এলোমেলো বাতাস বইছে বাইরে।চৈত্রের টান ধরা তপ্ত দুপুর রোদ মেখে বসে আছে একটু দূরের কৃষ্ণচূড়ার দিকে চেয়ে।মনও বড় এলোমেলো আজ।মেজ মেয়ের বাড়িতে এসেছেন মনোরমা তার আসানসোলের বাড়ি থেকে।মনীশ নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে।এক ছেলে আর তিন মেয়ে তিনজনই কাছে, দূরে থেকে যে যেভাবে পারে আগলে রাখে মাকে। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি সকলে বলে 'তুমি রত্নগর্ভা।' অনেকটা ভালোলাগা ছুঁয়ে থাকে এই শব্দটির সঙ্গে।তবুও বুকের মধ্যে খচখচ করে কোথাও।বড় ছেলে মনীশ যখন দশ বছরের তখন তার স্বামী একদিনের জ্বরে হঠাৎ করেই চলে যান তাদের ছেড়ে। আধা সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানের চাকরি ছিল ওনার।তার মৃত্যুর পর এককালীন কিছু টাকা, সামান্য পেনশন আর মাথার ওপর শশুরবাড়ির ছাদ এটুকুই সম্বল তখন মনোরমার।চারটি ভাত কাপড়ের অভাব না হলেও ছোটছোট এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে অকুল পাথারে পড়েছিলেন তিনি।তারই বা তখন কী এমন বয়স। এক বসন্তে হঠাৎই হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবনের সমস্ত রং। বসন্ত কেড়ে নিয়েছিল আরও একজনকে। বসন্ত এলে তাই বুক দুরুদুরু করে এখনও। ঠাকুরকে ডাকেন মনেপ্রাণে।তার সন্তানেরা, বৌমা, জামাইরা, নাতি নাতনি সবাই ভালো থাকুক। কিছু বুঝে উঠবার আগেই স্বামীকে হারিয়েও সেসময় মনোবল হারাননি।কঠোর হাতে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। অবশ্য মনীশ তার হীরের টুকরো ছেলে। খুব অল্প বয়স থেকে সে যেমন রোজগারপাতি শুরু করেছিল, তেমনই ছোট ভাই বোনদের প্রতি তার ছিল সদাসতর্ক দৃষ্টি ও অফুরন্ত স্নেহ। প্রতিটি ধাপে খুব ভালো রেজাল্ট ও পড়াশোনার প্রতি অনুরাগী, পরিশ্রমী এই ছেলেটির তাই উচ্চপদস্থ চাকরি পেতে খুব বেশিদিন লাগেনি। একে একে তিন বোনকে সুপাত্রে, ভালো পরিবারে বিয়ে দিয়ে মনীশ যথার্থ বড় দাদার কর্তব্য পালন করেছে।
'মা, এবার ধীরেসুস্থে তৈরি হয়ে নাও। যেখানকার ঠিকানা দিয়েছে তোমার জামাই,বেশ অনেকটা সময় লাগবে যেতে....'
'কত জায়গাতেই তো গেলাম..তোরা, বড়খুকি, মনীশ নিয়ে গেছিস যখনই যেতে চেয়েছি..যখনই যেখান থেকে যেমন জানতে পেরেছি তোদের কাছে আর্জি রাখলে কখনো বাধা দিসনি কেউ..লাভ তো হলোনা কিছু..এই বৃদ্ধ বয়সে আবারও এলাম তাও..আশা যে মরেনা....' গলা বুজে এল মনোরমার।
দুপাশে পলাশের গেরুয়া আভাকে পাশে রেখে এগিয়ে চলেছিল গাড়িটি। রাজ্যের পশ্চিম দিকের এই জেলাটিকে প্রকৃতি বসন্তের অকৃপণ সাজে সাজিয়ে তোলে ঋতুর আসা যাওয়ার খেলায়। এড়িয়ে যেতে চাইলেও এ আবেশ মনকে টানবেই টানবে।
বাবার অফিসে বাবার শূন্য পদে যোগ দেওয়ার জন্য যখন ওনার চলে যাওয়ার অনেকগুলো বছর পর ডাক এসেছিল, মনীশ তখন তার যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির বিভিন্ন পরীক্ষায় ব্যস্ত।সে জানতো তার জন্য এর চাইতে অনেক ভালো সুযোগ অপেক্ষা করছে।তার ছোট ভাইও সেসময় প্রাপ্তবয়স্ক। তাকে ওই পদে নিয়োগ করলে তার মন বাঁধা পড়বে হয়তো।একটা গতি হয়ে যাবে আর পরিবারেরও সুরাহা হবে।
মনীশের ছোটভাই.. হ্যাঁ, মনোরমার বাউন্ডুলে ছোট ছেলে।যার পড়ায় কোনো মন ছিল না কোনদিনই।একটু বড় হতেই হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যেত কোথায়। আবার হঠাৎ এসে হাজির হয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করতো এটা সেটা খাওয়ার।মা রান্না করে দিলে সেগুলো কোথায় কোথায় গিয়ে বিলি করে আসতো। নিজের পরার দুচারটে জামাকাপড় থেকেও দিয়ে দিত একে ওকে। দুপুরবেলা খাওয়ার সময় ভিখিরি এলে নিজের খাওয়ার থালা ধরে দিয়ে দিত। অনেকদিনের জন্যও নিখোঁজ হতো মাঝেসাঝে। প্রশ্ন করলে একটা উত্তরও পাওয়া যেতনা।কতলোক কত কথা বলতো।খারাপ সঙ্গে পড়েছে, নেশার চক্রে জড়িয়েছে এমন আরও কত কথা কানে আসতো থেকে থেকে। খুব জোরজার করে তাকে ওই চাকরিতে নিযুক্ত করালেও সকলের তিন তিনবারের চেষ্টাকে বিফল করে সে একদিন অফিস থেকেই চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বার চাকরি ছেড়ে চলে গেলেও কিছুদিন পর হয়তো বা মায়ের টানেই ফিরে এসেছে বাড়িতে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়েও তৃতীয়বার আর তাকে আটকে রাখা যায়নি।বসন্তের ঝোড়ো একটা রাত পুরোটা জেগে কেটেছিল মনোরমার তার অপেক্ষায়।বেশ কয়েকবার কেউ কেউ হঠাৎ বাড়িতে এসে বা অন্য সূত্রে খবর দিয়েছে তার। তাকে দেখতে পেয়েছে নাকি সে বা তার পরিচিত কেউ।মনোরমা কেঁদে আকুল হয়েছেন। মনীশ সাধ্যমতো সব জায়গায় ছুটেছে ভাইয়ের খোঁজে। যেখানে সম্ভব মাকেও সঙ্গে নিয়েছে।মেয়ে জামাইরাও এগিয়ে এসেছে,বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। কিন্তু এতগুলো বছরে কোথাও গিয়েই পাওয়া যায়নি তাকে।তার নাম করলে কেউ চিনতেও পারেনি..ছবি দেখালেও কোনো কাজ হয়নি।
উপাসনার বড় হলঘরটির ঠিক মাঝখানে শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তি।যার দিকে তাকালে সহজ সরল এক যাপন আর ভক্তি ও বিশ্বাসের ছবি চোখে ভাসে। অপরূপ ফুলের সাজে সাজানো মূর্তির বেদি থেকে শুরু করে তার আশপাশ ও পিছনের দিকটি। মায়া জড়ানো মুখে ঠাকুর চেয়ে আছেন ঘরটিতে সারে সারে বসা ভক্তদের দিকে। একপাশে আশ্রমবাসী ছেলের দল সান্ধ্যসঙ্গীতে অঞ্জলি দিচ্ছে ঠাকুরকে।সেই গানে তাদের সঙ্গে একক সুরে আছেন গেরুয়া বসন পরা একজন স্বামীজি।ভরাট গলায়, নিখুঁত সুরে ও স্পষ্ট উচ্চারণে তিনি গেয়ে চলেছেন।তাঁর মুখ সামনে ঠাকুরের দিকে ফেরানো। কপালে হাত ঠেকালেন মনোরমা ঠাকুরের দিকে চেয়ে। বসলেন সবাই। গান শেষ হলে স্বামীজি ঘুরে বসলেন ভক্তদের দিকে। শ্রীরামকৃষ্ণকে স্মরণ করে তাঁর জীবন ও বাণীর কিছু অংশ তুলে ধরলেন তাঁর সাবলীল বক্তব্যে।
মনোরমার মেজ জামাইকে একজন খবর দিয়েছিল শহরের এই অঞ্চলটিতে পলাশকে দেখা গেছে কোথাও। পলাশ অর্থাৎ মনোরমার ছোট ছেলে।ওনারা এখানে পৌঁছোনোর আগেই জামাই নিজে এসে অনেক খোঁজখবর করেছে সম্পূর্ণ এলাকাটিতে।কিন্তু কোনো হদিস মেলেনি তার। মনোরমার কানে কথা পৌঁছোতে তিনি আকুল হয়ে ছুটে আসেন মনীশকে সঙ্গে করে।গাড়ি থেকে নেমে নেমে ওরা সবাই মিলে খবর নিচ্ছিল পথের অনেকের থেকেই।নিরাশ হয়ে ফিরবার পথে একবার শুধু প্রণাম করতে এই আশ্রমে আসা।
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন মনোরমা স্বামীজির দিকে। বুক টনটন করে উঠছিল অসম্ভব এক কষ্ট মিশ্রিত আনন্দে। সেই অনুভূতি জল হয়ে নেমে আসছিল চোখ থেকে গাল বেয়ে।কত? ঠিক কতগুলো বছর পার করে দেখলেন আবার? হিসেব মেলাতে লাগলেন মনে মনে। তোলপাড় করে উঠলো বুকের ভেতরটা।স্বামীজিও সামনের দিকে চোখ মেলে অন্যমনস্ক রইলেন কিছুটা সময়।গাল বেয়ে নেমে এল জলের ধারা। ওনার দিকে তাকিয়ে উপস্থিত ভক্তদের মৃদু গুঞ্জন উঠেই আবার নীরব হলো তৎক্ষণাৎ।ধরা গলায় বক্তব্যের শেষটুকু বলে নমস্কার জানালেন স্বামীজি।টলোমলো পায়ে এগিয়ে গেলেন অন্দরের দিকে।
মনোরমা নিজেকে সামলাতে না পেরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবার।সবটা বুঝতে পেরে ঝাপসা চোখে মনীশও জড়িয়ে ধরলো মাকে।
আশ্রমের চাতালে বসে ছিলেন ওরা সবাই। অপেক্ষা করছিলেন। একজনকে দিয়ে বলে পাঠানো হয়েছে..সে যদি একবার আসে,যদি সামনাসামনি একবার দেখা হয় কাছ থেকে..দুটো কথা হয়। বসে থাকতে থাকতেই এখানকার অনেকের মুখে অকুন্ঠ প্রশংসা শুনলেন ওই স্বামীজির। ওনার বড় মন,ওনার জ্ঞান, ওনার কর্মযজ্ঞ নিয়ে বলছিলেন কিছু প্রবীণ মানুষ। আশ্রমের অন্য আর একজন স্বামীজিকে দেখে তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে মণীশ উপাসনার জায়গায় দেখা সেই স্বামীজির বিষয়ে জানতে চাইলো পরিচয় গোপন রেখে। ওনার জীবনের পূর্বকথা এখানে কেউ জানেনা আর জানলেও বলা বারণ এমনই বললেন সেই স্বামীজি ,মুখে স্মিত হাসি রেখে।
'পড়াশোনায় নিবিড় মনোযোগ ওনার। প্রচুর পড়াশোনা করেন সারাদিন।সর্ব বিষয়ে ওনার জ্ঞান ও সমস্ত কাজে পারদর্শিতা মুগ্ধ করে আমাদের। বেশ অনেকগুলো বছর উনি আমাদের এখানকার প্রধান স্বামীজি হয়ে আছেন। তবে খুব শীঘ্রই উনি চলে যাবেন অন্য কোথাও, অন্য আশ্রমে। ওনাকে হারিয়ে আমরা সবাই অনাথ হয়ে পড়বো....' বিষন্নতার ছায়া নামে তাঁর মুখ জুড়ে।
আবেগ মিশ্রিত গলায় উনি বলে চলেছিলেন, ' সংসারের সমস্ত মায়া ত্যাগ করে এই ধর্মের পথে পা বাড়াতে হয়। একনিষ্ঠ থাকতে হয়।একচুল এদিক ওদিক হলেই, মায়ায় জড়ালেই এই নিষ্ঠার পথে, মানব সেবার পথে বাঁধা আসবে ....'
