Saturday, August 21, 2021


 

বিশেষ রাখিবন্ধন  সংখ্যা 




 চিঠি 

রাখির চিঠি (পরদেশী ভাইকে)
নন্দিতা পাল

প্রিয় আবদুল
প্রযত্নে সুলতান খান
শিরপুর স্কয়ার,
নিউ কাবুল, আফগানিস্থান
পিন কোড-২০২১১

কেমন আছিস আবদুল। দেখতে দেখতে কত বছর হয়ে গেল তুই তোর বাবার সাথে আসতিস আমাদের বাড়িতে কত রকমের শুকনো ফলের বাহার নিয়ে। এখনও মনে আছে, বোধহয় প্রথম তোকে কাবুলিওয়ালা মানে তোর বাবা, সঙ্গে নিয়ে এসেছিল সেবার। আমার মা তখন ফল কেনাকাটায় ব্যস্ত, কাবুলিওয়ালা আধভাঙ্গা বাংলায় বিভিন্ন ফল নিয়ে বলে চলেছে। তুই চুপ করে তোর বাবার গা ঘেঁসে বসে ছিলি। আমার মা অনেক বার তোকে কত কথা জিজ্ঞাসা করলেও কোন উত্তর দিস নি তুই। হঠাৎ আমি সামনে আসতেই তুই একগাল হেসে ফিসফিস করে কাবুলিওয়ালাকে কিছু বলেছিলি। কাবুলিওয়ালা পরে বলেছিল, তোর দিদি, আয়েশা, যার সাথে সারাক্ষণ খেলতিস দেশে; ওকে ছেড়ে আসতে তুই খুব কান্নাকাটি করেছিলি। আর সেদিন তুই আমায় দেখে খুশি হয়ে বলে ছিলি ‘ছোটি দিদি’। , কাবুলিওয়ালা তোকে এ দেশে নিয়ে এসেছিল কলকাতা দেখাতে আর কাজ ও শেখাতে। তুই তোর ছোটি দিদিকে সবচেয়ে মিস করতিস। আমাদের বাড়ি এলে যেতেই চাইতিস না। এমন ও হয়েছে কাবুলিওয়ালার কেনাকাটা হয়ে গেলে বসে থাকতে হত, তোর গল্প আর খেলা শেষ ই হত না। পরে তোকে একটা স্কুলে ও ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল কাবুলিওয়ালা । সেই কয়েক বছর রাখি, ভাইফোটায় আমার ভাইয়ের সাথে তোকেও পরাতাম প্রতিবার।

একবার তোরা দেশে চলে গেলি আয়েশার শরীর ভালো নয় শুনে, যাবার আগে এসেছিলি দেখা করতে। খুব মন খারাপ ছিল তোর। সেদিন ছিল রাখি, তোকে রঙ বেরঙের রাখি পরিয়ে দিলাম আর মার হাতের পায়েস খেয়ে একটু তোর মনটা একটু ভাল হল। এরপর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে, আমি তখন পড়াশুনোর জন্য কলকাতার বাইরে। বাড়ি এসে শুনলাম, কাবুলিওয়ালা আসে মাঝে মাঝে ফল নিয়ে, কিন্তু শরীর খুব ভেঙ্গে গেছে। আয়েশা মারা যাওয়ায় তুই আর ফিরে আসিসনি কলকাতায় তোর মাকে ছেড়ে। কাবুলিওয়ালার কাছে একবার আমার জন্য উপহার পাঠিয়েছিলি। কাঠের একটা টুকরোর ওপর তুই বাংলায় খোদাই করে লিখেছিস ‘ছোটি দিদি’। খুব যত্নে রেখেছি ওটা আমার আলমারিতে, যখন ই দেখি চোখ অকারণে জলে ভরে আসে।  

আজ এত বছর পরে পুরনো এক ডায়েরিতে তোর ঠিকানা খুঁজে পেলাম। কোন একদিন ভাগ্যিস লিখে রেখেছিলাম। কাবুলিওয়ালা তো আর আসে না অনেক বছর, দেশে ফিরে গিয়েছে নিশ্চয়ই। তোর পছন্দের ময়ুর রাখি পাঠালাম আবদুল। কদিনেই পৌঁছে যাবে। ভালো থাকিস, এই দুর্দিনে খুব সাবধানে থাকিস এই প্রার্থনা করি।

ইতি
তোর ছোটি দিদি
৬এ এসপ্ল্যানেড। কলকাতা, ৭০০০১৩


রাখির চিঠি (প্রবাসী ভাইকে)
ঝুমক গোস্বামী 

স্নেহের পিকলু,

                 মেক্সিকোর ঘরের পুবদিকের জানলা দিয়ে নরম রোদখানা  এতক্ষনে নিশ্চয়ই তোকে ছুঁয়ে ফেলেছে, তুই হয়তো আধবোঝা চোখে হাতড়ে বেড়াচ্ছিস বিরাটির বাড়ির লম্বা বারান্দাটা l জানি পাশের বাড়ির ইলিশ মাছের সুঘ্রান বড়োই প্রবল, কিন্তু সে ভৌগোলিক দূরত্বের কাছে পরাধীন, নরম রোদের চাদর সরিয়ে তোর আঙুলগুলো স্পর্শ করতে চাইছে যে অক্ষরগুলো তা আসলে অমূল্য স্নেহ, যা বিনি সুতোতেও বটগাছের শিকড়ের মতো অগুনতি পথ পাড়ি দিতে পারে l
যে বন্ধন দুর্যোগের রাতে ছাতা হয়ে যায়, খাবারের গ্রাসে ভেসে ওঠে নিষ্পাপ হাসিমুখ - দুহাতে জড়িয়ে রাখে ভরসার আকাশ.....
দিদি আর ভাইয়ের এই রক্ষাকবচ অনির্বান হোক, আমার আঁচলের সব মমতা, স্নেহ তোকে আজীবন ছুঁয়ে থাক ভাই....
দেখ, সূর্যের আলো তোর আঙুলছুঁয়ে বলে যাচ্ছে "পৃথিবীর সব দুর্যোগের রাতে দিদি স্নেহ দিয়ে আগলে রাখবে "

দিদিমনি 



রাখির চিঠি (বোনকে)
পার্থ বন্দোপাধ্যায় 

প্রিয় সুতপা,

আশাকরি সব কুশল।  প্রতিবারই রাখীবন্ধন এর দিন, রাখি  পরা এবং মিষ্টি খাওয়ার পর এতটাই আড্ডায় মেতে উঠি  যে নব্বই এর দশকে, উত্তর ভারতের প্রত্যন্ত  গ্রামের এক বাড়িতে রাখিবন্ধন  অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা,  বলব বলব করেও বলা হয়ে ওঠে নি।

আজ রাজবাড়ী দিঘির কোনায়, বাদামওয়ালা ছেলেটা তার  উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদের বাড়িতে বোনের  সাথে, মোবাইল ফোনে কথোপকথন  শুনে, সব  মনে  পড়ে গেল। 

কথিত  আছে   যে,  শ্রাবণী পূর্ণিমায় যখন চাঁদের উজ্জ্বল  বর্ণছটা   যখন  কালোমেঘে   অর্ধেক আকাশ ঢেকে   থাকবে,  ভূপৃষ্ঠ   ঢাকা  থাকবে  ভিজে  সবুজ  ঘাসে,  তখন  ব্রাহ্মণ  পুরোহিত স্নান  সেরে অভিষ্ট দেবতাকে জল দান করে,  পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্য বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ করে, রেশমি  বস্ত্রে, গোটা ধান, চাল, শস্যদানা এবং লাল  বা  গেরুয়া  পবিত্র  মাটির পুঁটলি রাজার হাতে  বাঁধবার  সময় বলবেন,  "হে ঈশ্বর তুমি আমাদের মহান রাজাকে অসুরদের হাত থেকে রক্ষা করো।" 

এভাবেই  ব্রাহ্মণ,  ক্ষত্রিয়,  বৈশ্য,  শুদ্রেরা রাখিবন্ধন  উৎসব  পালন  করে  থাকেন।

হিন্দু  মাইথোলজিতে  আমরা  দ্রৌপদিকে দেখেছিলাম,তিনি  তাঁর  নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে শ্রীকৃষ্ণের  হাতে  বেঁধেছিলেন। 

দেশের  বাড়ির  বাইরে  থাকবার  সুবাদে , প্রতিবছরই  নতুন  নতুন বোনেরা, হাতে রাখি পরিয়ে  দেয়, আবার  কালের  স্রোতে  তারা হারিয়েও   যায়। কিন্তু   সেবার  রাখি পরেছিলাম, উত্তর ভারতের একটি পারিবারিক  রাখিবন্ধন অনুষ্ঠানে। উত্তর ভারতে  উপস্থিত  থাকবার  সুবাদে।  প্রকৃতপক্ষে রাখি  পরা  যে  কতটা  ভাগ্যের  এবং  আনন্দের বিষয়, তা   অন্তর দিয়ে  অনুভব করেছিলাম। 

