুর শাঁখা আলতা পায়ে।
শীতের নরম রোদের খেলা
শিকল তোলা দুপুর দোরে ,
খুলছে আগল তুবড়ি কথা
জল থৈ থৈ হাসির তোড়ে।
শব্দ হাসির হল্লা ছোটে
ঘর পেরিয়ে অন্য ঘরে,
ছন্দ কাটে খুশির হাটে
সাঁঝের আঁধার আছড়ে পরে।
নতুন ছবি আয়না জুড়ে
সিঁদুর শাঁখায় ঘোমটা টেনে,
মুক্তো হাসি আদব হারায়
কয়েক দিনেই বদলে মানে।
ফেটেছে ঠোঁট ভেঙেছে মনমজনু মিয়া
তুমি বিহীন হে তপন, তাপ গিয়েছে কমে
রাতের শিশির পাতার ডগায় আছে জমে।
উষ্ণতা হারিয়ে গেছে এই শুষ্ক ঠাণ্ডা বায়ে
চরচর করে ঠোঁট ফেটেছে লোম খাঁড়া গায়ে।
অনাথবন্ধু তুমি প্রভু, নির্দয় হইও না এমন আর
জ্বালিয়ে দাও রবির আলো বন্ধ হোক চিৎকার।
পথের ধারে পড়ে থাকা মানুষ গুলোর দিকে
চাওয়া যায় না! বন্য প্রাণীর চেয়ে নগণ্য ফিকে।
ভেঙেছে মন আঁধার যখন নেমেছে ধরাধামে
তুমি ছাড়া কে পারে বলো? বলে নরাধমে-
সরিয়ে দিতে কুয়াশার জাল শীতের আড়ষ্টতা
মানুষ বাঁচুক সুন্দরভাবে পাক খোঁজে স্পষ্টতা।
ছবি
শিল্পী- আকাশলীনা ঢোল
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৯
No comments:
Post a Comment