মনীশের পাশে দাঁড়িয়ে মনোরমা ও তার মেয়েও কথাগুলো শুনছিলেন কানপেতে। অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল ছলোছলো চোখে সেই ছেলেটি, যাকে সবকিছু বলে খবর দেওয়া হয়েছিল স্বামীজিকে একবার দেখবার বাসনায়।সে এগিয়ে এসে বলল 'স্বামীজী ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। ওনার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।'
কথাগুলো বলতে বলতে সেই ছেলেটির চোখে ভাসছিল স্বামীজির সেই হৃদয় বিদারক কান্না।টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছিলেন স্বামীজি। সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল ওনার। ওকে দেখে হাত নেড়ে নেতিবাচক ভঙ্গি করে আবার ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়।
ফিরে চলেছিল ওরা সবাই। অনেকগুলো বছরের ভুল বোঝাবুঝি, অভিমান, অভিযোগ অনুযোগ, হয়তো বা কিছুটা রাগও গলে গলে জল হয়ে যাচ্ছিল সকলেরই।পেয়েও হারানোর দুঃখ ছাপিয়ে মনের কোণে জমা হচ্ছিল অনেকটা শান্তি, স্বস্তি, ভালোলাগা আর গর্বও কিছুটা। মনীশ বলে চলেছিল,
'আমার ভাইটা কত বড় হয়ে গেল মা, কত পরিণত। পড়াশোনা ওর ধ্যানজ্ঞান হবে ভেবেছি কখনো? ধীরস্থির, নম্র, বিনীত। আমার খুব গর্ব হচ্ছিল মা, যখন ও বক্তব্য রাখছিল এত লোকের মাঝে।এত সুন্দর গান ভাই কেমন করে শিখলো বলো তো? সাধনার কোন মার্গে গেলে মানুষের এতটা পরিবর্তন হতে পারে ভেবে দেখো। আমি হীরের টুকরো নই মা, তুমি সবসময় যেমন বলো। তোমার আসল হীরে তোমার ছোট ছেলে..যে তার ভক্তি আর জ্ঞানের আলোয় ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের মন্ত্রে সকলের মনে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধুমাত্র সংসারের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে দশের কাজে....'
মন ভরে উঠছিল মনোরমার। চোখে জল নিয়েও হাসিমুখে বললেন,' পলাশের বরাবরই সুন্দর একটা মন ছিল রে।সেটার অধিকারী হতে পারলে জীবনে সব কঠিন কাজই সহজ হয়ে যায়।'
কান্না জড়িত গলায় মেয়ে বলে উঠলো 'আমরা তো সবাই কমবেশি স্বার্থের দাস, নিজেদের গোচরে বা অগোচরে অন্যের জন্য কিছু করবার মধ্যেও আমাদের নিজেকে বড় দেখানোর প্রবণতা লুকিয়ে থাকে। ছোড়দার মতো নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিতে ক'জন পারে বলো....'
'একদমই তাই। সংসারে থেকে সংসারধর্ম ও সকলের জন্য কর্তব্য করবার মধ্যেও আত্ম অহংকার কাজ করে নিজেরও ভেতর মনের কোথাও গোপনে। আরও..আরও সুনাম, আরও প্রশংসা দাবি করে মন। সেগুলো পাওয়ার আশাতেই দায়িত্ব কখন অভ্যেস হয়ে পড়ে। কিন্তু ভাই যে পথে গেছে সেখানে কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। শুধু অকৃপণ দেওয়া আছে....মুখে পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে কথাগুলো বলছিল মনীশ।
কথাগুলো গোধূলির গেরুয়া আলোয় মিলেমিশে দুধারের পলাশবনের গেরুয়ায় মিশে যাচ্ছিল। পলাশ ফুলের ঝাঁকে দ্যুতি ছড়াচ্ছিল পড়ন্ত বিকেলের সেই উজ্জ্বলতা।
সেই আলোয় আলো হচ্ছিল এক মায়ের মুখ।মন বলছিল,আজ আর 'রত্নগর্ভা' শব্দটি শুনতে দ্বিধা নেই কোনো। জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে বারে বারে ঋণী থাকছিলেন তিনি হঠাৎ পাওয়া এক আনন্দ বসন্তের কাছে।
টিনা ভট্টাচার্য
ভোররাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় প্রমিলার। একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে। টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে জল খেয়ে নিল ও। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মাত্র দু'দিন হয়েছে প্রমিলা, ঋক আর ওর শ্বশুর শাশুড়ি এবং দিদিশাশুড়ির সাথে গ্রামের এই জমিদার বাড়িতে এসেছে। প্রমিলার শ্বশুরের ঠাকুরদা ছিলেন এই নবাবগঞ্জের শেষ জমিদার। পুরনো আমলের জমিদার বাড়িতে ওরা এসেছে গ্রামের লোকেদের ওদের বিয়ের ভোজ খাওয়াতে। ঋকদের বংশের এটা রীতি। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে তার কিছুদিন পর গ্রামেও ছোটো করে একটা অনুষ্ঠান করে গ্রামের লোকেদের খাওয়ানো হয়। ঋক আর প্রমিলা বিয়ের পর হানিমুন থেকে ফিরল, আর তারপরই সারা পৃথিবী জুড়ে মারণরোগের প্রকোপ। তাই সেসব কাটিয়ে উঠতে প্রায় একবছর হয়ে গেছে। আর ঋক আর প্রমিলার বিবাহবার্ষিকীতেই এখানে বড় করে অনুষ্ঠান করে গ্রামের লোকেদের ভোজ খাওয়ানো হবে। তবে প্রমিলার যিনি দিদিশাশুড়ি আছেন, মানে ঋকের ঠাকুমা তিনি এখানে আসতে বারংবার বাধা দিচ্ছিলেন। কারণটা ঠিক খোলসা না হলেও প্রমিলা শুনেছে ওর শ্বশুরমশাইকে বলতে, " আহ মা, এখনকার দিনে ওসব পুরনো গল্প মনে রাখলে চলবে? আর তাছাড়া এই সুবাদে অনেকদিন পর সপরিবারে গ্রামেও ঘুরে আসা হবে আর সব আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাটানো যাবে। "
প্রমিলা ঋক কে এব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ঋক বলে সে কিছু জানেনা। চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিদিশাশুড়ি আসেন প্রমিলাদের সাথে।
গ্রামের জমিদার বাড়ির ঘরগুলোর উচ্চতা বেশ অনেকটা, প্রায় বারো একর জায়গা জুড়ে এই জমিদার বাড়িটি নির্মিত। বাড়িটিতে আটটা ভবন এবং দুটো বড় পুকুর আছে। একটা পুকুরে পানা আর আগাছা ভরে গেছে। আরেকটা পুকুরে জল আছে, সেটা এখানকার গ্রামবাসীদের বর্গা দেওয়া আছে । তারা মাছ চাষ করে। ঋকের পিসিমারা ত্রিপুরাতে থাকেন, তারাও এসেছেন এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ঋকের কাকা কাকিমা,তাদের ছেলে- ছেলের বৌ, মেয়ে জামাই সকলেই এসেছে। প্রমিলা কে সকলেই খুব ভালোবাসে। তাছাড়া আরও আদর যত্ন বেড়ে গেছে কারণ প্রমিলা তিন মাসের গর্ভবতী। সদ্যই এই সুখবর জানতে পেরেছে সকলে।
কিন্তু এখানে আসার পর থেকে প্রমিলা লক্ষ করেছে ঋকের ঠাম্মি কেমন যেন থম মেরে আছেন। সর্বদা একটা ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। সন্ধ্যেবেলায় প্রমিলাকে পুকুর পাড়ে যেতে বারণ করেন, একা এদিক সেদিক যেতে না করেন কিংবা মাথার চুলে একটা লোহার পেরেক রাখতে বলেন। যদিও প্রমিলা এর কিছুই মানে না। আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এসব অন্ধবিশ্বাস ছাড়া ওর কাছে আর কিছু নয়। কিন্তু ও এমন ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখছে কেন যখনই ঘুমাতে যাচ্ছে?! প্রেগন্যান্সির সময় অবশ্য মেয়েদের অনেক হরমোনাল চেঞ্জ হয়; তার ফলেই কি এসব হচ্ছে নাকি ও কোনো স্ট্রেস নিচ্ছে বলে হচ্ছে? উত্তর খুঁজে পায় না প্রমিলা।
