বিনোদ, শ্যামলী, রহমত, খুশবু এবং আরো অনেকে সকাল সকাল ক্ষেতে কাজে ব্যস্ত। মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সাম্যদ্বীপে ওদের বাস। কাজের ফাঁকে নিজেদের মধ্যে গ্রাম্য মস্করা চলছিল। রহমতের কোনো আওয়াজ না পেয়ে সবাই তাকায় তার দিকে।
দেখে, রহমত একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিনোদ বলে, "তোর কি হইল রে? আকাস পানে তাইকে আছিস কেনে?" রহমত কথা না বলে শুধু আঙ্গুল তোলে আকাশের দিকে। সবাই দেখে আকাশে গোলমত চকচকে কি একটা জিনিস তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। কাজ ভুলে গিয়ে রহস্য-রোমাঞ্চে ওদের দম বন্ধ হবার জোগাড়! অনেকটা কাছে এসে থেমে ভেসে থাকে বিরাট এক চাকতি। দরজা খুলে ছোট একটা যান বা পড নেমে আসে মাটিতে। বিনোদরা মন্ত্রমুগ্ধের মত হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। পড থেকে দু'জন বেড়িয়ে ওদের দিকে এগোতে থাকে। মানুষের মত দু'পেয়ে, কিন্তু মাথা বড়, হাত-পা গলা সরু সরু। বিনোদরা প্রচন্ড ভয় পেয়ে "পালা রে, সবাই পাইলে যা" - বলে দৌড়ে পালাতে শুরু করে। কিন্তু যান্ত্রিক শব্দে ঘুরে দাঁড়ায়। আগন্তুক দু'জন দু'হাত তুলে আশ্বস্ত করে। ওদের কথাগুলোই যান্ত্রিক আওয়াজের মত। বিনোদ, রহমতদের ভয় কাটে ধীরে ধীরে। মুখোমুখি দাঁড়ায়। আগন্তুকদের একজন বিনোদের কপালে তার তর্জনী ছুঁইয়ে বড় বড় চোখ বন্ধ করে কিছু অনুভব করতে চেষ্টা করে। তর্জনীর অগ্রভাগ টুকটুকে লাল হয়ে যায়। তারপর বাংলা ভাষায় কিন্তু যান্ত্রিক স্বরে বলে,
--- "তোমরা বাঙালি? ভয় পেয়ো না বন্ধু।"
দ্বীপের আবালবৃদ্ধবনিতা ততক্ষনে হাজির রহস্যের খোঁজে। রহমত বলে,
--- "হ্যাঁ, আমরা বাঙালী। তোমরা?"
--- "আমরা মানুষ। আমাদের মধ্যে জাতপাত, সম্প্রদায় বা ভাষার ভেদাভেদ নেই। তোমাদের সৌরজগতের বাইরের এক সৌরজগতের 'কমিউনো' গ্রহ থেকে এসেছি।"
তসলিম নামের এক ছাত্র বলে,
--- "হ্যাঁ, এরকম গ্রহ আছে বলে শুনেছি। কিন্তু সেখানে মানুষ ---"
কথাটা শেষ না হতেই আগন্তুক বলে ওঠে,
--- "তোমাদের বিজ্ঞানীরা একেবারেই বাচ্চা। কিসসু জানে না। আমাদের পূর্বপুরুষেরাই পৃথিবীতে কিছু মানুষকে রেখে গিয়েছিল, এই নীল গ্রহকে বাসযোগ্য করার জন্য।"
আর এক ছাত্রী বিশাখা বলে ওঠে,
--- "কিন্তু আমরা যে পড়েছি, সমুদ্রের জলে সৃষ্ট নিউক্লিওপ্রোটিন হলো পৃথিবীর প্রথম প্রাণ! সেখান থেকে প্রোটোজোয়া সহ বিভিন্ন ধাপ পেড়িয়ে সৃষ্টি হয়েছে গাছ, অন্যান্য প্রাণী এবং মানুষের!"
--- "ভুল, ভুল জানো তোমরা।" আগন্তুক বলে ওঠে, "সেখান থেকে মানুষ জন্মায় নি। মানুষ আমরা পাঠিয়েছি। মানুষের জন্ম যদি পৃথিবীতেই হত, তাহলে অন্য প্রজাতির প্রাণীদের মত নিজেদের সব প্রয়োজন মেটাতে পারে না কেন? কি, পারে?
