আজও অপেক্ষিত ছড়াসম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদার
(বিবৃতির অনুপ্রেরণায় উত্তরে কবির জন্মদিন।
কবির ছাড়ায় মানব সত্তার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিশু চেতনার বিকাশ)
সঞ্জয় সাহা(এস. সাহা)
“এক দুর্গা রিক্সা চালায় কুচবিহারের হাটে
এক দুর্গা একশো দিনের কাজে মাটি কাটে।
এক দুর্গা রাস্তা বানায় পিচ ও পাথর ঢালে
এক দুর্গা রোজ চুনো মাছ ধরছে বিলে-খালে।
এক দুর্গা করছে মাঠে দিনমজুরের কাজ
এক দুর্গা খিদেয় কাঁদে, পায়নি খেতে আজ।
সবাই জানি, এদের কারো হয় না কোনও পূজো
এরা তো মা তোমার মতো নয়কো দশভুজো।
সব দুর্গার চোখে-মুখেই ফুটবে হাসি কবে?
মাগো, তোমার পুজো সেদিন সত্যি সফল হবে।”
কবির দরদি মনের পরিচয় এবং বাস্তব জীবনের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ কবিতাটিতে ধরা পড়েছে। আমরা মৃত্তিকার দুর্গা বানিয়ে পুজো অর্চনা করি, কিন্তু প্রকৃত রক্তমাংসের দুর্গারা হয় অবহেলিত উপেক্ষিত। এই কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি সমাজকে জাগাতে চেয়েছেন।
বাংলা ছড়ার জগতে যার অবদান কোনোদিনই ভোলা যায় না, তিনি হলেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। নিপাট মাটির মানুষ, খুব আন্তরিক, খুব কাছের সকলেরই আপনজন। শিশু-কিশোর থেকে বড়রাও তাঁর ছড়ায় মুগ্ধ না হয়ে পারত না। বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখে মুখে আবৃত্তি হত তাঁর ছড়া। শিশু মনস্তত্ত্বের উপর এতটা বেশি প্রভাব তিনি ফেলতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই মহান মানুষটি বাংলা সাহিত্যে উপেক্ষিত রয়ে গেলেন। তার মৃত্যুর পরেও তাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা গেল না উত্তর থেকে দক্ষিণ কোন বঙ্গেই কোন উদ্দীপনা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাংলা সাহিত্যে উপেক্ষিতই থেকে গেলেন। মরণোত্তরও তাঁকে দেওয়া হয়নি কোন সরকারি সম্মান। কোনো ছড়া স্থান পায়নি শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে। একমাত্র সত্যজিৎ রায়ের হাতে সম্মানিত হয়েছিলেন 'সন্দেশ' পত্রিকার পক্ষ থেকে "সুকুমার রায় স্মৃতি" পুরস্কার। এছাড়া আর তাঁর ভাগ্যে জোটে নি কোন সরকারি সম্মান। এই মহান ব্যক্তিটিকে সসম্মানে বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরতে এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রতিভাকে মূল্য দিতে উদ্যোগী হয়েছেন উত্তরবঙ্গের 'বিবৃতি' সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মাননীয় দেবাশিস দাস মহাশয়। মাননীয় দেবাশীষ দাস মহাশয়ের অনুপ্রেরণায় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের জন্মদিন যথা মর্যাদা সহিত পালিত হয়। তারই অনুপ্রেরণায় বিপুল আচার্য সম্পাদিত 'শব্দ' পত্রিকার উদ্যোগে দিনহাটা'র বয়েজ রিক্রিয়েশন ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় বিশিষ্ট কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের জন্ম দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। তারই প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে আলিপুরদুয়ার টংঘর ও লোকমানস সাহিত্য পত্রিকার উদ্যোগে কবি মিহির দে'র বাড়িতে অনারম্বরে হলেও আন্তরিক ভাবে উদযাপিত হয় কবি ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের জন্মদিন। তবে মূল অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় মাথাভাঙায়। মাথাভাঙ্গা রেবতী রমন সেবা সদন গ্রন্থাগারে গত ০৯/০৪/২০২৫ তারিখ বিকেল পাঁচটায় আন্তরিক ভাবে উদযাপিত হয় কবি ও ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের জন্মদিন। উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কবি ও ছড়াকার আলোচনা করেন ছড়াসম্রাট ভবানীপ্রসাদ মজুমদার সম্পর্কে। তারপর চলে কবিতা পাঠের