কাঞ্চনজঙ্ঘা
পর্ণা চক্রবর্তী
চৈত্র মাস পড়তে না পড়তেই নিমাইয়ের দোকানে বেশ ভিড় লেগে গেল। ছাপা শাড়ি, ছিটের ব্লাউজ সেমিজ পাজামা পাঞ্জাবি এসব নানান জিনিস ভালোই বিক্রি হচ্ছিল অনেক দিন পর। ভিড় বাড়লে নিমাই একা সামলাতে পারছিল না বলে বড় ছেলেকে বলছিল দোকানে এসে বসতে। দীপু আগে গ্যাংটকের একটা হোটেলে চাকরি করতো ,ছোট হোটেল । ওদের পাড়ায় থাকত রমেন দত্ত, সেই লিজে হোটেলটা নিয়েছিল। দীপু বেশ সপ্রতিভ ছেলে , দেখতে ,টেখতেও ভালো। বিএ পাশ করে বসেছিল,চাকরি পায় নি। গরীব বাড়ির ছেলে,এরপর আর বেশিদূর এগোতে পারেনি। রমেনই তখন ওকে এই চাকরিটার কথা বলে।
শেষ দুবছর ধরে সারা পৃথিবীর মানুষ খুব খারাপ ছিল। রমেন হট করে মারা গেল , হোটেলও বন্ধ হয়ে গেল। দুবছর ধরে সেই ইস্তক বাড়িতেই বসে আছে দীপু । চাকরির চেষ্টা করছে কিন্তু এ বাজারে কে এখন ওকে চাকরি দেবে। একটা বাইক থাকলেও হত , ডেলিভারি ম্যানের কোনো চাকরি পেতে পারত। মনমরা হয়ে দোকানে বসে এই সব ভাবে। কদিন পরেই নব বর্ষ , বিক্রি বাটা ভালোই হচ্ছে। বড় রাস্তায় অনেক দিন পর গাজনের সঙ বেরিয়েছে। নিমাই বলল ,"আমাদের ছেলেবেলায় জেলেপাড়া থেকে সঙ বেরুত তখন। চড়কের মেলা হতো। বাবা নিয়ে যেত। কি সব দিন ছিল তখন, বুঝলি দীপু! তখন আমাদের দোকানটা বিক্রি হয়নি, তারপর.…..” বলেএকটু থামল নিমাই ।ওর ছেলে বেলার উৎসবের দিনগুলো মনে পড়ল হঠাৎ করে।এই দারিদ্র আর তার সাথে লাগাতার যুদ্ধ, সব রূপ,রস,গন্ধ যেন শুষে নিয়ে ওর জীবনটাকে ছিবড়ে করে দিয়েছে। শুধু দীপুকে দেখলে একটু বুকে বল পায়, মনে হয় আবার সব ফিরে পাবে।
একটু বেলা বাড়তেই ওদের দেখা যায়। নতুন কাপড় আর লাল গামছা গায়ে কিছু মহিলা পুরুষ মাটির মালসা হাতে নিয়ে ভিক্ষে করছে আর থেকে থেকে "বাবা তারক নাথের চরনের সেবা লাগে, মহাদেএ এ এ এ…..ব বলে ফুকরে উঠছে। শিব দুগ্গা,কালীরা রাস্তায় বেরিয়েছে। গৃহস্থের ঘর থেকে চাল ,আলু, টাকা এসব পায়। দোকানিরাও দেয়, যে যেমন পারে। দীপু দশ টাকা দিল। রোদ প্রখর , বাতাসে আদ্রতার হার বেশ বেশী। শিবের মুখের রঙে ঘামের দানা জমেছে। নিমাই বলে, "একটু জিরিয়ে যাও গো, জল খাবেন নাকি এক ঢোঁক। ফুটপাতের পেছনে দেওয়াল ঘেঁষে রঙচটা প্লাস্টিকের টুলে বসে এক চুমুকে জল শেষ করে মহাদেব একটু হাঁপান।তাঁর মুখটি শীর্ণ, চোখ দুটোতে জমেছে রাজ্যের ক্লান্তি। সারা শরীরে পাকে পাকে সাপের মত জড়িয়ে আছে করাল দারিদ্র্য।বিড়ি খাওয়া কালো ঠোঁট দুটো চেটে খসখসে গলায় বলে, "গত দুবছর এসব বন্দ ছিল,ভালো করি খাওয়া জোটে নি অনেক দিন, বেঁচে থাকব সে ভাবিনি কো। এবার দুটো পয়সা পাব বলে সেই কত দূর থেকে আলাম …, কিন্তু শরীলটা আর দিচ্চে নি ।" কালী বিড়ি ফুঁকতে, ফুঁকতে কার সাথে একটা খসাটে মোবাইলে কথা বলছিল। ফোনটা গোলাপী রঙের ঝলঝলে ব্লাউজের ভেতর চালান করে খড়খড়ে গলায় শিবকে বলল "ওটো দেকি একন, বসি ,বসি ওতো প্যাঁচাল পারতে হবে নি। এখনও অনেক দূর যাওয়ার লাগে।" থতমত শিব ত্রিশূল নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, করুণ হাসে। নিমাই ওকে আরো দশ টাকা দেয়। টাকাটা নিয়ে ক্লিষ্ট হেসে মহাদেব হুঙ্কার তোলেন "ববোম ব্যম"। আশপাশের চিৎকার শোরগোলে সে আওয়াজ চাপা পড়ে যায়, শুধু দীপুর বুকের ভিতর সে চিৎকারের রেশ কান্না হয়ে বাজতে থাকে।