রহমত আমতা আমতা করে বলে,
--- "না, সিটা পারে না বটে।"
আগন্তুক আরো বলে,
--- "প্রায় সব প্রাণী দিনের পর দিন রৌদ্রস্নান করতে পারে, মানুষ পারে না কেন? সূর্যের আলোয় শুধু মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যায় কেন? মানুষই কেন এত ক্রনিক রোগে ভোগে? অন্য প্রাণীদের মত মানুষের কেন বাচ্চা প্রসব হয় না? কেন শুধু মানুষের দেহেই ২২৩ টি অতিরিক্ত জিন থাকে? কেন, কেন, কেন? কি, আরো বলবো?"
দ্বীপবাসীরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কোনো শব্দ বেড়োয় না মুখ থেকে। আগন্তুক আবার কথা শুরু করে,
--- "শোনো, প্রথম যখন মানুষকে পৃথিবীতে ছেড়ে যাওয়া হয়েছিল, মানুষ তখন এরকম লোভী, শয়তান, খুনী, দুর্নীতিগ্রস্ত, ধর্ষক, পাপী ছিল না। সবকিছুতেই সবার সমান অধিকার ছিল। কিন্তু দিনে দিনে প্রচুর সম্পদ সৃষ্টি হতেই, কিছু মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে দুর্বলদের নিপীড়ন করে সম্পদের অধিকার লুঠ করে নেয়। শুরু হয় সমাজের শ্রেণী বিভাগ। আমরা এসেছি বিশ্বমানবতার ধর্মে সকলের সমান অধিকার অর্জনে তোমাদের সাহায্য করতে। পৃথিবীতে কোনো কাঁটাতারের বেড়া থাকবে না। একটাই পরিচয় থাকবে। আর সেটা 'বিশ্বমানব'। তবেই আবার আমরা বন্ধু হবো। আমাদের বন্ধু ভাবতে পারবে তো?"
তসলিম এগিয়ে এসে বলে,
--- "হ্যাঁ গো, আমরা আছি তোমাদের সাথে। পথ দেখাবে আমাদের। আমরা মানুষের মত মানুষ হয়ে বাঁচবো।"
--- "তাই হবে বন্ধু।"
আগন্তুকের এবার বিদায় নেবার পালা। বলে,
--- "বিদায় বন্ধু। আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে। আবার শীঘ্রই দেখা হবে।"
কমিউনো গ্রহের মানুষের মহাকাশযান দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। সাম্যদ্বীপের মানুষের উল্লাসময় চিৎকারে চারদিক মুখরিত হয়।
দীপনের জন্মদিন আজ। সকাল থেকে উঠে আজ ভারী তোড়জোড় করে রান্নাবান্না সেরে নিয়েছে দিয়া। বিরিয়ানি বানিয়েছে, তার হাতের বিরিয়ানি খেতে বড্ড ভালোবাসে ছেলে -টা। পায়েশও বানাবে। ওর প্রতিটি জন্মদিনেই দিয়া পায়েশ বানায়। দুপুরে ধানদূর্বা, পায়েশ দিয়ে বাঙালিয়ানায় জন্মদিন পালন করা হয়। সন্ধেতে দীপনের স্কুলের বন্ধুরা আর ঘনিষ্ঠ কিছু অতিথিদের নিয়ে ছোটখাট একটা অনুষ্ঠান হয়। সে আর নিখিল প্রতি বছরই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। আজ ছয় পেরিয়ে সাত বছরে পরল দীপন।
পায়েসের দুধ জ্বাল দিতে দিতে দিয়ার মন ফিরে ফিরে যাচ্ছিল ছ'বছর আগের সেই ঘটনায়। ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিল দিয়া আর নিখিল। বিয়ের পাঁচ বছর পর যখন সন্তান আসার খবর পেল, তখন আনন্দের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল তারা। আহা! কী প্রশান্তি! যেদিন ছাই হয়ে মিশে যাবে ক্ষিতি-অপ-তেজ- মরুৎ-ব্যোম এই পঞ্চভূতে সেদিন এই নীলগ্রহে থেকে যাবে তাদের দু'জনের শরীরের অংশও — তাদের সন্তান। প্রথমেই তারা ঠিক করেছিল তাদের নামের অংশও জুড়ে দেবে সন্তানের নামের সঙ্গে। তাই দিয়ার "দ" আর নিখিলের "ন" নিয়ে বাচ্চার নাম ভেবে রেখেছিল দীপন। অনাগত নতুন অতিথির জন্য উলের জামা, মোজা, টুপি বুনে রেখেছিল দিয়া। তৈরি করে রেখেছিল কাঁথা। তার পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায় একটি একটি করে মূহুর্ত গুনছিল দিয়া আর নিখিল।