আসর। বাচিক শিল্পী হিরন্ময় দাস ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের মজার মজার ছড়া পরিবেশন করে স্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। প্রাবন্ধিক রাজর্ষি বিশ্বাসের আলোচনায় উঠে আসে কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদার এর নানা দিকগুলি। তারই বক্তব্যে আরও প্রকাশ পায় যে তিনি আজ পর্যন্ত একটিও সরকারি পুরস্কারে ভূষিত হননি, এমনকি মরণোত্তরও তাঁকে কোনো পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। বিশিষ্ট ছড়াকার কবি মলয় দত্তের বক্তব্যে ফুটে ওঠে সম্প্রতি বাংলা ভাষার করুন অবস্থার কথা। তিনি কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ভাষায় বলে ওঠেন 'বাংলাটা ঠিক আজ আমার আসে না।'
একই মঞ্চে প্রকাশিত হয় কবি সঞ্জয় সাহার 'আঁকশি' কাব্যগ্রন্থটি। রেবতী রমন সেবা সদনের সভাপতি শ্রদ্ধেয় ব্রজগোপাল সাহার কন্ঠে ভেসে উঠলো তাঁর সময়কার বিভিন্ন ছড়ার সংলাপ ও ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের নানা প্রসঙ্গ। আমরা সকলেই মুগ্ধ হলাম ছড়াকার সুনীল সাহার ছড়ার পাঠ শুনে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সুন্দরভাবে সঞ্চালনা করেছেন কবি রীতা মোদক মহাশয়া।
ভবানীপ্রসাদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাওড়া জেলার জগাছা থানার অন্তর্গত দাশনগরের কাছে দক্ষিণ শানপুর গ্রামে ১৯৫০ সালে। প্রয়াত হয়েছেন ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪। তাঁর পিতা ছিলেন নারায়ণচন্দ্র মজুমদার এবং মাতা নিরুপমা দেবী। কবির শৈশব জীবন তাঁর গ্রামেই কেটেছিল। পেশায় ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক। কর্মস্থল ছিল হাওড়া জেলার শানপুর গ্রামের কালিতলা প্রথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি এই বিদ্যালয়টিরই প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
প্রধানত ছোটদের উপযোগী মজার মজার ছড়া-কবিতা লেখায় তাঁর জুড়ি ছিল না। তাঁর প্রকাশিত ছড়ার সংখ্যা কুড়ি হাজারেরও বেশি। ছড়া নিয়ে নিরন্তর নানান রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে ভালোবাসতেন। তাঁর ছন্দে পর্বমিল ও অন্ত্যমিলের ব্যবহার, চলিত-সাধুরীতির শব্দগুচ্ছকে একইসঙ্গে বসানো, ছড়ার শরীর বেয়ে নির্মল হাস্যরসের প্রবাহ, ভাব-ভাষায় শ্লেষ-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও প্রতিবাদের আমদানি, কল্পনা ও বাস্তবতাকে তুলে আনা সবকিছুতেই শিশুমন মুক্তি পেত। ২০১৮ সালে একবার তোর্সা সাহিত্য পত্রিকার উদ্যোগে লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে কোচবিহারে এসেছিলেন। এখানে এসেও তিনি কোচবিহার নিয়ে ছড়া লিখে ফেলেছিলেন, "কোচবিহারের রাজার ছিল একটা কালো হাতি,
যখন তখন সেই হাতিটাই করতো মাতামাতি।"
তিনি বলতেন, একবার ছড়ার জগতে প্রবেশ করতে পারলে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেরই আত্ম উন্মোচন ঘটে। আনন্দের উৎস মুখ খুলে যায়। প্রকৃতি নিজস্ব ছন্দের মতোই অক্ষর,বর্ণ,শব্দ আপন খেলায় নৃত্যেরত। সেই নাচের তালটিকে ধ্বনির মধ্য দিয়ে আয়ত্ত করাই ছড়াকারের মূল কাজ। এই কবিকে আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না।দেশে-বিদেশে যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বাস করেন, ভবানীপ্রসাদ তাদের কাছেই পরম আপনজন হয়ে থাকবেন। এই উদ্যোগই হয়তো নিয়েছেন বিবৃতি পত্রিকার সম্পাদক দেবাশিস দাস মহাশয়। আমাদের শৈশব,আমাদের প্রতিবাদ, আমাদের মানব দরদি মন তাঁর ছড়ায় উদ্ভাসিত হোক, তেমনি আমাদের শিশুরাও তাঁর ছড়ার কাছে নিজেদের খুঁজে পাক । মানব সত্তার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চেতনার বিকাশও নানাভাবে সহায়তা হোক। আর তিনি চিরদিন বেঁচে থাকুন বর্তমান প্রজন্মের প্রতিটি শিশুর মনে।
No comments:
Post a Comment