সম্পাদকের কথা
বাংলা নববর্ষ এবার কোনও হর্ষ নিয়ে এলো না। বরং সারা পৃথিবীতে মৃত্যু মিছিল দেখতে দেখতে আমরা প্রত্যেকে ক্লান্ত। হতাশা ঘিরে ধরছে আমাদের। কেউ জানিনা এর শেষ কোথায়। নানাভাবে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি দ্রুত এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে। প্রার্থনা করছি যে, আবার সব আগের মতো হয়ে যাক, ফিরে আসুক স্বাভাবিকতা।
এই অতিমারী আমাদের ঔদ্ধত্য ও অহংকারকে ধুলোয় মিটিয়ে দিয়েছে। এক সামান্য জীবাণুর কাছে আমরা যে কত অসহায় তা আজ প্রমাণিত। অনাগত ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে আমরা অজ্ঞ সে বিষয়ে। কীভাবেই বা নিজেদের বাঁচাবো সে সম্পর্কেও আমাদের কোনও ধারণা নেই। বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, প্রচুর মানুষ ইতিমধ্যেই কর্মহীন হয়েছেন, দেওয়ালে পিঠ থেকে গেছে আমাদের সবার।
তবু আমরা লড়াই করছি একটিই আশা নিয়ে যে, এই দুরাবস্থা বেশিদিন চলবে না, চলতে পারে না। যুগে যুগে বিভিন্ন বিরুদ্ধ শক্তি আমাদের বিনষ্ট করবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য যে, আমরা সে অবস্থা কাটিয়ে উঠেছি। এই ভরসাই আমাদের বল, আমাদের শক্তি। আবারও সব ঠিক হবে, মানুষের চিরদিনের জয়যাত্রা একইরকম থাকবে সেই আশাতেই দিন গুনছি।
মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৭
মুজনাই অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা
মুজনাই সাহিত্য সংস্থার একটি প্রয়াস
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
ঠিকানা- হসপিটাল রোড, কোচবিহার, ৭৩৬১০১, প ব
ইমেল ঠিকানা- mujnaisahityopotrika@gmail.com
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৭
মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৭
স্মরণ
লীলা নাগ রায়
মুজনাইয়ের ঋণ যাঁর কাছে কোনদিন শেষ হবে না...
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা-
দুর্গাদাস মিদ্যা, বাণীপ্রসাদ নাগ, সুবীর সিনহা রায়, শ্যামলী সেনগুপ্ত, গৌরাঙ্গ সিনহা, কুমকুম ঘোষ, কাকলি ভদ্র, রাহুল গাঙ্গুলী, শেখ একে এম জাকারিয়া, বিপ্লব তালুকদার, বটু কৃষ্ণ হালদার, মজনু মিয়া, বুদ্ধদেব দাস, নারায়ন ভৌমিক, দীপ্তিমান মোদক, রুনা দত্ত, রাতুল দত্ত, সুস্মিতা পাল কুন্ডু, ফিরোজ হক্, ছবি ধর, সায়ন তরফদার, রকি মিত্র, রবিনা সরকার, স্বপন কুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রতিভা পাল সেন, সম্পা পাল, নিশীথ বরণ চৌধুরী, নবনীতা সরকার, লুবনা আখতার বানু, সঞ্জয় কীর্তনিয়া, বিজয় বর্মন, শাবলু শাহাবউদ্দিন, মাথুর দাস, শ্যামল কুমার রায়, বাবুল মল্লিক, অর্পিতা দাস, সায়ন্তন প্রামাণিক, কৌশিকী চন্দ, মৌরুসি দত্ত, আরাত্রিকা, জয়িতা দেবনাথ, সংহিতা ভৌমিক, সম্পূর্ণা নন্দী
প্রচ্ছদ - কৌশিক বিশ্বাস
বিশেষ রচনা
ধ্বংসের বিনির্মাণ --২০২০
কুমকুম ঘোষ
(..."মরণ রে , তুঁ হুঁ মম শ্যামসমান
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,
রক্তকমলকর, রক্ত- অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তবে
মৃত্যু - অমৃত করে দান"...)
কি আশ্চর্য ভাবে উপসংহার লেখা হয়ে গেল।
কি আশ্চর্য ভাবে এক মঞ্চে পরপর দাঁড়িয়ে থাকলো : শক্তিমান রাষ্ট্রনেতা থেকে হরিপদ কেরানি; বিলিওনার উন্নাসিক থেকে নগ্ন পদ উদ্বাস্তু শ্রমিক ; ঝুনো নেতা থেকে সবেমাত্র চৌর্যবৃত্তিতে হাত পাকানো চামচা এবং, এবং এবং পৃথিবী নামক এক গ্রহের সাদা কালো বাদামী ফ্যাকাশে বেঁটে লম্বা মোটা রোগা ভালো মানুষ ,খারাপ মানুষ, দয়ালু মানুষ, নিষ্ঠুর মানুষ সহ তাবৎ সভ্য অসভ্য রুচিশীল রুচিহীন মুখর অথবা ভাষা থেকেও বোবা একদল পরিযায়ী।
(..."অনেক দিয়েছ নাথ, আমায় অনেক দিয়েছ নাথ
আমার বাসনা তবু পুরিল না---
দীনদশা ঘুচিল না, অশ্রুবারি মুছিল না।
গভীর প্রাণের তৃষা মিটিল না,মিটিল না"...)
কি আশ্চর্য ভাবে উপসংহার লেখা হয়ে গেল।
যে ভাবছিল আমি কেন?
যে ভাবছিল "হে ভগবান" আমি কেন?
যে ভেবেছিল " কেন প্রভু" আমি কেন? কিংবা
যারা ভেবেছিল" এমন একটা দান চালবো না!"
কিংবা টাইটানিকের সেই বড়োলোকের দল, জাহাজ ডুবলেও ভেবেছিল "মরবে ঐ ডেকের হাভাতের দল";
সেই তাদের মত, তারা, অসহায় ,হতাশ,ব্যর্থ কিংবা অতিচালাকের দল ; একদিকে নিশ্চিত ক্ষয় অন্যদিকে আশঙ্কার বুলডোজার :
ফুটপাত থেকে বিলাসী গজদন্তমিনার;
দূরত্ব মাপা হয়ে গেল ; সাড়ে তিন ফুট
অথবা কয়েক মিটার ।
(..."হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী , নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব
ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ।।
নূতন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী
কর' ত্রাণ মহাপ্রাণ , আন' অমৃত বাণী"...)
কি চমৎকারভাবে উপসংহার লেখা হয়ে গেল।
কি আশ্চর্য ভাবে উপসংহার লেখা হয়ে গেল।।
গুদাম ভরা গোলা- বারুদ - ক্ষেপণাস্ত্রে ভরা বিমান এবং ডুবোজাহাজ- মাটির তলায় বাঙ্কারে সুসজ্জিত পরমাণু বোমার সম্ভার - শতশত সাঁজোয়া গাড়ি - লাখোলাখো অ্যাসাল্ট রাইফেল - কোটিকোটি বেয়নেটধারী ----
যুদ্ধ চলছে --
যুদ্ধ চলছে -- ভুখা পেটে , বোবা কান্নায় :
যুদ্ধটা চলছে: সীমানাহীন অদৃশ্য কাঁটাতারের এদিকে অথবা ওদিকটায়।
পানপাত্র ভরা আছে মদিরায় ;
গোলাপী ঠোঁটগুলো আছে প্রতীক্ষায় ;
দুচোখে ভরা আছে স্বপ্ন
সত্য, তবু বিচ্ছেদ বেদনা
নিঃশব্দ ,
হৃদয়ে শিশির-পতন।
অনাবশ্যক এক উপসংহার;
তথাপি, লেখা হয়ে যায়।।
("ক্রন্দয়ময় নিখিলহৃদয় তাপদহনদীপ্ত
বিষয়বিষবিকারজীর্ণ খিন্ন অপরিতৃপ্ত।
দেশ দেশ পরিল তিলক রক্তকলুষগ্লানি,
তব মঙ্গলশঙ্খ আন' তব দক্ষিণপাণি--
তব শুভসঙ্গীতরাগ , তব সুন্দর ছন্দ।
শান্ত হে , মুক্ত হে , হে অনন্তপুণ্য ,
করুণাঘন , ধরণীতল কর' কলঙ্কশূন্য"...)
এই বড় নেতিবাচকটা বড় ইতিবাচকও
গৌরাঙ্গ সিনহা
হঠাৎ কী যে ঝড় এল।চারদিক তছনছ করে দিচ্ছে। মৃত্যুমিছিল কত বড় হবে এখনও আমরা কেউ জানিনা।আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছি সবাই নিজেকে এবং অপরকে বাঁচাতে।এর আগেও এই জাতীয় ভাইরাস মহামারী ঘটিয়েছে, কিন্তু তখন আমরা এত উন্নত ছিলামনা।এখন নিজেকে বাঁচাতে অনেক স্মার্ট আমরা,আত্মবিশ্বাসীও।কিন্তু না করোনার আক্রমণাত্মক বলটা এতই স্মার্ট যে আমরা একেবারে বোল্ড আউট।বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলো পর্যন্ত ধরাশায়ী হয়ে গেল। কেউ এই অদৃশ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিটানুর ক্ষমতা বুঝতে পারেনি।বলতে গেলে শক্তিধর দেশগুলো তো পাত্তাই দেয়নি।বোঝো ঠেলা তাই।এখন বাঁচবে,বাঁচাবে না মৃতদেহ কবর দেবে।হিমসিম খাচ্ছে সবাই আসু কর্তব্যে।হিম মৃত্যুর আতঙ্ক যেন মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর। এমনি তর বিপর্যয়ের সামনে আমরা আক্রান্ত মানুষ যখন জেরবার,তখন তার প্রতিবেশী সংখ্যাগুরুরা, যারা এখনও আক্রান্ত হইনি, তারা কিন্তু এক জটিল মিশ্র মানসিক সংক্ষোভে নিমজ্জিত। প্রথমত আমিও কি দেখতে পাচ্ছি আমাকে মৃত্যুর মিছিলে? নাকি আমি নিশ্চয়ই আক্রান্ত হবনা, অথবা হলেও বেঁচে যাব।অথবা সামগ্রিকভাবে একটা গ্রছ মৃত্যুছারের ভাবনায় ডুবে থাকা,কেননা বিসিজি,ম্যালেরিয়ার দেশ বা কম সম্ভাবনা ময় হলেও গরম দেশের তত্ত্ব রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে।দ্বিতীয় ভাবনা,যদি কোনপ্রকারে বেঁচেই যাই,সামনের দিনগুলো তো ভয়ঙ্কর হবে।টিভির পর্দায় বড় বড় অর্থনীতিবিদদের যা প্রেডিকশন প্রতিদিন ঝরে পড়ছে তাতে দেশের অর্থনীতি যেভাবে মুখথুবড়ে পড়বে,তাও যেন অন্য এক মৃত্যুভয় এনে দেয়।কেন, আমরা মধ্যবিত্তরা এই ভয়কে কি চিনিনা? চরম অর্থনৈতিক সংকটে একান্ত গরীব মানুষ গুলো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তায় থালা নিয়ে বেরোতে পারবে,আমরা পারব কি? উপরন্তু এই চলন্ত লাইফস্টাইলের উচ্চতা থেকে ধুপ করে পরে যাওয়া,যেমন ধরুন সপ্তাহে ৫ দিন মাছের জায়গায় ১ দিন,৫০ টাকার চালের জায়গায় ৩০ টাকার,মাসে৪ কিলো তেলের জায়গায়২ কিলো, সপ্তাহে একদিন করে,বাইরে খাবার একদম ছাটাই, জামাকাপড়ও কোনওরকম চলনসই,সহ্য করতে পারব আমরা? হয়তো পারব কারণ মানুষ পরিস্থিতির দাস।কিন্তু তার আগের টেনশন বা ভয়,তাতেইতো কারও হয়ে যায় স্ট্রোক, কেউ বা চরম হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়।না,আমরা নিশ্চিত সেই জায়গায় এখনও আসিনি।কিন্তু আমাদের ভেতরে ভেতর একটা আশংকার মেঘ জমা হচ্ছে কিন্তু। আবার দেখুন এইসকল নেগেটিভের পাশাপাশি অনেক পজিটিভ ঘটনা এবং সেইসব পজিটিভ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক চরম পজিটিভ ভাবনাও আসছে অনেকের মধ্যে। ভালো করে তাকিয়ে দেখুনতো চারদিকটায় ঘরবন্দী জানলা দিয়েই। আকাশ বাতাস কত ধোঁয়াহীন,নির্মল।জানি,এখন বেরিয়ে নদীনালা, বনজঙ্গল দেখতে পাচ্ছেননা।তাতে টিভির চোখ দিয়ে দেখুন আমাদের লোভি লুঠেরার হাতে রিক্ত প্রকৃতি তার হারানো সম্পদ কতটা ফিরে পেয়েছে। বন্যেরা বনে সুন্দর। কবির কথা।আমরা তা হতে দিয়েছি।করোনার দয়ায় এখন তা অনেকটাই হয়েছে।