মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
আমার মা
গৌতমকুমার ভাদুড়ি
আমার মা খুব মিথ্যে কথা বলতেন।
মা সম্পর্কে ডায়েরির পাতায় দুচার লাইন আর ফেসবুকের বাক্সে দুর্লভ মুহূর্তের দু’একখানা ছবি পোস্ট করার কালচারে আমরা এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে ফরমায়েশি কিছু কথা বলবার জন্য আমন্ত্রণ পাওয়াটা অনেকের মতো আমার কাছেও খুবই উত্তেজনার, আবেগেরও বটে। তবে একটা কথা খুব সত্যি যে আমাদের মতো সন্তানদের মায়েরা, অর্থাৎ আমরা যারা ডবল সাবালকত্বকেও বহুদিন অতিক্রম করেছি এবং স্বাভাবিক নিয়মে মাতৃহারাও হয়েছি, তাদের প্রত্যেকের মায়েরাই প্রায় একই রকম ছিলেন। সেসব মায়েদের ঘরে বাইরে কত যে সন্তান ছিল তার গোনাগুনতি ছিলনা কোনও। কিন্তু একান্তভাবে নিজের মা সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে শুরুটা করেছিলাম তা থেকে বিচ্যুত হলে চলবে কেন? সত্যিই আমার মা খুব মিথ্যে কথা বলতেন।
আমাদের শৈশবে মুখ্যত বাবার কাকা এক উকিলদাদুর কারণে আমাদের পরিবারেও পুজোআচ্চার পাশাপাশি জবরদস্তি কিছু সংস্কার চালু ছিল। প্রকাশ্যে আমরা কোনও অব্রাহ্মণ বয়স্ককে প্রণাম করতে পারতাম না, তিনিই গ্রহণ করতেন না। খেতে বসে কথা বলা নিষেধ ছিল ইত্যাদি। বিশেষভাবে রান্নাঘরে বর্ণনির্বিশেষ অবাধ বিচরণ গর্হিত বিবেচিত হত। মা এই কঠিন বিধিনিষেধগুলোকে একটু একটু করে মুছে দেবার চেষ্টা করত।
আমার বন্ধু ছিল বাবলা।বলা নেই কওয়া নেই, সে মাঝে মাঝেই চলে আসত আমাদের বাড়িতে, একেবারে খাবার সময়।তখন আমরা মেঝেতে পিঁড়ি পেতে খেতে বসতাম।দাদু প্রায়ই স্নান সেরে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে আমাদের খাওয়া দেখতেন। আমাদের দুটো কাকুও ছিল অনেকটা দাদুর ধাঁচে মানুষ।মাঝে মাঝে সমীর নামে একটি ছেলেও রান্নাঘরে আমাদের সঙ্গে বসে খেত, সে আমার ক্লাসমেট।মা তাদের বাবা বাবা বলে খাওয়াচ্ছে, বাবলা,সমীর সম্বোধন করে খুব হাঁকডাক তাদেরকে।যেন আমাদের মামাবাড়িরই কেউ তারা,সেটা মা সারাক্ষণই বুঝিয়ে দিত।দাদুর সন্দেহ না হয় তাই গল্পে গল্পে জানিয়ে দিত ওরা দুজনেই ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে। প্রকৃত পরিচয়ে ওরা দুজনেই কিন্তু যথাক্রমে আমজাদ হোসেন এবং আওলাদ হোসেন। এখনও তাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সেদিনের মতোই আছে।আমাদের ধার্মিক দাদু এবং কাকুরা এখন স্বর্গে আছেন। মাও বছর কয় আগে স্থানান্তরিত হয়েছে, কেবল মার এই মিথ্যে বলাটা তাঁরা কেউ ধরতে পারেননি।
আর একজন ছিলেন কাশেমালি দাদু। তিনি মাকে ঠাকুরঝি বলে ডাকতেন। তখনকার দিনে কিছু কিছু মানুষকে চা দেবার সময় তাদের জন্য নির্ধারিত কাপ ব্যবহার করার রেওয়াজ ছিল। মা কাশেমালি দাদুকে নিজের কাপেই চা দিত, বলত, বুড়ো মানুষ ,কদিনই বা বাঁচবে, আমি তো স্নানের সময় সব কাপই নিজে হাতে মেজে আনব। এটা সেসময়ে অনেকটাই ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে গণ্য হত।পাড়া জুড়ে অনেক বাড়িতেই মাকে তখন ভোগ রান্নার জন্য ডেকে নিয়ে যেত। কাশেমালি দাদু মার কাপে চা খাওয়ার ব্যাপারটা সম্ভবত একসময় সামান্য গুঞ্জন তুলেছিল।উপোস থেকে স্নান করে ভোগ রান্নায় কোনও দোষ নেই মার হয়ে বাবা সেটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজকের অস্থির সময়ের প্রেক্ষিতে মার এই কাজগুলোকে খুব মনে পড়ে।
আমরা তখন আজকের চেয়ে আরও অনেকটাই আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যে দিন কাটাতাম।তবে আমাদের চাইতেও গরিব পরিবার যে ছিল না তা নয়।মা কষ্ট করে হলেও দৈনিক রান্নার সময় খানিকটা চাল বেশি নিত।বলত ভাতটা একটু বেশি থাকলে ডাল তরকারি কোনদিন কম পড়ে না । আর আমাদের এমনই ভাগ্য ছিল যে প্রতিদিন একজন অন্তত অতিথি বাড়িতে আসবেই সে আমার বন্ধুবান্ধব হোক কি বাবার কাছে পরামর্শ নিতে আসা গ্রামের মানুষই হোক। মা তখন নিজের বুদ্ধির তারিফ নিজেই করত, ভাগ্যিস তখন চালটুকু বেশি নিয়েছিলাম। এই দুপুরে একটা মানুষ না খেয়ে গেলে সেটা খুব খারাপ হত। নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল এটা আমাদের ছেলেবেলায়।