আমরা  যেভাবে  কুলো বরণডালা দিয়ে নতুন জামাই   কে বরণ করি।  ঠিক সেভাবে শুদ্ধতা সহকারে উপবাস থেকে বোন ভাইকে বরণ করবে। সেই বরণকুলোর উপকরণ আর আড়ম্বরের আতিশয্যে আমার চোখ কপালে উঠবার জোগাড়। সম্ভ্রান্ত অবস্থাপন্ন বাড়িতে, অথবা অনেক বোন, একটি মাত্র ভাইয়ের  প্রাপ্তি যোগ সর্বাধিক।  তারা পাবে সোনার রাখি। রূপো বা চাঁদির রাখি বা হাজার হাজার টাকার রাখির তো ছড়াছড়ি। বরণ করবার পর, প্রথমে কপালে তিলক পরিয়ে, মিষ্টিমুখ, উপহার দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে  রাখি পরাবে। সেই মন্ত্রের অর্থ,  " হে ঈশ্বর,  তুমি আমার ভাই কে সর্ব্ব বিপদের থেকে রক্ষা করো, আমার ভাই কে দীর্ঘজীবন দান করো। "

রাখি পরাবার সময় কোথাও কোথাও ভাই সংংগীত  পরিবেশন করে থাকে।  তবে বেশির ভাগ ভাই-ই ,  "এক হাজারো মে মেরী ব্যাহেনা হ্যায়..." গানটি গেয়ে থাকে। সেই দিনটির স্মৃতি কোনো দিন ভুলতে পারব না।

ভালো থেকো।  সর্বাঙ্গীণ শুভকামনায়। 

 পার্থদা




রাখির চিঠি (বোনকে)
স্বপন কুমার দত্ত 

স্নেহের বোন সবিতা,

                         প্রথমেই তোমাকে জানাই আমার আন্তরিক আশির্বাদ ও ভালোবাসা। জামাইকেও আমার আশির্বাদ দিও। ভাগ্নে ভাগনিদের জানাই আমার ভালোবাসা।
                   আজ বারবার তোমার কথা মনে পড়ছে। খুব ছোট্টবেলা থেকেই এই দিনে আমাকে রাখী পড়িয়ে দিতে। সকাল বেলায় স্নান করে সেজেগুজে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিতে, আর বলতে " ও দাদা কখন উঠবে, তোমায় রাখী পড়িয়ে দিয়ে আমি খেতে পারবো।" 
            আমি ইচ্ছে করে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতাম। তুমি রেগে যেতে। এরপর রাখী পড়িয়েই বলতে "দাও এবার কী দিচ্ছ।" 
             আজ এসব অতীত। বিয়ে হয়ে কতদূর চলে গিয়েছ। এখন আর ছোট্ট বোনটি নেই। তুমি নিজে আজ মা হয়ে গিয়েছ। কিন্তু সেই দিনটির কথা ভুলি কী ভাবে। তোমারও নিশ্চয়ই আজকের কথা মনে পড়ছে।
             যাক বোন ভালো থেকো। আজ রাখী বন্ধনের দিনে প্রাণ ভরে আশির্বাদ করি।মনে মনে বিনি সুতোর রাখী পড়িয়ে দিও, তাহলেই আমার রাখী পড়া হয়ে যাবে।  
  আজ এখানেই শেষ করছি।

                                    
ইতি
                          
তোমার দাদা



প্রবন্ধ/নিবন্ধ 

মানুষের মিলনের সেতুবন্ধন করেছে রাখীবন্ধন উৎসব

গৌতম চক্রবর্তী

রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশের প্রায় সব উৎসবের উৎসই পুরাণ। পুরাণের আবার ক্রনোলজি খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। রাখীর শুভ সূচনার পৌরাণিক আখ্যান কিন্তু চার্জড করবে কলির দেবদাসদের। মন্ত্রপূত রাখীর পৌরাণিক বাঁধন ভাইয়ের জন্য নয়, তা বরাদ্দ ছিল পতিদেবতার মঙ্গল কামনায়। ভনিতা না করে আসল কথাটুকু বলা যাক। দেবাসুরের ভয়ানক যুদ্ধে দেবরাজ ইন্দ্রের প্রাণ যাবার উপক্রম হলে পতিঅন্ত প্রাণ ইন্দ্রাণী ধ্যানে বসে কোন এক শ্রাবণ পূর্ণিমায় স্বামীর জন্য তৈরি করলেন মন্ত্রপূত রক্ষাবন্ধন। সেই কবচ পরে অজেয় দেবরাজ ভীমবেগে বঙ্গভূমিতে ধাবিত হয়ে নিধন করলেন অসুরকুল, ফিরলেন স্বর্গপুরীতে। তবে রাখীর রিভাইসড এডিশন বা ভ্রাতৃকরণের শুরু হল মৃত্যুরাজা যম, এবং তস্য ভগ্নী যমুনার রক্ষাবন্ধনের মাধ্যমে। দেবকুলের হয়েও অপ্রিয় মন্ত্রক পাওয়া যমরাজ দিনরাত মরা নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে বিমর্ষ বোধ করেন। দুঃখ ভোলাতে যমুনা রাখী বাঁধলেন ভাইয়ের হাতে, ফোঁটা দিলেন যমের কপালে। রক্ষাবন্ধনের অমর মহিমায় অমর হলেন মৃত্যুরাজা।

 শিশুপালের সঙ্গে তখন মারকাটারি বিরোধ শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেবের। কথা দিয়েছিলেন শিশুপালের মাকে যে তার একশত অপরাধকে ক্ষমা করে দেবেন। উদ্ধত শিশুপাল অচিরেই সেই সীমারেখা লঙ্ঘন করল। কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে নারাজ মদমত্ত শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমানের সীমারেখা পেরোলে ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে কৃষ্ণ শিশুপালকে বিনাশ করলেন সূদর্শন চক্রের আঘাতে। ঘটনার ঘনঘটায় সূদর্শন চক্রাঘাতে কৃষ্ণের নিজের হাত কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এলে শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাত বেঁধে দেন কৃষ্ণা দ্রেীপদী। শ্রীহরি কথা দেন এই রক্ষাবন্ধনকে তিনি সারাজীবন মনে রাখবেন। কুরু রাজসভায় দুঃশাসনের দুঃসাহসে বেআব্রু ভ্রাতৃবধূর শরীরে কৃষ্ণ প্রদত্ত একটুকরো কাপড়ের বাঁধনই ফিরে এল অন্তহীন আব্রু হয়ে যা মান বাঁচাল ভাই বোনের চিরায়ত সম্পর্কে।

 রক্ষাবন্ধন তাই কবে রাখীবন্ধন হলো সেই সন তারিখ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে রাখীর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে রক্ষা পেল এতে তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাখীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও কম উৎসাহব্যঞ্জক নয়। খৃষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে বৃষ্টিভেজা ঝিলমের পাড়ে সুদুর ম্যাসিডন থেকে সসাগরার অধিশ্বর হতে ভারত সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে ঘাঁটি গেড়েছেন সম্রাট আলেকজান্ডার। ভয়াল, ভয়ংকর যুদ্ধশেষে অপরাজেয় আলেকজান্ডারের কাছে বিনাযুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করলেন তক্ষশিলা রাজ অম্ভি। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ নীতিতে গ্রিকরাজের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে আশপাশের  আরো কিছু ছোটখাটো পুরুবিদ্বেষী রাজাকে জুটিয়ে প্রতিবেশী শক্তিশালী রাজ্য পুরুকে পরাস্ত করতে চাইল। পুরুর আসল শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন আলেকজান্ডারের ভারতীয় পত্নী রোক্সানা। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এই উপজাতি মেয়েকে বিবাহ করেন আলেকজান্ডার এবং এই রাজকন্যাই হয় তাঁর জীবন মরণের সাথী।

