মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা
সম্পাদকের কথা
আগুনের রং চারদিকে। শিমুল, পলাশ, মাদার সব্বাই ঢেলে দিয়েছে তাদের সব....প্রকৃতিকে সাজাবার জন্য। আসলে ফাল্গুন এরকমই। বছর শেষের সব কলুষ যেন পুড়িয়ে ফেলতে চায় সে এভাবেই। সেজন্যই বোধহয় তার কদর সবচেয়ে বেশি। কেননা কলুষ শেষেই থাকে প্রকৃত অমৃত, খাঁটি মধু।
এই মধুমাসে তাই জীবনের গান আর অমৃতের কথা। প্রকৃতির রঙের সঙ্গে জীবনের জায়গানের গল্পকথা।
এই সংখ্যায় যাঁরা আছেন
চিত্রা পাল, শ্রাবণী সেন, পার্থ রায়, চন্দ্রানী চৌধুরী, রফিকুল নাজিম, দেবার্ঘ সেন,
রীনা মজুমদার, রুনা দত্ত, অর্পিতা গুহ মজুমদার, সংস্থিতা কবি, মৌসুমী চৌধুরী, রূপক রায়, উমা শঙ্কর রায়, চন্দ্রিকা শীল, সুপর্ণা চৌধুরী, বিজয় বর্মন, শান্তা সাহা, রীতা মোদক, অদিতি মুখার্জী(সেনগুপ্ত), মজনু মিয়া, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, সুনন্দ মন্ডল, সুব্রত দত্ত, বিচিত্র কুমার
মুজনাই সাহিত্য সংস্থা
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪২৭
গল্প
ফাল্গুনী
চিত্রা পাল
পাশাপাশি দুটো জমি। একটা একটু বড়, আর একটা একটু ছোট। ওটা ওই মাপে, তেমন করে দেখতে গেলে চোখে লাগেনা। যে টা বড় সেটায় বাড়ি উঠলো খুব তাড়াতাড়ি। পেল্লায় বড় মাপের। নিচে তলাটা শুধু গাড়ি রাখার গ্যারাজ। ওপরে দুতিন তলা বসবাসের ঘরদোর। বাড়ি তৈরি হয়ে যাবার দু তিন সপ্তাহের মধ্যে বেশ জমজমাট হয়ে উঠলো। ওবাড়ির জানালা দিয়ে দেখাযায় এই জমিটা। মেয়ে জিজ্ঞেস করে ‘বাবা এ জমিটা কাদের’ ? বাবা বলে, ‘আমি ঠিক জানিনা। দ্যাখ না, জমিটা কিনে ফেলে রেখে দিয়েছে। হয়তো এটা কিনতেই সব শেষ, আর ইঁট ফেলার টাকা নেই’। অবশেষে এক শীতশেষে দেখা গেলো ওখানে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তার সঙ্গে খুব মাপজোক করে গাছ পোঁতার কাজ। এক কোনায় বেশ বেড় দিয়ে কি যেন একটা গাছ পোঁতা হয়েছে। জানালা দিয়ে দেখে মেয়ে জিজ্ঞেস করে বাবাকে ,’ বাবা এটা কি গাছ’?বাবা বলে ‘ওই কিছু হবে একটা’ । বেশ কিছুদিন পরে খোঁজখবর করে মেয়ে জানতে পারে ওটা স্বর্ণচাঁপার গাছ সেদিন খুব খুশি। কেননা ও শুনেছে এ চাঁপা ফুলের খুব সুবাস।
