মতামত
ডাক্তারদের আন্দোলন থেমে গেছে,অভয়া বিচার পাবে না
বটু কৃষ্ণ হালদার
হাসপাতাল হল সাধারণ, নিরীহ, মধ্যবিত্ত জনসাধারণের কাছে ধর্মীয় স্থান। ডাক্তাররা হলেন সেই ধর্মীয় স্থানের পূজারী। জীবনের সহায় সম্বলহীন আশাটুকু বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাসপাতাল নামক মন্দিরে উপস্থিত হন ভক্তরা। শুরু হয় দৈনন্দিন রোজনামচা। লাইন দিয়ে টিকিট কাটা, ইমার্জেন্সি রোগী ভর্তি করানো, স্ট্রেচার বারের জন্য দৌড়াদৌড়ি, রক্তের জন্য হুড়োহুড়ি, ডাক্তারবাবু ডাক্তারবাবু বলে চিৎকার, কেউ চোখের জল মুছে যায় কেউবা আবার হাসাহাসি করে,- প্রতিদিনের চেনা দৃশ্য গুলো ফুটে ওঠে হাসপাতাল চত্বরে। সবকিছু সমস্যা সমাধানের প্রধান ডাক্তার। ভক্তদের আহ্বানে পূজারীরা যথাসাধ্য মনস্কামনা পূরণ করার চেষ্টা করেন। তাই হাসপাতালে সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্ক একেবারে নাড়ির সঙ্গে গাঁথা। এই দুই সম্পর্কের বাঁধনটাকে আরও মজবুত করেন ডাক্তাররা। বলে রাখা ভালো হাসপাতাল হল প্রতিদিনের লাইফ লাইন। এই হাসপাতাল দিয়ে তৈরি হয় মানব প্রেমের পূজারীরা। অর্থাৎ জুনিয়র ডাক্তার। আগামী ভবিষ্যতের মানব প্রেমের প্রকৃত পূজারী। বহু পিতা মাতা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নিজেদের সন্তানকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখে। সন্তান ডাক্তারি পাস করে মানব সেবায় নিযুক্ত হবেন।অথচ ভগবান রুপী ডাক্তাররা বর্তমান সমাজে কসাই নামে পরিচিত হয়েছে। তার প্রধান কারণ হলো আরজিকর হসপিটাল-এর ঘটনা ও কিছু মানুষরূপী জানোয়ারদের কারণে।হাসপাতালে প্র্যাকটিস চলাকালীন রাজনৈতিক মদত পুষ্ঠ উধ্যতন কর্মচারীদের খুশি করতে হয় লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে, শারীরিক চাহিদা মিটিয়ে। নইলে মাঝপথে ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন ভরাডুবি হয়ে যায়। আর প্রতিবাদ করলেই তিলোত্তমার মত নৃশংস ভাবে খুন হতে হয়।এটাই সমাজের বাস্তব চিত্র।
প্রায় দুই মাস অতিক্রান্ত,দেশে বিদেশে জনগণ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য। শুধু নরপশুদের শাস্তি নয়, হাসপাতালে যে অন্ধকারময় দুর্নীতি হচ্ছে তা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে।কিন্তু সরকার এখনো অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর।পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জনগণকে বোকা বানিয়ে যাচ্ছেন প্রশাসন। শিক্ষাব্যবস্থা আজ দাঁড়িপাল্লায় ওজন হয় রাজনীতির রং দিয়ে। ডাক্তারি পড়ার যোগ্যতা নেই অথচ অনেকেই ডাক্তার হয়ে যায় শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে। আবার যে প্রকৃতপক্ষে প্রতিভাবান বা দক্ষ, অথচ আর্থিক ভাবে অক্ষম সে থেকে যায় উপেক্ষিত। এটাই এখন শিক্ষার মূল আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এবার আসা যাক প্রসঙ্গ যখন ডাক্তার।