অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪২৮
সম্পাদকের কথা
তারপর আমরা এখনও সেই তিমিরেই আছি। কবে জীবন স্বাভাবিক হবে কেউ জানিনা। এই অনিশ্চিত দোলাচলে বেড়ে চলেছে বেকারত্ব, দারিদ্র, অবসাদ। যন্ত্রের মতো নিয়ম মেনে সব করলেও আসলে আমরা কেউ ভাল নেই। এই ভরা শ্রাবণ মাঠ-ঘাট-বিল-পুকুর-নদী সবকিছু ভরিয়ে দিলেও মানসিক শান্তির বৃষ্টি দিতে পারছে না। তবু আশা একটিই যে, হয়ত এই শ্রাবণ মুছিয়ে দেবে অশ্রু, হেসে উঠবে আগামীর আকাশ মনের সঙ্গে সঙ্গে!
মুজনাই সাহিত্য সংস্থা
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রচ্ছদ- অভ্রদীপ ঘোষ
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা ১৪২৮
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
ডঃ ইন্দ্রাণী বন্দোপাধ্যায়, মাথুর দাস, শিবির সিনা, কুমকুম ঘোষ, মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, শ্রাবণী সেন, গৌতম চক্রবর্তী, চিত্রা পাল, সীমাক্ষি শর্মা, পার্থ সারথি চক্রবর্তী, রীনা মজুমদার, অনির্বাণ ঘোষ, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, সুনন্দ মন্ডল, জয়িতা সরকার, স্বপন কুমার দত্ত, অপর্ণা দেবনাথ, তমালী দাস, মহাজিস মন্ডল, সুজাতা কর, অম্বালিকা ঘোষ, শতাব্দী সাহা, দীপ মুখার্জি, সুরজ সিং, পৌলোমী চক্রবর্তী, জয়িতা চট্টোপাধ্যায়, সোমা দে, চম্পা বিশ্বাস, অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত, বিপ্লব গোস্বামী, চন্দন কুমার দাস, সৌমেন দেবনাথ, বুলবুল দে, কবিতা বণিক, অসীম মালিক, মুনমুন সরকার, বিজয় বর্মন, রীতা মোদক, মজনু মিয়া, শাবলু শাহাবউদ্দিন, মৌমিতা মোদক, রূপক রায়, সুধারঞ্জন সাহা, কাকলি বিশ্বাস সরকার, অর্চিত বটব্যাল, তনভি দাম
শ্রাবণ নিবন্ধ
ডুয়ার্সে বৃষ্টি মানেই রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চার, প্রেম
গৌতম চক্রবর্তী
বর্ষা হল প্রাণসঞ্চারের
কাল, কবিতার কাল। কবিতা ছাড়া ঘন বর্ষার কথা কি বলা যায়? সেই কালিদাসের মেঘ এখনও ভেসে আসে আমাদের আকাশে। কবিতাও তেমনই
ভেসে থাকতে জানে। বৃষ্টি ঝরাতেও জানে। বাংলা কবিতার বৃষ্টিভাণ্ডার বিপুল। মেঘের মর্ম
বোঝে বসুন্ধরা, মেঘের মর্ম বোঝেন কালিদাস। মেঘের জন্য উতলা হয় সুন্দরী ধরণী। গ্রীষ্মের
দাবদাহে ধরণীর শরীরে আগুন জ্বলে। সে আগুন সমস্ত বনস্থলীর হৃদয়ে। বর্ষণলাভের জন্য ধরণী মুখিয়ে থাকে মেঘের দিকে তাকিয়ে। ধরণীর এই উত্তপ্ত শরীরের মধ্যে ঝড়ের মেঘ আসে প্রথমে, উথালপাথাল করে দেয়
ধরণীর আবরণ-আভরণ। আগ্রহিণী বসুমতী অপেক্ষমাণ যুবতীর
মতো গ্রহণ করে মেঘ-পুরুষের তেজ। চারদিকে বর্ষার জল থইথই ছবিতে উত্তরবঙ্গের বর্ষা ঋতুতে বানভাসির
আবহ। ভিন্ন ঋতুর চেনা ডুয়ার্স বর্ষায় প্রতিবার অন্য রূপে অচেনা হয়ে যায়। এমনিতেই প্রকৃতি
উপুড় হস্তে আমাদের ডুয়ার্সকে অকৃপণ হাতে সাজিয়েছেন। বর্ষায় যেন তাকে নবরূপে দেখতে পাই।
ডুয়ার্স বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাহাড়
আর সবুজ সাজে অরণ্য। আর তার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা সরু ফিতের মতো সব পাহাড়ি নদী। বর্ষায়
এই চেনা বনাঞ্চল, এই চেনা নদীর আদিম রূপ আমাদের চোখে নেশা ধরিয়ে দেয়। বৃষ্টিপতনের অবিরাম
শব্দে আছে একটা ছন্দ। এই ছন্দকে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন তাঁর বিভিন্ন ছন্দ কবিতাতে। প্রকৃতিকে নিয়ে এমন করে আর কে ভাবতে পারেন
তিনি ছাড়া? কালি নয়, প্রকৃতিকে আহরণ করে সেই রস দিয়ে লিখতেন তিনি। বৃষ্টি আর সভ্যতার
গহন প্রেমপর্বের তুমুল আখ্যান নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য লেখা। তাই হয়তো তাঁর সৃজনীধারা
মিশে যায় বাদলধারার সঙ্গে।
এই বর্ষায়
ভরন্ত তিস্তা, তোর্স্ রায়ডাকের উথালপাথাল রূপ আর তার জলের উদ্দাম শব্দ প্রকৃতিপ্রেমীদের
কাছে এক অমোঘ আকর্ষণ। কোচবিহার শহরের বুক চিরে প্রবাহিত অবগুন্ঠিত যে নদী, বর্ষায় সে
সদ্যযৌবনে পা দেওয়া তরুণীর মতো উচ্ছল। হাসিমারা থেকে
মাদারিহাট যেতেও পথে পড়ে তোর্সা। তার সেতুর উপর দাঁড়িয়ে নীচে তাকালে অতি বড় সাহসীরও
বুক কেঁপে ওঠে। ডুয়ার্স সময়ে সময়ে যেন চেরাপুঞ্জি। বৃষ্টি আর বৃষ্টিতে মুহূর্তে মুহূর্তে
বদলে যায় প্রকৃতি। পাহাড়ি কন্যা তখন বাঁধনহীন উতলা হয়ে ছুটে চলে দক্ষিণে। একেবারে
পূর্ব সীমান্তে, অসম রাজ্যের সীমানায় বারোবিশা থেকে সোজা উত্তরে কুমারগ্রাম ছাড়িয়ে
শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো চা-বাগান। তার পাশে সঙ্কোশ। বৃষ্টিভেজা চা-পাতা, পাশে
বয়ে যাওয়া অস্থির রায়ডাক। এই নয়নাভিরাম দৃশ্যের সামনে থমকে দাঁড়ায় চোখ। বৃষ্টির সঙ্গে ডুয়ার্সবাসীর
বেশ আবেগঘন প্রেমপর্ব চিরকালের। ঘোরতর অভাবীর সংসারে যেমন ঈশ্বরদর্শনের আকুতি, তপ্ত
নিদাঘের পর বর্ষা চেয়ে ঠিক একই রকম ঐকান্তিক প্রার্থনা ডুয়ার্সের মানুষেরও। যখন মাটির
শরীর-মন শুষ্ক হতে হতে বিচ্ছিন্ন ধুলোতে পরিণত, যখন ঝরনাধারা বিলুপ্তির পথে ধাবমান,
যখন ব্যাঙেদের কোলাহল শ্রুতির অতীত, যখন মরা মাছেরা শুকিয়ে যাওয়া নদীতে ক্ষয়িষ্ণুপ্ৰায়,
সেই পরম ক্ষণে বর্ষার অবাধ প্রবেশ অধিকার। অঝোর বর্ষণ তখন আমাদের কাছে নিয়ে আসে অমোঘ
শান্তির জল। রচিত হয় আমাদের প্রেমপর্বের অবধারিত স্বপ্নপূরণ।
ডুয়ার্স নিয়ে অনেক কথাই তো লেখা যায়। সমরেশ মজুমদারের কালবেলা
বা সাতকাহনের ডুয়ার্স। গরুমারা, চাপরামারি, জলদাপাড়া, গজলডোবা, ঝালংয়ের মতো সুন্দর
সুন্দর জায়গার দুয়ার মানে দরজা, সেই থেকেই যার পরিবর্তিত নাম ডুয়ার্স। এখানকার প্রকৃতির
সৌন্দর্য অনেকটা অদ্ভুত। যখন অরণ্যের গহিনে ঢোকা যায় তখন রাস্তার ওপর থাকবে শাল-সেগুনের
লম্বা ছায়া। গা ছমছম করা। সাইনবোর্ডে লেখা ‘আস্তে চলুন, সামনে হাতি চলাচলের পথ’। বাইসনও
দেখা দিতে পারে। শরীর-মন চমকে দিয়ে হঠাৎ রাস্তা পেরোল গোটা তিনেক ময়ূর। আহ্, অনেকটা
‘নীরব স্বর্গ’। ডুয়ার্সের নাম শুনলেই প্রথমে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাহাড়-জঙ্গল। কিন্তু
বর্ষায় ডুয়ার্সে বেড়াতে গেলে ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করা যাবে না একেবারেই। কারণ বর্ষাকাল
প্রাণীদের প্রজননের সময়। তবে বন জঙ্গলের বাইরেও রয়েছে আলাদা একটা ডুয়ার্স যা একেবারেই অন্যরকম। কালো মেঘ যেন ঝেঁকে ধরেছে পুরো আকাশকে। যে কোনো
সময়েই নামতে পারে বৃষ্টি। দিনে দু-তিন কিংবা চারবারও হতে পারে। এমন সময়ে ডুয়ার্সের
চেয়ে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে? কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় হয়তো এ কারণেই
লিখেছিলেন, ‘বৃষ্টিতে ডুয়ার্স খুবই পর্যটনময়’। ছবির মতো সুন্দর চা-বাগান। তার পাশেই
সংকোশ নদী। ভরা বর্ষায় তার রূপ দেখলে চোখ জুড়োবে। কাছেই রয়েছে রসিকবিল। ভ্রমণরসিকের
কাছে এ ক্ষেত্র মোটেই অচেনা নয়। তবে অচেনা লাগতে পারে বর্ষায় এর রূপ।
বৃষ্টির সময় বাঁশঝাড়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির
নিজস্ব এক ভাষাকে অনুভব করা যায়। কালচিনির পথে রয়েছে ডিমা নদী। বর্ষায়
প্রবল জলোচ্ছ্বাসে রাশি রাশি ফেনা নিয়ে ছুটে চলে এই নদী। তার বহতা শব্দে কম্পিত হয় যেন আস্ত পৃথিবীটাই। পাশেই আছে বসরা। পূর্ণিমা রাত আর বসরার যুগলবন্দী নিশ্চিত এক অলৌকিক ক্ষণ। ডুয়ার্সের পাহাড়, জঙ্গল, নদী আর বর্ষা
এই চারের সম্মিলিত রূপ যে কোনও নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে হার
মানিয়ে দেয় অনায়াসে। ডুয়ার্সের ছোট গঞ্জ শামুকতলার আশপাশে জঙ্গল ঘেরা বনবসতি শিলটং, টিয়ামারি বসতিগুলির বর্ষা-সৌন্দর্য নিখাদ আদিমতায় ভরা। পূর্ণ বর্ষায় জঙ্গলের রাস্তায় হঠাৎ দেখা মিলতে পারে চিতল বা পেখম তোলা ময়ূরের। কালচিনি থেকে উত্তরে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে ভাটপাড়া, রায়মাটাং, চিনচুলা। রায়মাটাঙে বৃষ্টি ও প্রকৃতি যেন একে অন্যের সঙ্গে দিনরাত লুকোচুরি খেলে। এর সঙ্গে আছে
ভরা যৌবনের রায়মাটাং নদী। বৃষ্টির শব্দ যে কত রকমের হতে পারে, তা জানা যায় রায়মাটাংয়ে।
পাহাড়-ঘেরা ডুয়ার্স আরও বেশি সবুজ হয়ে ওঠে এই বর্ষায়।
বর্ষায় অরণ্যের রূপ যে কেমন মোহিনী শক্তিতে ভরপুর হয়ে ওঠে তা নিজে প্রত্যক্ষ না করলে
অনুমান করা অসম্ভব। ভেজা মাটি, বৃষ্টিস্নাত সবুজ গাছের পাতা, উড়ে যাওয়া পাখির ডানা
ঝাপটানো, তার সঙ্গে অরণ্যের নিজস্ব কতরকম শব্দ। ডুয়ার্সের বনাঞ্চলের আরেকটি বিশেষত্ব
বর্ষায় প্রতিটি জঙ্গলের এক এক রকম আবেদন। বক্সার জঙ্গল যদি হয় আদিম আর বন্য, তা হলে
চিলাপাতা ফরেস্ট যেন উদাসী প্রেমিক। এইভাবে প্রতিটি বর্ষায় পাহাড়ের সঙ্গে জঙ্গলকে নিয়ে
সেজে ওঠে ডুয়ার্স।
বর্ষাকালীন
ডুয়ার্সের অপার সৌন্দর্যের উল্টো দৃশ্যও চোখে পড়ে ডুয়ার্সে। প্রবল বৃষ্টিতে
বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ডুয়ার্সের পাহাড় ও সমতল। নদীগুলির ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসে প্রতিবারই
ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। প্রতি বছর বন্যায় অনেক নদীর বাঁধ ভাঙা জল ঢুকে পড়ে
জনবসতিতে। গৃহহীন হয়ে পড়েন বহু মানুষ। জলে ডুবে যায় কৃষিক্ষেত্র, চা-বাগান। খোলা
আকাশের নীচে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে বেড়ায় অসহায় মানুষ আর গবাদি পশু। সব মিলিয়ে
বর্ষা আর এই সময়ে আশীর্বাদ থাকে না। বরং অভিশাপ হয়ে নেমে আসে উত্তরের জনজীবনে।
অতিবর্ষণে পাহাড়ে নেমে আসে একের পর এক ধস। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় পাহাড়ি পথে।
বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সড়ক যোগাযোগ। ব্যাহত হয় ডুয়ার্স-রুটের ট্রেন চলাচলও। বিস্তীর্ণ
বনাঞ্চল জলে ডুবে গেলে ক্ষতি হয় নিরীহ পশুদের। আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে তারা। খাদ্যাভাবে
মৃত্যুও হয় তাদের। বর্ষার এই ধ্বংসাত্মক রূপকে অস্বীকার করা যায় না। তবুও যেন
প্রতিবারই এই বৃষ্টির অপেক্ষাতেই থাকে ডুয়ার্সের জঙ্গল, পাহাড়, নদী। বর্ষা আসে এবং
নবরূপে সজ্জিত হয় আমাদের প্রিয়, অতি প্রিয় ডুয়ার্স। বর্ষার রিমঝিম ধারায় বাঙালির
বরাবরের পছন্দের ডুয়ার্স।
বৃষ্টির ছন্দে
ডুয়ার্সের সৌন্দর্য তুলনাহীন। তিন মাসের জন্য তালা ঝুলিয়ে দেওয়া থাকে জাতীয় উদ্যান
এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলিতে। তবুও মূর্তি নদীর ধারে হেলান দেওয়া চেয়ারে বসে বর্ষার
ডুয়ার্স দেখার মজাটাই আলাদা। দিনের শেষে পাহাড় আর সবুজের আবহে সূর্যাস্ত সমস্ত
কিছুকে এক লহমায় দূরে সরিয়ে দেয়। সেইসময় চতুর্দিকে মূর্তি নদী মোহময়ী রূপ ছড়াতে
থাকে। অচেনা একঝাঁক পাখি উড়ে যায় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে। এক অন্য সুখের স্মৃতি। কিন্তু
লকডাউন শুরুর পর থেকে মারাত্মক লোকসানে ডুয়ার্সের পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এখনও অধিকাংশ
ছোট, মাঝারি হোটেল পর্যটক শূন্য। থমকে গেছে গাড়ি চালক, হোটেল স্টাফদের জীবনের
গতি। মাথা উঁচিয়ে থাকা গাছে আবেগ জড়ানো নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয় পাখির কিচিরমিচির।
সামসিং, সুনতালেখোলা নেচার ক্যাম্প, নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক, ঝালং, বিন্দু
সব চেনা জায়গাগুলো পর্যটন শূন্য। ভরা মরসুমে নিঃসঙ্গ বেঞ্চির মতোই স্থানীয় পর্যটন
সুনশান-নিস্তব্ধ। রাস্তার দু পাশের সবুজের ভিড়ে কতগুলো মাস হয়ে গেল বুক ভরে
নিঃশ্বাস নিতে পারিনি। চা বাগানের সবুজ গালিচা নয়নজুড়ে প্রশান্তির ছোঁয়া দেয়নি। জঙ্গলের
মাঝে অচেনা ফুল দেখে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলে নেওয়া হয়নি। দূরে গাছের মাথায়
গ্রেটার র্যাকেটেড টেল ড্রংগো, গ্রে নাইট জার দেখা হয়নি। সুস্থ হয়ে উঠুক পৃথিবী।
প্রেমের টানে বাঙালি ঠিক পৌঁছে যাবে প্রেমিক ডুয়ার্সের কাছে। তারপর পাথর ভরা
মূর্তি নদীতে তৃপ্ত হওয়া। তারপর রকি আইল্যান্ড।পরের
দিন সামসিং, সুনতালেখোলা নেচার ক্যাম্প, নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক, ঝালং,
বিন্দু সব দু-চোখ ভোরে দেখে নেবে বাঙালি। সঙ্গে রেখে দেবে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার।
শ্রাবণ ভ্রমণ
সালার জং মিউজিয়াম ও কয়েকটি বিশেষ দ্রষ্টব্য
কুমকুম ঘোষ
(ছবি: দেবাশিস ঘোষ)