বাড়িটা শেষ হয়ে গেল তাড়াতাড়িই। মাত্র দুকামরার ঘরবাড়ি, কিন্তু বাড়ির সামনের হাতায় বেশ খানিক খোলা জমি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেখানে লাগানো হয়েছে অনেক ফুলের গাছ। স্বামী স্ত্রী শাশুড়ি সন্তান নিয়ে সংসার। সবাই গাছের যত্ন নেয়। গেটে লতিয়ে উঠেছে মালতি লতা। যুঁই ফুলের লতাও চাঁপা গাছ বেয়ে উঠছে। এবার শীত শেষ হয়ে বসন্ত আসতেই শুরু হয়েছে ফুল ফোটানোর তোড়জোড় । বেড়ার গা ঘেঁসে সারি দিয়ে বেলফুলের গাছে গাছে একেবারে ফুলের মেলা। সে ফুলের সৌরভে সমস্ত অঞ্চল সুরভিত। মেয়েটি রোজ দেখে, ওর কাঁচা প্রাণ তাই এই সুন্দরের ওপরে ওর বড় টান।
একদিন দেখে ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটি এত ফুল নিয়ে এসেছে পুজোর জন্য। জানালা দিয়ে দেখে ওই বাগানটা লন্ডভন্ড শূণ্য। ওর বুঝে নিতে বাকি থাকে না এ ফুল কোথা থেকে এসেছে। ও কাজের মেয়েটিকে ডেকে খুব বকাবকি করে বললে ওদের কাছে গিয়ে মাফ চাও আর সব ফুল ওদের দিয়ে এসো। ওর বাবা শুনে বলে দুটো ফুল তুলেছে তো কি হয়েছে? যদি সেরকম কিছু বলে তাহলে দাম দিয়ে দেবো’। সেদিন ও ওর বাবাকে বলে, ‘সব কিছু টাকা দিয়ে হয় না বাবা’। দূরত্ব সরিয়ে সমস্ত ফুল নিয়ে ও যখন বেড়ার আগল খুলে ও বাড়িতে গেল, ওরা অবাক। ও খুব ক্ষমা চেয়ে নিলে এই অন্যায়ের। বৌটি বলে, ওরা না জেনে করেছে।কিন্তু আজ এক বড় খবর আছে। মেয়েটি বলে,কি?বৌটি বলে,ওই দ্যাখো, ওই স্বর্ণচাঁপা গাছে এই ফাল্গুনে ফুটেছে প্রথম ফুল। আর তুমি এলে এ বাড়িতে বন্ধু হয়ে, তোমার নাম দিলাম ফাল্গুনী। মেয়েটি একবার তাকিয়ে দেখলে ওদের উদ্ধত ইমারতের ওপরে সমস্ত আকাশে হাসির ঝলক আর নীচে সবুজ পাতায় ভরা স্বর্ণচাঁপা গাছে সুরভিত প্রস্ফুটিত ফুল। এক ঝলক বসন্ত বায় একথায় সায় দিয়ে বয়ে গেল তাদের আঁচল উড়িয়ে।ওরা দুজনেই হেসে ওঠে আপনমনে।
কবিতা
বাসন্তিকা
শ্রাবণী সেন
ঝরাপাতায় ফাগুন হাওয়ার টান
উড়িয়ে নিয়ে চললো কোথায় জানি!
বসন্তদিন এমন পাঠায় ডাক!
রঙিন হবে শুকনো ডালের গাছ
শুনলো নাকি ফুলের আগমনী?
পলাশফুলে আশার আলোর সাজ!
সামনে এবার খর নদীর স্রোত
কিম্বা বোধহয় চরের ডাকাডাকি!
সাগর পানে যাবার বুঝি সাধ!
ছলাৎ ছলাৎ বইছে গহীন জল
নদীর জলে আদর মাখামাখি।
কৃষ্ণচূড়ার ডালে ফুলের ডাক!
নুইয়ে পড়া গাছের ডালে আলো
আলোর রঙে আবীরগুলাল মাখা।
ঝরাপাতায় নতুন ফুলের সাজ!
দেখার আশায় কাটলো কতদিন
বছর, মাস আর দিনের হিসাব রাখা!