আজ বনে ময়ূর কী আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে, সমস্ত পাখপাখালি আনন্দেবিভোর,অবাধ তাদের বিচরন।আর নদীগুলো? আমাদের যথেচ্ছ দূষণভারে যারা দম নিতে পাচ্ছিলনা,আজ কী সুন্দর শ্বাস নিচ্ছে। সেদিন টিভির পর্দায় সচ্ছসলিলা যমুনাকে দেখে আমি তো হতবাক।সেকি! সেই কবছর আগের যে যমুনা মিশকালো অযুত আবর্জনার নীচে নিজের পুরো চেহারাটাই হারিয়ে ফেলেছিল আজ সে স্বমহিমায়, স্বরূপে উজ্জ্বল, অবিশ্বাস্যভাবে প্রানবন্ত।ভাবিয়ে তুলছেনা আমাদের? এটাইতো প্রকৃতির আসল চেহারা! আমরা যা হরন করেছিলাম,করোনা লকডাউন তা ফিরিয়ে দিল।প্রকৃতির লুন্ঠিত যৌবন,লুন্ঠিত স্বাস্থ্য আজ করোনা ফিরিয়ে দিল। আর আমাদের স্বাস্থ্য!? কেন অবাক হলেন বন্ধুরা।হ্যাঁ,হ্যাঁ,বন্ধুরা, ভুল শোনেননি। আমাদের স্বাস্থ্যের কথাই বলছিলাম। সেটাও অনেকটা ফিরে পেয়েছি। দেখুনতো,এই ১৭/১৮ দিনের আগের চিত্রটা কল্পনায় আঁকুনতো।প্রতিদিন সকাল বিকাল অন্তত শহরে ৩০ টি ডাঃ চেম্বারের প্রতিটিতে গড়ে ৪০ + ৪০ মোট ৮০ টি রোগী। তারপর প্যাথলজিতে কত ধরনের কত টেস্ট। কত খরচ বা চিকিৎসায় কত ঢালা ছিল? সেগুলো এখন গেল কই? কেনই বা গেল,ভেবে দেখবনা একবার? তাহলে আমাদের রোগ কি খানিকটা আমরাই সৃষ্টি করি? কেউ কেউ হয়তো বলবেন লকডাউনএর কারনে,কষ্টে চেপে আছি।সেটা ক'জনের? আর অসুখ ঠেলা দিলে আপনি বসে থাকতে পারবেন? অন্য সময় তো প্রায় মরে যাই,এখনি করোনা না আসলে,এই মরে যাওয়া থাকতনা,হাজার হাজার টাকা খরচ হতনা? হতই।এখন কেন হচ্ছেনা।আত্মবিশ্লেন করুন।ঠিক বেরিয়ে যাবে।এভাবে যদি এক এক করে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব করোনা ধ্বংসের পাশাপাশি সৃষ্টিও নিয়ে এসেছে। কেন পৃথিবীর ওজন স্তর যেটা আমরা ক্রমাগত দূষণে অনেকটাই খালি করে দিয়েছিলাম, সেটা ভরে ওঠেনি? আর সামনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়? জানি সবাই একবাক্যে আমায় ঝেপে ধরবেন।হ্যাঁ,জানি,আসবেইতো।সেতো পুরোনো ব্যাবস্থাটাকে ভেঙে চুরমার করে একটা নূতন অপেক্ষাকৃত উপযোগী, আরও একটা সুস্থ্য অর্থনৈতিক ব্যাবস্হা তৈরি করতে।আপাতভাবে আমাদের মৃত্যু,অজস্র ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতেই হবে।কিন্তু সেই ক্ষয়ক্ষতি একটা অন্য লাভ,অন্য প্রাপ্তির পথ করে দিয়ে যাবে নিশ্চিত। যেমন কাল বৈশাখী ঝড় একটা ভাঙচুড় নিয়ে আসে,তবুও আমরা কবির সঙ্গে সঙ্গে বলি,এত যে ভীষণ তবু ধরায় ধরেনা হর্ষ।আমার মনে হয় এইভাবেই সভ্যতার চড়াই উতড়াই,উত্থানপতন, ভাঙাগড়া, আলো আঁধারীর মধ্য দিয়ে চলন বা গমন,যুগে যুগে।
বিশেষ কবিতা
দুটি কবিতা
শ্যামলী সেনগুপ্ত
পৃষ্ঠা
হতে পারে মুড়ে রাখা পৃষ্ঠা অথবা
পুরনো সূচীপত্র
যার কোণার দিক কুচিকুচি হয়ে গেছে
প্রবল চাপের নীচে
শূন্যতার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে
যেমন হয় থমকে যাওয়া দুপুরের ঘ্রাণে
খুঁটিনাটী সাজিয়ে অন্তরীণ
মন ও মানসাঙ্ক
*******
প্রেক্ষাপট
সবকিছুর পরেও একটি ডিম পড়ে থাকবে
পরিত্যক্ত ক্ষেপণাস্ত্র দেখতে দেখতে
একটি বালক অপেক্ষা করবে
তেরোতম জন্মদিনের জন্য
একটি কিশোরী মন্দিরের মেঝে মুছতে মুছতে
নীল রং সালোয়ারের অন্তরঙ্গে খুঁজে পাবে
তিন লহরী নূপুর
সবকিছুর পরেও তা দেওয়া ছেড়ে কোকিলটি
দোতলার বিছানায় যাবে
ডিমের পিতৃত্ব পরখ করতে
আসন্ন অমাবস্যায় তার দুটো ফড়িং দরকার
বালিকাটির এক লহরী দানা আর
এক রতি পানি
বালকটি হাতজোড় করে থাকে
একটা আসল ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য,
খোলায় চিড় ধরলেও যাতে
কুসুমটি গাঢ় ও টলটলে থাকে
নাজেহাল
দুর্গাদাস মিদ্যা
মরন শিবিরে বসে আছি
পা ঝুলিয়ে দেখি কখন
সে আসে কে যে ভালোবেসে
অকারনে বাতাসে ছড়ালো বিষ?
তার কথা ভাবছি অহর্নিশ।
প্রগতির ধ্বজা উড়িয়ে গর্বে
ভরেছিল আমাদের বুক
না জানি কত না সুখ
চেয়েছি আমরা প্রকৃতির ক্ষতি করে
প্রতিশোধে জর্জরিত আজ
সকলে আমরা ভয়ে ভয়ে
বসে থাকি ঘরে
এমন কপাল
কোথা থেকে এলো এমন মরণ বিষ
সে কথা ভাবছি অহর্নিশ।
কোভিড্-১৯ সংক্রান্ত, কয়েকটা ইচ্ছে-দৃশ্যকবিতা
শব্দরূপ : রাহুল গাঙ্গুলী
১
খাপেখাপ বসে গেলো
নিখুঁত প্রোটোপ্লাজম
অন্ধ বাজার
দুর্গন্ধ স্যানিটাইজেশন্ ______
কাগজে তৈরি চাকতি উ
ড়
ছে ~ মাঝামাঝি আকাশ
২
যারা ফিরে এলো
লকডাউনবিহীন্
যারা ফিরে গেলো _______
বৃষ্টি পড়ছে টু
প
টা
প্
মিথুন চামড়া
লতপৎ উল্কা
লুকোচোরি স্যাটেলাইট _______
৩
মুহূর্ত _____
কোনো বসন্ত নেই
শীত।গ্রীষ্ম।বর্ষা।শরৎ।হেমন্ত কিছুই নেই
থমকানো ঘড়ি ~ জন্ম-অভিযোজন
||
???????? _____
গলে যাওয়া ০
দৈনিক ভীড় বাড়লে ~ স্পর্শ = নি|স্পর্শ
৪
০ || পোড়ে না
চুপিচুপি পাতাপাতা-ঘাস
আগুন }
জল }
মাটি }
বাতাস }
পোড়াপুড়ি ঠোঁট
# ভ্রূণ-শব্দ খোঁড়াখুঁড়ি
সূর্য-গ
ও
হো
ব
র
৫
ঘোড়াটা ১লাফে ~ যা যা ডিঙোতে পারলো না
কলম
উষ্ণতা
প্রতিকবিতা
ক্ষারা-গাণিতিক
সকলেই ভাবছি কিছুকিছু সমুদ্র
সমুদ্র-ফসল
# কয়েকটা শেকড়/পালক ঝুঁকে
তাপতাপ ব
র্ণ
পরিচয় ____
ইদানিং
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ
বাণী প্রসাদ নাগ
ট্যাঙ্কের মাটি কাঁপানো ঘড়ঘড় শব্দ কানে আসে না। কামানের গোলা ছোটে না। সাইরেন বাজে না।
ব্ল্যাক আউট হয় না। অকেজো হয়ে পড়ে অত্যানুধিক বন্দুক ও যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম। আকাশ পথে বন্ধ মিশাইল নিক্ষেপণ। তবুও একটা অঘোষিত যুদ্ধ এক অদৃশ্য শক্তি করোনার সাথে, জন্ম চীনে।
বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত যুদ্ধাস্ত্রের খোঁজে। সাত সমুদ্রের বিশ্বে মানুষ দিকে দিকে লড়ছে মৃত্যুর বিপক্ষে, পরাজিত যোদ্ধারা যোগ দিচ্ছে মৃত্যুর মহামিছিলে। লাখে, কোটিতে বিশ্বের অপারাজিত মানুষ গৃহবন্দি লক ডাউনে।
নিয়মের ফেরে বিশ্ববাসী ক্লান্ত অবসন্ন নিজ নিজ গৃহকোনে। বিধি নিষেধের ছড়াছড়ি,কোথাও বাড়াবাড়ি, কোথাও মারামারি। বন্ধ যোগাযোগ, বন্ধ দোকান পাট, কল কারখানা। নাগরিক বৃন্দ অতিষ্ঠ, সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে।
আমরা বুঝতে চাইনা সামাজিক দূরত্ব স্থাপনের বিষয়টা, মাস্কের ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোওয়ার গুরুত্বটা,বুঝতে চাইনা, দেশ ও পরিবারের স্বার্থে বন্দি থেকে একঘেয়েমি জীবনে অবসর যাপনের কথাটা, ভাবি না দশের স্বার্থে লড়াকু যোদ্ধা ডাক্তার, সেবিকা, সাফাই কর্মী ও শাসকের প্রতি শ্রদ্ধার কথাটা। সবটাই সকলেরই মঙ্গলের জন্যে।
বিশ্বের দিকে দিকে মৃত্যুর দুন্দুভি। আজ কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষ অভুক্ত। গৃহহারারা রুজি রোজগার ছাড়া আটকে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে। দিন থেকে রাত ঘুরে বেড়াচ্ছে মেঠো পথে দুমুঠো খাবারের খোঁজে। করোনা মহামারীর চপেটে অনেকেই আজ দিন কাটাচ্ছে অনশনে। যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। অলস অবসরের বদলে কর্ম চঞ্চল দিন সাথে শান্তি আসুক বিশ্বের অঙ্গনে।
প্রসঙ্গ, অতিমারি
সুবীর সিনহা রায়
... ... বৌদ্ধশিষ্য অনাথপিন্ডদকন্যা সুপ্রিয়া সমকালীন যুগে মন্বন্তরের দুঃসময়ে
আপন উদ্যোগে খাদ্যভান্ডার রচনা করে রাজ্যের নিরন্ন মানুষের মুখে আহার যুগিয়ে প্রাণবাঁচানোর যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছে , ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয়, সাক্ষী থেকেছে মহাবিদ্রোহোত্তর মহামারি ( প্লেগ, বর্ধমান ফিভার) ঘন ঘন বন্যা আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন,দুর্ভিক্ষ মৃত্যুকবলিত নগরের মানুষের পাশে থেকে দিনেরাতের ক্লান্তি মুছে ওষুধ খাদ্যসহ আর্তসেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন যিনি,মানবতাবাদের এক উজ্জ্বল মুখ স্বামী বিবেকানন্দ-অনুগামী স্বামী অখন্ডানন্দজি --- সেই দরদী মরমী কাহিনি।
আজ এই ভয়ংকরী করোনা-ব্যাধির করাল গ্রাসে বিধ্বস্ত খাদ্যহীন কোথাও আশ্রয়হীন চিকিৎসাহীন দিশাহীন সমাজের অসহায় মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে নানাপন্থী এই সমাজের অনুভূতিসম্পন্ন পরার্থপর দায়বোধের একদল মানুষকে, যে তারা অনাথপিন্ডদকন্যাদেরই প্রতিরূপ এবং সময়ের উতবর্তনে তাদেরও এমন মরমী উদ্যোগের কথা সাক্ষী হয়ে থাকবে আগামী ইতিহাসের,-- বলতে হবে সেই ছোট্ট সংবেদনশীল ষষ্ঠশ্রেণির প্রান্তিক স্কুল বালকটির কথা, এই দুর্মর ক্রান্তিকালে তারও কিছু দায় আছে সমাজের কাছে, এমন ভাবনা থেকে স্কুল থেকে সংগ্রহ করা ত্রাণসামগ্রী চাল ডাল নিজে না খেয়ে পথের ধারে বসেথাকা অভুক্ত জীর্ণশরীর বৃদ্ধের হাতে তুলে দেয় অনায়াসে যে,বলতে হবে সেই হাসপাতালের সেবিকা মায়ের কথা,দুধের সন্তান ছেড়ে দিনেরাতে কর্তব্যপরায়ণী, মারীআক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর সেবায় আত্মআহুতি দিয়ে সংক্রমণ নিয়ে চলে গেছে চিরতরে পৃথিবী থেকে,The coward dies a thousands deaths , but the brave one --
প্রবাদকে যথার্থ প্রমাণ করে এ যেন শ্রেষ্ঠ
মরণযাত্রারই ইতিহাস লিখে যাওয়া, অথবা মৃত চিকিৎসক ডঃ বন্দনা তেওয়ারি ডঃ প্রিয়া খান্নাদের আত্মত্যাগের মহৎ ইতিকথা !
