`মৃন্ময়ী পথ চিন্ময়ী রূপে....`
পথ.....তুমি কার?
জয়তী ব্যানার্জী
আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। আনন্দের সরণী বেয়ে আজ আমরা এঁকেবেঁকে চলেছি নানা বাঁক- এর মধ্য দিয়ে। জীবন সায়াহ্নে রএই গলি কখনো বা রাজপথ আবার কখনো বা কিনু গোয়ালার গলি, কখনো বা দুজনার দুটি পথ যায় মিলেমিশে। আর সেই আনন্দে আমাদের মন বলে ওঠে ---আমার মুক্তি আলোয় আলোয় ।তবু যেন কোথাও একটা তাল কেটে যায়, দৈনন্দিন জীবনে চলতে গিয়ে মতবিরোধ হয়, ছন্দ পতন হয় কিন্তু তাহলে তো চলবে না । তুমি যে অনন্ত অসীম--- তোমার কোথায় শুরু ,কোথায় যে শেষ... কেউ তা জানে না ।তুমি যে ধ্রুব সত্য। তুমি তো সাকার- নিরাকার উভয়ই। তাইতো তোমারও অসীমে প্রাণ মন নিয়ে কত দূরেই আমি ধাই-ই -ই। সেখানে যে কোথাও মৃত্যু, কোথাও জড়া আবার কোথাও বা নতুন করে পথ চলার নির্দেশ। চরৈবেতি চরৈবেতি _____তুমি যে অনন্ত অসীমে ধাবমান। আমিও জীবন মধ্যাহ্নে দাঁড়িয়ে হেঁটে চলেছি নি:সীম শুন্যে। হাজার বছর ধরে মনে হয় এই হাঁটা চলছে। পথ--- তোমার কি কোন বাঁধনই নাই, কেউ কি তোমার পথের ঠিকানা জানে না গো, কেউ কি বলতে পারে.... তোমার আদি অন্ত ...সে তো, এই পথ যদি না শেষ হয় ----সেই অনন্ত পথে হেঁটে যাওয়া। বড় সাধ জাগে গো পথ, তোমায় শুধাই ---কোন বাঁধনে বাঁধো তুমি আর যাবেই বা কোন ঠিকানায় ...তবে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দাতা, আমাদের আশ্রয়স্থল রবি কবি তাঁর শেষের কবিতায় 'অমিত' কে দিয়ে বলিয়েছেন------
"পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হওয়ার পন্থী"------
কিন্তু সেই চলমান পথ..... তোমার কোন বাঁধন নেই, তাই তো তুমি ঘর ছাড়া। তোমার কোন ঘড়ি নেই ,তোমার কোন গন্তব্য নেই ,তোমার পৌঁছানোর কোন তাড়া নেই। শুধু ছুটে চলেছ ,চলছো তো চলছোই। তোমার প্রতি যে অনন্ত জিজ্ঞাসা আমার ।তোমার কি অনেক কাজ গো পথ----- মনে হয় ,তোমারও অনেক কাজ তাইতো। তোমার ই ভাষায়, যার ঘর নেই.. তাকে তোমার ধারণ করে রাখতে হয় বুকের মাঝে... আবার তুমি যে সোনার তরীর মতো ভারা ভারা রাশি রাশি ধান ভিড় করে রাখো তোমার ধারে। কিন্তু আবার যার ঘর আছে তাকে যত্ন করে ঘরে পৌঁছে দিতে হয় তোমাকে। আবার তোমার পাশেই তালপাতার পাখা হাতে নিয়ে বসে থাকে বুড়ি মানষির দল, কিশোর মন অকারণ পুলকে ধানক্ষেতের আলপথ ধরে ছুটতে থাকে---- সেই ছোটার ও যে কোন শেষ নেই গো---- তারপর একসময় তোমার বট গাছের ছায়ায় এসে বেদী তলে বসে জিরিয়ে নেয়।
তুমি যে গরমকালের ঝলমলে রোদের সাথে গা-মাখামাখি করে লুটোপুটি কর আবার বর্ষার মেঘলা মেদু রতাকেও উপভোগ করতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়নি কখনো তোমার অবয়ব। তাইতো তুমি হয়ে ওঠো পথ ভোলা এক পথিকের ক্ষুদ্র নামান্তর। তোমার সাথে সখ্যতা হতে দ্বিধাবোধ হয় না যেমন বর্ষার আলো আঁধারী মেঘের ,তেমনি আবার কুয়াশা ঘেরা সদ্য রৌদ্র স্নাত আকাশও যেন তোমায় খুব আপন করে নেয় গো। গ্রাম্যপথে তুমি যে কত না বলা কথার আশ্রয়স্থল---- ভরা গ্রীষ্মের দুপুরে কলসী কাখে পোড়া চেহারায় রিক্ত শ্রান্ত গ্রাম্যবধূকে আশ্রয় জোগাও তুমি ,আবার একরাশ বাঁধন ছেড়া কিশোর কিশোরী অবগাহন করে তোমার দূর-দূরান্তের পথের মাঝে ----তৃষ্ণার্ত তোমার ধুলো সিক্ত করে কোন যৌবন ভীরু পল্লীবালা----সেও যেন এসে আশ্রয় চায় তোমার আঁচলে তুমি যে গেয়ে ওঠো----
"আমার এ পথ তোমারও পথের শেষে"
