Friday, May 2, 2025


 

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলা নববর্ষ
                                 শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী

"এভাবেই একক দশক
একেকটা বৈশাখ
রোজকার খোসা ছাড়ানোর জ্বালা ভালোবেসে
একেকটা লাঠি হেঁটে যায় দুর্মর “

পয়লা তারিখে একটু বেলা করে বিছানা ছাড়ার কি উপায় আছে নাকি! নতুন বছরের শুরু বলে কথা। বছরে দুটিই তো জোটে, জানুয়ারীতে একটি, অন্যটি বৈশাখে। একখানি হ্যাংলা, অন্যটি বাংলা। সে সময়ে আয়েসে বিছানা জড়িয়ে তিনি থাকতে দেবেন না। হাঁক শুনেই ঘুমের বারোটা বেজে যেতে কতক্ষণ।
- কী হল কি, নিকষার মেজ ছেলের মতো ঘুমাবে? বচ্ছরকার দিন, এর পরে কিছু থাকবে বাজারে! সারা জীবনটাতো আলু ভাতে কেটে গেল, আজকের দিনে কি একটু মাংস জুটবে না! বাপের বাড়ি ছাড়ার পর থেকে ভালো খাওয়াই তো ভুলে গেছি।

বোঝো কান্ড! দিনটা গেল আজ পয়লায়। আটশো টাকার মাটন আজ হাজারে কাটবে। পকেট তো বামদলের অসময়ের ব্রিগেডের, পনের দিন গেলে সেখানে চামচিকেতে বাসা বাঁধে, সেটা তখন এবানডন্ড এরিয়া। হাত ঢোকাতে কেবল গোপন জায়গা চুলকোলে।  

অগত্যা পুরনো থলেটাকে ঝাড়া দিয়ে, ফতুয়া গলিয়ে দে হাঁটা। যে কটা টাকা আছে একাউন্টে, খালি করেই আসি।

সবের দাম বাড়ছে, ইলেক্ট্রিক থেকে গ্যাস, দুধ থেকে কাজের মাসি, সরকার ধ্যানমগ্ন, শিবনেত্র ।

থলেখানি হাতে তুলতেই মনে পড়ে গেল পংক্তি কটা। কোট আনকোট থাকার মানে কথাগুলি কোনো নামজাদা বড় কবির থেকে ধার করা, তা কিন্তু নয়। যদি কেউ সেরকম ভেবে রাখে তাহলে বড় ভুল হবে। সামান্য লেখোয়ার আমিও, তার মাথা থেকেই কিভাবে বেরিয়ে এসেছিল কে জানে! যদিও তার লেখার কেউ ধার ধারে না, লবিই ক্রিয়াশীল সর্বত্র। লবির আমি লবির তুমি, লবি দিয়ে যায় চেনা ।

আসলে উপলব্ধি ব্যাপারটা নিজস্ব, যাকে বলে ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু আহ্নিক ও বার্ষিক গতি প্রাকৃতিক এক ফেনোমেনান। বিজ্ঞানী বলবে বিজ্ঞানের কথা, আস্তিক বলবে সব ঈশ্বরের খেলা। পৃথিবী চব্বিশ ঘন্টায় নিজে একবার পাক খাছে, রাত হছে দিন হচ্ছে। খাচ্ছো খাও, কবীর সুমন বলেছিল না -খাঁও খাঁও। তা খাও না বাপু, ওরকম সূর্যের চার পাশে পাক খাওয়ার কি দরকার ছিল! তাতেই তো নববর্ষ আসছে। "খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে।"  তোমার এ খেলায় তো আম বাঙ্গালীর শ্বাস উঠে যাবার যোগাড়।

কে যে কোথায় কোন খেলা খেলে আমআদমীর বোঝা মুশকিল। খেলাও কত রকমের, ইন্ডোর আউটডোর। যেটি বাইরে হয়, তা লোকে দেখে। ইন্ডোর খেলা দেখার সুযোগ নেই দর্শকের। নিজেরা খেলে নিজেরাই দেখে। দিল্লী কা লাড্ডু, যো খায়া ও পস্তায়া ।

চৈত্রের গরম পড়তে না পড়তেই সুপ্রিম আদালত উত্তপ্ত। ছাব্বিশ হাজারের দানাপানি বন্ধ, খেলার গেরোয়। আদালত হচ্ছে গিয়ে সাত্ত্বিক একটি সংস্থা , সারা বছর নিয়ম করে চলে। তার চালের গামলায় দু চারটি মুসুর ডাল পড়লে চলবে কেন! তুমি কেন এই অকম্মটি করেছো। দাও ফেলে সব পুকুরের জলে।

দুর্গা মা যাবার পর থেকে আকাশে শুকনো খটখটে। মেঘের দেখা নাই রে, বৃষ্টির দেখা নাই।

যার পায়ে খেলা আছে, সে তো খেলবেই। খেলা তো একার কারো বাপের না। বৈশাখ এ বছর ইনিংস শুরু করলো এক পক্ষের চোখের জল, আরেক পক্ষের বুক কাঁপুনি দিয়ে।  প্রথমে ভিজলো অভয়ার মা-বাবার চোখ, তারপর রাজপথ। পথ দখল হল, রাত দখল হল। তরমুজ মন্ত্রী বলেন, লাল পাখি পথে এসেছে। তাই কি? নীল সাদা পাখি ছিল না! টিয়া, ময়না- এগুলো কি চুপ মেরে গেছে সেন-গোস্বামী-সরকার-মুখার্জীদের মতো! ওরা দানাপানিতে ঠোঁট ডুবিয়ে উড়তে ভুলে গেছে।