বিশ্ব যখন নিদ্রামগন জেগে আছে শুধু ওরা,
একদল বিজ্ঞানী গবেষক প্রযুক্তিবিদের মত সীমান্তসৈনিক, উৎকন্ঠ প্রতিজ্ঞা দৃঢ়, কোভিদ উনিশ-রোগের দ্রুত নিরাময়ে অব্যর্থ প্রাণদায়ী ওষুধ আবিষ্কারের মত মহৎকাজে নিবেদিতপ্রাণ -- এঁরাওতো স্মরণ্য !
মানুষ আজ সত্যি জায়গা করে নিয়েছে মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠা দিতে,সব কিছু আচার বিচার সংকীর্ণতা সরিয়ে। এবং ' সম্পর্কের ওঠানামা, তার মহত্ব, তার স্খলন... ন্যায়বোধ '
--সব আজ একাকার হয়ে গেছে। তালাবন্দী জীবনের অবসাদ অনিশ্চয় ভবিষ্যতের গ্লানি ভুলে থেকে হাসি আনন্দ হাস্যপরিহাসে মেতে
ওঠার ( সোশাল মিডিয়ার ও অন্যান্য মাধ্যম ) মধ্যেদিয়ে জীবনকেই যেন খোঁজকরা .... জীবনমুখিতাই যে মানুষের ধর্ম ....এও এক আশাবাদের দিককেই যেন সূচিত করে ;
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব: ২০১৯-২০২০
শেখ একেএম জাকারিয়া
করোনা ভাইরাস এই সময়ে পৃথিবীজুড়ে এক প্রাণঘাতী আতঙ্কের নাম। ইতোমধ্যে এই ভাইরাস চীনসহ বিশ্বের ২১০টির বেশি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এশিয়ার পর ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে মহামারি আকার ধারণ করেছে এই ভাইরাস। সাধারণ লোক থেকে শুরু করে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, মন্ত্রী, উপদেষ্টা কেউই রেহাই পাচ্ছেন না এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে। বিশ্বজুড়ে চলছে মৃত্যুর মিছিল৷ সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়ানক মন্দার আতঙ্ক৷ করোনার কবল থেকে কবে মুক্তি পাওয়া যাবে, সেটা কেউ জানে না। তবে মুক্তির অপেক্ষায় আছে বিশ্ববাসী৷ করোনা ভাইরাস কী? কীভাবে হলো এর উৎপত্তি? এ নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা কৌতুহল ও আতঙ্ক। আসুন সংক্ষেপে জেনে নিই এ ভাইরাস সম্বন্ধে। করোনা ভাইরাস বলতে ভাইরাসের একটি শ্রেণি বা বিভাগকে বোঝায় যা স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখিদের আক্রান্ত করে। মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস শ্বাসনালীর সংক্রমণ ঘটায়। এই সংক্রমণের লক্ষণ হালকা হতে পারে, অনেকসময় যা গতানুগতিক সর্দি-কাশির মতো মনে হয় (এছাড়া অন্য কিছুও হতে পারে। যেমন, রাইনো ভাইরাস), কিছু ক্ষেত্রে তা অন্যান্য প্রাণঘাতী ভাইরাসের জন্য হয়ে থাকে। যেমন সার্স, মার্স এবং কোভিড-১৯। তবে অন্যান্য প্রজাতিতে এই লক্ষণের তারতম্য দেখা যায়। যেমন, মুরগির মধ্যে এটা উর্ধ্ব শ্বাসনালীর সংক্রমণ ঘটায়, আবার গরু ও শূকরে এটি উদরাময় সৃষ্টি করে। মানবদেহে সৃষ্ট করোনা ভাইরাস সংক্রমণ এড়ানোর মতো কোনও টিকা বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আজও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে ইদানিং ফেইসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে, জাপানে করোনা ভাইরাসের ওষুধ আবিস্কৃত হয়েছে। করোনা ভাইরাস রাইবোভিরিয়া পর্বের নিদুভাইরাস বর্গের করোনাভিরিডি গোত্রের অর্থোকরোনাভিরিন্যা উপ-গোত্রের সদস্য। তারা পজিটিভ সেন্স একক সূত্রবিশিষ্ট আবরণীবদ্ধ বা এনভেলপড ভাইরাস। তাদের নিউক্লিওক্যাপসিড সর্পিলাকৃতির। এর জিনোমের আকার সাধারণত ২৭ থেকে ৩৪ কিলোবেস-পেয়ার (kilo base-pair) এর মধ্যে হয়ে থাকে যা এ ধরনের আরএনএ ভাইরাসের মধ্যে সর্ববৃহৎ। করোনা ভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন ভাষার করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে যার অর্থ মুকুট অর্থাৎ মালা বা হার। কারণ দ্বিমাত্রিক সঞ্চালন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটির আবরণ থেকে গদা-আকৃতির প্রোটিনের কাঁটাগুলির কারণে এটিকে অনেকটা মুকুট বা সৌর করোনার মতো দেখায়। ভাইরাসের উপরিভাগ প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপলোমার দ্বারা এর অঙ্গসংস্থান গঠন করে। এ প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যু বিনষ্ট করে। ভাইরাসটি ডাইমরফিজম রূপ প্রকাশ করে। ধারণা করা হয়, প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস প্রথম মানব শরীরে প্রবেশ করে। করোনা ভাইরাসের অতীতকথা পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করলে দেখা যায়, করোনা ভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে গতানুগতিক সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে এরকম দু'ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ নামপ্রদান করা হয়। এরপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময়ে ভাইরাসটির আরও কিছু প্রজাতি পাওয়া যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএসসিওভি’,
২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’,
২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে
‘এমইআরএসসিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে চীনে 'এসএআরএস-সিওভি-২’
পাওয়া যায় (যা এ সময়ে সাধারণত নোভেল করোনা ভাইরাস নামেই পরিচিত)। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের মারাত্মক সংক্রমণ দেখা দেয়। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে জ্বর, অবসাদ, শুষ্ক কাশি, বমি হওয়া,শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যাথা, অঙ্গ বিকল হওয়া, মাথা ব্যাথা, পেটের সমস্যা ইত্যাদি। তবে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে উপরোক্ত সকল উপসর্গ দেখা গেলেও জ্বর থাকে না। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রমণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে‘২০১৯-এনসিওভি ’ নামপ্রদান করে।
২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ২১০টিরও বেশি দেশ ও অধীনস্থ অঞ্চলে ৩০,৪২,৪৪৪ জনেরও (৩০ লক্ষ ৪২ হাজার ৪ শত ৪৪) বেশি ব্যক্তি মরণব্যাধি করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন বলে সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। এদের মধ্যে ২,১১,২১৬ জনের বেশী ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে এবং ৮,৯৪,৫৭৪ জনের বেশি রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেছে। তারমধ্যে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৬,৪৬২ জন। সুস্থ হয়ে ওঠেছে ১৩৯ জন। মৃত্যুর সংখ্যা ১৫৫ জন।
উহানে দেখা দেওয়া ভাইরাস প্রজাতিটি ‘এসএআরএস-সিওভি’ প্রজাতির সাথে ~৭০% জিনগত মিল পাওয়া যায়। অনেকের ধারণা, নতুন এ প্রজাতিটি সাপ থেকে এসেছে যদিও অনেক গবেষক এ মতের বিরোধিতা করেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়,সকল প্রকার
করোনা ভাইরাসের সর্বশেষ সাধারণ পূর্বপুরুষ এর উৎপত্তি ঘটে আনুমানিক ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আলফা করোনা ভাইরাসের এমআরসিএ ধারা ২৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, বেটা করোনা ভাইরাসের ধারা ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, গামা করোনা ভাইরাসের ধারা ২৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং ডেল্টা করোনা ভাইরাসের ধারা ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি হয়েছে। বাদুর এবং পাখির মত উড়ন্ত উষ্ণরক্তধারী
মেরুদণ্ডী প্রাণীরাই করোনা ভাইরাস জিন-উৎসের বিবর্তন এবং ছড়িয়ে দেওয়ার আদর্শ বাহক (বাদুড়ের জন্য আলফা ও বেটা করোনা ভাইরাস, পাখির জন্য গামা এবং ডেল্টা করোনা ভাইরাস)। বোভাইন করোনা ভাইরাস এবং ক্যানাইন
শ্বসনযন্ত্রের করোনা ভাইরাসের শেষ পূর্বপুরুষ এসেছে (~ ১৯৫০) এর দিকে। বোভাইন এবং মানব করোনা ভাইরাস ওসি৪৩ ১৮৯০-এর দিকে ছড়ায়। বোভাইন করোনা ভাইরাস ছড়ায় ইকুয়াইন করোনা ভাইরাস প্রজাতি থেকে, ১৮ শতকের শেষদিকে। মানব করোনা ভাইরাস ওসি৪৩-এর এমআরসিএ ১৯৫০-এর দিকে উৎপত্তি লাভ করে। মার্স-কোভি কিছু বাদুড়ের করোনা ভাইরাস
প্রজাতির সাথে সম্পর্কযুক্ত হলেও ধারণা করা হয় বেশকিছু শতাব্দী আগে এর উৎপত্তি ঘটে। মানব করোনা ভাইরাস এনএল৬৩ এবং একটি বাদুড়ের করোনা ভাইরাসের এমআরসিএ ৫৬৩-৮২২ বছর আগে উৎপত্তি লাভ করে। ১৯৮৬ সালে বাদুড় করোনা ভাইরাস এবং সার্স-কোভির সাথে সম্পর্কযুক্ত ভাইরাস উৎপত্তি লাভ করে। বাদুড়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত সার্স ভাইরাসের বিবর্তনের একটু যাত্রাপথ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গবেষকেরা মনে করেন, করোনা ভাইরাস দীর্ঘসময় ধরে বাদুড়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়েছে এবং সার্স-কোভির উত্তরসূরীরা প্রথমে হিপোসিডারিডি গণের প্রজাতির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। এরপরে তা রাইনোলফিডির প্রজাতির মধ্যে, পরবর্তীতে ভামের মধ্যে এটি ছড়ায় এবং সর্বশেষে ছড়ায় মানুষের মধ্যে। আলপা করোনা ভাইরাস এবং মানব করোনা ভাইরাস ২২৯ই ১৯৬০-এর দিকে উৎপত্তি লাভ করে। ক্ষতির দিক থেকে করোনাভাইরাস বেশ বৈচিত্র্যময়। কিছু প্রকরণ আক্রান্তের
৩০%-এরও বেশিকে মেরে ফেলে (যেমন মার্স-কোভি), কিছু প্রকরণ মোটামুটি নিরীহ, যেমন সাধারণ ঠাণ্ডা। করোনা ভাইরাস ঠাণ্ডার পাশাপাশি বড় ধরণের কিছু উপসর্গ সৃষ্টি করে। যেমন, জ্বর, ফুলে যাওয়া অ্যাডিনয়েডের ফলে গলা ব্যথা।এগুলো সাধারণত শীতকালে এবং বসন্ত ঋতুর শুরুর দিকে হয়। করোনাভাইরাস নিউমোনিয়া
ঘটাতে পারে । ২০০৩ সালে সার্স-কোভি ছড়ানোর পর থেকে করোনা ভাইরাস পরিচিতি পায়। এই ভাইরাস একইসাথে সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) এবং উর্ধ্ব ও নিম্ন শ্বাসনালী সংক্রমণ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, 'ভাইরাসটি হয়ত মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতোমধ্যেই 'মিউটেট করছে' অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে - যার ফলে এটি আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।' কিন্তু এ ভাইরাসের প্রকৃতি এবং কীভাবেই বা তা রোধ করা যেতে পারে - এ সম্পর্কে এখনও বিজ্ঞানীরা বিশদভাবে জানার চেষ্টা করছেন। সার্স বা ইবোলার মতো নানা ধরণের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝেমধ্যেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। এই করোনা ভাইরাস তারমধ্যে সর্বশেষ। করোনা ভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি প্রজাতি মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে। এক দশক আগে সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার এ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও ছিল এক ধরণের করোনা ভাইরাস।এতে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারেরও বেশি লোক। এছাড়া বিজ্ঞানীরা জানান, ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন সময় লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তারপর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট ও জ্বর এবং তখন কোনও কোনও রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়,উহান শহরের বিমানবন্দরে সতর্কবাণী ছিল
