মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
মা
মনোমিতা চক্রবর্তী
মা শব্দটা খুবই ছোট্ট একটা শব্দ, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ,সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সুখ- শান্তি, মায়া, মমতা আর এক আকাশ ভরসা ।
আসলে , মা হল পৃথিবীর সবচেয়ে দামি সম্পদ। মায়ের সাথে কোন কিছুরই তুলনা চলে না।
মা ,ছোটবেলায় তোমার মুখে একটা কথা শুনেছিলাম -
"মা নেই যার সংসার অরণ্য তার ,
দেখিলে মায়ের মুখ ঘুচে যায় সব দুখ। "
সত্যিই মা,তোমায় ছাড়া সংসার কল্পনাই করা যায় না ।
যাদের মা নেই তারাই বোঝে মাকে হারানোর যন্ত্রণা। প্রায় দু 'যুগ হতে চলল তোমায় একটু ছুঁইনি, তোমার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাইনি ।
আজ তুমি নেই তাই তোমায় হারানোর যন্ত্রণা কুরে কুরে খায় আমায়।
জানো মা তোমার কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে তোমার কষ্টের কথা গুলো ।সামান্য মধ্যবিত্ত পরিবারের হাতেগোনা কটা টাকায় সংসার চালাতে গিয়ে কিরকম হিমশিম খেয়ে যেতে তুমি। নিজের মা, দাদা, দিদি ,আত্মীয়-স্বজন সবার থেকে শত শত মাইল দূরে ভিনদেশে শুধুমাত্র শ্বশুরবাড়ির সবাইকে নিয়ে কত না দুঃখ কষ্ট বুকে চেপে রেখে হাসিমুখে সবার সাথে মানিয়ে চলতে।
হাজারটা সমস্যায় জড়িয়ে পড়লেও কিভাবে তুমি হাসিমুখে থাকতে ভাবলে আজও অবাক হয়ে যাই আমি। তখন ছোট ছিলাম মা তোমার কষ্টগুলো বুঝতাম না বলে অকারণেই তোমায় অনেক জ্বালাতাম। কখনো কখনও হয়তো বায়নাও করতাম।আবার কখনও হয়ত তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতাম ।কারণে অকারণে অবুঝের মত তোমার ওপর রাগ করতাম। কিন্তু বিশ্বাস কর মা মনে মনে খুব কষ্ট পেতাম তোমায় আঘাত করার জন্য। সবকিছুর জন্য তোমার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়ার ছিল কিন্তু সেই সুযোগটুকু তুমি দিলে কই?
খুব কষ্ট হয় মা এই ভেবে যে কোনদিনও তোমায় এতোটুকুও সুখ দিতে পারিনি ।আজ সামান্য হলেও আমি রোজগার করি। রোজগারের টাকায় তোমার অনেক ইচ্ছে পূরণ করার স্বপ্ন আমি দেখতাম ছোটবেলা থেকেই।
কিন্তু কি দুর্ভাগ্য আমার !তোমার সেই ইচ্ছা পূরন তো দূরের কথা একটা সুতো পর্যন্ত কিনে দিতে পারিনি । কিশোরী বয়সেই আমায় একলা ফেলে চলে গেলে।
পরপারে যাবার যে বড় তাড়া ছিল তোমার তাই না মা?
জানো মা তোমাকে খুব মনে পড়ে! আমাদের জন্য তোমার যত্ন করে রান্না করা ,ঘরদোর, পুরো বাড়ি নিজে হাতে তোমার গুছিয়ে রাখা, তোমার উঠোন ছাড় দেওয়া ,স্কুলের কর্মশিক্ষার কাজ গুলো করে দেওয়া,যত্ন করে মাথায় তেল দিয়ে চুল বেঁধে দেওয়া,মাথায় বিলি কেটে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো,সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও দিন শেষে তোমার হাসিমুখটা। কিংবা সারাদিন পরিশ্রম করার পরও গরমকালে লাইট চলে গেলে তালপাতার পাখায় বাতাস করে নিজে রাত জেগে আমাদের বাতাস করে আরামে ঘুমানোর সুযোগ করে দেওয়া। এই কথাগুলো মনে পড়লে নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয় মা।
জানো মা তোমাকে খুব খুব ভালোবাসি অথচ এই কথাটাই তোমায় কোনদিন বলাই হয়নি।।
যেদিন জানতে পারলাম তোমার লিভার ক্যান্সারের কথা খুব কেঁদেছিলাম আমরা ভাইবোনেরা। খুব কষ্ট হচ্ছিল , মনে হচ্ছিল মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল বুঝি !
