Saturday, November 2, 2024


 

প্রবন্ধ 


মাল‍্যবান, কাঞ্চনফুলের কবি এবং অনুবাদ 

মাল‍্যবান মিত্র

ইংরেজি সাহিত্যের পরিচিত মুখ রেবেকা হুইটিংটন সম্প্রতি পাশ্চাত্য সাহিত্যের পাঠকদের জন্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন একটি উপন্যাস , যে উপন্যাসের  , শুরু ও সমাপ্তির অবকাশ নেই , রিক্ত হৃদয়ের করুণতা ছত্রে ছত্রে প্রতীয়মান।  মনখারাপ উদযাপন থেকে সমাজ , দৈনিক জীবনের ওঠাপড়া , জৈবিক টানাপোড়েন থেকে মধ্যবিত্তের যাপনসীমানার মধ্যে থাকা মানুষদের দ্বন্দ্ব , জীবনদরিয়ার সহযাত্রীদের মধ্যে তৈরী হওয়া আক্ষেপ - রিরংসা , ছত্রে ছত্রে বিদ্যমান সেই উপন্যাসে !  অনুবাদিত সেই উপন্যাসটির নাম “ মাল্যবান ”  , এবং সেই উপন্যাসটির রচয়িতার নাম জীবনান্দ দাস।  

                                                               জীবনানন্দ দাস অনুবাদ করা যেকোন অনুবাদকের কাছে একটি বাস্তব চ্যালেঞ্জ। কারণ জীবনান্দের সাহিত্য শুধুমাত্র শব্দ এবং বাক্যাংশের অনুবাদ  না, এটি রঙ এবং সঙ্গীত, কল্পনা , বাস্তবতা , পরাবাস্তবতার কল্পিত  চিত্রের 'অনুবাদ' । অনুবাদ কে  ব্যাখ্যা এবং পুনর্গঠনের কাজ হিসেবে মনে করলে যখন জীবনানন্দের  কথা আসে, তখন তা  উভয়ই বেশ কঠিন। যদিও এর আগেও বহুবার জীবনানন্দের সাহিত্য অনুবাদের চেষ্টা হয়েছে। কবি বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে জীবনানন্দ নিজেই তাঁর কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন সেটি ছিল ১৯৫২ , তার অনুবাদের মধ্যে রয়েছে “ বনলতা সেন” , “ মেডিটেশন” , “ ডার্কনেস” যার অনেকগুলি এখন হারিয়ে গেছে। এগুলো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংকলন ও পত্রিকায় বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে। চিদানন্দ দাসগুপ্ত জীবনানন্দ দাসের সাহিত্যের অনুবাদ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 

"Effort has of course been made to see that the original's obliqueness or deliberate suppression of logical and syntactical links are not removed altogether. Sometimes Jibanananda's very complicated and apparently arbitrary syntax has been smoothed out to a clear flow. On occasion, a word or even a line has been dropped, and its intention incorporated somewhere just before or after. Names of trees, plants, places or other elements incomprehensible in English have often been reduced or eliminated for fear that they should become an unpleasant burden on the poem when read in translation".

জীবনানন্দের কবিতা  অনুবাদের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ নিজে ছাড়া  দুজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; একজন হলেন ক্লিনটন বি. সিলি [বই: A Poet Apart: A Literary Biography of the Bengali Poet Jibanananda Das (1899-1954)] এবং অন্যজন ফকরুল আলম [বই: Jibanananda Das: Selected Poems with an  Introduction, Chronology, and Glossary]। নিজের কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ একটু বেশি স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদের ব্যাপারে সেটা তার ও ক্লিনটন বা ফকরুল এর অনুবাদের তুল‍্যমুল‍্য বিচার করলে বোঝা যায়, অনুবাদেও তিনি সৃষ্টিশীল। 

মাল্যবান , বাশমতির  উপাখ্যান , কারুবাসনা , বিরাজ , চারজন , প্রেতিনীর উপাখ্যান , জলপাইহাটি প্রমুখ কোনো উপন্যাসই জীবনান্দের জীবনকালে প্রকাশিত হয়নি , মাল্যবান জীবনান্দের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস , যা ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই মাল্যবানের অনুবাদের প্রেক্ষিতে , আসল উপন্যাসটির দিকে ফিরে তাকাতে গিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গ  এর বলা সেই উক্তিটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে , একজন অন্য বিশ্বের , অন্য ভাষার  সাহিত্যিক হিসেবে, জীবনান্দের সাহিত্য সম্পর্কে বহির্বিশ্বের অনুভব ধারণা করা যায়।

    "One poet now dead, killed near his fiftieth year ... did introduce what for India would be "the modern spirit" – bitterness, self-doubt, sex, street diction, personal confession, frankness, Calcutta beggars ect [sic] – into Bengali letters — Allen Ginsberg


কবিতায় যেমনি, কথাসাহিত্যেও তিনি তার পূর্বসূরীদের থেকে আলাদা, তার সমসাময়িকদের থেকেও তিনি সম্পূর্ণ আলাদা। তার গল্প-উপন্যাসে আত্মজৈবনিক উপাদানের ভিত লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাই বলে এই রচনাগুলো আত্মজৈবনিক নয়। তার সর্বাধিক পরিচিত উপন্যাস মাল্যবান,সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি সদা  সোচ্চার সেই কবি  ,  কলকাতায়  ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে  হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা যখন  ছড়িয়ে পড়ে কবি তখন লেখেন ১৯৪৬-৪৭ কবিতাটি। দেশভাগের কিছু আগে কবি  কর্মস্থান  থেকে  ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসেন  ।  ছুটি বাড়িয়ে কলকাতায় দীর্ঘ কয়েক মাস অবস্থান করেন সেই  কবি  ।  ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের কিছু পূর্বে  সপরিবারে বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।