হোটেলের কাজটা দীপুর খুব পছন্দের ছিল।হাতের কাছেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। চারপাশটা কেমন ধোঁয়া,ধোঁয়া কুয়াশা মাখা। জঙ্গলে জড়ানো পাহাড়ের সারি আর একটানা ঝিম ধরা ঝিঁঝির ডাক। ওই হাড় কাঁপানো ঠান্ডা, তার মধ্যে সারাদিন খুব পরিশ্রম করতে হতো দীপুকে। কিন্তু কাজটা করতে ওর এতো ভালো লাগত যে পরিশ্রমটা গায়ে লাগত না। তাছাড়া রমেন ওকে বেশ ভালোও বাসতো। হোটেলটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল রমেনের দীপুও ওর সাথে থাকতে ,থাকতে স্বপ্ন দেখতে শিখছিল। কিন্তু সব হট করে বদলে গেল। গরিব ঘরের ছেলে দীপু, জীবনে সে ভাবে কিছুই পায় নি। হোটেলে কাজ করার সূত্রে কত রকমারী লোক, কত অদ্ভুত জীবন দেখল ও । তার ওপর অমন উদাত্ত প্রকৃতি, কি তার রূপ । সারাদিনের সব ক্লান্তি এক মুহূর্তে উধাও হয়ে যেত কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে দাঁড়ালে। জোৎস্না রাতে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে প্রথম দেখে অনেকক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল দীপু । দরিদ্র পরিবারের ছেলে, জীবনে কখনো ভাবে নি এমন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হবে । সেই পাহাড়ের বরফ চুড়োয় যখন ভোরের আলো ঝলকায়, সূর্যাস্তের সিঁদুরে লাল রং লাগে ,ওর যেন এক অলৌকিক অনুভব হয়। ওই মায়াবী মুহূর্তে বৃন্দাবন পাল লেনের এঁদো পুরোনো স্যাঁতসেঁতে বাড়িটা আর তার লোকগুলোর জন্য দীপুর মন কেমন করে ওঠে।
পৃথিবীটা যে কত বিশাল ,আর জীবন যে কত বড় হতে পারে, সে ভালো বুঝতে পারে দীপু। কিন্তু কি হল! ফুটপাতে বসে এখন জামা কাপড় বেচছে। প্রথম কটা দিন কান্না পেত ওর। সারাদিন ধরে অবিশ্ৰান্ত গাড়ি চলছে আর তারস্বরে হর্ন বাজছে, চিৎকার আর চেঁচামেচি। মাথায় ওর যন্ত্রনা হয় । অথচ দু বছর আগেও কি অদ্ভুত এক নৈঃশব্দের মধ্যে ওর দিন কাটতো। এর মধ্যে বসেই নিমাইরা এত বছর ধরে দোকান চালাচ্ছে যে কি করে কে জানে। নিমাইকে বললে ও বলে "সেই কবে থেকে এ কাজ করচি। সব হলো অব্যেস, বুঝলি না!" দীপুর কষ্টটা নিমাইও বুঝতে পারে, কিন্তু কি করবে। বড় হোটেলে কাজ করতে গেলে আরো পড়াশোনা লাগবে। পয়সা কোথায় পাবে নিমাই? বিকেল হলে রতনের দোকানে চা খেতে যায় দীপু। ট্রাম রাস্তাটা সোজা চলে গেছে শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় অব্দি। নেতাজীর মাথার ওপরে চৈত্রের নীল আকাশে সাদা মেঘের মিনার ।সে দিকে তাকিয়ে থাকলে মেঘের ফাঁক দিয়ে যেন উঁকি মারে বরফঢাকা ছায়া ছায়া পাহাড়চূড়া। শেষ অস্তরাগের আলো পড়ে তার মাথার সোনার মুকুটখানা ঝলমল করতে থাকে। দীপু তখন চোখে ঝাপসা দেখে।