বসন্ত যায়, না মিটিয়ে সাধ।
স্ব পিণ্ড
পার্থ রায়
আকাশ আশ্রয়ী জল বিস্তীর্ণ মুক্তির স্বাদ পেলে
বিপদসীমা অতিক্রম করে
গৃহস্থের আঙিনায় প্রবিষ্ট হয়
জলের সহবাসে ঘর ভাঙে
অগ্নিবৃষ্টি জমে
এবং তুমিও বল স্বর্ণ হরিণী ভ্রমে
ঘাস ক্ষেতে এসেছো হে প্রলাপ সম্বর
কোথায় আশ্রয় পাবে প্রেমিক প্রবর
এ আমার স্বপিণ্ড এ আমারই সামবেদ
এ আমার ভাগ্যলেখ নিঃস্ব অনুচ্ছেদ
বসন্ত প্রেম চন্দ্রানী চৌধুরী
বাতাসে শিহরণ
দুয়ারে খবর এলো
বসন্ত এসে গেছে ।
আবির রাঙা রাজপথে
কোকিলের কুহুতান বুকে নিয়ে
হেঁটে যাই
এলোমেলো কবিতার সাথে ।
ঝরা পাতাদের ভিড়ে
পলাশের রক্তিম আভা
আমাকে রাঙিয়ে দিয়ে যায়
হৃদয়ে উচ্চারিত হয়
বসন্ত প্রেম ।
বসন্ত বিলাপ
রফিকুল নাজিম
তোমার বাগানে ফুল লালে লাল
আমার বাগানে পাতা ঝরা ডাল,
তোমার ডালে কোকিলের কুহুতান
আমার পাঁজরে বেদনার পিছুটান।
তোমার পাড়ায় বসন্তেরা উন্মাদ
আমার পাড়ায় কষ্টের নোনাস্বাদ,
তোমার আকাশ নীল রঙে আঁকা
আমার আকাশ কালো মেঘে ঢাকা।
তোমার মনে আজ বাহারী ফাগুন
আমি পুড়ি নিরবধি বিরহ আগুন।
বসন্তবাগান
দেবার্ঘ সেন
সময়ের স্নিগ্ধতায় আরও নিবিড়
তোমার চোখের মতো জানলা এখন নৈসর্গিক বড়ো।
অভিমানতুল্য মেঘ বৃষ্টি দিচ্ছে,
শেষ ভেজা ব'লে কিছু নেই।
ভালোবাসার সূক্ষ্মতায় বিরামহীন তুষার,
ন্যাড়াগাছ দিগন্ত..
আমাদের ব্যর্থ দূরবীন।
তবু চোখে দূরবীন রাখলে
সময়ের ঊর্ধ্বে সুরেলা সর্বস্ব, বসন্তবাগান।
প্রথম পলাশ রীনা মজুমদার
কোথায় সে রঙ নেই ?
ঋতুরাজ জেগে ওঠে
একটি রাঙা পলাশে
আলতা পা'য়ে হেঁটে যায়
গোপনে জ্বালে রংমশাল,
পলাশের পরশে সেজে ওঠে
অরণ্যে ফাগুন-বাসর।
সূর্যের আসা-যাওয়া লগ্ন,
সীমন্তিনীর কেশবীথি
চিরন্তন রঙে, রাঙা পলাশ !
তোমার আমার প্রথম বিনিময়
সেও তো ছিল, এক পঞ্চমীতে
অঞ্জলির প্রথম পলাশ !
কোথায় সে নেই ?
প্রাপ্তবয়স্ক প্রেম
রুনা দত্ত
দ্বিমাত্রিক সংখ্যার বয়সটাকে
তুড়ি মেরে উড়ালাম
একটু সাহসী হলাম
অনেকটা বেহিসেবী হলাম।
বসন্ত ফাগুন পলাশ ছুঁয়ে
আজ না হয় আগুন হলাম
হলুদ জোৎস্না খুঁজে পেতে
নিজেকে নতুনভাবে রাখলাম।
চিবুক অধর বিভাজিকা
ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসের
গভীরতায় বারুদ জ্বাললাম
ভালোবাসার রাত জাগলাম।
শ্লীলতা অশ্লীলতা শব্দগুলোকে
একটু একটু করে ভাঙলাম
আদম ইভের মতো প্রেমে
প্রাপ্তবয়স্ক মুগ্ধতা রেখে গেলাম।
মুলতুবিঅর্পিতা গুহ মজুমদার
স্বরচিত কুয়াশা থেকে বেরিয়ে এসো,
চলো বসন্তের হাত ধরি,