আর তুমি শুষে নাও বারিধারার ভালোবাসাটুকু। তুমি যে অমৃত কলস । আচ্ছা সত্যি করে বলতো, আমার মৃন্ময়ী পথ ---তুমি কি কোন সময় চিন্ময়ী রূপে ধরা দেবে তোমার প্রেয়সিকে, সে চকিতে অবগুন্ঠানবতী হয়ে আঁচল গোছাবে বলেই কি বসে আছো তোমার আয়াস লব্ধ মধুরতা নিয়ে ।সেই থেকেই বুঝি তুমি কত ঘর ছাড়া লোকের আপনজন হয়েছ ,আবার নতুন করে ঘর বাঁধবার ঠিকানা জুগিয়েছো।
কিন্তু তুমি যে আবার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নারাজ; তুমি চাও না প্রশ্নের কড়াঘাতে জেরবার হোক তোমার জীবন ।তুমি যে চিরকালই রহস্যময়ী ,তুমি তো অধরা। তুমি নিজেকে মোহময়ী করে তুলতেই সদা ব্যস্ত। চিরকালই রহস্যের হাসি এঁটে তুমি দূরে মিলিয়ে যাও ,দিগ্ বলয়ের প্রান্তে, সেই দিগন্ত প্রসারিত তুমি যে ধুমায়িত বসনাবৃত এক রমণীর কায়া, যা চিরকালই অধরা। তোমার সাথে পাড়ি জমিয়ে ভেবেছিলাম ,এই বুঝি তোমার শেষ ----কিন্তু তুমি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছো ____শেষ বলে কিছু নেই। যার শুরু নেই তার আবার শেষ কোথা থেকে হবে ....তুমি অনন্ত অসীম। মহাবিশ্বে তোমার ছুটে চলা। তুমি যে অপু দুর্গার সংসার, এই পথেই লাবণ্য খুঁজে পেয়েছিল শিলং পাহাড়ের 'অমিত' কে আবার শরৎ বাবুর 'সতীশ' তার 'সাবিত্রী'কে পথ থেকেই তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছিল বাসা বাড়িতে।
কোলিয়ারির পথে বিভ্রান্ত পথিক হয়ে ছোট্ট ছেলেকে কাঁধে নিয়ে হেঁটে বেরিয়েছিল অপূর্ব---- শোক স্তব্ধ হয়ে.... তুমি সেই কাল থেকে এসবেরও সাক্ষী পথ। তবুও যে বিস্তর প্রতিবাদ করেছি আমি। যুগের পরিবর্তন হয়েছে। বারবার দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছি---- জীবনের পথ শেষ হয় মৃত্যুর দরজায়, তবুও তো তুমি মানো নি। তুমি বলেছ আত্মার মৃত্যু নেই শুধুই রূপান্তর। তুমি বলেছ মৃত্যু হয় শরীরের, দেহের। কাজের মত কাজ জাজ্বল্যমান হয়ে থাকে--- সে যে অশরীরী আত্মা। তুমি প্রতিমুহূর্তেই নিজেকে আখ্যায়িত করেছ এইভাবে, তুমি অসীম ---তুমি নি:সীম শূন্যে হেঁটে চলো ।
তুমি বলেছ যার ঘর নেই তাকে তোমার ধারণ করে রাখতে হয় বুকের মধ্যে, তুমি যে গৃহহীনদের গৃহ আবার যার ঘর আছে তাকে যত্ন করে ঘরে পৌঁছে দিতে হয় তোমাকেই---- তখন তো তুমি দায়িত্ববান পিতা। আবার প্রেমের জোয়ারে ভাসমান কিশোর কিশোরীর রাসলীলা করবার রঙ্গমঞ্চ ও যে তুমি ।এই ইঁট কাঠ পাথরের দেওয়ালে ভরা জগতলে তারা যে ঠাঁই নেয় তোমারি ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কোন বেদী তলে, কোনো নদীর ধারের সংগোপন আশ্রয়ে ।সেখানেও যে তোমার দুয়ার খোলা।
তাইতো তুমি কারো কাছে আটকে পড় না। তুমি কখনো যাও তেপান্তরের মাঠে, আবার কখনো বা নরম নীল ডিঙিয়ে সবুজ পান্নার মত জেগে থাকা কোন দারুচিনি দ্বীপে, আবার কখনো বা জঙ্গলের গহীন অরণ্যে---- যেখানে রৌদ্রছায়ার খুনসুটিতে বেলা কেটে যায়। কোন অচেনা পাখির ডাকে দূরে মিলিয়ে যায় রাখালের মেঠো বাঁশি। সন্ধ্যা নামে ধীরে, জোনাকি জ্বলে ওঠে ইতি উতি। আর তুমিও দিন শেষে অস্তা চলে পাড়ি দিতে নিজেকে প্রলম্বিত করো এক দিশা থেকে অন্য দিশায়।
তবু আমি জানি আমার এ পথ তার ঠিকানায় কখনো পৌঁছবে না, তোমার সাথে দেওয়া-নেওয়ার পালাও বোধ করি কখনো চুকবে না। এ যে নিত্য কার অভ্যেস। অনিত্যের বেড়াজাল একে বাঁধতে পারবে না কোনদিন ।ভালো থেকো আর ভালো রেখো উত্তরসূরীদের, যারা শ্রান্ত ক্লান্ত জরা- জীর্ণ ,তারা এসে জুড়িয়ে নিক আমার প্রিয় পথের পাশে। তুমি জড়িয়ে ধরো এদেরকে বুকের মাঝে। এসব নিয়ে ভালো থেকো আর ভালো রেখো। কান্না হাসির দোল দোলায় বেঁচে থেকো আর সবুজ সতেজ করে বাঁচিয়ে রেখো। আজ তাহলে চলি, পথ।।
No comments:
Post a Comment