Sunday, June 2, 2024


 

বাবা বিহীন এই সব দিন 

বাবা
মনোমিতা চক্রবর্তী



বাবা -দুই অক্ষরের এই ছোট্ট শব্দটির গভীরতা অনেক। এই ছোট্ট শব্দটি উচ্চারিত হলেই যে কোন সন্তানের হৃদয়ের শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর কৃতজ্ঞতা বোধ সেগে ওঠে ।আমাদের প্রত্যেকের জীবনে বাবার অবদানের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। বাবারা আসলে অনেকটা মোমবাতির মত । যে নিজে জ্বলে তার সন্তান ও পরিবারের সবাইকে আলোকিত করে।

     আমার কাছে বাবা মানেই সমস্ত অন্ধকার দূর করে ভোরের আলো নিয়ে আসা এক দেবদূত।আসলে বাবা-মা হল ঈশ্বরের দেওয়া সেই দামি সম্পদ যার সাথে কোন কিছুরই তুলনা চলে না। মায়ের চলে যাবার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে বাবাও চলে গেলেন। মায়ের চলে যাওয়ার আঘাতটা সামলে ওঠার আগেই আমাদের একেবারে অনাথ করে বাবা চলে গেলেন ।আমরা বাস্তবের মাটির পৃথিবীতে মুখ পড়লাম যেন। শুরু হলো লড়াই,পরিবেশ - পরিস্থিতি সব কিছুরই সাথে ।বাবা চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম পৃথিবীতে টিকে থাকাটাও কতটা কষ্টের ।

     যতদিন বাবা ছিল বুঝিনি বাস্তব কতটা কঠিন! বাবা চলে যেতেই ,সেই কিশোরী বয়সেই যেন বয়স অনেক বেড়ে গেল আমার। পরিস্থিতি শুধু আমায় নয়,আমাদের সমস্ত ভাই বোনকে অনেক বড় করে দিল।কিশোরীবেলার  সমস্ত সাধ, আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে দিলাম। কারণ তখন সেটা আমাদের কাছে ছিল বিলাসিতার স্বরূপ। 

      জানো বাবা তোমার চলে যাওয়ার সাথে সাথে চেনা মানুষগুলো কেমন যেন অচেনা হয়ে গেল ।তোমার বন্ধু - বান্ধব ,আত্মীয় - স্বজনে,গমগম  করত পুরো বাড়ি। তুমি চলে যাওয়ার পর সেই বাড়িতে আর লোকের সমাগম হতো না। পুরো বাড়িটাই যেন তার প্রাণ হারিয়ে ফেলেছিল। 

    থাক সেসব কথা। কারণ সময় চলে যায়, কিন্তু কিছু কথা তো মনেই রয়ে যায়। কিছু কথা না হয় মনেই থাক । আমি বরং আজ বাবাকে নিয়ে কিছু বলি ।

    বাবা যে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে আস্ত একটা বটগাছের স্বরূপ সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বট গাছের কোমল ছায়াটা সরে যেতেই বুঝতে পেরেছি বাবা তুমি ছাড়া কতটা অসহায় আমরা।

    তুমি যখন ছিলে বাবা তখন তোমার আত্মত্যাগ, তোমার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের ভালো রাখার চেষ্টা করাটা বুঝিনি গো। আসলে তোমার বাইরেটা দেখে ,আমাদের প্রতি তোমার শাসন দেখে তোমাকে খুব শক্ত মনে হতো ।আসলে ভিতরে ভিতরে তুমি ছিলে ঠিক ততটাই নরম ।পিসির কাছে, মায়ের কাছে তোমার গল্প শুনে এবং নিজে অনুভব করে বুঝতে পেরেছি তুমি ভীষণ ভীষণ রকমের সহজ সরল একটা মানুষ ছিলে।সেজন্য তো সারাটা জীবন তুমি আপনজনদের কাছ থেকে শুধু ঠকেই গেলে। বারবার ঠকে গিয়েও তুমি কিন্তু সম্পর্ক কারো সাথে খারাপ হতে দাওনি।আজীবন সম্পর্কগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছো। সবার সাথে মিলেমিশে থাকার শিক্ষা তো বাবা তুমি দিয়ে গেছো। 

   জানো বাবা তোমাকে খুব মনে পড়ে। সুখে ,দুঃখে সব সময় মনে পড়ে। চোখ বন্ধ করলেই তোমার সঙ্গে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো অবলীলায় ভেসে ওঠে। সেই যে আমাদের পড়তে বসানো, পূজার সময় ভিড়ের মধ্যে তোমার কাঁধে করে প্রতিমা  দর্শন ।মেলায় গিয়ে বায়না করে পছন্দের জিনিস কেনা। পুজোয় জামা জুতো কিনতে গিয়ে হোটেলে বসে পছন্দের খাবার খাওয়া ।কিংবা তুমি শহরে কোন কাজে গেলে অপেক্ষায় থাকতাম, কখন তুমি ফিরবে আর আমাদের জন্য আমাদের পছন্দের ক্যাডবেরি, ফ্রুটি নিয়ে আসবে। রেজাল্টের দিন আমাদের রেজাল্ট দেখে খুশিতে তোমার মুখটা আলো হয়ে যেত। তোমার ওই মুখ দেখে পরম শান্তি পেতাম যে আমরাও।

