সম্পাদকের কথা
আলোর উৎসব, উৎসবের আলো।
শরত শেষের এই আশ্বিনে যখন চারদিকে সবুজ ধানক্ষেতের সাথে পাল্লা দিয়ে সাদা কাশফুলের চুপিচুপি কথা, যখন দাবদাহ শেষে, বৃষ্টি অন্তে ঝকঝকে চারদিক তখনই আলোর উৎসবে ভেসে যাবে এই আর্যভূমি। উৎসবের আলোয় অন্ধকারতম মুখেও খেলবে চিহ্ন-জ্যোতি।
অন্ধকার কি মিটবে তবু?
উত্তর তো অজানা!
হিংসার অন্ধকার কেড়ে নিচ্ছে নবীন প্রাণ, অজ্ঞানতার অন্ধকারে সমষ্টির বিরাট অংশ, কুসংস্কারের অন্ধকারে ডুবে আজও জনমানস, অশিক্ষার অন্ধকারে অন্ধ ঠুলি পড়ে থাকি আজও!!
উৎসবের আলো, আলোর উৎসব উদ্ভাসিত করুক অন্তঃস্থল। তমসা কাটুক। আলো দেখাক পথ- সত্যের, সৃজনের, সুজনের, সেরার, সৃজনের....
সার্থক হ'ক দীপাবলি......
এই সংখ্যায় লিখেছেন যাঁরা
তৈমুর খান, মীরা সরকার, লক্ষ্মী নন্দী, সুতপা রায়, আনিসুর রহমান খান,দীপায়ণ পাঠক, শুভদীপ ঘোষ, সম্প্রীতি আতর্থী, কৃষ্ণা সাহা, শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী, মাম্পি রায়, সমীরণ চক্রবর্তী, মন্দিরা ঘোষ, মৃণালিনী ঘোষ, গৌরব রায় চৌধুরী, উদয় সাহা, রাহুল ঘোষ, সুস্মিতা পাল কুন্ডু, সোমনাথ গুহ, নিশীথ বরণ চৌধুরী, রীনা মজুমদার, মজনু মিয়া, অর্পিতা চক্রবর্তী, সম্পা দত্ত, দীপশিখা চক্রবর্তী, মৌসুমী চৌধুরী, নবনীতা স্যান্যাল, পিনাকী চক্রবর্তী, শ্রী কল্যাণ, দেবপ্রিয়া সরকার, প্রতীক কুমার ভৌমিক, অনিমেষ সরকার,পিয়াংকি মুখার্জী, সুকন্যা সামন্ত, দেবযানী সিনহা, অনিন্দিতা চক্রবর্তী
সম্পাদনা ও অলঙ্করণ-
শৌভিক রায়
প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
"সেকালের কলকাতার দুর্গোৎসব ও হুতোমের নক্সা"
কুমকুম ঘোষ
বঙ্গদেশে দুর্গাপুজোর প্রবর্তন : ---জনশ্রুতি আছে মধ্যযুগে রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গদেশে দুর্গাপুজো উদযাপন করেন।কিন্তু অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নতুন রীতিতে শারদীয়া দুর্গোৎসবের সূচনা করলেন।মহালয়ার দিন থেকে শুরু করলেন এক মহাযজ্ঞ।সকলের(প্রজাদের) মঙ্গলকামনায় এই যজ্ঞ চলত টানা নবমী পর্যন্ত।কথিত আছে মহালয়ার পর থেকে কখনও নিভত না যজ্ঞের আগুন।তাই ধরা হয় বর্তমানের(২০১৭ পর্যন্ত) পক্ষকালব্যাপী শারদোৎসবের মূল প্রবর্তক নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
রম্য-রসিক কালীপ্রসন্ন সিংহের "হুতোম প্যাঁচার নকশা"য় (১৮৬২সালে প্রকাশিত)তৎকালীন শহর কলকাতার দুর্গোৎসবের হুজুগ ও আমোদের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন।সেখানে সমাজের সব স্তরের মানুষের এই উৎসবে যোগদানের চিত্রটি পাওয়া যায়।শুরুতেই তিনি জানাচ্ছেন--"দুর্গোৎসব বাঙ্গালা দেশের পরব,উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে এর নামগন্ধও নাই ; বোধ হয়, রাজা কৃষ্ণচন্দরের আমল হতেই বাঙ্গালায় দুর্গোৎসবের প্রাদুর্ভাব বাড়ে।পূর্বে রাজা-রাজড়া ও বনেদী বড়মানুষদের বাড়ীতেই কেবল দুর্গোৎসব হতো, কিন্তু আজকাল অনেক পুঁটে তেলীকেও প্রতিমা আনতে দেখা যায় ; পূর্ব্বেকার দুর্গোৎসব ও এখনকার দুর্গোৎসব অনেক ভিন্ন" প্রদীপ জ্বালানোর আগে যেমন সলতে পাকানো হয় তেমনি পুজোর শুরু ও হয় অনেক আগে---"শ্রাবণমাসের ঢ্যালা ফেলা পার্ব্বণ, ভাদ্রমাসের অরন্ধন ও জন্মাষ্টমীর পর অনেক জায়গায় প্রতিমের কাঠামোয় ঘা পড়লো, ক্রমে কুমোরেরা নায়েক বাড়ী একমেটে, দোমেটে ও তেমেটে করে বেড়াতে লাগলো।---দেখতে দেখতে পুজো এলো"
এই প্রসঙ্গে কলকাতার প্রথমদিকের কয়েকটি বিখ্যাত পুজোর উল্লেখ করা যায়।
আদি কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয় ১৬১০ সালে।বরিশা(বেহালা শখেরবাজার অঞ্চল)র সাবর্ণ রায়চৌধুরীর আটচালায় প্রথমবার পুজো শুরু হয়।এই পুজো এখন বহুবিভক্ত। এই আটচালাতে বসেই জোব চার্ণকের জামাই চার্লস আয়ার ১৬৯৮ সালে গোবিন্দপুর সুতানুটি ও কলকাতার সত্ব কেনেন।
সঠিক সন তারিখ পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয় অষ্টাদশ শতকের (১৭০০--সাল) প্রথমদিকেই কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চলের "ব্ল্যাক জমিনদার" বাবু গোবিন্দরাম মিত্রের বাড়ীতে শহরের দ্বিতীয় প্রাচীনতম পুজোটি হয়েছিল।কিন্তু একটি ধর্মীয় পুজোকে সামাজিক উৎসবে পরিণত করার কৃতিত্ব শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধজয়ের বিজয়োৎসব ও লর্ড ক্লাইভের সম্বর্ধনা উপলক্ষে তাঁর রাজবাড়ীতে প্রথমবার দুর্গাপুজো পালিত হয়েছিল মহা ধুমধাম করে।সেই পুজোয় ইংরেজদের মনোরঞ্জনের জন্য লখনউ বারাণসী থেকে বাঈজি আনা হয়েছিল।সে সময় শহরের চালু কথা(রসিকতা) ছিল -----"মা দুগ্গা নাচ দেখেন শোভাবাজার রাজবাড়ীতে"
এই আড়ম্বরের এক বিশদ চিত্র "হুতোম প্যাঁচার নকশা" গ্রন্থের দুর্গোৎসব" - নামক অধ্যায়টিতে আঁকা আছে হুতোমী ভাষায় ও সরস ব্যঙ্গ-রসিকতায়। তার কয়েকটি ছবি তুলে ধরি...
এখন যেমন পুজোর মাসখানেক আগেই হাতিবাগান গড়িয়াহাটে জমজমাট বেচা-কেনা চলে সেযুগেও তার কমতি ছিল না------"ক্রমে দুর্গোৎসবের দিন সংক্ষেপ হয়ে পড়লো ;
ঢাকাই ও শান্তিপুরে কাপুড়ে মহাজন, আতরওয়ালারা ও যাত্রার দালালেরা আহার-নিদ্রে পরিত্যাগ করেছে । কোনখানে কাঁসারীর দোকানে রাশীকৃত মধুপক্কের বাটী , চুমকি ঘটি ও পেতলের থালা ওজন হচ্ছে। ধুপ-ধুনো , বেণে মসলা ও মাথাঘষার একষ্ট্রা দোকান বসে গেছে । সিন্দুরচূপড়ী , মোমবাতি, পিঁড়ে ও কুশাসনেরা অবসর দোকানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এস রাস্তার ধারে 'অ্যাকুডক্টের' উপর বার দিয়ে বসেচে। বাঙ্গাল ও পাড়াগেঁয়ে চাকরেরা আরসি , ঘুনসি, গিল্টির গহনা ও বিলাতী মুক্তো একচেটেয় কিনচেন ; ...শহরে সকল দোকানেরই, শীতকালের কাগের মত চেহারা ফিরচে।যত দিন ঘনিয়ে আসচে , ততই বাজারের কেনা-বেচা বাড়চে ; কলকেতা তত গরম হয়ে উঠচে।
এতো গেল পুজোর আগের শহরের চেহারা ..এবার সরাসরি নব্য বাবুর নতুন বাড়ীর পুজোর ধূমের একটা ছবি দেখা যাক হুতোমের বয়ানে ------"ক্রমে চতুর্থী এসে পড়লো....বাবু দেড়ফিট উচ্চ গদীর উপর তসর কাপড় পরে বার দিয়ে বসেচেন ,দক্ষিণে দেওয়ান টাকা ও সিকি আধুলির তোড়া খাতা খুলে বসেচেন , বামে হবীশ্বর ন্যায়ালঙ্কার সভাপন্ডিত অনবরত নস্য নিচ্চেন ও নাসা - নিঃসৃত রঙ্গিন কফজল জাজিমে পুঁচ্চেন।
এদিকে জহুরী জড়ওয়া গহনার পুঁটুলী ও ঢাকাই মহাজন ঢাকাই শাড়ীর গাঁট নিয়ে বসেচে। মুন্সি মোশাই , জামাই ও ভাগনেবাবুরা ফর্দ্দ কচ্চেন ,...আতরওয়ালা , তামাকওয়ালা , দানাওয়ালা ও অন্যান্য পাওনাদার মহাজনেরা বাইরের বারান্ডায় ঘুরচে , পুজো যায় তথাপি তাদের হিসেব নিকেশ হচ্চে না। সভাপন্ডিত মহাশয় সরপটে পিরিলীর (জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার)বাড়ীর বিদেয় নেওয়া বিধবা-বিবাহের (বিদ্যাসাগর মহাশয়ের )দলের এবং বিপক্ষপক্ষের ব্রাহ্মণদের নাম কাটচেন....নামকাটাদের পরিবর্ত্তে সভাপন্ডিত আপনার জামাই, ভাগনে , নাত-জামাই , ও খুড়তুতো ভেয়েদের নাম হাসিল কচ্চেন "
...ক্রমে চতুর্থীর অবসান হলো ,পঞ্চমী প্রভাত হলেন এবং শহর আরো শশব্যস্ত হয়ে উঠলো..এলো ষষ্ঠীর সকাল...."রাজপথ লোকারণ্য ; মালীরা পথের ধারে পদ্ম , চাঁদমালা , বিল্লিপত্র ও কুচো ফুলের দোকান সাজিয়ে বসেচে।.....ষষ্ঠী সন্ধ্যায় সহরের প্রতিমার অধিবাস হয়ে গেল "
এভাবেই " আন রে ,এটা কি হলো' কত্তে কত্তে ষষ্ঠীর শর্ব্বরী অবসন্না হলো ; সুখতারা মৃদুপবন আশ্রয় করে উদয় হলেন ,....সেই সঙ্গে সহরের চারিদিকে বাজনা-বাদ্দি বেজে উঠলো , নবপত্রিকা স্নানের জন্য কর্ম্মকর্তারা শশব্যস্ত হলেন---ভাবুকের ভাবনায় বোধ হতে লাগলো , যেন সপ্তমী কোরমাকান নতুন কাপড় পরিধান করে হাসতে হাসতে উপস্থিত হলেন"
কাড়া, নাকাড়া ,ঢোল ও সানাইদার সহযোগে সহরের সকল কলাবউ স্নান কত্তে বেরুলেন।.....বাবুও চললেন পুরোহিত ,পুঁথি হাতে তন্ত্রধারক,বাড়ীর আচার্য্য বামুন,গুরু ও সভাপন্ডিত সহকারে।
ক্রমে তাবৎ কলাবউরা স্নান করে ঘরে ঢুকলেন।এদিকে পুজোও আরম্ভ হলো।
সেকালের বনেদী বাড়ীর পুজোর অন্যতম অংশ ছিল বলিদান ।তার এক বিস্তারিত
বিবরণ পাওয়া যায় হুতোমের লেখায়..শব্দের বিচিত্র ব্যবহারে সে বর্ণনা যেন চলমান ছবি......"আমাদের বাবুর বাড়ীর পুজোও শেষ হলো প্রায় , বলিদানের উদযোগ হচ্চে ; বাবু মায় স্টাফ আদুড় গায়ে উঠানে দাঁড়িয়েচেন , কামার কোমর বেঁধে প্রতিমের কাছে থেকে পুজো ও প্রতিষ্ঠা করা খাঁড়া নিয়ে , কাণে আশীর্ব্বাদী ফুল গুঁজে, হাড়কাঠের কাছে উপস্থিত হলো ,পাশ থেকে একজন মোসাহেব 'খুঁটি ছাড়!' 'খুঁটি ছাড়!' বোলে চেঁচিয়ে উঠলেন ; গঙ্গাজলের ছড়া দিয়ে পাঁঠাকে হাড়কাঠে পূরে দিয়ে খিল এঁটে দেওয়া হলো ; একজন পাঁঠার মুড়ি ও আর একজন ধড়টা টেনে ধল্লে , অমনি কামার "জয় মা! মাগো!" বোলে কোপ তুল্লে ;"
এইভাবে হুতোমের চোখ বাবুর বাড়ীর আনাচে কানাচে ঘুরতে থাকে। দালানের গ্যাসের ঝাড় জ্বলে ওঠে এবং সন্ধ্যের সঙ্গে দর্শকের ভিড় বাড়তে লাগলো।
"এদিকে দেখতে গুড়ুম করে নটার তোপ পড়ে গেল ; ছেলেরা 'বোমকালী' 'কলকেত্তাওয়ালী' বলে চেঁচিয়ে উঠলো।বাবুর বাড়ীর নাচ, ....বাবু জরি ও কালাবৎ এবং নানাবিধ জড়ওয়া গহনায় ভূষিত হয়ে , ঠিক একটি "ইজিপশন মমী সেজে" মজলিসে বার দিলেন--বাই , সারেঙ্গের সঙ্গে গান করে সভাস্থ সমস্তকে মোহিত কত্তে লাগলেন।"
এই ভরপুর আমোদ-আহ্লাদে সপ্তমী অষ্টমী ও সন্ধিপুজো কেটে যাবার পর নবমী এলো।
হুতোম তাঁর নকশায় সেইদিনের অনুভূতির একটি রঙমশাল জ্বালিয়েছেন এই ভাবে----""আজ নবমী , আজ পুজোর শেষদিন।এতদিন লোকের মনে যে আহ্লাদটি জোয়ারের জলের মত বাড়তেছিল , আজ সেইটির একেবারে সারভাটা।....ক্রমে দেখতে দেখতে দিনমণি অস্ত গ্যালেন ,...পুজোর আমোদ প্রায় সম্বৎসরের মত ফুরালো।"
পরদিন নিরঞ্জন..তার বর্ণনাতেও হুতোমের অননুকরণীয় কলম চলে পাঠকের মন আকর্ষণের অবশ্যম্ভাবী প্রচেষ্টায় ---"ক্রমে দেখতে দেখতে দশটা বেজে গেল ; দইকরমা ভোগ দিয়ে প্রতিমার নিরঞ্জন করা হলো ; আরতির পর বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠলো ।---এদিকে এ কাজে সে কাজে গির্জ্জার ঘড়ীতে টু্ং টাং টুং টাং করে বারটা বেজে গেল ; সূর্য্যের মৃদুতপ্ত উত্তাপে সহর নিমকি রকম গরম হয়ে উঠলো ; এলোমেলো হাওয়ায় রাস্তার ধুলো ও কাঁকর উড়ে অন্ধকার করে তুল্লে ।"
সেসময় বিসর্জনের সমারোহ আজকালকার "কার্নিভাল"-এর চেয়েও যে কিছু কম ছিল না তার খবরও পাওয়া যায়-----"ইংরেজী বাজনা , নিশেন , তুরুকসোয়ার ও সার্জ্জন সঙ্গে প্রতিমারা রাস্তায় বাহার দিয়ে বেড়াতে লাগলেন-----তখন 'কার প্রতিমা উত্তম' 'কার সাজ ভাল' 'কার সরঞ্জাম সরেস' প্রভৃতির প্রশংসারই প্রয়োজন হচ্চে। কিন্তু হায় ! 'কার ভক্তি সরেস' কেউ সে বিষয়ের অনুসন্ধান করে না----কর্ম্মকর্ত্তাও তার জন্য বড় কেয়ার করেন না।"
-----"কর্ম্মকর্ত্তারা প্রতিমা নিরঞ্জন করে, নীলকন্ঠ শঙ্খচিল উড়িয়ে 'দাদা গো দিদি গো ' বাজনার সঙ্গে ঘট নিয়ে ঘরমুখো হলেন ।বাড়ীতে পৌঁছে চন্ডীমন্ডপে পূর্ণঘটকে প্রণাম করে শান্তিজল নিলেন "
অবশেষে বিজয়ার উপসংহার হলো এবং সম্বৎসরের পুজোর আমোদের সাথে দিনমণি অস্ত গেলেন।
এক চিরন্তন সত্যভাষণের মধ্যে দিয়ে মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ উনিশ শতকের কলকাতা শহরের আলো -ঝলমল দুর্গোৎসবের বিবরণ শেষ করেছেন-----"ক'দিন মহাসমারোহের পর আজ সহরটা খাঁ খাঁ কত্তে লাগলো----পৌত্তলিকের মন বড়ই উদাস হলো , কারণ , যখন লোকের সুখের দিন থাকে ,তখন সেটির তত অনুভব কত্তে পারা যায় না , যত সেই সুখের মহিমা , দুঃখের দিনে বোঝা যায়।"
.......................