পুরোনো বাধ্যবাধকতাকে তুলে রাখো কোন গোপন তোরঙ্গে।
আজ না হয় কিছু অন্যরকম হোক----
এসো আগুন পলাশ, পিয়ালের বনে ডুব স্নানে নিমগ্ন হই,
সামনে জেগে ওঠা শিমুল রাঙ্গানো পথে পথ হারাই,
আহ্লাদি প্রজাপতি হয়ে গা ভাসাই রূপালি স্বপ্নের স্রোতে,
যাবতীয় লোকলজ্জা আজ মুলতুবি থাক।
চেনা বসন্ত
সংস্থিতা কবি
শুকনো পাতাগুলি সবুজ হতে চায়,
যতটা সবুজ হলে,
ক্লোরোফিলের উত্তেজনাকে হার মানানো যায়,
ঠিক ততটা।
পলাশ ফুলগুলি নিস্তেজ হয়ে,
বিদায় নেবার আগে,
আবার ফিরে আসে পলাশরঙা হয়ে।
দেখতে দেখতে শীত ফুরিয়ে যায়,
তারপর বসন্ত নেমে আসে।
কোকিলদের এবার গান শোনানোর পালা।
বিকেলের আধডোবা সূর্যটা বসন্তের নামে
অচেনা কবিতা লেখে।
শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার মেলায় হারিয়ে যায়,
কোকিলের সুর।
কোনো এক যৌবনের নামে বিকিয়ে যায়,
চেনা বসন্তগুলো।।
এ বসন্তে
মৌসুমী চৌধুরী
হরির দোকানে উনুনের ধোঁয়ায় কুন্ডলী পাকায়
লাল-সবুজ-কমলা রঙের জ্বালাময়ী বাষ্প।
চায়ের কাপে তুফান — সি.বি.আই তদন্তের কালো তরজা,
মিছিলে ওঠে দাবীদাওয়ার হাত, রক্তরঙা মুখ,
চুনীর মায়ের চুপড়িতে সজনে ফুল, কলমী শাক,
এ বসন্তে দুয়ারে আমাদের উৎসব...উৎসব!
বাবলাবীথিতে ঝুরুঝুরু দখিনা সুর,
ঝাঁক বেঁধে ঘুঘুদের আহ্লাদে চিড়িক চিড়িক।
সজনে ডালে সাদা রঙের উল্লাসী গান,
পাঁজর ফাটিয়ে রক্ত ঝরায় ন্যাড়া শিমূল গাছ,
খানার টলটলে জলে তালের ঋজু ছায়া,
লাল-হলদে ডানার ফড়িংদের চড়ুইভাতি।
আমের মুকুলের গন্ধে ম' ম' বাতাস,
শিরশিরে উতল হাওয়া, উদাস দুপুর,
আগুনরঙা ফাগ মাখে পাতাহারা দুঃখী পলাশ!
মুখ ঢাকা কিশোরের করুণ চোখ জালালার বাইরে,
দিদিমণি পড়িয়ে যান বৌদ্ধ নৈরাত্ম্যবাদের কচকচানি...
দূরেকোথাও বিরহী কোকিলটার বুকফাটা কুহুতান!
হু হু বাতাসে কে বাজায় মন-কেমনের বাঁশি, এ বসন্তে!
একুশের যৌবন
রূপক রায়
একুশের পদধ্বনি
শুনেছ কি তুমি
উত্তাল যৌবনকে
দেখেছ কি তুমি
সে যে দিয়েছিল প্রাণ,
দিয়েছিল মন,
দিয়েছিল নব কল্লোল,
সে যে এসেছিল আজ
দুয়ারে আমার
নিয়ে নব-প্রাণের হিল্লোল।
আজ বসন্ত উমা শঙ্কর রায়
ঝড়া পাতা হাত নাড়িয়ে যায় -
নতুনের কাছে কোনো হিসেব রাখে না
বাতাস ও তার আদ্রতা আত্মস্থ করে নিজেই
ধুসর বিবর্ণ মেঘ সরিয়ে, দেয় সুনীল -
সুবাসিত করে, মত্ত হয় মহুয়ায়
শাল চিকরাশির হৃদয় ছুঁয়ে
বসন্তমুখারী গায় কোকিল
আজ বাকা কালো পলাশ গাছের ডালে ডালে
দোলা দেয় সবুজ টিয়ে -
গুটিবসন্তের মত সারা গা ঐ মাদার গাছ
