।। লকডাউন আর আমি- ৮ ।।
কথোপকথন- ৩
শৌভিক রায়
- স্যার...ও স্যার... আছেন নাকি?
- কে?
- আমি ভার্চু স্যার। বলছি আসব?
- এসেই তো পড়েছিস। আবার পারমিশান চাইছিস কেন?
- হে হে...জাতীয় অভ্যেস স্যার। সবটাই করে ফেলি কিন্তু তবু লোক দেখানো অনুমতি চাই!
- এটা জাতীয় অভ্যেস?
- আলবৎ স্যার। বিশেষ করে বাঙালির...
- বাব্বা...একেবারে জাতে চলে গেলি! তাও নিজে যে জাত বিলঙ করিস তাতে!
- আসলে স্যার বাঙালির মতো ধ্যাষ্টামো তো কমই করে অন্যেরা...তাই বাঙালির কথাই বলি।
- থুতু ওপরে ছিটোলে নিজের গায়েই পড়ে কিন্তু ভার্চু!
- জানি স্যার। তাও বলছি। তা বাবামশাই...
- বাবামশাই? সেটা আবার কি রে?
- আপনাকে বলছি স্যার।
- আমাকে বাবামশাই বলছিস কেন?
- আহা...আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ...মাতব্বর মানুষ। আমার বাপের বয়সী। তাই...
- তাই বলে আমাকে বাবাঠাকুর বলবি?
- রাগ করেন কেন? পক্ষকাল চলছে তো...এখন এরকমই বলতে হয়।
- পক্ষকাল? মানে?
- রবিপক্ষকাল। বুঝলেন না?
- ওহহহ...তা তার সঙ্গে বাবামশাইয়ের সম্পর্কটা কোথায়?
- দেখুন স্যার...সময়কালে সময়েরটা করতে হয়। তাই বাবামশাই...
- বুঝিয়ে বল।
- যেমন দেখুন স্যার...আজকাল বসন্তে হোলি মানে ছেলেদের হলুদ পাঞ্জাবি, মেয়েদের ওরকমই শাড়ি। প্রথমদিন নেচে নেচে রবি ঠাকুরের গানের সঙ্গে এট্টু আবির আমার এই গালে আর আপনার ওই গালে! পরদিন সকাল থেকে ঋষি চার্বাকের দর্শন মেনে যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেতের পাল্লায় সক্কাল থেকেই আউট! তারপর ধরুন স্যার পুজোর সময়...অষ্টমীতে পাজামা-পাঞ্জাবি, নবমীতে প্যান্ট-শার্ট, দশমীতে মহিলাদের কম্পালসারি সিঁদুর খেলা...এটাই ট্রেন্ড এখন।
- বাব্বা! কত কী জানিস!
- শেষ হয় নি স্যার। একটু নাচতে জানলে ওই ধুনুচি নিয়ে ড্যা ড্যাং ড্যাং...ভিডিও করা বা ছবি তোলা। আর তারপরেই তেড়েমেরে সমাজমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া। পছন্দ, আনন্দ, বিস্ময়, রাগ, বেদনা...এখন তো আবার যত্নও হাজির!
- এসব কী?
- ইমোজি স্যার।
- ইমোজি?
- হ্যাঁ স্যার। এই ধরুন সমাজমাধ্যমে...
- থাম থাম। সমাজমাধ্যম ব্যাপারটা কী?
- সোশাল মিডিয়া স্যার। এই ধরুন টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক...
- ওহ। তো সেটা বল। খামোকা সমাজমাধ্যম সমাজমাধ্যম করছিস কেন?
- স্যার কবিপক্ষ। দেবীপক্ষের মতো বাঙালির অন্যতম সেরা পক্ষ। আর কয়েক বছর পর আঠারো বৈশাখ 'জাগো কবি তুমি জাগো' বলে কবিলয়া শুরু হল ব'লে!!
- কবিলয়া?
- হ্যাঁ স্যার মহালয়ার মতো।
- ইনটারেস্টিং তো। তা আঠারো কেন?
- দুটো কারণে। একটা হল পঁচিশের সাতদিন আগে। আর একটা হল কবিস্পর্শ। কবিরা তো এক একজন বাঘ। তা বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা...ওরকমই আর কি!
- উফফ তোকে নিয়ে পারি না।
- তা যা বলেছেন বাবামশাই।
- আবার বাবামশাই?
- ওই যে কবিপক্ষ!
- তার সঙ্গে বাবামশাইয়ের সম্পর্কটা কোথায়?