টাউন স্কুলের পিছন দিকে গলির ভেতর দীপুদের বাড়িটা অনেক পুরোনো । বহুদিন কোনো সংস্কার হয় নি। সে যাই হোক এবাজারে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তো বটে। দুতিন ঘর ভাড়া আছে বটে, তবে সেই নিমাইয়ের বাবার কাল থেকে আছে বলে ভাড়ার পরিমাণও নাম মাত্র। সেদিন রাত এগারোটা বাজল বাপ ছেলের বাড়ি ফিরতে। কনক বলল "বচ্ছর কার দিন, এক তারিখ একটু মাংস এনো না ,তবে একটু পোলুয়া করি। কত দিন এসব রান্না হয় না।" তপু,হিমি বেশ খুশি হয় । নিমাইকে বলে, "আনো না বাবা, সত্যি এই দুটো বছর তো কোন আনন্দই হয় নি।" নিমাইয়ের বিক্রি ভালোই হচ্ছে, মনটাও ভালো। সে হেসে বলল," হবে হবে।এ দুবছর ধার জমেছে কত সেগুলোও তো শোধ দিতে হবে ।" দীপু চুপচাপ বসে খায়। ওর মুখটা দেখে মনটা খারাপ লাগে নিমাইয়ের। রাতের বেলা স্বামী স্ত্রীতে আলোচনা করে কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পায় না। দীপুও খুব চেষ্টা করেছিল সিকিম না হোক আশে পাশে এমন আরো অনেক জায়গার কোনো হোটেলে যদি কিছু জুটে যায়। ড্রুকপা হোটেলে কাজ করার সময় কিছু জনের সাথে আলাপ হয়েছিল দীপুর। এ কদিন ধরে সবাইকে ফোন করল কিন্তু কেউ তেমন আশার কথা বললনা। দীপুর মনটা ভেঙে যাচ্ছে। বাবার পাশে দাঁড়াতে হবে। পড়ার ক্ষতি হবে বলে ওকে দোকানে বসতেই দিত না নিমাই। কিন্তু আজকাল আর সবটা সামলাতে পারে না , বয়স হচ্ছে। ভালো টাকার কাজ না পেলে অত দূরে গিয়ে লাভের লাভ কিছু হবে না। দীপু অনেকরাত অব্দি জেগে থেকে নিজের ইচ্ছেগুলোর সাথে লড়াই করতে থাকে।
নিমাইয়ের অনেক দিনের ইচ্ছে ফুটপাথের দোকানটা তুলে একটা পাকা দোকান ঘর নেয়। বাবার দোকানটা ছিল একদম ট্রাম রাস্তার ওপর। তেমন এখন আর কোথায় পাবে তবে ফরিয়া পুকুরের কাছে ছোট একটা দোকান ঘরের সন্ধান পেয়েছে নিমাই। মালিককে চিনত, বিমলদা। ছেলেপুলে নেই, বিমলদার বউ চেনাজানা বিশ্বাসী লোক না পেলে দোকান ভাড়া দেবে না। একটু করে করে যা জমিয়েছিল, গত দুবছর সে সব বসে খেয়েছে। দীপুটার কাজটাও চলে গেল। রাতে ওরও ঘুম আসে না। কনককে বলে," ঘুমোলে?" সারাদিনের খাটা খাটনিতে ক্লান্ত কনক ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কি উত্তর দেয় স্পষ্ট বোঝা যায় না তবুও নিমাই বলে যায় ,"বুঝলে বৌদিকে বলতে হবে আর কটা দিন অপেক্ষা করতে। ভাড়াটা বড় বেশীই চাইছে। তার ওপর সেলামি আছে… নিজের মনেই বকতে থাকে নিমাই আর কনক কনকের মতো ঘুমতে থাকে। "দোকানে কিছু ভালো কোয়ালিটির শাড়ি রাখতে হবে আগের মত। আরো নানা ধরনের জিনিস যেমন ধরো, বেড কভার টেবিল কভার এসবও রাখতে হবে। দীপু যদি সাথে থাকে তাহলে দুবছরের মধ্যে কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিকই হবে, আমার মন বলছে।" মনের ভেতর খুব একটা আশা জাগে নিমাইয়ের। দুদিন পর নববর্ষ , নতুন বছরে সব ভালো হবে। "আগের মতো সব ঠিক হয়ে যাক মা," দেওয়ালে লাগানো মা ভবতারিণীর ছবির দিকে তাকিয়ে মিনতির সুরে প্রার্থনা করে নিমাই।