আজ ওদের বিবাহবার্ষিকী। ঋক ওকে একটা সুন্দর পেনডেন্ট দিয়েছে। সকাল থেকেই বেশ কোলাহল জমে উঠেছে। সব আত্মীয়রা গতকালই এসে গিয়েছে। সবাই রাতে আড্ডা দিচ্ছিল। কিন্তু প্রমিলা শুয়ে পড়েছিল; শরীরে দিচ্ছিল না। সবসময়ই বলতে গেলে ওর কেমন একটা মাথা ঘোরা গা বমি ভাব কাজ করে এখন। আর ঘুমটা যখনই গাঢ় হয় তখনই ও সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে ওঠে। একটি মহিলা দু হাত বাড়িয়ে বলছে, " তোর পেটের টাকে আমায় দিয়ে দে। বাঁচতে দেব না তোদের। এ বাড়িতে আর কোনো বাচ্চা জন্মাতে পারবে না। তার আগেই আমি শেষ করে দেব। " বলেই তিনি যেন এগিয়ে আসেন প্রমিলার দিকে। আর পেটের দিকে হাত বাড়াতে যান;- ঠিক সেই মুহুর্তে প্রমিলা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। বুঝে পায় না এর কারণ কি। ঋক জাপটে ধরে প্রমিলাকে শান্ত করে। বোঝায় যে প্রেগন্যান্সি নিয়ে ও হয়ত একটু বেশিই চিন্তা করছে, তাই এমন দুঃস্বপ্ন দেখছে। কিন্তু প্রমিলা বলে, " না ঋক। আমি কলকাতায় থাকাকালীন ও তো প্রেগন্যান্ট ছিলাম কিন্তু এরকম ভয়াবহতা তো কখনো গ্রাস করেনি?! "
ঋক এর উত্তর খুঁজে পায় না। অগত্যা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়।
সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে প্রমিলা স্নান সেরে নেয়। ইতিমধ্যেই এখানকার লোকজন বউ দেখতে চলে এসছে। ঠাম্মি সবসময় প্রমিলাকে চোখে চোখে রাখছে। সেজে গুজে তৈরি হয়ে নিল প্রমিলা আর ঋক। কাকিমা- কাকু,পিসি পিসেমশাই সকলেই উপহার দিয়ে আশীর্বাদ করলেন প্রমিলাকে। কিন্তু ঠাম্মি আশীর্বাদ করে বললেন "কু'নজর থেকে আমার বংশধর কে রক্ষে কোরো ঠাকুর।" এই বলে প্রমিলার হাতে একখানা তাবিজ বেঁধে দিলেন। সমস্ত কিছু মিটতে রাত হয়ে গেল। সবাই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। প্রমিলাও ঋকের সাথে শুতে গেল কিন্তু ঘুমাতে পারল না। সেই দুঃস্বপ্ন ওকে নিশ্চিন্তে চোখ বুঝতে দিল না। শরীরের ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তা এই দুই মিলে প্রমিলাকে যেন বিধ্বস্ত করে ফেলছে। মাত্র তিনদিনেই চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। সমস্ত গয়না খুলে শোবার সময় ঠাম্মির দেওয়া সেই তাবিজটাও খুলে যায় প্রমিলার অলক্ষ্যে। ফোনের গ্যালারিতে আজকে সবার সাথে তোলা সেলফিগুলো দেখতে দেখতে তন্দ্রা এসে যায় প্রমিলার। আবারও সম্মুখীন হয় সেই ভয়ংকর সময়ের। এবার দেখে সেই মহিলা এগিয়ে আসছে ওর দিকে, আর বলছে, "বলেছিলাম না তোকে বাঁচতে দেব না। এখন তুই আর তোর পেটের ছাওয়াল দুটোই আমার খাদ্য" বলে এক পৈশাচিক হাসি দেয় সে।
প্রমিলার গোঙানির আওয়াজে ঋক উঠে বসে। প্রমিলাকে ডাকতে গিয়ে দেখে ওর মুখ দিয়ে ফেনা উঠে এসেছে; গায়ে ধুম জ্বর। ঋক তাড়াতাড়ি ওর বাবা কে ডাকে। একে একে সকলেই আসতে শুরু করে। সদর থেকে ডাক্তার আনতে যায় এই জমিদারবাড়ির সত্তর বছরের ম্যানেজার বাবু রমেন কাকা। ডাক্তার এসে সব কিছু দেখে জ্বরের ওষুধ দিয়ে চলে যান। কালকের মধ্যে যদি জ্বর না কমে তাহলে সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
প্রমিলা জ্বরের ঘোরে বলতে থাকে, " ও নিয়ে যাবে বলেছে আমার পেটের টাকে খেয়ে ফেলবে বলেছে.. মেরে ফেলবে সবাইকে.."
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। কেবল ঠাম্মি বলে উঠল, "বলেছিলাম বার বার, গর্ভবতী বউটাকে নিয়ে এখানে আসার দরকার নেই। শোনেনি আমার কথা কেউ। ওই অভিশাপের ফল এসব , বংশের অভিশাপ যাবে কোথায়? কোথায় যাবে ওই নারীর হৃদয় বিদারক যন্ত্রণার হাহাকার?!!"
"ঠাম্মি কিসের অভিশাপ?" ঋক বলে ওঠে।
" মা তুমি শুধু শুধু সেই পুরনো গল্প শুরু করলে। কিছু না ঋক। তুই বউমাকে নিয়ে বিশ্রাম কর। " এই বলে ঋকের বাবা ঠাম্মি কে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সাথে পিসি,পিসেমশাই, কাকা কাকি সবাই একে একে যে যার ঘরে চলে গেলেন।
পরের দিন ভোর ভোর পিসিমারা রওনা দিলেন ত্রিপুরার উদ্দ্যেশ্যে। কাকা কাকিরাও বিকেলে রওনা দিলেন। পুকুরের বর্গার টাকা কাকা এবং ঋকের বাবা সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন।
বিকেলের দিকে প্রমিলা একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল। বারো একর জমির ওপর এই বিশাল জমিদার বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। প্রতিটা ভবনেরই সুন্দর সুন্দর নাম আছে। কিন্তু পুকুরপাড় ধরে সোজা এগিয়ে বাঁ হাতে যেই দোতলা ভবন সেটার কোনো নাম নেই। তবে এই ভবনটি বেশ জরাজীর্ণ। এখানে কেউ মনে হয় থাকে না আর তাই হয়ত পরিচর্যার অভাবে এইরকম ভাঙাচোরা অবস্থা। এগিয়ে যায় প্রমিলা বাড়িটির দিকে। নানারকম আগাছা জন্মেছে, মাটি ফুঁড়ে আবার বেশ কিছু লতাও গজিয়েছে। বাড়ির দেওয়াল গুলোয় শ্যাওলার আস্তরণ। প্রথম ঘরের দরজাটা বন্ধ। কিন্তু দ্বিতীয় ঘরের দরজায় দুটো বড় বড় তালা ঝুলছে। কেবলমাত্র এই দ্বিতীয় ঘরটা ছাড়া বাকি যে দুটো ঘর এই একতলায় রয়েছে সবের দরজাই এমনি বন্ধ। কিন্তু.....
তালা দুটোয় হাত দিতেই যেন ক্যাঁ অ্যাঁ চ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। প্রমিলা যেন কোন সম্মোহনী শক্তির দ্বারা চালিত হয়ে এগিয়ে চলেছে। ঘরের ডানদিকে একটা পুরনো আমলের খাট। আর সোজাসুজি দেওয়ালে একটা সাদা কালো পোর্ট্রেট। ধুলোর আস্তরণে ছবিটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। প্রমিলা হাত দিয়ে ধুলোটা মুছতেই চমকে দু'পা সরে গেল। এই ভদ্রমহিলাকেই তো ও রোজ স্বপ্নে দেখে। ইনিই তো ওর বাচ্চাকে আর ওকে মেরে ফেলার কথা বলেন বারংবার।
প্রমিলার কানের কাছে যেন সেই মহিলার কন্ঠস্বর বেজে ওঠে আবার, " আয় আমার কাছে চলে আয়.....বাঁচতে পারবিনা তুই.. তোর পেটেরটাও থাকবেনা.... শেষ হয়ে যাবি, এই বাড়িতে আর কোনো সন্তান প্রসব হবে না.... হা হা হা...."
"না..... না....." প্রমিলা পিছিয়ে আসতে থাকে।
" নতুন বৌমা??? " ম্যানেজার রমেনকাকার প্রশ্নে হুঁশ ফেরে প্রমিলার।
" কার সাথে কথা বলছ বৌমা? আর এই ভর সন্ধ্যেতে তুমি এইখানে কি করছ"
" না, আ.. আ.... আমি মানে এই ঘরে...." ঘরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে গিয়ে প্রমিলা আবার ধাক্কা খায়। ঘরের দরজা যেমন তালা দিয়ে বন্ধ ছিল তেমনই আছে। তাহলে ও এই কয়েক মিনিটে এখানে যে ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল সেটা কি আদৌ বাস্তব নাকি অলীক জগতে পৌঁছে ছিল ও?!!