 পুরুর বীরত্বে ত্রস্ত আসমুদ্র হিমাচল। চুপি চুপি হাজির  হলেন রোক্সানা পুরুর দরবারে। আলেকজান্ডারের অজান্তেই তাঁর প্রাণভিক্ষা করে গেলেন তাঁর সহধর্মিনী পুরুকে ভ্রাতৃত্বের  রাখীবন্ধনের মাধ্যমে। রোক্সানাকে কথা দিলেন পুরু কোন অবস্থাতেই আলেকজান্ডারের ক্ষতি হতে দেবেন না। বৃষ্টিভরা রাতে ঝিলমের তীরে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধকৌশলে পুরুর সেনারা যখন কোনঠাসা তখন পুরুর বীরত্বের সামনে অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্যেও বেকায়দায় ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন সম্রাট আলেকজান্ডার। উদ্যত তরবারি উঁচিয়ে গ্রিকরাজের বুকটা এফোঁড়-ওফোড় করে দেবার প্রাক্কালে চোখ পড়ল রাখী বাঁধা হাতের ওপর। রোক্সানার দেওয়া রাখী। ভাই পাতিয়ে গিয়েছিল রোক্সানা। কথা দিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর কোন ক্ষতি হতে দেবেন না। কথা রাখলেন তিনি। অন্যমনস্ক হয়ে পড়াতে ভীমবেগে আক্ৰমণ শানালো গ্রীকবাহিনী। বন্দী হলেন পুরুরাজ। আলেকজান্ডারের কাছে দাবি করলেন রাজার প্রতি রাজার মত আচরণ। শৃঙ্খলিত পুরু রাজের প্রতি সশ্রদ্ধ আলেকজান্ডার মুক্তি দিলেন পুরুরাজকে। অন্তঃপুরের পর্দার আড়ালে যে সৈনিক শেকল পরিয়ে এসেছিলেন আগের রাতেই তার খবর ছিলো না ম্যাসিডনাধিপতির কাছে।

 চরম সংকটে চিতোর, গুজরাটের বাহাদুর শাহের আক্রমণে মরণপন যুদ্ধে হার মেনেছেন রাজপুত যোদ্ধারা। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় দিল্লীর মোঘল সম্রাট হুমায়ুনকে ‘খত’ লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন রাণী কর্ণাবতী। চিঠির সঙ্গে রাখী পাঠিয়ে বোনকে রক্ষা করার আবেদন জানালেন রাণী। কর্ণাবতীর এই আবেদনে গলে গেল মোগল সম্রাটের হৃদয়। হিন্দু রাখীর সম্মান রক্ষার্থে মুঘল বাদশাহ মেবার অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করলেন গুজরাট নরেশের আক্রমণ থেকে বহিনকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু মেবার পৌঁছানোর পূর্বেই শত্রুপক্ষের শাণিত তরবারির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রাজপুত যোদ্ধারা বীরের মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যদিকে আত্মসম্মান রক্ষার্থে রাজপুত রীতি মেনে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে ‘জওহর ব্রত’ পালন করে প্রাণত্যাগ করেন রাণী কর্ণাবতী। গণচিতা জ্বলে ওঠে রাজপুতানায়। সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় বোনকে বাঁচাতে না পারার অনুশোচনায় দগ্ধ মোগল বাদশাহ হুমায়ুনের হৃদয়।

 রাখীকে ঘিরে রাখীবন্ধনের প্রেক্ষাপট আবর্তিত হয়েছিল অবিভক্ত বাংলাকে ঘিরে। ‘বাংলার মাটি বাংলার জলে’ পুষ্ট রাখী সেতুবন্ধন রচনা করেছিল এপার বাংলা ওপার বাংলার। ১৯০৫ সাল। বড়লাট লর্ড কার্জন অনুভব করলেন বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে হিন্দু মুসলিম বিভেদ সৃষ্টি করা। ত্রিকালদর্শী রবি কবি বললেন, ‘ইংরেজই মুসলমানকে আমাদের বিরুদ্ধে করিয়াছে...... শনি তো আর ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না, অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্পর্কে সাবধানতা অধিক প্রয়োজন’। সেই ফাটল জুড়তেই প্রয়োজন হয়েছিল রাখীবন্ধন উৎসবের। একজোট হিন্দু মুসলিম বাংলার মাটি বাংলার জলের সুর কণ্ঠে নিয়ে রাখীর বাঁধনে একত্রিত হয়ে উত্তাল বাংলায় মিলনোৎসবে সামিল হয়েছিলেন।

 বঙ্গভঙ্গে ঘর ভেঙেছিল শত্রুপক্ষ। আর আজ আমাদের এই প্রিয় বঙ্গদেশকে ভঙ্গ করছি আমরাই। অন্তর্কলহের জেরে দার্জিলিং-এর বুকে গোৰ্খাল্যান্ডের নামে বা উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য হিসাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবনা মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের রাজনীতিবিদদের কিছু যাবে আসবে না, অঙ্গরাজ্যের তালিকায় নতুন একটি রাজ্যের নাম সংযোজিত হবে। কিন্তু এই বঙ্গদেশ হবে টুকরো টুকরো। সহজ সরল নেপালী ভাষী বোনের হাতে বাঙালী ভাই কি আর রাখী বাঁধতে পারবে না? তাই যুগে যুগে কালে কালে রাখীবন্ধন মানুষের মধ্যে মিলনসেতু রচনা করেছে। এই রাখীবন্ধন উৎসব সবরকম বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরূদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।




একটি রাঙা রাখী
চিত্রা পাল

রাখী বন্ধন উৎসব হয় শ্রাবণী পূর্নিমা বা ঝুলন পূর্ণিমাতে। এই উৎসবে বোন ভাইকে রাখী পরিয়ে দিয়ে জীবনভোর বাঁধা পড়ে এক পবিত্র সম্পর্কে। একবার এক রাখীভাই যেভাবে রাখীবোনের মর্যাদা  রক্ষা করেছিলো সে কাহিনী আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খোদিত। সে কাহিনী রাজপুতানার মেওয়ারের রাণী কর্ণাবতী আর মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের।

রাজপুতানার মেওয়ার রাজ্যের রাণী ছিলেন কর্ণাবতী। তিনি ছিলেন চিতোরের মহারাণা সঙ্গের স্ত্রী। এই রাণীর ছিলো দুই সন্তান-রাণা উদয় সিং আর রাণা বিক্রমাদিত্য। যখন মুঘল সম্রাট হুমায়ুন তাঁর  রাজ্য বিস্তারের জন্য অন্যত্র ব্যস্ত ছিলেন সেই সুযোগে গুজরাটের বাহাদুর শা ১৫৩৩ খৃষ্টাব্দে চিতোর আক্রমণ করেন।

মহারাজা সঙ্গের মৃত্যুর পরে মহারাজা রতন সিং সমস্ত রাজপুত রাজ্যগুলোকে এক পতাকার তলায় নিয়ে এসে চিতোরের সিংহাসনে বসেন। রাণা রতন সিংহের মৃত্যুর পরে তাঁর ভাই চিতোরের মহারাণা হন। বিক্রম তাঁর আর্মিতে সাত হাজার কুস্তি জানা লোক নিয়োগ করলেন। তিনি ভালোবাসতেন কুস্তি শিকার জীব্জন্তুর যুদ্ধ এসব। মেওয়ারের অভিজাতদের এসব পছন্দের ছিলো না। ক্রমে এই নিয়ে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে তাঁরা তাদের রাজ্য পরিত্যাগ করে অনেকে সম্রাট বাহাদুর শা বা আর কারোর কাছে  চলে গেলেন।     

  গুজরাটের শাসক বাহাদুর শা চিতোর আক্রমণ করে এই সব অসন্তুষ্ট দেশত্যাগী লোকদের নিয়ে। যদিও বিক্রম চেষ্টা করে ছিলেনবাহাদুর শাহের সঙ্গে সন্ধি করতে, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। বাহাদুর শা  আরো শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেন। তার বিশাল সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাণা বিক্রমের বাহিনী পারবে না। রাজমাতা সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠালেন। কিন্তু বাহাদুর শা তা পরিত্যাগ করে দিলেন।  

এই পরিস্থিতিতে মহারাণী কর্ণাবতী  মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে প্রস্তাব দিলেন যে রাজপুত আর মুসলিম দুই  দলই তাদের দুজনের শত্রু বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে লড়বে। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন সেই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন কারণ রাজমাতা কর্ণাবতী বুঝে গিয়েছিলেন, মহারাণা বিক্রমাদিত্য ভালো দক্ষ  যোদ্ধাও নয় ভালো শাসকও নয়। সেইজন্য মেওয়ারের সম্মান রক্ষা করার জন্য তিনি  সম্রাটকে রাখী  পাঠিয়ে ভাই হয়ে সাহায্য  করার অনুরোধ করেন। হুমায়ুন ধর্ম ভাই হয়ে তাঁকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। বোনের ভাই সেই রাজত্ব রক্ষার দায়িত্বও নেন। হুমায়ুন রাজমাতার রাখীর মর্যাদা দিয়ে প্রচুর উপহার পাঠান আর তাঁকে  আশস্ত করেন যে তিনি সাহায্য করতে আসবেন।     

যখন চিতোর আক্রমণ হয় তখন হুমায়ুন গোয়ালিওর ফোর্টে ছিলেন। আর তিনি তাঁর দলকে দিল্লি হয়ে আগ্রা যাবার নির্দেশও দিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু যখন সেই দলকে ফিরিয়ে তিনি চিতোরে পৌঁছলেন, তখন দেরী হয়ে  গিয়েছে। রাজমাতা কর্ণাবতী জহর ব্রতে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন প্রাসাদের সব রমণীকে নিয়ে। যাই  হোক জহর ব্রতের আগে তিনি রাজকুমার উদয়সিংহকে নিরাপদে বুন্দি ফোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ধাত্রী পান্নার হাত দিয়ে।