সেও আজ লাস্যময়ী -
আজ কারো কোনো পুরনো পরিচয় নেই -
আজ নেই কোনো হিংসা বিবাদের ঘেরাটোপ -
আজ সব রঙিন, সব নতুন, প্রেমময়-
চাক ভুলে ভ্রমর নেচে নেচে গেয়ে যায়
আজ বসন্ত -
রক্তাক্ত দলিল
চন্দ্রিকা শীল
জীবনের তেত্রিশটা বছর অজ্ঞাত নীরব সম্পর্ক যাপনের পর,
আজ আমি ফের বিরহের যাত্রী।
ঝিরঝিরে বসন্তের ওই খ্যাপাটে হাওয়া যে তেত্রিশ বছর আমায় ভরসা দিয়ে গেছে,
সেটা তো কেবল মননের চুপিসারের কথন।
গোঁড়া থেকেই জানতাম বসন্তের সেই ছদ্মবেশটা আমার কাছে, তোমার মিথ্যে ছিল,
মিথ্যে ছিল পাশ দিয়ে যাবার কালে আড়চোখে তাকানোটা,
মিথ্যে ছিল আমার একফোঁটা আশা যে, তুমি একদিন কাঙ্ক্ষিত উত্তর হয়ে দাঁড়াবে সামনে এসে,
তবে সত্যি ছিল,
বসন্তের ঠোঁটে পলাশের আগুন লাগিয়ে
প্রেমিক জন্মটা,
সত্যি ছিল, ক্যালকুলাসের কাছে সম্পর্কের মিলতে না চাওয়া অঙ্কটা আর
আমার নগ্ন ভালোবাসাটা।
কেবল আজ এটুকু বুঝতে পারি,
তেত্রিশের ঝাপসা বসন্তে ,
কেবল পলাশের চেয়ে লাশ চোখে পড়ে বেশি।
দূরে-র রাস্তায় বিছিয়ে থাকা আগুনরঙাকে কাছে গিয়ে চিনতে হয়,
টাটকা রক্তের ছোপ হিসেবে।।
গল্প
বসন্তের ডাক
সুপর্ণা চৌধুরী
ঘুম ভাঙতেই পঞ্চমে সুর ধরা কোকিলের একটানা কুহ ডাক কানে এল। গায়ের চাদরটাকে এখন বাড়তি মনেহয়। পলাশ চোখ খুলল। বেশ বেলা হয়েছে। ঘরের জানলা খোলা। পাশের পুকুরে সূর্যের আলো পড়েছে, তার প্রতিবিম্ব পড়েছে ঘরের সিলিঙে। বাতাসে বিদায়ী শীতের অধিকার ধরে রাখার চেষ্টা আর বসন্তের পাগল হূল্লোড়। এই টানাটানি সিলিঙের প্রতিবিম্বকে ঢলচ্চিত্র করে তুলেছে। প্রকৃতি যেন একটু একটু করে রঙ ঢালছে পলাশ-শিমূলে। বাতাস উষ্ণ হচ্ছে ধীরে ধীরে ।
পলাশ বাইরে এল। কোকিলটা একটানা ডেকে চলেছে। মনটা উদাস হয়ে গেল পলাশের। বহুদিন হয়ে গেল মল্লিকা তার অনেক দূরের কর্মস্থল থেকে ফিরে আসতে পারেনি। এই বসন্ত বাতাসে মল্লিকা যেন ডাক পাঠাচ্ছে পলাশকে ।
বসন্ত সকালে চারিদিকের এত ফুল, প্রকৃতির এত মনোরাঙানিয়া আয়োজনের মাঝে কোথাও না কোথাও মল্লিকাও তো মিশে আসে। হঠাৎ যেন অদ্ভুত একটা প্রাণের আরাম খুঁজে পায় পলাশ! ছাই হয়ে যাবার পর মল্লিকা তো মিশে গেছে এই মাটিতেই , এই জলেই। এই পঞ্চসায়রের বাতসেই তো পড়েছে মল্লিকার শেষ নিঃশ্বাস ...
মল্লিকার না-থাকাটা তাই আর ভারাক্রান্ত করে তুলতে পারে না পলাশের মনকে। পাশের ঘরে টিভি চ্যানেল থেকে ভেসে আসছে গান,
— "সখী, ওই বুঝি বাঁশি বাজে-- / বনমাঝে কি মনোমাঝে॥/বসন্তবায় বহিছে কোথায়,/
কোথায় ফুটেছে ফুল,..."