এরা কিভাবে সমাজের উপকারী বন্ধু? হাসপাতালে যখন একটা রোগী আসে তখন কোন ডাক্তার রাজনীতির রং দেখেনা। ধর্ম, জাতপাতের ভেদাভেদ ভুলে শুধু রোগীকে সেবা দিয়ে সারিয়ে তোলা যাদের একমাত্র লক্ষ্য। একজন রোগী হাসপাতালে সুস্থ হয়ে উঠলে, একটা সফল অস্ত্রপাচার হলে, একটা সুস্থ সবল নবজাতককে মায়ের কোলে হাসিমুখে ফিরিয়ে দিলে সবথেকে বেশি আনন্দিত হয় ডাক্তাররা। যারা ভগবানের আরেক রূপ, বর্ণময় চরিত্রের মহাউপাখ্যান। তেমনই একজন ডাক্তারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। অথচ এই বাংলায় অনেকেই আছে যারা সব থেকে বেশি সরকারি হাসপাতালে সুযোগ-সুবিধা নেন, তাদের বেশিরভাগ কিন্তু রাস্তায় নামেনি। তারা এখনো বুঝিয়ে দিচ্ছেন হাসপাতালের এই সিস্টেমটা চালু থাকলে তাদের কোন অসুবিধা নেই।
মেয়েটির মৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল নিজেদের জমি মাপামাপি করলেন। সেই সঙ্গে অপরাধীদের পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করে গেল দিনের পর দিন। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলের কোন ভূমিকা নেই, তারা নিরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, আবার জাত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বহু জনগণ জনগণ রাস্তায় নামলেও শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনে সুপ্ত আগুনে ঘি ঢেলে দাবানল হয়ে ওঠার অপেক্ষা করছে হাসপাতালে ডাক্তাররা। এর কারণ হলো পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তাই ডাক্তারদের আন্দোলন একমাত্র ভরসা অপরাধীদের সাজা দেওয়ার জন্য। প্রায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে নিজে কর্তব্য পালনের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সাধারণ জনগণ সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মিথ্যা গুজব রটাচ্ছেন,মানুষ খেকো, যুব সমাজের স্বপ্ন চূর্ণ চূর্ণ-বিচূর্ণ করা মানুষেরা। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার সব ডাক্তার কিন্তু কিন্তু কসাই নয়। মানবিকতার খাতিরে হাসপাতালে জরুরী বিভাগ পরিষেবা চালু রেখেছেন, সেই সঙ্গে নিহত জুনিয়র চিকিৎসকের নামে বিভিন্ন জায়গায় অভয়া ক্লিনিক খুলে পরিসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও ডাক্তারদের আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব রটিয়ে সাধারণ জনগণকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, ডাক্তারদের আন্দোলনের ফলে সারা রাজ্যে প্রচুর রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে।
এর থেকে বড় মিথ্যা আর হয় না, মালদার এক সরকারি ডাক্তারের মতে,-সারা রাজ্যে সরকারী ও বেসরকারি, ছোট ও বড়ো মিলিয়ে প্রায় ৩০০০ হাসপাতাল। জুনিয়র ডাক্তার, হাউস স্টাফ, পিজিটি একমাত্র মেডিকেল কলেজগুলোতেই আছে। এখন প্রতি জেলায় একটি করে মেডিকেল কলেজ, যাদের অনেকেরই প্রথম ব্যাচ বেরোয়নি, তাই intern তো অনেক দূরের কথা। পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অনুযায়ী PHC, BPHC, RH মিলে মোট ১২৫৭- টি,যেখানে কোনো জুনিয়র ডাক্তার নেই, ফলে সারা রাজ্যে আন্দোলন হলে ও এখানে চিকিৎসায় ব্যাঘাত হওয়ার কোনো কারণ নেই। পশ্চিমবঙ্গে তালিকায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অনুযায়ী বাংলার জেনারেল ও সাব ডিভিশন হাসপাতাল মিলে মোট ৭০ টির মতো, যেখানে ও কোনো জুনিয়র ডাক্তার নেই, ফলে সারা রাজ্যে আন্দোলন হলে ও এখানেও