ভাবতে পারে না প্রমিলা। মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
জ্ঞান ফিরলে প্রমিলা দেখে ও শুয়ে আছে, ঋক ওর মাথার কাছে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শ্বশুর শাশুড়ি ঠাম্মি এবং রমেন কাকা সবাই যেন এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।
সবার মধ্যে থেকে রমেন কাকা প্রমিলার শ্বশুর মশাইয়ের উদ্দ্যেশ্যে বলল, " মেজ কর্তা যদি কিছু মনে না করেন তবে বলি কি নতুন বৌমার এ অবস্থায় এখানে থাকা ঠিক নয়। বৌমা আর দাদাবাবুকে বরং কলকাতায় পাঠিয়ে দিন। আজ সন্ধ্যে তে আমি মালির বাড়ি যাওয়ার সময় নতুন বৌমাকে ভাঙা দালানে দেখতে পাই। এগিয়ে গিয়ে দেখি নতুন বৌমা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই বৌমা মাথা ঘুরে পড়ে গেল আর আমি আপনাদের ডাক দিই। "
" আমি বার বার বলেছিলাম...." ঠাম্মি বলে উঠল কান্না ভেজা গলায়।
" আমাকে খুলে বলো ঠাম্মি। কি ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই বাড়ির সাথে? প্রমিলার সাথে কেন এমন হচ্ছে ? আজ আমাকে জানতেই হবে।" ঋক বলে ওঠে উত্তেজিত হয়ে।
ঠাম্মি আঁচলে চোখ মুছে বলতে শুরু করে, " আঠারো ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার বাজারের জন্য কেবল আফ্রিকাই নয়, বরং আরব, চীন, মালয়,আরাকান ও আসাম হতেও ক্রীতদাস আমদানি করা হত। অভাব, নদীভাঙন, দুর্ভিক্ষ, পরিবারের উপার্জনকারী সদস্যের মৃত্যু- প্রভৃতি দুর্যোগ কবলিত ব্যক্তিরা বেঁচে থাকার তাগিদে স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করত। উনিশ শতকের প্রথম দিকে শিশু ও বৃদ্ধদের বাজার দর ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকা। স্বাস্থ্যবান তরুণ দাসদের মূল্য হত কুড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকা। অভাব ও দুর্ভিক্ষ হলে বাজার দাসে ছেয়ে যেত। পুরুষ দাসদের নিয়োগ করা হতো কৃষি এবং চাষাবাদের যাবতীয় কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজে। লাঙল দিয়ে জমি চাষ, ক্ষেত নিড়ানো, আগাছা পরিষ্কার করা, জমি ঠিক করা, মাছ ধরা, কাঠ কাটা, গবাদিপশুর জন্য ঘাসবিচালি কাটা, পশু লালনপালন করা, ফসল মাড়াই করে গোলা ভর্তি করা ছিল তাদের কাজ। এছাড়াও এঁটো থালাবাসন মাজা, নদী থেকে খাবার জল আনা, মনিবের জন্য হুক্কা এবং পান সাজানো তাদের অন্যতম কাজ। ভাণ্ডারী বা গোলামের মালিক আশেপাশের ছয় সাতটা দাসীবাঁদীদের সাথে তাদের বিয়ে দিতো যাতে তাদেরকে রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বিয়ে হলেও দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতো মালিকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। বিয়ের খরচাপাতি দাসের মালিকই বহন করত কিন্তু এই সাজানো বিয়েতে নারীদের কোন লাভ ছিল না বরং নারীদের যথাসম্বল জমানো টাকা খরচ করে বিয়ের ব্যয় নির্বাহ করা হতো এবং কিছু অর্থের মালিক হয়ে যেত দাস পুরুষটি।একসময়ের স্বাধীন জীবিকার অধিকারী মানুষগুলো প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলায় এক নিমিষে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে অনিশ্চয়তার কাছে নিজেদের সঁপে দিয়ে পাড়ি জমালো শহরে। এদের স্থান হলো রেললাইনের বস্তিতে। আর এই ছিন্নমূল মানুষের নতুন নাম হলো চাকর। তখনকার দিনে হিন্দু পুরুষ চাকরের নাম ছিল ভাণ্ডারী বা ক্রীতদাস আর মুসলমান পুরুষ চাকরের পরিচয় গোলাম বা নফর। নারীদের ক্ষেত্রে হিন্দু এবং মুসলিম ভেদে দাসী ও বান্দি নামে ডাকা হতো।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় এমন অনেক পরিবারই ছিল যাদের স্বামীরা খাদ্যের সন্ধানে শহরে গিয়েছিল অথবা যাদের স্বামীরা অভাবের তাড়নায়
স্ত্রী -সন্তানকে বেচে দিয়েছিল জোতদার - জমিদার কিংবা মহাজনদের হাতে। ঠিক সেইরকম ভাবেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল এক রমনী কুখ্যাত এক জমিদারের কাছে। আর তার প্রতি হওয়া অত্যাচারের অভিশাপ বর্ষিত হয় সেই বংশের উপর। সেই বংশ হল এই রায়চৌধুরী বংশ। আর সেই রমনী ছিলেন হাসিনা। ঋক তোর বাবার ঠাকুরদার যিনি তৃতীয় পূর্বপুরুষ ছিলেন তিনি ছিলেন সেই সময়ের জমিদার। হাসিনা দাসী হয়ে আসে ঠিকই কিন্তু থাকতে হয় ওই জমিদারের রক্ষিতা হয়ে। প্রতি রাতে নিজেকে জমিদারের কাছে অর্পণ করতে করতে একসময় ও গর্ভবতী হয় ; কিন্তু জমিদারের কড়া আপত্তি তাই বাধ্য হয়ে গর্ভপাত করতে হয় হাসিনাকে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবারও গর্ভবতী হয় হাসিনা। কিন্তু এবার আর জমিদার প্রতাপচন্দ্র রায়চৌধুরীর কথায় গর্ভপাত করতে রাজি হয় না হাসিনা। ফলত, জমিদার মশাইয়ের ক্রোধের স্বীকার হয় হাসিনা। জমিদারের বারংবার হুমকি তে যখন কাজ হয়নি, তখন তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খাবারে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যায় হাসিনা। শেষ অবস্থায় নিজের রক্ত দিয়ে দেওয়ালে লিখে গিয়েছিল সেই অভিশাপ বাণী, "আমি যেমন সন্তান সুখ চেয়ে আজ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি, ঠিক তেমনি ভাবেই এই বংশের কেউ কখনো সন্তান সুখ পাবে না। আমি এই ভাঙা দালানেই থাকব। কাউকে শান্তি দেব না। কোনো বাচ্চা আর জন্মাবে না এই জমিদার বংশে। "
সবাই যেন সেই শতকে পৌঁছে গেছে। ঋক প্রশ্ন করল, তাহলে " ঠাম্মি এই যে আমিও তো এই বংশের বংশধর। বাবাও তো তাই আর দাদুভাই ও তাই....."
ঠাম্মি আবার বলতে শুরু করলেন, " হ্যাঁ তোরাও এই বংশেরই বংশধর। তোদের পূর্বপুরুষ রাও তাই। এখন প্রশ্ন হল তোরা কিভাবে বেঁচে থাকতে পারলি এবং তোদের পূর্বপুরুষরা বেঁচে ছিলেন কি করে এই অভিশাপের মধ্যেও, তাহলে বলি শোন।
প্রতাপচন্দ্র রায়চৌধুরীর স্ত্রী দুইবারই মরা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। তারপর এক তান্ত্রিক কে ডেকে যজ্ঞ করালে তিনি বলেন, গর্ভবতী হওয়ার শুরু থেকে সন্তান জন্মানোর পর সন্তানের পাঁচবছর বয়স পর্যন্ত এবাড়িতে থাকা যাবে না। তাই জমিদারের স্ত্রী তৃতীয় বার যখন গর্ভবতী হন তখন তিনি তার বাপের বাড়ির গ্রামে চলে যান। কন্যা সন্তান পাঁচবছর হলে তিনি ফিরে আসেন। এভাবেই তিনি আরও দুই পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সেই তান্ত্রিকের বিধান মেনেই এই বংশ এগিয়েছে কিন্তু ওই শাপ কেউ খন্ডাতে পারেনি। এই জমিদার বাড়িতে কোনো সন্তান জন্মায়নি। সব বংশধর তাদের মাতুলালয়ে জন্মেছে। জন্মের পাঁচবছর পর এই ভবনে ফিরে এসেছে। ভাঙাদালানে কারোর যাওয়ার সাহস হয় না। ওটা তাই পরিত্যক্ত। " ঠাম্মি থামলেন।
"আমি লাগেজ গোছাচ্ছি প্রমিলা। কালই বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। আজ রাতটা কষ্ট করে থাকো।" ঋক বলে ওঠে।
সেই রাতে সবাই প্রমিলাকে পাহারা দেয়। ঘুমের মধ্যে দু'বার কেঁপে উঠেছিল কিন্তু এর বেশি কিছু আর হয়নি। পরের দিন কাকভোরে ঋকরা সপরিবারে কলকাতার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। ফেরার সময় গাড়ির কাচ নামিয়ে দিয়ে জমিদার বাড়িটাকে দু'চোখ ভরে দেখে প্রমিলা। এত সুন্দর এত ঐতিহ্য থাকতেও সমগ্র বাড়ির ভবনগুলো থেকে যেন ভেসে আসছে এক নারীর হৃদয় নিংড়ানো যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি। এক গর্ভবতী মায়ের সন্তানকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকুতি।
সময়
মনোমিতা চক্রবর্তী
রোজকার মতো খাবার খেয়ে টিফিন বক্সটা ব্যাগে ভরিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে অতনু। বাড়ি থেকে অফিসটা বেশ দূরেই তার। ঘুম থেকে উঠতে আজ একটু দেরি হয়ে গেছে তার, তাই বেরোতেও আধ ঘন্টা মত লেট সে আজ ।
তাই একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে গ্যারেজ থেকে মোটরসাইকেলটা বের করে কোনমতে স্টার্ট দিয়ে অতনু বেরিয়ে পড়ে।
মনে মনে যে ভয়টা ছিল অতনুর সেটাই হলো ।কদমতলার ডি বি সি রোডটা পুরো আটকে গেছে জ্যামে।
এই হলো প্রতিদিনের সমস্যা।একে স্কুল, অফিসের সময় তাতে ছোট রাস্তা ।এখন লোকসংখ্যা অনেক বেশি তাই যানবাহনও অনেক বেশি এই রাস্তায়। এটা প্রায় রোজকার সমস্যায় দাঁড়িয়েছে। এই জায়গাটাকেই এড়ানোর জন্য অতনু রোজ আধঘন্টা সময় হাতে নিয়ে বের হয়। কিন্তু আজ ঘুম থেকে উঠতেই যে দেরি হয়ে গেল ।তাই যথারীতি বেরোতে দেরি হলো।
কি আর করা যাবে ,অপেক্ষা করা ছাড়া। জ্যামটা তো মনে হচ্ছে কদমতলা মোড় থেকে শুরু হয়েছে,মনে মনে ভাবে অতনু ।
এমন সময় মুখটা ঘোরাতেই অতনুর চোখ যায় ডি বি সি রোডের পাশের ফুলের দোকান গুলোর দিকে ।কত সুন্দর সুন্দর রং বেরঙের ফুল রয়েছে দোকানগুলিতে।
ঐতো জুঁই ফুলের মালা ও রয়েছে!
