Wednesday, October 18, 2017

ডাবল ডেকার
ঋতভাষ রায়

                                ডাবল ডেকার....ছোটবেলা থেকে বাসের সাথেই কথাটির ব্যবহার শুনে এসেছি। না, এবার বাস ছাড়াও অন্য একটি অদ্ভুত বস্তুর সাথে যে এই শব্দের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তার প্রমাণ হাতেনাতেই পেলাম।
                                 পুজোর জাঁকজমকময় দিনগুলোর শেষে আপামর মধ্যবিত্ত ন্যায় বার্ষিক ভ্রমণ পর্ব সম্পন্ন করার জন্য ভাড়ার গাড়ি চেপে বাবা মা এবং আমি হাজির হলাম খাসি পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত ছোট্ট শহর চেরাপুঞ্জিতে যার স্থানীয় নাম 'সোহরা' (SOHRA)। সেখানে দু'দিনের আস্তানা। হোটেলের সুবিনয়ী ম্যানেজারের কাছেই খোঁজ পেলাম এই ডাবল ডেকারের। কি এই জিনিস? না, এ আর কিছুই নয়- সেতু। সেতু? তা শুধু সেতুর এত সুনাম কেন? সেতুটি শেকড় দিয়ে তৈরী। শেকড়? হ্যাঁ, গাছের শেকড় এবং স্বাভাবিকভাবেই তৈরী। সেতুটি আবার দোতলা। অর্থাৎ ডাবল ডেকার। প্রকৃতির এই আশ্চর্যের প্রতি টান অনুভব করলাম এবারে। ভদ্রলোকের মুখেই জানতে পারলাম, শহর থেকে আধঘন্টার রাস্তা পরিয়ে 'টিরনা' (TYRNA) গ্রাম। সেখান থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে নেমে গেছে সাড়ে তিন হাজার সিঁড়ি। সিঁড়ির শেষে দেখতে পাওয়া যাবে এই সেতুটিকে। কিন্তু পথ বড়ই দুর্গম এবং সময়সাপেক্ষ। অতএব যাত্রার তোড়জোর শুরু হ'ল। পরদিন ভোর ছ'টায়  সকালের তীব্র রোদ গায়ে মেখে টিরনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হ'ল। শহর থেকে খানিকটা বের হতেই পাহাড়ের সর্পিল রাস্তায় এঁকেবেঁকে চলতে লাগল গাড়ি। পথের দু'ধারে খাড়া পাহাড় এবং তা বেয়েই নেমে এসেছে ফার্ণ জাতীয় নানা গোছের উদ্ভিদ। বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা হওয়ার দরুণ স্যাঁতসেতে পরিবেশ বিরাজমান। ছোট পাহাড়ী ঝরণার প্রাচুর্যও লক্ষ্য করা যায়। কিছু জায়গায় সূর্যের আলোর অভাবে গা ছমছমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। যেন কোন শিকারীর আখ্যান থেকে তুলে নেওয়া এক খন্ডচিত্র। কিছু সময় বাদেই চড়াই উৎরাই শেষ হল। টিরনায় প্রবেশ করলাম। দিকনির্দেশ নেওয়ার জন্য গাড়ি থামাতেই স্থানীয় খাসি উপজাতির কিছু মানুষ এগিয়ে এলেন। তাদের মধ্যে একজন ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, 'স্যার... গাইড...রুট ব্রিজ।' আমরা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম গাড়ি রাখবার জায়গার কথা। তাদের নির্দেশানুসারে কিছুটা নেমে পাওয়া গেল সেই জায়গা। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি সেই লোকটি। কখন পাহাড় বেয়ে চলে এসেছেন কে জানে।।আবার একইভাবে জিজ্ঞাসা করলেন গাইডের কথা। সরকারের নির্ধারিত ছ'শ টাকাতেই রাজী হলাম আমরা তাকে গাইড হিসেবে নিতে। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন তিনি এবং নিয়ে আসবেন। ইতিমধ্যে অপর এক স্থানীয় ভদ্রলোক এসে হাতে ধরিয়ে দিলেন বাঁশের লাঠি এবং আকারে ইঙ্গিতে বোঝালেন যে পাহাড় চড়তে নামতে খুব কাজে লাগবে এই লাঠি। অতঃপর দেরী না করে আমরা রওনা দিলাম। আমরা বলতে আমি, বাবা আর সেই গাইড। মা হাঁটু ব্যথা এবং ড্রাইভারকাকু রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার ভয়ে ওপরেই অবস্থান করবার সংকল্প করল। সবার আগে গাইড, তারপর বাবা, শেষে আমি। শুরু হল নামা। অতি মনোযোগ দিয়ে নামতে নামতেই কানে এলো গাইড এবং বাবার কথোপকথন। ভদ্রলোকের নাম শানবর। টিরনা গ্রামেই বসবাস। টি-শার্টের ওপর জ্যাকেট পড়া পাহাড়ী লোকটি ছোটখাটো হলেও বেশ শক্তপোক্ত চেহারায়। তার নির্দেশনায় চলতে লাগলো সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামা। 
                                    পথের দু'ধারে ছোট ছোট ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। তাতে একটি দু'টি দোকান এবং কিছু ঘর, লোকের বাস। কিছু সময় বাদে গ্রাম শেষ হতেই সিঁড়ির ধাপ যেমন খাড়া হল তেমনি দেখা গেল ঘোর জঙ্গল। পাশের রেলিঙ ধরে নামতে নামতে দেখা গেল স্থানীয় আরও কিছু মানুষকে। পথের ধারে পাথরের চাতালে বসে আমেজ সহকারে পাইপে টান দিচ্ছেন তারা। সিঁড়ি খাড়া হয়ে এঁকেবেঁকে নীচে নেমে যাচ্ছে। সাথে নামছি আমরাও। কিছু জায়গায় ধাপ ভাঙাচোরা। পা হড়কে পড়ে যাওয়া কিছু অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রবল মনোসংযোগের প্রয়োজন। সিঁড়ি ভেঙে নেমে উপস্থিত হলাম একটি ঝুলন্ত সেতুর কাছে। নীচ দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ী এক নদী। ছোট কিন্তু প্রবল স্রোতস্বিনী। তারই ওপর দিয়ে ঝুলতে ঝুলতে হৃৎপিন্ডের ব্যাপক চলাচল অনুভব ক'রে ওপারে পৌঁছলাম। কিছুটা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হ'ল আবার। চারধারে সবুজ চাদরে ঢাকা পাহাড়। রোদ প'ড়ে যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে গেছে সেই শোভা। জঙ্গলের মধ্যে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা আলোই পথ দেখিয়ে নিয় চলল আমাদের। কিছুক্ষণ চলবার পর দেখা গেল কিছু বাড়িঘর। গাইড ভদ্রলোকের মুখে শুনলাম পৌঁছে গেছি আমরা। ঘর্মাক্ত কলেবর এবং হাঁপানির শিকার হলেও নতুন উদ্যম এলো মনে। হেঁটে চললাম।
হঠাৎই চোখে পড়লো ছায়াবৃত এক  স্থান। নীচ দিয়ে বয়ে গেছে এক পাহাড়ী ঝর্ণা। তারই ওপরে দুটি পাহাড়ের ঢালকে সংযুক্ত করেছে শিকড়সেতু। একটি নীচে এবং একটি ওপরে। একটি গাছ থেকে অনেক শিকড় বেরিয়ে সমকোণে ঘুরে সোজা চলে গিয়ে জড়িয়েছে একই রকমভাবে বেরোনো অপর একটি গাছের শিকড়কে। এভাবেই তৈরী হয়েছে সেই সেতু। দু'শো বছরের পুরোন এই সেতুদ্বয় প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী। মানুষের হাত পড়ে নি তাতে। প্রকৃতির কোন্ জাদুকরের কোন্ অলীক মন্ত্রে যে এই সেতুর সৃষ্টি তা আজও অজানা। মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে দেখতে দেখতেই উঠে গেলাম সেতুর ওপরে। শিকড় নির্মিত হলেও বেশ শক্ত। নীচের ঝরণাটিও বেশ মনোরম। গাইড বললেন তাতে স্নানও করা যায়। কিন্তু কিছু ছোট মাছের কামড়ানোর উপদ্রবও আছে। ঝিঁ ঝিঁর ডাকে মত্ত এলাকাটি বহির্জগতের কলরব থেকে বিরত। প্রকৃতির রহস্য অনুসন্ধানী ব্যক্তির কাছে অতিব আকর্ষণীয়ও বটে। প্রাণ ভরে সেই পরিবেশ উপভোগ করলাম বেশ কিছুক্ষণ। ফেরার পালা এলো। 