হুমায়ুন দুঃখ পেয়েছিলেন রাণী নেই শুনে,  আর যখন শুনলেন রাজমাতা জহরব্রতে জীবন দিয়েছেন  তখন ক্রোধে আগুন  হয়ে বাহাদুর শা কে আক্রমণ করে তাকে পরাস্ত করলেন। এরপর প্রিন্স উদয় সিংকে  বুন্দি থেকে আনিয়ে তাকে মহারাণা পদে অভিসিক্ত করলেন।  

সম্রাট  হুমায়ুন এদেশে এসেছিলেন ভারতের বাইরের দেশ থেকে। কিন্তু তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিতে ভাইবোনের  পবিত্র সম্পর্কের কথা জানতেন। এক সময় তিনি অমরকোটের রাজপুত শাসক বীরশালের কাছে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। সে সময়   বীরশালের পাটরাণী তাঁকে নিজের ভাই এর মতো দেখতেন। হুমায়ুনের ছেলে  সম্রাট আকবর তাঁর অমরকোটে থাকাকালীন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেজন্য   তিনি চেষ্টা করেছিলেন এই সম্পর্কের  বোন রাণী কর্ণাবতীর রাখীর মূল্য দিতে।জাতি ধর্ম নির্বিশেষে একটি রাঙা রাখী হয়েছিলো সেই মর্যাদার রক্ষক। যে কাহিনী আজও ফেরে লোকমুখে। 

   


ঝুলনযাত্রা ও রাখী পূর্ণিমার ঐতিহ্য 
 অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত 

সুপ্রাচীন কাল থেকে ঝুলন ও রাখী উৎসব ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় এবং সমাজ জীবনে এক অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে চলেছে। এই উৎসবের মুখ্য উদ্দেশ্য হল প্রেম, মৈত্রী, জাতীয় সংহতি, জন জাগরণ, দেশভক্তি ও দেশপ্রেম এবং আধ্যাত্মিকতার বিকাশ সাধন। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন উৎসব। 
আজও ধর্ম প্রাণ নরনারীদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে এই উৎসব হয়ে ওঠে আনন্দমুখর। এই উৎসব বেশ কয়েকদিন ধরে চলে। বর্তমানে কালের বিবর্তনে কিছু পরিবর্তিত রূপ আমরা লক্ষন করি। ভারতবর্ষের সর্বত্রই এই উৎসব ধুমধামের সাথে পালিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মণিপুর, বৃন্দাবন এবং মায়াপুর ও নবদ্বীপ ধাম। প্রতিটি মঠ, মন্দির এবং গৃহাঙ্গনকে আলোকমালা ও ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও মেতে ওঠে উৎসবে। পাড়ায় পাড়ায় দেখা যায় ঝুলন উৎসব। শ্রাবণী পূর্ণিমাকে ‘ঝুলন পূর্ণিমা’ ও ‘রাখী পূর্ণিমা’ বলা হয়।

ঝুলন ও রাখী উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু হলেন শ্রীকৃষ্ণ
ভগবান। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই নানা লীলার কেন্দ্রবিন্দু। তার মধ্যে সর্বোত্তম নরলীলা। ঝুলন তারই মনোরম প্রকাশ। দ্বাপর যুগে বৃন্দাবনে স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে যখন গগন মণ্ডল উদ্ভাসিত, তখন সখা ও গোপীগন পরিবেষ্টিত হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঝোলায় (দোলায়) আরোহণ করে লীলা বিহার করেন এবং ভগবৎ আনন্দের সঞ্চার করেন সমবেত ভক্তদের মধ্যে। এই ঝুলন ‘হিন্দোল ক্রীড়া’ অর্থাৎ ঝুলা বা দোলা খাওয়া। ঝুলন প্রেমের উৎসব। মহামিলনের ‘পবিত্র নীড়’। ভগবানের সঙ্গে মিলিত হবার উৎসব। তাঁকে আপন করে পাওয়ার উৎসব। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মহামিলন উৎসব। যুগ যুগ ধরে আসমুদ্র হিমাচলের কোটি কোটি নরনারী সমস্ত প্রতিকূলতা জয়ের জন্য পরম পুরষোত্তমের নিকট আরাধনা করে চলেছেন।

কেন এর নাম রাখী পূর্ণিমা
শ্রাবণী পূর্ণিমাতে শ্রীকৃষ্ণ গোকুল বাসীদের হাতে এবং গোকুলবাসীরা ভগবানের হাতে মঙ্গলসূত্র রাখী বেঁধে দিয়ে পরস্পরের রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাই এই পূর্ণিমার নাম রাখী পূর্ণিমা। 

বর্তমানে ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনে রাখী বন্ধন এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। জাতি,ধর্ম,বর্ণের সীমা অতিক্রম করে পরস্পর পরস্পরের শুভ কামনায় রাখী বন্ধন করে চলেছে অবলীলাক্রমে।


পুরানে উল্লেখ্য একটি ঘটনা হল যে সত্যযুগে দেবরাজ ইন্দ্র বহু বছর ধরে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হচ্ছিলেন। তখন দেবগুরু বৃহস্পতির নির্দেশে ইন্দের স্ত্রী ইন্দ্রানী শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন ইন্দের হাতে রক্ষা কবচ পরিয়ে দেন। ইন্দ্র যুদ্ধে গমন করলেন। অসুরদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হল। অবশেষে অসুররার পরাজিত হল। 

আবার ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বালী বধের পূর্বে সুগ্রীবও রামচন্দ্রের হাতে লতা পাতা দিয়ে রক্ষা কবচ পরিয়ে দিয়েছিলেন ।

দ্বাপরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবাসীদের হাতে রাখী পরিয়ে দিয়েছিলেন।

ইতিহাসেও রয়েছে রাখী উৎসবের টুকরো স্মৃতি যেমন, কলিতে রাধাকৃষ্ণ মিলিত তনুধারী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও বৃন্দাবন ও নবদ্বীপে ঝুলন এবং রাখী উৎসবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।

ঐতিহাসিক মত প্রচলিত আছে যে, সিকন্দরের পত্নী রৈক্সোনা রাখী পূর্ণিমার দিন রাজা পুরুকে রাখী পাঠিয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে রাজা পুরু যখন সিকন্দরকে হত্যা করার জন্য তরবারি উদ্যত করেন তখন তাঁর নিজের হাতের রাখীর দিকে দৃষ্টি পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে রাজা পুরু তরবারি নামিয়ে নেন এবং সিকন্দরের প্রাণ রক্ষা পায়।

বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরস্পরের হাতে রাখী বেঁধে দিয়ে দেশ রক্ষার সঙ্কল্প করেছিলেন।

পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থণা- ঝুলন ও রাখী পূর্ণিমা উৎসব প্রসারিত হোক সমাজ জীবনের প্রতি কোনে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হোক শান্তি, সংহতি, দৃঢ় হোক মানব মেল বন্ধন।