জুঁই ফুলের মালা দেখে অতনু কোথায় যেনো হারিয়ে যায়।
এক মনে জুঁই ফুলের মালার দিকে তাকিয়ে অতনু ভাবে আজ ফেরার পথে তনুর জন্য জুঁই ফুলের মালা নিতেই হবে।
এমন সময় পেছনের গাড়িগুলোর তীব্র হর্ণে সম্বিৎ ফেরে অতনুর । জ্যাম খুলে গেছে, সবাই এগিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব গন্তব্যে।অতনুও তার টু হুইলার কে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্য।
অফিসে আজ ঠিক মত মন বসছিল না অতনুর। যদিও এখন এটা প্রায় রোজই হচ্ছে তার ।একপ্রকার জোর করেই কাজে মন দেয় অতনু।
ফেরার পথে তনুর জন্য জুঁই ফুলের মালা আর একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে নেয় অতনু।
অতনু বাড়ি ফিরে সোজা চলে যায় শোবার ঘরে। তনুুর সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখিয়ে জুঁইফুলের মালা আর গোলাপ গুলো রেখে দেয় অতনুু।
ছল ছল চোখে তনুর দিকে তাকিয়ে অতনু বলে দেখো তনু তোমার জন্য তোমার পছন্দের জুঁই ফুলের মালা এনেছি। সাথে কিছু গোলাপও।
তুমি তো বিয়ের পরপর একবার বলেছিলে জুঁই ফুলের মালা তোমার খুব পছন্দ। তোমার খুব ইচ্ছে সারা ঘর ফুল দিয়ে সাজিয়ে মোম জ্বালিয়ে, হালকা আলোয় আমরা দুজন মিলে রোমান্টিক গান শুনবো । ওই যে তোমার পছন্দের ওই হিন্দি গানটা "তুমসে মিলকে অ্যায়সা লাগা তুমসে মিলকে ,আরমা হুয়ে পুরে দিলকে ....."
জানি তুমি কিছুই তেমন চাওনি আমার কাছে। অথচ এই সামান্য উপহার টুকুও আমি এতদিন তোমায় দিতে পারিনি। এখনো তুমি ড্যাব ড্যাব চোখ করে তাকিয়েই থাকবে আমার দিকে?কিচ্ছু বলবে না?
বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠে চির গম্ভীর অতনু ।
চোখ মুছে আবারো তনুর দিকে তাকিয়ে বলে অভিমান হয়েছে না তোমার ?হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমিও যে নিরুপায় ছিলাম তনু!তুমি তো জানো, প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি আমার। চাকরিটা টিকিয়ে রাখতে মালিক পক্ষের কথা মত গাধার খাটুনি তখনো খাটতে হতো এখনো খাটতে হয়। না হলে যে চাকরিটাই থাকতো না আমার। আর চাকরিটা না থাকলে তো বাবা ,মা ,ভাই, বোন এরা যে ভেসে যেতো।
বিশ্বাস করো তনু আমি নিরুপায় ছিলাম। তোমায় আমি ইচ্ছে করে সময় দেইনি এমনটা নয় ।তবে আমারও ভুল ছিল,এটা আমি মানছি তনু।
আমিও চেষ্টা করলে হয়তো এক আধদিন তোমার ইচ্ছে গুলো পূরণ করতেই পারতাম। তখন ভাবিনি গো সময় এত দ্রুত চলে যাবে ।অভিমানের পাহাড়টা যে তোমার মনে এতটাই বড় হয়ে যাবে সেটাও খেয়াল করিনি ।আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও তনু, আমি জানি তুমি কাউকে কখনো কষ্ট দিতে চাওনি ।
তুমি চাওনি অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে ।আমার,আমার পরিবারের সদস্যদের কষ্ট বেড়ে যাবে এটা ভেবেই তো তুমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে চির নিদ্রায় নিদ্রিত হলে।
বলেই আবারো হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে অতনু ।
এরপর কিছুটা শান্ত হয়ে অতনু বলে আজ কত মাস হয়ে গেল বলতো তুমি নেই!
আমি ভালো নেই তনু। তনুর অতনু ভালো নেই।
দ্যাখো আজ এনেছি তোমার পছন্দের জুঁই ফুলের মালা ।
জানি বড্ড দেরি হয়ে গেছে!
বড় আফসোস হচ্ছে আজ তনু, কেন যে সময় থাকতে তোমার মনের ছোট ছোট ইচ্ছেগুলোকে প্রাধান্য দেই নি। কেন যে বলিনি বড় ভালোবাসি তোমায় ।
টেবিলে রাখা তনুর ডায়েরিটা হাতে নেয় অতনু ।ডাইরিটা খুলতেই দেখে তাতে লেখা _
"তোমার আমার গল্পটা অভিমানের কাব্যই হয়ে থাক ,
সময়ে না বলা কিছু কথার জন্য জীবনটা না হয় আজ ছন্নছাড়াই হয়ে যাক।"
চোখে জল নিয়ে তনুর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অতনু বলে ,সত্যি সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না ।সময়ের কাজ সময়ে করলে হয়তো আমাদের জীবনটাও অন্যরকম হতে পারতো।
স্বপ্ন বেচা
জনা বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ সকাল থেকে পঞ্চানন হালদারের ঘরের দাওয়ায় মেলা লোকের ভিড়। আর কদিন পর শ্মশানের পাশের মাঠে গাজনের মেলা বসবে। এখানে গাজনের আগের দিন সারা রাত বোলান গানের আসর বসে। পঞ্চানন হালদার অকৃতদার। গ্রামের ভাগ চাষী। মাটির টালি ছাওয়া দুটো ঘরে বিধবা বোন লক্ষ্মীকে নিয়ে থাকেন। কয়েক বছর ধরে বোলান গানের আসরে ওস্তাদ হিসাবে গান লিখে ও গেয়ে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পঞ্চাননের গানের সঙ্গে সহযোগিরাও গান। তাঁদের কারোরই বয়স বেশী নয়, বছর পঁয়ত্রিশের মধ্যে। পেশায় বেশীর ভাগই চাষী। কয়েকজনের ছোটখাটো মুদির দোকান আছে।
মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার মিলনস্থল দক্ষিণখন্ড গ্রাম। শিবের গাজন উপলক্ষ্যে এখানকার বোলান গান বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানের অন্যান্য জায়গার মতোই জনপ্রিয়। শিব দুর্গার পৌরাণিক কাহিনী বা দাম্পত্য কলহের মতো সামাজিক কাহিনী নিয়ে বোলান শিল্পীরা গান বাঁধেন খানিকটা পালা গানের আঙ্গিকে। এই লোকগানে লোকনাট্যও লক্ষিত হয়। পঞ্চানন হালদারের দলে ঢোল বাজান নিতাই বায়েন। তিনি এই দলে প্রৌঢ়,বাহান্ন পেরিয়েছেন, প্রায় পঞ্চানন হালদারের বয়েসী। গান, বাজনার তালে তালে দলে রাঘব, শম্ভু, মনোজ, শিবেন প্রভৃতি কয়েকজন বিভিন্ন চরিত্রের সাজে নেচে আসর মাতান। পঞ্চানন আসরের শুরুতে গুরু বন্দনা করেন প্রত্যেক বার।
পঞ্চানন হালদারের বোন লক্ষ্মী সমবেত সকলের জন্য চা, বিস্কুট আর পাঁপড় ভাজা নিয়ে আসে। দলের শিবেন কে লক্ষ্মীর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে লক্ষ্য করেন পঞ্চানন। লক্ষ্মী যুবতী বয়সে বিধবা হলেও বেশ সুন্দরী। চটক আছে চেহারায়, পুরুষের নজর কাড়ে। লক্ষ্মীকে চা পরিবেশনের পর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পঞ্চানন বলেন, " তুই দাঁড়ালি কেন? তুই ভেতরে যা। এটা পুরুষমানুষদের সভা।"
লক্ষ্মী ভেতরে যায়। নিজে সংসার না পেতে পঞ্চানন আঠারো বছরের ছোট বোনকে পিতৃস্নেহেই বড় করেন। দু বছর আগে শহরের পি. ডবলু. ডি-র ড্রাইভারের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বিয়ে দেন বোনের। কিন্তু তিন মাস যেতে না যেতেই গাড়ি দুর্ঘটনায় লক্ষ্মীর স্বামীর মৃত্যু হয়। তারপর শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে লক্ষ্মী দাদার কাছেই ফিরে আসে।
সভার মাঝে রাঘব হঠাৎ বলে ওঠেন, " গানের বিষয়ে এবার কিন্তু একটু চমক চাই পঞ্চানন কাকা।"
" কি রকম চমকের কথা বলছিস তুই? "
পঞ্চানন অবাক হন। তাঁর গম্ভীর ব্যক্তিত্ব, দোহারা চেহারা, কাঁচা পাকা গোঁফ।
" না বলছিলাম যে, প্রতিবারই তো পুরাণের কাহিনী বা সামাজিক ব্যাপারগুলো গানে থাকে। এবার না হয় একটু রাজনীতি নিয়ে ব্যাঙ্গ রসও থাকুক।"
পঞ্চানন বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, " রাজনীতি ঢোকাবি বোলান গানে? তাতে ঐতিহ্য নষ্ট হবে। তাহলে বাপু তোরাই গান বাঁধ। আমায় ছেড়ে দে।"