(হুতোম প্যাঁচার নকশায় ব্যবহৃত ভাষা অপরিবর্তিত)
দীপাবলি
দীপায়ণ পাঠক
'অসতো মা সদ্গময়।তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মামৃতং গময়।ওঁ শান্তিঃ ।।ওঁ শান্তিঃ ।।ওঁ শান্তিঃ।। '
অসৎ থেকে সত্যে নিয়ে যাও।অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাও।মৃত্যু থেকে অমরত্বে নিয়ে যাও।শান্তির বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দাও।যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেন দীপাবলি বা দেওয়ালি উৎসবের সারবত্তা উপনিষদের এই আভা থেকেই পরিষ্কার।দুষ্টের দমন বা শিষ্টের পালন বা ন্যায়ের কাছে অন্যায়ের পরাজয় ,দীপাবলি প্রধানত অন্ধকারের ওপর আলোর বিজয়ের উৎসব।নিরাশার বিরুদ্ধে আশার বিজয়ের উৎসব।
দীপাবলি বা দেওয়ালি মূলত উত্তর ও পূর্ব ভারতের একটি অন্যতম প্রধান উৎসব
দীপাণ্বিতা,দীপশিখা,সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও এর প্রচলন আছে।সাধারণ মানুষ একদিন পালন করলেও দীপাবলি সাধারণত পাঁচদিনের উৎসব।আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাস বা ধন ত্রয়োদশীর দিন থেকে এর সূচনা হয় আর কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া বা ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটে।গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অক্টোবর মাসের মধ্যের সময় থেকে নভেম্বর মাসের মধ্য সময় মধ্য এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
উত্তর ভারতীয় হিন্দুরা বিশ্বাস করে দীপাবলির দিনই শ্রীরামচন্দ্র চৌদ্দ বছর বনবাস কাটিয়ে দেশে ফেরে। রামচন্দ্রের পুনর্গমনের খুশিতে প্রজারা ঘিয়ের প্রদীপ দিয়ে সমস্ত রাজ্যকে আলোকিত করে তোলে।এইদিনই ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কালিপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দীপাবলির আগের রাত্রিকে বলা হয় ভূত চতুর্দশী বা নরকা চতুর্দশী।কথিত আছে এই দিনটিতেই কৃষ্ণ ও তার স্ত্রী সত্যভামা নরকাসুরকে বধ করেছিলে।সেই আনন্দেও এই দিনটি পালন করা হয়। বলে মনে করেন অনেকেই।
তবে দীপাবলি শুধু হিন্দুদের মধ্যেই আবদ্ধ নেই।জৈন ধর্মাবলীদের মতে ৫২৭ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে মহাবীর এই দীপাবলির দিনই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেন।শিখদের ধর্মগুরু হরগোবিন্দ সিং ও ৫২জন রাজপুত এই দীপাবলির দিনই মুক্তি পেয়েছিলেন।দয়ানন্দ সরস্বতী এইদিনেই অমৃতলোকের পথযাত্রী হয়েছিলেন বলে আর্য সমাজও এই দিনে নব শস্যেষ্টি পালন করেন।
প্রতি বছর এই উৎসবে সমগ্র ভারতবর্ষ আলোকিত হয়ে ওঠে।ভূত বা প্রেতাত্মাদের বিতারিত করার জন্য প্রচুর শব্দবাজী ও আতসবাজী ব্যবহার করা হয়।আট থেকে আশি জাতি ধর্ম বর্ণের সমণ্বয়ে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত।ধন ধান্যের প্রার্থনায় ঐদিন উত্তর ভারত ও বাংলার কিছু অঞ্চলঃ লক্ষ্মী পূজারও প্রচলন আছে।বহুল প্রচলিত এই উৎসব এখন আর ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।নেপাল,শ্রীলঙ্কা,মায়নামার, মরিশাস,গুয়ানা,ত্রিনিদাদও টোবাগো ,সুরিনাম,মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ফিজি এবং অধুনা পাকিস্তানের অর্ন্তগত সিন্ধু প্রদেশেও দীপাবলির দিন সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়।
এককথায় দীপাবলির মাধ্যমে আজকের বিশ্ব অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার এক পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে।মাটির দীপের শিখার বদলে মানুষের হৃদয়ে জ্বলুক শান্তির শিখা,সমৃদ্ধির শিখা।তবেই সার্থক দীপাবলি।সার্থক আলোর উৎসব।।
কবিতা
তৈমুর খান
পথ শেষ হয়ে আসে না আমাদের
নির্মিত ঐশ্বর্যের পাশে
কিছুক্ষণ বসি, বিকেলের ঘরবাড়ি
আশ্চর্য সংহিতা পাঠ করে
দ্রুত দিন শেষ হয়
চৈতন্য ভাগবতের শেষ অধ্যায় থেকে
লীলা সম্বরণ করে ফিরি
তখনও নীলাচলে বেজে ওঠে বাঁশি
দুয়ার আগলায় কারা ?
নিসর্গ ভাষার পাখি উড়ে চলে গেলে
কোনও কোনও মহোৎসব
পার্থিব সুন্দর থেকে চলে যায় দূরে
সব নৈকট্য ছিন্ন হলে
ফাঁকা রেললাইন বেয়ে যুগের ধূসর ট্রেন যায়
মোহিনী আলোয় উড়ে উড়ে
আমরা পার হই যুগ এ যুগের ধর্মদাস…
অপ্রদীপ রাত
মীরা সরকার
সব বাড়িতে জ্বলে না আলো
ওদের শিশুটি গতকাল ও
একহাতে কাঠি লজেন্স আর অন্য হাতে পরম বিশ্বাসটুকু
নিয়ে ধরেছিল; আপন এক ভরসার হাত।
ওই দেখ ঠিক তার পরদিন ,
ছেঁড়া খোঁড়া তার রক্ত মাখা প্রশান্তি
শুয়ে আছে।যে ঝোপ লজ্জায়
ওকে রেখেছে লুকিয়ে তার পাশে।
সর্বাঙ্গে শিশির ঝরেছে সারারাত।
এক বিপন্ন বিস্ময় ছিল
তার অপেক্ষায়। কটা দিন আর
কটা দিন বরাদ্দ ছিল তোর মেয়ে?
তুই তো জানিস নি দেহের আলোয়
নারীখাদকের চোখ জ্বলে ওঠে।
মেয়ে রে এ অমাবস্যা হবে না প্রভাত।
প্রতান
লক্ষ্মী নন্দী
ভোর হচ্ছে।
অাস্তে অাস্তে অালো ফুটছে।
শব্দের অাত্মপ্রচার অার শব্দের অার্তনাদকে
রেখেছি রূপ অপরূপ অাবহে বোধিরের ঘরে
এই মৃত্যু , মৃত্যুর চেয়ে সুন্দর তুমি।
তাই অসময়ে ধাবমান অামি মনন বহ্নিত নিমগ্ন
তোমার প্রমোদে। অামার অায়নায় প্রতিফলিত
হচ্ছে তোমার সেই মুখ। তোমার হিরন্ময় শরীরের
উষ্ণ স্নিগ্ধ শমিত দহন জ্বলছে অামার পোশাকে
গেরুয়া অাগুন হয়ে। অামাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে
শুদ্ধো ফেনায়িত শ্বেত পযোধি দুধ গঙ্গা তোমার
অদৃশ্য বোধের প্রতানে। এ তো তোমারই
সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতি। অামি নিয়তির মতো
অবদমিত বাসনা নিয়ে ভেসে চলেছি।
অাজ নেবে তো অামাকে?
এই গন্ডির মধ্যের থেকে তোমার
ঐ শূন্যের বৃত্তে। সম্পর্কের সব শর্ত একজন
রাখবে। অরেক জন রাখবেনা ????
অভিজ্ঞতা/ভাবনা
"আলো ও উৎসব" নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা জানতে চেয়েছিলাম ভরতনাট্যম শিল্পী
শ্রীমতি সুতপা রায়-এর কাছে। তিনি জানালেন নিজের কথা-
হিন্দুদের প্রধান উৎসব হলো দুর্গাপূজা। আর তারপরেই এই আলোর উৎসব, দীপাবলি...আমি কিন্তু দু'টি উৎসবকে একসাথে ধরেই বলছি যে এই উৎসবকে ঘিরে আপামর জনগন মেতে ওঠে। মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের চন্ডীপাঠ দিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা আর "জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিনী"... এই গান আজও মনে প্রাণে এক অনন্য অনুভূতি সঞ্চার করে। ঢাকের আওয়াজ ও নতুন জামা কাপড়ের গন্ধ এখনোও মনকে উতলা করে.....
ছোটবেলায় পুজো কেটেছে কলকাতার বাইরে, বড়ো বয়সে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখা শুরু হয়। আজও সেই উন্মাদনা অব্যাহত আছে। এখন তো প্রতিযোগিতার যুগ। তাই প্রতিটা প্রতিমাই, দুর্গা বা কালী প্রতিমা, অসাধারণ লাগে। শিল্পী হিসেবে খুব গর্ব বোধ করি যে আমাদের দেশে কত গুণী শিল্পীর ছোঁয়ায় মা দূর্গার রূপ যেন বিভিন্ন রূপে মর্ত্য আগমন ঘটে। আর পুজোর এই ক'টা দিন এই যে সবাই সব দুঃখ কষ্ট ভুলে আনন্দে মেতে ওঠে এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে? আলোর উৎসব যে!
আমাদের এই কলকাতা শহর যেন মিলন মেলায় পরিনত হয়। টিভি দেখে বা খানিকটা নিজের অভিজ্ঞতাতেও বুঝি জেলাগুলিও এই ব্যাপারে এক। ক'টা দিন কাটাই তাই মহাসমারোহে। এরপর বিজয়া দশমীতে চোখের জলে মা কে বিদায়। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। মনে মনে বলি, "মা গো, যেন আগামী বছর এমন হাসি মুখে তোমাকে বরণ করতে পারি।" এখন আমাদের হাউসিং এর পুজো উপভোগ করি। চার দিন ধরে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা বেশ উপভোগ করি আর থাকে পঙ্কতি ভোজ। সবাই মিলে এক সঙ্গে খাওয়ার মজাই আলাদা। দীপাবলিতে একসাথে আলো জ্বালানো, বাজি পোড়ানো, মিষ্টিমুখ করা....এভাবেই দিনগুলি যেন কাটে আগামীতে......
হাতীবান্ধায় শারদীয় দূর্গোৎসব
আনিসুর রহমান খান
টাঙ্গাইল জেলার অন্তরগত সখীপুর উপজেলার একটি ইউনিয়ন হাতীবান্ধা। মোট জনসংখ্যার অর্ধেক সনাতন ধর্মাবলম্বী। এখানে হিন্দু -মুসলিম যেনো পরম আত্বীয়তার বন্ধনে বসবাস করে আসছ। ভারত ও বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে হিন্দু -মুসলিম দাঙ্গা হয়। কিন্তু আমাদের সখীপুরের হাতীবান্ধায় আজ পর্যন্ত এসব ঘটেনি। বিয়ে পুজা পার্বণে হিন্দু মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অন্যের কাজে সহযোগিতা করে থাকে। দূর্গা পুজা উপলক্ষে আমাদের পুরো ইউনিয়ন জুড়ে আনন্দের উৎস চলছে। বাংলাদেশের অন্য কোথাও এমন উৎসব হয় কি না আমার জানা নেই। এক লক্ষ জনবসতির পরিসরে বারটি স্পটে শারদীয় দূর্গোৎসব উৎযাপন হচ্ছে। বাইটকা উত্তরপাড়া দূর্গা মন্দিরে শারদীয় দূর্গোৎসব হচ্ছে হরিচরণ সরকার বললেন মা দূর্গার আবির্ভাবের কথা। এ পাড়ার যুবক ছেলেরা দিন রাত পরিশ্রম করছে কি হিন্দু কি মুসলিম। পাটজাগ পূর্বপাড়া আমাদের বাড়ির খুব কাছে এখানে শুধু দূর্গোৎসব নয় যতো পুজো আছে আমাদের উপস্থিত থাকবে। এখানেও চলছে সুন্দর মনোরম আয়োজনে উৎসব। শ্রী গোপাল চন্দ্র সরকার এই পুজোর আয়োজক কমিটির একজন। পাটজাগ পশ্চিমপাড়া খুবই মনমুগ্ধকর আয়োজন করে থাকে শারদীয় দূর্গোৎসবের। জেলা উপজেলার সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তা এ আনন্দ উপভোগ ও দেবী দর্শনে আসেন। পশ্চিম পাড়ায় যেকোনো পুজোতে সরকার সহযোগিতা করে থাকে। কামার পাড়া নাটমন্দিরে আয়োজন করা হয় দূর্গৎসব। এটি আমাদের স্যাটেলাইট শহর ঘেষা। শ্রী নারায়ন সরকার ও অজিত কুমার সরকার এর তত্বাবধায়ক। অজিতের সম্পর্কে আমি মামা হই। গতমাসে অজিত আমেরিকায় চলে যাওয়ায়। নারায়ন দা পুরো পুজার দায়িত্ব পালন করছে। ছোট বড় সবাই উচ্ছ্বাসে আনন্দে দেবী দূর্গা দর্শন করছে। হাতীবান্ধা আমাদের পুরনো বাড়ি এখানে সবচেয়ে বড় আয়োজন হয়। ধ্বনি ব্যক্তিদের বসবাস এ অঞ্চলে। ডাক - ঢোল বাজে মনোরম ছন্দে। নানা আয়োজনে মুখোর থাকে টানা দশ বারোদিন। অগ্নিশিখা যুব সংঘের দুইশত একুশতম দূর্গোৎসব। এটি আয়োজন হয় কালিমন্দির প্রাঙ্গণে।
টেকিপাড়া দূর্গোৎসবের তত্বাবধায়ক হরীচরন সরকার। এখানেও খুব জাকালো আয়োজন। এখানে মুসলমানদের ভীর জমে যেনো একে অপরের ভাই সুষ্ঠুভাবে শারদীয় দূর্গোৎসব শেষ করা সকলের সমান দায়িত্ব। এমন আরো সাতটি জায়গায় উৎসবের আয়োজন হয়। তন্মধ্যে বড়চালা, চাকদহ, বালিয়াটা, রতনপুর, আহালিয়াচালা, রাজাবাড়ি ও কামালিয়াচালা।
পঞ্চমী শারদীয় দূর্গাদেবীর বোধন। ষষ্ঠাদি কল্পারাম্ভ সয়ংকালে দেবী আমণ্ত্রণ ও অধিবাস। সপ্তমী শারদীয় দূর্গাদেবীর নব পত্রিকা প্রবেশ স্হাপন, সপ্তমী বিহিত পুজা ও দেবীর নৌকায় আগমন। অষ্টমী তিথি রাত্রি শ্রী শ্রী শারদীয় দূর্গাদেবীর মহাষ্টমী পুজা এবং রাত্রিগতে সন্ধিপূজা আরম্ভ। নবমী তিথিরাত্রি শ্রী শ্রী শারদীয় দূর্গাদেবীর মহানবমী পুজা। দশমী রাত্রি শারদীয় দূর্গাদেবীর মহাদশমী বিহিত পুজা সমাপনান্তে বিসর্জন ও দেবীর ঘোটকে গমন।
এই বিসর্জন পর্ব দিয়েই দূর্গোৎসবের সমাপন ঘটে। যুগে যুগে প্রতিটি মানুষ তার ধর্ম পালন করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে আগে মানুষ হও তবেই তুমি ধর্মীয় হয়ে উঠতে পারবে। পাগলের কোনো ধর্ম থাকে না। ধর্ম হলো শান্তি ঐক্যের বন্ধনে মানুষকেই বাঁচাতে শেখায়।
আনিসুর রহমান খান
টাঙ্গাইল জেলার অন্তরগত সখীপুর উপজেলার একটি ইউনিয়ন হাতীবান্ধা। মোট জনসংখ্যার অর্ধেক সনাতন ধর্মাবলম্বী। এখানে হিন্দু -মুসলিম যেনো পরম আত্বীয়তার বন্ধনে বসবাস করে আসছ। ভারত ও বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে হিন্দু -মুসলিম দাঙ্গা হয়। কিন্তু আমাদের সখীপুরের হাতীবান্ধায় আজ পর্যন্ত এসব ঘটেনি। বিয়ে পুজা পার্বণে হিন্দু মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অন্যের কাজে সহযোগিতা করে থাকে। দূর্গা পুজা উপলক্ষে আমাদের পুরো ইউনিয়ন জুড়ে আনন্দের উৎস চলছে। বাংলাদেশের অন্য কোথাও এমন উৎসব হয় কি না আমার জানা নেই। এক লক্ষ জনবসতির পরিসরে বারটি স্পটে শারদীয় দূর্গোৎসব উৎযাপন হচ্ছে। বাইটকা উত্তরপাড়া দূর্গা মন্দিরে শারদীয় দূর্গোৎসব হচ্ছে হরিচরণ সরকার বললেন মা দূর্গার আবির্ভাবের কথা। এ পাড়ার যুবক ছেলেরা দিন রাত পরিশ্রম করছে কি হিন্দু কি মুসলিম। পাটজাগ পূর্বপাড়া আমাদের বাড়ির খুব কাছে এখানে শুধু দূর্গোৎসব নয় যতো পুজো আছে আমাদের উপস্থিত থাকবে। এখানেও চলছে সুন্দর মনোরম আয়োজনে উৎসব। শ্রী গোপাল চন্দ্র সরকার এই পুজোর আয়োজক কমিটির একজন। পাটজাগ পশ্চিমপাড়া খুবই মনমুগ্ধকর আয়োজন করে থাকে শারদীয় দূর্গোৎসবের। জেলা উপজেলার সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তা এ আনন্দ উপভোগ ও দেবী দর্শনে আসেন। পশ্চিম পাড়ায় যেকোনো পুজোতে সরকার সহযোগিতা করে থাকে। কামার পাড়া নাটমন্দিরে আয়োজন করা হয় দূর্গৎসব। এটি আমাদের স্যাটেলাইট শহর ঘেষা। শ্রী নারায়ন সরকার ও অজিত কুমার সরকার এর তত্বাবধায়ক। অজিতের সম্পর্কে আমি মামা হই। গতমাসে অজিত আমেরিকায় চলে যাওয়ায়। নারায়ন দা পুরো পুজার দায়িত্ব পালন করছে। ছোট বড় সবাই উচ্ছ্বাসে আনন্দে দেবী দূর্গা দর্শন করছে। হাতীবান্ধা আমাদের পুরনো বাড়ি এখানে সবচেয়ে বড় আয়োজন হয়। ধ্বনি ব্যক্তিদের বসবাস এ অঞ্চলে। ডাক - ঢোল বাজে মনোরম ছন্দে। নানা আয়োজনে মুখোর থাকে টানা দশ বারোদিন। অগ্নিশিখা যুব সংঘের দুইশত একুশতম দূর্গোৎসব। এটি আয়োজন হয় কালিমন্দির প্রাঙ্গণে।
টেকিপাড়া দূর্গোৎসবের তত্বাবধায়ক হরীচরন সরকার। এখানেও খুব জাকালো আয়োজন। এখানে মুসলমানদের ভীর জমে যেনো একে অপরের ভাই সুষ্ঠুভাবে শারদীয় দূর্গোৎসব শেষ করা সকলের সমান দায়িত্ব। এমন আরো সাতটি জায়গায় উৎসবের আয়োজন হয়। তন্মধ্যে বড়চালা, চাকদহ, বালিয়াটা, রতনপুর, আহালিয়াচালা, রাজাবাড়ি ও কামালিয়াচালা।
পঞ্চমী শারদীয় দূর্গাদেবীর বোধন। ষষ্ঠাদি কল্পারাম্ভ সয়ংকালে দেবী আমণ্ত্রণ ও অধিবাস। সপ্তমী শারদীয় দূর্গাদেবীর নব পত্রিকা প্রবেশ স্হাপন, সপ্তমী বিহিত পুজা ও দেবীর নৌকায় আগমন। অষ্টমী তিথি রাত্রি শ্রী শ্রী শারদীয় দূর্গাদেবীর মহাষ্টমী পুজা এবং রাত্রিগতে সন্ধিপূজা আরম্ভ। নবমী তিথিরাত্রি শ্রী শ্রী শারদীয় দূর্গাদেবীর মহানবমী পুজা। দশমী রাত্রি শারদীয় দূর্গাদেবীর মহাদশমী বিহিত পুজা সমাপনান্তে বিসর্জন ও দেবীর ঘোটকে গমন।
এই বিসর্জন পর্ব দিয়েই দূর্গোৎসবের সমাপন ঘটে। যুগে যুগে প্রতিটি মানুষ তার ধর্ম পালন করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে আগে মানুষ হও তবেই তুমি ধর্মীয় হয়ে উঠতে পারবে। পাগলের কোনো ধর্ম থাকে না। ধর্ম হলো শান্তি ঐক্যের বন্ধনে মানুষকেই বাঁচাতে শেখায়।
Light And Festivity
Subhadeep Ghosh
She is my favourite..my darling. Everyday I used to visit her home after coming back from school. I was never very much passionate about playing, running in the field with my friends in the twilight hour. Rather I found a placidity...a solace of having her company.
