দুটি সুর
শুভেন্দু নন্দী
ফাগুন মাসের বিদায় ঘন্টা বাজতে আর যে বেশী দেরী নেই। ঠান্ডা -গরমের এখনও মিশ্র অনুভূতি। রোদের তেজ তেমন তীব্র নয়। বসন্তে কোকিলের একটানা কুহুরবে চারিদিক আজ সচকিত।.... মৈনাক এইমাত্র বাড়ি ফিরলো- বন্ধুদের সঙ্গে মজলিসি আড্ডা সেরে। বাঙালী যেমন কর্মবিমুখ; তেমনি আবার আড্ডাপ্রিয়। তবুও মনটা তার আজ ভারী। সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা - আড্ডার এই যে মানসিকতা, এটার ছন্দপতনের কথা ভেবে। ব্যাপারটা তবে খুলেই বলা যাক। গতকাল teachership-এর নিয়োগপত্র পেয়েছে মৈনাক। স্পষ্টতঃই বাড়ির সকলেই উচ্ছ্বসিত। মা আর ছোট্ট বোন টুমপা। বাবার সরকারী চাকরী। শেষ হবার মেয়াদ আর মাত্র একমাস। পি.এইচ.ডি. করছে ওর বোন। মৈনাকের চাকরীর স্থল বাড়ি থেকে বেশ দূরে। অবশ্য এটার কথা এখনই ভাবছেনা মৈনাক। বাবা-মার মুখে হাসি ফুটেছে-এটাই ওর কাছে ভীষণ স্বস্তিদায়ক। আজ সে খবর তার বন্ধুমহলে ছড়িয়ে দেবার জন্য সকাল সকাল তার আড্ডার স্থলে হাজির হয়েছে। বলা বাহুল্য, সকলেই উচ্ছ্বসিত। "বেকারত্বের জ্বালা তোর এতদিনে ঘুচলো রে- আমাদের যে কি হবে?" সকলেই একথা সমস্বরে ঘোষণা করলো বেদনাহত হয়ে। সকলকে চায়ের দোকানে বসে মিষ্টিমুখে আপ্যায়িত করলো। সঙ্গে অবশ্যই চা। দীর্ঘায়িত হোলো তাদের কথাবার্তা। অবশেষে বাড়ি ফিরলো সাইকেল চালিয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে। সব কিছুই তার আজ নতুন লাগছে। আকাশ,বাতাস- সবুজ, মধুর,রঙীন- সব কিছুই তার এই চাকরী পাবার সুবাদে। শিক্ষকতার চাকরী এই দুর্মুল্যের বাজারে ! সে স্বগতোক্তি করে উঠলো। Salary-তো রীতিমতন lucrative! সব কিছুর প্রাপ্তি S.S.C.-এর বদান্যতায়। বন্ধুবান্ধবদের সাথে রীতিমতন আড্ডা, গল্পগুজব, রাজনীতি,খেলাধূলো,সাহিত্যচর্চার খোলাখুলি আলোচনা, চায়ের পেয়ালায় ঘন্টার পর ঘন্টা তুফান-এগুলো বন্ধ হবার চিন্তায় তার মন ক্রমশঃ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। তাদের সাথে আসন্ন বিদায়ের কথা ভেবে রীতিমতন মুষড়ে পড়লো মৈনাক। সাতদিন পরেই তার চাকরিতে যোগদানের কথা ভেবে একই সাথে পুলকিত আবার বিষাদগ্রন্থ হয়ে উঠলো মন।
-"দাদা- আমাকে কিন্তু একটা অত্যাধুনিক মোবাইল ফোন কিনে দিতে হবে" বোন আবদার করে বলে ওঠে।
-আমাদের কথাও কিছু ভেবেছিস কী?" বলে বাবা-মা রগড় করতে থাকলেন।
-" সব হবে। সব হবে।" হাসতে হাসতে বলে ওঠে মৈনাক।
- কি গো ? তোমার আবার কি হোলো?" মা শুধালেন বাবাকে।
-" কিছু হয়নি তো" বাবার চটজলদি উত্তর।
কিন্ত মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে থাকেন-"তোমার হোলো শুরু, আমার হোলো সারা। আর মাত্র তো একটি মাস। তারপরই তো retirement. এতদিনের ছকে বাঁধা routine-এর বিরাট একটা
ছন্দপতন ঘটবে।"
কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটা গান তাঁর
বিশেষভাবে মনে পড়ে গেলো- "চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়"
No comments:
Post a Comment