বর্তমান তেলেঙ্গানা রাজ্যের মুসী নদীর দক্ষিণ তীরে সেকেন্দ্রাবাদ।হয়দ্রাবাদের যময এই শহর বিখ্যাত এর সালার জং মিউজিয়াম এর জন্য। হায়দ্রাবাদ ভ্রমণের সময় চারমিনার, ইতিহাস খ্যাত গোলকোন্ডা ফোর্ট, রামোজি রাও ফিল্ম সিটি( দেখার অভিজ্ঞতা অসাধারণ) ,হুসেন সাগর লেক দেখা ও হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানীর স্বাদ নেওয়ার পর এই মিউজিয়াম টি চাক্ষুস দেখাটা ঘোরাঘুরি র লিস্টে অবশ্যই রাখা দরকার।একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা কিভাবে জাতীয় মিউজিয়াম ( ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম জাদুঘর) হয়ে উঠতে পারে তা এর সংগ্রহ-সম্ভার দেখে সম্যক বোঝা যায়। পরাধীন ভারতের "হায়দ্রাবাদ রাজ্যের" নিজাম আমলে তৃতীয় সালার জং ছিলেন রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। পুরো নাম -- নবাব মীর ইউসুফ আলী খান। তিনি ছিলেন একজন শৌখিন মানুষ ও শিল্প রসিক। তাঁর নেশা ছিল সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে বিশিষ্ট অ্যান্টিক শিল্পসামগ্রী সংগ্রহ করা এবং সেগুলিকে ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা য় রক্ষণাবেক্ষণ করা। ১৯৪৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এই সংগ্রহশালাটি মিউজিয়াম হিসেবে গড়ে ওঠে এবং ১৯৫১ সালে সেটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু।
কি নেই এই সংগ্রহে? ৪০ হাজারের ওপর শিল্প দ্রব্য এবং ৫০ হাজারের ওপর আছে দুষ্প্রাপ্য বই ও পান্ডুলিপি আছে এখানে।সোনার জলে হাতে লেখা কোরান থেকে অতি ক্ষুদ্র হস্তাক্ষরে লেখা তার মিনিয়েচার সংস্করণ থেকে পৃথিবীর নানান নামী এবং কিছু কিছু নাম-না-জানা অসাধারণ চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য এবং অজস্র ঘড়ির কালেকশন।পার্শিয়ান ব্লু পানপাত্র, ফ্লাওয়ার ভাস্ এবং হাতির দাঁতের তৈরী সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ করা ছোরার হাতল থেকে মিনিয়েচার মূর্তি;রাজা রবি ভার্মার অবিস্মরণীয় সব চিত্র থেকে আমাদের বাংলার( দেখে গর্ব হয় বৈ কি) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি, আছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ,নন্দলাল বসুর আধুনিক শৈলী র চিত্র কলা। জাহাঙ্গীর এর আমল থেকে টিপু সুলতানের আমলের নানান ড্যাগার ও যুদ্ধাস্ত্র। কিন্তু সব সংগ্রহের মধ্যে উৎসাহী দর্শকদের আকর্ষণ করে বিশেষ তিনটি দ্রষ্টব্য।সেগুলি হলো----Veiled Rebecca, Musical Clock এবং Double Statue ( Wood)
Veiled Rebecca বা অবগুন্ঠিতা রেবেকা ভাস্কর্যটি একটি মরমী নারীর ব্রীড়াবনত আবক্ষ মূর্তি। মুখটি ঢাকা আছে স্বচ্ছ ওড়না দিয়ে।সাদা মার্বেলের তৈরী মূর্তি টির ওড়নাটি কিভাবে পাথর কেটে অমন স্বচ্ছ রূপ দেওয়া যায়! যার আড়াল থেকে রেবেকার মুখটি স্পষ্ট দেখতে পায় দর্শক! সেটা দেখলে বিস্ময়ে স্তম্ভিত ও অবাক হতে হয়। শিল্পী Giovanni Maria Bezoni এইরকম মূর্তি মাত্র ৪টি নির্মাণ করেছিলেন ,যার তিনটি আছে আমেরিকার বিভিন্ন মিউজিয়ামে আর চতুর্থ টি আমাদের ভারতে। এই মূর্তি টি এখানকার অন্যতম সেরা আকর্ষণ।
Musical Clock বা সুর- রণিত ঘড়িটি সালার জং মিউজিয়াম এর আরও এক বিশেষ দ্রষ্টব্য। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কুক এন্ড কেলভি কোম্পানি র ( Cooke and Kelvey co) তৈরী রট আয়রনের এই বিশাল ঘরিটি নির্মাণ করা হয়েছিল ইংল্যান্ডের কারখানায় কিন্তু একত্রিত (assembled) করা হয় খোদ কলকাতা য় বিশ শতকের প্রথম দিকে।ঘড়িটি একটা বড়ো হলঘরের মাঝখানে রাখা আছে এবং সামনে আছে দর্শকদের বসার জন্য অজস্র চেয়ার। শুধু ঘন্টাধ্বনি শোনার জন্য দর্শক রা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন এখানে।প্রতি ঘন্টায় একটি দাড়িওয়ালা পুরুষ (পুতুল) ঠিক ৩মিনিট আগে বামদিকের কুঠুরি থেকে বেড়িয়ে এসে অপেক্ষা করে এবং নির্দিষ্ট ঘন্টার ধ্বনি বাজিয়ে দেয়। যেমন ১টা বাজলে একবার,২টো বাজলে দুবার,৩টে বাজলে তিনবার এইভাবে। ঘন্টা বাজানো শেষ হলেই দাড়িওয়ালা পুতুলটি টুক করে আবার নিজের কুঠুরিতে ঢুকে যায়। ডানদিকে থাকে একজন পুতুল-কামার(blacksmith)। সে প্রতি সেকেন্ড জানান দেয় হাতুড়ির ঘা দিয়ে। দুপুর ১২টায় বারো বার ঘন্টাধ্বনি হয় তাই সেই সময়ে এই হলঘরে বিপুল সংখ্যক দর্শকের ভিড় হয়।চেয়ার ফাঁকা না পেয়ে আমরা দোতলার বারান্দা থেকে দেখেছিলাম এই বিস্ময়কর ঘড়ির কান্ডকারখানা।হলঘর ফাঁকা হবার পর অবশ্য ঘড়ির ছবিটি তুলতে পারা গিয়েছিল।
Double Statue (wood) বা অনবদ্য একটি দ্বিমূর্তি একটি কাঠের বিপরীত দিকে খোদাই করা( Front : Mephistopheles ; Back : Margaretta) সামনের দিকে সোজাসুজি দর্শক দেখতে পান মেফিস্টোফিলিসের ক্রুর শয়তান মূর্তি আর আয়নার মাধ্যমে দেখতে পান গ্যেটে রচিত যুগান্তকারী নাটকের নায়ক Dr.Faust(যিনি নিজের আত্মাকে রাক্ষস মেফিস্টোফিলিসের কাছে বিক্রি করেছিলেন) এর প্রিয়তমা, সুন্দরী মার্গারিটার আনত নম্র মূর্তি টি। ফ্রান্স থেকে সংগৃহীত এই বিস্ময়কর শিল্পকর্মের স্রষ্টার নাম জানা যায়না। প্রকৃতপক্ষে এখানকার বিপুল সংখ্যক শিল্প সম্ভার একবার ঘুরে দেখা সম্ভব নয় অন্ততঃ দুই- তিন বার ঘুরে দেখতে হয়।কারণ ইতিহাস ও সময়ের সমন্বয় হয়েছে এই জাদুঘরের প্রতিটি শিল্পদ্রব্যের মধ্যে কিন্তু গোলকোন্ডা ফোর্ট দিনের আলোয় দেখার জন্য তাড়া ছিল তাই কিছু টা তারাহুরো করেই বেড়িয়ে পরতে হয়েছিল মিউজিয়াম থেকে। ভবিষ্যতে আবার একবার হয়ত দেখার সুযোগ ঘটবে আবার একবার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে প্রত্যক্ষ করবো অবগুন্ঠিতা রেবেকা অথবা সুন্দরী মার্গারিটাকে। দেখবো ক্রুর শয়তানি চাহনির মেফিস্টোফিলিসকে বা ১২ টার ঘন্টা ধ্বনি শুনবো মিউজিক্যাল ক্লকের।
ভাইরাস- মুক্ত পৃথিবীতে আবার নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ানোর আশা জেগে থাকে এভাবেই অনবরত।
শ্রাবণ গল্প
ধারাপাত
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
জানলা ধরে দাঁড়িয়ে মণি, মণিমালা। জানলার বাইরে বৃষ্টির ধারাপাত। মণি বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি পেরিয়ে আর একটু দূরেও দৃষ্টি যাচ্ছে ওর, সামনের হলুদরঙা বাড়িটার একটা জানলায়। সেই জানলাটা আজ বন্ধ! ওটা নীলাঞ্জনের ঘর, লেখাপড়ায় তুখোড় ছেলে সে, নায়কের মতো সুন্দর। মণি যখনই সময় পায় লুকিয়ে ওকে দেখে, নীলাঞ্জন কি টের পায়? মণি জানে না, তবে এটুকু ও জানে ওর কাছে সে কিছুই নয়, ও বড়ো সাধারণ! মন খারাপ ক'রে জানলা থেকে সরে এলো মণি, আজ ও একটা কবিতা লিখবে। খাতা-কলম গুছিয়ে বসতেই তুমুল বৃষ্টি নামলো!
আজ কি কুক্ষণেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল মণি, কে জানতো এমন ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে! একটু অন্ধকার নেমে এসেছে। কোনোভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে সামনের গোলাপি রঙের বাড়িটার শেডের নিচে দাঁড়ায় ও, ইতিমধ্যেই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দু’জন ওদিকটায় আশ্রয় নিয়েছে। আলগা চোখে একবার তাকিয়েই চমকে খর চোখে আবার তাকায় মণিমালা! একজন তো নীলাঞ্জন, সঙ্গে মেয়েটা---কে? খুব চেনা চেনা লাগছে! আরো ভালো ক'রে একটুক্ষণ তাকিয়ে বোঝে মেয়েটি বিশাখা, ওদের কলেজেই পড়ে, হিস্ট্রি। এতো কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে ওরা--, মণির চোখ জ্বালা করে, বুক জ্বালা করে, শরীর জ্বালা করে! বাড়িতে ফিরে ওই বৃষ্টি দেখার জানলাটা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেয় মণিমালা।
উঁহু! বৃষ্টি এখনও ধরে নি! আজও ওই জানলাটা বন্ধ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা প্রায়ই ওই জানলা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর চোখদুটো দেখলে কেমন জল-ভরা মেঘের কথা মনে আসে নীলাঞ্জনের, বড়ো বড়ো কাজলকালো চোখে উদাস দৃষ্টি, সবসময় কবিতার কথা ভাবে বোধহয়! দারুণ সুন্দর কবিতা লেখে মেয়েটা। নামটাও স্পষ্ট মনে আছে নীলাঞ্জনের, মণিমালা, মণিমালা ব্যানার্জী। বিশাখার নম্বরটা খুঁজে ওকে একটা ফোন করে নীলাঞ্জন।---হ্যালো বিশাখ........
সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল আজও! এখন বৃষ্টি থেমে গিয়ে গাছের পাতা থেকে টুপটুপ জল পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, বর্ষামেদুর প্রকৃতি! মণিমালার মন একটা অদ্ভুত অনুভবে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে আজকাল, সারাক্ষণ! বৃষ্টির ভেতরে একটা মানুষের ছবি, বৃষ্টিকে ছাপিয়ে সেই ছবি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে জেগে থাকে মনে।
ডোরবেল বাজলো, এতো বৃষ্টিতে কে!
-কে?
এ তো সে! বুকের রক্ত ছলাৎ ক’রে ওঠে, রোমকূপে শিহরণ!
-নমস্কার, আমি নীলাঞ্জন, ওই সামনের বাড়িটায় থাকি। আপনি মণিমালা তো! এবারে শ্রাবণ সংখ্যায় অসাধারণ একটা কবিতা লিখেছেন—তটিনী পত্রিকায়, ধারাপাত! আমি নিয়মিত পড়ি আপনার কবিতা। এর আগে পড়েছি বর্ষণগীত—অপূর্ব! ক'দিন আপনাকে দেখি না, ভাবলাম একটু খোঁজ নিই, বিশাখাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আজ আপনার কথা, আমার মাসির মেয়ে, বললো আপনি কলেজেও যান না, তাই ভাবলাম....
হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি—অঝোর বৃষ্টির শব্দে কথা ভেসে যায়! শ্রাবণের বাঁধনহারা সর্বনেশে বৃষ্টি, ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব, একূল ওকূল--দু'কূলই!
আবার এল শ্রাবণ, আবার শ্রাবণধারা
শ্রাবণী সেন
নীলাক্ষির কথাঃ
তোমার সাথে কতদিন পর দেখা হল বলত? আটাশ বছর পর ঐশিক দা, আটাশ বছর পর! ষোল বছরের নীলাক্ষি এখন চুয়াল্লিশের নীলাক্ষিম্যাম আর তুমি বছর পঞ্চাশের ঐশিক রায় এখন বিশাল ব্যস্ত এবং সফল একজন মানুষ! তোমার ডিগ্রি, ইনটেলিজেন্স, এবং এক্সপেরিয়েন্সে তুমি সব কটা বাধা টপকে টপকে চাকরি জীবনের শীর্ষে। তোমার হাতের মুঠোয় তুমি সব ইচ্ছে গুলোকে ধরেছ অবলীলায়।
কিন্তু আমি তো তোমায় সেই ঐশিকদাই দেখছি। সেই ছোটবেলা থেকেই যে সবসময়ই আমার সাথে থাকত, আমার সব আবদারের সঙ্গী হয়ে। বড় হবার পর শ্রাবণ দিনে ঝরঝর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যে আমার সাথে দেখা করত স্কুল ছুটির সময়। যার চিঠির জন্য আমি আকুল হয়ে অপেক্ষা করতাম। বাড়িতে তোমার চিঠি আসা তো অসম্ভব ছিল, শুভশ্রীর হাতে চিঠি দিতে তুমি যদিও এক পাড়াতেই আমাদের বাড়ি! কার্সিভে লেখা তোমার হাতের অক্ষরমালায় আমার নাম - নীলাক্ষি বাসু, আমি এখনও যেন দেখতে পাই ঐশিক দা। একটা চিঠিও আর আমার কাছে নেই, জানো! কি হত বল? যদি রেখে দিতাম তোমার হাতের লেখা চিঠি একটা, একটাই মাত্র! এই তো তুমি আমার হাতে দিলে আমার লেখা চিঠি, সেই কতবছর আগের লেখা, যেন পূর্বজীবনের।
জান, কতদিন বাংলা লিখি না। ষোলো বছরের সেই মেয়েটা চিঠির শেষে তোমায় লিখেছে - "তোমার নীলা "।
কত বড় বোকা ছিল মেয়েটা! জানতো না তো মায়ের কড়া শাসনে তোমার আমার যোগাযোগ বন্ধ হবে, তুমি কত ক্ষতি করতে পার আমার মত বাচ্চা মেয়ের, সেই সব আমাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কড়া পাহারায় আমার চিঠি লেখাও বন্ধ হবে। তখন তো ভাবতেই পারিনি এমনও হতে পারে!
তোমার আমার কারণে আমাদের দুটি পরিবারের যে সুন্দর সম্পর্ক ছিল তাও যেন কেমন বদলে গেল। তোমার মা, মানে নন্দিনী মাসি মনেহয় আমাকে খুব ভালোবাসত, তুমিও তো আমারই মত একমাত্র সন্তান, মাসির হয়ত একটা মেয়ের শখ ছিল! নন্দিনী মাসি আচার বানালে আমার ডাক পড়ত, নতুন শাড়ি আমি পাটভেঙে অনভ্যস্ত ভাবে পরে দিলে তারপর মাসি পরত, আমার গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত মাসির সবচেয়ে পছন্দের ছিল। তুমি জান মাসি একটু বিষাদ মাখানো গান পছন্দ করত? কতবার শুনিয়েছি - "আজ যে রজনী যায় ফিরাইব তায় কেমনে"? কিম্বা " সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা অন্ধ বিভাবরী সঙ্গ পরশ হারা... " অথবা " না, সজনি না, আমি জানি জানি সে আসিবে না"....
আমরা যেদিন চলে গেলাম এই শহর ছেড়ে তার আগের দিন আমি মাসির সাথে দেখা করতে গেছলাম, মাসি শুভশ্রীর কাছে খবর পাঠিয়েছিল আমি যেন দেখা করি, তুমি তখন কলকাতায় তোমার পড়াশোনায় ব্যস্ত। সেদিনও ছিল ভরা শ্রাবণের সন্ধ্যা, বাইরে যত বৃষ্টি, ঘরের ভেতর আমি আর মাসি দুজনেই তত কাঁদছি। মাসি আমার হাতে একটা ফটো এনে দিয়েছিল, জান। তোমার আর আমার ছবি! ছোট্ট আমি দোলনায় বসে আর তুমি দোল দিচ্ছ আর হাসছ। এটাই একমাত্র ছুঁতে পারার মত স্মৃতিচিহ্ন আমার কাছে, তোমার আর আমার স্মৃতিচিহ্ন !