সুরটা যেন মল্লিকা হয়ে লেগে থাকে পলাশের বুকে।
কবিতা/ছড়া
খোলা হাওয়া
বিজয় বর্মন
ভোরে রঙিন পূবের আকাশ,
রাঙামাটি আবীর বাতাস,
স্পর্শে দোলে মন,
হাজার ব্যাথা ভুলে থাকা,
বছর প্রতি ক্ষণ।
দোলের হাওয়ায় শুকনো পাতা,
চিরসবুজ ন্যাড়া মাথা,
শীতের শেষে মাঘ,
গোলাপ খুঁজি হলুদ মাখি,
ফাগুনে খুঁজি ফাঁক।
আমের মুকুল গন্ধ ছড়ায়,
ভ্রমর ঘোরে আগা গোড়ায়,
পরাগ মিলন বেলা,
কোকিলের ডাক কুহু তানে,
প্রকৃতি প্রেমের খেলা।
শিমুল পলাশ রাঙিয়ে তোলে,
আয় চলে আয় আমার কোলে,
প্রকৃতির কিযে সারা,
রঙের খেলা নীল সবুজের,
সাক্ষী সূর্য তারা।
মান অভিমান ভুল বুঝে,
চঞ্চল চোখ তোমায় খুঁজে,
নতুন করে চাওয়া,
জুড়াবে প্রাণ বিলিয়ে দিও,
তোমার খোলা হাওয়া।
কে যায়?
শান্তা সাহা
কে যায়? কে যায়?
মন্দ মধুর বায়!
কোকিল শুধু গায়
তারই জন্য বাঁশি,ফুলের মুখে হাসি
দূরে পলাশ রাশি রাশি!
কে আসে? কে আসে?
ঝরা চৈত্র মাসে
বসন্ত বাতাসে
তারই উদাস হাওয়া,লাজুক লাজুক চাওয়া
স্বপ্নের আসা যাওয়া!
কে থাকে? কে থাকে?
মনেতে ছবি আঁকে
দূর রাস্তার বাঁকে
তারই জন্য দোলা,সারাটি বিকেল বেলা
রোদ্দুরে সুখ মেলা!
কে বোঝে? কে বোঝে?
নীলচে হৃদয় খোঁজে?
লুকিয়ে চিঠির ভাঁজে
সর্বস্ব যায় ভেসে,শুধুই ভালোবেসে
নিভৃত নিরুদ্দেশে!!
ফাগুন এলো
রীতা মোদকও শিমুল বউ ঘোমটা খোলো ...ফাগুন এলো বনে ,লাল হলো যে কৃষ্ণচূড়ালাগলো আগুন মনে ।গাছে গাছে গাইছে পাখিঅলি উড়ে বাতাসে ,ডাল- পালা ঢেকে গেছেগুচ্ছ গুচ্ছ পলাশে।ডালে বসে ডাকিস কেনোওরে কোকিল পাখী ,বসন্ত কাল এসে গেছেজানতে নেই তো বাকি ।মহুয়া বনে পাগল বাতাসমন হলো যে আনমনা --ভ্রমর গুঞ্জন কানে বাজেডাকে আমায় কোন জনা ?
বসন্ত এসে গেছে
অদিতি মুখার্জী (সেনগুপ্ত)
"বসন্ত এসে গেছে" ,বইছে মন্দ-মৃদুল মলয় বাতাস,
কোকিলের কুহু-কুহু ডাকে বাতাসে আনন্দের রাশ।
শীতের প্রকোপ গেছে চলে বহুদূরে,
কেটেছে যেন সকল জরা, অলসতা গেছে সরে।।
ডালে-ডালে নব পল্লব, জাগায় নতুন প্রাণের সাঁড়া,
পলাশ ও কৃষ্ণচূড়ার আগুন-রঙে ভুবন আজ সৌন্দর্যে ভরা।
বসন্তে শান্তি-বেশ, উজ্জ্বল রাজটীকা,
বাতাসে সুরের লহরী তোলে কুহু ও কেকা।।
বসন্ত পঞ্চমী ও দোল পূর্ণিমার পূণ্য তিথিতে,
স্মৃতি চারণে ওঠে অনেকেই মেতে।
"বসন্ত এসে গেছে", আনন্দে মাতোয়ারা সবাই,
জাগে নতুন আশা, অনন্ত তার রোশনাই।।
ফাল্গুনের গান
মজনু মিয়া
ফাল্গুনে গান গায় অলি কূল
ঘুরে ফিরে মধু খায় ফুল
শিমূল পলাশ ফুল ফোটে লাল