গল্প 


মায়াডোর
ড.  ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ রাখী পূর্ণিমা।  গোপাল মন্দিরের মাঠে বড় মেলা বসেছে। আলো আর আকাশ  ছুটছে মেলার মাঠের দিকে। কী আনন্দ। আকাশের বাজুবন্ধে আলোর পরানো রাখী, বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।আলো আকাশের হাত ধরে বলে --  ভাই চল্ তোকে  মিষ্টি খাওয়াবো। 
  -- না দিদি আমার খুব শখ  হাতে উল্কি আঁকার। বন্ধুরা মেলার মাঠে  উল্কি আঁকিয়েছে।
  -- আচ্ছা ঠিক আছে কিন্তু মা বকলে আমি জানি না। 
  -- না না আমার চাই চাই চাই। 
নিতান্তই গরীব পরিবারে ওদের দিনাতিপাত। কিন্তু তার জন্য মনে কোন দুঃখ  নেই । ওদের মা চাল কলে কাজ করে বাবা যাত্রা দলে গান লেখে, নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। সংসারের ভালো মন্দ দেখার ফুরসৎ নেই। তবে যখন বাড়ি থাকে ছেলে মেয়েরা আনন্দে মেতে থাকে। 
মেলায় নাগরদোলা,  পুতুল নাচ,  কুয়োর মধ্যে মোটর সাইকেল রেস কত কী। ওদের কাছে অত পয়সা নেই। মিষ্টি খেয়ে উল্কি বুড়োর কাছে গিয়ে দুজনে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে --   একটা ফুল আঁকো তো দাদু। আচ্ছা তার ভিতরে আমাদের নাম লিখে দিতে পারবে? 
  -- লিচ্চয়। খুব পারবো। 
মেলা থেকে নাচতে নাচতে বাড়ি ফেরে দুটি  বালক বালিকা। 
সময় এগিয়ে চলে। আলো মাধ্যমিক দেবে। আকাশ ক্লাস এইট। সংসার চালাতে ওদের মা দিশেহারা। আলোর মত রূপসী মেয়ে এই গোপালগঞ্জে  একটাও নেই। তাই ভয়ে  আরো কাঁটা হয়ে থাকে। চালকলের মালিকের মেয়ের বিয়ে সবাইকে নিয়ে  গেছে আলোর মা। মালিকের এক বন্ধু তার ছেলের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ছেলে দূরে কাজে যাবে তাই তার মা বাবা বিয়ে দিয়ে পাঠাতে চায়। আলোর বাবা বাড়ি ফেরে নি মাস ছয়েক, কোথায় গেছে কবে ফিরবে কে জানে। পাড়ার সবাই পরামর্শ দিল  এমন রূপসী মেয়ে পাত্রস্থ করাই ভালো, সব থেকে বড় কথা বিয়ে তে কোনো দেনা পাওনা নেই। আলো শুধু কাঁদে আর ভাবে  মাধ্যমিক পাস করে আমি একটা কাজ পেয়ে যাবো। ভাই কে আমি ঠিক ভালো করে মানুষ করবো। 
সানাই বাজে। শাঁখ উলু বরণ ডালা.... আলো চললো শ্বশুর বাড়ি।ট্রেনে নতুন বর  আলোর জন্য নিয়ে এল রাতের খাবার আর জল। আলো খায়, ঘুমে চোখ বুজে আসে। 
ঘুম ভাঙে।  আধা অন্ধকার ঘুপচি টিনের চাল। দমবন্ধ লাগে। অনেক কষ্টে চোখ মেলে... কোথায় আছে বুঝতে পারে না, দেয়ালে বিশ্রী ছবি  দেওয়া ক্যালেন্ডার। এক স্থূলা মহিলা এসে  ভালো করে দেখে আলো কে তারপর কর্কশ সুরে বলে  --  আরে চিড়িয়া  ঘুম থেকে উঠেছে রে কমলি বিমলি দেখে যা।  আজ ই ওর নথ ভাঙা হবে। বহুৎ রূপেয়া দিয়ে কিনেছি। খুব খুবসূরৎ আছে লড়কি।উড়ে যায় যদি... 
মা গো বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে আলো। সপাটে এক চড় দেয় স্থূলা মাসী টি। আবার জ্ঞান হারায় আলো।
 আলোর দিন শেষ, এখন চোখ ধাঁধানো বিজলির দিন শুরু। 
রূপে র জৌলুস এ লাইনে এক ডাকে সবাই চেনে বিজলি কে। বিজলি কিন্তু তার ছোট ভাই আর মা কে ভুলতে পারে নি। প্রতি মাসে নিয়ম করে টাকা পাঠায়, চিঠি দেয়  কিন্তু ঠিকানা দেয় না । আর বছরে একটা দিন সুন্দর একটা রাখী পাঠায়।দুঃখে বুক ফেটে যায়, চোখের জলে ভাবে .. রাখী তো  শুধু জরি কাজ ফিতে আর ফুল নয় এ হল মায়ার ডোর।কোনদিন কাটবে না। 
সময় চলে আপন গতি তে। পনের টা বছর কেটে গেছে। বিজলি নিজে ই এখন এই সাম্রাজ্যের কর্ত্রী।  পুলিশ কে বশ করে, চোখে ধুলো দিয়ে এই শহরের বুকে  বড় বড় হোটেলে তিন খানা মধু চক্রের মালকিন। বাড়িতে এখনো টাকা পাঠায় অনেক টাকা। 
খুব ভোরে  দলের ছেলেরা এসে খবর দিল  --  মৌসী   এক নতুন পুলিশের এস. পি এসেছে। খুব খতরনাক।  ঘুষ নেয় না। মধু চক্রের খবর পেয়েছে। আজ রেইড  করতে যাবে।  কি করতে হবে বলো। বডি নামিয়ে দি? 
   -- ছি ছি এইসব কথা বললে মার খাবি আমার কাছে। আমি নিজে যাবো। কত বড় বড় অফিসার কে কাৎ করে ফেলেছি আমি। তোরা আমার উপর ভরসা রাখ। 
সন্ধে বেলায় সুন্দর করে সাজলো  বিজলি, পরনে স্বচ্ছ মসলিন শাড়ি। হোটেল ব্লু ভিউ এ ঢুকে সোজা চলে গেল চব্বিশ নম্বর ঘরে। এ ঘরটা ওর নামে সারা বছর বুকড  থাকে। আজ মধু চক্র বন্ধ। ওর ডাক পড়ল ম্যানেজারের অফিস ঘরে সেখানে এস. পি অপেক্ষা করছেন, ওর সাথে কথা বলবেন। 
বিজলি ঘরে ঢুকল। এস পি বিপরীতে চেয়ারে বসে। রাগে মুখ থমথমে। বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন  --  আগে থেকে খবর পেয়ে আজ মধু চক্র বন্ধ রাখলেন? ভেবেছেন আমি ধরতে পারবো না। আমার ভয়ে  এ শহরে সবাই কাঁপে এটা জানেন নিশ্চয়ই। 
বিজলি শরীরে একটা হিল্লোল তুলে ভুরু ধনুকের মত বেঁকিয়ে মধুর হাসল। তারপর বলল --  এত রাগ করছেন কেন। শরীর খারাপ হবে। চলুন আমার ঘরে কপালে  ওডিকোলন লাগিয়ে দি। শরবত বানিয়ে দেব। পান খাবেন ঠান্ডা পান? আর কিছু? 
ধনুকের ছিলার মত ছিটকে উঠলেন এস. পি  --   ছিঃ ছিঃ কি বলছেন আপনি? দেখুন আপনি বয়সে বড় বলে  সম্মান দিয়ে কথা বলছি। আরে আপনি তো তার যোগ্য ই নন। চরিত্র খারাপ হলে এ ধরনের ঈঙ্গিত দেয় তোদের মত মেয়ে ছেলেরা। লজ্জা করেনা এ সব কথা বলতে। জেনে রাখ তোর মধু চক্র আমি ভাঙব ই। নিজের মহল্লা য় গিয়ে যা খুশি কর। উফ্ফ্ আই কান্ট টলারেট..  উত্তেজিত হয়ে মুঠো শক্ত করে  শার্টের হাতা তুলছে এস. পি। হঠাৎ চোখ চলে গেল বিজলির....  হাতে উল্কি আঁকা তার মধ্যে লেখা আকাশ। 
পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে পড়ে যাবে এক্ষুনি, ভিতরে অসহ্য কাঁপুনি। চেয়ারের হাতল টা শক্ত করে ধরে দাঁড়াল বিজলি অস্ফুট মুখ থেকে বের হল  . .  ভাই
 -- ওই ডাক তুই মুখে আনবি না  , তোর পাপী মুখে মানায় না। আমার নিজের দিদি  স্বর্গের আলো বুঝলি। কত কষ্ট করে অন্যের সেবা করে আমার পরিবারকে হেল্প করেছে আমাকে মানুষ করেছে। তার প্রতিটি চিঠি আমার মুখস্থ। তাকে আমি খুঁজে বার করব ই। দেবী র মত ভক্তি করি তাকে। তুই পাঁকে থাকিস। সেখানে ফিরে যা। এই পাপ মুখ আমাকে আর দেখাস না। যা যা নরকের কীট। 
বিজলি দু চোখ ভরে দেখে ভাই কে। চোখ মুছে সিঁড়ি আঁকড়ে ধরে উঠে যায় উপর তলায়। 

ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজে। ভোরের ট্রেন ধরে আকাশ গ্রামের বাড়ি যাবে। আজ রাখী পূর্ণিমা, দিদি নিশ্চয়ই খুব সুন্দর রাখী পাঠিয়েছে। ফোন বেজে উঠল হঠাৎ। থানা থেকে মেজ বাবু  জানাল হোটেল ব্লু ভিউ  এ কে যেন ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। লোক জানাজানি হবার আগে ওরা ব্যাপার টা মিটিয়ে নিতে চায়। 
জিফ থেকে নেমে এস. পি আকাশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখেন এক মহিলা উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। মাথার চারপাশে মাটিতে রক্তের  চিহ্ন। 
   --  স্যার আপনি  শুধু  দেখে নিন বেঁচে আছে কিনা তারপর আপনি বাড়ির দিকে রওনা দেন। আমরা সব মিটিয়ে নেব.....বলে মেজ বাবু ডেড বডি চিৎ করে দিলেন
চারদিকে চাপা গুঞ্জন। আকাশ বলে উঠলেন -- ওহ সেই মধু চক্রের মালকিন। এভাবে  আত্মহত্যা করল কেন? 
সামনে এগিয়ে নাড়ি ধরতে ই তীব্র শক লাগল যেন... খোলা সাদা হাত টা এলিয়ে পড়ে আছে... উল্কি আঁকা ফুল, ফুলের মধ্যে লেখা আলো... 
দুলছে সারা পৃথিবী দুলছে আকাশের... .... 