' ভাইরাসটি ছড়িয়েছে কোনও প্রাণী থেকে '
বিশেষজ্ঞদের মতে, 'মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। তারপর ১১ জানুয়ারি সর্বপ্রথম সে শহরের একজনের মৃত্যু হয়।' তবে ঠিক কীভাবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল তা এখনও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সম্ভবত কোনও প্রাণী এ ভাইরাসের উৎস ছিল। প্রাণী থেকেই প্রথমে ভাইরাসটি কোনও মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে এবং পরে তা মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। তারা আরও জানান, উহান শহরে সামুদ্রিক খাবারের একটি বাজারে আসা যাওয়া করে এমন লোকদের সঙ্গে এ ভাইরাসের যোগসূত্র আছে। কেননা, ওই বাজারটিতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী যেমন, বনমোরগ, বাদুড়, খরগোশ ও সাপ বেচাকেনা হয়ে থাকে। এছাড়া কিছু সামুদ্রিক প্রাণী যেমন, বেলুগা জাতীয় তিমি করোনাভাইরাস বহন করতে পারে। হয়ত এসবের কোনও একটি থেকে এই ভাইরাস এসে থাকতে পারে। যেহেতু এই ভাইরাসটি নতুন, তাই এর কোন টিকা বা ভ্যাকসিন এখনও আবিস্কার হয়নি এবং এমন কোনও চিকিৎসা নেই যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। এর হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হলো, যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে বা এ ভাইরাস বহন করছে - তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। তাছাড়া ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়েছেন, বার বার হাত ধোয়া, হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা, ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরা। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গ্যাব্রিয়েল লিউং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত এ নির্দেশনায় বলছেন, হাত সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, বার বার হাত ধুতে হবে। হাত দিয়ে নাক বা মুখ ঘষা যাবে না, ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরতে হবে।
উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষাপটে এটাই বলা যায় যে, এ রোগের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের নিজেদেরকে সচেতন হতে হবে, পাশাপাশি অন্যদেরকে সচেতন করতে হবে। আসুন সবাই নিজেকে বাঁচাই, হোম কোয়ারান্টাইন মেনে চলি, যদি অসুস্থ হয়ে থাকি তবে মুখোশ পরি এবং এমনভাবে হাঁচি- কাশি দিই যাতে অন্যরা সংক্রমিত না হয়, আর নিজে অসুস্থ না হলেও, অন্যের সংস্পর্শ এড়াতে মুখোশ পরি।
নববর্ষ
বেদনার গাজন ও নববর্ষ
বিপ্লব তালুকদার
শীতের শেষে অপেক্ষা শুরু ঋতুরাজ বসন্তের ,চারদিকে রাঙা পলাশ,মন কেমন করা বাউলা বাতাস । চারদিকে কোকিল ,বউ কথা কও পাখির কলতান জানান দেয় বসন্তের আগমন। চলে আসে রঙের উৎসব দোল।ধীরে ধীরে জানান দেয় বছর শেষ হতে চলল,সঙ্গ দেয় গাজন।লাল বসন পরে একমাসের উপবাস শেষে চরক ঘুরিয়ে শেষ হবে পুরোনো বছর।স্বাগতম জানানো হবে নতুন বছরকে।
কিন্তু এবার সেসব কিছুই নেই, এক অজানা রোগের আতঙ্কে আমরা সবাই গৃহবন্দী।সমাজে থেকেও অসামাজিক জীবে পরিণত আজ আমরা।কেউ কারো সাথে মিশছে না,কারো বাড়ি যাচ্ছে না ,সবসময় এক আতঙ্ক।কি জানি কি হয়।ঘরে বসে জীবন না ভুল বললাম সময় কাটছে।সঙ্গী অবশ্যই টিভি ,সংবাদ পত্র এবং অতি অবশ্যই মোবাইল। হ্যাঁ এটা ঠিক চৈত্রের দাব দাহ থেকে রেহাই পাচ্ছি,কিন্তু কত কি হারাচ্ছি। যেমন এই গাজন , চৈত্রের দুপুরে ঢাক বাজিয়ে ঝুমুর বাজিয়ে যে ছেলেদের দল বাড়িবাড়ি ঘুরে মাগণ তুলতো,দেখা নেই আজ তাঁদের।আসলে হবে নাতো এবার চরক ,মেলা কোনোটাই।বাজার নিঝুম,ক্রেতা নেই ।দেখা নেই চৈত্র সেলের,বছরের এই সময় কেনাকাটার ধুম পড়ে, সে জামাকাপড় হোক,জুতো হোক ।বোশেখ পড়তে লেগে যায় বিয়ের মরশুম, সেই উপলক্ষে অনেকেই কিনে রাখেন অনেক কিছুই।কিন্তু এবার বিধি বাম ,সব বন্ধ।যেহেতু পয়লা বৈশাখ অবধি লকডাউন, তাই ওই দিন টা এবার মাটি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দু একবার পয়লা বৈশাখ পণ্ড হয়েছে কিন্তু মৃত্যু ভয়ে পন্ড আমার কেন অনেকেই হয়তো দেখেন নি।
কি করে হবে,দুমুঠো খাবারের জন্য মানুষ আজ রাস্তায়।দিনমজুর, বাগানের শ্রমিক, ভবগুরে সহ অজস্র এমন মানুষের মুখে দুমুঠো আহার তুলে দেওয়াই আজ আমাদের আশু লক্ষ্য।
ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্তের মতো পয়লা বৈশাখ হোক না হোক আজ বৈশাখ।কবির ভাষায় এসো হে বৈশাখ।
পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালীদের কাছে ক্রমশ একলা হয়ে যাচ্ছে
বটু কৃষ্ণ হালদার
সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ। ভারতবর্ষে প্রবেশ করার পর বিভিন্ন বৈচিত্র দেখে তার সেনাপতি সেলুকাসের উদ্দেশ্যেই এই উক্তি করেছিলেন সম্রাট আলেকজান্ডার। উক্তিটি তৎকালীন সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে এই উক্তির সত্যতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে।আসল সত্য হলো গ্রীক ভাষায় আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসকে কি বলেছিলেন সেটি পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি।সম্ভবত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা "চন্দ্রগুপ্ত" নামক নাটকে আলেকজান্ডারের আবেগঘন অনুভূতি র মুহূর্তটি সম্পর্কে লিখেছিলেন, সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র দেশ এই উক্তিটি। ভিন্ন ভাষাভাষী সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র হল পবিত্র ভারত ভূমি। ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির দেশে প্রতি মাসে কোন না কোন উৎসবে মেতে ওঠেন দেশবাসী। সেই বৈচিত্র্যময় দেশে বাঙালি সমাজ হলো এক অতি প্রিয় জনজাতি। কথায় আছে"বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ"। সে সমস্ত পার্বণের মধ্যে এক অতি প্রিয় উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ। একটি বাঙালির সার্বজনীন লোক উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ ও বৈশাখ মাসের প্রথম দিনকে বাঙালিরা আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়। কল্যানা নতুন জীবনের প্রতীক হলো বাঙালির হৃদয়ের উৎসব নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত সম্রাট আকবরের সময় থেকে। সে সময়ে নববর্ষ পালিত হতো অর্ত ব উৎসব বা ঋতু ধর্মী উৎস ব হিসেবে। কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষি কাজের সঙ্গে নববর্ষ উৎসবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কৃষি কাজের সুবিধার্থে মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে ১০/১২ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসন কে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে "ফসলি সন" নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়।
তৎকালীন সময়ে নববর্ষ পালনের এক বিশেষ তাৎপর্য ছিল।সে সময় বাংলার কৃষকের চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীর খাজনা পরিশোধ করতো। পরেরদিন নববর্ষ স্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। উপলক্ষে তখনকার সময় মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।সেই থেকে পারিবারিক ও সমাজ জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখর হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভ দিন হিসেবে পালিত হয়ে থাকে বর্তমানে। অতীতের সেই চিরাচরিত ধারা বাংলা নববর্ষের উৎসব ছিল "হালখাতা"। এটি পুরোপুরি একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামেগঞ্জে নগরের ব্যবসায়ী রা নববর্ষের প্রারম্ভের তাদের পুরোনো হিসেব-নিকাশ সম্পন্ন করে নতুন খাতা খুলতে ন।উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন খদ্দেরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসুত্র স্থাপন করতেন চিরাচরিত অনুষ্ঠানটি আজো পালিত হয় আন্তরিকতার সঙ্গে তবে আধুনিকতার ঠেলায় দিন দিন এসব উৎসবের জৌলুস অনেকটাই ম্লান হয়ে আসছে।
নববর্ষ উৎসব বাংলার গ্রাম্য জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দিনটিকে ঘিরে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের উদ্দীপনা,উন্মাদনার শেষ থাকেনা। নববর্ষের আগে তারা ঘরবাড়ি ব্যবহার্য সামগ্রী সমস্ত কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। শুধু তাই নয় কৃষিভিত্তিক বাংলার কাছে এই দিন টা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পহেলা বৈশাখের ভোরের বেলা গৃহস্থের কর্তারা নিজ নিজ চাষের জমি, বাস্তুভিটা তে খড়ের আঁটি দিয়ে আগুন জ্বালায়। এই দিনে বাঙালির ঘরে ঘরে শিল নোড়া দিয়ে নিমপাতা ও কাঁচা হলুদ বাটা হয়। তারপর সেই মিশ্রণে একটু সরিষার তেল দিয়ে সবার প্রথমে মাখানো হয় বাড়ির গরু,ছাগল সহ নানান গৃহপালিত পশুকে। তাদেরকে নদীতে কিংবা বাঁধে নিয়ে গিয়ে স্নান করানো হয়। এরপর বাড়ির ছোটরা সমস্ত বড়দের পায়ে সেই মিশ্রণ দিয়ে আশীর্বাদ নেন। এই প্রাচীন রীতিনীতি বাঙালি সমাজে বহু যুগ ধরে চলে আসছে। তবে ইদানিং এইসব রীতিনীতি জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। সকালে স্নান সেরে সবাই পবিত্র হয়। সাধ্যমত নতুন বস্ত্র পরার চেষ্টা করে বাঙালিরা। নববর্ষের টানে ঘরে ফিরে আসে বাইরে থাকা সন্তানরা, আগমন ঘটে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের। এই দিন বাঙালির ঘরে ঘরে নানান পদের সমাহারে একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে।
