গল্পে বাবা
বাবা
সম্রাজ্ঞী
বৈঠকখানার দেওয়ালে টাঙানো তৈলচিত্রটা মানস বসু খুব মন দিয়ে দেখছিলেন। ছবিটার তলায় "দ্য মাদার" - নামটা ইংরেজি অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। সোনালি রঙে লেখা দুটো ইংরেজি শব্দ।
শিশু যিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মেরি। ছবিটা দেখতে দেখতে তাঁর মনে হল যে, অসাধারণ আঁকার হাত ছিল ছেলেটার! অথচ এই ট্যালেন্ট অকালেই ঝরে গেল...।
ছোট ছেলে শুভমের মৃত্যুতে আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে পড়েছিলেন মানসের স্ত্রী সুনন্দা। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য কী না করেছিলেন তিনি ? পুজোপাঠ, যাগ যজ্ঞ কিছুই বাদ যায়নি।
আর মানস? তিনিও যথেষ্ট খরচ করেছেন ছেলের চিকিৎসায়। কিন্তু লিভার ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে আর কী-ই বা করার থাকে?।
শুভম চলে গিয়েছে আজ প্রায় ছ' মাস হল।
এখনও ছোট ছেলের জন্য মানসের বুকটা ফেটে যায়।
মেরির শান্ত স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে মানসের মনে হল, কেউ তো কখনও যোসেফের ছবি আঁকে না! যিশুর পিতা হয়েও তিনি চিরকাল অবহেলিতই থেকে গেলেন।আর সেই জন্যই পিতা আর সন্তানের কোনও ছবি আঁকার কথা কোনও শিল্পী ভাবল না।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মানসের মনে হল বড় ছেলে রূপমের কথা।
বহু বছর ধরে সে লন্ডনের বাসিন্দা। তবে ভাইয়ের অসুখের কথা জানতে পেরে একবার দেশে এসেছিল। কিন্তু তাকে ঠিক 'বিলেত ফেরত 'বলা যায় না।
রূপম বিদেশের নামকরা ডাক্তার। কিন্তু তার অত বড় বিলিতি ডিগ্রিও ভাইয়ের প্রাণ রক্ষা করতে পারেনি।
মানস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
সবাই জানে, রূপম আর দেশে ফিরে আসবে না। বাকি জীবনটা সে বিদেশের নাগরিক হয়েই কাটাবে।
শুভম না থাকায় মানস বড় একা হয়ে গিয়েছেন। এখন আর তাঁকে কেউ "বাবা" বলে ডাকে না। মেইন রোডের ওপরে এত বড় বাড়িটায় কেমন যেন একটা শূন্যতা গিলে খেতে আসে ।
শুধু শুভমের অভাবে তাঁর বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে!
কিন্তু কেন এমন হল? চব্বিশ বছর কি চলে যাওয়ার বয়স? এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না!
মানস ভাবছিলেন যে, রূপম তো পাকাপাকিভাবেই দেশে ফিরে আসতে পারে। একটু না হয় কম রোজগার হবে ! তাতে কী? মানস- সুনন্দার সংসারে বৈভব প্রাচুর্যের তো কোন অভাব নেই। এদেশে ফিরে এলে সে অন্তত শোকের দিনে বাবা মায়ের পাশে থাকতে পারবে!
হঠাৎই ডোর বেলটা বেজে উঠল।
কে এল, বঙ্কু? মনে মনে সহায়ক ছেলেটির কথা ভেবে মানস এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে।
দরজা খুলে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। বড় একটা রুই মাছ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন। ৷ মাছওয়ালি!
মানসদের বাড়ির কাছেই চৌরাস্তা। সেই চৌরাস্তার মোড়ে তার মাছের দোকান।
" ও বাবা, আজ ভাল বিক্কিরি হয়নি গো। তুমি এটা নিয়ে নাও। আজ তো তুমি মাছ কিনতে দোকানে আসনি। তাই আমি ভাবলাম, যাই, বাবাকে এটা দিয়ে আসি গে। ও বাবা, নিয়ে নাও না গো।"
"তুমি দাঁড়াও ; আমি টাকা নিয়ে আসি। "
"ও আমি পরে নেবোখন। এখন চলি গো বাবা। দেরি হলে আবার টেরেন ছেড়ে দেবে যে।"
আর কথা না বাড়িয়ে মাছওয়ালি হাঁটতে শুরু করল নিজের গন্তব্যের দিকে।
বহুদিন পরে "বাবা" ডাকটা শুনে মানসের চোখের কোণটা ভিজে উঠল। শুভমের আবদার, বাবা বলে ডাকা- সবই যেন ফিরে এসেছে তাঁর কাছে অন্যরকম ভাবে। ।
হলই বা মাছওয়ালি। হলই বা প্রবীণ বিধবা।
তবুও তো তাঁকে "বাবা" বলে ডাকে!
No comments:
Post a Comment