Hardly I was nine or ten years old..Her home was down wards where the uneven hill gets some rest.I played with her..had gossips, feel the setting sun, clouds of red love.
After sun down she would come with her mother to the basil plant to offer evening prayer... joss stick, little lamper upon clay dish was lit up and blowing of conch make a strange, spiritual air.Then I went my home.It became my habit out of love.
I gradually was growing up. With the first hour of emerging sun I could feel the very presence of my manliness in and within the every limps of my body.And then with the western sun I became a timid lover of her with all my passionate zeal.
' Why do you love me?' she said, 'you never find light in me.' In spite of knowing her blindness I love her. I thought whenever you are in darkness you are not buried; actually you are being planted.
I said to her, "you are what you are.I love you what the way you are. To find the star one must embrace the infinite darkness."
That was the first Durga festival after we had married. She wore a light blue chiffon saree. It was her favourite colour.Drums, bells and brasses welcomes the new beginning with dance and especially, the dhunuchi naach. Sandha Arati or the Evening Offering.The shower of lights, tuni bulbs all around simmering and flooding. I became the mirror of light to her to show her the light and festivity.
"Do you love this festival of light?" I asked.
"There is something to the feelings of not knowing your surroundings...not seeing the colour of things as they appear, but as they truly are.Something unspoken I never put words to..something terrifying yet beautiful.."she replied.
I was silent for a while. I was counting the darkness within me. She asked the reason of being silent.I told indifferently, "you mean that I could not show you anything?"
My love...my dearest She put her hand on me; pressed and said, "You make me feel the joy of festivity and warmth of light."
আলোর উৎসবে অন্য আলোর খোঁজ
সম্প্রীতি আতর্থী
“অদ্ভুত আঁধার এক আসিয়াছে পৃথিবীতে আজ” -এমন একটা পরিস্থিতিতে বর্তমানে আমরা বসবাস করছি যেখানে আঁধার গ্রাস করে রেখেছে আমাদের চারপাশকে,আঁধার ছেয়ে আছে আমাদের চিন্তায় ভাবনায়।এ আঁধারকে দূরীভূত করার উপায় আছে আমাদের হাতেই।আর তাই হাতড়ে ফিরি একটু আলোর খোঁজে।আজ চিন্তার আলোকে যখন গ্রহণের মত গ্রাস করেছে আর আমরা ছুটে চলেছি অবিরত তার উদ্দেশ্যে সে যেন মরীচিকার মত আমাদের থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ক্রমাগত।
“এ সকাল যখন রাতের চেয়েও অন্ধকার ঠিক এমনই একটা দিনে চলে আসে আলোর উৎসব। উৎসবই একমাত্র পারে সমস্ত অন্ধকার ঢেকে রেখে আলোর দিশা দেখাতে।আর যদি তা হয় আলোর উৎসব তবে আর কিছু ইঙ্গিত দেবার প্রশ্নই আসে না।আলোর উৎসব আসে নিজের নিয়মে,এসে তার আলোর ছটায় ভরিয়ে দেয় চারপাশ।উৎসবের দিনগুলিতে প্রতিটা আলো এমনকি সকালের সূর্যটাও যেন নিত্যনতুন গান রচনায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে এই আলোর উৎসব থাকুক আর কিছুক্ষণ আমাদের জীবনে,রেশ রেখে যাক অনেকটা,পৃথিবীর সমস্ত মলিনতা,বিষণ্ণতাকে ধুয়ে মুছে দিক বরাবরের মত। সে আলো ছড়িয়ে পড়ুক পথে-প্রান্তরে,গ্রামে-শহরে,পাশে র বস্তিটায় এমনকি ইট ভাটার শ্রমিকের ঘরেও যেখানে উৎসবের মানে এখনও জানে না বাচ্চা ছেলেটা।আলোয় আলোময় করে পরিষ্কার করে দিক সমাজের কলুষিত আবর্জনাদের।
ইচ্ছে করে নতুন ভোর দেখার কিন্তু কখন যেন মেঘ এসে সমস্ত আলোকে ঢেকে দেয় আবার।বিদায় জানাতে হয় তাই প্রিয় আলোর উৎসবকে আগামী বছরের অপেক্ষায়।লোকে বলে অন্ধকার না থাকলে নাকি আলোর মাহাত্ম্য বোঝা যায় না,আলোর কদরের জন্যে অন্ধকারের উপস্থিতি নাকি ভীষণ জরুরী।উৎসবের ক্ষেত্রে সে কথা সত্যি হয়তো কিন্তু ‘আলো’?ওকে যে বড্ড দরকার প্রতিমুহূর্তে,প্রতিনিয়ত।আলোর উৎসবকে বিদায় জানালেও আলো কে উপেক্ষা করার সময় বোধহয় নেই আর।বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের মননে-চিন্তনে-ভাবনার গভীরতায় জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে আলো থাকুক আমৃত্যু।
" আলোকেরই ঝর্না ধারায় ধুইয়ে দাও "
কৃষ্ণা সাহা
সত্যি কি দিপালীর আলোর বন্যায় এই সমাজের অন্ধকার আলোয় বানভাসি হয় ?নাকি শুধুই চিরাচরিত নিয়মে ক্ষণিকের আনন্দের মাতামাতি মাত্র ?চৌদ্দ বছর বনবাসের পর রামচন্দ্রের নিজ রাজ্যে প্রত্যাগমনের উল্লাস জানাতে প্রজাবাসি আলোর উৎসবে মেতে উঠেছিলেন। তবুও অযোধ্যায় নারীত্বের অবমাননা হয়েছে। সতীত্ব প্রমাণে বার বার পরীক্ষা দিতে হয়েছে সীতাকে। তবে কিসের আলোর উৎসব ? মনের অন্ধকারে আলোর রোশনাই কোথায় ? কত কত যুগ পার হয়ে গেছে। যুগে যুগে কত সীতাদের নারীত্ব অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। তবুও কি আজও তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়েছে ? মূল ধারা রয়েগেছে একই শাশ্বত।
তাই দিপালীর আলোর বন্যা ভাসিয়ে দিক মনের অন্ধগলি। শব্দ বাজীর হুঙ্কারের হোক অবসান। দিপালীর উৎসবের আলোর রোশনাই মনের চিলেকোঠায় বন্দী না রেখে মনের মনিকোঠায় ছড়িয়ে পড়ুক।এই ধরনী হয়ে উঠুক অন্ধকার মুক্ত।সংকীর্ণতার অন্ধকার দূরীভূত হয়ে এই পৃথিবীর মানুষের মন হোকক আলো ঝলমলে ।তার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই, শুধু আনন্দ উৎসবে মাতামাতি করে
নয় দীপান্বিতা,দীপালিকা,আকাশ প্রদীপে মতো আলোক বর্তিকা হয়ে। মঙ্গল আলোকে সাজুক পৃথিবীর প্রতিটি কোণ। আলোর উৎসবে শান্তি নামুক জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জীবনে।
তাই দিপালীর আলোর বন্যা ভাসিয়ে দিক মনের অন্ধগলি। শব্দ বাজীর হুঙ্কারের হোক অবসান। দিপালীর উৎসবের আলোর রোশনাই মনের চিলেকোঠায় বন্দী না রেখে মনের মনিকোঠায় ছড়িয়ে পড়ুক।এই ধরনী হয়ে উঠুক অন্ধকার মুক্ত।সংকীর্ণতার অন্ধকার দূরীভূত হয়ে এই পৃথিবীর মানুষের মন হোকক আলো ঝলমলে ।তার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই, শুধু আনন্দ উৎসবে মাতামাতি করে
নয় দীপান্বিতা,দীপালিকা,আকাশ প্রদীপে মতো আলোক বর্তিকা হয়ে। মঙ্গল আলোকে সাজুক পৃথিবীর প্রতিটি কোণ। আলোর উৎসবে শান্তি নামুক জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জীবনে।
"বলো দূগ্গা মাইকি.......জয়"
শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী
মহালয়ার পূন্যলগ্নে নিপুন হাতে, শিল্পীর সুক্ষ তুলির টানে, ভোড়বেলা মাতৃরূপেন সংস্থিতা দেবীমায়ের হয় চক্ষুদান ।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে,,,,,,,,,
ইয়াঃ দেবী সর্বভূতেশু,শক্তিরূপেন সংস্থিতা,
নমঃস্তশৈই,নমঃস্তশৈই,নমঃস্তশৈই নমঃনমাহ্..........
দেবীদূর্গার কাজলনয়না চোখ নানা আদলে হয় সসজ্জিত,,,,
কোনো মন্ডপে মায়ের স্নিগ্ধ শীতল চাহনীতে অসুরদমন,
কোথাও দেবীর রক্তচক্ষু দর্শনে মহিষাসুর বধ । শরতের হিমেল হাওয়ার পরশে মহাসমারোহে সূচনা হয় মাতৃবন্দনা ।
শিশিরভেজা ঘাসে শিউলি ফুলেরা মূর্ছা যায়
শিউলিসুবাসে ভেসে আসে পূজোর গন্ধ,
নদীতীরে কাশফুলের সারি প্রকৃতিরানীকে
কোরে তোলে অপরূপা-------
কোথাও থিমের পূজার আতিসাজ্যে সজ্জিত মন্ডপসজ্জা,,,,কোথাও আড়ম্বরহীন নিয়ম-নিষ্ঠার পূজার্চনা। ষষ্ঠীতে দেবীবোধন,কলাবৌ স্নান শেষে অধিষ্ঠান, সপ্তমি,অষ্টমি,নবমীতে পূজাঞ্জলি শেষে মহাভোগ প্রসাদ লাভ । ঢাকের কাঠিতে ঢ্যাম-কুড়াকুড় তালের সুরমূর্ছনা, বিজয়াদশমীতে সিঁদুরখেলার সমাপ্তিতে মাতৃবিসর্জনের পালা ।
বিদায়বেলার বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায় মন,
আবারও অপেক্ষা,অপেক্ষা একটা বছরের,,,
মাগো আবার এসো তুমি এই ধরাধামে------
পৃথিবীর অসুরগুলোর আসুরিক প্রবৃত্তি দমনে
চারিদিকে হানাহানি,হিংসা-বিদ্বেষের হোক অবসান ।
সুখ-শান্তি- সমৃদ্ধি নিয়ে এসো সবাকার মাঝে----------বলো বলো দূগ্গা মাইকি...........জয়.........জয় মা দূর্গার জয়
"দীপাবলি মানাই সুহানি"
মাম্পি রায়
সারাদিন ধরে পূজোর আয়োজন মায়ের সাথে, পূজোর জন্য ব্যস্ত হওয়া কি যে আনন্দের। কোজাগরী কৃষ্ণপক্ষী তিথিতে "মা" কে আবাহন করা, ভাই এর সাথে সারা বাড়িঘর আলোকসজ্জায় ভোরে তোলার আনন্দগুলো খুব মনে পড়ে।
দীপাবলি বলে কথা; মা এর হাতে আল্পনা দেওয়া দেখে নিজেও পাকামো করে তুলি হাতে আল্পনা দিতে বসে পড়তাম, যদিও খুব আড়াত্যাড়া হিজিবিজি হত সেটা আর যাই হোক আল্পনা হত না।
পূজোর আগের দিন ছাদে গিয়ে ভাই এর সাথে খুব খাটনি করে লিচুর মত দেখতে, খুব প্রিয় টুনিবাল্প দিয়ে বাড়িময় আলোকসজ্জার কারুকার্য করতাম, ছাদের মাথায় একটা লণ্ঠন বানিয়ে ঝুলিয়ে দিতাম, পাড়ার সবার থেকে যেন আমাদের আলোকসজ্জা বেশী সুন্দর আর আকর্ষণীয় হয় সেটা খুব নজর দিতাম। বন্ধুদের নিমন্ত্রণ দিতাম পূজোর প্রসাদ নিতে, তবে আসল কথা তো আলোকসজ্জা দেখানো ছিল।
বন্দুদের সাথে পাড়ার মণ্ডপসজ্জা দেখে চলে যেতাম অরুণ, রসনা,রিমিদের বাড়ি, প্রতিবার দীপাবলির দিন তাদের বাড়ি লক্ষ্মী পূজো হয়।
সেবার অরুণের অনুরোধে তার বাড়ি আমাকে নিমন্ত্রণ জানালো রংগোলী বানানোর জন্য। সকাল সকাল গিয়ে রংগোলী বানিয়ে দিয়ে নিজের বাড়িতেও একটু রংগোলীতে সাজালাম। সন্ধ্যেবেলা বাড়ির পুজো সেরে পিয়ালি, পূজা,রাকেশ সবাই চলে গেলাম অরুণের বাড়ি দীপাবলির দ্বীপ জ্বালাতে।মা লক্ষ্মী কে আবাহনী গীতে আরতি পূজো সেরে সব শেষে তুবড়ি, চড়কা,ঝাড়বাতি, চকলেট ব্যোম, বুড়িমার ফাটিয়ে বাড়ি রওনা দিলাম।
দীপাবলির দিন চারিদিকে আলোর ঝর্ণাধারায় বয়ে যাই; ছুট্টে চলে যায় মন শৈশবের দিন গুলিতে; পিছনে ফেলে আসা স্মৃতিপথের সেই অলিগলি পথ হাতরে খোঁজে শিশুকাল। খুব ইচ্ছে করে সেই ছোটোবেলা ফিরে পেতে।
প্রতিবছর ঠিক পূজো_পূজো রবে মন কিরকম যেন হর্ষে ওঠে, নতুন জামা, নতুন জুতো পড়ে, বন্ধুদের ডেকে ডেকে সব দেখানোর আনন্দটা খুব মনে পড়ে। আজ সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে গেছে স্মৃতিময় সেই আলোর রোশনাই।
কবিতা
ফিরে এসো লক্ষ্মী
সমীরণ চক্রবর্ত্তী
তোমার সাথে মুখোমুখি হলে
জোৎস্না খসে পড়ে,
আর ফেলে আসা সময়
হিমেল রাত চন্দ্রকলা গড়ে।
কোজাগরী চাঁদ তখনও
বন্দী বাঁশ পাতার ফাঁদে,
নিভন্ত আঁচে আগুন আছে জেনেও
লক্ষ্মীর নীল আঁচল শুধুই ডুকরে কাঁদে।
রুটি নেই, জীবন-জীবিকাও নেই
তাই ফিরে এসো লক্ষ্মী আবার কমলালয়ে,
বজ্রকীটে নতুন করে গড়ুক
সহস্র নারায়ণ শীলা, গোপন বরাভয়ে।
তোমার সাথে মুখোমুখি হলে
জোৎস্না খসে পড়ে,
আর ফেলে আসা সময়
হিমেল রাত চন্দ্রকলা গড়ে।
কোজাগরী চাঁদ তখনও
বন্দী বাঁশ পাতার ফাঁদে,
নিভন্ত আঁচে আগুন আছে জেনেও
লক্ষ্মীর নীল আঁচল শুধুই ডুকরে কাঁদে।
রুটি নেই, জীবন-জীবিকাও নেই
তাই ফিরে এসো লক্ষ্মী আবার কমলালয়ে,
বজ্রকীটে নতুন করে গড়ুক
সহস্র নারায়ণ শীলা, গোপন বরাভয়ে।
আগমনী
মন্দিরা ঘোষ
আকাশপাড়ে সাদা কাশের ঠাস বুনট
শিউলির ঘুমকথার নকশা আঁকা সবুজ ঘাসে
শিশিরভেজা আলতা পায়ের ছাপ
ফুল পাখি ঘাসফড়িংয়ের জড়ানো উল্লাস
ধ্রুবলোক নেমে আসার অনুভবে
ঘোলাপুকুরের পূণ্যলোভের অহংকার
চেয়ে থাকার ভেতর মায়ার ডুবজল
খোলাচুলে কপালের লাল টিপ
জাগতিক বিস্মরণরেখায়
লাল নীল দৈবের আলো
পথ ভাসে অলৌকিক সাধনায়
আর্দ্র করুনার হাতে নীলপদ্ম
ঢাক কাঁসর আর ধূনোর মায়ায়
উৎসবের রঙ লাগে সাদা মেঘে
মন্দিরা ঘোষ
আকাশপাড়ে সাদা কাশের ঠাস বুনট
শিউলির ঘুমকথার নকশা আঁকা সবুজ ঘাসে
শিশিরভেজা আলতা পায়ের ছাপ
ফুল পাখি ঘাসফড়িংয়ের জড়ানো উল্লাস
ধ্রুবলোক নেমে আসার অনুভবে
ঘোলাপুকুরের পূণ্যলোভের অহংকার
চেয়ে থাকার ভেতর মায়ার ডুবজল
খোলাচুলে কপালের লাল টিপ
জাগতিক বিস্মরণরেখায়
লাল নীল দৈবের আলো
পথ ভাসে অলৌকিক সাধনায়
আর্দ্র করুনার হাতে নীলপদ্ম
ঢাক কাঁসর আর ধূনোর মায়ায়
উৎসবের রঙ লাগে সাদা মেঘে
সূর্যের জোনাকী
মৃণালিনী ঘোষ
তিস্তার পারে বসে তোমার আলো খুঁজতে খুঁজতে
অরণ্যের নাভীশ্বাসে তুমি তারা,
সন্ধ্যার সূর্য ; চাঁদের আকাশে
সবুজ আঁচলে রুদ্রের কেশপাশের দুল
জটায় ছড়িয়ে থাকা লুপ্ত আলোয় গিরিশৃঙ্গের ফুল।
সবুজের চোখে কুয়াশার কাজল
রোদ- বৃষ্টি দোলায় আঁচল,
দুলে ওঠে ধানক্ষেত
ট্রয় ট্রেনে স্বর্গের পথে পথে গঙ্গার উঁকি
সংকেত পৌঁছে দেয় নিজস্ব কৈলাসে।
আদিম
গৌরব রায় চৌধুরী
ফর্সা,নরম গোড়ালি দেখেই
পুরুষটির মনে জেগেছিল প্রেমে।
নারীটির গোলাপী নখ; তাঁর দুধেল বুক
কাঁঠালিচাঁপার ফুলের মত শরীরগন্ধ---
পুরুষটিকে নিয়ে গিয়েছিল গাঢ় চন্দনের বনে
যেখানে ময়ূর একাধারে সুঠাম,একাধারে কোমল ও আবেগমথিত
মেঘ
যেন দিগন্তের নাভিদেশ ছুঁয়ে যাওয়া আঙুলস্পর্শ
মহুয়াগন্ধে ঘুম ভেঙে গেলে যেখানে কৃষ্ণাদ্বাদশীর
চাঁদ শোনায় সুবর্ণরেখার গল্প।
প্রার্থনা
উদয় সাহা
একটা নতুন ভোর দাও
একটা নতুন আলো
নতুন একটা শুরু হোক
কন্ঠেতে সুর ঢালো।
হেমন্তের গানে আমার
ভালোলাগার ঘোর
পায়ের পাতায় লবণ জল
সময় ঘুম ভাঙানোর।
একটা ভারী ডানা দাও
ছুঁয়েছি গহীন অরণ্য
উড্ডীন হব ঐ আকাশে
সাথে ভাবনারা বন্য।
মেঘের কোলে রাস্তা দাও
গাইব গগনবিহারী
ঝরে যাবে কথা সব
এমন হৃদয়বিদারী।
কলম
রাহুল ঘোষ
১
বাস্তব জগতে আমাকে চলানো কঠিন,
রংহীন শব্দের প্রান বাক্যে,
অচেতন বাক্য চেতন হয় আমার অনুর স্পর্শে,
অসহিষ্ণুকে জড়াই নিজ বাক্ জালে,
ফলস্বরূপ পক্ষ - প্রতিপক্ষ,
সময়ে তাড়িত মৃত স্বপ্নেরা ভিড়ে চারপাশে,
কল্পের অধুনা ছোয়ায় পূর্ন হয় আমার তরে,
রংহীন জীবন স্রোতে আমি প্রানবন্ত,
চারিপাশে কালো মেঘের আড়ালে আমার কাহিনী জীবন্ত।
২
নৃশংসতার দাবানলে জ্বলন্ত পটভূমি।
বদ্ধ খাঁচায় বন্দি আমি,
শোষিত আমার অণু-মন;
বিদ্বেষিত আবেগ বড়ই দুষ্কর,
ধর্মের দোলাচলে নিরপেক্ষ আমি।
প্রতিশোধের দাহে ক্ষত বিক্ষত আমার অণু,
মহাকালের অমোঘ নিয়মে ফিব়ব আমি;
শানিত বাক্যে কাঁপাব দুষ্করদের ভূমি
বন্দুকের নলে নেই সে শক্তি,
যে কাঁপাতে পারে আমার ভিওি।
শিল্পী
সুস্মিতা পাল কুন্ডু
ওরা শিল্পী, ওরা একাগ্রচিত্তে
কাজ করে , ওরা জীবন বড়ো ভালোবাসে ;
ঘরে অভাব নিত্যদিনের কথা ,
সামিল উৎসবে ,বুকে একরাশ ব্যথা !