তারপর কত বছর কেটে গেল বল! আবার এক শ্রাবণ দিনে আমি তোমার সামনে।
এখান থেকে চলে যাবার পর আমি আরো মনোযোগী হয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম, একটার পর একটা পরীক্ষা টপকে টপকে আজ কেমিস্ট্রির অধ্যাপিকা। কিন্তু জীবনের পরীক্ষাতে তো আমি ডাহা ফেল! সেই যে তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেলে, আর কাউকেই ভালোবাসা তো দূরস্থান পছন্দই করতে পারলাম না ঐশিক দা।
তুমি মধুরিমাকে নিয়ে সুখে আছ ভেবে আমার ভালো লাগে। অন্তত তুমি তো সুখে আছ,ঐশিক দা।
ঐশিকের কথাঃ
হায় রে! আমি নাকি সুখে আছি! আমার আর মধুরিমার মাঝখানে অদৃশ্য দেওয়াল হয়ে তুমি দাঁড়িয়ে আছ যে নীলা! আমি হয়ত তোমায় ভুলে যেতাম, কিন্তু মধুরিমা কোনদিন ভুলতে দিলই না। কি করে বা কার কাছ থেকে ও তোমার কথা শুনেছিল জানিনা, তারপর থেকে একজন যাকে আমি তার ষোলোবছর বয়সের পর আর চোখেই দেখিনি সেই তুমিই ওর প্রতিদ্বন্দিনি হলে। ওর সৌন্দর্য, ওর শিক্ষা, ওর পরিবেশ কোন কাজেই এল না! ছোট বড় সবকিছুতেই আমার বিন্দুমাত্র বিচ্যুতির পিছনে একটাই কারণ সেটা শুধুমাত্র তুমি নীলা! আর আমি আরো আরো বেশিকরে কাজে ডুব দিলাম। বাইরে থেকে আমরা পারফেক্ট কাপল কিন্তু ও কোনদিনই আমার মনের খোঁজ নিল না।
যাক্ ওসব কথা। ভাগ্যিস এই শহরের সঙ্গে যোগসূত্রটা তোমার একেবারে ছিন্ন হয়নি এখনো, তাই আমাদের দেখা হল। তোমার কলিগ উদিতের দাদা আমার বন্ধুু। কথায় কথায় তোমার কথা বলল। আর আমি তোমার ফোন নাম্বার পেলাম, নীলা। এতদিন পরেও হৃদয় জুড়ে একই আলোড়ন যতই কেন তুমি অস্বীকার কর, এটাই সত্য। তুমি আসবে জানার পর আমি যেন সেই আমাদের সময়ের পুরোনো শিলিগুড়িতে ফিরে গেছি জান? সেই সবুজে সবুজ শান্ত শহরে। না কোনো ঝাঁ চকচকে শপিং মল, না কোনো ফ্লাই ওভার!
হিলকার্ট রোড ধরে যেতে যেতে নীল পাহাড়ের দেওয়াল দেখা! আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার কথা মনে আছে তোমার! আমার মা বলত - "আমি তো রান্না করতে করতে পাহাড় দেখি"। তোমরা চলে যাবার পর মায়ের মন খুব খারাপ হয়ে গেছল, বাবাও বলত - "মেয়েটা আসত আমাদের ঘরে সেই ছোটবেলা থেকে।" দীর্ঘনিশ্বাসে বাবার কথা শেষ হত না। আমি ইউনিভার্সিটি ছেড়ে কম্পিটেটিভ এক্সামের প্রেপারেশন করতে লাগলাম, পেয়েও গেলাম। তারপর কত অপেক্ষা জান? মনে মনে ভাবতাম তুমি কলেজে পড়বে যখন ঠিক তখন আমার কাছে চলে আসবে। বছরের পর বছর গেল তুমি এলে না। তুমি তো ঠিকানা জানতে নীলা, একটা চিঠিও লিখলে না!
তারপর মধুরিমার সঙ্গে বিয়ে হল, মাসীমণির দূর সম্পর্কের দেওরের মেয়ে ও। রূপবতী, আগাগোড়া কনভেন্টে পড়া মেয়ে, ভালো চাকরি করা ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে স্বচ্ছন্দে ঘরে থাকাই ওর ইচ্ছে ছিল। আমি কোনো ইচ্ছেতেই বাধা দিই নি। রিমা বেশ ভালো ছবি আঁকে, এক্সিবিশনও হয়েছে দুটো। সুখি হবার সব উপকরণ আমাদের হাতের কাছে ছিল কিন্তু সবার কপালে সুখ থাকে না নীলা!
নীলাক্ষির কথাঃ রাত হয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টিও পড়ছে। এবার আমায় উঠতে হবে ঐশিক দা। আমি এখানের ইউনিভার্সিটিতে সিলেক্টেড হয়েছি কিন্তু জয়েন করব না ঠিক করলাম। আমাদের আর যোগাযোগ না থাকাই উচিত ঐশিক দা। তোমায় একবার দেখার ইচ্ছে ছিল, হল তো দেখা। কাল চলে যাব আমি। দেখ আজও -" সঘন গহনরাত্রি ঝরিছে শ্রাবণধারা" ..... আমার বিভাবরী অন্ধ এবং সঙ্গ পরশহারাও, কিন্তু তুমি মধুরিমাকে দূরে সরিয়ে রেখোনা, ওকে বুঝিয়ে বল আমি কেউ নই তোমার, সেই ছোটবেলায় এমন একটু আধটু ঘটেই থাকে।
তোমার জীবন ভরে উঠলে আমিও তো অন্তত শান্তি পাব।
আর একটা শেষ আব্দার মেনে নাও, আমরা কোন যোগাযোগ রাখব না। ফোনে নয়, সোশ্যালমিডিয়াতেও নয়, কেমন? নন্দিনী মাসিকে আমার কথা বলনা, কষ্ট পাবে।
আসি এবার! ভালো থেকো তোমরা।
ডঃ নীলাক্ষি বাসু ওর জন্য অপেক্ষমান কারে বসে গেস্টহাউসে পৌঁছানর আগেই স্থির করে নেয় সিঙ্গাপুরের ইউনিভার্সিটির অফারটা ও নিয়েই নেবে। এখানে তো ওর কোনো পিছুটান নেই।
নাঃ, ওর চোখে জল নেই " বিরহিণীর অশ্রু হরণ করেছে ওই তারা, সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা".....।
মায়ালোক হতে ছায়া তরণী
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
একটানা বৃষ্টি হয়েই চলেছে। বিরামহীন এই শ্রাবন ধারায় সব কাজ পন্ড হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর একটু ছাদে গিয়ে নদীর ওপারের দূর প্রকৃতির চোখজুড়ানো শোভা দেখছিল সে। চিলেকোঠার ঘুলঘুলির পাশে কয়েকটা শালিক ভিজে নেয়ে একেবারে একাকার।নিজেদের মধ্যে বচসা চলছে। কি যেন সব বলেই চলেছে। হঠাৎই বৃষ্টির ঝাপটায় নিচে নেমে এল আলোলিকা।
পূর্বাভাস ছিল ৪৮ ঘন্টা লাগাতার বৃষ্টিপাতের, কিন্তু ৭২ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও অবিরাম অন্তহীন শ্রাবণ ধারার কোন বিরাম নেই। রাতের গভীরে কেমন যেন এক শূন্যতায় ভরে দেয়। একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে আড়ামোড়া ভেঙে উঠে বসে আলোলিকা। হাজার স্মৃতির দরজা খুলে যায় যেন। এ যেন এক আত্মকথন লেখা কোন বই। ঝড়ের ঝাপটায় নিমেষে মলাট উল্টিয়ে নিয়ে যায় হারানো দিনগুলোতে।
সব ভালো স্মৃতিগুলোই এখন রাতের আঁধারে তার মনকে দুমড়ে মুচড়ে নিঃশেষ করে দেয়। নদীর ধারের এই প্রকান্ড আবাসন টা তাকে গিলে খেতে আসে যেন। সব থেকে বেশি করে মনকে নাড়া দেয় সেই সন্ধ্যার ঘটনা।
আলোলিকা সেদিন অন্যান্য দিনগুলোর মতোই, সেজে গুজে বাইরের ঘরের সোফাটায় বসে একটা পুরনো " দেশ " এর দুমড়ে মুচড়ে, কোনা উলটানো পৃষ্ঠার ভাঁজ খুলে কবিতা পড়ছিল । প্রসূন ও মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। প্রসূন বড় একটা কথা বলে না । কথা শোনাই যেন তার কাজ।আলোলিকাই একথা সেকথা পায়রার মতো ঘাড় নেড়ে নেড়ে বকবক করে যায়। তখনই ঘটে গেল খুব বড়ো বিপর্যয়। কি দরকার ছিল "ভালোবাসা" শব্দটা উচ্চারণ করবার। শব্দটা যে এতটাই ভয়ংকর, বিপদজনক এবং আগামী দিনগুলোতে অন্ধকার ডেকে আনতে পারে, তা ওদের দুজনের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল।
বহুদিন হ'ল প্রসূন আর এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়ায় নি। মন যে কি বিরাট বিষয়, তা এখন প্রতি মুহুর্তে অনুভব করে আলোলিকা। রোজকার মতোই অাজও " অাবৃত্তির কবিতা" পড়ছিল। পড়ছিল না বলে চোখ বোলাচ্ছিল বললেই ভালো হয়। তার লেখা কবিতা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে বহুবার। প্রতিবারই প্রকাশিত হবার পর ফোন আসত প্রসূনের । বার বার নিজের নামটা পড়ত, আলোলিকা। আলো মুখোপাধ্যায় , এই৷ নামে প্রকাশিত কবিতাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করত আর একজন। সে ছিল প্রসূন ।মনে মনে খুব ভালবাসতো তাকে। কি দরকার ছিল সে কথা মুখ ফুটে বলবার, তা আজও ভেবে পায় না। সে আজ শুধুই একটা দীর্ঘশ্বাস। এক মিষ্টি স্মৃতি বিজড়িত প্রেম। কবিতাকে কেটে জুড়ে, নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করাই ছিল তার কাজ। সে ছিল এক অদ্ভুত কবিতা পাগল মানুষ। ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লান্তিহীন ভাবে কবিতাচর্চা চলত ওদের। এমন দরজায় কলিং বেল বাজিয়ে প্রেম কখনো কারও জীবনে এসেছে বলে মনে হয় না আলোলিকার।
আলোলিকা একরাশ কালোচুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে বই এর পাতা থেকে চোখ তুলে দরজার দিকে তাকায়, কখনো কখনো। একটা হালকা৷ পায়ের শব্দও মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসে হঠাৎ করে। গালে হাত দিয়ে ভাবে। সবই কেমন চেনা ছন্দে চলে। পৃথিবীর এত আলো, বাতাস, হাসি, নাচ, গান সবই কেমন নিজের নিয়ম মেনে চলতে থাকে। এক মুহুর্তের জন্য একটা শব্দ " ভালোবাসা " সবকিছু নিমেষে ভেঙেচুরে ছারখার করে দেয়।
মনে পড়ে মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় গানের আসর বসত। রবীন্দ্র নজরুল অনুরাগীরা আসতেন। আসতেন দূর - দুরান্ত থেকে কবি সাহিত্যিকরা । সেই জমজমাট সন্ধ্যাগুলো আজ অতীত। এই ভাবনার যেন কোন শুরু নেই, শেষ নেই। রবীন্দ্র সংগীতের এক বহু উচ্চারিত অংশ, " মায়ালোক হতে ছায়া তরণী ভাসায় স্বপ্নপারাবারে, নাহি তার কিনারা " কানে ভেসে আসে। যার অাদি নেই অন্তও নেই।
বৃষ্টিভেজা ভারি বাতাস জমাটবাঁধা অন্ধকার ভেদ করে, জানালার ভারি পর্দাগুলোকে মৃদু নাড়িয়ে দেয়। পাশের আবাসন থেকে গান ভেসে আসে, " সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণধারা।"
মায়াময় শ্রাবণে
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
মাথার ওপর টিপটিপ বৃষ্টিফোঁটা গুলো ধীরে ধীরে বড় বড় হয়ে ঝরতে শুরু করলো। ছোট ছোট হাত দুটোকে কাদায় মাখামাখি করে এক হাঁটু কাদায় দাঁড়িয়ে বিলু ছটফটে মাছগুলোকে হাতের পাতার আওতায় আনার চেষ্টা করছিল। হাঁড়িটাও মাঝে মাঝে ভাসিয়ে দিচ্ছিল ঘোলা জলটার মধ্যে। কালকেও এভাবে ও আর হারানকাকা মিলে বেশ অনেকগুলো মাছ ধরেছে। ক'দিন ধরেই মাছ ধরার নেশায় পেয়েছে ওকে। হারানকাকা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে প্রায় প্রতিদিন এখানে। কাকা মাছ ধরবার অনেক কৌশল জানে। ঠিক বাবার মতো। ওদের সেই গ্রামের বাড়িতে বর্ষার আগে বাবা উঠোনে বসে জাল বুনতো। ঘরের কোণায় টাঙানো থাকতো সেই জাল। বাবার মাছ ধরতে যাওয়ার সঙ্গীও কয়েকবার হয়েছে বিলু। গতবছর, যখন নদী বানভাসি হলো, পাড় ভেঙে বিলুদের বাড়িঘর সব ভেসে গেল, বাবাও নৌকো নিয়ে তলিয়ে গেল কোথায় কে জানে। মা তো আগেই গেছে। গ্রামের একটা দলের সঙ্গে জুড়ে ভবঘুরে দশ বছরের বিলু বেরিয়ে পড়লো মেলার উদ্দেশ্যে। গ্রামে গ্রামে পালা পার্বণে মেলায় মনিহারী দোকানের জিনিসপত্র বিক্রিতে সাহায্যকারী হিসেবে বহাল হলো দুটো ভাতের বিনিময়ে। এ গ্রাম, সে গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে ওদের নৌকা এসে ঠেঁকলো কাঞ্চনপুর গ্রামে।
গাঁয়ের আর সব মেয়ে বৌদের সঙ্গে ফুলিও শ্রাবণের সোমবারের সন্ধ্যায় শিবের মন্দিরে এসেছিল শিবের মাথায় জল ঢালবে বলে। মন্দির চত্বর জুড়ে ছোট বড় অনেক দোকান সেজে উঠছিল তাদের রকমারি জিনিসপত্র নিয়ে। ফুলিদের দুজনের সংসারে তেমন স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও অভাব অনটন নেই কোনো। ওদের স্বামী স্ত্রীর ভাব ভালোবাসারও কমতি নেই কোথাও। শুধু একটাই কষ্ট.. এই পাঁচ বছরে ওর কোল আলো করে কেউ এলনা। সকলের সঙ্গে একসাথে জল ঢেলে মন্ত্রোচ্চারণ করে ফুলির বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে একটি সুন্দর শিশুর মুখ.. কানে ভেসে আসে 'মা', 'মা' করে ডাকা এক সুমধুর স্বর। শ্রাবণের রাত জানান দিচ্ছিল আসন্ন দূর্যোগের। ঝড়ের দমকে ঘিয়ের প্রদীপ নিভে যাওয়ার জোগাড়। কোনোমতে হাতের আড়াল করে নটরাজের রুদ্র মূর্তির মতো প্রদীপের নৃত্যরত শিখার আলো ছায়ায় রহস্য ঘেরা জরাজীর্ণ মন্দিরটির বিগ্রহের কাছে মনস্কামনা জানিয়েছিল কান্নায় কেঁপে কেঁপে। চোখ খুলতেই দেখে তার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাগর চোখ মেলে চেয়ে আছে ফুটফুটে সুন্দর একটি বছর দশেকের ছেলে। সন্ধ্যা আর রাত্রির সন্ধিক্ষণে শ্রাবণ তখন বড় অকৃপণ। তৃষ্ণার্ত পৃথিবীর সমস্ত চাওয়া পরিপূর্ণ করতে সে বদ্ধপরিকর যেন। কাউকেই যেন আজ খালি হাতে ফেরাবে না সে। মালতীর ডাকে ঘোর কেটেছিল ফুলির। 'দে, প্রসাদ দে.. কেমন হাত বাড়িয়ে চেয়ে আছে দেখ। '
সেই শুরু। তারপর কয়েকদিন শুধু লেগেছিল ফুলির, বিলুর মা হয়ে উঠতে। সন্ধেবেলা থেকে রাতের পুরোটা মেলায় কাটলেও সকাল থেকে সারাদিন হারান আর ফুলির মাটির কুঁড়েঘরই ছিল বিলুর নিজের বাড়ি। এখানেই ওর আবদার, খেলা, খাওয়ায় ভাগ বসানো, হারানকাকার পিছু পিছু মহাজনের ইঁটের ভাটায় রওনা দেওয়া, কাকার ছুটির দিনে মাছ ধরার সঙ্গী হওয়া, মায়ের হাতে হাতে কোনো বারণ না শুনে কাজ এগিয়ে দেওয়া, কলমী শাক, হেলেঞ্চা আর শাপলা আনতে মায়ের সঙ্গে আনন্দে বৃষ্টি মাথায় করে রওনা দেওয়া। ঘরের চাল বেয়ে যে পেঁয়ারা গাছটা ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ইচ্ছে খুশি মতো সেখান থেকে পেঁয়ারা পেড়ে খাওয়া। পকেট ভরে মায়ের জন্য নিয়ে তবেই নীচে নামা। মাঝে মাঝে সন্ধেবেলায়ও হানা দিত বিলু, হারানকাকার ঘরে.. কাকার ধরে আনা মাছগুলোকে রাতের বেলা দেখবে বলে। ফুলি মা বলেছে মাছগুলো সারারাত হাঁড়ির মধ্যে খপাত খপাত করে নিজেদের মধ্যে কত খেলাই না খেলতে থাকে। মায়ের গলা জড়িয়ে কুপির আলোয় ও মাছেদের খেলা দেখতো বিলু। দুপুরের খাওয়া তো বরাদ্দ ছিল এখানেই। তাছাড়াও নাড়ুটা, মোয়াটা, চিঁড়ে, মুড়ি, মুড়কি সবই যত্ন করে রাখা থাকে বিলুর জন্য। তবে অনাথ বিলুর আর নিঃসন্তান ফুলির মনের খোরাক একটা নিবিড় বন্ধনের জায়গায় এসে মিলেমিশে এক হয়ে যায় বারবার।
সন্ধ্যে থেকেই আকাশ কালো করে এসেছে আজ। ভরা শ্রাবণের আসন্ন রাতের মনে কী আছে কে জানে। আজ সকাল থেকে ফুলিকে দেখে প্রাণে একটু বল পেয়েছে হারান। মুখের যে হাসি সম্পূর্ণই হারিয়ে গিয়েছিল ফুলির, আজ অনেকদিন পর সেই হাসি আবার নজরে এসেছে। অন্য সব মেয়ে বৌদের সঙ্গে বাবার মাথায় জল ঢেলেও এসেছে নতুন ডুরে শাড়িটা গায়ে দিয়ে। কতদিন পর আজ কলমী তুলেছে ফুলি। হারান বহুদিন পর আজ পেঁয়ারা পেড়েছে ফুলির জন্য ওদের গাছটার থেকে। হারানের মনেও ছায়া নেমেছে। এতদিন একটা পেঁয়ারাও ছুঁয়ে দেখেনি ওরা কেউ। ঝড়ে কোথায় কোথায় পড়ে নষ্ট হলো, পাখির দল ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে গেল কতগুলো। হাসিখুশি, ছটফটে সেই ফুলি গত শ্রাবণের সেই বৃষ্টির রাতের পর থেকে এক বিষন্ন প্রতিমা যেন। হাসেনা, কাঁদেনা, কথা বলেনা.... টিনের চালের ফুটো দিয়ে ঘরে জলের বন্যা বয়ে গেলেও হুঁশ নেই ফুলির। হারানকেও বালতি, গামলা জড়ো করে ঘরের আনাচে কানাচে দিতে দেখলে চোখের আড়াল হতেই সব সরিয়ে দেয় মুহূর্তে। বাসনের মধ্যে জলপড়ার শব্দ যে বড় প্রিয় ছিল একজনের। ওর নাকী মাথা ধরে এখন.. হারান সব বোঝে.. কিছু বলেনা আর।