রাজপথ আবার সরগরম। ধর্ণা, অবস্থান, লড়াই। লড়াই লড়াই চাই , লড়াই করে বাঁচতে চাই। কে বাঁচাবে? ঘোর কলি, প্রত্যেকে নিজে বাঁচলে বাপের নাম। ডুবছে মানুষ ওরা সন্তান মোর বিমাতার।  

তাতে কি? আমরা দক্ষিণের ঢেউয়ে আছি, আছি উত্তরের ফেস্টে। রোম পোড়ার পুড়বে, তার জন্যে বেহালার সুর কেটে গেলে আর কি পাওয়া যাবে! তাছাড়া একদিনে যখন সে গড়ে ওঠেনি, একদিনে মরেও যাবে না। যাবে, নিশ্চয়ই যাবে, স্লোলি বাট স্টেডিলি।

একটা চোর ধরতে সাধুগুলিকেও ল্যাঙ্গট খুলতে হল। বেনিফিট অব ডাউট বাইশ গজে আর কাঠগড়ায় আছে। সিভিল কোর্টে সে সব নেই। ফলে হাহাকারের তুলিতে তৈরী হল নববর্ষের চালচিত্র এবারে।

রাজপথ গরম, মরা বাঁচার লড়াই বলে কথা। আগস্ট থেকে সন্তান হারানোর ব্যথা তো ছিলই। রাত দখল, রাস্তা দখল। কিছু হল কি? ঐ ঘাড়ের নাম গর্দান হল। যে ধরা পড়েছিল, সেই ধরা থাকলো। শুধু শুধু সময় নষ্ট। এমন আওয়াজ দিচ্ছিল যেন মেঘ ভাঙ্গা বর্ষণ হবে, যেন মুরগী ফুটবল ডিম পাড়বে। খুন নাকি গণধর্ষণ সেটাই তো চুল্লিতে পুড়ে নাই হয়ে গেল মুরুব্বির উৎসাহে।

সেই আগুনেই ঘি পড়লো যেন। আন্দোলন ঢেউ তুলে দিল সমাজে। অস্থির হল রাজ্য। জ্যোতিবাবু বলেছিলেন না এক কালে, পুলিশ কি রসগোল্লা ছুঁড়বে! তাই বৈশাখ শুরু হল লাঠিতে ও লাথিতে। বাংরেজীতে অনুবাদ করলে বানান তো দুটোর একই।

আগুন ধিকিধিকি ছিলই। পাশের রাস্ট্রে লুট পাটের নমুনা দেখেছি এপারে বসে। মাতৃসমার অন্তর্বাস হাতে নিয়ে কিভাবে উল্লাস করেছে ছাগলগুলো। মুরগী, বালতি, কম্পিউটার - কিছুই বাদ রাখেনি কোলে তুলে নিতে।

এপারেও দেখলাম একই রকম ছবি। কোলে ছাগল তুলে চলে গেল ছেলে ছোকড়ার দল, গরু টেনে নিয়ে গেল। বাবা ছেলে খুন হল হাত ধরাধরি করে। ওয়াকফ আইন নাকি এর কারণ। কত জন এটি পড়েছে , তা নিয়ে একটা সমীক্ষা হওয়া দরকার ছিল বছরের শুরুতেই। কে করবে? কে দেবে কার গোয়ালে ধোঁয়া? পুতুল নাচে মঞ্চ , সূতো পেঁচানো ওস্তাদের আঙ্গুলে।

আমরা এবছর এভাবেই আছি। দুঃখে কান্নায় হাহাকারে। বাজার কিন্তু তার কাজ করেই চলেছে , গতকাল জ্যোতি-আলু এগারো টাকা, তো আজ পনের টাকা। ফড়েরা সদ্ব্যবহার করছে সুযোগের। তিন তলা বাড়ি বানাচ্ছে রাজবাড়ির মতো।

তবে একটা এচিভমেন্ট আছে। মানুষ ও হনুমান জাতির মধ্যে মিসিং লিঙ্কটি খুঁজে পাওয়া গেছে এ বছরের রামের জন্মদিনে। মিস্টার ডারউইন যদি থাকতেন, তিনি খুশি হতেন, নাকি ওপেনআইমারের মতো ফুপিয়ে কাঁদতেন, কে জানে !

 কেলগস কলেজের সভায় মহারাজ ঘোষনা করলেন, শিল্প হবে। হোক বা না হোক, এটা কি কম পাওনা! অন্ততঃ আশায় বাঁচে চাষা।

এমন রুক্ষদিনে প্রেমের জয়গান শুনলে কার না ভালো লাগে। বৈশাখী দোলা দিলেই মন নেচে ওঠে সুরে। সেখানে বয়স ইজ জাস্ট আ নাম্বার। ঘোষে বোসে না হোক, মজুমদারে হলেই বা  ট্রোল কেন বাপু। ওদের সুখেই আমাদের আনন্দ। এরম ভাবলে দোষ কোথায়!

প্রেক্ষিত যেমনই হোক,  নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম। পথ মসৃণ হোক, হোক ফুলে ফলে ঢাকা, সে পথে আমরাও গড়িয়ে যেন দিতে পারি চাকা । 

No comments:

Post a Comment