মার ছিল সিনেমা দেখার দারুণ নেশা।বেশির ভাগই ম্যাটিনি শো দেখতে যেত নিউ সিনেমায়। আমাদের দিদিমা এবং মার দু তিনটে সাগরেদ ছিল সিনেমাযাত্রী দলে।আমি বাড়ির বড়ো ছেলে, সব দেখেশুনে রাখার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে মা খুব নিশ্চিন্তে যেত সিনেমা হলে।হাউসফুল হলেও কেমন করে যেন টিকিট যোগাড় করে ফেলত সবার জন্য। তখন টিকিট ব্ল্যাক হত। কোন একজন ব্ল্যাকার মাকে বিশেষ করে আমাদের দিদিমাকে খুব পছন্দ করত।বাবা বাবা করে আদর করে তার কাছ থেকে টিকিট পেত অনায়াসে। খুব মস্তান ছিল সেই ব্ল্যাকার।মা ছিল তার মাসিমা। আমরা তখনও সিনেমা দেখতে যেতাম না।তবে মা যেদিন করে সিনেমায় যেত,আমাকে ঘুষ দিত, আমি যেন কাউকে বিশেষ করে বাবাকে না জানাই। দশ কুড়ি পয়সা উপার্জন বাঁধা ছিল।
আমাদের ছোটবেলায় মাকে দেখেছি প্রায় সারাক্ষণই কিছু না কিছু আবৃত্তি করতে।মহাভারত থেকে অনর্গল কাহিনী বলে যেত সুর করে। আমরা রান্নাঘরে বসে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেসব শুনতাম। আমাদেরও মুখস্থ হয়ে গেছিল অনেকগুলো জায়গা। আসলে মাকে বিকেলি আসরে অনেকের মাঝখানে পাঠ করতে হত, রোটেশনে যদিও সবাই পাঠ করত তবু মহাভারতখানা আমাদের বলে মার মুখস্থ করবার দায়িত্ব বেশি ছিল।রাত জেগেও মুখস্থ করতে দেখেছি।
আমার সম্পর্কে মার একটা খুব উচ্চ ধারণা ছিল। একেবারে শেষদিকে মা যখন প্রায় শয্যাশায়ী তখন ডাক্তারের চাইতেও আমাকেই বেশি ভরসা ছিল মার।আমি যা বলব সেটাই ঠিক।এমনকি ভূমিকম্প থামিয়ে দেবার ক্ষমতাও যে একমাত্র আমারই আছে মা সেটা বিশ্বাস করত।তখন ভূমিকম্পটা একটু বেশিই হচ্ছিল আমাদের এদিকে। মা বলত ,আজ তুই বাইরে যাস না,যদি ভুমিকম্প হয়! আমি সাহস দিয়ে বলতাম এই শঙ্খটা কাছে রাখো, ভূমিকম্পের আভাস পেলেই আমি অফিস বন্ধ করে চলে আসব। বাড়ি ফিরলে প্রথমেই বলত, তুই এসে গেছিস আর চিন্তা নেই।বলে শঙ্খটা ফেরত দিত।আমার উপস্থিতিতে ভূমিকম্প হলে আমি মাকে নিয়ে একটা দরজার চৌকাঠের তলায় দাঁড়াতাম।মা খুব শক্ত করে ধরে থাকত আমাকে, আর আমি মন্ত্র পড়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ভূমিকম্প থামিয়ে দিতাম।বলত, এই জন্যই তোকে বাইরে যেতে দিইনা। আজ তুই না থাকলে সবার যে কি সর্বনাশ হত!এবং যথারীতি ভূমিকম্পের পর মার ইচ্ছায় আমরা সবাই চা খেতাম, সে দিন-রাত যাই হোক না কেন। মাঝ রাত্তির হলেও আমাকেই চা করতে হত।তখন সবাই খুব হৈহুল্লোড় করতাম আমরা। আমার কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করায় মার সে কি প্রয়াস !
জীবনের শেষ দিনেও মা মিথ্যে বলা ছাড়তে পারেনি। মার আয়ারা মাকে খুব শোষণ করত। তারা দুঃখের কথা বলে মার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে চাইত। মা রোজই বলত, সেদিন যে দশ টাকা দিলি,ওষুধ এনে ফুরিয়ে গেছে, আরও দশ টাকা দিবি বাবা? দিতাম। দুদিন বাদে আবার দশ টাকা। পরে দেখি আমারই নতুন নোট দিয়ে আয়ামাসি জর্দাপান কিনছে।অনেকবার ধরেছি হাতেনাতে,কিন্তু কি আর করব, গরিব মানুষ ,আর কতই বা নেয় অমন করে।উলটে খুশিই হতাম মার মিথ্যে বলায়।
মাকে নিয়ে লেখা একটি কবিতায় একদিন এই মিথ্যের প্রসঙ্গেই লিখেছিলাম -
তারপর একদিন সেজেগুঁজে হাসপাতালে রওনা হল
আমাদের মা।
দুদিনেই ফিরে আসব বলেছিল যাবার সময়
মিথ্যে কথা বলেছিল সেটা।
সারাজীবন মিথ্যে কথাই বলেছিল মা ।
এটুকুই বলবার সৌভাগ্য হল অনেকের জেঠিমা, অনেকের মাসিমা অনেকের বৌমা সেই মানুষটির কথা। আমার মা।
No comments:
Post a Comment