"তা কি করে হয় ওস্তাদ? তুমি হলে আমাদের মাথা। তোমার মতো কেউ এ তল্লাটে গান বাঁধতে পারে না।"
মনোজের কথায় শম্ভু, শিবেন এবং দলের অন্যান্যরা সায় দেন ।
পঞ্চানন খুশি হয়ে বলেন, "তাহলে কাল থেকে এবারের গানের কথাগুলো লিখতে শুরু করব। গান, বাজনার সঙ্গে নাচের তাল যেন মেলে। তবে তো জমবে আমাদের পোড়ো বোলান।"
দলের সদ্য যুবক কানু দলে কাঁসর বাজায়। সে আনন্দে তালি দিয়ে এক পাক ঘুরে বলে," আমরা মাঠের একদিকে আসর জমাবো আর কিছু দূরে মড়ার খুলি নিয়ে জাদু দেখানো শুরু করবে দাঁড় বোলানের লোকজন। সে সত্যি এক হই হই কান্ড! বেড়ে মজা হবে। কত মানুষ সারা বছর এসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকে।"
পঞ্চানন সহমত প্রকাশ করে বলেন, " শিল্পীদের এখনো কদর আছে। তবে কিছু বছর পর তোদের ছেলেপিলেরা হয়তো এসব আর ধরে রাখতে পারবে না।"
ঢোল বাদক নিতাই বায়েন বলেন, "জীবিকার তাগিদে পেটের ভাত জোটাতে এরপর এসব শিল্প উঠে যাবে গো ওস্তাদ।"
সভা শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। সকলে একে একে প্রস্থান করলে পঞ্চানন স্নানাহার সেরে গুরু বন্দনা লিখতে বসেন। লক্ষ্মী পাশে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখে দাদার লেখা। পঞ্চানন লেখেন--
" গুরুর নাম নকুল চরণ পাটনি, দক্ষিণখন্ডে বাড়ি। তাঁর চরণ স্মরণ করে কত স্থানে দি পাড়ি।"
পঞ্চানন বোনের মাথায় হাত দিয়ে বলেন, "তোর তো গানের কাব্যি কথা পড়তে ভালো লাগে। তুই প্রথম পড়ে বলবি এবারে কিরকম লেখা হয়েছে।"
লক্ষ্মী সরল ভাবে হাসে।
গাজনের দিন বোলানের আসর জমজমাট। গায়ক, বাদকের সঙ্গে নৃত্যশিল্পীরা নানান রকম চরিত্র সেজে নিজ নিজ শিল্প ক্ষমতা প্রদর্শন করে মানুষের মন জয় করেন। ওখানকার গ্রামের শ্মশানে চড়ক মেলা বসে। চড়ক কাঠ পুঁতে সন্ন্যাসীরা ঘোরেন। জিভ ফোঁড়া, ভুরু ফোঁড়া, পিঠে ফোঁড়া--এগুলো গাজনের মেলায় 'বান ফোঁড়া' নামে খ্যাত। দুই বঙ্গের সন্ন্যাসীরা সরু লোহার রড নিজেদের জিভে বিদ্ধ করেন। এসব অভাবনীয় দৃশ্য দেখতে ভিড় করে দূরদূরান্তের মানুষ। চড়কের মেলায় এরকমও দেখা যায় যে, ঝুলন্ত সন্ন্যাসী ভক্তের মুখ নীচের দিকে, যেখানে একটি গর্তে আগুন জ্বলছে। সন্ন্যাসীর গোটা শরীর পেন্ডুলামের মতো ঝোলে। মাথাটি আগুন কুন্ডের এদিক ওদিক করে। এছাড়া সন্ন্যাসীরা ধারালো বঁটির ওপর বুক পেতে ঝাঁপ দেন। এসব মেলায় বাতাসার লুঠও হয়।
পঞ্চানন গাজনের দিন বিকেলে ভিড়ের মধ্যে শিবেনের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেন। শিবেনের ব্যাপারে কেউই উত্তর দিতে পারে না। আসর শেষ হলে ভোর রাতে ক্লান্ত শরীরে পঞ্চানন বাড়ি ফেরেন। লক্ষ্মীর নাম ধরে ডেকে সাড়া পান না। ঘরের দরজা খোলা। লক্ষ্মী কোথাও নেই। পঞ্চানন দেখেন লক্ষ্মীর চৌকির ওপর এক টুকরো কাগজে লেখা " আমায় খুঁজো না। তোমায় দু:খ দিতে চাই নি। কিন্তু আর কতদিন তোমার গলগ্রহ হয়ে থাকবো! শিবেনদার সঙ্গে কলকাতা চললাম। ওখানে একটা পার্লারে কাজ করব। শিবেনদা ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে।"
পঞ্চানন কাগজের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে বুক ফাটা আর্তনাদ করেন, " লক্ষ্মী তুই জানিস না তুই নিজে তোর কি সর্বনাশ করলি! তুই এই পাপের দুনিয়ায় কাউকে চিনিস না। সব মানুষ এখানে মুখোশধারী। শিবেন যে তোকে দালালের হাতে বেচে দেবে। তুই ফিরে আয় বোন। আমি গান বাঁধলে কে পাশে থাকবে!"
লক্ষ্মীর খবর আর পঞ্চানন পান নি। শিবেনও সেদিনের পর গ্রাম থেকে নিখোঁজ। শিবেন ছোট থেকে অনাথ। এই গ্রামে মামা মামীর সংসারে মানুষ। বিড়ি বাঁধার কাজ করত সে একটা দোকানে।
পরের বছর গাজনের সময় পঞ্চানন দলের ওস্তাদ হিসাবে আর থাকতে চান না। শুধু দলের নয়, এই পৃথিবীর প্রতি তাঁর টান উঠে গেছে। আজকাল বুড়ো বটের নীচে বসে বিড় বিড় করে আপন মনে পঞ্চানন কি সব বলেন। দলের কেউ এসে কুশল জিজ্ঞাসা করলে একভাবে চেয়ে থাকেন। তাঁর হয়তো মাথার ঠিক নেই এ কথা অনেকেই বোঝেন। নিতাই বায়েন একদিন পঞ্চাননকে বলেন, "দল নিয়ে তোমার কত স্বপ্ন ছিল। কেন তুমি সব ছেড়ে দিলে? তোমার দল যে ভেঙে যাবার মুখে।"
পঞ্চাননের মাথার চুল এলোমেলো। ঘোলাটে চাউনি। মুখ ভর্তি পাকা দাড়ি। পঞ্চানন কিছু ক্ষণ নীরব থাকেন। তারপর উদাস স্বরে বলেন, " আমি স্বপ্ন বেচবো। আমার স্বপ্ন কেউ কিনে নিক! কিনে নিক!"
নিতাই বায়েন বিস্ময়ের দৃষ্টিতে পঞ্চাননকে দেখেন। আর কিছুই বলতে পারেন না।
কবিতা
শব্দ
পূর্ণিমা বোস
শব্দ ভেঙে যায় জলে স্থলে
দখিনা বাতাসে ডানা মেলে
এক দল মৌমাছির সাথে
মস্তিষ্কের মন্দিরে জাগে।
দুগ্ধ পোষ্য বালক রাতে
আমি বেড়াই খুঁজে অকাতরে
স্নেহ চুম্বন দিয়ে চিবুকে
আমার কবিতার শরীরে।
চঞ্চলতা রং বদলায় ক্ষনিকেই
সম্বল খুঁজে পাই আমার মতো।
যুদ্ধ
টি এইচ মাহির
যুদ্ধ বাঁধে ঘর ভাঙে
ধ্বংস পথে পথে
ছোট্ট শিশু ছোট্ট দেহ
কাঁদে থরে থরে।
এতিম শিশুর কান্নায়
ঝরে শতো ফুল
অস্ত্র তন্ত্রে লক্ষ্য যেন
মানব বংশ মূল।
দেশে দেশে ভাঙে শুধু
মানব সভ্যতা
শাসকদের শাপাঘাতে
রূদ্ধ মানবতা।
যুদ্ধ শেষে রুগ্ন দেশে
নিত্য হাহাকার
রাজায় রাজায় লড়াই
ধরণী ছারখার।
কবিতাশতাব্দী সাহা
১) অন্তহীন ভাবনারা মিলিত হলে জন্ম নাও তুমি।
২) মৃত অক্ষর হয় সঞ্জীবিত কখনও কবিতাময় জীবনে নয়তো জীবনময় কবিতায়।
বেঁচে থাক স্বপ্ন লীনা রায়
দু' চোখ জোড়া স্বপ্ন নিয়ে তুই
খুঁটিয়ে দেখিস রাতের কালো আকাশ,
মুঠো মুঠো ছড়িয়ে রাতের তারা
ইচ্ছেমতো স্বপ্নকে তোর সাজাস।
স্বপ্ন নিয়েই তোর নিত্যদিনের বাঁচা
আকাশ ছুঁতে হাতদুটো নিশপিস,
স্বপ্ন-তাড়ায় বেদম তো আজ তুই
স্বপ্নটা তুই দেখেছিলি ভাগ্যিস !
বেঁচে থাকা যুদ্ধ তো নয় কেবল
তুই তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাস,
স্বপ্ন জড়াস তাই তো বেঁচে থাকায়
রঙিন করিস মনের সাদা আকাশ।
মহাকাব্য
দেবদত্তা লাহিড়ী
শোন, বৃদ্ধ হবার আগে তোমার সাথে
ঐ লাস ভেগাস আর মলদিভস টা
ঘুরে আসতে চাই।
কি বলছ? নদী পাড় আর ফুচকা চুরমুরে
কাটবে চমৎকার জীবন-
যদি তোমাকে পাই।
হাসছি আমি - সেতো চুরমুর আর পচা ডাম্পিং গ্রাউন্ড এর পাশে
লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করেই কেটে গেছে কত দিন।
যাকনা সেসব কথা,কিন্তু বলতো
এত কম কেমন করে চাই তোমার কাছে?
তুমিই তো একিলিস।
আমার একিলিস,যাকে কেন্দ্র করে
লিখে ফেলা যায় একখানা গোটা মহাকাব্য।
তুমিই আমার সেই একিলিস
যে একের পর এক করে যায় অসাধ্য সাধন।
যে মহা নায়কের একমাত্র একটাই দুর্বল অংশ
এই ধরে নাও না - যেমন তোমার আমি।
তাই তোমায় করবো ছোট
এমন সাধ্য আমার নাই।
তবে, এই যে আমার এত চাওয়া, এত কথা।
তার কারণ অবিশ্যি আছে
আমি।
আমি ও কিন্তু খুব তুচ্ছ নই যে তোমায়
একিলিসের আসনে বসাই
আমাকে পেতেও তো মূল্য চোকাতে হয়,
অনেকখানি মূল্য।
নাহলে এত প্রেম পাবে কোথায়।
লেখা হবেই বা কেমন করে?