তোমার আদর , আমাদের প্রতি তোমার স্নেহ, তোমার ভালোবাসার  কথা খুব মনে পড়ে বাবা। কতদিন, কত মাস ,কত বছর তোমার আদর, স্নেহ,ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত বলো আমরা!  তোমাকে হারানোর কষ্টের প্রহরগুলো বুকের ভেতর জামাট বেঁধে এই বুকে কান্নার ঢেউ তুলে যায় বাবা !এক একটা দিন বড় একা লাগে। তোমার স্পর্শটুকু ,তোমার মায়া ভরা ডাক অথবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া কিংবা কঠিন সময়ে তোমার আশ্বাস ভীষণ ভীষণ মনে পড়ে বাবা ।তুমি বলতে - "চিন্তা করিস না ,আমি আছি তো।"

   বাবা  তুমি কত কষ্ট করেছ আমাদের জন্য। বিনিময়ে কিছুই তো দিতে পারিনি তোমায়। তোমার জন্য কিছু করার সুযোগ টুকু তো  দিলে না তুমি। বুকভরা অভিমান নিয়ে তুমি চলে গেলে না ফেরার দেশে। 

   এখনো মনে পড়ে বাবা তোমাকে শেষবারের মতো স্পর্শ  করার মুহূর্তটা ।কি অসম্ভব ঠান্ডা ছিল তোমার শরীর !আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম তোমার শরীরের ঠান্ডা স্পর্শে ।কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ভাসিয়ে ডেকেছি তোমায়,তুমি সাড়া দাওনি সেদিন।

   আজও তোমার কথা মনে পড়লে চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে থাকে ।মাকেও যেমন কোনদিন বলা হয়নি ভালোবাসি তেমনি তোমাকেও কোনদিন বলাই হয়নি ভালোবাসি বাবা। খুব ভালোবাসি তোমায়। জানো বাবা কতদিন মনে হয়েছিল তোমার মৃত্যুটা একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র ।যেকোনো সময় তুমি হয়তো আবার ফিরে আসবে। এসে বলবে ,-"চিন্তা করছিস কেন ?আমি তো আছি।"

  এখনো মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি তুমি আমি পাশাপাশি হাঁটছি। তোমাকে ঘিরে প্রতিটা মুহূর্তই খুব খুব মনে পড়ে  ।জানো বাবা তোমার বন্ধুদের দেখলে বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে ।মনে হয় তুমি থাকলে হয়তো ওই কাকুদের মতো তোমারও চুল সাদা হয়ে যেত। তুমিও হয়তো হালকা রঙের পোশাক পড়তে। সকাল হলেই হয়তো চলে যেতে খবরের কাগজ আনতে পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে।

কত কিছু দেখার ছিল তোমার বাবা। আমাদের বড় হওয়া ,আমাদের নিজে পায়ে দাঁড়ানো ,আমাদের বিয়ে ,সংসার ,নাতি-নাতনি কিছুই তো দেখলে না তুমি!

   প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বলতে সাবধানে যাস। টিউশন থেকে ফিরতে দেরি হলে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার অপেক্ষায়। তুমি চলে যেতেই আমার মাথার উপর রাখা তোমার ভরসার হাতটাও চলে গেছে বাবা তবে বাবা তোমাকে দেওয়া কথাগুলো এখনও ভুলিনি। তোমার শেখানো পথে আজও হেঁটে চলেছি। তুমি আজীবন আমার হৃদয়ে স্মৃতিসৌধ হয়ে রয়ে যাবে । বিশ্বাস কর বাবা সেদিন হয়তো আমি শান্তি পাবো যেদিন তোমার পাশে গিয়ে বলতে পারব তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা ।

     ঈশ্বর যতটা নেন ততটাই হয়তো আবার দু হাত ভরে ফিরিয়েও দেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ আমি দ্বিতীয় বার বাবা পেলাম বিয়ের পর ।আমার শ্বশুর মশাই স্বর্গীয় তপন কুমার চক্রবর্তী। সারা গয়েরকাঁটা যাকে মাস্টারমশাই হিসেবে চেনে। ভীষণ সহজ - সরল, মায়ায় ভরা একজন মানুষ ।যিনি আমায় মাথায় করে রাখতেন। আমি ওনার কাছে শুধু পুত্রবধূ ছিলাম না, ছিলাম আরো একজন কন্যা সন্তান যেন। উনি নিজেই বলতেন তুমি হলে আমার মেয়ে।উনি আমাকে সব সময় নিজেরই অংশ মনে করে  অন্তরের ভালোবাসা দিয়েছেন ।

    আমার বাবা গত হওয়ার পর থেকে  যেকোনো রকম সাধ - আহ্লাদকে আমার  বিলাসিতা মনে হতো ।পরিস্থিতি আমায় এতটাই  বড় করে দিয়েছিল যে ,আমাকেও যে  কেউ পদে পদে আগলে রাখতে পারে এটা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের পর থেকে বুঝতে পারলাম  আমারও আহ্লাদ- আবদারের জায়গা আছে !কেউ একজন আছে যে আমাকে স্নেহ-  মায়ায় আগলে রাখছে ।