নববর্ষকে উৎসব মুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। বিভিন্ন জায়গায় এই মেলার মাধ্যমে বৈশাখী উৎসবকে পালন করা হয়ে থাকে।স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য কারুপণ্য লোকশিল্প জাতীয় পণ্য কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর হস্তশিল্প সামগ্রী এই মেলার বিশেষ আকর্ষন। আবার কোথাও কোথাও এই মেলায় গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতি যেমন _যাত্রা পালা গান,কবি গান,জারি গান,গাজন গান,লোকসংগীত,বাউল সংগীত, ভাটিয়ালি গান পরিবেশন করা হয়ে থাকে।আবার লায়লা মজনু,ইউসুফ জুলেখা,রাধাকৃষ্ণের,মতো প্রভৃতি আখ্যান উপস্থাপিত করা হয় কোথাও কোথাও। আবার কোথাও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী,নাটক, পুতুল নাচ,নাগরদোলা,সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে।তাছাড়া শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ ছিল "বায়স্কোপ"। বর্তমান সমাজে এই বাইস্কোপ একেবারে হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। তবুও এসবের কারণ এই বৈশাখী মেলাকে বাঙালি সমাজের আনন্দঘন লোক সংস্কৃতির ধারক ও বলা হয়।
বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় পাল্টেছে নাগরিকদের জীবনযাত্রার ধরন। চারিদিকে বেড়ে চলেছে প্রতিযোগিতার পাল্লা। সময় কে কিনে নেবার প্রয়াস। বিশ্ব আজ তালুবন্দি। এসময় মানুষ প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতি ছেড়ে আপন করেছে এন্ড্রয়েড সেট ও ইন্টারনেট। বাঙালিয়ানা খাবার ছেড়ে সবাই হয়েছে রেস্তোরা মুখি। ভাত,ডাল,মাছআলুভাজা, পোস্ত ছেড়ে বাঙালি এখন চাউমিন, বিরিয়ানি চিকেন কাবাবে অভ্যস্ত হয়েছে। বাইরের জাঙ্ক ফুড খাওয়ার ফলে মানুষ নিজেদের বিপদ নিজেই ডেকে আনছে অজান্তে। মানুষ অল্পতেই রোগব্যাধি গ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অল্প বয়সে মাথার চুলে পাক ধরেছে, চুল ঝরে গিয়ে বাড়ছে টাক ধারি মানুষের সংখ্যা। অল্প বয়সে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যাচ্ছে। দিনে দিনে সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারাচ্ছে নারীরা, সেই সঙ্গে বাড়ছে বিকলাঙ্গ সন্তানের সংখ্যা। তবুও কারো হুশ নেই। ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে বাঙালি আর টাই তে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইংরেজি আর হিন্দি ভাষার চাপে ভুলতে বসেছে বাঙালির অতিপ্রিয় বাংলা ভাষাকে। ধুতি-পাঞ্জাবি ভাত ডাল মাছ আলু পোস্ত ছেড়ে বাঙালি নিজের ভাষা সংস্কৃতি কে হারিয়ে অন্য ভাষা সংস্কৃতির দাস হয়ে যাচ্ছে।নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করার প্রবণতা সবথেকে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যুব সমাজের মধ্যে। যাদের মধ্যে আগামী ভবিষ্যতের স্বপ্নের বীজ লুকিয়ে থাকে, সেই যুবসমাজের হাত ধরেই লেখা হবে বাঙালির প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির নিধনের ইতিহাস। তার জীবন্ত নিদর্শন হল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তি ঘটছে পুরানো সভ্যতা-সংস্কৃতি। যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পূণ্যাহ উৎসব এর বিলুপ্তি ঘটে। তখন পহেলা বৈশাখ ছিল জমিদারদের পুণ্যাহ র দিন।সেই সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানো গরুর দৌড় ঘোড়া দৌড় ষাঁড়ের লড়াই মোরগ লড়াই পায়রা উড়ানো নৌকা বাইচ বহুরূপী সাজ ইত্যাদি ছিল গ্রাম বাংলার অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বিশেষ আকর্ষণ। আধুনিক থেকে আধুনিক তর হওয়ার লক্ষ্যে আজ এসব হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা-সংস্কৃতি পরিণত হয়েছে। যার ফলে বাঙালির অতিপ্রিয় পহেলা বৈশাখ ক্রমে ক্রমে একলা হয়ে যাচ্ছে।
পহেলা বৈশাখ ও কিছু স্মৃতি
মজনু মিয়া
আমরা কিছু বন্ধু একাত্র হয়ে পহেলা বৈশাখের দিনে চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় যেতাম,অনেক ঘুরাফেরা শেষে বিকেল বেলায় মেলায় চৈত্র পূজার চরক গাছ ঘুরাত তা দেখতাম। মেলা থেকে বাঁশি পুতুল বেলুন আরো অনেক খেলনা কিনে আনতাম সাথে খাবার জন্য কিনে আনতাম বিন্নি খই আর চিনি দিয়ে তৈরি হাজ তাতে নক ঘোড়া মুকুট মুরগ হাতী থাকত। বাড়ি আসার সময় উত্তর পশ্চিম কোণে মেঘ করে কালো হয়ে আকাশ ছেঁয়ে যেত ঝড় তুফান আর বৃষ্টি শুরু হতো কোনো দিন পথেই ধরত আবার কোনো দিন রাতে আসত।
বাড়ি ফিরে এলে,,মসজিদের মুন্সী সাহেব ডেকে বলত ঐ মেলায় মুসলমানের যেতে হয় না কারণ ইহুদীরা মুসলমানদের অপমান করেছিল আর ইসলাম ধর্মকে লাঞ্ছিত করেছিল তাই। মা বাবাও তাই বলত কিন্তু অনেক আগে থেকে মেলায় আনন্দ করার জন্য সবাই যায় তাই আমরাও যেতাম। সকাল বেলা মা বলত তোর দাদী তিত বংকই গোটা দিয়ে গেছে আর শুকনা বড়ই মিঠাই দিয়ে জ্বালদিয়ে দিত বলত খা -খেলে পরে শরীরে খোঁচ পচড়া হয় না।আর এক ধরনের লতাপাতা তুলে দিত বলত ঘরের সামনে যখানে পা দিয়ে বাহির ও ভেতরে যেতে হয় সেখানে শ্বাস বন্ধ করে পুঁতে দিতে তাতে নাকি ঘরে সাপ ঢুঁকতে পারত না।
আর সবাই কে ডেকে ডেকে বলত আজ পহেলা বৈশাখ কেউ গোসল ছাড়া থাকবি না। গোসল ছাড়া থাকলে সারা বছর অপবিত্র থাকা হয়। আর ভালো ভালো রান্না করত মা তা খেতে দিত বলত আজ ভালো খেতে হয়। মা কেও মনে পড়ে এই পহেলা বৈশাখ এলে পরে।
সাপ্তাহ জুড়ে বৈশাখের মেলা বসত তাতে নাচ গানের আয়োজন হতো।নানান ধরনের ফসরা সাজিয়ে বসত দোকানিরা ছোট ছোট ছেলে মেয়ের জন্য হরেক রমক জিনিস থাকত তাতে। এতে বড়দের অনেক কাজের জিনিসসহ নানান জিনিস থাকত। একে অপরের সাথে দেখা হলে ভালে মন্দ কথা জানতে চাইতে বাড়ি এলে আপ্পায়ন করা হতো। সেই সব এখন খুব দেখা যায় না।তবুও একটু ভিন্ন সাজে হলেও বৈশাখের আয়োজন হয়ে থাকে কিন্তু এ বছর বিশেষ এক মহামারি রোগ আসাতে বৈশাখের কোনো আয়োজন বা মেলা সহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরও অনুষ্ঠান রোহিত করা হয়েছে।তবুও ভেতরে ভেতরে সবাই সবাইকে জানাই বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
ভ্রমণ
ত্রিপুরা ও রবীন্দ্রনাথ
কাকলি ভদ্র
ভারতের অন্যতম প্রান্তিক রাজ্য ত্রিপুরা আয়তনে ছোট হলেও ঐতিহ্য ও শিল্প সংস্কৃতিতে সুমহান। সুপ্রাচীন সংস্কৃতিসম্পন্ন ত্রিপুরার সঙ্গে বঙ্গ সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোত ভাবে।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ত্রিপুরার রাজ পরিবার আর ত্রিপুরার মানুষের যোগাযোগ নিয়ে নতুন করে বোধহয় আর বিশেষ কিছু বলবার নেই।ত্রিপুরার রাজবংশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল
(মালঞ্চ নিবাস, আগরতলা)
ত্রিপুরার হৃদয়ের সঙ্গে যোগ।একসময় তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের একটি কাব্যগ্রন্থ সদ্য পত্নীহারা এক শোকাহত ত্রিপুরা নরেশের হৃদয়কে দিয়েছিল অনাবিল শান্তির পরষ। জোড়াসাঁকোর সেই তরুণ কবিকে নিজের রাজ দরবারের সভাকবি করার প্রস্তাব নিয়ে রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের প্রধানমন্ত্রী রাধারমণ ঘোষ হাজির হয়েছিলেন কবির বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ রাজি হন নি বটে, কিন্তু ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সঙ্গে কবির বন্ধুতার সেই ছিল শুভারম্ভ। কবিগুরু সর্বপ্রথম ১৩০৬ সালে আগরতলায় আসেন। এরপর বারবার রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা গিয়েছেন রাজ অতিথি হয়ে।রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজপরিবারের দ্বন্দ্ব নিয়ে রাজর্ষি নামক একটি উপন্যাস রচনা করেন। এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১২৯৩ বঙ্গাব্দে। এই উপন্যাসের প্রথমাংশ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ 'বিসর্জন' নামে একটি নাটক রচনা করেন যা আজও রক্তকরবীর পর রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ নাটক বলে বিবেচিত হয়। এই নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১২৯৭ খ্রিষ্টাব্দে।ধর্ম যে নিছক এক আনুষ্ঠানিকতা নয়, নয় শুধু লোকাচারের অনুশাসন, বরং সত্যিকার ধর্ম হলো মানব কল্যাণের- তাঁর এ ভাবনার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ "বিসর্জন" নাটক।
(উজ্জয়ন প্রাসাদ, আগরতলা)
রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছিলেন মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।মহারাজ বীরচন্দ্রের আমল থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার যোগাযোগ শুরু হয়েছিল।মহারাজ বীরচন্দ্র , রাধাকিশোর , বীরেন্দ্রকিশোর এবং বীরবিক্রমের সঙ্গে কবিগুরুর গভীর সম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন মহারাজাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি , সংগীত , নৃত্যকলা প্রসারে শুভ ও সৎ পরামর্শ দিতেন। ত্রিপুরার আগরতলায় রবীন্দ্রনাথ সচরাচর যে বাড়িটিতে থাকতেন সেটি হল মালঞ্চ নিবাস এবং এখানে বসেই রচনা করেছিলেন তাঁর ‘বিসর্জন’ নাটকটি।কিশোর রবীন্দ্রনাথকে আগরতলার উমাকান্ত একাডেমীতে "কবি সম্বর্ধনা " জ্ঞাপন করেন। ত্রিপুরার সর্বশেষ মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য কবিগুরুকে “ভারত ভাস্কর” উপাধিতে ভূষিত করেন।রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে ত্রিপুরার অনেক কৃতি সন্তান বিশ্বভারতীতে শিক্ষাগ্রহণ করেন।শান্তিনিকেতনের উন্নয়নে বীরবিক্রম মাণিক্য মুক্ত হস্তে অর্থ দান করেন।রবীন্দ্রনাথের বন্ধু বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু বিলেতে গিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা করবেন। তাঁর অর্থ চাই প্রচুর। কবি স্বয়ং অর্থ সংগ্রহে নামলেন। মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য সানন্দে এগিয়ে এসে সেকালে ৫০ হাজার টাকা জগদীশ চন্দ্রের বিজ্ঞান সাধনায় দান করেন। অকুণ্ঠভাবে বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।
নেই ত্রিপুরা রাজতণ্ত্র।নেই কবিগুরু । কিন্তু আজও ত্রিপুরাবাসীর হৃদয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চির উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
রম্য রচনা
করোনা-কাহিনী
বুদ্ধদেব দাস
ভীষণ হইচইতে যমরাজের ঘুম ছুটে গেল। রাগে আগুন হয়ে যমরাজ হেঁড়ে ডাক দিলেন – চিত্রগুপ্ত, একি হচ্ছে? চারিদিকে এত গণ্ডগোল কিসের?