দেখেছো কি নারী বিবর্জিত কোনও মহাকাব্য?
তুমি ভেবেও কি দেখনা কখনো
তোমার মহাকাব্য ও হবে অসম্পূর্ণ
যদি আমি চলে যাই।
অন্য গল্পের খোঁজে
সারণ ভাদুড়ী
গোলাপ গুলো গাছেই ঝড়ে যায়তারা আর শোভা পায়না তোমার হাতে,
চাঁদ দিগন্তে ডুবে যায়
সে আর থাকেনা তোমার অপেক্ষায়.....
গলির মোড় গুলো আজ ফাঁকাই থাকে
তাতে আর আমার চিহ্ন নেই।
এখন ক্লাস নোটগুলো আমিই রাখি
অন্য হাতে যায় না আর;
বাসের সিটটা রিজার্ভ আজ
আর ব্যাগটা আমার পিঠে,
সাইকেলটা হাতে নিয়ে আমি এগিয়ে গেছি
এগিয়ে গেছি হয়তো অন্য গল্পের খোঁজে....
রোদ বাগান
অলকানন্দা দে
এক যে ছিল আলসে দুপুরবেলা
হাওয়ার গায়ে দুপুর দুপুর গন্ধ
চিল ওড়া এক আকাশ ছিল বেশ
খরস্রোতা স্মৃতি মায়ায় অন্ধ!
এক যে ছিল গপ্পো বলা রাত
লোডশেডিঙে চাঁদ ধরতো বাতি
রাঙতামোড়া বিশ্বজয়ী কালো
স্বাস্থ্যঘুমে পেরিয়ে যাওয়া রাতি!
এক যে ছিল বোশেখ মাসের ঝড়
উথাল পাথাল তালসুপারির পাতা
আলতো টোকায় বৃষ্টি ঝরায় মেঘ
কোলাহলে ছড়ায় নিজস্বতা!
মানুষ মেলায় দিনের পাড়ে দিন
জড়িয়ে থাকার তন্তু ছিল সোনা
বপন করা আলোর চারাগাছ
অভয়ধারা স্নেহের আনাগোনা!
সবই ছিল অদল বদল সুখে
সোনাবরণ আনন্দ একরাশ
এ-সুখ থেকে ও- সুখ সাঁকো জুড়ে
পারাপারের নেশায় বারোমাস!
পশ্চিমে সেই মিলিয়ে যাওয়া বেলা
পরিব্রাজক মন করে যায় খোঁজ
মৃত্তিকাকে পথ দেখাতে বলে
দলবদ্ধ আকাঙ্ক্ষাতে রোজ!
শুধু মনে রাখা
বিজয় বর্মন
বাবা আজকাল খুব অন্য মনস্ক থাকেন,
মা অনেক বার ডাকা ডাকি করলে,
তবেই উত্তর মেলে একবার,
যা দেখে,কি যে নিরীক্ষণ,মনে হয় প্রথম বার নজরে এলো তার,
জানিনা কোথায় হারিয়ে যায়,সত্যটা বললেই,
ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, ভীষণ রেগে যায়,
মায়ের সাথে হরহামেশা,
যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব,
কিছুক্ষণেই নিরবতা বিরাজ করে বাড়িময়,
মায়ের মুখ ভার,
জানালায় চোখ খোঁজে, হারিয়ে যাওয়া গোলাপ,
তবু জল ঢালে শুকনো গাছে,
ফুল বা কাঁটা যা পাওয়া যায়,
আমার যে মন খারাপ হয় না,
তা নয়,
আত্মশ্লেষের হাসি, মুচকি রূপান্তর,
ওদিকে চাঁদের মালায় লকেট ঝুলেছে,
বিচ্ছেদের খবর কেউ রাখেনা।
মা বলে দেখ,রাগ করিস না,
এখনও অনেক পথ বাকি আছে চলার,
আমরা ভালো আছি,
বাবার কাছে এটাই স্বান্তনার,
মনে রাখিস,সংসারে হারানোর কিছু নেই !
প্রতিবেদন
হারিয়ে যাওয়ার কথা
আশীষ কুমার বিশ্বাস
এই যে আমাদের সমাজ , এই সমাজ থেকে মাঝে মধ্যেই শোনা যায় অবলা ,চপলা , হেমাঙ্গি ,মাধুরী , বা আল্লাদি হারিয়ে গেছে । বয়ঃসন্দী যখন তেরো-চোদ্দ , কিংবা পনেরো-ষোলো , তখনই এদের হারিয়ে যাওয়ার পালা !
এমনটা কেন ঘটছে , একটু ভেবে দেখা দরকার । সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোক বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত , এক শ্রেণীর লোক তাঁরা খোঁজ রাখে , বা চোখে রাখে এই উর্তি বয়সের মেয়েদের , শুধু তাই নয় তাঁদের সাংসারিক অবস্থা , হাঁটা চলা ,পড়াশোনা , দিন কাল সবই । কেন এটা করে ? কারণ এদের সাথেই যোগ থাকে বিভিন্ন মানব পাচারকারির , সমাজের অন্ধকার জগতের লোকের ।
খুব সন্তর্পনে এরা কাজ করে থাকে , বিভিন্ন অসৎ উপায় অবলম্বন করে এরা সেই সব ঘরে কল্যাণ কামী রূপ নিয়ে আবির্ভুত হয় । এখানে এরা সহজেই টাকার প্রলোভন দেখিয়ে কাজ হাসিল করার দিকে এগিয়ে যায় ।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম , পত্র - পত্রিকা বা সরকারি রিপোর্টে দেখা যায় যে ভিনদেশে এরা পাড়ি দিয়েছে বা অন্য রাজ্যে গিয়ে ধরা পড়েছে । ধরা পড়ার তালিকায় খুবই কম । এমন ভাবে ভিন দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে স্ব-ইচ্ছায় বা পরিবারের কেউ , তাঁদের ই সাথে যাচ্ছে , অথবা অনেক সময় বোঝার কোনো উপায়ই থাকে না ।
প্রলোভনের মধ্যে অনেক কে ভালো ভালো চাকরীর কথা , নার্সিং ট্রেনিং , টেলিফোন অপারেটার বা ভিন্ন ধরনের কাজের কথা এবং ভালো আয় আছে এই ধরণের কাজের কথা বলে ,দরিদ্র ঘরের মেয়েদের তুলে আনা হয় !
এমনও আছে ভিন দেশি ছেলেকে পাত্র সাজিয়ে অবলা , চপলা , বা আল্লাদির মতো মেয়ে কে
বিয়ে করে ভিন দেশে পাড়ি দিচ্ছে ।
দিন যায় , মাস যায় , বছর যায় , তাঁদের আর খবর পাওয়া যায় না । মা-বাবা , ভাই বোন তখন দুঃখের
সাগরে , শুধু দুঃচিন্তা তাঁদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায় !
যে মেয়ে বিয়ের ভাবনা ভেবে বিয়ের পিঁড়িতে পা দিলো , তাঁর মনে কিন্তু একটা ভাবনা জেগে ওঠে , সে ভাবে সংসারে যে অবস্থা তাঁতে তার ভবিষ্যতে বিয়ে হওয়া অসম্ভব । সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় , তবুও কোনো দেনা-পাওনা ছাড়াই এই যে বিয়ে হয়ে গেল তাঁতে তার বাবা-মা তো আর্থিক দুর্দশা থেকে কিছুটা রক্ষা পেল !
কিন্তু এই রক্ষা , শেষ রক্ষা নয়। যে পাত্রের সাথে তাঁর বিয়ে হলো তাঁর কিছুটা বলি । এই যে ট্রেনে এক দিন বা দু,দিন রেল যাত্রা বা দীর্ঘ বাস যাত্রা সেরে যখন বরের বাড়ি যাওয়ার কথা , তখন পাত্রীর ( বউ ) আর বাড়ি পৌঁছায় না । এখান থেকে কোনো ট্রাকের বা মেশিন ভ্যানে যে স্থানে পাড়ি দেয় , সেটা ভয়ানক এক স্থান , পতিতালয় বা বেশ্যাখানা । এখানে নববধূকে বসিয়ে রেখে পাত্র মোটা টাকায় বিক্রি বা নিয়োগ করে , সে কেটে পড়ে । পাত্রীর কপালে ঘনিয়ে আসে চির অন্ধকার , কিছুতেই সেই পরিবেশ বা তাঁর যাপন মেনে নিতে পারে না ।
এই রকমই আরও অন্যান্য মেয়েদের সাথে ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করা হয় , যাঁরা চাকরি করবে বলে এসেছিল , তাঁদের চাকরী তো দূরের কথা, নিম্ন মানের কাজ , অস্বস্তিকর পরিবেশ , অস্বাস্থ্যকর , হানিকারক জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয় । দিনের আলোতে তাঁরা অন্ধকারে , অথই জলে পড়ে হাবু-ডুবু খেতে হয় ।
পরিশেষে কেউ কেউ আবার মেনে নেয় , মানিয়ে নেয় । মনের মধ্যে ঘোরা-ফেরা করে বাড়ি ফেরার ।
পথ খোঁজে কিন্তু খুঁজে পাওয়া দায় ! যে দালাল চক্র এই কাজ গুলি করে তাঁরা ভীষণ চালাক এবং নির্মম। এঁদের যা সম্বল অর্থাৎ তাঁদের কুঁড়িয়ে কাঁচিয়ে যে টাকা পয়সা , তা কেড়ে নেওয়া হয় , এমন কি এদের শিক্ষাগত যা যোগ্যতা বা প্রমান পত্র সব নিয়ে নেওয়া হয় , এর পর এদের আর কোনো উপায় থাকে না।
যাঁরা দুঃসাহসী বা দূরদৃষ্টি সম্পর্ণ , তাঁরা কোনো মতে লুকিয়ে চুরিয়ে এ স্থান থেকে পালিয়ে পুলিশ থানায় খবর দেয় , কিংবা সুষ্ঠ সংগঠনের হাতে পড়ে এদের মুক্তি ঘটে !