একমুঠো রোদ্দুরের জন্য
কত আপস ,কত সংগ্রাম !
বিস্ময় বিষণ্ণতার দোলাচলে জীবন ,
পায়না সঠিক দাম ;
রোদ্দুর চায় জীবনের ,
স্বস্তি চায় স্বজনের ;
উৎসবের আনন্দে হাসি ফোটাতে ,
মাতায় , মাতে ঝলমলে হেসে ;
চারিদিক রোশনাই ,
ওরা কাজ করে ,সম্মানের প্রত্যাশায় ;
ওরা কাজ করে উল্লাসে ,
ওরা কাজ করে, ওরা জীবন ভালোবাসে ...!!
আসমানী
সোমনাথ গুহ
আশ্বিনে নীলে নীলে আসমানীদের মেলা
দেখি কত শত.. চলে যায় তারা
কেউ বা ক্ষণিক দাঁড়ায় অবসরে
শুভ্রবসন ছিন্ন হয় পলকেই
মানবী কে দেখি, দেখি পাশে যুদ্ধের রথ
কখন বুনো হাসের দল ছুটে যায়
ঠাকুর ঘরে ধুনোর মতো
দেব-দৈত্য আর কত পুরাণের পাতা
শিউলির গন্ধ হয়ে উড়ে আর
মিলে যায় সবে আসমানীদের মেলায়।
পূজার স্বাধিকার
নিশীথ বরণ চৌধুরী
নানান আলোয় শহর হয়েছে সুসজ্জিত
মণ্ডপে মণ্ডপে থিমের বন্যা
পূজার বাদ্য বাজছে অবিরত।
খুশির হাওয়াই আনন্দ লহরী
হৃদয়ে এনেছে প্লাবন--
বিস্তীর্ণ পথ হতে অন্ধকার গলি অবধি
জন অরন্যের ভীষণ বিস্ফোরণ।
পূজার আনন্দে নিদ্রাহীন ব্যস্ত শহর
দেখেনি কখনও?
গোধূলির রঙ ও হয়েছে ধূসর।
ঢাঁকের আওয়াজ ও শঙ্খ ধ্বনির মাঝে
কল্লোলিত যৌবনে প্রেমের কোলাহল
ব্যস্ত নগরী কানপেতে শোনে।
উৎসব ও আনন্দ মিলনের সুর উৎসারিত হৃদয়ে
রেখেছে সম্প্রীতি ও ভালবাসা অটুট বন্ধনে।
আকাশের পানে আমিও তাকিয়ে ভাবি
মণ্ডপ সমীপে ওই যে নিষিদ্ধ পল্লী
কেন কোর্টে যায়?খুঁজে নিতে দুর্গা পূজার অধিকার,
উৎসাহ আনন্দে ধুয়ে নিতে বেদনার ভার
শিখা রমলা সোমা আমাকে বলেছে কতবার।
রম্যরচনা
কালিপটকা ও পাটকাঠি
রীনা মজুমদার
প্রায় ছ’মাস পর আজ কালিপুজোতে খোকন বৌমা ,এগার বছরের নাতি বলে
কথা,সবাই এসে যাবে। মাছ মাংসের বাজার, বাজিপটকা সব আনতে হবে- তো আরেকজনের নাক ডাকাই শেষ হয়
না,আটটা বেজে গেল! মাধবীলতার ব্যস্ততা বেড়েই চলছে যতটা, তার চেয়ে মুখের ব্যস্ততা দশগুন। ডাকছি, বলি শুনছো?চা হয়ে
এল- এটা সেটা কত কাজ!আর কিন্ত চা হবে না, এটা তো আর দোকান নয়,যখন খুশি চা!
রমেনবাবু ধক করে ঘুমটা ভেঙেই, ঐ শুরু হয়ে গেছে রে! এলোপাতাড়ি গুলি!
হ্যা, হ্যা উঠছি, ওগো শুনছো, আমাকে দুটো হজমলার গুলি দাও তো। মাধবীলতার চিৎকার আরও বাড়ে ,ঠিক...ঠিক বুঝেছি
আজ কাজের দিনে শরীর খারাপ করে বসে আছে! বৌমা তাজা কই মাছ খুব ভালবাসে, দাদুভাইয়ের জন্য পাকা রুইয়ের
পেটিটা ভাজা করব, আহ্ কি ভালই যে বাসে—বলি এসব কি পরে বাজারে গিয়ে পাবে?কই কি তোমার জন্য বেঁচে
থাকবে?
মাধবী, তোমার এই
বাজারের ফিরিস্তি, বাজিপটকার ফিরিস্তি তো কাল থেকেই চলছে, সেগুলোই হজম হল না,তার উপর আবার সকাল থেকেই চাপিয়ে চলেছ,তা
পেটের আর দোষ কি?
ওহ্ বুঝলাম; আমি কথা
কইলেই তোমার....না না, কথার ফুলঝুড়ি, এই আর কি! দাও দাও চা দাও, বাজারটা সেরেই আসি।
এবার ক’দিন ধরেই
মাধবীর জীবনের একটা সাধ পুরন না হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছেটা জেগে উঠেছে-
সেই ছোটবেলায় পাথরে
পাথর দিয়ে দশ বার ঠুকে ঠুকে একবার হয়ত বা ক্যাপ টা ফুটত,তাতেই যা ভয়! আর চকলেট
বোম!বাপরে!দরজার কোনায় লুকিয়ে দাদাদের ফোটানোর শব্দ শুনতো।দাদারা আগুন ছাড়াই বোমটা
নিয়ে মাধবীর দিকে ছোড়ার ভান করত আর তাতেই ভয়ে যা চিৎকার করত তা নাকি বোমের
আওয়াজকেও হার মানাত।ভয় পেত বলে দাদারা আরও বেশী করে ভয় দেখাত আর হাসত।তখন খুব ছোটও
না,বছর বারো-তেরো ত হবেই-তাই একবার রাগে লজ্জায় বুকে সাহস নিয়ে লম্বা পাটকাঠি দিয়ে
লঙ্কা বোম ফাটাবে বলে দাড়িয়েছে-দাদারা বন্ধুরা অবাক হয়ে বুম্, ফুটলো বলে হেসেই
মরছে কিন্ত পাটকাঠি পুড়ে পুড়ে ছোট হয়ে গেল তাও লঙ্কা বোমের কাছে যেতে পারলনা।জীবনে
আর সেই সাহস হয়নি।
মাধবীলতা চারটি
ব্যাগ ও দুটো লিস্ট স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিল- দুটো লিস্ট? পরেরটায় আবার কি?রমেনবাবু
পড়তে থাকে ১।বন্দুক ও ক্যাপ
২।তারাবাতি
৩।তুবড়ি ও চরকি
৪।লঙ্কা বোম
৫।পা..টকাঠি।
পাটকাঠি! পাটকাঠি
দিয়ে কি হবে?আরে মাধবী দাদুভাই ত গেলবারই বেশ ফুটাল দেখনি? দাদুভাইয়ের পাটকাঠি
লাগেনা।
লজ্জায় মুখটা তুলে
মাধবী বেশ সংকোচেই-- পাটকাঠি দিয়ে আমিই একটা লঙ্কা বোম ফুটাব, জান তো ভয়ে জীবনে
একটা বোম ফুটাতে পারলাম না...খুব আফসোস,মনের সাধও বলতে পার,দেখ এবার আমি পারবই;ঠিক
পারব।
এই পারার আনন্দটা
মাধবীর মুখে যেন হাজার তুবড়ির আলো জ্বলে উঠল,রমেনবাবু মুচকি মুচকি হাসতে গিয়েও মাধবীর
সেই মুখখানা দেখে.....হ্যা হ্যা কেন পারবেনা?
অবশ্যই পারবে। পাটকাঠি আসছে, আানবই; আমিও ফুটাব তোমার সাথে, যে হাসবে
হাসুক, বোম আজ তোমার হাতে ফুটবেই..
অ্যা! আমার হাতে
ফুটবে?
আরে না না মাধবী, আকাশে ফুটবে।আজ আমাদের
কালীপুজোর রাতটা জমে যাবে এ ডা্রলিং।
ছড়া
পূজার দিনে
মজনু মিয়া
বাজছে ঢোল খুশির বোল
তা ধিন তা
দে উলু দে নে মজা নে
সা রে গা।
নাচছে সই সখী লই
আনন্দে
বাজে সুর খুশি মোর
স্বানন্দে।
দেবীর আজ শেষ যে কাজ
নিয়ে জল
ডুবাই দেই নিয়ম এই
ভক্তি বল।
আসে মা যায় যে মা
দিয়ে খুশ
নিয়ে যায় দুঃখ হায়
তাতেই পুশ।
মায়ের পা মায়ের গা
ধোয়াই দেই
মনে আর নেই তো তাঁর
দুঃখ নেই।
অসুর পুজো
অর্পিতা চক্রবর্তী
মহাদেব হলেন চটিয়া লাল, টিভির নিউজ দেখিয়া,
যে চ্যানেল ঘোরান একই খবর, সরব হয়েছে মিডিয়া |
মর্ত্যে গিয়েই দুর্গার জ্বর প্রবল কাঁপুনি দিয়া,
ডাক্তার বলেন, 'এ তো দেখছি হয়েছে চিকনগুনিয়া |
সরস্বতী যান পার্লারে, লক্ষীর ম্যালেরিয়া,
কার্তিক নাচে ডিস্কোয়, গনেশ হাঁপায় এদের নিয়া |
গণেশকে ডেকে অসুর বলে ফুলিয়ে বুকের ছাতি,
এ বছর 'আমি একই একশো' দূর হয়ে যা হাতি |
অসুখে দুর্গা হয়েছে যে কাবু, নেই কোনো তার শক্তি,
এ সুযোগ আমি করবো না মিস বাড়াবো সবার ভক্তি |
সবাই বলবে বাবা 'অসুর', তুমি আমাদের 'গুরু',
সবাইকে বাদ দিয়ে করবো তোমার পুজোই শুরু |
অসুরের ক্যাডার সব প্যান্ডেল করে দখল,
অসুর বেচারা নানান স্টাইলে সইছে দারুন ধকল |
সব চ্যানেলেই অসুরকে নিয়ে দারুন মাতামাতি,
নানান স্টাইলে হিরো অসুর হাসে জয়ের হাসি |
বুক ফুলাইয়া, দেহ দুলাইয়া অসুর করে নৃত্য,
নিউজ দেখিয়া মহাদেবের জ্বলে যায় গা পিত্ত |
ভক্তরা বলে বাবা অসুর 'গুরু' সাবাস 'গুরু',
মর্ত্যে করবো আমরা সবাই তোমার পুজোই শুরু ||
কৈলাশ ঘরনী মা দুগ্গা---
সম্পা দত্ত
মা'রে তুই চললি কোথায় পাগলা শিবের ঘর।
সাত জন্ম তপস্যা ক'রে পেলি এমন বর।।
সাত জন্ম তপস্যা ক'রে পেলি এমন বর।।
ছাই ভস্ম মাখে গায়ে, গাজা ভাং খায়।
তাই তো মা'রে তোর সাথে আসতে লজ্জা পায়।।
তাই তো মা'রে তোর সাথে আসতে লজ্জা পায়।।
চারটি দিন থাকিস মা'রে ঘরটি আলো ক'রে।
সব ছেড়ে তাই মনটা যে মা'তোর দিকেতেই পরে।।
সব ছেড়ে তাই মনটা যে মা'তোর দিকেতেই পরে।।
ঢ্যাং কুড়াকুড় বাদ্যি বাজে পূজোর গন্ধমাখা।
দশমীতেই কৈলাশ যাবি মনটা হবে ফাঁকা।।
দশমীতেই কৈলাশ যাবি মনটা হবে ফাঁকা।।
সন্ধি পূজো থেকে কেমন পাগল ক'রে মন।
রাত পোহালেই থাকবিনা ঘরে যাবি বিসর্জন।।
রাত পোহালেই থাকবিনা ঘরে যাবি বিসর্জন।।
একটা বছর পড়ে মা'রে আসবি আবার ঘরে।
এই কথাটা পরলে মনে বুকটা আমার পোড়ে।।
এই কথাটা পরলে মনে বুকটা আমার পোড়ে।।
দীপাবলি
দীপশিখা চক্রবর্তী
অন্ধকারের পথ ছাড়িয়ে আলোর পথে চলা,
নানা রঙে মাতবে জীবন, লাগবে হৃদে দোলা।
আলোর ছোঁয়ায় ধরণী যেন ভালবাসায় সিক্ত,
মান অভিমানের আকাশ আজ হোক তমশামুক্ত।
শব্দ বাজি দূষণ ভুলে ঘোচাও মনের কালো,
মঙ্গলবাণী ছড়াতে আজ নির্মল প্রদীপ জ্বালো।
একফালি ওই চাঁদের আলোয় স্নিগ্ধ হোক প্রাণ,
সবাই মিলে ভালোবেসে গাও সম্প্রীতির গান।
শহরতলী ভাসছে যখন লাল নীলের আভায়,
দীপাবলিতে রাঙবে আকাশ নানা রঙের শোভায়।
গল্প
আলোয় ফেরা
মৌসুমী চৌধুরী
ফর্মালিটিস সব শেষ হয়ে গিয়েছিল আগের দিনই। সই সাবুদও সব করা হয়ে গিয়েছিলো। আলিপুর মহিলা জেল থেকে ঠিক দীপাবলির দিনই জামিনে মুক্তি পেলো ললিতা। জেল সুপারের সাথে দেখা করে নিয়ে খুব ভোর ভোরই জেলের বাইরে পা রাখলো সে, ঠিক তিন বছর পর। জেলের ছোট্ট গেটটা গলে বাইরে আসতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস যেন আলতো স্পর্শ বুলিয়ে দিলো তার সারা শরীরে। পুব আকাশে তখন ডিমের কুসুম রঙের সূর্যটা সবে উঁকি দিতে শুরু করেছে। মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে গেল ললিতার। ভোরবেলায় উঠিয়ে বাবা তাদের সূর্য প্রণাম করাতেন, "ওম জবাকুসুম শঙ্কাসং/কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্......।"...... আজীবন একটা আঁধার ঝাপটা মারে বুকে, যেন একটা তীব্র আলোহীনতা তাড়া করে বেড়ায়
ললিতাকে........... জলে ভরে গেলো চোখ। জেল সুপারের কাছে ফোনে বাবার মৃত্যু সংবাদ এসেছিলো। তার জেল হওয়ার তিন মাসের মধ্যে বাবা মারা যান সেরিব্রাল অ্যাটাকে। তারপর তিন বছর ওরা কেউ আর তার খোঁজ নিতে আসেনি। জেলে তার সহবন্দিদের সাথে কেউ না কেউ দেখা করতে আসতো। শুধু তার সাথেই কেউ কোনদিন দেখা করতে আসে নি। এমন কি সমীরও নয়......... গাঁক গাঁক বাসের হর্ণে সম্বিত ফিরে পায় ললিতা। বরানগরে বাবার বাড়িতেই প্রথম যাবার মন স্হির করে সে। যে বাড়িতে জন্মের পর তার তেইশটা বছর কেটেছে, যেটা তার জন্মভিটে, তার ওপর যে তার প্রথম অধিকার। আর আছেন "মা".....বড় সুশীতল একটি শব্দ .......... দ্রুত ছুটে আসা রবানগরগামী মিনিবাসটিতে চেপে বসলো সে।....... বাবার অমতেই ভালোবেসে সমীরকে বিয়ে করেছিলো ললিতা। যে কম্পিউটার সেন্টারে সে কম্পিউটার শিখতো, সেখানেই টিচার ছিলো সমীর। সমীরকে বিয়ে করার কথা বাড়িতে জানাতেই বাবা খুবই অমত
করেছিলেন,"ওই ছেলে তোর উপযুক্ত নয়। ওই পরিবারও ঠিক নয়। তুই ওখানে ভালো থাকতে পারবি না।" সমীরদের বাড়ি আর তাদের বাড়ির দুরত্ব এ-পাড়া ও-পাড়া। বাবা যে সেদিন কিভাবে ওই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন ভেবে আজও অবাক হয় ললিতা। তার অল্পশিক্ষিত বাবা ছিলেন বেসরকারী অফিসের সামান্য গ্রুপ-ডি কর্মী। বাবা পড়াশুনা ভালোবাসতেন। তাঁর সামান্য আয়ের মধ্যেই ললিতাদের দু'ভাই বোনকে পড়াশুনা,গান-বাজনা,সেলাই শিখিয়েছিলেন। উষা কোম্পানির সেলাই স্কুলে ললিতা সেলাই শিখেছিলো, আর শিখেছিলো কিছু হস্তশিল্পও। ভাই বাবলু তার থেকে দু'বছরের ছোট। সে ভর্তি হয়েছিলো আই. টি. আই তে অটো- মোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। তাদের পড়িয়ে সংসার চালাতে বাবার খুব কষ্ট হোত। তবু বাবার কোনটাতেই মানা ছিলো না। সে যখন যুব কম্পিউটার সেন্টারে ভর্তি হতে চেয়েছিলো তখনও মানা করেন নি বাবা।
প্রথম প্রথম বিয়ের পরের দিনগুলো
মন্দ ছিলো না। সংসারে খুব একটা স্বচ্ছলতা না থাকলেও, ছোট্ট ছোট্ট প্রাপ্তিতেও গভীর সুখ খুঁজে নিতো ললিতা।শুধু একটাই অস্বস্তির কাঁটা মনের ভেতর খচখচ করতো শ্বশুর মশাই লোকটিকে ঘিরে। বয়স বছর ষাট, তবু যেন এখনও মেয়ে দেখলেই ছুঁকছুঁকে নজর। এই নিয়ে সমীরের সাথেও কোন আলোচনা করতে পারতো না। বিয়ের পর পরই সমীর চলে গিয়েছিলো রানীগঞ্জে, কোলিয়ারিতে চাকরি নিয়ে। সপ্তাহান্তে বাড়িতে আসতো। ওদিকে ললিতা "ন্যাশনাল জুট বোর্ড " এর একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পটের জিনিসপত্র
তৈরির প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো। বিয়ের আগে
একটি বুটিকে কাজ করতো সে। সেই
অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সে খুলে ফেললো একটি বুটিক, শ্বশুরবাড়ির লাগোয়া একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে। ততদিনে বাবা তাদের বিয়েটাও মেনে নিয়েছিলেন। দোকান খোলার ব্যাপারে বাবাই আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু গোল বাঁধলো দোকানের কর্মচারী
দুঃস্হ,স্বামীহারা উমা মেয়েটিকে নিয়ে।শ্বশুরমশাই সবসময় তার আশে পাশে ঘুরঘুর করতে লাগলেন। শাশুড়ি মা দেখেও যেন না দেখার ভান করতেন।...... একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে এক আকাশ অমা-নিশা মাথায় করে যেন পথ চলতে লাগলো ললিতা। কোথাও এক টুকরো আলো নেই, যাকে ধ্রুবতারা করে পথ চলা যায়।...... সেই বর্ষণমুখর রাতে উমা বাড়িতে ফিরতে পারে নি। থেকে গিয়েছিলো দোকানঘরেই। মাঝ রাত্রে হঠাৎ একটা কান্নার আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় ললিতার। ছুটে দোকানে গিয়ে দেখে বিবস্ত্র উমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করছেন শ্বশুরমশাই.............. অন্ধকার সুরঙ্গটা যেন টুঁটি চেপে ধরে ললিতার........কোথাও যেন একফোঁটাও আলো নেই..........কপালের দু'দিকের শিরা দপ্ দপ্ করতে আরম্ভ করলো তার। পাশে রাখা ছিলো বুটিকের কাজে ব্যবহৃত ছুরি,কাঁচি। জ্ঞানশূণ্য ললিতা ধারালো বড় ছুরিটি সপাটে গেঁথে দিলো শ্বশুরমশাইয়ের পিঠে....................তারপর. .....টিভি.......সংবাদপত্রের খবর...............শ্বশুর খুনে তিন বছরের জেল বৌমার...........