বুলবুলি ফোলায় তার দুই'গাল
কোকিল ডেকে করে কার খোঁজ
ফাল্গুনে সে ডেকে যায় রোজ
গাছ ঝরে পাতা শূন্য হয়
মুকুল ডাল ফেটে হয় উদয়
পাখিদের কোলাহল খুব ভোর
মন চায় উঠি খোলে ঘর দোর
আকাশের রং হয় গাঢ়ো নীল
দূর দেখা যায় উড়ে গাঙ চিল
ফাল্গুনে ভালোবাসার সুখ
প্রেমিক প্রেমিকার ভরে বুক।
বসন্তের আবাহন
শ্রাবনী সেনগুপ্ত
বসন্ত মানে ফাল্গুন,
পলাশের পাতায় পাতায় আগুন।
বসন্ত তুমি ভালোবাসার দূত,
তোমাতে লুকিয়ে প্রকৃতির সুখ।
রিক্ত শীত বিদায় নেয়,
জগৎসভার ভার তোমায় দেয়,
প্রকৃতিকে তুমি সাজিয়ে তোলো আপন হাতে ,
তোমার আগমনে ধরিত্রী তাই আনন্দে মাতে।
যৌবনের আবাহন তোমার সর্বাঙ্গে ,
হোরিখেলায় মাত তাই আপন রঙ্গে।
সেজে ওঠে নিকুঞ্জবন
মেতে ওঠে কৃষ্ণচূড়া ,
তার সাথে সঙ্গত দেয়
হলুদবরণ ওই রাধাচূড়া।
গুঞ্জরিত বিচিত্র সুর
ভ্রমর তোমায় শোনায়
তুফান তোলে প্রতিটি শোণিতকণায়।
আবির
সুনন্দ মন্ডল
চুপি চুপি মেঘ সরে যায়
ফাল্গুন মাতে আবিরের ছোঁয়ায়।
রাগ রাগিনী সুরে ওঠে বেজে
বসন্তের হুল্লোড়, কিছু রঙ ওঠে সেজে।
আকাশ ভুলে গেছে শোক
ভুল হয়ে গেছে জীবনের অর্ধেক।
স্রোতে ভেসে গেছে নির্ণয়
পরিমাপে শুধু গুনাঙ্কের ভয়।
সবুজ ছোঁয়া গালে, গায়ে গেরুয়া
হলুদ যখন পায়ে, মাথা লালে ধোয়া।
আবির যখন মাতায় ফাল্গুনে
বসন্ত গান গায় গুন-গুনে।
স্বপনচারিণী
সুব্রত দত্ত
ঘুমঘোরে তোমায় একান্তে স্বপনে পাই,
জাগরণে শূণ্যতায় তোমায় খুঁজে যাই।
তুমি কি রবে কেবল স্বপনচারিণী হয়ে,
কাল গুনে বিনিদ্র রাত একে একে যায় বয়ে।
কোন শুভক্ষণে শূণ্য ঘাটে চাইবে আমার পানে,
একলা জাগিবো তমসা রাত্রি চিরবন্ধন গানে।
সে গান তোমার হিয়ার মাঝে কবে বাজিবে,
বাহুডোরে বেঁধে আমারে কবে ভালোবাসিবে।
গুঞ্জরিয়া উঠিবে মোদের সকল রসের ধারা,
স্বপন ভেঙে মনের রঙে দেখবো সকল তারা।
ছায়া নয় প্রিয়া, কায়া হয়ে মেটাও হৃদের তৃষা,
শুধু বলো, কেমনে পাবো তোমার প্রাণের দিশা।
এই বসন্তে
বিচিত্র কুমার
নবীন পল্লবে পল্লবে ফুল ফুটেছে
ফুটেছে আমের মুকুল,
শিমুল পলাশ আনন্দে উল্লাসে
পাতার ফাঁকে গাইছে বুলবুল।
সুদূর থেকে ভেসে আসে
রবীন্দ্রসঙ্গীতের মিলনের সুর,
মনে শিহরন জাগে হই ব্যকুল
মনে হয় নয় বহুদূর।
প্রেমের পসরা সাজিয়ে ডালে ডালে
বস্তের কোকিল হাতছানি দিয়ে ডাকে,
একলা ঘরে মন বসে না
তোমায় লুকিয়ে দেখি পাতার ফাঁকে।
মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা
No comments:
Post a Comment