 টান 
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

কি দুঃসহ জীবন!!  চাপ চাপ অন্ধকার চারিদিকে। ঘরের জানলাগুলো পুরোপুরি ঢেকে দেওয়া হয়েছে। একফালি আকাশ, একমুঠো রোদ্দুর, এক টুকরো টাটকা বাতাস, কিছু চেনা মুখের সারি, কিছু বলা,না বলা কথা  সবই বড় দুর্মূল্য এখানে। নিজের চলার স্বাভাবিক ছন্দকে ভুলে যেতে হয়েছে, ভুলে যেতে হয়েছে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততাকে। কোনো দুরাচারির ইঙ্গিতে তর্জনী স্থায়ী ভাবে এসে ঠেকেছে বন্ধ ঠোঁটে। আতঙ্ক.. অদ্ভুত এক আতঙ্ক গ্রাস করছে সবসময়; এই বুঝি ওরা এল; আরও, আরও ভয়াবহতায় টেনে নিয়ে যাবার জন্য। 
                                  শবনমের নির্দেশে এবার চোখ বন্ধ করলো জয়। জয়ের বন্ধ চোখের পাতার দিকে আড় চোখে তাকাতে তাকাতে ওর কোলের ওপর নিজের হাতে এঁকে ফোড় তুলে সেলাই করা রুমালটা সাবধানে রেখে দিল শবনম। একটু আগে জয় যখন ওর দিকে ডানহাতটা হাসিমুখে বাড়িয়ে দিয়েছিল ; সেটা ছিল শবনমের আজকের এই পবিত্র দিনের সেরা মুহূর্ত। রাখিটা যত্ন করে পরিয়ে দিতে দিতে ভাইজানের দীর্ঘায়ু, সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করেছিল শবনম।  যেমন করে এসেছে সেই ছোট্টটি থেকে। রাখিবন্ধন ওদের উৎসব নয় আদৌ। কিন্তু আব্বুর সঙ্গে কলকাতায় আসবার পর থেকে এই বাড়িটার এতগুলো পরিবারের মধ্যে বড়মা আর ভাইজান ওকে এমন আপন করে নিল যে ওরা হিন্দু আর ও নিজে মুসলমান সেই বোধই তৈরি হলোনা ওর মধ্যে সেই ছেলেবেলা থেকেই। নিয়ম করে নামাজ পড়বার সঙ্গে সঙ্গে তাই বড়মায়ের দুলে দুলে পড়া লক্ষ্মীর পাঁচালির শব্দগুলোও ওর মনে চিরতরে গেথে গিয়েছিল। ভাইজানের কপালে ওরই পরানো চন্দনের ফোঁটা। এবার চোখ খুলেছে ভাইজান। প্রদীপের আগুনকে হাতের পাতায় স্পর্শ করে জয়ের মাথায় ছুঁইয়ে দিল শবনম। বোনের মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে মঙ্গলময়ের কাছে ওর সুখী জীবনের প্রার্থনা করলো দাদা। জয়ের পায়ের পাতা ছুঁয়ে শবনমের মন বলে উঠলো 'তুমি চিরটাকাল আমার রক্ষাকবচ হয়ে থেকো, ভাইজান।' বাটিভরা সেমাই থেকে এক চামচ তুলে দিল প্রিয় দাদার মুখে। তারপর সেই ছোটবেলার মতোই হাত বাড়িয়ে দিল জয়ের দিকে....  'আমার তোফা? 'বড়মার শঙ্খ বাজানোর আওয়াজ তখন ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বাড়িটায়। 
‌                               কলকাতার ইসমাইল স্ট্রিটের তিনতলা পুরোনো বাড়িটায় জয় ও তার মা বাবাকে নিয়ে যে বাড়িওয়ালার পরিবার,ওনারা হিন্দু, মুসলিম মিলিয়ে তাদের কয়েকঘর ভাড়াটের সঙ্গে এমনই একাত্ম হয়ে বসবাস করেন। শবনমের আব্বা আবদুল একবার দেশে গিয়ে ফিরবার সময় যখন ছোট্ট শবনমকে নিয়ে ফিরে এসেছিল; তবে থেকেই শবনম  বড়মার মেয়ে আর জয়ের ছোটবোন হয়ে গেছে। এখানেই গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা শেখা সবটাই তার।দূরদেশে আরও কয়েকটি সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকা মায়ের অভাব কোনোদিন টের পায়নি শবনম।  সদাব্যস্ত আবদুল কাবলিওয়ালারও বড় ভরসার জায়গা ছিল শবনমের প্রতি জয় ও তার মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা। শবনম যেন এক রঙিন প্রজাপতি। তিনতলা বাড়িটার সকলের ঘরেই কমবেশি ওর অবাধ বিচরণ। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর সে। জোরে জোরে হেসে হেসে কথা বলে,  বাড়ির এঘর থেকে সেঘরে ছুটে ছুটে বেড়ায়। এখানকার সকলেই চোখে হারায় শবনমকে। তবে ভাইজানের নয়নের মণি সে।বয়সের বেশ অনেকটা ফারাক থাকলেও অবাধ ভালোবাসার এক নিবিড় বুনোট নিজেদের অজান্তেই কখন যেন তৈরি হয়েছিল ওদের এই সুন্দর সম্পর্ককে ঘিরে।এরপর এল সেইদিন। শবনমের একান্ত অনিচ্ছায়, এখানকার সকলের অমতে আবদুল কিছুটা চাপে পড়েই পনেরো বছরের মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দিল নিজের দেশের পথে। 
                                বেশ কিছুদিন হলো বড় অস্থির লাগে জয়ের। শবনম চলে যাবার পর থেকে মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকানো যায়না আর। কিছুটা স্বাভাবিক ছন্দে যদিওবা ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল ওরা সকলে মিলে; সাম্প্রতিক এই ভয়াবহ পরিস্থিতি ক্রমশ হতাশ করে তুলছে জয়কে। শবনমটার কথা বড় বেশি করে মনে পড়ে এই অস্থির সময়ের নিরিখে।এতগুলো বছর ধরে শবনমের দেওয়া রাখিগুলোকে মেলে ধরে চোখের সামনে। নতুন আশায় বুক বাধে আবার।যতটুকু পারছে ওদের খোঁজখবর রাখবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে সবসময়। তবুও, মনে জোর এনে, সমস্ত সূত্রকে কাজে লাগিয়ে শবনমকে ওই ভয়াবহতা থেকে বের করে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে শবনমের ভাইজান.... এরপর শুধু অপেক্ষা.... 
                       বোরখার আড়ালে মুখ লুকিয়ে, সর্বাঙ্গ ঢাকা পোশাকে এগিয়ে যাচ্ছিল একজন। উদ্ধারকারী একটি দলের বিমান পরিসেবার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ওর মন বলছিল, ও ঠিক পৌঁছে যাবে ওর অভিষ্ট লক্ষ্যে, আলোর ঠিকানায়। আজকের এই তিথিই ওকে মিলিয়ে দেবে ওর বিশ্বাস, নিরাপত্তা ও ভালোবাসার বন্ধনের সঙ্গে। স্বপ্ন.. স্বপ্ন দেখছিল শবনমের মন। এই নিরাপত্তাহীনতার জীবনে স্বপ্নই একমাত্র আশ্রয়, বেঁচে থাকার। বন্ধ ঘরে বসে চোখ বন্ধ করে ভাইজানের মুখ মনে করে তার হাতে রাখি বেঁধে দিল ও। মন বলল আজকের এই দিন,যার বহু ছবি আঁকা হয়ে রয়েছে ওর স্মৃতির পাতায়, ওদের ভাইবোনের পবিত্র সম্পর্কের নিবিড় উদযাপনের দিন হয়ে উঠবে  আবারও,খুব শিগগির। সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে যেখানে ওর রক্ষাকবচ হয়ে উঠবে ওর প্রাণের ভাইজান। কলকাতার আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদে আঁকা শবনমের চাঁদমুখটিকে শ্রাবণের ঘন মেঘ এসে আড়াল করে দিচ্ছে বারবার। 


 