রাতে লাইট চলে গেলে অন্ধকার বাথরুমে যেতে যদি অসুবিধা হয় তাই মাথার কাছে টর্চ রেখে যেতে তুমি বাবা, যাতে হোঁচট না খাই ।  স্কুল থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে যখন বিকেলে ঘুমিয়ে পড়তাম তুমি মাথার কাছে চকলেট বাদাম রেখে যেতে। যাতে আমি ঘুম থেকে উঠে ওই চকলেট, বাদাম দেখে দেখে খুশি হয়ে যাই। বাইশ বছরের আমাকে তুমি শৈশবের দিনগুলিতে নিয়ে গিয়েছিলে বাবা! নিজের যত্ন নিতাম না জন্য হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলতে - "পার্লারে যাও ,নিজের যত্ন নাও ।একটু সাজগোজ কর ।"

তুমি আমাদের এখানে এলে, কিংবা আমি গয়েকাটায় গেলে তুমি নিজে দৌড়ে দৌড়ে বাজারে যেতে,আমি যা যা খেতে পছন্দ করতাম সব কিনে নিয়ে চলে আসতে। ছোট বয়সে বিয়ে হওয়ার দরুন সংসারের খুঁটিনাটি তেমন বুঝতাম না। তুমি চুপি চুপি বাইরের পিসিও বুথে গিয়ে আমায় ফোন করে শিখিয়ে দিতে কাকে কি বলতে হবে ।কাকে ফোন করতে হবে ।মাকে (শাশুড়ি মাকে) ফোন করতে ভুলে গেলে তুমি আমায় মনে করিয়ে দিয়ে বলতে -" তোমার মাকে ফোন করে বল তোমার ওখানে যেতে।" সত্যি বাবা কিভাবে সবটা ম্যানেজ করতে তুমি ভাবলেই অবাক লাগে! কতটা বুঝতে তুমি আমায় ।তোমার মত করে আর কেউ বোঝেনি আমায়।           
      
    জানো বাবা তোমার পাঠানো "সুখী গৃহকোণ"নামক ম্যাগাজিনগুলো, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, বিজয়ায় লেখা চিঠিগুলো আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছি। মন খারাপ হলে ওগুলো বের করে পড়ি।

    জন্মদিন এলেই মনে পড়ে তোমার কথা।সেবার আমি অন্তঃসত্ত্বা। তুমি আমার জন্মদিনের আগের দিনেই চলে এসেছিলে । কিন্তু সেবার সাধ না হওয়াতে আমি নাকি জম্মদিনে চালের পায়েস খেতে পারবোনা। কারণ নিয়মমত নাকি সাধ না হলে চালের পায়েস খেতে নেই ।কিন্তু তুমি বলেছিলে জন্মদিন আর পায়েস হবে না এটা কখনো হয় নাকি ? তাই তুমি বাজারে গিয়ে নিজে হাতে বাজার করে আনলে ।সাথে নিয়ে এলে কাউন। তোমার কিনে আনা কাউন দিয়ে পরের দিন কাউনের পায়েস হল । আমায় কাউনের পায়েস খাইয়ে আশীর্বাদ করলে ।সাথে তোমার দেওয়া চিঠিই আর উপহার।

      আমি যাই রান্না করে তোমাকে খাওয়াতাম না কেন তুমি তারই প্রশংসায় ভরিয়ে দিতে। তোমাকে দেওয়া সামান্য উপহারে কি খুশি টাই না হতে তুমি ! বাবা , তোমার বলা কথাগুলো আজও মনে পড়ে আমার। তুমি বলতে -"নিজেকে কখনো দুর্বল মনে করবে না । অন্যায় না করলে প্রতিবাদ করবে । মনে রেখো তুমি কিন্তু বানের জলে ভেসে আসোনি । তোমারও দাম আছে সংসারে, এতটাও নরম হয়ো না। শক্ত হও ,আত্মবিশ্বাস বাড়াও ,আমি আছি তো মা।"

তোমার ইচ্ছে ছিল  আমি যেনো স্পোকেন ইংলিশ শিখি ।যাতে ইংরেজিতে গড় গড় করে কথা বলতে পারি, কেউ কিছু ইংরেজিতে বললে তার উত্তর যেন ইংরেজিতেই দিতে পারি। কিন্তু আমার স্পোকেন ইংলিশ আর শেখা হলো না। তুমি থাকলে হয়তো জোর করে কবেই ভর্তি করে দিতে। 

কিন্তু তুমিও চলে গেলে আবারও একবার আমায় পিতৃহারা করে। আর লিখতে পারছি না বাবা চোখ যে জলে ভরে যাচ্ছে।

   হে ঈশ্বর ভালো রেখো তুমি আমার দুই বাবাকে আমার দুই মায়ের সাথে পরপারে এবং ভালো রেখো পৃথিবীর সমস্ত বাবাকে।

No comments:

Post a Comment