- ওই যে স্যার এই কয়েকদিন যা হবে সব কবির মতো হবে।
- তো?
- কবির বাড়িতে বাবাকে নাকি বাবামশাই ডাকবার রেওয়াজ ছিল স্যার। তাই এই কয়েকদিন আমরাও স্যার এই ডাক চালু রাখব।
- বটে! আর কী কী প্ল্যান শুনি!
- না স্যার বেশি কিছু নেই আর। সকাল সন্ধ্যে ওই ছবির সামনে ধূপধুনো দেব। পাজামা-পাঞ্জাবী বা শাড়ি পড়ে পা মুড়ে বসে কবিতা পাঠ, আবৃত্তি করব বা গান গাইব। ছাদে উঠে কবির ছবির সামনে নাচব। মানে স্যার আমি কতটা কবিকে ভালবাসি সেটা বোঝাতে জানপ্রাণ এক করে দেব অনেকটা জানেমন স্টাইলে...
- বাপরে! বলিস কি!!
- শেষ হয়নি স্যার।
- আরও আছে?
- আসলটাই তো বলিনি স্যার। পাবলিকের ভাল লাগল কি লাগল না সেসব কেয়ার না করে এইসবের ভিডিওগ্রাফি করে পটাপট সোশাল...থুড়ি সমাজ মাধ্যমে ইয়ে মানে পোস্ট করব!
- এতেই হবে?
- না স্যার। অনুসঙ্গ হিসেবে বাবামশাই ডাক, দুপুরে বিশুদ্ধ নিরামিষ ও রাতে জল সহযোগে মাংস ভক্ষণ, কালবৈশাখি রাতেও 'আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে' বলে ভেউভেউ ক্রন্দন আর সবশেষে বমিটমি করে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে লাট্টুর মতো মাথা নিয়ে শয়ন...এটা স্যার মহাজন্মদিনের পর্ব। বাকি পক্ষকাল এরকমটাই চলবে তবে কম বেশি এদিক ওদিক করা যেতে পারে। শেষের দিকের প্রোগ্রামটা একটু পাল্টাবে।
- কীরকম ও কেন?
- প্রথমদিকে একটু আলুথালু ভাব থাকবে। মানে এই 'আমার এই দেহখানি তুলে ধরো' টাইপ। পরের দিকে একটু রাগী রাগী 'ভগবান বুকে এঁকে দেব পদচিহ্ন' ধরণের। মানে আঁকব না কেননা সে সাহস নেই। তবে ভাবটা ওরকম থাকবে আর কি বাবামশাই...
- নিকুচি করেছে তোর বাবামশাইয়ের। একদম পিটুনি খাবি।
- এই তো...এই তো স্যার! আমি দুর্বল বলে আমার ওপর যত কিছু স্যার। সামান্য ডাকেই খেপে গেলেন। আর ওদিকে যে ওতগুলো লোক ওভাবে কাটা পড়ল তাও চুপ করে রইলেন!
- কাদের কথা বলছিস?
- আপনি জানেন না বাবামশাই? আয়নায় মুখ দেখতে পারছেন! নিজের দেশেই লোকগুলোকে পরিযায়ী তকমা দিলেন! কাউকে আনার জন্য দিলেন উড়োজাহাজ আর কাউকে দিলেন বাসি রুটি আর একটু আচার...যা শালারা হেঁটে হেঁটে যা...মরবি তো মর। লাখ দশেক ধরিয়ে দেব। তুই তো মরা, চুপ করেই গেছিস। তোর বাড়ির টিকটিক করা লোকেরাও চুপ! আর পাবলিক? আপনি বাঁচলে বাপের নামের পাবলিকরা কবে আর কতদিন হল্লাবোল পাকিয়েছে!
- তাই বলে অন্য কিছু হবে না? মর্মান্তিক ঘটনা নিঃসন্দেহে। কিন্তু এদিকটাও তো দেখতে হবে...এরকম একটা দিন!
- দেখবেন স্যার। অবশ্যই দেখবেন। তবে স্যার, যাঁর জন্য এই উদযাপন, তিনি বেঁচে থাকলে এই অবস্থায় কী করতেন সেটাও ভাববেন স্যার। লোকটা তো আমাদের ভাবতে শিখিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়েছিলেন ওটাই...ভাবনাটাই স্যার বন্ধ করে দিলেন!!
(মাথা নিচু করে ভার্চু চলে গেল। ও চলে যেতেই ঝুপ করে লোডশেডিং হ'ল।
লকডাউনের অন্ধকার আরও কালো হল বোধহয়।)
No comments:
Post a Comment