                        শুরু হল সিঁড়ি বেয়ে পাহাড় চড়া। নীচে নামার সময় যে কষ্টটা টের পাই নি তা এবার হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। কয়েক ধাপ সিঁড়ি চড়বার পরেই হাঁপাতে লাগলাম। ঝরতে লাগল ঘাম। যে বাঁশীর লাঠি এতোক্ষণ অব্যবহৃত ছিল তা এবার পরম বন্ধু হয়ে দাঁড়ালো। ওপরে ওঠবার সাথে সাথে বাড়তে লাগলো হাঁফানি। সিঁড়ির ধাপ, পথৃর ধারে জঙ্গলের মধ্যে থাকা পাথর সবই প্রবল আরামদায়ক বসবার স্থানে পরিণত হল। খাঁড়া সিঁড়ির শেষে দেখা গেল এক গ্রাম্য ছোট্ট দোকান। সেখানে বিশ্রাম নিয়ে জলে গ্লুকোজ মিশিয়ে খেয়ে আবার রওনা হলাম আমরা। ঘামে আমার আর বাবার জামা যখন চুপচুপে তখন অবাক করা ব্যাপার হিসেবে নজরে এলো গাইড কাকুর শুকনো জামাকাপড়। জিজ্ঞেস করতেই বললেন তাকে প্রতিদিনই প্রায় দু'তিনবার এভাবে যাতায়াত করতে হয়। বিস্মিত মনে ভাবতে লাগলাম, সামান্য অর্থ উপার্জনের জন্য হাড়ভাঙ্গা এই খাটুনি করে কিভাবে জীবন চলে যায় এই মানুষদের। পান্ডববর্জিত এই জায়গায় বসবাস করে অল্পেতেই খুশী তারা। ঠোঁটের কোণে তাই হাসি লেগে থাকে সবসময়। অথচ সব পেয়েও মন খুলে হাসতে পারি না আমরা। জীবন অতিবাহিত করবার কষ্ট না জেনেই সামান্য "ভাল আছি" বলতেও দ্বিধাবোধ হয়। 
এসব ভাবতে ভাবতেই ওপরে উঠে এলাম আমরা। পায়ের পেশী হাল ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। মায়ের কাছে যাত্রার বর্ণনা দিতে দিতে ছোট একটি দোকানে ধূমায়িত লাল চা এবং ম্যাগি নুডলস স্যূপ খেতে বসলাম। ঘামে ভেজা জামা ছেড়ে খালি গায়ে থাকা সত্ত্বেও যাত্রার ক্লান্তির চোটে ঠান্ডা লাগছিল না। হৃৎপিন্ডের তীব্র চলাচল তখনও কমে নি। কিন্তু বেলা বেড়ে যাচ্ছিল। অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখা তখনও বাকি। তাই, খাবার শেষ করেই গাড়িতে উঠে বসা হল আবার। গাইড ভদ্রলোক সবার সাথে করমর্দন করে ফিরে চললেন গ্রামে। ধোঁওয়া উড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। চোখে লেগে রইল শুধু পাহাড়ী সেই পথ আর কানে গাইড কাকুর  খাসি ভাষায় বলা- ধন্যবাদ "খুবলেই সিবুন"!

ছবি- শৌভিক রায়

No comments:

Post a Comment