স্মৃতিচারণা 

রাখীবন্ধন -কিছু চিত্র

     শ্রাবণী সেনগুপ্ত 

এক 

একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে কবেই।তবু রাখীবন্ধনের দিনটি এলেই মনে পড়ে কতো কথা।সব ভাইয়েরা (জ্যেঠ্তুতো,খুড়তুতো)মুখিয়ে থাকতো কখন বোনেরা তাদের হাতে বেঁধে দেবে রাখী।বোনেরাও তাদের সামান্য সঞ্চয় থেকে কিনে রাখতো বা কখনো নিজেরাও বানিয়ে রাখতো রাখী।বেশ কিছুদিন আগে থেকেই চলতো তার প্রস্তুতি।কমদামি,সামান্য আয়োজন তাও অমূল্য।আজও ভাইদের নামে রাখী কেনা হয়-বেশ দাম দিয়ে আর শুভেচ্ছা আদানপ্রদান হয় ভিডিও কলের মাধ্যমে।কেউ দূরে,অথবা কারোর সময় নেই।তাই এইভাবে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বন্ধনকে ধরে রাখার চেষ্টা।তবুও অতীতের সেই সহজ সরল আনন্দ কোথাও যেন অধরাই থেকে যায়।


দুই 

ভাইয়ের ভেসে ওঠা রাখী পরা হাতটা আজও চোখে ভাসে দিদির।এমনই এক রাখীপূর্ণিমার দিনে পুরীর সমুদ্র কেড়ে নেয় একমাত্র ভাইকে বাবা মা আর দিদির চোখের সামনে।সেদিন সকালে উঠে ভাইকে রাখী পরিয়ে মিষ্টি খাইয়েছিলো দিদি।সমুদ্র স্নানে যাবার সময়ও তার হাতে বাঁধা ছিলো তা।ভাইয়ের  নিথর দেহটা যখন পাড়ে তোলা হলো হাতে তখনো জ্বলজ্বল করছে ভাই বোনের বন্ধন।আজ এই রাখীপূর্ণিমায় অনাথ আশ্রমের ভাইদের রাখী পরানোর মধ্যে দিয়ে আবার সেই ভালবাসার বন্ধনকে ফিরে পেলো দিদি।

তিন 

সোনু আজ কারখানার মালিকের দেওয়া জলখাবারের টাকা বাঁচিয়ে রাখী আর মিষ্টি কিনেছে।এক কামরার ঘরে ফিরে এসে খাটে শুয়ে থাকা চলৎশক্তিরহিত দিদির হাতে রাখী বেঁধে দিয়ে একটু মিষ্টি খাইয়ে দেয় সে।ছোটো থেকে তাকে বড়ো করে তোলা দিদির কোনোদিন ভুল হয়নি আজকের দিনে তার হাতে রাখী বাঁধতে।আজ অপারগ পঙ্গু দিদির হাতে রাখী বেঁধে ভাই সে বন্ধনকে আরো দৃঢ় করলো।


চার 

মালবিকা বসে আছেন জানলার ধারের চেয়ারে।আকাশে আজ গোল থালার মতোন চাঁদ।বড্ড মনে পড়ছে ছেড়ে আসা নাতির কথা।এই বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসার আগে পর্যন্ত উনি নাতির হাতেই পরিয়ে দিতেন রাখী।বসে বসে সেই কথা ভেবে ভিজে উঠছে চোখের কোল।হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শুনে চেয়ার থেকে উঠে দরজা খুলে দেখেন সামনে দাঁড়িয়ে এক ক্ষুদে হাতে তার একটি রাখী আর তার পিছনে রয়েছেন এই বৃদ্ধাশ্রমের মালিক কেশব বাবু। তিনি ওর সামনে দাঁড়াতেই ওনার হাতটি নিজের কাছে টেনে নিয়ে রাখিটি পরিয়ে দিলো সেই ক্ষুদে। মনোরমা দেবীকে বিস্মিত হতে দেখে পেছন থেকে কেশব বাবু বলে উঠলেন-"ম্যাডাম এই বাচ্চাটি সামনের অনাথ আশ্রমের। আজ আমি আপনাদের একটু মন ভালো করবার জন্য চুপি চুপি এই ব্যবস্থা টি করেছি।ঐ আশ্রমের বাচচারা এসেছে আপনাদের হাতে রাখী পরিয়ে নতুন বন্ধনে বাঁধতে।"মন ভরে গেলো মনোরমাদেবির। সত্যিই এমন হয়-যেখানে আপনেরা ছেঁটে ফেলতে চায় সমস্ত বন্ধন,সেখানে অনাত্মীয় কেশববাবু এগিয়ে এসেছেন দুই ভালবাসার কাঙালের মধ্যে সেতু বন্ধনের উদ্দেশ্যে।নীচু হয়ে কোলে তুলে নিলেন সেই একরত্তি কে।কোনোখান থেকে ভেসে এলো গান 'চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে,উছ্লে পরে আলো ....।'


এবার রাখিহোক অন্যরকম

মনামী সরকার

তখন আমি অনেকটাই ছোট বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। রাতে ঘুমোতে যাওয়া মানে মায়ের কাছে গল্প শোনা। রূপকথার গল্প,রাজা রানীর,গল্প ইতিহাসের গল্প সবি থাকতো মায়ের ঝুলিতে।তারমধ্যে মনে আছে রাখি বন্ধন নিয়ে ছোট ছোট গল্প শোনাতো মা।রানা প্রতাপ এর গল্প, কর্মাবতীর গল্প, এমনকি বঙ্গভঙ্গের সময় রবীন্দ্রনাথ কিভাবে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন সেই সমস্ত গল্প। ইতিহাস সাক্ষী আছে বারবার বোনেরা নিজেদের রাজ্য,রাজ্যবাসীর প্রাণ, নিজেদের সম্মান সম্ভ্রম রক্ষার প্রার্থনায় ,ভাই বা দাদার মঙ্গল কামনা করে দীর্ঘায়ুর জন্য হাতে বেঁধে দিয়েছে রাখি। কখনো বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটাতে ভাই ভাইয়ের হাতে পরিয়ে দিয়েছে রাখি।আসলে রাখি একটা বিশ্বাস একটা অঙ্গীকার,প্রতিশ্রুতি।
                গল্প শুনতে শুনতে আমি শুধু ভাবতাম আমি তো একা আমার তো ভাই বা দাদা কেউ নেই, তবে আমায় কে রক্ষা করবে? রাখির নির্দৃষ্ট দিনটায় খুব মন খারাপ হোত। মা কিছু রাখি কিনে দিয়ে বলতো বাড়ির আশেপাশে প্রতিবেশী  যে দাদা বা ভাইরা রয়েছে তাদের রাখি পড়াতে। আমি খুব আগ্রহ করে ছুটতাম ওদের কাছে। কিন্তু সেখানেও ঘটে যেত কিছু বিরম্বনা।আগে ওদের নিজেদের দিদি,বোনরা রাখি পড়াতো তারপর আসতো আমার পালা।রাখির উপহারের ক্ষেত্রেও হত অনেক তারতম্য।শিশু মনে সত্যিই খুব আঘাত লাগতো।      
             ইতিমধ্যেই আমার একাকীত্ব ঘুচিয়ে চলে এসেছে আমার ছোট বোন। সে আমার খেলার সঙ্গী। কিন্তু বোনকে কি রাখি পরানো যায়? পড়ানো হয়ে ওঠেনি কখনো।সময়ের সাথে সাথে সে হয়ে উঠেছে আমার পরম বন্ধু। বাড়িতে দুষ্টুমি করলে বাবা-মার কাছে বকা খাওয়ার সময় আমরা দুই বোন দুজনকে রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠতাম।বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের বিচরণক্ষেত্র অনেক বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নানান সমস্যা,বিপদ। আমরা সব সময় একে অপরের ঢাল হয়ে থেকেছি। দাদা বা ভাই থাকলে এর বেশি কিছু করতে পারতো বলে আজা আর মনে হয় না।
       আর একটু বড় হওয়ার পর পেয়েছি একজন দিদিকে।রক্তের সম্পর্কের কেউ না হলেও তার সাথে আত্মিক সম্পর্ক টা অনেক গভীর।রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় সে এখনো আমাকে নিজের বাঁ দিকে রাখে।যত বড় বিপদ আসুক না কেন নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে চিন্তা করিস না এই দিদি টা তো আছে,বিপদ মুক্তি,মঙ্গল কামনার প্রার্থনায় যে বোনের হাতে বেঁধে দেয় বিপত্তারিণীর সুতো।কোন এক বছর শেষের শীতের রাতে তার জীবনে নেমে আসে আচমকা এক অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা। দিশেহারা হয়ে প্রথমেই তার মনে পড়েছিল এই বোনটার কথা।সেই বিপদ থেকে দিদিকে উদ্ধার করতে যা যা করণীয় তাই করেছিলাম। আমার ছোট বোন আমি আমার দিদি আমরা সবাই সব সময় সব অবস্থাতে একে অপরের জন্য রয়েছি।
                      ভাই বোনের সম্পর্কটা সত্যিই অন্যরকম,সুন্দর মিষ্টি একটা সম্পর্ক কিন্তু সেই সমস্ত রকম ভালোবাসা,নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আজকের দিনে একজন বোন আরেকজন বোনকে দিতে পারে।বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে যখন প্রতিনিয়ত আমরা নিজেদেরকে উন্নত করে চলেছি তখন কিছু নিয়ম,প্রথা, উৎসবেরও আধুনিকীকরণ হওয়া প্রয়োজন।রাখি শুধু ভাই-বোনের উৎসব,মিলন উৎসব না হয়ে দুই বোনের ভালোবাসা একে অপরের প্রতি দায়িত্বের অঙ্গীকারের উৎসবও হয়ে উঠুক। 




