মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
মাতৃত্ব
সুজাতা কর
প্রায় আট বছর পর পুজোতে বাড়ি আসছি। অনেক বছর বাড়ি আসা হয়নি সংসারের ঝামেলায়। মেয়ের পড়াশোনা- বিয়ে, বাড়ির পোষা কুকুর লিওর দেখভাল। লিও খুব ভীতু কুকুর। অচেনা মানুষ দেখলে ভয়ে ঘর নোংরা করে ফেলে অথচ লাগাতার চেঁচাতেও থাকবে। সেইজন্য কোথাও ওকে পাঠানো যায় না। আমরা বুঝি ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ও রাস্তা থেকে তুলে আনা। সবসময় ভয় পায় আমরাও বোধহয় একদিন ওকে তাড়িয়ে দেব। সবাইকে ভালো রাখতে গেলে সবসময় নিজের আর ভালো থাকা হয় না। মাকে অনেক বছর দেখিনি। আগে মা আসত আমার কাছে। এখন শরীর ভেঙে পড়েছে। আসতে পারে না। এবার আসার সময়ই ঠিক করে এসেছি সব বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করব। নীলের সঙ্গেও। নীল আমার ছোটবেলার বন্ধু।
আমি এখন ষাট। জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি। হয়ত খুব বেশি সময় হাতে আর নেই। পুরোনো কিছু কথা যা বলা হয়ে ওঠেনি, যা বলতে পারলে সে সময় ভালো লাগত, এখন সেগুলো বলে দিতে চাই। নীলও ষাট। দু'মাস হল অবসর নিয়েছে। ওর সঙ্গে দেখা করব এবার। কারণ আমার মা সেটাই চায়।
ট্রেন থেকে নেমে একটা টোটো ধরলাম। দূর থেকে দেখছি হাউসকোট পরে লাঠিতে ভর দিয়ে মা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। টোটো দাঁড়াতেই মা হাত বাড়াল। জড়িয়ে ধরলাম। দু'জনেরই আনন্দে চোখে জল এসে গেল। বাড়িতে ঢুকে দেখি পরিচ্ছন্ন টেবিলে ফ্লাস্ক, চায়ের কাপ আর আমার প্রিয় বেকারির নারকেল বিস্কুট। ভাই বউ স্কুলে গেছে। সাজিয়ে রেখে গেছে যাতে মার কোনো কষ্ট না হয়। আমি চটপট পরিস্কার হয়ে নিলাম। মা ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দিল। বিস্কুট এগিয়ে দিল। বসে চা খাচ্ছি, মা মাথায় হাত বোলাতে লাগল,"একেক সময় মনে হত আর বুঝি তোকে দেখতেই পাব না। তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।"
- সেকী কথা! কেন দেখা হত না, তুমি এখনো অনেক বছর বাঁচবে মা। তেমন কোনো অসুস্থতা তো তোমার নেই।
মা ম্লান হাসে,"যা স্নান করে আয়। জলখাবার খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে।"
-হ্যালো নীল, কেমন আছিস? পরশু তোর সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
-চলে আয় না বাড়িতে। রাতে খেয়ে ফিরবি।
-নারে নীল, সময় হবে না। আর বাড়িতে নয়, বাইরে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে দেখা করব। বিল আমি পে করব।
-কেন বলত?
-দরকার আছে নীল তোর সঙ্গে।
সন্ধ্যায় বসে আছি। মা মুখোমুখি বসে। ভাই বউ কফি আর পকোড়া দিয়ে গেছে। বলে গেছে,"কিছু দরকার হলেই ডেক দিদিভাই। আমি পাশের ঘরে স্কুলের খাতা দেখছি। তোমরা গল্প কর।" মা ব্যাগ খোলে। ফুল আঁকা খামে প্রায় দশটা চিঠি।
-নীল দিয়েছিল তোর বাবাকে। আমি জানতাম না। বাইরে দেখা করত তোর বাবার সঙ্গে।
চিঠিগুলো হাতে নিলাম। গন্ধ শুঁকলাম। চল্লিশ বছরে গন্ধ উড়ে গেছে। আমার প্রিয় রজনীগন্ধা পারফিউম স্প্রে করতাম চিঠিগুলোতে। শৌনককে লেখা দশটা চিঠি। প্রথম চিঠি খুললাম, পড়লাম, একটু হাসলাম। মায়ের থমথমে মুখ,"জানিস তো শৌনক এখন দিল্লিতে।"
-জানি না মা। জানার তো কোনো দরকার নেই। মা বলে,"আমি এর বিন্দুবিসর্গ জানতাম না। নীল তোর বন্ধু। বাড়িতে আসত। তলে তলে যে সে তোর জীবন ধ্বংস করার মতলব আঁটছে, জানতাম না। এই চিঠিগুলো তুই নীলকে দিতি শৌনককে দেওয়ার জন্য আর নীল তুলে দিত তোর বাবার হাতে। প্রতিটা চিঠি খুলে পড়ত তোর বাবা। তোকে কোনদিন বুঝতে দেয়নি, আমাকেও না। তারপর সাত তাড়াতাড়ি তোর বিয়ে দিয়ে দিল। তুই কি সুখী হয়েছিস?"