কিন্তু সিজারের পর হসপিটালে যখন জ্ঞান ফিরে এসেছিল তখনই জানতে পারে জটিল রোগ রয়েছে তার সদ্যজাত পুত্রের। নার্স যখন ছেলেকে কোলে তুলে দিয়েছিল বুকের দুধ খাওয়াতে তখন বাচ্চার ফুটফুটে মুখের দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল দিয়া। কাঁদতে কাঁদতে ডঃ শমিত সেনের হাত চেপে ধরেছিল লিখিল,
— " আমাদের ছেলেকে বাঁচান ডাক্তারবাবু। অনেক প্রতীক্ষার পর ও আমাদের কোল জুড়ে এসেছে।"
অসহায় গলায় ডক্তার সেন বলেছিলেন,
— " অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচক তৈরি হচ্ছে না আপনার বেবীর শরীরে। বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম।"
হাহাকার করে কেঁদে উঠেছিল দিয়া আর নিখিল। মেডিক্যাল বোর্ড বসেছিল। ডাক্তার - -দের সব রকম আন্তরিক চেষ্টা থাকা সত্বেও বাঁচান যায় নি তাদের ছেলেকে। শরীরে অ্যামোনিয়া বেড়ে যাওয়ায় হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে এবং ব্রেন ডেথ হয়ে জন্মের তিনদিনের মাথায় মৃত্যু হয় তার। মৃত্যু হয় তাদের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষার। তাদের দীপন তিনদিন বয়সেই তাদের ছেড়ে চলে যায়।
তারপর ভেতরে ধ্বসতে থাকা মন মাটিকে সামলায় দিয়া আর দীপন দু'জনেই। বুকের চামড়ায় খামচে ধরা টনটনে ব্যথাটাকে সরিয়ে রেখে তারা চায় এই নীলগ্রহে তাদের সন্তানের কোন স্মারক চিহ্ন থাকুক। সদ্যমৃত সন্তানের চোখদান করবার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তাদের ইচ্ছে অনুসারে স্থানীয় "ব্লাইন্ড রিলিফ সোসাইটি"-র কর্মীরা দুপুরে হসপিটালে এসে হাজির হয়। তাদের সন্তানের কর্ণিয়া সংগ্রহ করে নিয়ে যায় তারা। সেটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের "রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজি"-র কর্ণিয়া বিভাগে। তারপর ভাঙা মন আর বুক খালি করা গভীর শূন্যতা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে দিয়া আর নিখিল।
ঠিক তার পরের দিনই "ব্লাইন্ড রিলিফ সোসাইটি"র ফোনটা আসে,
— " আপনাদের সন্তানের কর্ণিয়া প্রতিস্হাপিত হয়ে গেছে এক সদ্যজাতের চোখে। সব শর্ত পূরণ হওয়ায় তার চোখে প্রতিস্থাপিত হয়েছে আপনাদের দান করা কর্ণিয়া। জটিল এক চোখের অসুখে ভুগছিল শিশুটি।"
এই "ব্লাইন্ড রিলিফ সোসাইটি"র কাছেই আসানসোলের অপরাজিতা আর কৃষ্ণেন্দুর ঠিকানাটা জেনেছিল তারা। ছুটে গিয়েছিল সেখানে। আন্তরিক অনুরোধ জানিয়েছিল তারা যেন বাচ্চার নাম " দীপন" রাখেন। তারও কথা রেখেছিলেন। সেই দীপনেরই আজ জন্মদিন।
এই নীলগ্রহে আজও থেকে গেছে দিয়া আর নিখিলের সন্তান। গ্যাসটা অফ করে পায়েসটা একটা টিফিনবক্সে ঢেলে রাখে দিয়া। অপরাজিতার পাশাপাশি দিয়াও যে দীপনের মা হয়ে উঠেছে। শুধু নানা শারিরীক জটিলতায় দ্বিতীয়বার আর মা হতে পারে নি দিয়া।
ছোটদের সৃজন
অভ্রদীপ ঘোষ
No comments:
Post a Comment