অমর কথারা

অলকানন্দা দে


মন নিঙড়ালে যেসব স্মৃতির সুঘ্রাণ মেলে তাতে কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যায় নিমেষে। তাদের সাথে ভাব-ভাব সম্পর্ক ফিরিয়ে নিয়ে যায় প্রাক্তন দিনে যাকে রেখেছি ভালোবাসার ছাউনিতে, নিশ্চিন্ত আরামের নীচে কর্তব্য-বোধে। রোদে-জলে মলিন না হয় এতটুকু বর্ণ যেন তার! আজ অনুভবের দেরাজ খুলে বের করে আনলাম পূর্ণিমাময় সেই দিনটাকে। আলো-বিচ্ছুরণ করে যাচ্ছে একইভাবে দেখছি। রসদপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে ভাদ্রের রোদ্দুর মাখিয়ে নিচ্ছি সংরক্ষণের তাগিদে আরও একবার।

 

ছেলেবেলায় সোনা-সোনা এই ছুটির দিনটাকে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই। কারণ, রাখির হাত ধরে আসতো ঝুলন। যেন দুই ভাই বোন। তাকে তো সাজিয়ে গুছিয়ে প্রস্তুত করতে হবে উৎসবের ডাঙায়। তাই সারল্য সম্বল করে বারান্দাময় কাজ চলতো দিনরাত্রি একজোটে। নিজহাতে তিল তিল করে স্থাপত্য গড়ে তোলার সে কি অমল আনন্দ! পাহাড়ের পাদদেশে থাকতাম বলে পাহাড় গড়ার আর্দ্র ইচ্ছেটাই প্রশ্রয় পেতো বারবার। তাই আতিপাতি খুঁজে শ্যাওলা জোগাড় করে আনা যা নাকি পাহাড়কে দুর্দান্ত সবুজ করে, কি জমাট উল্লাসের কাজ ছিল! গাছের ছোট ছোট ডাল এনে তাকে সাজিয়ে সার সার পাহাড়ী পাইন তৈরী করা আনন্দ-ঘাম ঝরানো একটি গর্বের সৃষ্টি। এ পাহাড় ও পাহাড় সংযোগকারী ব্রীজ কিন্তু ভীষণ জরুরী। বস্তুত সেটি দেখাতো যেন কাঠের তৈরী। নির্মাণ হোত পিসবোর্ড সহযোগে। তলা দিয়ে বয়ে যেত সরু নদী-ধারা, বুকে থাকতো ছোট ছোট নুড়ি-পাথরের নক্সা। বেশ একটু উচ্চতায় পাত্র বসিয়ে তাতে জল ভরাট করে এবং আশেপাশে সবুজের ছোঁয়া দিয়ে লেক তৈরী করা হোত। আর থাকতো পাহাড়ের গা বেয়ে লতিয়ে ওঠা সরু পথ। যাত্রীদের অভ্যর্থনা ত্বরে ছোট ছোট ল্যাম্পপোষ্টগুলি প্রতিশ্রুতি দিতো সাধ্যমতো আলো ছড়ানোর। কাগজ কেটে তৈরী হোত আলোস্তম্ভ। সরু তারের সাহায্যে এ পোষ্ট ও পোষ্টে সংযোগ ঘটানো হোত। এই পথে কিন্তু ব্যবধানে গাড়িও চলতো। ছোট ছোট ঘর বানিয়ে মৃদু দূরত্বে বসিয়ে তৈরী হোত পাহাড়ী গ্রাম। যার উঠোন ঘর-দোরে দু একটি পুতুল মানুষ ঘরকন্না সেরে নিচ্ছে। একটি দুটি ফুলেল গাছ পাহাড়ের ঢালে সমৃদ্ধ করছে তার রূপ। ঘাসের তৈরী ফসলী জমিতে কাজ করতো মশগুল কৃষকেরা! এই ভালোবাসার  রেপ্লিকাটি ভারী অহংকারে দাঁড়িয়ে থাকতো কিন্তু! স্বস্তির শ্বাস ফেলতাম তখন, যখন বড়রা দেখে বলতেন, ”ভীষণ সুন্দর বানিয়েছিস্ রে তোরা!”

 

পাঁচদিন ব্যাপী ঝুলন সাজানোর শেষের দিনটি ছিলো সেই সু-তিথি রাখির। উৎসব বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ক্লান্তি নেই। হাতময় রাখি নিয়ে নিটোল সুখের মুহুর্ত! কটা বড় রাখি কটা ছোট, গোনাগুন্তির পর্ব মিটতো না যেন! ইস্কুলে শেখানো হোত রবি ঠাকুরের রাখিবন্ধনের মর্মকথা! বুঝতে চাইতাম মশগুল হয়ে। এই শেষের দিনটিতে মা কাকিমারা খাবারের আয়োজন করতেন। চোঁ চোঁ খিদে নিয়ে সারি বেঁধে খেতে বসার আনন্দের যে অনুভূতি তা মনের মাটিতে আজও রাজত্ব করে! রাশ-টানিনা তার! চলুক না তল্লাট জুড়ে দহরম-মহরম! ফেলে আসা টুকরো টুকরো কথার দল আজকের বয়সের কিনারে দাঁড়িয়েও উইশ করে রমরমে জ্যোৎস্না রাতের! আলো-চলকানো রূপসী তিথিটা আজও যে বড় পুণ্যের সাড়া ফেলে মর্মজুড়ে!



রাখী বন্ধন
চম্পা বিশ্বাস 
     
         বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হওয়ার সুবাদে প্রতি বছর এক সুন্দর রাখী বন্ধন উৎসবের সাক্ষী থাকি। আমাদের বিদ্যালয় মাধ্যমিক পর্যন্ত। বিদ্যালয়ের পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রী ও বেশ কিছু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী রাখী পূর্ণিমার দিন রাখীবন্ধন উৎসবে মেতে ওঠে। একে অপরের হাতে রাখী পরিয়ে আনন্দ উৎসব পালন করে। বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীবৃন্দের হাতে রাখী পরিয়ে প্রণাম করে সকল ছাত্রছাত্রী এক আনন্দঘন মুহূর্ত তৈরী করে। 

           রাখী পূর্ণিমার দিন সকাল থেকেই বিদ্যালয়ে যাওয়ার এক অদ্ভুত টান অনুভব করি। বিদ্যালয়ে প্রবেশের সাথে সাথে শুরু হয় ওদের রাখী পরানো। দেখতে দেখতে সকলের মতো আমার ও দুই হাত রাখীতে ভরে যায়। সে এক অদ্ভুত ভালোলাগা। এরপর বিদ্যালয়ের কমন রুমে প্রবেশ করলে বাকি ছাত্রছাত্রীরা এসে লাইন করে রাখী পরিয়ে যায়। রাখী ভর্তি সেই হাতের দিকে তাকিয়ে আমার মন সত্যিই আনন্দে নেচে ওঠে। কবির ভাষায়--- "হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচেরে। "
আর এই আনন্দ উপভোগ করবার জন্যই প্রতি বছর এই বিশেষ দিনটির জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকি। ছাত্রছাত্রীদের রাখী বন্ধন সমাপ্ত হওয়ার পর শুরু হয় আমাদের উদ্যোগে সকল ছাত্রছাত্রীদের মিষ্টিমুখের পালা। 
   
     বিদ্যালয়ের অনতিদূরে অবস্থিত শ্রী শ্রী ঠাকুর নিগমানন্দের আশ্রম। রাখী পূর্ণিমার দিন আশ্রমে বিরাট বড়ো উৎসবের আয়োজন করা হয়। আমাদের বিদ্যালয়ের উৎসব শেষের পর সকল ছাত্রছাত্রী আশ্রমের  উৎসবে যোগ দিয়ে প্রসাদ গ্রহণ করে। 
 
        রাখী পূর্ণিমার প্রাক্কালে আজ মন ভারাক্রান্ত। গত বছরের ন্যায় এ বছর ও বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন বন্ধ , স্তব্ধ হয়েছে বিদ্যালয় জীবন। বিদ্যালয়ে রাখীবন্ধন আজ অতীত। আগত রাখী পূর্ণিমা তাই আজ মনে বেদনার সঞ্চার করে। 


ছবি  

তানভী দাম




No comments:

Post a Comment