-তুমি কি সুখী হয়েছিলে মা? বাবার যত শাসন তোমার আমার জন্য ছিল। নিজের জন্য বাবার ছিল অন্য নিয়ম, অন্য ভাবনা। শান্তি কাকিমার সঙ্গে বাবার যে শুধু আত্মীয়তা নয়, তুমি-আমি বুঝতাম। কিন্তু আমরা যে পরজীবী। পরের অন্নে-অর্থে আমাদের প্রতিপালন। আমার খুব ভালো লাগে জান আজকালকার মেয়েদের দেখলে। আমার মেয়েকে দেখলে। ওকে আমি বুঝিয়েছি- ভালোবাসবে, বিয়ে করবে কিন্তু সব কিছু নিজে পায়ে দাঁড়িয়ে। কারো কাছ থেকে সারা জীবনের বিশ্বস্ততা আশা করবে না।
-ঠিক তাই। এই সত্যটা বুঝতে বুঝতে জীবন পার হয়ে গেল।
-তুমি কাউকে কখনো ভালোবেসেছ মা?
-তোর বাবাকেই তো। আমাদের প্রেমের বিয়ে ছিল।
-আচ্ছা! ওহো আজ জানলাম।
-সেইজন্যই আরো খারাপ লাগে। শৌনক এত ভালো ছেলে অথচ তোর বাবা বুঝল না। আজ শৌনককে বিয়ে করলে হয়ত তুই এত ভুগতি না।
-মা, এসব ছাড়। এবার পুজোয় তোমার আমার জন্য খয়েরি গাদোয়াল কিনেছি। সপ্তমীতে আমি-তুমি পরে বের হবো।
না, না, না মা প্রবল ভাবে মাথা নাড়তে থাকল। তুই জানিস আমি পুজোয় নতুন শাড়ি পরি না।
-কেন পর না মা? কেন?ছোটবেলাতে তুমি-বাবা বের হতে পুজোর বাজার করতে। আমার জন্য রং-বেরংয়ের জামা। চারদিনের চারটে। ভাইয়ের জন্যও তাই। বাবার শার্ট-প্যান্টের কাপড়। অথচ তোমার কিচ্ছু না। কেন এমনটা ছিল মা? কেন নিজের জন্য কিনতে না?
মা চোখ বন্ধ করে। তারপর আমার দিকে তাকায়,"সদ্য দেশভাগ হয়েছে তখন। বগুড়া থেকে আমরা এপারে এসেছি। তিন ভাইবোন আমরা। অনেক কষ্টে বাবা একটি চাকরি পেলেন। বাড়ি নেই, বাসন নেই, শীতের জামা-কাপড় নেই। সব নতুন করে শুরু করা। সামনে পুজো। খুব সস্তার জামা একটা করে বাবা এনে দিলেন আমাদের তিন ভাইবোনকে। মায়ের ট্রাঙ্কে রাখা একটা মাত্র রং ওঠা পুরোনো শাড়ি। মায়ের বয়স তখন ত্রিশ। মা বাবার কাছে বায়না ধরল তাকে একটা শাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য। বাবা কিছুতেই রাজি নন। সপ্তমীর সকালে মা কাঁদতে লাগল। ঠাকুর দেখতে যাওয়ার মত একটা শাড়ি তার নেই। কীভাবে সে বাচ্চাদের হাত ধরে বের হবে! বাবা এককথার মানুষ। না তো না। সেবার আর মায়ের ঠাকুর দর্শন হলো না। পরের বৈশাখে চতুর্থ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় মা মারা গেলেন। অপুষ্টি, রক্ত হীনতা।" মা আমার দিকে তাকায়, চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে,"এর পরও তুই আমায় বলবি নতুন শাড়ি পরতে? পরা যায়?"
আমি মায়ের হাতটা ধরি। মা আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে,"ক্ষমা করতে পারবি আমাকে? আমি বড় অসহায় ছিলাম যে তোর বিয়ের সময়।" আমি হাসি,"আমাদের মেয়েদের অবস্থা লিওর মত মা। বাড়ি আছে, খাদ্য আছে, ওষুধ আছে। কিন্তু কোন অধিকার নেই।" আমার ভায়ের মেয়ে হঠাৎ ঘরে ঢুকল,"পিসিমনি এই বাচ্চা মেয়েদের ছবি থেকে একজনকে পছন্দ কর।"
-কেন রে?
-আমি দত্তক নেব।
-কিন্তু তোর যে বিয়েই হয় নি!
-আমি ঠাম্মা, আমার মা, তোমার মত একজন মা হতে চাই পিসিমনি। বিয়ে? তেমন কাউকে পেলে নিশ্চয়ই করব।
আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। বিয়ের প্রতি বিশ্বাস ভাঙছে, সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাস ভাঙছে কিন্তু মাতৃত্বের প্রতি অটুট আস্থা বহমান।
No comments:
Post a Comment