আজ বিকেলে গা ধুয়ে ধোওয়া কাপড় পরে, পায়ে আলতা পরে আকাশের দিকে চেয়ে নিজেই ঘরের কোণায় কোণায় বাসন বসালো ফুলি। হারানকে বলল 'বেশ জলতরঙ্গের শব্দ উঠবে'.. কলমী শাকের চচ্চড়ি, ছোট মাছের ঝাল আর গরম ভাত ফোটার গন্ধ যখন মিলেমিশে যাচ্ছে তখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত হারান ফুলিকে বলে মহাজনের বাড়ির দিকে রওনা দিল চাল মেরামতির জিনিসপত্র আনতে। এরপর যেদিনই রোদ উঠবে, এই কাজে হাত লাগাবে সে।
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নামলো। ঘরের এখানে সেখানে বসানো বালতি, বাসনে কোসনে টিনের চালের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির জল জমা হতে হতে এক অদ্ভুত সুরের মূর্ছনা তুলছে। ফুলির চুল খোলা। ডুরে শাড়ির আঁচল জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। রাতের আবছায়ায় বৃষ্টি মাথায় করে ও এগিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পুকুরটার দিকে। ওর মুখের 'বিলু', 'বিলু' ডাক একটানা বৃষ্টির তুমুল আওয়াজে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কানায় কানায় জলে ভরা পুকুরটার মধ্যে ডুবসাঁতার দিয়ে খুঁজে চলেছে ওর হারিয়ে যাওয়া স্নেহের জনটিকে। তলিয়ে যেতে যেতে ভেসে উঠছে কোন একবার, আবার চলে যাচ্ছে জলের গভীর থেকে আরও গভীরতায়। যেমন ঠিক ছোট্ট প্রাণটা তলিয়ে গিয়েছিল সেদিন.... সন্ধেবেলা একা একা মাছ ধরতে গিয়ে ফুলির ভালোবাসার শাপলা তুলতে গিয়েছিল ছেলেটা.. মাকে খুশি করবে বলে। পা হড়কে গেল.. শ্রাবণের ভরা নদীর উন্মত্ত স্রোতের টান ওকে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে গেল কে জানে! শ্রাবণ আজও বড় অকৃপণ.. সবটুকু ঢেলে দিয়ে শূণ্য হতে চায় সে।তাতে মরণই নয় হাজির হোক..সেই শূণ্য হওয়ার, রিক্ত হওয়ার খেলায় আজ যে তার সঙ্গী, জীবন মরণের সীমানায় দাঁড়িয়ে তার সাক্ষী রইল শুধু এই মেঘাবৃত নিবিড় দুরূহ রাত আর এই শ্রাবণধারা।
হাসনুহানা
চিত্রা পাল
প্রবল বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল সঞ্জয়ের। বেশ রাত এখন,কটা বাজে কে জানে, মাঝরাত বোধ হয়।লোড শেডিং,কোথাও কোন আলোর আভাস নেই। গহন রাত্রি, বাইরে বর্ষার মাতামাতি, খোলা জানলা দিয়ে আসছে বৃষ্টির ছাট। রেনু রেনু জলকণার দুচারদানা মশারিভেদ করে ওনার গায়ে আসছে, বেশ অনুভব করতে পারছেন,অথচ উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে করলো না। থেকে থেকে ভেজা হাওয়া বিনা অনুমতিতে প্রবেশকারির মতো ঢুকে পড়ে মশারিখানা দুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাত্ একখানা জোর দমকা হাওয়া দস্যুর মতো ঢুকে পড়লো সঙ্গে একরাশ ফুলের সুবাস নিয়ে। উনি সে ঘ্রাণ পেতেই আবার তা পাবার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠে জানলার কাছে এসে দাঁড়ালেন। চেষ্টা করলেন সে গন্ধের উৎস খোঁজার।
আবার ভেজা হাওয়ায় ভেসে এলো সেই ফুলের গন্ধ, হ্যাঁ,এ গন্ধ তো ভোলার নয়, এ তো সেই হাসনুহানা ফুলের গন্ধ,নিশ্চয়ই কাছাকাছি কারোর বাগানে ফুটেছে এ ফুল।বর্ষাই যে এ ফুলের সময় ফুটে ওঠার। কাল খোকাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এখন আবার সে ফুলের গন্ধ পাবার আকাঙ্ক্ষায় এলেন জানলার কাছে। আচ্ছা, বায়ু বা হাওয়া কে বলে গন্ধবহ,কিন্তু গন্ধ নিজে কি স্মৃতি বহন করে? কিজানি, আজ যে এই গন্ধই ওনাকে নিয়ে গেলো কয়েক দশক উজানে যেখানে এই পুষ্পগন্ধই প্রথম নিবিড় ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলো।
সঞ্জয় তখন সরকারি চাকরিগুলোর পরীক্ষায় পাস করে সবে চাকরিতে প্রবেশ করেছে। প্রথম পোষ্টিং উত্তরবঙ্গের এক মহকুমা শহরে। যতদিন পড়াশোনা চাকরির পরীক্ষা এসব নিয়ে ব্যস্ত ছিলো ততদিন মা কিছু বলেনি। কিন্তু পাকা চাকরি হওয়ার পরে ওর ব্যস্ততা কমলে মাএর ব্যস্ততা বহুগুণ বেড়ে গেলো। এ যেন জোয়ার ভাঁটা, একদিকে কমলে আর এক দিকে বাড়ে।মা ছেলেকে থিতু করতে একেবারে উঠেপড়ে লেগে বিয়ে দিয়ে ছেলেবৌ নিয়ে একেবারে কর্মস্থলের কোয়ার্টারেএলেন।উদ্দেশ্য কিছুদিন থেকে সংসারটাকে গুছিয়ে দিয়ে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে যাবেন। স্ত্রী মালতি একেবারে সংসার অনভিজ্ঞ,সেজন্যেও খানিকটা।
এই প্রথম সস্ত্রীক বেরিয়েছে দুজনে। এখানে কাছেই এক বন্ধুর বাড়ীতে সন্ধ্যেবেলা তাদের আমন্ত্রণে। মাকেও নিয়ে আসতে বলেছিলো,কিন্তু মাএর আসতে ইচ্ছে হয়নি বলে ওরা দুজনেই এসেছে। ওদের কথা বলার মাঝে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো সঙ্গে মিষ্টি ফুলের গন্ধ। মালতি একবার শ্বাস টেনেই বললো, আপনাদের কি হাসনুহানা গাছ আছে? বন্ধুর মা বলে, তুমি হাসনুহানা চেনো?’ ও একগাল হেসে বললো হ্যাঁ, এইহাসনুহানার গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে’।উনি বললেন,’তোমাদের বাড়িতে আছে? হ্যাঁ,এই প্রথম সঞ্জয় ওর স্ত্রীর নিজের ভালোলাগার বিষয় জানতে পারে।
পরের দিন সঞ্জয় অফিস থেকে বাড়ি ফিরলো, সঙ্গে একরাশ হাসনুহানা। মালতির হাতে দিতে ও খুব খুশি হয়ে রান্নাঘর থেকে একখানা কাঁচের গ্লাস এনে ফুলগুলোকে সাজিয়ে ওদের খাবার টেবিলের ওপর রেখে দিলো। সঞ্জয়ের মা টেবিলের ওপরে হাসনুহানা ফুল দেখে বলে ‘এ ফুল কে এখানে এনে রেখেছে রে?’ সঞ্জয় বলে ‘আমি, মা এর গন্ধটা কি ভালো,তাই না? ওর মা বলে, ‘খোকা শিগগির এ ফুল বাইরে ফেলে দিয়ে আয়। এ ফুল ভালো নয় রে, এরগন্ধে সাপ আসে। সঞ্জয় বলে,কি আবোল তাবোল কথা তোমার মা, ফুলের গন্ধে সাপ অমনি আসলেই হলো’? কিন্তু মা বারবার বলাতে ও ফুলগুলো ওদের শোবার ঘরের এককোনায় রেখে দেয়। রাতে খাবার সময়ে আবার গন্ধ পেতে মা জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে ফুলকটাকে ফেলে দিসনি, তুই আবার ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখলি? মালতি বলতে যাচ্ছিলো,’ওটা আমি রেখেছি, কিন্তু সে কথায় কান না দিয়ে ওর মা ওদের ঘর থেকে ফুল গুলো নিয়ে একেবারে সদরদরজা খুলে বাইরে ফেলে দিয়ে এলো। মায়ের কান্ডকারখানা দেখে দুজনেই অবাক।
মা ভাবলো, ‘আমি বারণ করলুম, তা সত্ত্বেও ফেলে না দিয়ে রেখে দিলো?’
মালতি ভাবলো, ‘আমার ভালোলাগার জিনিস আমি রাখতে পারবো না?’ খুব রাগ অভিমানে সে রাতে সঞ্জয়ের সঙ্গে ও কথা বলেনি একটাও। তারপরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো সঞ্জয়কে। তবুও মা ওভাবে সব শুদ্ধ ফেলে দিয়ে আসাতে সঞ্জয়েরও ভালো লাগেনি, আর মালতি যে মনে মনে ক্ষুব্ধ সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।সেদিন অনেকক্ষণ বালিশে মাথা দিয়ে এপাশ ওপাশ করেছিলো সঞ্জয়, কিন্তু মালতিকে কিছু বলতে পারেনি।
সম্পর্কের ক্ষয় যাতে আর না হয়, আর ওদের ভালো লাগে তাই একদিন ওরা সেভক ঘুরে এলো। বর্ষায় তিস্তার দুর্দান্ত, প্রবল বেগ, দুরন্ত স্রোত দেখে ওরা অবাক, তিনজনে বেশ খুশি নিয়েই ফিরে ছিলো সেদিন।
সঞ্জয় মনে মনে ভেবেছে, মা চলে গেলে ও আবার একদিন হাসনুহানা এনে দেবে মালতিকে।
রাতে খবরে শুনলো প্রবল বর্ষণে উত্তরবঙ্গের সব নদীতে জলচ্ছ্বাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। সঞ্জয় খুবই উদ্বিগ্ন তা নিয়ে। পরের দিনেও বৃষ্টি চলতে থাকায় ও মায়ের ফিরে যাবার টিকিটটাকে আগে রিফান্ডের ব্যবস্থা করে।
সেবার সঞ্জয় আর হাসনুহানা আনার চেষ্টা করেনি। কেননা আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে, আর সেটা একেবারেই কাম্য নয় দুজনের। ভেবেছিলো মা চলে গেলে ও আবার হাসনুহানা নিয়ে আসবে,কিন্তু তা আর এবার হলো না।
পরের বছর একখানা হাসনুহানার চারা এনে লাগিয়েছিলো, গাছটা বেশ বড়সড় ঘটঘটে মতো হয়েছে, একটা মরশুম গেলে পরের মরশুমে ফুল আসবে। এক দুপুরে একটু দুচোখের পাতা এক করেছে মালতি, এমন সময়ে মসমস শব্দে ঘুম ভেঙ্গে দেখে বাড়ির গেট খোলা আর ওপাড়ার ছাগলটা মনের সুখে চোখ বন্ধ করে গাছটার পাতা চিবুচ্ছে। ওকে যেই তাড়াতে গেলো অমনি ও গাছটাকে একটা ঝাঁকুনি ঊপড়ে নিয়ে চললো গেটের দিকে। সেবারের মতো ওর গাছেরও জীবন শেষ।মালতির খারাপ লাগা ওকেও আঘাত দিয়েছিলো বৈকি।
পরে আবার লাগিয়েছিলো হাসনুহানা, বর্ষার জলে বেশ সতেজ চেহারা পেয়েছিলো, সঞ্জয় মালতিকে বলে, সামনের বর্ষায় তুমি ওর ফুল দেখবে।কিন্তু ও ট্রান্সফার হয়ে চলে আসাতে ওই গাছের ফুল দেখা আর হয়ে ওঠেনি।
তারপরে কেটে গেছে দশ বারো বছর। এখন সঞ্জয় নিজের পৈতৃক বাড়িতে থাকে। ছেলে মেয়ে স্কুলে যায়। এক আষাঢ়ে মাহেশে রথের মেলায় গিয়েছিলো সেবার পিসিমার বাড়ি থেকে। সেখানে হাসনুহানার চারা দেখতে পেয়ে কিনে ফেলে। কিন্তু সেটা কে পিসিমার বাড়িতেই রেখে দেয়। পিসিমাকে বলে,’দ্যাখো তোমার জন্যে এই ফুলগাছ আনলাম, কোন জায়গাটায় লাগাবে বলো’?
তুই এখন রাখ,কাল জায়গা দেখে লাগাবো, কেননা ওটা বেশ ঝোপমতো হয় যে। বাড়িতে ফিরে এসে মাকে বলে, ‘মা,আমার বন্ধু বিমলের বাড়িতে এত্তবড় হাসনুহানার গাছ রয়েছে। ওদের তো কিছু হয়নি মা’? মা বলে, কার কি হয় না হয় জানি না, তোর ঠাকমা এ গাছ লাগাতে দেয়নি বারণ করেছিলো। তুই ও ওই ফুল গাছ আনবি না।‘
মায়ের যে কেন এতো বিরাগ এতোদিনে বুঝতে পারে। না এর পরে আর ও চেষ্টা করেনি।তবু বর্ষায় যখন কদম বকুল ফুলের সুবাস বাতাসে ভাসে, তখনো চেষ্টা করে হাসনুহানার সেই বিশেষ গন্ধ পেতে।
মালতি চলে গেছে কতবছর এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে এমন ঘন বর্ষার দিনে। আজ এই অশীতিপর বয়সে ঝর ঝর বৃষ্টির শব্দ আর সেই চেনা ফুলের সুগন্ধ যেন সেই রাতটাকে এনে দিলো এক লহমায়।
শ্রাবণ গদ্য
শ্রাবণের ধারাপাত
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
১)আজ রাতটা নিবিঢ় কালো । চারিদিকে শ্রাবণের মেঘের গম্ভীর আলাপ। তার সাথে তান ধরেছে বজ্র-আহ্বান জানাচ্ছে বৃষ্টিরূপি ঊর্বশী,রম্ভাকে। সেজে উঠেছে ইন্দ্রদেবের রাজ দরবার।
২)রাত্রি। ঘনকালো শ্রাবণের মেঘে ঢেকে আছে চারিদিক।দ্রুত হেঁটে আসছে মেয়ে। বৃষ্টি নামার আগেই পৌঁছাতে হবে ঝুপড়িতে। না হ'লে ভিজে আরো আঁটসাঁট হবে তার শতচ্ছিন্ন শাড়ি। সে নয় ঊর্বশী রম্ভা,কিন্তু সিক্তবসনা তার আহ্বানও কিছু কম হবে না-যা প্রলুব্ধ করবে জনগনকে।
৩) নিশুতি রাতে গহন কালো শ্রাবণ মেঘে ছাওয়া আকাশের তলায় ছাদে দাঁড়িয়ে অলকা। আজ স্বামীকে দাহ করে ফিরেছে সে। নীচে অশক্ত শ্বাশুড়িকে ঘুম পাড়িয়ে ছাদে উঠেছে সে। মিশকালো আঁধারের কোলে-সাদা শাড়ি এলোচুলে। অবশেষে নামলো শ্রাবণের ধারা- প্রকৃতি- নারী হ'লো একাকার। আজ এইরকম শ্রাবণ ধারারই প্রতীক্ষা করছিলো অলকা-এতক্ষণে চীৎকার করে কেঁদে উঠলো সে-তার বুকফাটা আর্তনাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো শ্রাবণের গহন রাতের বারিধারার শব্দে, কেউ জানলো না।
দূরে কোথাও রেডিওতে বাজছে-'সঘন গহণ রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণধারা।'
মায়ের সঙ্গে বর্ষাযাপন
জয়িতা সরকার
বৃষ্টি অনুভবে তোমায় পাব বলে, চাতকের মত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। শ্রাবণ রাতে মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে বানভাসি হওয়ার স্বপ্নে ঘুম ভাঙ্গে প্রায়ই। অঝোর ধারার রাতগুলোকে আগলে ধরে নতুন বর্ষার ঢেউ তোলা শব্দগুলোকে সাজিয়ে তোমাকে নিয়ে গল্প লিখি। বৃষ্টি এলেই তুমি আসো, তাইতো গ্রীষ্মের ঘাম ভেজা জপজপে গায়ে দিন গুনি মেঘে ঢাকা ঘন কালো আকাশের।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির সুরের সঙ্গে ছন্দ মেলায় তোমার নূপুরের রিনিঝিনি। ভরা বর্ষায় হৃদয় জুড়ে অনুরণনের সাঁকো বাঁধি প্রতি বৃষ্টি ফোঁটায়। আচ্ছা শীত-বসন্ত তোমার কখনও ভাল লাগেনি কেন? পাতা ঝরা প্রকৃতি কিংবা ফুলবাহারি বসন্তের জলসা তোমার পছন্দ নয় কেন? তোমার বুঝি বৃষ্টি ভেজা সবুজ ভাল লাগে? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়ত মিলবে না। তোমার আমার মাঝে বৃষ্টি ধোঁয়া অনুভূতি ছাড়া আর কোন অধ্যায় নেই।
তোমার মত আমারও ঘোলাটে, ঘূর্ণিপাক তোলা ভরা বর্ষার উত্তাল নদী ভীষণ প্রিয়। শ্রাবণের প্লাবনে ভেসে যাওয়া নৌকোয় এপাড় থেকে ওপারে যাওয়ার ইচ্ছেটা তোমার পূরণ হয়েছে। ওপারের বর্ষা কেমন? শ্রাবণ রাতে ওপারেও কি বর্ষার সুর বাজে? বর্ষা এলে কদম ফুলের গন্ধ মাখা আঁচল জোড়া আমায় যেমন আগলে রাখে, তোমার কি তেমন আমার কথা মনে পড়ে ? ওপারটা বড্ড দূর, তাই তো আর দেখা হয় না।
শেষ বিকেলে কাগজের নৌকো জোড়া আজও তেমন দোলে জানো। রিমঝিম বৃষ্টি ধারায় ঝনঝন চুরির শব্দ মেলে। বর্ষা ভেজা দুপুরে রং-তুলির ক্যানভাসে রামধনু সাজে তোমার আঁচল যখন রং তোলে, হঠাৎ আসা বৃষ্টি হাওয়ায় সবটা কেমন ঝাপসা লাগে। বৃষ্টি-আদরে জল ভরা চোখে তোমায় ছুঁয়ে থাকার মুহুর্তগুলো এভাবেই বর্ষা খামে যত্নে আছে। না ফেরায় প্রত্যয়ী তুমি বর্ষা সেজে আমার কাছে এভাবেই থেকো। ঘনঘোর বর্ষায় ধুয়ে যাওয়া ভস্মে নয়, এক পশলা বৃষ্টি সাজে তোমার স্পর্শে বর্ষা থাকুক আমায় ঘিরে।
সঘন গহন রাত্রি বহিছে শ্রাবণধারা
অপর্ণা দেবনাথ
বাইরে অঝোরে ধারাপাত! রাতের গভীরতার সাথে নিবিড় সখ্যতা! " শ্রাবণ বরিষণ পার হয়ে, কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে" ...