                                               কলকাতায়  ''দৈনিক স্বরাজ'' পত্রিকার রোববারের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা  শুরু  করলেন  সেই  কবি  । কিন্তু এই চাকুরি স্থায়ী হলোনা  ,  ছিল মাত্র সাত মাস। কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক একটি গদ্য রচনা মালিক পক্ষের মনঃপুত না-হওয়ায় এই চাকুরিচ্যূতি “মৃত্যুর  আগে ” এর  কবির  ।   কবি   দু'টি উপন্যাস লিখেছিলেন - ''মাল্যবান'' ও ''সুতীর্থ'', তবে জীবদ্বশায়   অপ্রকাশিত রেখে যান  “মহাপৃথিবীর  ” কবি  ।  এই  বছরেই   ডিসেম্বরে সেই  মানুষটির   পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ “  সাতটি তারার তিমির “  প্রকাশিত হয় এবং  এই   একই মাসে কলকাতায় মাতৃহারা  হন  বনলতা সেন এর কবি  , মা  কুসুমকুমারী দাশের জীবনাবসান ঘটে , যে  মা  সেই  কবে  লিখতে  পেরেছিলেন  –


“  আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে

কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে” –


                                                                  জীবদ্দশায় অন্নদা শংকর রায়ের "শুদ্ধতম কবি "এর  , তার একমাত্র পরিচয় ছিল কবি। অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে নিভৃতে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছিলেন প্রচুর যার একটিও প্রকাশের ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া ষাট-পয়ষটিট্টিরও বেশি খাতায় "লিটেরেরী নোটস" লিখেছিলেন যার অধিকাংশ এখনও  প্রকাশিত হয়নি।


                                                                              জীবনানন্দ কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। তিনি 'সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র' নামে একটি সংস্থার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই সংস্থার মুখপত্র দ্বন্দ্ব পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক নিযুক্ত হন। মাঝে তিনি কিছুকাল খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তার জনপ্রিয় কবিতার বই বনলতা সেন সিগনেট প্রেস কর্তৃক পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকানুকূল্য লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন-কর্তৃক ঘোষিত "রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার" জয় করে। মৃত্যুর কিছু পূর্বে হাওড়া গার্লস কলেজ-এ অধ্যাপনার চাকুরি জুটে গেলে তার কলকাতা জীবনের অপরিসীম দৈন্যদশার সুরাহা হয়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।


                                           জীবনানন্দের অধিকাংশ গদ্যপ্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো রচনাই ফরমায়েশী। সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজ, এই তিনটি পরিক্ষেত্রে জীবনানন্দ প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো লিখেছেন। তার বিশিষ্ট প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম এরকম - ‘কবিতার কথা’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা’, ‘মাত্রাচেতনা’, ‘উত্তররৈবিক বাংলা কাব্য’, ‘কবিতার আত্মা ও শরীর’, ‘কি হিসাবে কবিতা শ্বাশত’, ‘কবিতাপাঠ’, ‘দেশকাল ও কবিতা’, ‘সত্যবিশ্বাস ও কবিতা’, ‘রুচি, বিচার ও অন্যান্য কথা’, ‘কবিতার আলোচনা’, ‘আধুনিক কবিতা’, ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ’, ‘কেন লিখি’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘শরৎচন্দ্র’, ‘কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা’, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’, ‘পৃথিবী ও সময়’, ‘যুক্তি, জিজ্ঞাসা ও বাঙালি’, 'অর্থনৈতিক দিক’, ‘শিক্ষা ও ইংরেজি’, ‘শিক্ষা-দীক্ষা-শিক্ষকতা’, ‘শিক্ষার কথা’, ‘শিক্ষা সাহিত্যে ইংরেজি’ এবং ‘শিক্ষা-দীক্ষা’। বলা যায় যে সাহিত্য, বিশেষ ক’রে কবিতা নিয়ে জীবনানন্দ বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ উপহার দিয়েছেন। প্রতিটি রচনাই বহুমাত্রিক মৌলিক চিন্তাসূত্রের স্বাক্ষর বহন করে।


                                        শেষ পর্যন্ত মাল্যবান ভাবনার গল্প , যে ভাবনা বহুমাত্রিক , মাল্যবান সহ অন্যান্য জীবনান্দের উপন্যাস অনুবাদ হোক জীবনান্দের ভাবনায় নির্ভর করে। লাবণ্য দাস , জীবনানন্দের সহধর্মিনীর মতে জীবনানন্দ একেবারেই মাল্যবানের মতো ছিলেন না , তবু কবির মনের গহীন অন্তরে হয়তো মাল্যবান ছিল , যা   মাল্যবানের ভাবনাকে শেষে উধৃতকরে , জীবনান্দের প্রথম উপন্যাস - তার অনুবাদের খোঁজ ও তার সাফল্য কামনা করে , মাল্যবান উপন্যাসটির নাম হটাৎ করে আয়নায় দেখা দিলো।     


“ ঘড়িতে প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। মাল্যবান  দেখল, এতক্ষণ সে বিছানায় পিঠে শুয়ে অনবরত ভাবছে, আর সে সব ভাবনাই তার হৃদয়কে নিছক শুষ্ক করে রেখেছে – কোন তীর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তার চোখে ঘুমের পলক নেই। সে ধীরে ধীরে উঠে বসল। 

“ মাল্যবান”  - জীবনানান্দ দাস


No comments:

Post a Comment