চড়কের মেলা লেগেছে ছাতুবাবুর বাজারে। পুরো লম্বা টানা রাস্তা ধরে নানান পসরা নিয়ে বসেছে দোকানিরা। সারাদিনই মোটামুটি ভিড় ছিল তবে সন্ধ্যাবেলায় মানুষের ঢল নামল। চারপাশের চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে আনমনে ঘুরে বেড়ায় দীপু। আজকে দোকানে তপু আর হিমি আছে নিমাইয়ের সাথে। মনটা ওর অস্থির একটু। গুল ওস্তাগর লেন দিয়ে ঢুকে এলোমেলো হাঁটে। বিডনরো ধরে হেঁটে, অলিগলি সব পেরিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছয়। চার পাশে বেশীর ভাগ দোকানগুলো সেজে গুজে কালকের হালখাতার জন্য তৈরি হচ্ছে। উৎসবের আনন্দটা জমাট বাঁধছে ধীরে ধীরে।
মনটা ভালো হলো দীপুর দোকানের কাছে এসে। সেই পুরোনো দিনের মতো ভিড় করে লোক জিনিস কিনছে। সব দোকানেই বিক্রিবাটা ভালো হচ্ছে। তবে নিমাইয়ের এই ব্যবসা দুপুরুষের, সে জন্য ওর পরিচিতিও কম না।নিমাই বলে এটাই নাকি ওর আসল মূলধন। হিমি তপু খুব ব্যস্ত। তাড়াতাড়ি কাজে লেগে যায় দীপু। নিমাই ওকে দেখে হেসে বলে, "ভাগ্যিস সকালে তারককে দিয়ে আরো মাল আনিয়ে ছিলাম । শাড়ি পাঞ্জাবি আর পাজামার কাটতিটা বেশ ভালো বুঝলি।" দরদর করে ঘামছে নিমাই। ওর খুশি মুখটা দেখে দীপুর কেমন স্নেহ হয় বাবার ওপর।
নববর্ষ পড়ল শুক্কুর বাড়ে। সকাল সকাল বেরিয়ে ঠনঠনে কালী মন্দিরে গিয়ে পুজো দিল কনক আর নিমাই। সকালে তারক গিয়ে আজ দোকান খুলবে। বাড়ি ফিরে চা বসালো কনক, ছেলে মেয়েকে ডাকল। নিমাই আসার সময় একটু মুরগির মাংস দই মিষ্টি নিয়ে এসেছে। মনটা বেশ ভালো লাগছে সবার। অনেক দিন পর প্রাণ ভরে শ্বাস নিল কনক। সকালের রোদেও যেন সোনা রং ধরেছে। দীপু ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে জানলা দিয়ে তিনকোনা আকাশটা দেখছিল। নির্মেঘ নীল আকাশ। সাদা মেঘের মিনারগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। আবছা পাহাড়, ওর সেই ছায়া ছায়া বরফ চূড়াটাও যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। কনক বলে , "মুখ ধুয়ে আয় দীপু, চা খাবি না?" নিমাই ঘরে ঢুকে চুপ করে খানিক ছেলেকে দেখল। "আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখিস বলত?" নিমাই দীপুর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। "কিছু না তো," অপ্রস্তুত হাসে দীপু। বলে ,"লাভের টাকা এবার থেকে কিন্তু কিছু করে করে জমাতে হবে বাবা। নতুন বছরে প্রথম দিন থেকেই বরং শুরু করে দি। তারপর বেশ কিছু জমলে চলো তোমাদেরকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখিয়ে আনি।"
No comments:
Post a Comment