শ্রাবণ। ঘনঘোর বরষা। পরম ভালবাসার, ভাললাগার টুকরো টুকরো মুহূর্তের বহুল সমাহার আর কোনও সময় আমায় দুহাত ভরে উজাড় করে দেয় না!
তাই "শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে " আমার সমস্ত স্মৃতি, বোধের উৎসমুখ!
শ্রাবণের ধারায় ভিজে যাক মন। ভিজতে থাকি আমি!
কিছু টা বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম কি ভীষণ টানে এই অবিচ্ছিন্ন ধারাপাত! ঘনঘোর আকাশ। মেঘে মেঘে ছয়লাপ চারিপাশ! বারান্দায় বসে একমনে বৃষ্টি দেখি। শ্রাবণ ভিজিয়ে দেয় চারিপাশ! ভিজতে থাকে গোটা রাত! ভিজতে থাকে সবুজ বনানী। আশরীর! ভিজতে থাকে মাটির শরীর! গভীর আবেগে কেঁপে ওঠে ভোরের বাতাস!
মাটি আর বৃষ্টির ভালবাসায় ভরে ওঠে নদী। মাঠ ঘাট ডোবা। ভিজতে থাকে ধারাপাতে। আকন্ঠ। ভিজে আমার মা!
হ্যাঁ মা। আমার মা ও শ্রাবণ ভালবাসে! আগে ততটা না বুঝলেও এখন অনেক টা বুঝতে পারি! ছোটবেলায় যখন সঘন ধারাপাতে রাত ছেয়ে যায় দিনের বেলায়, আমরা ঘরবন্দী। সকালের জলখাবার একটু দেরী হতো। মা দেখতাম তাড়াতাড়ি কাজ সারতে ভিজতে শুরু করেছে। উঠোন টুকু পাড় হচ্ছে মা। ভিজে যাচ্ছে। ভিজছে মা!
" মা ভিজো না, ঠান্ডা লেগে যাবে "।
" না রে। স্নান করে নেব।"
আমার অন্তর্মুখী মা, ভালবাসে শ্রাবণ ধারা! বৃষ্টি ! মায়ের সেই বহু বছর হারিয়ে যাওয়া শিল্পী মন জেগে ওঠে! তেজপুর গার্লসের সেকেন্ড গার্ল কিশোরী মেয়েটি জেগে ওঠে! বেঁচে ওঠে মায়ের হলদে হয়ে যাওয়া ডায়েরীর কবিতা গুলো! মায়ের রবি ঠাকুরের গান আরও আরও প্রিয় হয়ে ওঠে!
যখন বাজতে থাকে "গহন রাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে" বা "এমন দিনে তাঁরে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়" অথবা " আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে ", মা পাশটিতে এসে বসে। মায়ের আর আমার ভাললাগার তারে একই সুর বাজে!
মনে পড়ে কলেজ থেকে ফেরার পথটুকু। আমাদের আদি বাড়ি থেকে বাসস্টপ কিছু টা দূরে। বাস থেকে নেমে সাইকেলে ফিরতাম। ততক্ষণে শ্রাবণের ধারাপাতে ভিজতে শুরু করেছে সব। আমি ও উন্মুখ! মেখে নেব সেই বারিধারা! ব্যাগটাকে কোনও ভাবে সেফ করে, ছাতাটি বন্ধ করে রেখে দিই সামনের বাস্কেটে। তারপর! তারপর সেই অবিচ্ছিন্ন ধারাপাত! ভিজতে থাকি আমি। অন্তরে বাহিরে!
বাড়ি পৌঁছনোর পর মা শুধু বলতেন, "তাড়াতাড়ি ভিজে কাপড় ছেড়ে নে। খাবি আয়।"
নিভৃতবাসের সেই তেতলার ঘরখানি। ঘনমেঘে প্রায়ন্ধকার দিনমান ! জানালার বাইরে গাছেদের গা বেয়ে নেমে আসা বারিরাশি! মলিন ধূলো ধুয়ে ফর্সা চোখে চেয়ে থাকে বকুল!
আর আমার ভেতর ঘরে শ্রাবণের ভালবাসার উচ্ছাস! ভিজতে থাকে যাবতীয় বোধের অন্তর্মুখী উৎসস্থল!
কলকাতায় বৃষ্টি মানেই জল জমে যাওয়া যদিও! কখনও কখনও ছপছপ পায়ে এগিয়ে যাওয়া! কিন্তু ভিজে যাওয়া, ভিজতে থাকা শহর বড় সুন্দর! ভিজতে থাকে রাজপথ, ভিজতে থাকে রাতের নিয়ন আলো! ভিজে কংক্রিটের জঙ্গল! শ্রাবণের অঝোর ধারায়। ভিজে ভেতরে। ভিজে বাইরে!
বাড়ি থেকে স্কুলের হাঁটা পথটুকু আমি বুভুক্ষুর মতো আস্বাদন করি! শ্রাবণের ধারা আমায় ফিরিয়ে দেয় আশৈশব উত্তরবাংলায় বেড়ে ওঠার, ভেতর বাহিরে ভিজতে থাকার মুহূর্ত গুলো! শহরের পায়ে জলনূপুর বেজে ওঠে!
আর এখন, আমার আড়াই বছরের মেয়ে, সকাল বেলায় ঘুম ভেঙে ঘুম চোখে জানালার দিকে তাকিয়েই আমায় বলে " বি ষ ষ ষ তি ই ই, মাম্মা! "
ছুটে যায় ব্যালকনি তে। ওর মুখ টা হাসিতে ফুটন্ত কদমফুলের মতন লাগে! গ্রিলের বাইরে ছোট ছোট হাতে ছুঁতে চায় শ্রাবণের ধারা! আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। দেখি। এক অবিচ্ছিন্ন ভাললাগার, ভালবাসার ধারাপাতে ভিজে ওঠে আমার ভেতর ঘর! বাইরে অঝোরে শ্রাবণ ধারা! ভেতরে ও তাই!
এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্ম! আরও এক প্রজন্মের হাত ধরে বয়ে চলেছে, বয়ে চলবে শ্রাবণ ধারা! সঞ্চারিত হচ্ছে ভালবাসার শ্রাবণ! ভাললাগার শ্রাবণ! ভিজে, ভিজতে থাকবে উওরাধিকার!
শ্রাবণ কাহন
তমালী দাস
একটা ধূসর বিকেল...ভিজে ভিজে,চাপ ধরা ভাব।এমন বিকেলে যখন কোন কাজ থাকে না,মনে হয় দু দন্ড বসি।কোন পাহাড়ি রাস্তায়,পায়ের নীচে ফার্ণ আর মাথার ওপর উঁচু উঁচু পাইনের সারি,বসার জন্য ফাঁকা বেঞ্চ পেয়ে যেতেই পারি।কিছু ভাবতেই হবে তা নয়..তবু খানিক এলোমেলো উথাল-পাতাল অলিগলি ঘুরে কোথাও যেন গোপন চোরকুঠরিতে মন ঢুকে পড়ে।হুহু করে মনে পড়তে থাকে কবে বন্ধুর খাতা ছিঁড়ে দিয়েছিলাম বলে সে কি কান্না তার!কবে খেলতে গিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছিল বলে কতগুলো এলোপাতাড়ি মিথ্যে সাজিয়েছিলাম!পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করে কত গঞ্জনা শুনেছিলাম! কে,কারা কতবার হাত ছাড়িয়ে চলে গেল..ফেরার কি কথা ছিল কোনও??মনে পড়ে না।নাকি মনে করতে চাই না..জানি না।কাউকে কি সরি বলার ছিল??বলা হয়ে ওঠে নি??আজ সেই ঠিকানায় চিঠি ও যায় না।সবসময় মুঠোফোন সরি বলার উত্তম মাধ্যম হয় না!কথা জড়িয়ে আসে,ছন্দপতন হয়,ভুল হয়..শুধু সরি বলা হয় না!
ধূসর বিকেল কখন গাঢ় অন্ধকার হয়,কখন পাইনের তীক্ষ্ণ পাতার ডগা থেকে বৃষ্টিবিন্দু চোখের পাতায় নেমে আসে...কে জানে!!আসলে পাহাড়ে থাকা আর বুকের ভেতর আস্ত পাহাড় বয়ে নিয়ে চলা..এক নয়।এই ঝাপসা চোখে দূরের সব সবুজ গাঢ় নীল মনে হয়।পাকদণ্ডী বেয়ে নামা হুহু স্রোতের কোন ঋতু হয় না।যে কোন জায়গায় তীব্র মনখারাপ আর নিম্নচাপ একসঙ্গে এলে আমরা তাকে শ্রাবন বলে ডাকি!
শ্রাবণ কবিতা
শ্রাবনভেজা রাত্রিপথে
শিবির সিনা
.... পরদেশি নির্জনপথ,
দুুধারে আচ্ছাদন গাছ হাত ধরাধরি ক'রে দাঁড়িয়ে কথাহারা, ভিজে ভিজে সারা
ঝাপসা অন্ধকার চমকে ওঠে বিজলি থেকে থেকে ছুঁড়ে দেয়
আলোর ঝলকানি অন্ধকারের বুক ছিড়ে দিয়ে
ঝিরি ঝিরি হাওয়াতাড়িত বৃষ্টি, চিকের আড়াল
করেছে সৃষ্টি....
জনহীন শুধু দুটো গহেরী প্রেম বিলম্বিত্ পথ চলে
বারিস পবনে জেগেওঠা শাসউত্তাপে বিভোর
শ্রাবনক্লান্ত পথের নৈঃশব্দ ভেঙেছে কখন
মুহাব্বাতী দুজনের ঘনিষ্ঠ হাসিতে... উষ্ণ ঠোঁট
ছুঁয়েছিল শরমের গালে, পিপাসিত হাত রাখে ফেনায়িত শরীর বুকে,
সাকি ভরে দিয়েছে নেশার পেয়ালা,
শারাবিচোখে নামে রাতের কিসসা....
মাতাল হাওয়ায় ভেসে ভেসে রাত্রি নামে সাওনপথে, রাতজাগা কেতকি ঢেলে দিয়েছে
চূড়ান্ত মদ...
আশিক ! তোমার রাগান্ধ চোখে বেহোসি রং...
থামো এবার আসক্ত প্রেমিক, ফিরে যেতে দাও
সাকি রসের পাত্র হাতে, শ্রান্ত রাত্রিপথ বেয়ে
ক্লান্তি নেমেছে ভোরের হাওয়া ঘুমভাঙানিয়া সোনার আভায় কাঁপে সবুজ সকাল...
শ্রাবণের জলছবি
ড.ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
ঘন শ্রাবণ রাত। অঝোর বর্ষণ। ডুবে যাচ্ছে ফেরিঘাট। মিশে যাচ্ছে কালো কাজল হলদির জলে। ঐ দূরে বাতিঘর । আলো ভাসে আলো ডোবে। ছলাৎ ছল কাঁপে জল। বেহালার ছড়ে আহির ভৈরবী। ভাসানের শেষে কেউ ফিরে আসে? তবু প্রতীক্ষা অপার। গোপন কথা নদীর সাথে। মনের গভীরেও যে অন্তঃশীল এক নদী থাকে।
শেষ লঞ্চ চলে যায়।ভাঙ্গা সিঁড়ি শূন্য পড়ে থাকে। নিশুতি চারিধার। দু একটি শুশুক মাথা তোলে। সারি গান। নৌকো ভেসে যায় মোহানার দিকে। মাঝিদের গরম ভাত আর মাটির সোঁদা গন্ধ এক হয়ে যায়। অপেক্ষায় অপেক্ষায় রাত বাড়ে।তার অন্তরে কদম সোহাগ।ইচ্ছে সুখ মিলন সংরাগ। নথে কাঁকনে বৃষ্টির জলতরঙ্গ।শিলাবৃষ্টি বুকে তীর হয়ে বেঁধে।
জলে ভাসে ও কার মুখ? শঙ্খ লাগা কামনার বিষে নীল... নীল....গাঢ় নীল.. . ..
শ্রাবণ ধারা
মহাজিস মণ্ডল
'সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা'
হৃদয়ে প্রেম এবং অশ্রুর মেঘ
নিরবধি নদীতে নৌকা ভাসায়-
সুদূরের ডানায় নিরন্তর হাতছানি দেখি
অবিশ্রান্ত ভালবাসায় রাত্রিদিন পাগল পারা।
জল-শৈশব
রীনা মজুমদার
ছোটবেলা পেরিয়ে আসতে
ঠিক যেমন দেখেছিলাম!
অঝোর ধারায় ঝরছে শ্রাবণ
উনুনে ভেজা কাঠের কুন্ডুলী ধোঁয়ায়
মায়ের তখন আবছা ধূসর মুখ,
দিনে রাতে টিনের চালে
শব্দ যাকে ভাসায়
কাগজের নৌকো রূপকথা জাগায়
জল ছপ্ ছপ্ জল-ছবি
জল তরঙ্গে ঢেউ গুনি
অঝোর ধারায় ঝরছে শ্রাবণ
পথগুলো সব ডুব দিয়েছে নদীর মতন
রিমঝিম ঝমঝম শ্রাবণ
গন্ধরাজে রিনিঝিনি শিহরণ..
আজও ঝরে শ্রাবণ ধারা
ধুয়ে দিয়ে যায় যত শূন্যতা
পারে না শুধু মুছে দিতে
জল-শৈশব স্মৃতি-মধুরতা।
শ্রাবণ ও শ্রাবণী
সুনন্দ মন্ডল
শ্রাবণ
স্যাঁতসেঁতে উঠোন
মাটি ফুঁড়ে সোঁদা গন্ধ।
শ্রাবণী
কালো ঘন চুল পিঠে
বিন্যস্ত প্রেমিকার অন্তর।
জলাময়
পুকুর, ঘাট, খাল, বিল
কচুরিপানার সংসার।
শ্রাবণ
ব্যাঙের ডাক
চাষীদের মেঠো জীবন।
শ্রাবণী
চোখের কাজল
ঘন মেঘ ভাসে মনে।
বসুন্ধরাও জাগে
নতুন স্বাদে
সঘন বৃষ্টির মাসে রাত্রি প্রেমিক।
শ্রাবণ অনুবাদ কবিতা
সময়ৰ আগমন
সীমাক্ষি শর্মা
সময়ের আগমন
অনুবাদ: পার্থ সারথি চক্রবর্তী
এনেকৈয়ে সময়বোৰ পাৰ ভাঙি উৰি যায় দিগণ্তলৈ
ৰাতি আহে ৰাতি যায়
জীৱনৰ সপোনবোৰ সপোন হৈয়ে ৰয়
সুখৰ অনুভুতিয়ে ক্ষন্তকতে বিদায় লয়
দুখৰ বেদনাই মনতে থিতাপি লয়
নদীখন কিন্ত বোৱতী হৈয়ে থাকে
পাত সৰি গজালি ওলায়
সকলোৱে মৃত্যু পথৰ যাত্রী হয়
মদাৰে কিন্ত ফাগুনৰ বতৰা দিয়েই যায়
**************************************************
এভাবেই সময়ধারা পাড় ভেঙে উড়ে যায় দিগন্তে
রাত আসে রাত যায়
জীবনের স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে যায়
সুখের সময় ক্ষণিকেই চলে যায়
দুঃখ কষ্ট মনে স্থায়ী হয়
নদীটি কিন্তু আপনমনে বয়ে যায়
পাতা ঝরে, নতুন পাতা গজায়
সবাই মৃত্যুপথযাত্রী হয়
ফুলগুলো যথারীতি ফাগুনের বার্তা দিয়ে যায়
(বিশেষ কৃতজ্ঞতা: বিজয়া চক্রবর্তী ভট্টাচার্য)
শ্রাবণ স্মরণ
কবিগুরুর প্রয়াণে
স্বপন কুমার দত্ত
সঘন গহন রাত্রি
ঝরিছে শ্রাবণধারা,
থমকে গিয়েছে ধরিত্রী
বৃষ্টিতে পাগলপারা।
খালবিল নদীনালা
একেবারে ভরপুর,
ভেককুল ছেড়ে গলা
গান গাইছে মধুর।
অবিরাম বৃষ্টিতে স্নান
করে গাছপালা,
এবার বুঝি নামবে বান
কান হল ঝালাপালা।
এমনি এক অশুভ শ্রাবণে
হল নক্ষত্র পতন,
কবিগুরু আঘাত দিয়ে মনে
ছেড়ে দিলেন এ ভুবন।
আজও তাই শ্রাবণ
আবার ফিরে এলে,
বিষাদে করি কালযাপন
ভাসি চোখের জলে।
প্রত্যয় ছিল গুরুদেবের
" মরিতে চাহিনা আমি
সুন্দর ভুবনে".....