চিত্রগুপ্ত পিঁড়ির উপর উপুড় হয়ে নাক ডেকে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছিলেন। হঠাৎ এমন হেঁড়ে আওয়াজ শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তড়াক্ করে লাফিয়ে যমরাজের পায়ের কাছে ছিটকে পড়ে বললেন – কি… কি... কি হয়েছে প্রভু?
- সারাবেলাতো ঘুমিয়ে কাটালে। কি খোঁজ খবর রাখো? এরকম করে আরকদিন চলবে? একদিন দেখবে মর্ত্যের মানুষ এসে পেন্দিয়ে পোস্তা বানিয়ে দেবে। যাও, গিয়ে খোঁজ নাও। অফিসের বাইরে এই অসময়ে এত হল্লা কিসের?
চিত্রগুপ্ত চোখ রগড়াতে রগড়াতে বাইরে গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া। ছুটে ভেতরে এসে যমরাজকে বলে – মাফ করেন, প্রভু। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। লাখখানেক ভুতপ্রেত এসে হল্লা করছে। স্বর্গ-নরকে তিল ধারনের জায়গা নেই। এতজনে থাকবে কোথায়?
- কি বল কি চিত্রগুপ্ত ! এমন বিভ্রাট হল কি করে? পাজি, নচ্ছার কোথাকার। অকর্মার ঢেঁকি। আবার দাঁত বের করে হাসি হচ্ছে। দাঁড়াও হাসি বের করাচ্ছি।
- প্রভু, ভুল হয়ে গেছে, স্যার।
- (তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে) তোকে না কতবার বলেছি আমাকে ‘স্যার’ বলবি না। ‘প্রভু’ বলবি।
- থুড়ি। প্রভু স্যার।
- তা কি করে এতবড় ভুল হল শুনি? (রাগের চোটে) কি এমন মহৎ কর্মে মগ্ন ছিলে, বাবা?
- না প্রভু। এতে আমার কোন ত্রুটি নেই। ওই করোনার জন্যই এত কাণ্ড ঘটেছে।
- করোনা? (অবাক হয়ে) সে আবার কে?
- একজন যমদূত। গেল জানুয়ারীতে নিয়োগ করা হয়েছে, প্রভু।
- আমি জানলাম না নিয়োগ হয়ে গেল। আমার সাধের নরক দুর্নীতিতে ভরে গেল। এবার নরকেও ঘাপলা শুরু হয়ে গেল।
- ঘাপলা কোথায় প্রভু? মর্ত্যের মানবসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যমদূত নিয়োগ করা হয়। গত পাঁচ-সাত বছর নিয়োগ হয়নি। কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিল। সীমিত কর্মচারীর উপর চাপ বাড়ায় কথায় কথায় ধর্মঘট হচ্ছিল। যমদূত নিয়োগে আপনার গা-ছাড়া মনোভাব দেখায় আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে কয়েকজন যমদূত নিয়োগ করেছি, প্রভু।
- (একটু থতমত খেয়ে পরে নিজেকে সামলে নিয়ে) তুমি আমার কর্মচারী হয়ে আমারই ভুল ধরো! এত বড় আস্পর্ধা?
- (দু হাত জড়ো করে) মাফ করবেন, প্রভু।
- আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। যাও করোনাকে ডাকো।
খানিকবাদে চিত্রগুপ্ত চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে এক কালো কুচকুচে শক্ত-সমর্থ জোয়ানকে ধরে নিয়ে এল। মাথায় তার ভয়াল ভয়ঙ্কর মুকুটের সাজ দেখে যমরাজ অট্টহাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন – তোর মাথায় একি সাজ?
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে করোনা বলতে লাগল – কি বলব হুজুর। মানুষরা আজকাল যমদূতের ভয় পায় না। উল্টে উপহাস করে। ডাক্তার বলে এক রকমের লোকেরা রীতিমত মানুষকে মরতেই দেয় না। তাই অনেক রকম ভয়টয় দেখিয়ে, কখনও কখনও ধমক টমক দিয়ে কসরত করে তবেই কাজ সমাধা করতে হয়। আর কখনও কখনও ....
- থাম, থাম, থাম। কথায় কথায় খই ফোটাতে হবে না। এত বড় ভুল হলটা কি করে?
- (কাঁদো কাঁদো গলায়) আমার কোন ভুল হয়নি, স্যার।
- তবে কার ভুল শুনি।
- (কয়েক তাড়া কাগজ দেখিয়ে)চিত্রগুপ্ত স্যার একদিন এইগুলো দিয়ে বললেন যা এদেরকে যত তাড়াতাড়ি পারিস নরকে নিয়ে আয়।
চিত্রগুপ্তঃ- এ্যয় এ্যয় ব্যাটা নচ্ছার। তোকে আমি এতগুলো কাগজ দিয়েছিলাম? যে যার কাজ যে যার নামে লিখিত আছে। কোন দেশে কে ডিউটি করবে তা ভাগ করা আছে। তোকে তো শুধু তোর নামের কাগজটা নিতে বলেছিলাম।
যমরাজঃ- এই ব্যাটা, তোর কোয়ালিফিকেশন কি?
করোনাঃ- স্যার, আমি ফোরে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পাশ করতে পারিনি।
যমরাজঃ- এ্যাঁ! একি শুনছি চিত্রগুপ্ত । তুমিতো জানো, আপাতত মিনিমাম গ্র্যাজুয়েশন ছাড়া নিয়োগ হয় না। নরক রাজ্যে একি বেনিয়ম! একি দুর্নীতি!
চিত্রগুপ্তঃ- ব্যাটা! নচ্ছার! তখন গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেট দেখিয়ে এখন বলা হচ্ছে ফোর পাশ করতে পারিনি।
করোনাঃ- এখন আমাকে বকছেন কেন? আমিতো তখন সব বলেছিলাম। আপনিতো আমাকে বললেন যদি আমি আপনাকে মর্ত্য থেকে দুবেলা দুছিলিম গাঁজা এনে দিতে পারি তবে নকল সার্টিফিকেট বানিয়ে নিয়োগ দেওয়া আপনার কাছে নস্যি।
যমরাজঃ- এ কথা শোনার আগে আমার মৃত্যু হল না কেন? (নিজেকে সামলে নিয়ে) না না না, এ আমি কি প্রলাপ বকছি? যমরাজের কি মরণ হয়! যাকগে, দেখোতো চিত্রগুপ্ত, কতজনে আগাম শমনবার্তা পেয়েছে?
চিত্রগুপ্তঃ- (কাগজের তাড়িগুলোতে চোখ বুলিয়ে) তা প্রায় এক কোটি হবে।
যমরাজঃ- এতজনে রাখবে কোথায়? সকল ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। শাসনতন্ত্র যে অচল হয়ে পড়বে।
এমন সময় দরজায় ধাক্কাধাক্কির ও কোলাহলের শব্দ শোনা গেল।
যমরাজঃ- যাও চিত্রগুপ্ত, দেখো দরজায় ভালো করে ছিটকিনি লাগানো হয়েছে কিনা। না হলে যাও ভালো করে ছিটকিনি লাগিয়ে আসো। কখন কি অঘটন ঘটে যায় তার ঠিক নেই।
চিত্রগুপ্তঃ- ঠিকঠাক লাগানো আছে, প্রভু।
যমরাজঃ- দেখোতো চিত্রগুপ্ত, কতজনে মর্ত্য থেকে তুলে আনা হয়েছে?
চিত্রগুপ্তঃ- তা প্রায় কুড়ি লক্ষের মতন হবে।
একথা শুনে অ্যাঁ অ্যাঁ গোঁ গোঁ করতে করতে যমরাজ সিংহাসনে ঢলে পড়লেন।
চিত্রগুপ্ত ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে ‘জল আনো, জল আনো’ বলে ঘরের ভেতর দৌড় লাগালেন।
কবিতা/ছড়া
ছায়াপথ-মায়াপথ
নারায়ন ভৌমিক
অলীক শূন্য এ ছায়াপথে
নস্ট্যালজিয়ার কলম ছুঁয়ে
তৃপ্তির শেষ কনা
আলেয়ার মিছে মিথে
কিছু গূড় কথা সেঁকে নেওয়া
চাঁদ রাতে
নগ্ন হই যুবতীর চোখের ভাষাতে
তাজা ল্যাভেন্ডারের গন্ধ
চুঁয়ে পরে বিজ্ঞাপনী চুল ছোঁয়া
পূর্নিমাকে অস্বিকার করি আয়েশে,
অমাবস্যাকে জড়িয়ে থাকি
নিষিদ্ধ পল্লীর ওই মেয়ে টি থেকে যায় আবেশে
হাতের মুঠোয় নীল খাম
কালের পিঠে.. অশ্বমেধের ঘোড়া
জলতরঙ্গে ভেসে যায়
প্রথম প্রেমের আনার কলি দিন সুর মোরা
আকাশ, ঘুড়ি.. দুর ছাই
পুতুল পুতুল তুমি
মুখপোঁড়া ছেড়ে গেছে নাটাই।
সময়
দীপ্তিমান মোদক
ঘরে অনেকগুলো পেট,
হাড়ির তলায় লেগে থাকা পোড়া ভাতও নিংড়ে নিতে হচ্ছে।
বাইরে কঠিন অসুখ,
পরিস্থিতির সাথে পেরে উঠতে পারছি না।
দিনের রোজগার রাতে শেষ হয়ে যাওয়া, মানুষগুলোর তালিকায় আমিও।
একদিকে পেটের জ্বালা , অন্যদিকে এই কঠিন অসুখ
ভয় দুটোতেই, যেহেতু মৃত্যু দুটোতেই।
গভীর রাতে প্রিয়জনের মুখগুলো ভেসে ওঠে,
সবার কত স্বপ্ন দেখা বাকি।
তবুও টিকে আছি, একটা ভালো সময়ের আশায়
এখনো ইচ্ছেগুলো পূরণ করা যে বাকি....