চিকিৎসায় ব্যাঘাত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, পশ্চিমবঙ্গ রেকর্ডে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতাল যেমন রেলওয়ে ই এস আই মিলে মোট ৬০ টির মতো, যেখানে ও কোনো জুনিয়র ডাক্তার নেই, ফলে সারা রাজ্যে আন্দোলন হলে ও এখানেও চিকিৎসায় ব্যাঘাত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, সারা রাজ্যে যে পৌরসভা ও কর্পোরেশন হাসপাতাল আছে তাদের ও কোনো জুনিয়র ডাক্তার নেই ফলে সারা রাজ্যে আন্দোলন হলে ও এখানেও চিকিৎসায় ব্যাঘাত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, প্রাইভেট হাসপাতাল তো রয়েছেই, যেখানে এখন স্বাস্থ্যসাথী সুবিধা নিয়ে ও চিকিৎসা চলছে, তাও বন্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাহলে, কটি হাসপাতাল রইল, যাদের পরিষেবা জুনিয়র ডাক্তারদের জন্য বিঘ্নিত হতে পারে সবমিলিয়ে ১৪ থেকে ১৬ টি হাসপাতাল, যা মোট হাসপাতালের 0.৫২%। সেখানেও একদিন নয়, এক ঘন্টার জন্য ও কোনো পরিষেবা বন্ধ হয়নি। গুজবে কান দেবেন না, সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবা আগের মতোই ২৪ ঘন্টা ৩৬৫ দিন আগের মতই চালু আছে।
তবে ডাক্তারদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো অভয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের জমি পাকা করে নিতে ব্যস্ত। কারণ সব রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের গতি প্রকৃতি মূল কেন্দ্র থেকে ফিরিয়ে দেওয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাত দখল,দিন দখল,ফুটপথ দখল, রাস্তা দখল, প্রতিবাদী গান, কবিতা, পথনাটিকা মিটিং মিছিল হওয়ার পরেও আন্দোলন উদ্দেশ্য বিহীন হয়ে পড়ছে।
তাই অভয়ার বিচার পেতে হলে ভরসা কিন্তু ডাক্তারদের আন্দোলন। মেয়েটি হাসপাতালে দুর্নীতি নামক বিষাক্ত অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিল। হাসপাতাল দুর্নীতিমুক্ত হলে সাধারণ জনগণের সবথেকে বেশি পাবেন। অথচ মেয়েটি মারা যাওয়ার ফলে সবাই কিন্তু রাস্তায় নামেনি। তাই সবার প্রথমে ডাক্তারদের পরিষেবা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। বিনামূল্যে অভয়া ক্লিনিকে পরিষেবা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তবেই সব জনগণ রাস্তায় নামবে। আর সব জনগণ রাস্তা নামলে বিচার অতি দ্রুত হবে। নইলে ভবিষ্যতে এমন ভাবে ডাক্তার মারা যাবে আর সাধারণ জনগণ শুধু নিজেদের সুবিধাটুকু বুঝে নেবে এটা মেনে নিলেই আগামী ভবিষ্যতে ডাক্তারদের উপর চরম শাস্তির খাঁড়া নামতে পারে। ডাক্তারদের আন্দোলন পূর্ণ সমর্থনযোগ্য। তারা ও একটা পরিবারের মত। সেই পরিবারের একজনকে কর্তব্যরত অবস্থায় নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে,তাই সুবিচারের আশায় তারা পরিষেবা বন্ধ করতে পারে করতেই পারে, দিনের পর দিন রাস্তায় নেমে অনশন করতেই পারে। আর এমন জঘন্য অপরাধের সমাজের কখনো বন্ধু হতে পারে না। আরে কঠোর শাস্তি হলে সমাজ থেকে কিছু জঞ্জাল পরিষ্কার হবে।আর লড়াইটা হল শিক্ষিতদের সঙ্গে অশিক্ষিত মূর্খ ছুঁচো সভ্যতার সঙ্গে। সে বিষয়টা মাথায় রেখে সবাইকে ডাক্তারদের আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করুন।
(মতামত ব্যক্তিগত)
No comments:
Post a Comment