কথাটি কী তোমার,
পড়েনি মনে।
অন্য শ্রাবণের গল্প
শিয়ালুর দিনকাল
অনির্বাণ ঘোষ
চোখ বুজে ভরসা করতে পারা নির্ভরতার কাহিনী। ব্যাগ হাতড়ে জিনিস বের করে আনছে এক প্রায় দৃষ্টিশক্তিহীন বুড়ো। তুলে দিচ্ছে উন্মুখ নেশাখোর খরিদ্দারের হাতে।বিনিময় মূল্য হাতে ধরিয়ে চলে যাচ্ছে নেশাখোর। যাবার আগে পেছন থেকে বুড়ো হাঁকছে, ঠিক আছে তো? নেশাখোর বলছে হ্যাঁ দাদু ঠিক আছে। আর পরম নির্ভরতায় বুড়ো ট্যাঁকে গুঁজছে টাকা।
শিয়ালুর আসল নাম জানিনা। ওর সাথে আলাপ ছিল না। আর আমার বাংলা মালের নেশাও নেই।প্রথম দেখি বিলাসপুরে লোকাল বাসে। একটা জীর্ণ ছিন্ন প্লাস্টিকের বস্তা কেটে তৈরি ব্যাগ নিয়ে হাচোরপাচোর করে ভিড় বাসে উঠলো। ওরকম তো কত প্যাসেঞ্জারই বাসে ওঠে। প্যাসেঞ্জারের গুঞ্জন। তা ছাপিয়ে বাসের বাইরে হাটের হাটুরে আওয়াজ। তারই নয়েজ কাটিয়ে মায়াবী বোতলের টুংটাং শব্দ।
"দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে শরাবি দেখ ফির হোতা হ্যায় ক্যায়া "গানের প্রিলিউড এর মত।
হাত ধরে বাসের ভেতরে টেনে নিল কন্ডাক্টর। জায়গা মত সেট হয়ে গেল পেটমোটা ঢাউস ব্যাগ। একটু এদিক সেদিক করে একটা সিটেরও বন্দোবস্ত করে দিলো বুড়োর জন্য। সত্যি কথা বলতে কি শিয়ালুর আগমনে বাসের স্টাফদের মধ্যে আলাদা জোশ। খালাসি আরো একটু জোরে চিল্লাত রায়গঞ্জ, রায়গঞ্জ। এক্ষুনি ছাড়বে। আরেকটু বেশি করে চেপে সেট করত প্যাসেঞ্জারদের কাঁধে ব্যাগ ঝোলা কন্ডাক্টর যাতে আরো দুটো পয়সা আসে। আর ড্রাইভার ক্যাসেট পাল্টাতে ফাটা স্পিকারে শুরু হয়ে যেত কিশোর কুমারের রোমান্টিক সং।
বিলাসপুর হাটের ভাটি থেকে বাংলা মাল তুলতো শিয়ালু। পড়ন্ত বিকেলের রোদ মেখে ঘরফিরতি সারাদিনের শ্রমক্লান্ত প্যাসেঞ্জার নিয়ে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে ফেরা লোকাল বাসগুলোর কোন একটাতে উঠে পড়তো শিয়ালু। যৌবনের বলিষ্ঠ কাঠামো সময়ের ভারে একটু ন্যুব্জ। চৌকোনো মুখ পুরুষালী পক্সের দাগে পরিপূর্ণ । আর তার থেকে সামনে এগিয়ে এসেছে টিকালো নাক। ঈষৎ বক্র। ভঙ্গুর চেহারায় একটা নেভার সে ডাই অনমনীয়তার ছাপ। ওর ঠোঁটে ঝুলে থাকতো একটা অকারণ বিগলিত হাসি
লাইন বাসের রেগুলার যাত্রীদের সবাই কমবেশি দাদা কাকু জেঠু দিদি কাকিমা। কিন্তু শিয়ালু শিয়ালুই। স্টাফেদের সাথে তার যথেষ্ট খাতির থাকলেও আত্মীয়তার বাঁধনে বেঁধে ফেলে নি তারা। তবে বাসে স্টাফেদের কাছে যে একটু কমেসমে বাংলা মালের বোতল শিয়ালু তুলে দিত তা বাসের স্টাফদের তৎপরতা দেখলেই বোঝা যেত।
রায়গঞ্জ স্ট্যান্ডে প্যাসেঞ্জার ও রিক্সাওয়ালা হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি দরদামের ফাঁকে ফাঁক গলে হঠাৎ করেই উবে যেত সে। সন্ধ্যের মোহনবাটি বাজারে গেলে মিলতো তার দেখা। বাজারের পেছন দিয়ে ঢোকার গলির মুখে দিনের আলোয় যেখানে ঝলকানো ছুরি-কাঁচির পসরা নিয়ে বসত এক সিড়িঙ্গে বুড়ো, ঠিক তার উল্টো দিকেই সন্ধ্যের আলো-আঁধারিতে ল্যাম্পপোস্টের মরা আলোয় সামনে চলতো তার বিকিকিনি। তার ঢাউস ব্যাগ নিয়ে দ হয়ে বসে থাকত সে। কাস্টমারদের আনাগোনা চলতো। হাতে টাকা গুঁজে দিলেই ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসতো বোতলবন্দী বাংলা।
সেই বাংলার ধ্বকে বুঁদ হয়ে থাকতো খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষের দল আর পেঁচো মাতাল। রেল গুমটির জল মারা বাংলা শিয়ালুর মালের কাছে ফিকে।
দিনকাল বদলেছে। কঠোর করোনাকাল। ঝাঁপবন্ধ স্কুল আর উন্মুক্ত সুরা বেচিয়েদের বিকিকিনি। দু'পা হাঁটলেই দিশি বিলিতির অফশপ। মোহনবাটি বাজারের পেছনের এন্ট্রান্স সন্ধ্যের সময় এলইডি আলোয় উজ্জ্বল ঝকঝকে তকতকে। দিনের বেলায় এখনো ছুরি-কাঁচিওয়ালা সিড়িঙ্গে বুড়োর ম্রিয়মাণ মুখ মাঝে মাঝে শাণিত ছুরি-কাঁচির ঝলকানিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সন্ধ্যার পরে আর দেখা মেলেনা শিয়ালুর। হালের কথা হলে করোনায় টেঁসে গেছে বুড়ো বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু করোনার মুখোশকাল আসবার আগেই থেকেই নিপাত্তা সে।
মরে গেছে???
বোতলবন্দী করে স্বপ্ন যারা বেচে সস্তায় তারা মরে না। হারিয়ে যায়। They simply cease to exist.
অবসেশনসুজাতা কর
সুলেখা মন দিয়ে টিভি দেখার চেষ্টা করছিল।টিভি সামনে চলে যাচ্ছে।হিরো-হিরোইন সুইজারল্যান্ডে নাচছে।অপরূপ দৃশ্য।সুলেখা ঘড়ির দিকে তাকালো।দশটা।সুলেখার মনটা পড়ে আছে ফোনের দিকে।টিভির নাচ-গানে ও মন দিতে পারছিল না।একটা চাপা উৎকণ্ঠা।আজো মনজিত মেসেজ করবে তো? এই সময়টা মনজিতের মেসেজ আসার সময়।মনজিত সুলেখার বান্ধবী সুহানার দাদা।ফেসবুকে যোগাযোগ।প্রথম প্রথম নেহাত কি করছো,কেমন আছো এই ভাবেই মেসেজের সূত্রপাত।তারপর ক্রমশঃ নিজেদের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে আলাপ-আলোচনা।শেষে দিনের প্রতিটি কাজের বর্ননা একে অপরকে জানানো।এভাবেই কবে যেন এত কাছাকাছি চলে আসা দুজন দুজনার যে এখন মেসেজ না এলে চরম উৎকণ্ঠা শুরু হয় সুলেখার।মনে হয় মনজিতের কি কিছু হলো? মনজিত অসুস্থ নাতো? একসিডেন্ট হয়নিতো কোনো ? কোনো বিপদে পড়েনি তো? কেন এমন হয় সুলেখা জানেনা।মনজিত তার কেঊনা।তারা শুধু বন্ধু।
দশটা কুড়ি।মনজিতের কোনো মেসেজ নেই। সাড়ে দশটায় সুলেখা বুঝলো বিনবিনে ঘাম তার কপালে জমছে।সে উৎকণ্ঠা কমাতে চ্যানেল বদলায়।এখানে খবর চলছে।কতজন করণায় আজ মৃত তার খবর।সুলেখা আবার গানের চ্যানেলে ফিরে আসে।দশটা চল্লিশে সুলেখা লেখে 'হ্যালো'।দেখে মনজিত হোয়াটস আপ এ অনলাইন।অপেক্ষা করতে থাকে সুলেখা।এগারোটায় লেখে 'খুব ব্যস্ত'? মনজিতের উত্তর নেই।আরো দশ মিনিট অপেক্ষা করে সুলেখা লেখে 'রাগ হয়েছে?' না ,তাতেও কোনো উত্তর নেই।আজও মনজিত তাকে মেসেজ করলোনা।আজ চতুর্থ দিন। আজকাল মনজিত সুলেখাকে এড়িয়ে চলে।সুলেখা বোঝে কোথাও সুর বেসুরো হচ্ছে।তাল কেটে যাচ্ছে।মনজিতের কথায় সেই প্রশ্রয় নেই,সেই আদর নেই।সুলেখা বুঝে উঠতে পারেনা কোথায় তার দোষ! মনজিতের মেসেজ যে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।অনেক প্রশ্ন মনে ভিড় করে।সেকি কোনো ভুল করেছে,কোনো অন্যায়।সে যে মনজিত ছাড়া জীবন ভাবতে পারেনা।কি হবে যদি মনজিত জীবন থেকে হারিয়ে যায়!!সুলেখা যন্ত্রনায় কাতর হয়ে ওঠে।ঠোঁটে দাঁত চেপে কান্না রোধের চেষ্টা করে ফুঁপিয়ে ওঠে।
রাত বারোটায় বেডরুমে ঢোকে সুলেখা।সুদৃশ্য বেডরুম।এসি চলছে।জানলায় মোটা পর্দা।ঘরে নীল আলোতে অপার্থিব অন্ধকার।বিছানায় বসে সুলেখা,বালিশে হেলান দেয়।বিভাস ঘুমাচ্ছে প্রতিদিনের মতো ঘুমের ওষুধ খেয়ে।বিশ ঘন্টা সে বিছানাতেই।পাশের বেড সাইড টেবিল থেকে জল নিতে গিয়ে কিসে একটা হাত ঠেকে যায় সুলেখার।দেখে বিভাসের ঘুমের ওষুধের শিশি।এক মুহূর্ত থমকায় সুলেখা।মাথার মধ্যে চলতে থাকে তরঙ্গের পর তরঙ্গ।প্রানপন যুদ্ধ করতে থাকে মনের সঙ্গে।হাঁফাতে থাকে অল্প অল্প।অনেক কষ্টে দমন করে নিজেকে।শিশিটা আবার যথাস্থানে রেখে দেয়।তারপর জল খেয়ে চাদর টেনে শুয়ে পড়ে।
শ্রাবণ কবিতা
তৃষ্ণার্ত
অম্বালিকা ঘোষ
রাতের আকাশ উপুড় করে কারা যেন ঢালে সুখ,
ভিজে যায় আজ জীর্ণ পত্রক,বিবর্ণ লতা উন্মুখ!
বাদল দিনে যুথিকা-সুরভি বয়ে এনেছে বারতা,
প্রিয় সমাগত,বিরহী মনের যেন উচ্ছ্বাসে নেই মাত্রা!
সেই যে সেদিন, সে বিদায় নিয়েছিল, এমন বরষায়,
সে আবার ফিরবে, মন-মাঝি তাই মল্লার রাগ গায়।
মেঘের আড়ালে গোপনে তৈরী বজ্র-মাণিক হার,
প্রিয় এসো ফিরে হৃদয়পুরে,দেরী যে না সয় আর!
ঘনঘোর এই জলোৎসব যে দু আঁখিতে ধরা যায় না,
মনের প্লাবন দেহের বাঁধনে আর বুঝি বাঁধা যায় না!
আজ তমসাবৃত এই বারি-উন্মুখ দীর্ঘ রাত্রি জানে,
ধূসর ধূলি মৃত্তিকা ছিল হুতাশে,শুধু সরসতার টানে।
আজ এই সিক্ত রাতের পটে মেঘ-রঙে যেন কারা,
আঁকছে দেখ নব উল্লাসে ভরে উচ্ছ্বল শ্রাবণধারা!!
অজান্তে
শতাব্দী সাহাকিছু কথা জমে রয়আর কিছু ঝরে পড়ে খরচের খাতায়।আজও ক্লোরোফিলের হাতছানিতেআলোড়ন জাগে বিবর্ণ পাতায়।গাছের কোটর থেকে ডানা মেলে স্বপ্নতার ভেজা পায়ে আঁকা জলছবিআকাশ যখন আরো ঘন হবেআমার শুধু নীল রেখো,বাকি তোমার সবই।স্রোতের আবেশে ভেসেমন খোঁজে ভাঙাচোরা লকগেট প্রশ্নের উপচে-পড়া ভিড়েসিক্ত বেলায় হাত ফসকায় উত্তর কয় সেট।
বর্ষামঙ্গল
দীপ মুখার্জি
সেই তুমি
আমার মাধবীলতা ছিলে..
কত শ্রাবনের রাতে
দুজনে একসাথে ভিজেছি-
বর্ষার হাওয়ায় খোলা ছাতাটা
ইচ্ছে করেই উড়িয়ে দিয়েছি..
সিক্ত হয়েছি দুজনে
শ্রাবনধারায়।।
মনে পরে..
এই বর্ষা এলেই
কত রাত নিভৃতে কাটিয়েছি
দুজনে।
পাহাড়িয়া নদী যেমন
কলকল শব্দে -বর্ষার
উন্মত্ত তরঙ্গে গর্জনশীলা
হয়ে পাহাড়কে আলিঙ্গন করে
নেমে আসে...
কত শ্রাবনী রাতে
তুমি আমি..যৌবনের
ভরপুর নেশায় অলিঙ্গনরত হয়েছি
মিলনের আশায়।।
বৃষ্টিভেজা শরীরে তুমি যখন
সামনে এসে দাঁড়াতে..
মনে হত নব মাধবীলতা বুঝি
আমার সামনে ফুটে উঠেছে।
কপাল থেকে গড়িয়ে আসা
বারি বিন্দু যখন তোমার
ঠোঁট ছুঁয়ে নেমে আসে..
তোমার ঐ বক্ষ বিভাজিকায়
মাথা রেখে তোমার ঐ
ভারী বুকের আন্দোলনে
বেসামাল আমি..সানন্দে
পান করি..সেই অমৃতসুধা।।
সেদিন দুজনের
সেই দুটি শরীর..
শ্রাবণ ধারায় বর্ষা রাগিনীর
হিল্লোল সুরে সৃষ্টি করেছিল
আমাদের বর্ষামঙ্গল কাব্য।।
শ্রাবণী
সুরজ সিং
আজ আকাশের মুখ বড়ই ভার
কালো মেঘের স্বপ্নে ।
দক্ষিণের জানালাটা সহসা বাতাসে
খটখট শব্দে আপন মনে তাঁকিয়ে তিস্তার সীমান্তরেখায় ।
এই দুর্দিনে বড় একা একা লাগে
শ্রাবণের সন্ধ্যায় ।
কোল বালিশে মাথা ঠেকিয়েও
ঘুম আসেনা চোখের পলকে ।
বাদুরের ডানা ঝাপটানো গহীনে
হ্যারিকেন জ্বলে দোমহনীর রাস্তায় ।
ত্রাসের বুকে জেগে থাকে বাষ্প প্রবাহ,
দূরে দূরে দুম করে ওঠে বিদ্যুৎ ।
লাইনধরে মালগাড়ি পেড়িয়ে যায় কু ঝিক ঝিক শব্দে।
আমার জমানো ব্যথাগুলো আরও গভীর হয় ।
শ্রাবণী ...!
গতকালের মতো তুমি আজও নেমে এসো ।
শ্রাবণধারা
পৌলোমী চক্রবর্তী
বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় আমি বসে আছি
আনমনা হয়ে তোমার অপেক্ষায়
চারিদিক অন্ধকার লোডশেডিং এ
ঝর শ্রাবনধারায় আকাশ মেতে উঠেছে গর্জনে।
কোথাও বা জ্বলছে মোমের আলো,
কোথাও আবার আধুনিকতার আলাদা আলো
মিলেমিশে সব আজ লাগছে ভালো।
কানের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ,
মিষ্টি শীতল বাতাস
সে যেন অনেক কিছু বলতে চাইছে
প্রকৃতির বুকে আজ।
বর্ষার শ্রাবনধারায় সেজে উঠেছে নদনদী
ভরে গেছে জলাশয় পথ দিঘি।।
তুমি চলে গেলে
জয়িতা চট্টোপাধ্যায়
তুমি চলে গেলে শ্রাবণ রাত্রি ভোর হয়ে যায়
রাস্তায় হাঁটুজল বন্যার আভাস
তুমি চলে গেলে রক্তে চলে বিষের স্রোত
মাথা তুলতে পারি না অসহ্য যন্ত্রণায়
তুমি চলে গেলে লিখতে পারি না বাংলা বা ইংরেজি
ভোর হতে দাও আমি বন্যায় ভেসে গেছি।।
শ্রাবণ গল্প
মন কেমনের শ্রাবণী রাত
সোমা দে
-- রাত্রি দুটো বাজে বাইরে তুমুল বজ্রসহ বৃষ্টি হচ্ছে মাঝে মাঝেই ছতলা বিল্ডিংটা কেঁপে উঠছে ঠিক যেমন পিউ এর ভেতরটা কেঁপে উঠছে এই ভেবে যে রক্তিমকে হারিয়ে ফেলছে ক্রমাগত ..
