ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস সিক্স
লীনা রায়
১৯৮১ সালের জানুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। শনিবার, বিকেল তিনটে। আমরা চার পাঁচজন সঙ্গে আমার সীমাদি চলেছি ফালাকাটা গার্লস হাই স্কুলে। সেদিন ক্লাস ফাইভের এডমিশন টেস্টের রেজাল্ট।স্কুলে ঢুকে দেখি আমাদের মত আরো অনেকেই আছে। ঠিক চারটের সময় বড়দি, মায়া বোস বাইরে এলেন। কিছু কথা বলেছিলেন। আজ সবটা যদিও মনে নেই। এরপর লিস্ট পড়তে শুরু করলেন। প্রথম নাম চৈতালি কর।যদিও আমাদের ক্লাসে এরপর প্রতিটি ক্লাসে সুমনা ছাড়া আর কেউ কোনদিন ফার্স্ট হতে পারে নি।যা হোক ,আমার নাম ও এলো।একসময় লিস্ট পড়া শেষ হল।লিস্টে আমার প্রিয় বন্ধুর নাম নেই। আনন্দ কেমন উবে গেল নিমেষে।
ক্লাস শুরু হল। নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ। ভাল লাগা, ভয় সব মিলেমিশে একাকার।এর মধ্যেই মোহনদা ক্লাসে অ্যানুয়াল স্পোর্টসের নোটিশ নিয়ে এলো। তিনটে ইভেন্টে নাম দেয়া যাবে। মনে আছে, আমরা ক্লাসের সবাই নাম দিয়েছিলাম।সেদিন সিলেকশন।ক্লাস ফাইভের ছাত্রীদের নিয়ে শুরু হল হিটস। এক একবারে জনা কুড়িকে দৌড়তে হচ্ছে। একমাত্র ফার্স্ট ফাইনালে খেলবে। দৌড় শুরু হল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝে গেলাম খেলাধুলো আমার জন্য নয়। আর ওটাই প্রথম , আর অবশ্যই শেষবার।তবে স্কুল স্পোর্টসের নিয়মিত দর্শক ছিলাম।
সে সময় বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া হলে আড়ি হত। আর যাদের আড়ি হত তাদের ভাব করানোর দায়িত্ব থাকত অন্য বন্ধুদের ওপর। চৈতালি আর স্মৃতির ভাব করানোর জন্য কী পরিশ্রমটাই না করেছিলাম আমরা। একজনকে ধরে আনছি, আর একজন পালিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ভাব হয়েছিল ওদের। আর স্কুল পেরিয়ে কলেজ জীবনেও ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।
ফাইভ পেরিয়ে তখন সিক্সে। ফিফথ পিরিয়ডে তেষ্টা পেয়েছে। আমরা তখন জলের বোতল নিয়ে স্কুলে যেতাম না। তেষ্টা পেলে চাপা কল টিপে জল খেতাম। আমি আর বুবু জল খেতে যাচ্ছি। টিচার্স কমন রুমের সামনে একটা বকুল ফুলের গাছ ছিল। তাতে কমলা রঙের ছোট ছোট ফল ধরত। মেয়েরা ঢিল ছুড়ে সেই ফল পেড়ে খেত। সেই সময় একটি ঢিল আমার মাথায় পড়ে। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরি। হঠাৎ দেখি সব্বাই পালিয়ে যাচ্ছে। আর গরম কিছু আমার চুলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে কানের পাশ দিয়ে পড়ছে। হাত দেখি। রক্তে মাখামাখি। একাই দিদিমণিদের কাছে যাই। মৈত্রেয়ী দিদিমনি আর রিতা দিদিমনি আমাকে হসপিটালে নিয়ে যান। ফিরে এসে দেখি যার ঢিলে আমার মাথা ফেটেছিল, সেই মাধবীদি কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
ছ'বছর – দীর্ঘ সময়। কত স্মৃতি। আজ পেছন ফিরে যখন দেখি সব মন ভাল করা স্মৃতির ভীড়। অবাক হয়ে ভাবি, খারাপ কিছু কি ছিল না? সত্যিই হয়ত ছিল না। আজও সেই স্কুলের বন্ধুরা একসঙ্গে আছি। কথা হয়। মেসেজের আদান প্রদানও নিয়মিত হয়। একবার সবাই দেখাও করেছি। সেই আনন্দ হয়ত লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।এই অমূল্য বন্ধুত্ব– সৌজন্যে ফালাকাটা গার্লস হাই স্কুল।
No comments:
Post a Comment