বাবার নির্দেশ ছিল তোমার সামনে চোখের জল না ফেলার। বাবার কথামতো তোমার সামনে আমরা কাঁদিনি। তোমার সামনে আমরা দুর্বল না হওয়ার অভিনয় করেছিলাম। তোমার আড়ালে দিন রাত ভগবানকে ডাকতাম। তুমি যেন সুস্থ হয়ে ওঠো।
তুমি যেদিন চলে গেলে ঈশ্বরের উপর বিশ্বাসটা সেদিনই চলে গিয়েছিল।তোমার চলে যাওয়ার ছ 'মাস পরে বাবার যাওয়াটা মেনে নিতে পারিনি। তাইতো দীর্ঘদিন ঈশ্বরে বিশ্বাসই করিনি।
তবে কি জানো মা ঈশ্বরে বিশ্বাস আবার ফিরে এসেছিল যেদিন আমার কোল আলো করে আমার সন্তান এলো ।আমি মা হলাম।
এখন বুঝতে পারি মায়ের কাছে সন্তানের সুখই সব। সন্তানের মঙ্গলের জন্য ,কল্যাণের জন্য মা কিনা করতে পারে!
মা আমি তোমার মত হতে চাই ।কিন্তু হতে পারি কই?
তোমার মত ধৈর্যশীল, মানব দরদী ,ক্ষমাশীল হয়তো আমি কোনদিনই হতে পারবো না ।আমি একটুতে বিরক্ত হলে তুমি বলতে "যে সয় সেই রয় ।"
তাই জীবনে সমস্যা এলে তোমার বলা কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করি মা।
মা ,কতদিন ,কত মাস ,কত বছর হয়ে গেল বলো তো তোমার সাথে বসে মন খুলে কথা বলতে পারি না !
জানো মা যখন কোন আনন্দ হয় তোমার কথা খুব মনে পড়ে। আবার যখন ভীষণ রকম কষ্ট পাই ,মন খারাপ হয় তোমায় ডাকি তো মা ! মন থেকে ডাকি ।তুমি কি শুনতে পাও ?
আবার যখন শরীর খারাপ করে,কিংবা জ্বর এলে তোমায় খুঁজি, তোমার স্পর্শ খুঁজি ।
একসাথে কোন মা মেয়েকে দেখলে কিংবা তোমার বয়সী কোন মাকে দেখলেও তোমার কথা মনে পড়ে বুকটা কেমন যেনো মুচড়ে ওঠে। জানো মা,এই বয়সেও তোমার কোলে মাথা রেখে পরম শান্তিতে ঘুমাতে ইচ্ছা করে। তোমার আদর পেতে ইচ্ছা করে। তোমার গাওয়া একটি গানের কিছু কথা যখন তুমি ছিলে তখন অতোটাও অনুভব করতাম না কিন্তু তোমাকে হারানোর পর থেকে আজ অবধি গানের কথা গুলো খুব খুব বাস্তব মনে হয়।
তুমি গাইতে
"যেদিন তুমি থাকবে না মা সেদিন আমার হবে কি?
সুখে থাকি দুখে থাকি ,কার আসবে যাবে কি ?
তাইতো বলি তোমার মত দরদী কেউ নাই গো ,
মায়ের মত আপন কেহ নাই। "
জানি ,আমার জীবনের সুখ দুঃখ এ কারো কিছু যায় আসে না। যার যায় আসত তাকেই তো হারিয়ে ফেলেছি জীবন থেকে।
ভাবতে অবাক লাগে তোমায় ছাড়া এতগুলো বছর কিভাবে কাটিয়ে দিলাম। আর লিখতে পারছি না মা, চোখ যে জলে ভরে যাচ্ছে ।শুধু এটুকুই বলবো সন্তানের জীবনে বাবা-মায়ের প্রয়োজনীয়তা কতটা তা আমার মত অভাগী সন্তানরাই জীবনের প্রতি পদে পদে বুঝতে পারে ।ভালো থেকো মা বাবার সাথে পর পাড়ে। আর আমাদের সব ভাইবোনদের আশীর্বাদ করো আমরা যেন ভালো থাকি তোমাদের উত্তরসূরীদের নিয়ে ।
No comments:
Post a Comment