-- ঘুম আসছে না পিউ এর , আজ অফিস থেকে ফেরার পথে বহুদিন বাদে বন্ধু বিনয়ের সাথে ডিনারে গিয়েছিল সাথে হালকা হুইস্কিও নিয়েছে তবুও নেশা চড়েনি একফোঁটা স্মৃতি ভুলতে চেয়ে আরো বেশি করে মনে পড়ছে । কয়েকটা ছবিও ফেসবুকে আপলোড করেছে যদি রক্তিম কোন রিয়াক্ট করে , না কিছুই করেনি সে কারণ বিনয়কে নিয়ে আর হিংসে হয়না ওর , পিউকে হারানোর ভয়টাই যে আজ মরে গেছে তার।
-- অনলাইনে কিছুক্ষন থেকে ফের মোবাইলটা বন্ধ করে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো পিউ , বৃষ্টির ঝাপটা ওকে ভিজিয়ে দিতে দিতে কখন যে ওর চোখজোড়াও নিমেষেই ভিজিয়ে দিল টের পেল না ।
-- মনে পড়ে যাচ্ছে রক্তিমের সাথে কাটানো এক একটা মূহুর্ত কত যত্নে মনের মাঝে সাজিয়ে রেখেছে ও । তবে দিন দিন অফিসের কাজ ও নানা ধরনের ব্যস্ততার অজুহাতের ঠুনকো দোহাই দিয়ে রক্তিম কতটা সরে গেল ওর থেকে ভাবলেই কেমন জানি অসুস্থ বোধ করে পিউ , বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই যেন হারিয়ে যায় । রক্তিম একটা মেসেজ কিংবা কল করে একটু ভালোমন্দও জানতে চায়না দীর্ঘদিন , সত্যিই ভালোবাসা জীবন্ত থাকলে কি এতটা দূরত্ব তৈরি করা সম্ভব !
-- নাহ্ , রক্তিমের জীবনে তাহলে নতুন মায়াবিনীর প্রবেশ ঘটেছে । হতেই পারে , পিউ নিজেও বিশ্বাস করে প্রেম একাধিকবার হতেই পারে আজকের ভালোলাগার মানুষ কে আগামীতে ভালো নাই লাগতে পারে এই টপিকে অনেক গল্প লিখেছে পিউ , ওগুলো পড়ে রক্তিম ওকে কতো কথাই না শোনাতো যে পিউও একদিন রক্তিমকে ছেড়ে আবার নতুন প্রেমে পরবে কিন্তু সে তাকে চিরদিন মনের মাঝে ধরে রাখবে কিন্তু আজ পুরোটাই উল্টো হয়ে গেছে ।
-- জোড় করে আর যাই হোক প্রেম টিকিয়ে রাখা যায় না ' মনের মানুষ রক্তিম ' পিউ এর মনে থেকে যাবে আজীবন তবে সম্পর্কের বাঁধন থেকে এবার তাকে মুক্তি দেবার সময় এসে গেছে ঠিক যেভাবে শ্রাবণ বৃষ্টিকে মুক্ত করছে মেঘের ঘর ভেঙে।
সহন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা
চম্পা বিশ্বাস
অফিস থেকে ফিরে এককাপ কফি হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় অমিত। এক মাস হল একটি ম্যাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে দিল্লিতে একটি অ্যাপার্টমেন্টে রয়েছে সে। তিনতলার ব্যালকনি থেকে সামনের ছোট্ট গোল পার্কটির শোভা দর্শনই প্রতি সন্ধ্যার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তার। দেখতে দেখতে বৃষ্টি শুরু হয়েছে অঝোর ধারায়। বৃষ্টি স্নাত বৃক্ষরাজি তার স্মৃতিকে আরো ও উস্কে দেয়।
ঠিক পাঁচ বছর আগে এমনই এক শ্রাবণ রাতের স্মৃতি আজও অমলিন। অমিতের মামাবাড়ি জলপাইগুড়ি শহর থেকে একটু ভেতরে দেবনগর অঞ্চলে। পাঁচ বছর আগে যখন সে মামাবাড়ি এসেছিল তখন শ্রাবণ মাস। চারপাশ জলে থৈ থৈ। সকাল থেকেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি চলছে। বৃষ্টির ফোঁটা টিনের চালে পরে এক অপূর্ব শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। মামাবাড়ির সকল ভাই বোনেরা এক জায়গায় বসে শুরু হয় আড্ডা সঙ্গে চা, মুড়ি মাখা আর মামীর হাতে তৈরী পকোড়া।
শহরের কোলাহল থেকে দূরে গাছগাছালি পূর্ণ এক অপূর্ব পরিবেশ এখানে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে শুরু করলো। মামাতো বোন এবার গাইতে শুরু করলো - "সহন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা। " ওর ঐ মিঠে গলায় গাওয়া গান পরিবেশটিকে আরোও মোহময় করে তুলছিল। গানটি শেষ হওয়ার পরও আমাদের সকলের অনুরোধে ও আরোও গাইতে থাকে --"আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে", "ঝরো ঝরো বরিষে বারিধারা ", "শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা। " গানগুলো শেষ হওয়ার পরও তার রেশ রয়ে গেল গোটা ঘর জুড়ে। আর এরপর রাতের খাবারে ছিল খিচুড়ি, পাপড় ভাজা, আলু ভাজা। সে এক আনন্দ ঘন মুহূর্ত।
ব্যালকনি থেকে বৃষ্টি দেখতে দেখতে পাঁচ বছর আগের স্মৃতি স্মরণ করে একাকী অমিত নিজের মনেই গেয়ে ওঠে -- " সহন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা। "
রঞ্জনের অভিজ্ঞতা
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত
রঞ্জনের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা কয়েকদিন আগেই শেষ হয়েছিল। সকাল- সকাল একটা বিশেষ দায়িত্ব বর্তাল তার ওপর। তাকে যেতে হবে ধারাঝিরি বলে একটি জায়গায়। সে জায়গাটির নাম বাড়িতে একাধিকবার শুনেছিল কিন্তু পরোক্ষ কৌতুহলের প্রকাশ করেনি কোনোদিন। রঞ্জন শুনেছিল ওর বাবার এক দূর সম্পর্কের মামা সেখানে থাকেন। ধারাঝিরি কাটোয়ার কাছাকাছি একটি গ্রাম। রঞ্জনকে একটি বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে সেখানে পাঠানো হয়েছিল এবং তাকে সেইদিনেই ফিরতে হতো।
রঞ্জনের একটা নতুন অভিজ্ঞতা হল অভিভাবকহীন ভ্রমণের। সে এক বিরল আনন্দ বুকে নিয়ে লোকাল ট্রেনে চেপে বসল। কামরায় সেরকম ভিড় ছিলনা, একটু পরেই জানালার ধারের সিটটা তার দখলে এসেগেল। ট্রেন চলাকালীন রঞ্জন দেখল শহরতলীর আঙিনা পেরিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে তেপান্তরের মাঠের মাঝখান দিয়ে আর সুদূরে যেন উত্তর-পশ্চিমের কানাচ ঘেঁষে একটা মিশমিশে কালো স্তুপ দ্রুত উঠে আসছে দিগন্ত পেরিয়ে। কিছুক্ষন আগেই যে আকাশ স্নিগ্ধ ছিল, প্রভাতি সুর্য ছিল আপন দীপ্তিতে, হঠাৎ সেই আকাশের পশ্চিমে মেঘ যেন জটিল হতে শুরু করল। রঞ্জন গুনগুন করে উঠল,"অথবা ও কিরে সচল অচল ভেদিয়া কোন সে অসীম অতল...।"
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠান্ডা দমকা বাতাস মাঠ পেরিয়ে ট্রেনের গুমোট কামরায় প্রবেশ করল। আর একটু পরেই ছুটে এল বরফ কুচির মতো ঠান্ডা বৃষ্টির পাগল ঝোরা। এমনিতেই উত্তরের ভরা বর্ষার শেষে মাঠ-ঘাট জলে থৈ থৈ করছিল, রেললাইনের পাশের নয়ানজুলি থেকে ভরন্ত খেতখামার সবই একাকার। তারই মধ্যে হয়তো বা এমনিতেই ছিল কোনো সেচের খাল যা মর্যাদায় এখন একটা ছোটো নদীর রূপ নিয়েছে। তারই একটা কালভার্টের ওপর মন্দগতি নিয়ে ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল। ট্রেনের কামরার প্রায় বেশিরভাগ জানালার কাচ না থাকার দরুণ বৃষ্টির ছাট থেমে থাকা ট্রেনের কামরায় নির্বিঘ্নে প্রবেশ করল। বৃষ্টির উথাল পাতাল রঞ্জন নির্নিমেষ চেয়ে দেখতে লাগল। সবুজের সমুদ্রে দিগন্তজোড়া এক অলৌকিক দৃষ্যপট।
কখন যে ঘটনাস্থলে পৌচাবে সেই চিন্তাই রঞ্জনের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রবল বৃষ্টির সাথে সাথে ঝোরো হাওয়ার মাতামাতি আরম্ভ হয়েছিল।কবির অভিজ্ঞতা যেন আজ রঞ্জনের কাছে নিজের অভিজ্ঞতা হয়ে উঠল,"দিবসের ভাগে টানিয়া ফেলিছে বেণীবন্ধন সন্ধ্যার।"
বৃষ্টির খামখেয়ালীতে কখনও একদিকের আকাশ ঝাপসা ধুসর হচ্ছে, অপরদিকে দূরের বনরাজি দেখে রঞ্জনের মনে হল, এমন নৈস্বর্গিক রূপকল্প প্রকৃতির তুলিতেই সম্ভবপর। দিগন্তের প্রান্তসীমায় একটি দুটি করে গ্রামের অবয়ব ফুটে উঠছিল। আকাশে বাতাসে যেন সঞ্চালিত হচ্ছিল এক অবিরাম আনন্দধারা।
রঞ্জনের মনে নিজস্ব ভাব কল্পনা দেখা দিতে লাগলো। টুকরো টুকরো কিছু বিচ্ছিন্ন লাইন ভিড় করে এলো তার মনে। সে ভাবলো বাড়ি ফিরেই ভাবনা গুলোকে সুন্দর রূপে লিখে ফেলবে।
সে যখন গন্তব্যে পৌঁছালো তখন প্রকৃতি মেঘের মায়া কাটিয়ে এক অন্য মেজাজে। কাজ ঠিকঠাক ভাবে মিটিয়ে সে বাড়ির পথে রওনা দিলো। প্রকৃতির সেই রূপ রঞ্জনের মনের মণিকোঠায় গভীর ভাবে স্থান নিয়েছিল। তাই ফেরার পথে ভাবতে লাগল বাড়ি ফিরেই গুছিয়ে একটা বর্ণনা দিতে হবে। বাড়ি ঢুকতেই মায়ের প্রশ্নবাণের সম্মুখীন হতেই, রঞ্জন মুখ খুলতেই যা বেরিয়ে এলো তা হলো বিশাল একটা "হ্যাঁ... চ্চো"।
শ্রাবণ কবিতা
শ্রাবণ দিনে
বিপ্লব গোস্বামী
আজো মনে পড়ে
বৃষ্টিভেজা ঐ শ্রাবণের দিনে
তোমাকে কিছু একটা দিয়েছিলাম।
একদম জোর করে নয়
তুমি চেয়েছিলে তাই।
আমিও রিক্ত হাতে ফিরিনি
তুমিও কিছু একটা দিয়েছিলে।
কিন্তু কবে কখন তুমি
তোমারটা নিয়ে গেলে !
সহজ সরল আমি টেরই পাইনি।
তাই বলে আমারটা ফিরিয়ে দিবে,
না না তা একদম নয়।
যদিও তোমার কাছে তা মূল্যহীন !
তবু রেখে দিও অচ্ছিষ্টের মত
মনের একটা কোণে।
অশান্ত শ্রাবণ
চন্দন কুমার দাস
উন্মত্ত ধারায় অশান্ত শ্রাবণ এলো
স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় ঝমঝম মুখরিত যেন মায়াবী সন্ধ্যা
সারি সারি গাছ ছায়া ফেলে-- জীবনের অঙ্গনে,
নতুন অর্থের সন্ধানেআলো-আঁধারির খেলা ,
ঝমঝম বৃষ্টি ঘুমের আবেশ তোলে।
শরণার্থী পিঁপড়েরা সারি বাঁধে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে
গর্তের থেকে মুখ উঁচু করে ঠাঁই খোঁজে চার
খরগোশ;
তারপর চলে যায় জ্যোৎস্নায় ভিজে ।
ঘোলাজল ;ঝোপঝাড় চলে জীবন সংগ্রাম
সাপেরা আশ্রয় খোঁজে গাছের শাখায়
নীড় ভাঙা পাখি আর ঝুপড়ির চালাঘর ভিজে
যায়।
শ্রাবণেও শীতে কাঁপে বস্তির কোন ছেলে
খাবারের আকাঙ্ক্ষায় রাত হয় দীর্ঘতর--
তারপর রাত কাটে ,ভোর হয় ;
ভোরের আলোয় ভিজে যাওয়া ফুল রঙিন গন্ধ ছড়ায় ।
তবুও অনেক মানুষ তখনও ঘুমন্ত থাকে!
সুরদ্যোতনায় বৃষ্টি
সৌমেন দেবনাথ
বিশুষ্ক জীবন শোকে চৌচির
চিত্ত ন্যূনতম মাধুরীশূন্য।
আকাশে বিপুল মেঘদল, তুমুল বৃষ্টির সম্ভাবনা,
হঠাৎ টিনের চালে বৃষ্টি পতনের রুম ঝুম ঝুম সুরের
ঐকতান সাঙ্গীতিক মূর্ছনা তোলে।
শ্যামল বনান্ত জুড়ে যে বিষাদগীতি-
সঘন শ্রাবণসন্ধ্যার বাঁধনহারা ধুমল বৃষ্টি টেনে দেয় ইতি।
হৃদয়ে ঢেউ উঠে- দেহলতা থরথর কাঁপে কম্পনে,
মন মেঘের সঙ্গী- দিগ দিগন্তের পানে উড়ে
হংস বলাকার পাখায় ভর করে-
হৃদয়াকাশ সামূহিক উদ্ভ্রান্তির জগতে সমর্পণ,
আমে-জামে, শিরিষে-শালে বারিবিন্দু হাসে,
মাধবীলতা দোলে দুল দোলে।
জেগে উঠে অন্তর্লীন ঘুমন্ত সুখ,
মনের পালক ডানা মেলে ঝাঁপটায়;
বাদলমূখর মোহাবেশে চঞ্চল সজল পবন করে হৃদয়
মন্দিরের শূন্যতাপোলব্ধির বেহাগ সংগুপ্ত সংরচন।
মনের ময়ূর নাচে- অশ্রুকণা কিছুটা চক্ষুকোণে,
গোপন অভিসারিকা উঠে উত্তুঙ্গে।
মেঘের অস্পর্শিত আঁচলখানি তরঙ্গ হিল্লোলে হারমনিকা হয়ে বাজে,
যাতনার উপশম হয় না, হয় আরো মন্দীভূত।
অব্যক্ত অন্তর্বেদনা বুকের মধ্যে গুমড়ে মরে,
নৈর্ব্যক্তিক প্রেমের অতীন্দ্রীয় অনুভূতি
জাগালো বর্ষার এ মুহূর্তমঞ্জুরি।
শ্রাবণের অশ্রুধারা
বুলবুল দে
একেই আষাঢ়ে হাবুডুবু দশা, ভরা শ্রাবণে কি আছে কপালে ভাইবা কূল কিনারা না পাই,
ঝরঝরা চাল নড়বড়া বেড়া,ঠেকনা দিয়া তারে কুনমতে যে ঠেকাই।
দিনের বেলায় যখনই ঘনায় রাতের মতনই আঁধার,
বুক ধুকপুক চোখ টনটন ,এই বুঝি মোর খুইলা গেল সব খোয়ানের দুয়ার।
শ্রাবণে যদি প্লাবনে ভাসায় ,কোথা পাব হায় মাথা গুজনের একটুকু ঠাঁই?
চরম অভাগা দীন হীন মোরা, ঘর ছাওনের এইটুকু খড় কেনার সাধ্যি নাই।
শতছিন্ন একখান তেনা আধেক পরি আধেক শুকাই,
খাওন নাই পরন নাই, নিশ্চিন্তির ঘুমডাও নাই।
আষাঢ় শ্রাবণে বাদলেরে মোরা বড় যে ডরাই বড় যে ডরাই !
জরাজীর্ণ একখান ঘরে জনাপাঁচেকের কঠিন লড়াই।
এদিক সরিতো ওদিক জল ,ওদিক সরিতো এদিক জল,
মাথায় ভাঙে আকাশ মোদের ,পায়ের নীচে মাটি টলমল।
ছিল এক ফালি আবাদি জমি, সে তো কবেই গিলসে নদী,
নাই এর মাঝেও অসুখ আছে ,তার লগে নাই বদ্যি ।
বাবুরা শ্রাবণে আবেগে ভাসে,আমরা ভাসি প্লাবনে,
শ্রাবণের গান মন আনচান, এসব মোদের নাই জীবনে।
বাবুগো বাড়ি ঐ গান বাজে-- "সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা, "
আমাগো সদাই বুকের মাঝে-- সঘন গহন রাত্রি,নয়নে অশ্রু ধারা!!
ছন্দে শ্রাবণ
সার্সি
মাথুর দাস
সার্সি জুড়ে বৃষ্টি ফোঁটা আরশিতে মুখ ঝাপসা,
কার কীসে আর কী এসে যায় মনকে ভেজায় আর্দ্রতা ;
উলুক ঝুলুক উদাস বেলা সুলুক খুঁজেই হাপসা,
হোক না যেমন আষাঢ় শ্রাবণ কিম্বা যে মাস ভাদ্র তা !