সাপ সিঁড়ি খেলা
রুনা দত্ত
সাপ সিঁড়ি খেলার মতো
জীবনের খেলায়ও
কেউ তরতর
করে উপরে উঠে যায়
কেউ আবার দুম করে
নীচে পড়ে যায়
কেউ কেউ আবার
লুডোর ঘুঁটির মতো
এঘরে ওঘরে দান মেরেই
জীবনটা কাটিয়ে দেয়
জীবন আর লুডোর
সাপ সিঁড়ি ভাঙা
অংকর হিসেবটা
একদম জলের মতোই
আপাত সহজ সরল
হয় ছক্কা নয় শূন্য ....
চুপিচুপি
রাতুল দত্ত
অন্ধকার থেকে সন্তর্পে বেড়িয়ে
দিনের আলোতে এলাম যখন
দেখি পাখি জাগা দিন
বসে আছি নীড়ের প্রান্ত ধরে
নিথর ঠোঁট কথা বলেনি
অপলক দূর... দৃষ্টি ---
টুপ...টুপ...বৃষ্টি পরছে
ভিজছি কেবল
চুপি... চুপি
আমরা আছি....বেঁচে আছি
সুস্মিতা পাল কুন্ডু
আমাদের চাহিদা গুলো সীমিত,
তবুও যুদ্ধ করতে করতে
জীবনটা বড়ো বিধ্বস্ত .....
একদিক পূরণ করতে গেলে
অন্যদিকে প্রকট হয় বৈসাদৃশ্য ...হা অদৃষ্ট !
সবটাই জানা , আমরা যারা মধ্যবিত্ত ....
এক আকাশ ইচ্ছেরা ডানা মেলে কখনো সখনো ;
দৌড় করায় ওড়ার অছিলায় ,
কিন্তু একসময় থমকাতেই হয় ...
ঠোক্কর খেতে খেতে অভিমান এসে জড়ায় ,
বলে... 'কে বলেছে এসব তোর জন্য ? '
ঘুম পাড়াতে চেয়ে তাদের কোণঠাসা করে জব্দ
হৃদয়পুরে জমে ওঠা কান্নাদের সংবরণে চোখ অভ্যস্ত ;
বলে ওঠে ,
' যা সমাধান করা কষ্টসাধ্য ...সেটাই জীবনের জটিল উপপাদ্য '
সবটাই জানা ,আমরা যারা প্রকৃত মধ্যবিত্ত ....
অবশ্য হার না মানার জেদ ,জিতিয়ে দেয় কিছুসময় অন্তত --
এটাই তবে ভবিতব্য ....!!
খোঁজ
ফিরোজ হক্
বহুদিন তোমাকে ছুঁয়ে দেখিনি
কবিতা।
তোমার কাছে যাওয়ার শত চেষ্টাতেও
যেতে পারিনি কাছে।
আমার মনে প্রাণে তুমি থাকলেও
তুমি আর আমাতে ধরা দাও না।
আমি ক্রমশ তোমায় খুঁজে বেড়াই
হাটে-বাটে,মাঠে-ঘাটে।
কোথাও তোমার দেখা মেলেনি
চারিদিক নির্জন,
রাস্তাগুলি খাঁ খাঁ করে চেয়ে থাকে
বোবা মানুষগুলির অদ্ভুদ চাহনি
খেয়ে ফেলেছে তোমায়।
আমি আর তোমাকে খুঁজে পাইনা
কবিতা।
একবিংশের কথা
ছবি ধর
একবিংশের কাছে ইতিহাস হয়ে থাক আমাদের কথা l
হিমাচল থেকে অরুণাচল পর্যন্ত কথারা শব্দ নয়
অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো বিছিয়ে যাক
ধূলিকণা , পত্র পল্লবে ,পান্থশালায় ,চৌরাস্তার বাঁকে l
দূষণে প্লাবনে বিপন্ন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া কথাদের
আবার জুড়ে দেই কলমের নিষ্ঠায় প্রগতির দিকে l
প্রতিবাদ জাগিয়ে তুলুক , ঘুমন্ত শিশুকালের l
ভেঙে দিক বৈষম্যের সেতু
জুড়ে দিক একতার সাঁকো
মুছে দিক দূষণ l
ঐকতানের মেলবন্ধনে যুক্ত হোক মানুষ l
যন্ত্রণা বুকে কথারা হেঁটে যায় নদী পাহাড়ী পথ ---
সহিষ্ণুতা আর সংযম পাথেয় ক'রে
কোনো মুনি ঋষির পায়ের কাছে বসে "পাখি পড়া "
রাম রাম আওড়ে নয় ,
তিলক মালায় সেজে নয় ,
নীতিকথার মতো নয় ,
রূপকথার গল্পের মতো নয় ,
সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রাঞ্জল কথারা অন্তর বিন্যাসের
মাধ্যমে করুক যাত্রা l
মিছিল
সায়ন তরফদার
যদি দ্যাখো কখনো, কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে মিছিল।
আর স্লোগান "কবিতা দীর্ঘজীবী হোক"।
অবাক হবে খুব?
যদি পাঠক এসে লাঠিচার্জ করে
কবিদের হটিয়ে দেয়, অবাক হবে খুব?
প্যারামাউন্ট থেকে যদি 'সনেট' নামক
কোনো শরবত খাই, যদি তোমার ভেজা
চুলে লিমেরিকের গন্ধ পাই,
আশ্চর্য মনে হবে, না?
এ শহরের ছন্দ কেটে গেলে, তখনও
কি অবাক হবে না তুমি?
স্বগতোক্তি
রকি মিত্র
রকি মিত্র
প্রতিদিন মানুষ হওয়ার যে আপেক্ষিক গতিতে হাঁটছে জীবন-
আমি প্রতিনিয়ত পথ মাপি তার
প্রতিনিয়ত নিজেকে করি সমর্পন।
মনে হয় আমি ভেসে চলেছি
কোনো এক সুদূর প্রাচীন টেরানোভা নিয়ে আটলান্টিকের বুকে,
আমার সাহারা মনের প্রান্তদেশে-
এখনও বাস করে 'তুমি' নামের সেই ক্ষণিকের জলরাশি,
আমি প্রতিদিন তার হাত টেনে ধরি
প্রতিদিন তার পাশে গিয়ে বসি।।
এক এক সময় মনে হয়
যেন খুবলে খাচ্ছে রোজ কেউ ,
যেন বনস্পতির বুক চিঁড়ে এদিকেই ধেঁয়ে আসছে আরেকটা দাবানল,
যেন সুনামি আছড়ে পড়েছে ওই তীরে
যেন পুঁড়ে যাচ্ছে এদিকে সব অনর্গল।
এ অনেকটা কাঙ্গালের অবলম্বনের মতো
যেন দশ বিশটা হিমালয় পেরিয়ে বুঝতে শিখেছি
সম্পর্কগুলো কি নিটোল মলিনে গড়া,
সম্পর্ক গুলো কি নিদারুণ পরিণতি চায়!
যেমনটা আমি সামলাতে শিখিনি ঢেউ --
যেমনটা আঁকড়ে ধরি তাকে,সে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ায়।
আমি প্রতিনিয়ত পথ মাপি তার
প্রতিনিয়ত নিজেকে করি সমর্পন।
মনে হয় আমি ভেসে চলেছি
কোনো এক সুদূর প্রাচীন টেরানোভা নিয়ে আটলান্টিকের বুকে,
আমার সাহারা মনের প্রান্তদেশে-
এখনও বাস করে 'তুমি' নামের সেই ক্ষণিকের জলরাশি,
আমি প্রতিদিন তার হাত টেনে ধরি
প্রতিদিন তার পাশে গিয়ে বসি।।
এক এক সময় মনে হয়
যেন খুবলে খাচ্ছে রোজ কেউ ,
যেন বনস্পতির বুক চিঁড়ে এদিকেই ধেঁয়ে আসছে আরেকটা দাবানল,
যেন সুনামি আছড়ে পড়েছে ওই তীরে
যেন পুঁড়ে যাচ্ছে এদিকে সব অনর্গল।
এ অনেকটা কাঙ্গালের অবলম্বনের মতো
যেন দশ বিশটা হিমালয় পেরিয়ে বুঝতে শিখেছি
সম্পর্কগুলো কি নিটোল মলিনে গড়া,
সম্পর্ক গুলো কি নিদারুণ পরিণতি চায়!
যেমনটা আমি সামলাতে শিখিনি ঢেউ --
যেমনটা আঁকড়ে ধরি তাকে,সে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ায়।
আমি জানি এ তীব্র চাওয়ার কোনো সীমানা নেই,
তটরেখা লেখা নেই বাতাস কিংবা আগুনে
এই যে যন্ত্রণাকে দু হাত ভরে পাওয়া
ধীরে ধীরে দুটিতে কাছাকাছি যাওয়া -
মানুষ হওয়ার এমন গভীর মন্ত্র ,
কে কবে পেয়েছিল, কোন রণে?
আমি দূর থেকে দেখি
তোমার আকাশ ভরেছে যে বকুল ফুলে , আমি তার গন্ধ গায়ে মাখি বসে মাস্তুলে
আমার স্বপ্নের সেই রাজপথ আর বাস্তবের এই ডেকের নগরী
যতদূর চোখ যায় আমি শুধু দেখে যাই
আর যাই হোক প্রেমকে কি আমি জ্বালিয়ে দিতে পারি??
তটরেখা লেখা নেই বাতাস কিংবা আগুনে
এই যে যন্ত্রণাকে দু হাত ভরে পাওয়া
ধীরে ধীরে দুটিতে কাছাকাছি যাওয়া -
মানুষ হওয়ার এমন গভীর মন্ত্র ,
কে কবে পেয়েছিল, কোন রণে?
আমি দূর থেকে দেখি
তোমার আকাশ ভরেছে যে বকুল ফুলে , আমি তার গন্ধ গায়ে মাখি বসে মাস্তুলে
আমার স্বপ্নের সেই রাজপথ আর বাস্তবের এই ডেকের নগরী
যতদূর চোখ যায় আমি শুধু দেখে যাই
আর যাই হোক প্রেমকে কি আমি জ্বালিয়ে দিতে পারি??
এই সময়, জীবন সত্য
রবিনা সরকার
১.
এই সময় সুযোগ দিলো,
ব্যস্ততার মাঝে হারিয়ে...
আমরা হারিয়েছি মনের যে ইচ্ছেগুলো,
আবার তাদের যত্নে গড়তে।
২.
এই সময় জানিয়ে দিলো,
প্রিয়জনদের মাঝে কাটানো মুহূর্তরা,
জীবনের সংগ্রামে...
হারিয়েছিলো কয়েক যোজন দূরে।
৩.
এই সময় শিখিয়ে দিলো,
বিলাসিতার ঘেরাটোপে...
প্রয়োজনের জিনিস,
ভীষণভাবেই অল্প ছিলো।
৪.
এই সময় দেখিয়ে দিলো,
প্রকৃতির শান্ত চরিত্রে,
মানবজাতি কতটা অশান্ত।
৫.
এই সময় বুঝিয়ে দিলো,
জাতি, ধর্ম, রাজনীতির উর্ধে,
মানবধর্ম ও জীবনই চিরসত্য।
হে ঈশ্বর
স্বপন কুমার চট্টোপাধ্যায়
ঈশ্বর তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?
উঠ জাগো এখন অনেক রাত
পাখিটা তোমার কাছে গেছে
নালিশ জানাতে,
ওর বুকে তোমার বিরুদ্ধে
জমা আছে প্রচুর অভিমান
ঘুমিয়ে পড়না ঈশ্বর
ওঠ জাগো, এখন গভীর রাত।
কারা যেন পাহাড়ে জ্বালায় আগুন
সবুজ ধ্বংস করতে চায় ওরা
পাখিটি পারতো নিজেকে বাঁচাতে
আগুন দেখে উড়ে চলে যেতে
ওরা তো মানুষ নয়
মা কে ফেলে রেখে চলে যায়নি।
বন্য পশুর দল পাহাড়ের কোলে
মায়ের মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করেছে।
ঈশ্বর তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?