বাড়ির স্টপে নেমে বুকটা কেমন একটা ভারী হয়ে ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো ললিতার।...........বুকের সেই নিকষ কালো অন্ধকারটা যেন অজগরের মতো গিলতে আসতে লাগলো তাকে........কোথাও কেন একটুও আলো নেই?.....ওরা তাকে তাড়িয়ে দিলে এত বড় বান্ধবহীন এই পৃথিবীতে কি করবে সে?............. মা- ই দরজাটা খুলে দিলেন..... ললিতাকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। তারপর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কোনক্রমে কান্না সামলে ভেতরে চলে গেলেন। ভাই পরিস্কার জানিয়ে দিল, "জেল ফেরত খুনীর ঠাঁই এ বাড়িতে নেই। তোর জন্যই বাবা মারা গেছেন ধুঁকতে ধুঁকতে............"
দুপুর রোদেও এক আকাশ ঘোর কালো সেই অন্ধকারটা ভেঙ্গে পড়লো ললিতার মাথায়। অবশেষে ভালোবাসার দরজায় মরিয়া কড়া নাড়লো সে। শাশুড়ি মা বেড়িয়ে এসে বললেন,"এখানে কি চাই? আমি কি খুনী বৌকে বরণ করে ফের ঘরে তুলবো? যা,যেখানে ইচ্ছে, চুরি-ডাকাতি করে খা গে....। ছেলের আমার আবার বিয়ে দেবো।" পেছনে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো সমীর.......
ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যেতারার টিপটি পরে সন্ধ্যে নেমে এসেছে নিঃশব্দে। আলিপুর মহিলা জেল থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া ললিতা দত্ত বুঝলো জেলের বাইরের জগতটা তার জন্য পুরোটাই পাল্টে গেছে। খুব ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়ালো ললিতা। কয়েকটি চেনা মুখ কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। বুকের ভেতরটা কেমন স্তব্ধ হয়ে আছে ললিতার। একটা পাবলিক বুথ থেকে ফোন করলো "রক্ষক ফাউন্ডেশন"-এর বন্দনাদিকে............।
ললিতা জেলে ছিলো তিন
বছর। ওই তিন বছর তাকে শিখিয়েছে
অনেক কিছু। জেল জীবনেও দমে যায় নি সে। বন্দিদের সঙ্গে ছবি আঁকার কাজ শুরু করেছিল,ভর্তি হয়েছিল ইংরেজি শিক্ষার ক্লাসেও। সেই সময়ই পরিচিত হয় "রক্ষক ফাউন্ডেশন" এর বন্দনাদির সাথে।বিশেষ স্নেহ করতেন তাকে। ললিতা দেখেছে জেলে অনেক লোক নির্দোষ। অনেকে আবার পরিস্হিতির চাপে কোন অপরাধ করে ফেলেছেন। সারা জীবন কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে চলছেন। কিন্তু মানুষগুলো খারাপ নন। তাদের পাশে থাকার জন্যই আবার জেলমুখী হল ললিতা। আলিপুর জেলফেরত ললিতা "রক্ষক ফাউন্ডেশন" এর বন্দনাদির নির্দেশে দমদম সেন্ট্রাল জেলমুখী হল। এবারে সে অন্য ভূমিকায়, জেলের বন্দীদের কর্মমুখী করার প্রশিক্ষকের ভূমিকায় । সেখানকার বন্দিদের পাটের জিনিসপত্র তৈরির দিদিমণি এখন থেকে হবে ললিতাই.......
আজ দীপাবলি ---- আলোর
উৎসব। চারিকের বাড়িগুলিতে একে একে জ্বলে উঠলো হরেক রকমের আলো। এত আলো সত্যি সত্যিই কি দূর করতে পারবে মানুষের মনের অন্ধকার, জীবনের অন্ধকার? অনেকদিন একটা অন্ধকার লম্বা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত হাঁটতে থাকা ললিতার মনে হলো বহুদূর হেঁটে এসে, বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসে আজ যেন সত্যিই সে পৌঁছতে যাচ্ছে সুড়ঙ্গের মুখের খুব কাছাকাছি, যেখানে আলোর ঝর্ণাধারা যেন তার বুকের সেই অন্ধকারটিকে ধুইয়ে
দিচ্ছে.......তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আলোকময় এক উত্তোরণের পথে।
আলোকসূত্র
নবনীতা স্যান্যাল
প্রায় মাসখানেক পরে নিজের ছোট শহরে ফিরেছে দীপ। , পুজোর আলোর রোশনাই গায়ে মেখে ।কিন্তু নিজের এলাকায় এসে বডড মিয়ানো,শুকনো লাগছে সব।কোথায় ভেবেছিল, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবে 'ফিলিং ফেসটিভ' ।কত কথা বলে এসেছে নতুন বন্ধুদের ..ছোট শহরে পুজোয় প্রাণ থাকে , আয়োজন কম থাক, আনন্দ থাকে ...।কিন্তু কোথায় কী !!নিজের ক্লাবের পুজো এবার নমো নমো করে সারা হবে ।কারণ, পাড়ার ডাক্তার বিজন কাকু হঠাৎই মারা গেছেন ।তিনি ই ক্লাবের পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ।মা ওর কথা . , ওর ছেলের কথা বলে চলেছে. . ".কত ছেলেকে সাহায্য করেছেন আর নিজের ছেলের ডাক্তার হওয়া দেখে যেতে পারলেন না! !" এইসব আর কি ।
ধূর , ভাল্লাগে না, দীপের ।এমন ই শারদ দ্বাদশীর দিন দীপের বাবা ও চলে গিয়েছিলেন হঠাৎই ।ছোটবেলার সেসব কষ্টের দিন মনে করতে ইচ্ছে করে না আর ।মার মুখটায কিন্তু বেশ আলো আলো ।এতদিনে ছোট্ট একখানা পাকা ঘর তৈরি করতে পেরেছে ওরা ।মায়ের কাজটা যদিও এখনও পাকা হয়ে যায় নি, তবু মা বেশ খুশি খুশি ।কারণ দীপ । ওর দিকে তাকিয়ে বাঁচার রসদ পাচ্ছে মা । আর প্রথম বার লুচি সুজির ম ম গন্ধে দীপের মনে হচ্ছে আজ উৎসব।
কিন্তু মণ্ডপে কেমন একটা বিষাদ লেগে আছে ।সবাই আসেও নি মণ্ডপে। গান টান চালানোর কথা বলতে যাবে হঠাৎ চোখে পড়লো কৌশিক কে। মাথার চুল গুলো খুব ছোট করে ছাঁটা'।কী হলো রে?'তুই জানিস না? '----খারাপ খবর শুনতে হবে আশঙ্কা করে দীপ ।তাতে পুজোর আনন্দ আরও মাটি হবে ।মাঝে এত বখাটে হয়ে গিয়েছিল কৌশিক যে কারো সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না ওর ।হাউহাউ করে কাদে কৌশিক ।'এতো দিন খুব ফাঁকি দিয়েছি রে, সবাই কে ঠকিয়েছি ।তাই তো নিজের হাতে আর কিছুই থাকল না ।'দীপের চোখে ভেসে উঠল কৌশিকের বাবার মুখটা ।এইচ. এস এর রেজাল্ট এর পর কী শুকনো মুখে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন স্কুল থেকে ।দীপদের দেখে শুকনো মুখে হেসে দীপকে বলেছিলেন , 'ভালো রেজাল্ট হয়েছে, শুনেছি, আরও ভালো করতে হবে তোকে ।ভালো থাকিস, মাকে
প্রায় মাসখানেক পরে নিজের ছোট শহরে ফিরেছে দীপ। , পুজোর আলোর রোশনাই গায়ে মেখে ।কিন্তু নিজের এলাকায় এসে বডড মিযানো,শুকনো লাগছে সব।কোথায় ভেবেছিল, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবে 'ফিলিং ফেসটিভ' ।কত কথা বলে এসেছে নতুন বন্ধুদের ..ছোট শহরে পুজোয় প্রাণ থাকে , আয়োজন কম থাক, আনন্দ থাকে ...।কিন্তু কোথায় কী !!নিজের ক্লাবের পুজো এবার নমো নমো করে সারা হবে ।কারণ, পাড়ার ডাক্তার বিজন কাকু হঠাৎই মারা গেছেন ।তিনি ই ক্লাবের পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ।মা ওর কথা . , ওর ছেলের কথা বলে চলেছে. . ".কত ছেলেকে সাহায্য করেছেন আর নিজের ছেলের ডাক্তার হওয়া দেখে যেতে পারলেন না! !" এইসব আর কি ।
ধূর , ভাল্লাগে না, দীপের ।এমন ই শারদ দ্বাদশীর দিন দীপের বাবা ও চলে গিয়েছিলেন হঠাৎই ।ছোটবেলার সেসব কষ্টের দিন মনে করতে ইচ্ছে করে না আর ।মার মুখটায কিন্তু বেশ আলো আলো ।এতদিনে ছোট্ট একখানা পাকা ঘর তৈরি করতে পেরেছে ওরা ।মায়ের কাজটা যদিও এখনও পাকা হয়ে যায় নি, তবু মা বেশ খুশি খুশি ।কারণ দীপ । ওর দিকে তাকিয়ে বাঁচার রসদ পাচ্ছে মা । আর প্রথম বার লুচি সুজির ম ম গন্ধে দীপের মনে হচ্ছে আজ উৎসব।
কিন্তু মণ্ডপে কেমন একটা বিষাদ লেগে আছে ।সবাই আসেও নি মণ্ডপে। গান টান চালানোর কথা বলতে যাবে হঠাৎ চোখে পড়লো কৌশিক কে। মাথার চুল গুলো খুব ছোট করে ছাঁটা'।কী হলো রে?'তুই জানিস না? '----খারাপ খবর শুনতে হবে আশঙ্কা করে দীপ ।তাতে পুজোর আনন্দ আরও মাটি হবে ।মাঝে এত বখাটে হয়ে গিয়েছিল কৌশিক যে কারো সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না ওর ।হাউহাউ করে কাদে কৌশিক ।'এতো দিন খুব ফাঁকি দিয়েছি রে, সবাই কে ঠকিয়েছি ।তাই তো নিজের হাতে আর কিছুই থাকল না ।'দীপের চোখে ভেসে উঠল কৌশিকের বাবার মুখটা ।এইচ. এস এর রেজাল্ট এর পর কী শুকনো মুখে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন স্কুল থেকে ।দীপদের দেখে শুকনো মুখে হেসে দীপকে বলেছিলেন , 'ভালো রেজাল্ট হয়েছে, শুনেছি, আরও ভালো করতে হবে তোকে ।ভালো থাকিস, মাকে যথারীতি নেশা করে বসে ছিল ।তাপ উত্তাপহীন ।সেই কৌশিক আজ কাদছে।ফিজিক্স এর ছাত্র দীপের স্বভাবতই মনে হল 'every action .......।মাতৃ পক্ষেই পিতৃতর্পণের সুযোগ এল বোধ হয় ।কৌশিকের পিঠে হাত রাখে দীপ ।বলে, 'নোটস গুলো নিয়ে যাস।জেরকস করে ফেরত দিবি ..জলদি ।তপাদার দোকানে যাবি, ওখানে কমে হয় ।এবার তোর পাশ করার guarantee দিতে হবে ।নইলে বন্ধুত্ব নট ।'কৌশিক ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে ।
আজকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে দীপ আর তার বন্ধুরা ।আজ দশমী।সিদ্ধান্ত টা আজ ই নিহতে হবে ।কথা হয়েছিল আগে ই।আজ ফাইনাল ।পুজোর সময় যে টাকা টা খরচ করে ওরা ।সেটা খরচ হবে না ।জমা হবে ।অথবা একদিন করে একজন কেউ খরচ করবে ।বাকিরা করবে না ।যে খরচ করবে তাকে আর টাকা দিতে হবে না ।জমানো টাকা বছর ঘুরে ইন্টারেস্ট সহ যা হবে, তাতে কৌশিকের কারো পড়ার খরচ সামান্য হলেও উঠবে ।'খুব বেশি কিছু হবে না, জানি ।তবু ..'।'আর বড়ো জোর চার পাঁচ বছরের মধ্যেই যে যার মতো রাস্তা খুঁজে নেব আমরা ।অথবা চেষ্টা করব সহজ সঠিক রাস্তা টা খোঁজার ।অথবা লড়াই করব সেজন্য ।তার আগে বন্ধুত্বের এই আলোকসূত্রে আয় আজ থেকে বেধে ফেলি নিজেদের ।'অনেক কথা বলে চুপ করে দীপ ।'বন্ধুদের হাততালির মধ্যেই এতদিনে উৎসব খুজে পায় দীপ।হাতে হাত রেখে হেঁটে যায় ওরা স্বপ্ন পূরণের রাস্তায় ....
গুহামানবের সুখ-দুঃখ
পিনাকি চক্রবর্তী
১
দৃশ্যটা
প্রথম বলিরাজের চোখেই পড়ল । গঙ্গার শান্ত
বুকে , রাজতরীটা প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে
। বলিরাজ সূর্য প্রণামে মগ্ন ছিল । দু ‘হাত জুড়ে কর অঞ্জলি দিয়ে , জলে ফুল ফেলছিল , ঘিরে ছিল অমাত্যরা
; আচমকাই
দেখলেন , দূরে একটা মৃতদেহ ! পাশে মন্ত্রী
রয়েছে । উল্টো দিকে সেনাপ্রধান দাঁড়িয়ে রয়েছে ।
গঙ্গার
স্থির জলে কখনো মৃত দেহটা ভাসছে , আবার কখনো ডুবছে ।
দূরে আপাতত দৃশ্যটা এইরকম - কাঠের
ভেলার উপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে এক বৃদ্ধ ; গালের লম্বা
সাদা দাড়ি আর বুকের উপর উপবীত দেখা যাচ্ছে । দেহটা নির্ঘাত কাঠের ভেলার সাথে
বাঁধা ; নতুবা এমন ভাবে ভাসতে পারত না ! বলিরাজ মন্ত্রীকে
বলল – একটু দেখতো । মনে হচ্ছে , কোন বৃদ্ধ ব্রাক্ষ্মণ হবে । দেহটা সৎকারের
ব্যবস্থা করো । প্রাতঃভ্রমণের সময় এমন দৃশ্য দেখে মন খুব খারাপ হয়ে যায় !
মন্ত্রী
দৃশ্যটি দেখল । মনে –মনে বলল
- হ্যাঁ , দেহই বটে । দিনের আলোয় , দেহটি
যে রুগ্ন , বোঝাই যাচ্ছে । গলায় জড়ানো পৈতেটি দেখেই একে বিপ্র বলে মনে হচ্ছে । একটা উটকো ঝামেলা এসে জুড়ল ।
ধার্মিক বলিরাজ সমারোহের সাথেই , বিপ্রের দেহের সৎকার করবেন । আজ দিনটা একটা অপরিচিতের
পিছনেই যাবে !
মন্ত্রী , জেলে কে ডাকল । বলল – ওই
দূরে যে লাশটা ভাসছে । লাশটাকে জল
থেকে তুলে আনবি। তাঁবুর ভিতরেই
আছি । দেখিস যেন দেহ কোনভাবেই বিকৃত না হয় । না হলে রাজ রোষে পড়বি । আজ তোদের গত জন্মের পুণ্যের
ফল পেলি ! শূদ্র হয়ে ব্রাক্ষ্মণের দেহ
ছুঁতে পারবি ! কয়েকপুরুষ পাপ মুক্ত হবে । নে
দাঁড়িয়ে না থেকে কাজ কর ......
জেলে দেখছিল , লাশে এখনো পঁচন ধরেনি । তার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে , আদৌ
হয়ত মৃত নয় ! আবার কিছুক্ষণের জন্য ভাবল , - রাজা যখন
বলে দিয়েছেন মৃত , মন্ত্রী যখন মেনে নিয়েছেন , তখন তার আর বলবার কিছু নেই । তাছাড়া এখন তার
কাজ , ওই রুগ্ন , লম্বা সাদা দাড়ি , কাঁধ
থেকে কোমর অব্দি জলে ভাসমান সাদা সুতোয় জড়িয়ে থাকা দেহটাকে খুব সাবধানে তরীতে নিয়ে আসা । একদিক থেকে সে নিশ্চিন্ত , ওই মৃত
দেহটি যদি ব্রাক্ষ্মণের হয় সে রেগে
গিয়ে শাপ দিতে পারবে না। তাই বিপ্রের দেহকে স্পর্শ করলে শাপ নেওয়ার ভয় নেই । তবে বলিরাজ
ভীষণ ধার্মিক । তিনি দেহের বিকৃতি দেখলেই
রেগে যেতে পারেন । তাই দেহে পঁচন না ধরলেই হল!