ঝাপুর ঝুপুর টাপুর টুপুর গাছের পাতা টিনের চাল,
ঝরতে থাকুক ঝরণা মনের একসা ভেজা ওড়না চুল ;
ভিজছি আমি ভিজছ তুমি ঘুরছে হাওয়া টালমাটাল,
বরষা দিনের ভরসাটুকু দিক ঘুচিয়েই মনের ভুল ।
আরশি না হয় আরশি হল সার্সি কিছু ফেলনা নয়,
বৃষ্টি তো নয় জমেও শিশির কাঁচের জানলা সার্সিতে ;
আবছা রূপে ভাব যা জমে ক্রমেই যে তা মূর্ত হয়,
এমন ছবি ঠিক দেখা যায় বর্ষাকালে আর শীতে ।
বর্ষার মানে
কবিতা বণিক
বর্ষা মানে- মেঘ কন্যের গুরু গুরু ডাক।
বর্ষা মানে- ঘোলা জলের কত না ঘূর্ণিপাক।
বর্ষা মানে- ফুলের গন্ধে বাতাসের কানাকানি।
বর্ষা মানে- সতেজ সবুজ শ্যামলের হাতছানি।
বর্ষা মানে- বাজ বিজুলির রাগের যত কথা।
বর্ষা মানে- চলে মেঘেদের অবাধ স্বাধীনতা।
বর্ষা মানে- মায়ের কোলে গান, গল্প শোনা।
বর্ষা মানে- বৃষ্টি ভেজায় মানেনা তো মানা।
বর্ষা মানে- মল্লার সুরে মুখরিত চারিদিক।
বর্ষা মানে- বৃষ্টিও ঐ সুরে সুর ধরে ঠিক।
বর্ষা মানে- মাঠ, ঘাট, পথ জলে একাকার।
বর্ষা মানে- ছোট, বড় মাছ ধরার হিড়িক সবার।
বর্ষা মানে- মানুষের কষ্টের নাই শেষ।
বর্ষা মানে- পশুপাখিরা ও অসহায় বেশ।
বর্ষা মানে- বৃষ্টি শেষে মিষ্টি আলোয় ঘাসের ঝিলিমিলি।
বর্ষা মানে- মানুষের জীবন বাঁচায় অন্নপূর্ণার ঝুলি।
বৃষ্টি
অসীম মালিক
বৃষ্টি আমার ছেলেবেলার দূরন্ত এক দুপুর।
বৃষ্টি আমার কিশোরবেলা রাঙা পায়ের নুপুর।
বৃষ্টি আমার ছুটি শেষে ঘরে ফেরার তাড়া।
বৃষ্টি আমার বুকের ভিতর গোলাপ ফুলের চারা।
বৃষ্টি আমার কলার ভেলা খুশির স্রোতে ভাসা।
বৃষ্টি আমার মাঠের খাতায় অনন্ত এক আশা।
বৃষ্টি আমার আলের পথে দুর্বাঘাসের মায়া।
বৃষ্টি আমার চিরকালের ছেলেবেলার ছায়া।
বৃষ্টি আমার শহর-নগর করেনা সে আড়ি।
বৃষ্টি আমার ছেলেবেলা সবুজ ঘেরা বাড়ি।
শ্রাবণ
মুনমুন সরকার
এলো রে বৃষ্টি ভেজা শ্রাবণ
ঝরে জল ধারার প্লাবন
খেলছে আকাশ ভরা টুকরো মেঘ
হঠাৎ বিদ্যুতের গতিবেগ !!
শুরু সময় অসময়
ফোঁটা ফোঁটা দেখা দেয়
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলের টুকরো
এলো যে বর্ষাকাল পুরো !!
মাঠ-ঘাট থই থই
জলে ফোটে পদ্মফুল ওই
শাপলা শালুক মাছের পোনা
দিঘী ভরা কচুরিপানা !!
ঝলমলে সাদা-কালো রোদ্দুরে
ব্যাঙেরাও চুপি সারে
উঁকি দেয় ঘরে ঘরে
লুকিয়ে বেড়ায় অন্ধকারে !!
রকমারি পোকামাকড়ের উপদ্রব
জমে ভীষণ রাগের ক্ষোভ
থেকে থেকে আকাশ- জুড়ে গর্জন
আরম্ভ শিব ঠাকুরের গাজন !!
মাছ ইলিশের সমাগম
কখনও আবার আবহওয়া থম থম
মাঝে মাঝে মেঘের আভরণ
এলো রে বৃষ্টি ভেজা শ্রাবণ ।।
দরবার
বিজয় বর্মন
ছুটছে আগুনের গোলা,
পুড়িয়ে ছারখার খোলা,
পিছন ফিরিলে যায় না ভোলা।
ফেলে আসা পথ, ছাই ভস্মে ঢাকা,
অপেক্ষারত বারুদ মাখা,
এ কোন উপত্যকা।
নজরে শুধু জ্বলছে আগুন,
অন্তরালে বসন্ত আগুন,
ছুটন্ত জীবন তরঙ্গে দ্বিগুণ।
জানিনা এ কোন খুড়োর কল
তৃষ্ণার বুকে শ্রাবণ জল,
বিবশ হয়েছে কর্মফল।
মেঘের গায়ে পাষাণ ঘষি,
বৃষ্টির সাথে, বিচারে বসি,
শুনবো না আর গড়িমসি।
এই জীবনের হিসাব চুকাও,
শ্রাবণ আমায় ভাসিয়ে দাও,
অনেক হলো ধূপছাও ।
ভিন্ন শ্রাবণ
রীতা মোদক
কারো শ্রাবণে প্রেম আসে
সুখ সাগরে ভিজে মন
আমার শ্রাবণ চোখের জলে
ভেসে যায় কষ্ট জীবন
কারো শ্রাবণ আমেজ আনে
গরম খিচুড়ীর স্বাদে
আমার শ্রাবণ থরথর কাঁপে
বৃষ্টি পরে ভাঙা ছাদে
কারো শ্রাবণ দিন দুপুরে
জমে উঠে তাসের আসর
আমার শ্রাবণ লাঙল চষে
জলে কাদায় আসে জ্বর
কারো শ্রাবণ ছুটির দিনে
নরম বিছানায় আলস্য ঘুম
আমার শ্রাবণ ভুখা পেটে
অন্ধের কারখানায় কাজের ধুম
ঘনবরষায়
মজনু মিয়া
আকাশ মেঘে ডেকে আছে
ঘন কালো বরষায়,
ও গো তোরা যাসনে বাহির
বিজলি যে চমকায়!
ঘন ঘন দেয়া ডাকে
দমকা হাওয়া বয়,
চারিদিকে জল আর জল
আজ নিরাপদ নয়!
কোলের শিশু কোলেতে থাক
বুকের মানিক ধন,
এমন দিনে বাইরে গেলে
ঘরে রয় না মন।
শ্রাবণে কল্পবিজ্ঞানের গল্প
রোবটদের রাজত্ব
শাবলু শাহাবউদ্দিন
ঘুম ভেঙে মিটমিট করে তাকাতেই স্থির চিত্রের মত চোখের সামনে ক্যালেন্ডারের সাদা পাতাটি ভেসে উঠলো চিতল মাছের মত ঝিলিমিলি করে। আজ ২১শে জুন ২৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে। ছোট বাচ্চাদের মত বেশ কয়েক বার চোখের পাতা ডলে ক্যালেন্ডারের সাদা পাতাটির দিকে আবার আমি চোখ রাখলাম। ২১শে জুন ২৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে। "শুফম, শুফম", বলে ডাকতে শুরু করে দিলাম। ডাক শুনে মানুষ রূপি সাদৃশ্য একটি রোবট আমার চোখের সামনে হাজির হলো।
"শুফম শব্দের (নামের) কিছুই এখানে নেই। দয়া করে সঠিক শব্দটি ব্যবহার করুন।" মৃদুস্বরে স্বচ্ছ কণ্ঠে বললো রোবটটি।
"কে ভাই আপনি?," রোবটটিকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম ঘুম ভাঙা বিরক্ত কণ্ঠে।
"আমি অকিওটকি দাতব্য রোবট প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবী একটি রোবট। আপনার দাস; আপনার সেবায় নিয়োজিত। এইবার বলুন কী দরকার আপনার?," আনুগত্য শিশুদের মত করে উত্তর থেকে প্রত্যুত্তর দিলো রোবটটি।
"আমার পরিবারের সবাই কোথায় তাই আগে বলুন?," ভীতু এবং রাগমুখি বিড়ালের ছানার মত মুখ করে আবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
মানুষ মারা গেলে যেমন করে আমরা এক মিনিট নীরবতা পালন করে শোক প্রকাশ করি ঠিক তেমনি করে কিছু সময় রোবটটি চুপ থেকে আমাকে বললো, "কয়েক শতাব্দী ধরে আপনার কেউ নেই। অজ্ঞাত অবস্থায় আপনাকে পাওয়া যায়, বলে নথিপত্রে লিপিবদ্ধ আছে। মানুষের হাত থেকে কালক্রমে রোবটের হাতে আপনার দেখভালের দায়িত্ব পরেছে। আমাদের সংগঠন আপনাকে দেখভালের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। দয়া করে বলুন আপনা জন্য কী সেবা করতে পারি, মানব।"
রোবটের কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। আমার মানবীয় মন দানবীয় হয়ে উঠলো। সত্য কী আমি এখন রোবটদের দেশে? মনে মনে নানা চিন্তা করতে করতে জানালা দিকে এগিয়ে গেলাম। জানালা খোলার চেষ্টা করতেই রোবট আমাকে নিষেধ করলো। কারণ বাইরে আবহাওয়া আমার জন্য মানানসই নয়। এছাড়া বাইরে নানা সময় নানা রকমের দুর্ঘটনা ঘটছে। সুতরাং জানালা না খোলাই ভালো।
আমি রোবটকে জিজ্ঞাসা করলাম, "কেন জানালা খুলবো না ? কী ধরনের দুর্ঘটনা বাইরে চলছে ?"
"বাইরে ড্রোন দুর্ঘটনা, স্যাটেলাইট দুর্ঘটনা, ড্রোন মশার কামড় ইত্যাদি রকমের দুর্ঘটনা বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে আছে। এছাড়াও বাইরের বায়ু মানুষ বসবাসের একদম অযোগ্য। এছাড়াও নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।" বলে রোবটটি চুপ হয়ে গেলো। রোবটের চুপ থাকা দেখে আমার সন্দেহ হলো।
"মানে, এ কী বলছো ? একটু পরিষ্কার করে বলো; তোমার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না, রোবট।"
[আপনি থেকে তুমি সম্বন্ধন করে ফেললাম, রোবট তো রাগ করবে না ! মনে মনে ভাবতে লাগলাম। কিন্তু রোবট রাগ করলো না। প্রাণী ছাড়া কেউ চায় না আধিপত্যের রাজ্য। কেবল প্রাণী জগৎ জন্ম থেকে তাদের চিন্তা আধিপত্য তাদের লাগবেই, লাগবে। ]
"কয়েক শতাব্দী আগে ধর্ম নিয়ে মানুষের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। সেই ধর্ম যুদ্ধ প্রায় শতাব্দী বছর ধরে চলতে থাকে। আধুনিক অস্ত্র সহ রোবটিক কায়দায় যুদ্ধ চলে। প্রথম প্রথম আগ্নেয়াস্ত্র, পরে নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক অস্ত্র, তারপরে লেজার লাইট অস্ত্র, রোবট অস্ত্র, স্যাটেলাইট অস্ত্র; যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বিষাক্ত ড্রোন মশা আবিষ্কার করে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করা হয়। রোবট তৈরি করা হয় স্বয়ংক্রিয় উপায়ে। রোবট, ড্রোন, স্যাটেলাইট এত পরিমাণ আবিষ্কার এবং ব্যবহার করা হয় যে, আকাশের যে দিকে তাকানো যাবে শুধু ঐ সকাল যুদ্ধ সামগ্রী। ফলে মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে ঐ যুদ্ধের কারণে একদম বিলীনের দিকে চলে যায়। এখন সব কিছু চালাচ্ছে রোবট।" প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুখস্থ বিদ্যার মত করে এক নিঃশ্বাসে বলে চললো রোবটটি ।
"থাম। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না রোবট। আমি পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাই।"
"জনাব, আপনি চাইলেও তা পারবেন না। মানুষ চলাচলের মত কোন পরিবহণ ব্যবস্থা এখন পৃথিবীতে নেই।"
"তার মানে রাস্তা-ঘাট, গাড়ি, উড়োজাহাজ সব শেষ হয়ে গেছে!" আশ্চর্য কণ্ঠে আমি জিজ্ঞাসা করলাম রোবটকে।
"জী, মানব । ধর্মে যুদ্ধ শুরুর দিকে মানুষ চালিত সকল পরিবহণ নষ্ট করে দেওয়া হয় আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এত পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করা হয় যে, ভূমিও এই অবস্থা সহ্য করতে পারে না। ভূ-গর্ভ থেকে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করা হয়; ফলে ভূমি গঠন ব্যাপক পরিমানে পরিবর্তন ঘটে। ফলে পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে শৃঙ্খল (ভূ-গর্ত) স্বয়ংক্রিয় ভাবে সৃষ্টি হয়। ফলাফল হিসেবে পাহাড় ধস সহ্য ভূমি ধস হতে থাতে থাকে। শহরগুলো ভূ-গর্তে চলে যায়। রাস্তা ঘাট শৃঙ্খলে গ্রাস করে। দুনিয়া দাঁড়িতে মানুষ বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠে। মানুষ হয় গৃহবন্দি। সকল ক্ষমতা চলে আসে রোবটের হাতে।"
"রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রতিনিধিও কী এখন রোবট?" আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম অজানা কণ্ঠে ।
"রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থা কয়েক শতাব্দী আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন সব কিছু চলছে রোবটিক ব্যবস্থায়। কয়েক শতাব্দীর মধ্যে হয়তো মানুষ একদম বিলীন হয়ে যাবে।"
"মানুষ বিলীন হয়ে গেলে পৃথিবী চলবে কেমনে? উৎপান তো বন্ধ হয়ে যাবে। সব কিছু স্থির হয় যাবে না? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিলীন হয়ে যাবে না?" খুব ভীতু কণ্ঠে জানতে চাইলাম।
"বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং ধর্ম পৃথিবী ধ্বংসের মূল কারণ। এগুলো সৃষ্টি হয়েছে বলে আজ সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এগুলোও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে নিজ নিজ শক্তি ও বলে। যার শক্তি কিংবা সৃষ্টি আছে, তার ধ্বংস অবধারিত, জনাব।"
ফজরের আযানের ধ্বনি ঘুমন্ত কর্ণে ভেসে আসতে লাগলো পাল তোলা নৌকার মত করে। নামাজের জন্য ঘড়ির এলার্ম ভেসে আসতে লাগলো আমার অসচেতন ঘুমপাড়ানি কানের পর্দায়। শুফম গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে লাগলো, "নামাজ পড়বি না ? উঠ"। ঘুম ভেঙ্গে গেলো। স্বপ্ন ভেঙে গেলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের মাঝে রোবটদের রাজ্যে চলে গেছিলাম। ঘুম থেকে উঠে উযুর জন্য গোসলখানায় প্রবেশ করলাম। উযুর সময় ঠিক পেলাম ঠিক বুকের বাম পাশে একটু একটু চিনচিন করে ব্যথা করছে। কিসের ব্যথা এটা; নিজেকে নিজেই জিজ্ঞাসা করলাম। ঠিক তখনি আবার আমার মনে হলো স্বপ্নে দেখা রোবটের কথা। প্রবীণদের মুখে শুনেছি, শেষ রাতে স্বপ্ন নাকি সত্য হয়। ধর্মেও আছে শেষ জামানায় নাকি ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ হবে। তাহলে কী সত্য হতে যাচ্ছে কিছুখন আগে ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্নের কাহিনী। রোবটদের দেশ, রোবটদের রাজত্ব! আসলে সৃষ্টিকর্তা সব কিছু ভালো জানে; আগামী ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য কী হবে।
শ্রাবণে অন্য ধারার কবিতা
কালোবাজারি
মৌমিতা মোদক
কেড়েছে নিবাস - আম্ফান আয়লা ইয়াস।
কেড়েছে কোটি কোটি প্রাণ - করোনা আর ফান্গাস।
লড়াই এখন শুধু - বাঁচানোর আর বাঁচার -
অসহায় সরকার পুলিশ ডাক্তার।
ওষুধের হাহাকার - সক্রিয় চোরাকারবার।
স্বাস্থব্যবস্থা কন্কালসার - শ্মশানে কাতারে কাতারে পলিথিন একাকার।
এনে দেবে একটু অক্সিজেন? একটু !
প্রান ভরে বিশুদ্ধতা চাই - কোথায় পাই !
বলুন না !
বরফের দোচালা গলে জল - চোখে চোখে জল।
একদিকে গৃহযুদ্ধ মহামারী - একদিকে কালোবাজারি।
থামছে না তবু গাছ ব্যাপারী।
টাকা আছে - শিক্ষা আছে - আছে ক্ষমতা - তবে কিসের অক্ষমতা ?
প্রাণ চাই ঠিক আর কটা? বলুন না !
ভাঙন
রূপক রায়
আমার গল্পগুলি কবিতাকে খোঁজে,
আর নিঃশব্দ রাতে
লুকায় মুখ কান্নার বালিশে
আমার কবিতাগুলি গল্পকে খোঁজে
ভরা কটালের রাতে আর
ঘুমোতে পারি না...
শিউরে উঠে কত সুন্দরী গাছ
শিকড় গুলো কেউ ছিঁড়তে চায় না
প্রতিদিন ঢেউ গুলো আঁছড়ে পড়ে
পাড়ের ভাঙন কেউ আটকাতে পারে না
ভোরের স্বপ্নগুলো লুপ্তপ্রায়
জীবন যুদ্ধে কেউ হারতে চায় না
প্রতিদিন ধ্বস নামে পরিচিত রাস্তায়
সম্পর্কের অলি-গলি কংক্রিটে ঢেকে যায়
দুটি ফুলের ঘ্রাণ বাঁচতে শেখায়
শুকনো মাঠে বৃষ্টিতে আবারও ঘাস জন্মায়
ওই দেখো কচি পাতা হাওয়ায় দোলায়
জীবনের স্মৃতি আঁকড়ে এই বেঁচে থাকা
তাই হৃদয়ের ব্যথা কেউ ভুলতে পারে না।
শ্রাবণ
No comments:
Post a Comment