ওঠ জাগো এখন গভীর রাত।
সভ্যতার পোশাক পরা মানুষ
তোমার সৃষ্টি কে পুড়িয়ে দিতে চায়
হে ঈশ্বর তোমার সৃস্টি কে বাঁচাও।
অন্য বৈশাখ
প্রতিভা পাল সেন
এবারের বৈশাখ, অন্যরকম-অনেকটা!
অন্য-এক আবহে তার আগমন;
শত বিমর্ষ-আঁচড়, আঁকড়ে ধরেও
যখন, বেঁচে থাকার অবসন্ন-দিনযাপন!
এবারের বৈশাখ অন্যভাবে সাজানো!
স্থবিরতা মেখেছে সময়ের-অবসাদ;
সম্পর্কহীন সামাজিকতার আঙিনায়-
মুখ-ঢেকেছে এবারের বৈশাখ!
ভারাক্রান্ত বৈশাখী-বাতাস এবার
রিক্ত হয়েছে অন্য অজুহাতে!
কে-যেন লিখছে বিষণ্ণ-স্বরলিপি -
জনহীন, শুনসান পথের প্রান্তে!
কালবৈশাখীর প্রমাদ-গোনা বিকেল
আগেও এসেছে কতবার এ-বৈশাখে!
বন্ধ-ঘরের মন-বন্দি খেলায়-
এবার, ঝড় এসেছে অন্য এক স্বাদে!!
তিস্তাবঙ্গ
আকাশ ছোঁয়ার দৌঁড় তো আর নেই
এবার এগিয়ে এসো
চৌকাঠ না পেরনোর গল্পটা সঙ্গে এনো
কিছু পরেই তিস্তাবঙ্গ
এখানে এখনও ভাটিয়ালি স্ক্রিপ্ট লেখা হয়
আমি কিন্তু এখানকারই মেয়ে.....
কেমন বৈশাখ
সম্পা পাল
আকাশ ছোঁয়ার দৌঁড় তো আর নেই
এবার এগিয়ে এসো
চৌকাঠ না পেরনোর গল্পটা সঙ্গে এনো
কিছু পরেই তিস্তাবঙ্গ
এখানে এখনও ভাটিয়ালি স্ক্রিপ্ট লেখা হয়
আমি কিন্তু এখানকারই মেয়ে.....
কেমন বৈশাখ
নিশীথ বরণ চৌধুরী
নববর্ষে প্রারম্ভিক বৈশাখ
সজ্জাহীন ললাট,জোটেনি বরণডালা।
শ্যামবনানী প্রকৃতি ,চৈতি দুপুর,
ঝরাপাতা বাজায়নি রাগিনীর সুর
করেনি বসন্ত বিলাপ।
তারই মাঝে এক নতুন বৈশাখ
স্নানের ঘরে অবগাহন শেষে জুড়ায় প্রান।
বিহ্বলে উচ্ছ্বসিত হৃদয়
খুঁজে প্রশান্তির আশ্রয়,
রোগ গ্রস্থ জীবন করে অনুভব
অজানা ভয়,অজানা সংশয় ।
দিকে দিকে সংক্রমন,মানুষে মানুষে দুরত্ব ও বিভেদ
ভুলায় তোমার আগমনী গান
ভুলায় জীবন সাধনা ।
সুখের মাঝে দুঃখ সাথী বিশ্ব দুঃখময়
প্রকৃতি তোমার খাতার পাতায়
কেবল দহন কেবল হনন।
শুধু ভুল শুধু ভুল হিসাব রাখা
যা ছিল সুখ,সবই মরীচিকা
সবই ভ্রান্ত সভ্যতায় প্রাপ্য শাস্তি ।
অবকাশ
নবনীতা সরকার
অতি দীর্ঘ এই অবকাশ...
বন্দি মানুষ ঘরের কোণে,
খুব সুখের নয় এই দিনযাপন...
আটকে থাকা গৃহকোণে ৷
তবু আজ অবকাশ...
অবকাশ সবার,
বিশ্বজোড়া...
ঘরের মাঝে , শুধু নিজের কাজে,
থমকে আছি আমরা...
মানুষেরা ৷
মানুষ ...
তুমি আজ খুশি তো ?
তুমি পেয়েছে সময়...
নিজেকে চেনার...
নিজেকে জানার...
নিজেকে দেখার মতো...
তোমার হাতে,তোমার সাথে,
আজ সময় অগণিত ৷
মানুষ...
তুমি আজ খুশি তো ?
নিজেকে এত নিজের করতে পেরে...
তোমার প্রিয় প্রতিটি মানুষ..
আজ তোমার থেকে দূরে ৷
এমনটাই তো চেয়েছিলে তুমি
এতদিন...এতকাল...
নিজের...নিজের...শুধুই নিজের,
তবে আজ কেনো নাজেহাল ?!
মানুষ...
তুমি শেখো খুশি থাকা..
কারণ ,
দেখার অনেক বাকি...
সব ফিরে পাবে সুদে আসলে
প্রকৃতি দেবেনা তোমায় ফাঁকি ||
একলা আকাশ
লুবনা আখতার বানু
একলা আকাশে ইচ্ছেদের
লুকোচুরি খেলা-
ইচ্ছেরা আজো অনেক স্বপ্ন
দেখে মুচকি হেসে।
ব্যালকনিতে থাকা
ফুলগাছগুলো,
রোজ অরুণোদয়কালে
আমায় সুপ্রভাত জানায়।
ভাবনারা অ্যাকুরিয়ামের
মাছগুলোর পিঠে ভর করে,
কল্পনায় অনেকটা পথ পাড়ি
দেয় নীল সমুদ্রে-
অনেক বছর ধরে যেই
কবুতরগুলোকে রোজ
খেতে দেই,
তাদের সঙ্গে আত্মার এক
সম্পর্ক খুঁজে পাই।
ইচ্ছেগুলো কখোনো তাদের
পিঠে ভর করে,
উড়ে চলে যায় আকাশের ঐ
গভীর নীলিমায়-
ক্লান্ত মন মুঠোফোনটা বেজে
ওঠার অপেক্ষা করে,
ক্লান্ত চোখ আপনজনদের
খোঁজে।
নবযুগ
সঞ্জয় কীর্ত্তনীয়া
ফেরিওয়ালা যায় শহর গঞ্জে
পণ্যবিক্রয় সদাই তার কর্মে
এ পাড়া থেকে ও পাড়া দৌড়
খরিদদার লক্ষীর সন্ধান তরে।
অশনি সংকেত আসেই দেশে
এ কোন ফেরিওয়ালা জগতে
রাজপুরী শহর অলিগলি পল্লী
সব খানে বাঁধাহীন তার ফেরি।
এমন ফেরিওয়ালা দেখেনি নরে
অতিত পৌরাণিক কোনো যুগে
অশনি সংকেত ভয়ের কিছু নাই
সঠিক শৃঙ্খলায় অশনি লুকাবে।
জীবন জীবিকা মহাসংকট পথে
ফেরিওয়ালার ভয়ে গৃহবন্দী নরে
খাদ্য সংকট লকডাউন কারণে
মৃত্যু দূতের হাতছানি ঘর বাহিরে।
কাল প্রবাহ নতুন বার্তা দিয়েছে
দু'টি যুগের নব ধারাপাত জগতে
করনা পূর্বের যুগ প্রেম মাধুর্যের
নবযুগ কষ্টের করনা পরবর্তীতে।
দিনান্তে
বিজয় বর্মন
ছোট্ট পরী আঙ্গুল ধরি ,
গুটি গুটি পায়ে ।
গলা জড়িয়ে আদর করি,
আল্তো হাতের ছায়ে ।
পুটুস পুটুস কথা বলা ,
শুধুই জানার ইচ্ছা ।
মায়ের মতন শাসন করে,
স্নেহের শুভেচ্ছা ।
তপ্ত হৃদয় শীতল হয় ,
বাবা ডাকটায় মুখে ।
রাতের পরে দিন আসে,
সময় কাটে সুখে।
আমার পরী ছোট্ট টা নেই,
পড়ালেখায় জয় ।
হাত ছাড়িনি চলার পথে,
হারিয়ে যাওয়ার ভয় ।
পরীর নাকি সময় হলো,
আপন বাসর,পরিণয়ে ।
কে যে কার, হাত ধরেছি ?
দিনান্তে সংশয়ে ।।
স্বাধীনতার স্বাদ
শাবলু শাহাবউদ্দিন
স্বাধীনতার স্বাদ বড় তিক্ত নির্লজ্জ মিথ্যাচার
স্বাধীনতার স্বাদ বড় চাওয়া পাওয়ার না পাওয়ার বাঁধ
স্বাধীনতার স্বাদ পোয়াতি মায়ের হাতে তেঁতুলের আচার
স্বাধীনতার স্বাদ গ্রামের চায়ের দোকানে গ্রাম্য অকথ্য
কথার ঝড় ।
স্বাধীনতার স্বাদ নিষ্ঠুর নিষ্পাপের বড় বড় পাপ
স্বাধীনতার স্বাদ বড় যৌবন জ্বালার স্ত্রীর কষ্টে রাত
স্বাধীনতার স্বাদ মায়ের নিরঙ্কুশ বিনিদ্র এক শতাব্দীর
রজনী
স্বাধীনতার স্বাদ পিতা পাথর বাঁধা বুকে আনন্দের ঝলক।
স্বাধীনতার স্বাদ কেউ পায় কেউ না খেয়ে দিন কাটায়
স্বাধীনতার স্বাদ বড় বিশ্রী এক সুশ্রী অলিখিত পাণ্ডুলিপি
মাপ
স্বাধীনতার স্বাদ বড় চাও কী পাও কী না পাও সংমিশ্রণে
অমৃত
স্বাধীনতার স্বাদ হৃদয় জুড়ে এক বিশাল ঝড়খণ্ডের সমীরণ ।
হালখাতা
মাথুর দাস
হালখাতা নেই অনলাইনে,
কাল কাটা সব কুপন
রি-ডিম্ করো হিমঘরে গে',
ঠকে না-শেখার কু-পণ ।
আপন ভাবা আপণগুলি
পাড়া কিম্বা বাজারে --
একলা থাকে ১-লা বোশেখ,
লবডঙ্কা বাজা রে !
খেরোর খাতা সিদ্ধি গণেশ
পুজোটি ভরা-গামলায়,
গেরোর গুরু গোপাল শেঠ
'ধেরো' খদ্দের সামলায় ।
করোনা
শ্যামল কুমার রায়
করোনা এবার দিচ্ছে ডাক
মানব সভ্যতা নিপাত যাক।
সচেতনতা ভাই উঠছে গড়ে
করোনা তাই যাচ্ছে সড়ে।
সভ্যতার আজ চরম সংকট
স্বার্থপরতা হচ্ছে প্রকট।
ছুটছি সবাই নিজের তরে
রসদ মজুত নিজের ঘরে।
আতঙ্ক আজ বড়ো পুঁজি
কালো বাজারির সুযোগ খুঁজি।
আর্ত অসহায় রইলো পরে
দিন মজুরিতে পেটটা ভরে
মৃত্যু মিছিল খবর করি
আরোগ্য সব আড়াল করি।
প্রভু তুমি দাওগো মেরে
মনুষ্যত্বহীনতা চিরতরে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মূলত নবীন প্রজন্মকে প্ৰেৰণা দিতে মুজনাই আয়োজন করেছে 'আঁকছি আমি আঁকছ তুমি` বিভাগ। এই বিভাগে প্রতিদিন ছবি পাঠাচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, অফিসকর্মী, গৃহবধূ থেকে শুরু করে অজস্র খুদে-বড় শিল্পী। সেই অঙ্কন থেকে বাছাই করা কিছু ছবি মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৭-এ প্রকাশ করা হল।
(সম্পাদক)
বাবুল মল্লিক
অর্পিতা দাস
সায়ন্তন প্রামানিক
কৌশিকী চন্দ
মৌরুসি দত্ত
আরাত্রিকা
জয়িতা দেবনাথ
সংহিতা ভৌমিক
সম্পূর্ণা নন্দী
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৭
No comments:
Post a Comment