সামনের স্থির জলে তাকিয়ে জেলে ছোট্ট নিঃশ্বাস
ফেলল ।
বলিরাজ রাজতরীর
ভিতর , সকলের সাথে বেদ পাঠ শুনছিল
। সাথে মন্ত্রী রয়েছে । এক নবীন ব্রাক্ষ্মণ
দাক্ষিণাত্য থেকে এসেছে । ছেলেটিকে দেখতে বেশ । বয়েস খুব বেশি হলে কুড়ি হবে । যেমন
নম্র ব্যবহার তেমনই মন্ত্রের উচ্চারণ । রাজা শুনছেন না শুধু ,
দেখছেন । তামার বাসনের মতন গায়ের রং , চোখ দুটো প্রসারিত আর মুখে হাসি মেখে আছে । বিপ্রের
কাঁধ ছুঁয়ে থাকা কালো কেশ গুচ্ছ ।
এমন সময় কানের কাছে , মুখ এনে মন্ত্রী বলল –
মহারাজ , ব্রাক্ষ্মণ এখনো প্রাণ ত্যাগ
করেননি । বৈদ্য দেখছেন । তবে শরীর অত্যন্ত দুর্বল ।
বলিরাজ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল – বৈদ্যকে ডাকো । এই আয়োজন এখানেই থামাও । চালককে
বলে দাও , রাজধানীর দিকে তরী নিয়ে যেতে । শেষে কি ব্রক্ষ্ম হত্যার দোষ নেব ! যে ভাবে হোক ব্রাক্ষ্মণ বাঁচাতে হবে ।তুমি নিজে
ব্যাপারটা দেখো ।
বলিরাজার মুখের ভঙ্গী আর উত্তেজনার বহর দেখে
, বেদ মন্ত্র উচ্চারণ করছিল যে নবীন ব্রাক্ষ্মণ , সে বলল –রাজন , আপনি আমাকে বলতে পারেন ।
বলিরাজ লজ্জা পেয়েছে । এখানে আরও তিনজন অতিথি রয়েছে । তারাও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বলিরাজ
বলল – বিপ্র আপনি বেদ মন্ত্র পড়ুন । এই মন্ত্রে শান্তি
আছে ।
-আপনি আমায় নাম ধরে ডাকুন । আমি নাদক । এই নাম আশ্রমের দেওয়া নাম ।
রাজা হাসতে –হাসতে বলল
– বিপ্রকে নাম ধরে ডাকব ! এই সংস্কার আর্যাবর্ত
বিরুদ্ধ । আমি এর বিপক্ষে যাব কেমন করে !
নাদক বলল – তাহলে একান্তে আমাকে তুমি বলবেন । আর
জন সমক্ষে নাদক বিপ্র । সম্বোধন চলুক ক্ষতি নেই।আমি সংসার ত্যাগ করলেও , বয়সে বড়
কোন ব্যক্তির কাছ থেকে স্নেহ পেতে আগ্রহী ।
নাদকের
কথা শুনে বলিরাজা হাসল ।
রাজতরী যখন ঘাঁটের সিঁড়ি ছুঁয়েছে , নগরের জনসমাগম ,এই দিকেই ধেয়ে আসছে । এটা হয়েছে ,রাজার প্রতি
ভক্তি বা শ্রদ্ধা থেকে নয় । ক্ষুধা থেকে ।
নাগরিকদের পেটে ভাত না থাকলে , অন্নদাতার প্রতি ক্ষোভ থাকে ; কিন্তু সেই
নাগরিক যদি দুর্বল , ভীতু আর অশিক্ষিত হয় – তাহলে তাদের অভ্যন্তরের ক্ষোভ , লোভে রূপান্তরিত হয় ! এই লোভ থেকেই
রাজার প্রতি আনুগত্য চলে আসে ।
বলিরাজা অন্যান্য দিন হলে নিজের হাতেই শস্য ,
বস্ত্র বিলিয়ে দিত । আজ এই দায়িত্ব
অন্যান্য অমাত্যদের হাতে দিয়ে দিতে হল ।
রাজমহলে ঢুকেই রাজা খুবই অস্বস্থি বোধ করতে শুরু
করল । নাদক বলল – আপনি এত চিন্তিত কেন ?
রাজা বলল – যেই ব্যক্তিটি আমাদের সাথে এসেছে ,বৈদ্য
বলছে মরণাপন্ন ।
নাদক স্থির চোখে তাকিয়ে বলল – রাজা , পৃথিবীতে
জন্ম বা মৃত্যু নিজের মতন ঘটে । আপনার উদ্বেগের কোন কারণ নেই । যদি এইক্ষনে মৃত্যু নিশ্চিত থাকে , আমরা
কেউই কিছু করতে পারব না ।
-আমি জানি । নাদক , তোমায় তা হলে খুলেই বলছি
।আমার সন্তান নেই । এই যে দিনরাত তোমরা যে রাজাকে দেখছ , সে ভিতরে সারাদিন চিতার আগুনে জ্বলছে । নিঃসন্তান
অবস্থায় দেহ রাখলে স্বর্গ প্রাপ্তি ঘটবেনা । এই রাজত্বের লোপ হয়ে যাবে। যদি
এই ব্রাক্ষ্মণ দেহ রাখেন , আমার বংশে বিপ্র হত্যার দোষ লাগবে । বংশ বিলোপ
হয়ে যাবে । আমি তাই অস্থির হয়ে উঠেছি । আমার কাছে যে বৈদ্য রয়েছে , তাদের উপর বিশ্বাস রাখতে পারছিনা
।
এতক্ষণ নাদক সব কথা শুনছিল । বলিরাজাকে বলল –
আপনি যদি আমার উপর বিশ্বাস করেন , আমি
বৃদ্ধ ব্রাক্ষ্মণের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে
চাই । জানিনা সফল হব কিনা ! আমি আশ্রমে থাকাকালীন গাছ গাছড়ার ব্যবহার শিখেছি । চিকিৎসাও করতাম । ভাবতে পারিনি এই এখানে এসে এমন
ভাবে সেই বিদ্যা প্রয়োগ করবার সুযোগ পাব !
বলিরাজা কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হল । অন্তত চোখে
–মুখে সেই তৃপ্তি ধরা পড়ল। - তাহলে আমি
নিশ্চিন্ত হতে পারি?এখানে যারা আছেন , অধিকাংশই পুরাতন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করেন ।
তুমি নবীন । আধুনিকতার সাথে তারুণ্যের উদ্দম দেবে । আমি চাই
তুমি ব্রাক্ষ্মণের চিকিৎসার জন্য যে দল গঠন হবে , তার নেতৃত্বে
থাকো । সেই দলে আমার বৈদ্যরাও থাকবে । আমি তোমার জন্য আলাদা স্থান
করে দিচ্ছি । সেখানে তুমি আর ব্রাক্ষ্মণ
একত্রে থাকতে পারবে । সর্বক্ষণের জন্য তাঁকে চোখে –চোখে রেখে চিকিৎসা করাতে
পারবে । আমি আশাবাদী , হে নবীন যুবক তুমি
এই বংশকে ক্ষয়ের হাত থেকে উদ্ধার করবে ।
আশা করছি তোমার সেবায় ব্রাক্ষ্মণ দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে ।
আশ্রম
কুটীরের চারপাশে প্রহরীর বেষ্টনী ঘিরে রয়েছে । ঘরের ভিতর পালঙ্কের উপর
শুয়ে আছে , রুগ্ন চেহারার বছর ষাটের বৃদ্ধ
। গায়ের রং কালো , গালে ঘন
সাদা দাড়ি , বুকের উপর সব কটা চুল সাদা হয়ে গিয়েছে ।
পালঙ্কের কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে তাম্র বর্ণের
নবীন বিপ্র । তারুণ্যে ভরপুর । নাম নাদক । এই একমাসে সে বলিরাজার খুব প্রিয় হয়ে
উঠেছে । তার একান্ত সেবায় আর বেঁচে উঠেছে শায়িত , ঘুমন্ত বৃদ্ধ ।
নাদক আচমকাই কিছুক্ষণের জন্য , একমাস আগের সেই
মুহূর্তের কথা ভাবছিল । আপাতত সে চিন্তামুক্ত , কেননা রাজা তার উপর যে বিশ্বাস
অর্পণ করেছিল , তার সম্মান রাখতে পেরেছে ।
ঘুম ভাঙতেই বৃদ্ধ উঠে বসল । নাদক সামনে গিয়ে
দাঁড়াল । বৃদ্ধের হাতে পাথরের বাটি দিয়ে
বলল
-ঋষি , আপনি জল পান করুন ।
প্রায় রুগ্ন বৃদ্ধ , কাঁপা –কাঁপা কণ্ঠে বলল
-নাদক , দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে ! আমি আগের থেকে অনেক সুস্থ । তোমাকে আর পাহারাদারের
ভূমিকা না নিলেও চলবে । বিশ্রাম নাও ।
-আপনার কাছে যতক্ষণ থাকি ততক্ষণইতো বিশ্রাম ।
আবার নতুন করে কি নেব !
-ঠিক বলেছ । এই বৃদ্ধ অন্ধের প্রতি এত মায়া কেন
? আমাদেরতো রক্তের সম্পর্ক নেই ।
-আপনি আবার ওই কথা বলতে শুরু করেছেন ! নিষেধ করা
স্বত্বেও । এমন ভাবে বললে , আমি ভাবব আমার উপস্থিতি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে ।
বৃদ্ধ দু’হাত দিয়ে , পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাদকের
কনুই ছুঁয়ে বলল – এই একমাসে তুমি আমার বিশ্বাস এতটা অর্জন করেছ যে, ছায়াও এর চেয়ে
কম বিশ্বাসযোগ্য । তুমি যেও না । আমার সামনে বসও ।
প্রদীপের জ্বলন্ত শিখার তলায় যেমন , শায়িত থাকে
ছায়া ; তেমনই বৃদ্ধের দুটি কোটরে লেপেছে
অন্ধকারের প্রলেপ! বৃদ্ধ চোখে দেখতে পাননা
, এই সত্য আবিষ্কার হয়েছে চতুর্দশ দিবসে । নাদকের খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছে , ভেলায়
ভেসে এসেছিল কেন ? কোন নিষ্ঠুর ভবিতব্য বৃদ্ধকে অসহায় করেছিল ? সে কি জন্মান্ধ ?
তাঁর নাম কী ? পরিবাররে ইতিহাস বা কী ? এতসব জানবার মতন শারীরিক অবস্থা বৃদ্ধের
ছিলনা । এই একমাস সমস্ত প্রশ্ন বুকে চেপে রেখেছে । বলিরাজাও জানতে চাননি ।
আজ নাদকের খুব ইচ্ছা হল । ঘরের জানালা দিয়ে
দেখছে , বাইরে শিউলি গাছের উপর ছোট্ট আকাশে ,সূর্য ডুবে যাচ্ছে । এই সময় আচমকাই
চারপাশ আলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে । তারপর এই আশ্রমটা প্রদীপের আলোয় ভেসে উঠবে । হলুদ
রঙের আলো । উঠানে , দুয়ারে , আশ্রমের তুলসী মঞ্চে জ্বলবে । আশ্রমটা আলোর মালায় সজ্জিত হয়ে ওঠে । যেনও রাজমহল থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন সবুজ জঙ্গলে
আলোর মালা বিছিয়ে রয়েছে !
আমি আহ্নিক করে আসছি । ---নাদক বলল ।
বৃদ্ধ
বলল – আজ বেশ সুস্থ বোধ করছি তোমার সাথে
গল্প করব ।
-শর্ত আছে ।
-আমার কাছে শর্ত !
-আপনার নিজের পরিচয় দিতে হবে ।
বৃদ্ধ বলল – তুমি আহ্নিক দিয়ে এসো । কেননা আমার জীবনের কথা জানতে হলে , তোমাকে আমার জীবনের দুটো ঘটনার কথা শুনতে হবে । তুমি আমার শিষ্য । তোমাকেই
বলব । তবে আমারও শর্ত আছে । আমার কথা তুমি আমার অনুমতি ছাড়া অপরজনকে জানাতে পারবেনা ।
নাদক বলল – প্রতিজ্ঞা করলাম । আপনার পা ছুঁয়ে ।
নাদক , ব্রাক্ষ্মণের রোগা , ক্ষয়ে যাওয়া পা স্পর্শ করল ।
২
প্রথম ঘটনা
বৃদ্ধ পালঙ্কের উপর বসে আছে । নাদক সামনে মেঝেতেই বসেছে। ঘরের দরজা বন্ধ ।
বৃদ্ধ বলতে শুরু করল ।
-তুমি উতথ্য ঋষির নাম শুনেছ ? এই গল্প উতথ্য ঋষি , তাঁর পত্নী মমতা আর দেব পুরোহিত বৃহস্পতিকে নিয়ে । মন
দিয়ে শুনবে ।
উতথ্য ছিল বৃহস্পতির দাদা । মমতা ছিল সম্পর্কে বৃহস্পতির দাদার স্ত্রী । বিয়ে তার উতথ্যের সাথেই হয়েছিল ।
কিন্তু মন কখনও এক জায়গায় স্থির হয়ে
থাকবার নয় । সে অভ্যাস বোঝে আর অনুশাসন বোঝে । উতথ্যের সাথে মমতার আর্য মতেই বিয়ে
হয়েছিল । বিয়ের সময় উতথ্যের অর্ধেকের বয়স
ছিল মমতার । সে যেমন বুদ্ধিমতী ছিল তেমনই সুন্দরী । উতথ্য একজন বেদজ্ঞ । তাকে বহু
দূরদূরান্তে যজ্ঞের কাজ সম্পর্ণ করবার জন্য বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকতে হত । ঘরে
যুবতি মমতা আর বৃহস্পতি থাকত । বৃহস্পতি খুবই সুপুরুষ । তখনো দেবভূমির পুরোহিতের স্বীকৃতি পাননি ।
মমতা একদিন বৃহস্পতিকে ডাকল । বাইরে শ্রাবণের
অনবরত বৃষ্টি ঝরছে । তার শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল , মৌমাছির হুল ঝরে পরছে ! ঘরেতে
যুবতী মমতা আর যুবক বৃহস্পতি ।
মমতা
ঘরের ভিতর আসতে বলল । বৃহস্পতি
চৌকাঠ পেড়িয়ে উত্তেজিত পায়ে , ঢুকল । বলল
-তুমি আমাকে ডাকলে কেন ?
-তোমার মনে হয়না , দাদার অবর্তমানে আমার মনোরঞ্জন
করবার দায়িত্ব তোমার । নিজের দায়িত্ব পালন কর ।
-মমতা আমাদের দুজনের মধ্যকার বয়সের পার্থক্য
বেশি নয় । আমরা বন্ধু হয়ে উঠতেই পারি ।
মমতা তাকিয়ে আছে , চোখের উপর চোখ রেখে ।
বৃহস্পতি আচমকাই তার ঠোঁটে –ঠোঁট রাখল ।
বেশ কিছুদিনের মধ্যেই , যখন দু’জনের সম্পর্ক বেশ
গভীর হয়ে উঠেছে , তাদের শারীরিক সম্পর্কের
মুহূর্ত যেন আরও দৃঢ় হতে শুরু করেছিল । একটা সময়ের পর মমতা বুঝতে পারে, বৃহস্পতি তাকে ভোগ করছে ! শুধু তাই নয় মমতা তার
কাছে শুধুই শরীর ! চতুর বৃহস্পতি উতথ্যের
সুনাম নষ্ট করবার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল । ইতিমধ্যে উতথ্য বাড়িতে ফিরে আসবার সময় হয়ে এলো ; এক বছর সে ছিল না ।
একদিন মমতা বুঝতে পারল , সে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে !
বৃহস্পতি চাইছিল এই সন্তান যে তার , মমতা যেন সে কথা বলে সমাজকে । মমতা এমনটা চাইল
না। কেননা , বড় ভাই থাকতে ছোট ভাইয়ের সন্তান গর্ভে ধারণ করলে , উতথ্যের সামাজিক
অবস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হবে । বৃহস্পতি শুধুই যে কামুক ছিল তা নয় , এক ঠক পুরুষ মানুষও । মমতা তাকে কোন মতেই নিজের
সন্তানের পিতা বলতে নারাজ । বৃহস্পতি কিন্তু সন্তানের জন্মের দিন অব্দি অপেক্ষা
করেছিল ।
ভাগ্য এখানেই করুণ খেলা খেলে দিল ! মমতার যে
সন্তান জন্মাল , সে জন্মান্ধ ! বৃহস্পতি তার দায়িত্ব পালন করল না । পালিয়ে গেল
! অন্ধ ব্রাক্ষ্মণ আর দুধহীন গাভী - সমাজে এমন এক ভক্তি মেশানো সহানুভূতির কেন্দ্র
হয়ে ওঠে , যাকে সহ্য করা যায় না।
বৃহস্পতি গৃহ ত্যাগ করল । মমতাই নিজের
ছেলের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল । অতি যত্নে সেই অন্ধ ছেলেটিকে বড় করে তুলল ।
সেই ছেলে সমাজের কাছে উতথ্য আর মমতার ছেলে , তবে
সে নিজে পরবর্তী সময়ে মায়ের মুখ থেকেই সত্য জানতে পারে । তার মা , তাকে বলে -
লোকসমাজে নিজের অন্ধত্বের কারণ হিসেবে
বৃহস্পতির ধর্ষণের গল্প প্রচার করা হয়েছিল আর অভিশাপের মিথ্যা কথাও বলা হয়েছিল ।
বৃদ্ধ উতথ্য শেষ বয়সে নিজের আশ্রয় আর মুখাগ্নির
লোভে মমতা আর তার ছেলেকে আশ্রয় দেয় ।
এই ছেলের নাম দীর্ঘতমা ।
বাইরে অনেক রাত হয়েছে । কেননা ঝিঁ –ঝিঁ পোকার
ডাক শোনা যাচ্ছে । অন্ধ বৃদ্ধ , যে এতক্ষণ গল্প বলছিল ; থেমে গেল । বলল – আজ আর নয়
, ফলাহার করা যাক । নাদক , শ্রোতার গল্প
শোনবার থেকেও , আগ্রহ থাকাটা জরুরী । বক্তার উচিত গল্পে রহস্য রাখা । বাকীটা আমি কাল বলব ।
নাদক দেখল , বৃদ্ধ ঋষি পালঙ্ক থেকে নেমে পড়েছে । তারা এক সাথেই ফলাহার করবে ।
৩
দ্বিতীয় ঘটনা
পৃথিবীতে এমন একটা সময় আসে , যখন দিনের আলো পাখিদের মতন নিজের বাসায় ফিরে যায় । চারপাশ
ডুবে যায় গভীর শূন্যতায় । তখনই সেই অন্ধ ছেলেটা কাঁদতে শুরু করে .........
সে এক গভীর , অনন্ত , দিকশূন্য আর্তনাদ ! সে কেন কাঁদবে না , দিনের বেলায় কানে পাখিদের ডাক শুনত । রাতে তাও
হারিয়ে যেত ! তার কান্না শুনবার মতন কেউ
ছিলনা । একে অন্ধ ,আবার রুগ্ন , দেখতেও ভালো নয় । এমন ভাবেই একদিন সে উপলব্ধি করল
, শরীরের এক বিশেষ রকমের উত্তেজনা...
এই অব্দি বলে , ঋষি বলল – নাদক , আমায় জল দাও । আমার গলা শুকিয়ে আসছে ।
নাদক কিছুটা চিন্তিত হয়ে উঠল । বলল – আগের দিনে
, অতক্ষণ আমাদের কথা বলা উচিত হয়নি । আজ থাক ।
জল পান করে , বৃদ্ধ অন্ধ ঋষি পাথরের বাটি রেখে
দিল । বলল – দীর্ঘ একমাস বিছানায় লাশ হয়েছিলাম । এতদিন বাদে , কেউ অন্তত আমার কথা
শুনছে ! তুমি আমার শরীরের থেকেও , আমার কাহিনীতে মন দাও । বাইরে এখন রাত । এমন গভীর অন্ধকার তখন সেই রুগ্ন ছেলের ভিতরে জমেছে
। যে বয়সে একজন পুরুষ চারপাশে নারীদের প্রতি যৌনতা অনুভব করে । সেই বয়সেই সেই অন্ধ
ছেলেটি নিজের ভিতরে তেমনই যৌন টান পাচ্ছিল
। সমস্যাটা হল অন্য জায়গায় । সে বুঝে উঠতে পাচ্ছিল না , এই উত্তেজনা লাঘব হবে কেমন
করে ! একদিন পালক পিতা উতথ্য , তিনচারদিনের জন্য বাইরে গিয়েছিল । তখন ঘরে একা সেই
কিশোর , তার মা ঢুকল । দরজা বন্ধ করবার শব্দ কানে এসেছে । কিশোর বুঝতে পারছে , এখন
বাইরে গভীর অন্ধকার। কিশোরের মা কিশোরকে মেঝেতে বসাল । তারপর বলল
-কিছুক্ষণের জন্য আমাদের ভিতরের সম্পর্ক ভুলে
যাও ।
-কেন মা ?
-আমি আজ তোমায় সেই শিক্ষা দেব , যা বংশ বিস্তারে
কাজে আসবে । তুমি জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন । মিত্র বর্জিত । তুমি এখন যেই বয়সে , সেখানে তোমার নারী শরীরের প্রতি ধারণা
থাকা দরকার । আর্য সংস্কার ভণ্ড । এরা
যৌনতাকে উপভোগ করতে পারে , কিন্তু স্বীকার করে না । এই নাও আমার বুকের উপর হাত
রাখো । এই যে নরম দুটো মাংসপিণ্ড বিভাজিত হয়ে গিয়েছে , এটাকে স্তন বলে । তুমি এখান থেকেই দুগ্ধ পান করতে । কোন নারীকে যখন কামনা
করবে , তার স্তনের উপর মুখ রাখবে । তারপর যেমন সন্ধ্যার আভা ধীরে –ধীরে ভূতলে
আচ্ছাদিত হয়ে যায় , তেমন ভাবেই আমার শরীরের
গুপ্ত গহ্বরে তোমাকে প্রবেশ করাবো ......
নাদক বলল – পুত্রকে , মা এমন শিক্ষা দিল !
ঋষি ঘামছে , বলল – হ্যাঁ । সেইদিন ছেলেটি নারী
শরীর চিনল । আর কিছুদিন বাদেই , এক অতীব সুন্দরী ব্রাক্ষ্মণীর সাথে বিয়ে দিয়ে
দেওয়া হল । প্রদ্বেষী তার স্বামীর প্রতি অনুরক্তা ছিল । সকল নারীই তার স্বামীর
কাছে ভালোবাসা চায় । স্বামী একাধিক হলেও , নারী তার কামুকের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেই
। সেই যুবকটি এই সত্য বুঝে গিয়েছিল । তাদের সন্তান হল । দিন যত এগিয়ে গেল , সেই
অন্ধ যুবক পরিণত হল সংসারী পুরুষে ,
মধ্যবয়স ঠেলে বৃদ্ধ হতে শুরু করল ! এরমধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে ! প্রদ্বেষীর সাথে আর্য মতে বিবাহ হওয়ার সময় কামধেনু নামে এক গরু উপহার পায় । তাকে রক্ষণা –বেক্ষণের জন্য এক
ছোট শিশুকেও পাঠানো হল । তাকে
সকলে কামধেনুর পুত্র বলে ডাকত । শিশুটিও
ধীরে – ধীরে যুবক হয়ে উঠল ।একদিন সেই অন্ধ বৃদ্ধ ঋষি , আশ্রমের গোয়াল ঘরে সেই কামধেনুর পুত্রের সাথে সঙ্গম করছিল । নেহাতই যৌন
উত্তেজনা বশত । দুই পুরুষের যৌন সঙ্গম আশ্রমের অন্যান্য ঋষিরা মেনে নিতে পারেনি
। প্রদ্বেষী মেনে নিতে পারল না। আসল
কথা প্রদ্বেষী নিজেও কামধেনুর পুত্রের
প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়েছিল । একদিন প্রদ্বেষী জানিয়ে দিল , সে আর বৃদ্ধ অন্ধ ঋষির
দায়িত্ব নেবে না। আশ্রমের উত্তরাধিকারী
ছেলেদের করা হবে , এই লোভ পুত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত করা হল । পুত্ররা , মাতার কথায়
সেই অন্ধ বৃদ্ধ পিতাকে ভেলায় বেঁধে ভাসিয়ে দিল । সরাসরি হত্যা করলে , পিতার হত্যাকারী রুপে সমাজে কলঙ্কিত হত। সেই
কলঙ্কের হাত থেকে বেঁচেও গেল আর ক্ষমতাও পেয়ে গেল !
নাদক এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল । কাহিনী শেষ হতেই ,
তার মন দোলাচলের বিচরণ ভূমি হয়ে উঠেছে ! এই অন্ধ বৃদ্ধ নিজেও ভেলায় ভেসে এসেছে ! তার মুখে কাহিনী শুনে নাদকের এই ধারণা স্থির হয়ে
গিয়েছে যে – ঘটনার সাথে এই বৃদ্ধ জড়িত ।
-তোমার মনের ভিতরে যে প্রশ্ন , আমি তার উচ্ছ্বাস
টের পাচ্ছি । সেই হতভাগ্য অন্ধ বৃদ্ধ
ব্রাক্ষ্মণ আমি । আমার নাম দীর্ঘতমা ।
৪
আশ্রমের কিছুটা দূরে ঝিল আছে । সেই ঝিলের পাশে
ছোট্ট বাগান রয়েছে । সুগন্ধি পুষ্প ঘেরা এক গোপন ডেরা । এখানেই সুদেষ্ণা দেখা
করবার কথা বলেছিল । নাদক আগে থেকে এসে অপেক্ষা করছে । দীর্ঘতমাকে সুস্থ করবার পর ,
বলিরাজার কাছে গুরুত্ব বেড়েছে । বলা যায় বলিরাজ এখন সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে ।
অন্দর মহলে সেই সূত্রেই নিয়ে গিয়েছিল । দুই মাস ধরে সুদেষ্ণার সাথে সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছে ।
তাদের ভিতরকার এই গোপন ব্যাপার দুইজন দাসি
ছাড়া কেউ জানেনা । এরা হল শন্দিনি আর সুলি
। মূলত শূদ্র যুবতি হলেও রূপবতী । সুদেষ্ণার কাছের মানুষ । তাইতো এতো ভরসা করে ।
পায়ের ঘুঙুরের আওয়াজ শুনে , নাদক পিছনে
তাকাতেই সুলি আর শন্দিনিকে দেখতে পেল । সুদেষ্ণা
আসতেই , দু ‘জনেই মুখে হাত রেখে হেসে বেরিয়ে গেল । আজ সুদেষ্ণা খুব সুন্দর সেজেছে । ফুলের সুবাস এই
স্থানকে অভিনন্দিত করছে । নাদকের হাতে , হাত রেখে বলল – সামনে একটা ঝর্ণা রয়েছে ।
আজ একটু ওইদিকে ঘুরে আসি চলো ।
নাদক বলল – তোমাকেতো আবার ফিরতে হবে ।
ওরা দুজনেই উল্টো দিকের ঢালু পথটা ধরে ফেলল ।
সেখান থেকে কিছুক্ষণ হাঁটলেই প্রতিবিম্বের
মতন স্বচ্ছ জল , আকাশ থেকে ঝরছে ; জলের স্রোত কম । স্থির । হাতে নিলে তালুতে ছুঁয়ে
শীতল অনুভূতি হয় । সেই জল সুদেষ্ণা হাতে
তুলে নিল । বলল – আজ একটু জলকেলি করি ।
নাদক আচমকাই এই প্রস্তাবে চমকে উঠল !
-বলিরাজ চলে আসলে ?
-কিচ্ছু হবেনা । উনি বেশ খোস মেজাজে আছেন ।
তোমার অন্ধ বুড়োটাকে নিয়ে শিকারে গিয়েছেন ।
-ছিঃ ওইভাবে বলতে নেই ।
-কারণ আছে ।বলিরাজা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম ।
তাছাড়া চিকিৎসা করলেও তেজদীপ্ত সন্তান পাবেন কিনা সন্দেহ আছে । তাই তোমার গুরুদেবের শরণাপন্ন হয়েছে । ভালোই পারো তোমরা ।
হাঁটু ডোবা জলে নেমে , হরিণীর মতন লাফাতে –লাগাতে সুদেষ্ণা কথা গুলো
বলছিল । তার বুকের স্তন এতটাই পোক্ত যে বক্ষ বন্ধনীতে সে স্থির হয়ে আছে ! বুকের
সরু খাঁজের ভিতর আলো আটকা পড়েছে , একটা কাব্যিক বাক্য মনে হয় ! নাদক দুচোখ ভরে দেখছিল । কেননা এই অভিজ্ঞতা যে
কোন পুরুষের কছেই এক অনন্য ।
নাদককে
ইশারা করল । নাদক জলে নেমেই , সুদেষ্ণার কোমর জড়িয়ে ধরল । মধুকর যেমন করে তীব্র আবেগে মধুভান্ড থেকে মধু শুষে নেয়
; তেমন ভাবেই সুদেষ্ণা ঠোঁট চুষতে
শুরু করল । নাদক জীবনে এই প্রথম নারীর ঠোঁটের স্বাদ পাচ্ছে
! উষ্ণ , উদগ্রীব , চঞ্চল , অকৃপণ ।
নাদকের নিম্মাঙ্গের যে বস্ত্রটি পড়েছে , সেটি খুলে ফেলেছে । সুদেষ্ণা নিজের বক্ষ
বন্ধনীটি খুলে, খুব সাবধানতার সাথে
,পাথরের একপাশে রেখেছে ।
এক সময় দুটি শরীরের উত্তেজনা থেমে যাবে । একসময় সন্ধ্যা হয়ে আসবে । একসময় মন
শূন্যতা আর শরীর , সুখের পরিশ্রান্তি নিয়ে ফিরে যাবে ।
দুটি যুবক –যুবতি নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে । সুদেষ্ণা
উঠে বসল । ফর্সা দেহে , বুকে পিঠে কাদা মেখে গিয়েছে । ঘাড় পেড়িয়ে যাওয়া চুলের গভীর
গোছা হাত দিয়ে ঘাড়ের পিছন থেকে বুকের উপর রাখল । পাশে শুয়ে নাদক । তার শরীরে
রোমাঞ্চ এখনো কাটেনি ! নাদকের দিকে তাকিয়ে,সুদেষ্ণা হাত দিয়ে , বক্ষ বন্ধনী বাঁধতে –বাঁধতে বলল –
আমি কিন্তু তোমার গুরুর সন্তানের মা হতে পারব না। ওই রুগ্ন , কালো আর দুর্গন্ধে ভরে থাকা বৃদ্ধর প্রতি আমার না ভক্তি আসবে না কামনা
। তুমি কিছু করো ।
নাদক
কিছুক্ষণ ভাবল । তারপর বলল – দেখো , বলিরাজা যখন চেয়েছেন , তখন উনি দীর্ঘতমার কাছে
সন্তান নেবেন । আর তোমাকেও দিতে হবে । কিছু একটা ভাবতে হবে ।
-নাদক , আমি তোমার সন্তানের মা হতে চাই । কিছু
একটা ভাবো । আমি ভালোবাসা পেয়েছি । সন্তান পেতে চাই ।
-তাহলে এক কাজ করতে হবে । অন্ধ বৃদ্ধ যখন তোমাকে
সঙ্গমে ডাকবে তখন তুমি সুলি আর শন্দিনিকে
পাঠিয়ে দেবে।
-মুনি অন্ধ হলেও নারী শরীর চিনতে তার ভুল হয়না ।
আমরা ধরা পড়ে যাব !
-না । পরে তোমাকেও একসময় যেতে হবে
। তুমি শুধু আমার দেওয়া শিকড়টা দুধের সাথে বৃদ্ধকে পান করিয়ে দেবে ।
-তাতে কী হবে ?
-বেহুঁশ হয়ে যাবে । বৃদ্ধ বুঝবেনা সেই রাতে , সে
তোমাকে ছুঁলেও সঙ্গম করতে পারেনি । অথচ
আমার সন্তান তোমার গর্ভে থাকবে । বুঝলে......
রাতে সুদেষ্ণা চোখের পাতা এক করতে পারল না। অনেক
রাত অব্দি জেগে ছিল । ঘুম হারানো পাখির মতন ছটফট করছিল , নিজের পালঙ্কের উপর ।
নাদকের প্রতি তার ভালোবাসা মিথ্যা নয় । এই ভালবাসার কোন পরিণাম নেই । সমাজে মেয়েরা শুধুই ব্যবহৃত হয় । কখনো পুরুষের শয্যা সঙ্গিনী হয়ে আনন্দ দিতে হয় । আবার কখনো গোষ্ঠীপতির জন্য উপহার দিতে
হয় সন্তানের । তার বুকে আজ একটা বোঝা চেপে বসেছে । সন্তান তাকে ধারণ করতেই হবে । তাহলে কেন নাদকের সন্তান নয় ?
৫
এক সন্ধ্যায় , নির্জনে বসে আছে নাদক আর দীর্ঘতমা
। অন্ধ ব্রাক্ষ্মণ কান পেতে শুনছিল ,বাসায় ফিরে
চলা পাখিদের কলরব । গাছের কোটরে –কোটরে
প্রাণের যে অস্তিত্ব , তা এই সময় ভালো করে
বোঝা যায় ।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায় ! নাদক এখন , দীর্ঘতমার
খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে । অবশ্য
সুদেষ্ণার সাথে সে যে সম্পর্কে জড়িয়েছে , তা তিন জন বাদে আর কেউ জানেনা । নাদক ভাবছিল সে কি অন্যায় করছে ? তার গুরুর
সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করছে ! বলিরাজ তাকে
এতো বিশ্বাস করে , স্নেহ করে – তবুও , নাদক কেন সুদেষ্ণাকে ভুলতে পারেনা ! নারী
পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য আর অচ্যুত আকর্ষণ !
সে
বহুবার ভেবেছে । তবুও এক সন্ন্যাসী হয়েও কামনা ত্যাগ করতে পারল না।, এই বিদেশ
বিভুইয়ে অন্তত এক জন কেউ আছে , যে তাকে
কঠোর রোদে বট বৃক্ষের ছায়া দেয় ! নির্জনে , লোক চক্ষুর আড়ালে থেকেও , এই ভালোবাসা তাকে তৃপ্তি দিচ্ছে । এই স্থান
ত্যাগ করে হয়ত খুব তাড়াতাড়িই ফিরতে হবে দাক্ষিণাত্যে । সেখানে নিজের নামে এক আশ্রম খুলবে । যেখানে সে
বেদ শিক্ষা দেবে ।
আচমকাই হুঁশ ফিরে এল । ঋষি কাঁধ ধরে বলল – একটু
ওই দিকটা নিয়ে চলো । কথা আছে , আমরা দু’জনেই থাকব।
ওই দিক বলতে , যেখানে বসে রয়েছে সেখান থেকে
তিরিশ পা সামনে হাঁটলেই ছোট্ট নদী রয়েছে ।
নদীকে ঘিরে হাল্কা উদ্যান ।
দীর্ঘতমা শ্যাওলা মাখা পাথরের উপর বসল । পাথুরে ভূমি রাতে ভূমি তাপ ছাড়তে থাকে । চারপাশের মতন পাথরের বুকেও শীতলতা নেমে আসে । বসে সেই উষ্ণতা অনুভূতি হল । বৃদ্ধ ঋষি বলল – প্রিয় নাদক কি
মনে হচ্ছে , আমি যদি কিছু গোপন কথা তোমাকে বলি তবে তা রাজমহল পর্যন্ত ভেসে যাবে ?
নাদক আকাশ থেকে , ভূতলে পতিত হওয়ার মতন মুখ করে রইল
। এখন আকাশের মাঝখানে গোল
সাদা চাঁদ উঠেছে । পৃথিবী ঠাণ্ডা হয়ে আসছে ।
ঠাণ্ডা পৃথিবী খুব মনোরম হয়ে ওঠে । সাদা জ্যোৎস্নার আলোয় নদীর চর ভিজে
গিয়েছে । নদীর পাড়ে হাল্কা –হাল্কা ঘাস , সেই আলোয় সিক্ত হয়ে আছে । এখন রাজমহলে
উৎসব চলছে।বলিরাজ তার জনপদ গুলোর জন্য , সম্ভবত পুত্র সন্তান পেয়ে যাবে । তারাই
শাসন করবে । তাদের হাত ধরেই শুরু হবে আর্যভূমি
নির্মানের কাজ । এটা একটা
প্রস্তুতি পর্ব । সূচনা হয়ে গিয়েছে ।
নাদক বলল – প্রভু , এই স্থান শত্রুদের জন্য
নিরাপদ । আমরাতো বলিরাজার মিত্র । আপনি বলুন ।
দীর্ঘতমা – আশ্রমে আমার এই অপারগতা প্রকাশ করাটা
বিপদজনক হয়ে যেত । সত্যি বলতে তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি । তাই আমার জীবনের দু’টো
ঘটনাই হুবহু বলেছি । রাজা এই ঘটনার অন্য রুপ জানে ।
নাদক মাথা নিচু করে বলল – বলিরাজ আমায় বলেছেন ।
আপনি সেখানে সব দোষটাই আপনার পিতা বৃহস্পতি আর আপনার পত্নির উপর দিয়েছেন ।
নাদক দেখল , বৃদ্ধের মুখ চাঁদের আলোতেও বিন্দুমাত্র
প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে না ! বরং আগের থেকে শুকনো মনে হয় । খালি গায়ে , বুকের
সরু ছাতি ভরা সাদা পশম , গাল ভরা সাদা দাড়ি । মাথার জটা শুকনো । পৃথিবীর সবচেয়ে
করুণ গুহামানব বলে মনে হচ্ছে ।
মানুষটিকে দেখে দয়া হয় । নাদক হাঁটু ভাঁজ করে ,
পায়ের কাছে , শুকনো হলদেটে ঘাসের উপর বসল
।
-আপনি বলুন । আমি শুনেছি আপনি রাজাকে শুনিয়েছেন
, আপনার পত্নী আর সন্তান , সম্পত্তির লোভে আপনাকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছে । এটাতো সত্যি
।তাই আপনি অনুশোচনা কেন করছেন ! আপনি মিথ্যা কিছু বলেননি ।
দীর্ঘতমা হাসল । - সত্যি
। তবে অর্ধেক সত্যি । কেননা , আমি আমার পত্নী , সন্তানদের প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন
করতে পারনি । আমি বলব , আমার অসংযমী যৌনতাই এর কারণ । তারা আমাকে বোঝা ভেবেই
বয়ে নিয়ে চলছিল।একদিন ছন্দপতন ঘটল । তুমি
কি বলতে পারো সম্পূর্ণ ভাবে ওরাই দায়ি ? -
এই প্রশ্নের পিছনে যুক্তি আছে । নাদক বলল – তা
নয় । তবে...
-পুত্র , অত ইতস্তত করছ কেন ? আসল কথা হচ্ছে
বলিরাজার কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরবার জন্যই আমাকে ঘটনাটা ঘুরিয়ে দিতে
হয়েছিল । সব কিছুই বলবার উপর নির্ভর করছে । এইবার আমার এই কথা গুলো বলবার পিছনে যে
কারন আছে , তা মন দিয়ে শোন ।
টিলাটার কিছুটা দূরে অনবরত বহমান নদীর শব্দ ,
কানে আছাড় খাচ্ছে । মনে হয় কোন বিদুষী চুড়ি পড়া হাতে , চাল বাছবার মতন নদীর
জলে জ্যোৎস্না খুঁজছে ; প্রতিধ্বনিত শব্দ
পাথুরে পরিবেশে । সেই শব্দই কানে অনুরণিত হয়ে চলেছে ।
নাদক শুনছে । সামনে বসে ঋষি দীর্ঘতমা ।চোখের দিকে তাকিয়ে আছে , দৃষ্টিতে এখন আর কোন
দূরদর্শিতা নেই । নাদক বলল – আপনি বলুন , আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন । আমি
আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখব ।
ঋষি বলতে শুরু করল – বলিরাজা নিজে সন্তান
উৎপাদনে অপারগ । আমরা যখন শিকারে গিয়েছিলাম তাঁকে সেই সত্য জানিয়ে দিলাম । প্রথমে
সে ভেবেছিল চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠবে ।
পরবর্তী সময়ে বুঝতে পারে সম্ভব নয় । তখনই আমার কাছে ছুটে আসে । সুরাহার জন্য ।
আবার বলতে পারো আমাকে এত যত্ন নিয়ে সুস্থ করবার পিছনে এটাই প্রধান উদ্দেশ্য । আমি যেন
তাকে উপযুক্ত বংশধর দিতে পারি । আমরা যখন এক সাথে শিকারে গেলাম , একান্তে পুত্র
সন্তান চাইলেন । নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে ।
নাদক বলল – সে নয় বুঝলাম । কিন্তু আপনি আমাকে এত কিছু বলছেন কেন ? প্রভু
, আপনি আর আমি , আমরা জানি ভবিষ্যতে আর্য
ভূমি রক্ষার জন্য গোষ্ঠী
পতির চাহিদা দেখা দেবে । ক্ষত্রিয়রা নিজেদের জন্যই আমাদের খাতির
করছে । একমাত্র আমরাই পারি ওদের বংশধরের চাহিদা পূরণ করতে । বলিরাজা যে জনপদ গুলো
দখল করেছেন , সেখানকার প্রজাদের বিদ্রোহ দমনের জন্য অন্তত তাঁকে
বংশধরের ভয় দেখাতেই হবে । রাজা তাই হয়ত এতটা
উদগ্রীব ।
দীর্ঘতমা হাসতে –হাসতে বলল
– এখানে সন্তান উৎপাদন এক বৃহৎ বিষয় । আমরা যদি ক্ষত্রিয়দের সন্তান না দিতে
পারি , ওরাও বা আমাদের তোষামোদ করবে কেন ? পুত্র তাহলে তোমায় খুলেই বলছি ।
নাদকের চোখে উদ্বিগ্নতা ধরা পড়ছে । সে বলল – আপনি আমায় বলতে পারেন । আমি আপনার শিষ্যত্ব
গ্রহণ করেছি । আপনার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম । ঘুণাক্ষরে কেউ টের পাবে না।
দীর্ঘতমা – বয়সের ভার আর পর্যায়ক্রমে দীর্ঘ যৌন জীবন ভোগ করবার পর , বর্তমানে আমার আর সেই
শক্তি অবশিষ্ট নেই , যা দিয়ে আমি এক যুবতির জরায়ুতে বীজ বপন করতে পারি । সন্তান দিতে আমি
অপারগ । তাই অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের একটা
চাল চালতে হবে ।
চারপাশে রাতের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে ।
এমন সবুজ ঘাসে মোড়া চারণভূমি দিয়ে , ঠাণ্ডা রক্তের প্রাণী বুকে ভর দিয়ে , এগিয়ে
চলেছে হয়ত! রাতজাগা পাখিরা কান পেতেছে । নাদকের বুক কাঁপছিল ।
নাদক বলল – আপনি বলুন
দীর্ঘতমা –
নাদক , বলিরাজ কাল সকালে আশ্রমে তার পত্নীকে নিয়ে আসবে । তোমাকে সেই
যুবতিকে রাজি করাতে হবে , যেই রাতে আমার কাছে সঙ্গম করবার জন্য আসবে ; তুমি আমার
জায়গায় থাকবে ।
নাদক এমন প্রস্তাবে কেঁপে গেল !- হে আর্য
শ্রেষ্ঠ , বলিরাজ আমাদের এই প্রবঞ্চনা
জানতে পারলে মেরে ফেলবে !
-সে জানতে পারলে তবে ! সুদেষ্ণা নিজের মুখে এই
প্রস্তাবে হ্যাঁ করবেনা । তবে রাজি হবে । কেননা আমার মতন কুৎসিত বুড়ো থেকে তোমার মতন সুন্দর বিপ্রের
সঙ্গ তার কাছে বেশি উপভোগ্য । বলতে পারো সুদেষ্ণা নিজে এই প্রস্তাব বিনা বাক্যে মেনে
নেবেই । তার কাছেও এর চেয়ে ভাল বিকল্প নেই ।
নাদক এই মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়েছে । বলল – এর
পর...
দীর্ঘতমা
বলল – তুমি সুদেষ্ণাকে বোঝাবে প্রথম রাতে যেন ওর দাসীদের আমার কাছে পাঠায় । আমি
চেষ্টা করে দেখব । তারপর বলিরাজাকে বলব ,
তার পত্নী আমাকে ঠকিয়েছে । তাই পুনরায় তাকে প্রেরণ করতে । তুমি বাকি কাজটা করবে ।
আশা রাখছি তোমার বীর্যে আমরা এক
শক্তিশালী গোষ্ঠীপতির মুখ দেখব । বলিরাজাও উত্তরাধিকারী
পাবেন...
নাদক ভাবছিল , যাক তাকে আর কষ্ট করতে হল না।
নিজের বিবেকের কাছে গুরু প্রবঞ্চনার দায় নিতে হবেনা ।
আর্যভূমির ইতিহাস খুবই বিচিত্র
! এই ইতিহাসে জন্ম পরিচয় খুঁজতে যাওয়া আর অন্ধকারে সূঁচ খুঁজবার
ঝামেলা একই রকমের ।
নাদকের চোখ দুটো - দূরে নদীর দিকে , নিস্তরঙ্গ স্রোতে আলোর খেলা দেখছে !
কবিতা
রোশনাই
শ্রী কল্যাণ
প্রজ্জ্বলিত আলো! লুন্ঠনে অবজ্ঞা, আজ্ঞাবহ
তমনিশী- কালের আবহ।
'চুরাশী লক্ষ যোনী- দ্বার খুলে দে- খুলে দে দ্বার'
ভূমিষ্ঠর পথে গর্ভাশয়েই জীবন পরিসমাপ্ত
মৃত্যু- কামনা করিস কেন?
নির্দিষ্ট যা তারও কামনা প্রয়োজন,
কামনার মায়াজালে কেন আয়নায় মুখ ঢাকি,
লিপিবদ্ধ মূচনায় ভুল নিজেরই,
খেয়াল খুশীই পূর্ণগঠনে যেন
সীমাবদ্ধতার অসীম অবতল।
শারদীয়া
দেবপ্রিয়া সরকার
শরতের অরুণিম প্রভাতে
শুভ্র কাশ আর শিউলি ঘ্রাণের মৌতাতে,
বেজেছিল সুর আগমনীর
খুলেছিল দ্বার আনন্দ সরণির!
বিচ্ছুরিত হয়েছিল মুক্তির আলো
ঢাকা পরেছিল আনাচে কানেচে
জমে থাকা ব্যাধি, লুকানো যত কালো।
ন্যুব্জ হল ক্রূরতা, ধ্বনিত হল শক্তির জয়গাথা!
তারপর এল বিষাদের বিজয়া
ফিরে এল একে একে
মুখোশের আড়াল থেকে
নৃশংস, লোভাতুর, ভন্ড ধার্মিকের কায়া!
মৃন্ময়ী তো তখন বিসর্জিতা
রয়েগেছে নদীতটে শুধু
ভাসমান কাঠামোটা!!
পাগললের দেওয়া-নেওয়া
প্রতীক কুমার ভৌমিক
আমাকে
তুমি দিয়েই চলেছ, দিয়েছ অনেক কিছুই বটে
আর
আমিও তো নিয়েই যাচ্ছি খালি
সদারিক্ত চৈতণ্যের তটে
সবই
যে আপন ইচ্ছায় পাচ্ছি, তা কিন্তু
কখনোই নয়
হয়
প্রারব্ধ, নয় নিয়তি, নতুবা কর্মফলের নামেতেই
সব রয়
শুধুই তো পেয়েই চলেছি কত, স্মারক সহ নাম-সুনাম-বদনাম
এমনও আছে কিছু যা জোর দিয়ে জয় করে নিয়ে, দিয়েছি বদহজমের দাম
আবার প্রতিশ্রুতিতে দেখানো স্বপ্নের ভেলা নিয়ে বন্যায় ভেসে,
না পাওয়া ব্যথার সাথের
না
পাওয়ার পাওয়াকেই একাত্ম করে, সহবাস করে চলেছি একান্তের রাতে
উপরন্তু
তুমিও যা দিচ্ছ ভরে ভরে –
তাইবা
সহ্য করতে পারছি কই সবার তরে!
আপন
ইচ্ছায় যাই চাই ভরিয়ে মনের কূল
তাই
তে পাই আমি-র সবাই, সবেতেই শুধু ভুল
বেদনার
পেছন থেকে আঘাতের ঢিল ছুড়ে আনন্দ লুকিয়ে হাসে
জানিনা
তবুও ছুটছি কোন আনন্দেরই নাগপাশে
এত
কিছু দেওয়ার পালায়, নেওয়ার খেলাও চলছে জ্বালায়
উৎসর্গ করছি কারে, সমর্পণের বিষম ঠ্যালায়!
নিংড়ে
আত্মশক্তির ঊর্জা যত্তো
সবই
কি তবে ফ্যালনা বৃথা, পাগলের খেলায় মর্তে
মত্ত।
বাঁচার উৎসব
পিয়াংকী মুখার্জী
শত-লক্ষ-কোটি যোজন দূরে উৎসবের আলোকবর্ষ ,
এক আলোকবর্ষের ও দূরে জীবন মৃত্যুর সংঘর্ষ !
প্রেম-ভালবাসা-বৈভব চাইনি আমি , জীবন-যুদ্ধ চেয়েছিলাম............
উত্সবের আলোর রোশনাই আমায় ফিরিয়ে দিলো শত-সহস্রাব্দ দর্শনার্থীর ভীড়ের পেছনে !!
আমি তো তোমাদের সাথে এক আসনে স্থান চাইনি ,
তবুও কেন আনন্দ-যজ্ঞে আমায়,
মায়ের পঞ্চপ্রদীপের তাতটা পেতে দিলে না ?
তোমাদের শারদীয়া-দীপাবলী শ্বেতমেঘা শরতের নীলাকাশ ,
শপিংমলে টাকা ওড়ানোর নতুন অবকাশ...
আমার তিনশো-পয়ষট্টি....
হঠাত্ আসা বৃষ্টি ভেজা পিছল নিশুতি রাস্তায় একাকী কেঁদে মরে ,,,
রক্তমাংস খুবলে খাওয়া নর-জন্তুদের ভীতির তাড়নায় !!
সন্ধ্যারতির একশো-আট প্রদীপ্তী, সন্ধিপুজোর ধুনোর গন্ধে ম ম করা বাতাস ,,,
চতুর্দশী-অমাবস্যার চোদ্দ-বাতি আর আলোক সজ্জায় যখন গয়না পরে তোমাদের মণ্ডপ ,,,
আমার কুঁড়েঘরে তখন ঝাঁঝড়া হয় আঁধারের কোলে দেবতার আসন !!
আমি জীবন বাজি রেখে খেলা দেখাই ঋতুমতী হই দাঁড়িয়ে ব্যলান্স দড়ির ওপর !!
এভাবেই লীন হয়......
আমার রংয়ের পাহাড় ,,,
ছেঁড়া কাপড়ের ভাঁজে লেপ্টে থাকে যন্ত্রণা-গানের হাহাকার ,,,
বেঁচে থাকি ,করি সংহার ,,,
দৃশ্যমান হয় তোমাদের থিমের পুজোর অগোছালো উপহার ,,,
ব্যথার নোনতা জলে চেখে নিই আলোর শামিয়ানায় একটুকরো অন্ধকার !!
এভাবেই........
জীবনকে মাতৃত্বের ছোঁয়ায় আদর করি , প্রতিদিন স্বাদ নিই যুদ্ধজয়ের ,,,
তোমাদের আনন্দ ,কেবল উত্সবের দিনকটার ,
আমার উত্সারিত আলো তিনশো-পয়ষট্টির প্রতি ভোরবেলার !!!
আমার দীপাবলি
অনিমেষ সরকার
আমার দীপাবলি হাজার আলোর রোশনাই,
আমার দীপাবলি অন্ধকারে পাপের বিনাশকারী,
আমার দীপাবলি ঘরছারাদের ঘরে ফেরার পথ,
আমার দীপাবলি ,
হাজার আলোর ঝলকানিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে পুর্বপুরুষদের স্মরন ,
আগামীর শক্তি জোগান,
নতুন সকালের ডাক৷৷
আমার দীপাবলি আমার ধর্ষিত বোনের বিচার,
মনের কোনে জমে থাকা পুরোনো অভিমান,
ধুয়ে মুছে একসঙ্গে থাকার অঙ্গীকার৷
এক পুত্রের পিতাকে ফিরে পাওয়া,
এক ইভটিজারের শাস্তি৷৷
নতুন সময়ের সুচনা ,
নতুন প্রেমের বীদির্নতা ,
কন্ঠে আসা শ্যামাসঙ্গীত,
একসঙ্গে কস্টমোচন৷৷
আমার দীপাবলি মায়ের চরন ছোয়া,
তর্কে বিতর্কে জিতে যাওয়া৷
দীপাবলির শুভ সুচনা মনকে ,
গভীর ভাবে নারিয়ে যাওয়া৷৷
আমার দীপাবলি তোমার আমার ,
ব্যার্থ প্রেমের স্মৃতিচারন করা,
আমার দীপাবলি আগামীর পথ দেখানো৷
রক্তে মাংসের মানুষের নতুন আশা,
নিজেকে প্রকাশ করার শেষ ভাষা৷৷
আমার দীপাবলি হাজার আলোর রোশনাই ,
না খেয়ে থাকা শিশুর মুখে অন্ন ,
ফুতপাতে শুয়ে থাকা মানুষের বস্ত্র,
বৃদ্ধ মা বাবাকে অজস্র প্রনাম৷
আমার দীপাবলি তে সবার মঙ্গলে তাই,
প্রতিবার লহকোটি দ্বীপ জ্বেলে যাই ৷৷
আমার দীপাবলি অন্ধকারে পাপের বিনাশকারী,
আমার দীপাবলি ঘরছারাদের ঘরে ফেরার পথ,
আমার দীপাবলি ,
হাজার আলোর ঝলকানিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে পুর্বপুরুষদের স্মরন ,
আগামীর শক্তি জোগান,
নতুন সকালের ডাক৷৷
আমার দীপাবলি আমার ধর্ষিত বোনের বিচার,
মনের কোনে জমে থাকা পুরোনো অভিমান,
ধুয়ে মুছে একসঙ্গে থাকার অঙ্গীকার৷
এক পুত্রের পিতাকে ফিরে পাওয়া,
এক ইভটিজারের শাস্তি৷৷
নতুন সময়ের সুচনা ,
নতুন প্রেমের বীদির্নতা ,
কন্ঠে আসা শ্যামাসঙ্গীত,
একসঙ্গে কস্টমোচন৷৷
আমার দীপাবলি মায়ের চরন ছোয়া,
তর্কে বিতর্কে জিতে যাওয়া৷
দীপাবলির শুভ সুচনা মনকে ,
গভীর ভাবে নারিয়ে যাওয়া৷৷
আমার দীপাবলি তোমার আমার ,
ব্যার্থ প্রেমের স্মৃতিচারন করা,
আমার দীপাবলি আগামীর পথ দেখানো৷
রক্তে মাংসের মানুষের নতুন আশা,
নিজেকে প্রকাশ করার শেষ ভাষা৷৷
আমার দীপাবলি হাজার আলোর রোশনাই ,
না খেয়ে থাকা শিশুর মুখে অন্ন ,
ফুতপাতে শুয়ে থাকা মানুষের বস্ত্র,
বৃদ্ধ মা বাবাকে অজস্র প্রনাম৷
আমার দীপাবলি তে সবার মঙ্গলে তাই,
প্রতিবার লহকোটি দ্বীপ জ্বেলে যাই ৷৷
উৎসব
সুকন্যা সামন্ত
আনন্দময়ীর আগমনে ,
উৎসব লেগেছে ভুবনে
–
ঘরে ঘরে জ্বলিছে বাতি ,
বালক বালিকারা –
করে সবে মাতামাতি
,
ব্যবসায়ীরা সাজায়ে পসরা –
করিছে বিকিকিনি ,
সকলের মুখে আজ -
ফুটেছে হাসি -
প্রস্ফুটিত কুসুম সম
।
ভায়ে ভায়ে বিভেদ ভুলে,
করিছে আলিঙ্গন ।
মায়ের চোখে ঝরিছে স্নেহ –
হেরিয়া ভাতৃপ্রীতি ।
ভাই বোনে হয়েছে মিলন,
উৎসবের এই আনন্দে ।
আনন্দধারা তাই বহিছে
ভুবনে ,
ভুবনবাসী হয়েছে ধন্য ,
হেরিয়া বিশ্বজননীর –
মধুর হাসি ।।
আলোময়
দেবযানী সিনহা্
ভোরের শিশিরসিক্ত শিউলি
আজ হাসছে কেবলি।
রোদ্দুর গায়ে কালোমেয়ে,
সেজেছে লাল রঙে।
উষ্ণ দুপুর বেলা
আশ্বিনের ঝড় করছে খেলা।
সন্ধ্যা নেমেছে ধানের খেতে,
অমানিশি ভাসবে আলোর স্রোতে।
আলোর বন্যা ধারা,
এ ধরনীর স্নানোৎসব হবে সারা।
শ্যামা মায়ের আবাহনে,
মিলেছি আজ একই সনে।
পদ্ম, জবা, নীলকন্ঠ দলে দলে,
ঠাঁই পেয়েছে মায়ের চরনতলে।
আলো মিশেছে আলোর ঝর্নায়,
জোনাকি আর প্রদিপ মেতেছে লুকোচুরি খেলায়।
নিস্তব্ধ রাত আর থাকবেনা কালো,
মাগো তুমি সবাইকে রেখো ভালো।
ভোরের শিশিরসিক্ত শিউলি
আজ হাসছে কেবলি।
রোদ্দুর গায়ে কালোমেয়ে,
সেজেছে লাল রঙে।
উষ্ণ দুপুর বেলা
আশ্বিনের ঝড় করছে খেলা।
সন্ধ্যা নেমেছে ধানের খেতে,
অমানিশি ভাসবে আলোর স্রোতে।
আলোর বন্যা ধারা,
এ ধরনীর স্নানোৎসব হবে সারা।
শ্যামা মায়ের আবাহনে,
মিলেছি আজ একই সনে।
পদ্ম, জবা, নীলকন্ঠ দলে দলে,
ঠাঁই পেয়েছে মায়ের চরনতলে।
আলো মিশেছে আলোর ঝর্নায়,
জোনাকি আর প্রদিপ মেতেছে লুকোচুরি খেলায়।
নিস্তব্ধ রাত আর থাকবেনা কালো,
মাগো তুমি সবাইকে রেখো ভালো।
শূন্যতার রং
অনিন্দিতা চক্রবর্তী
দীপান্বিতা আলোয় যখন
ভিজছে গোটা শহর
অমানিশা আমার একা
অতীত গোনে প্রহর
আলোয় রঙীন দিনগুলো সব
কবেই মুছে গেছে
সাদা কালো জীবন আমার
সীমন্তীনি মাঝে
একদিন তো সত্যিই ছিল
রং মশালি সুর
তোমার জীবন নিভিয়ে দিল
জীবণ সমুদ্দুর
আজকে যখন সবার মনে
উৎসব আনে আলো
অমাবশ্যার গহীন থেকেও
আমার জীবন কালো।।
No comments:
Post a Comment