এবার ফিরে আসি সেই সব মেয়েদের কথা , যাঁরা বিয়ের মালা পড়েছিল কোনো সুখের ঘর বাঁধবে বলে , তাঁদের জীবনে ঘটে গেছে চরম দুর্দিনের কাহিনী । দালাল তাঁদের নামিয়ে দিয়েছে দেহ ব্যাবসায় । জীবন কাটে পতিতালয়ে !
এ পথে হয়তো পয়সা আসে ঠিকই , কিন্তু মন সেটা চায় না , তাঁর মন বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে । বছরের পর বছর ঘুরে ফিরে আসে , বেশ কিছু টাকাও জমায় , টাকা গোনার সময় ফুঁটে ওঠে
তাঁর প্রিয় জনদের মুখ , মা-বাবা , ভাই-বোন কিংবা পাড়ার তাঁর বন্ধুর কথা ! নিঃশ্চুপ কান্নার চোখের জলে টাকা ভিজে যায় , তবুও গুনতে থাকে কারণ বেশ কিছু টাকা হলে সে তাঁর বাবা-মার এবং ভাই-বোনদের জন্য জামা কাপড় নিয়ে যাবে আর মার হাতে তুলে দেবে অনেক টাকা , পরিবার টা যেন সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারে !
স্বপ্ন সে তো স্বপ্নই থেকে যায় , পতিতালয়ের থেকে পালিয়ে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে যখন দীর্ঘ পথ , দীর্ঘ দিন অতিক্রম করে বাড়ি ফেরে , তখন আর বাড়িতে পা রাখতে পারে না । লাজ লজ্জা বদনামের অপ-প্রচারে মা-বাবা আর তাঁকে বুকে তুলে নিতে পারে না , চেনা পরিচিতির জগতে তাঁর আর ঠাঁই হয় না !
আবার তাঁকে ফিরে যেতে হয় অপরিচিত জগতে
শুধু বেঁচে থাকার জন্য , কিন্তু এই বাঁচা কি সঠিক ভাবে বাঁচা ?
প্রশ্ন রইলো আপনাদের কাছে ।
কবিতা
স্বপ্নস্মৃতি
দেবযানী সেনগুপ্ত
স্তব্ধ রাতের কড়া নাড়া
থমকে সময় যুগ,
ঘুমহীন চোখ প্রহর গোনে
না বলা ব্যথায় মূক!
সময় এগোয় আবছা আলোয়
অদেখা মিছিল মুখ,
স্বপ্ন জড়ানো ঘুম চোখ খোঁজে
আলতো হাতের সুখ।
স্মৃতি দরজায় হাট করে খোলা
অগোছালো বাড়ি ঘর
ছেলেবেলার পুতুল খেলার
ছোটখাটো টুকটাক।
চিলেকোঠার সান্ধ্য বুকে
মেঘলা বিকেল ঝুপ,
ভুলে যাওয়া এক, কি যেন নাম,
ডেকে ওঠে চুপ চুপ।।
গালিবের চ্যালা
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
বুকে স্টেথো, হাতে ইনসুলিন এর সূচ
একাকী রাত জাগি, প্রহর গুনি
নিস্পলক জেগে রই, নিকষকালো রাতে,
সভ্যতার সাদা - কালো বিছানো চাদরে,
বাসর সাজাই, শূন্য ঘরে আমি গালিবের চ্যালা।
হইল চেয়ারখানি হাতে চাকা ঠ্যালা বড়ো দায়
বেড়েছে ওজন শত জন্মের, কুড়ানো সে পাপ
উত্তাপে ফেটে যায় দিবালোক, চৈত্রের আকাশ
সাজাই বাতাস আমি বনফুল দিয়ে, একা আমি
বেদুইন তাবুতে আমি, একা গালিবের চ্যালা।
নিস্পাপ পাথর মাথা কুটে মরে মনে পাপবোধ
দংশনে নীল হয় শিরা উপশিরা, ক্ষতের গভীরে
উত্তাপ ধরা দেয় কোন প্রান্তদেশ শুধু মায়াজালে
ছড়িয়েছি শস্যদানা কোনো অবকাশে ধরণীতে
পথ খুঁজি একা আমি সেই গালিবের চ্যালা।
সংকল্প
এস.সাহা ( সঞ্জয় )
নীরবে নিভৃতে তোমাদের এই মহান অভিসার
আমরা বুঝতে পারি না!
নীরবে করে যাও ত্র্যহস্পর্শের
কত তিথি যেন না ঘুমিয়ে শেষ হয়!
ক্ষুদার্থের মুখে জোটেনা অন্ন
তোমরা যে সংকল্প নিয়েছো কত সংকল্প,
নীরবে করবে একই দিনে তিনটি তিথি পালন
রাতে যে তোমাদের নাখেয়ে ঘুমানো বারণ l
আগাছার স্তুতি
রথীন পার্থ মণ্ডল
যে পৃথিবীর কালগর্ভে হারিয়ে যায় না নকশালবাড়ি
যে সমাজের আঙুল চুষেও নিমেষে উৎখাত হয় জমিদারী
সেখানেই জন্মেছিল আমাদের মতো বুনো ঘাস
প্রতিপালনের দায়িত্ব না নিলেও যে নিজের গরজে
বাড়তে থাকে, ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে
সাধ্যমতো বিস্তার করে নিজের সাম্রাজ্য
তবুও লোকে তাকে আগাছাই বলে।
পায়ে মাড়াতে মাড়াতে তারই ওপর দিয়ে তৈরি হয় পথ
সে পথে সবুজ শহীদ হয়, তবু টিকে থাকে আগাছা
খটখটে শুকনো হয়ে তখন অপেক্ষারত, আর
সেই অন্তিমকালে আমি বারুদ মাখবো আঙুলে।
আগাছা বেঁচে থাকে সূর্যের পথ চেয়ে।
দোলযাত্রা
ছবি ধরহৃদয় পুঞ্জে গহন কুঞ্জে দোলযাত্রা আসে ,
পাতায় ফুলে মুকুলে কমলে দোল হাসে ।
নদীর বুকে সাগরের ঢেউয়ে দোল উদ্ভাসে ,
বসন্ত পূর্ণিমা রাঙা বদনে চন্দ্রিকা সম্ভাসে।
সুনীল আকাশে মেঘের পালকে রক্তিমা ছড়ায়,
পূর্নিমা চাঁদ মাতোয়ারা দিগন্তে জোছনা ঝড়ায় ।
অলির ডানায় ভ্রমরের গুঞ্জন আবেশে ভরায়,
পলাশ পলাশ শিমুল শিমুল লালিমা জড়ায়।
রঙের ভাবনায় ঋতুরঙ্গ মননে উচ্ছাস জাগায়,
কোয়েল কুহুকুহু দোসর ডাকে সোহাগের আশায়।
ফুলরেণু পথ পাশে আঁকে সুখে আলপনা,
মালতী , কাঞ্চন,কনক চাঁপার কুঙ্কিত জল্পনা।
কুসুমকলি রাত জেগে রয় বর্ণিল নেশায়,
ধরণী কাননে কুসুমে ফাগুয়ার ফাগ মেশায় ।
দোলের আগমনে মুখরিত ব্রজের বৃন্দাবন ধাম,
খোল ,পাখোয়াজ, করতালে জপে রাধাকৃষ্ণ নাম।
শান্তিনিকেতনে রবিগানে অথৈ বিহ্বল গৌর প্রাঙ্গণ,
শ্যামরাই দোলে দোদুল ঝুলনায় সুসজ্জিত আঙ্গণ।
ঋতুরঙ্গে বাঁশরির লহরীতে নাচে বসন্ত বিলাসীনি ,
দোলযাত্রার আনন্দ উৎসবে রঙ মাখে সুভাসিনী।
সবই রবে পড়ে
বিপ্লব গোস্বামী
ক্ষীণ হবে চোখের দৃষ্টি
পাকবে মাথার চুল,
কমবে দেহের বল
নড়বে মুখের বোল।
কানে লাগবে তালা
কমবে পায়ের বল,
ভাই বন্ধু ছাড়বে সঙ্গ
ঈশ্বর হবে সম্বল।
বাড়ি গাড়ি পয়সা কড়ি
সবই রবে পড়ে,
সমন এলে যেতেই হবে
সাধের দেহ ছেড়ে।
আমার ভেতর........
বিনিময় দাস
আমার ভেতর আকাশ আছে
সীমাহীন ঠিকানা,
মেঘের কোলে পাখি উড়ে
পথ যাদের অজানা ।
রবি হাসবে প্ৰাণটা খুলে
খুব ছড়াবে আলো,
বৃষ্টি শেষে পাবে তুমি
রামধনু খুব ভালো ।
আমার ভেতর সাগর পাবে
ঢেউয়ের আলিঙ্গনে,
কাণটা পেতে শুনতে পাবে
কত কথা মনে ।
আমার ভেতর পাহাড় আছে
বুকের মধ্যে চাপা,
মনে হয় যে পাহাড় ভেঙে
কথারা হোক্ ক্ষ্যাপা ।
আমার ভেতর নদী আছে
এঁকে বেকে চলে,
সারাটা দিন আপন স্ৰোতে
তোমার কথাই বলে ।
আমার ভেতর ভালোবাসার
তোমায় দেবো ছোঁয়া,
স্বচ্ছ হবে উভয় প্ৰান্ত
উড়ে যাবে ধোঁয়া ।
বছর শেষের মাস চৈত্র মজনু মিয়া
বারো মাসের শেষ মাস চৈত্র
বর্ষায় ভিজে যায় ভাসিয়ে
পলিমাটি দেয় পবিত্র
বৈশাখী ঝড় যায় কাঁদিয়ে।
ফলমূল শাকসবজি ভরে রয়
জৈষ্ঠ্যমাস মধুমাস জেনে
ভাদ্রের তাল রসে মজা হয়
বাঁধা জীবন নিয়ম মেনে।
সোনালি ফসল সবুজ মাঠ
দুলে ওঠে হেমন্তের গান
কাঁঠালের ঘ্রাণ হৃদয়ের পাঠ
শীত কাঁপন জবুথবু প্রাণ।
ডাল ফেটে মুকুট কুঁড়ি ফুল
ফাগুনের আগুন ধরায় বুক
কোকিলের ডাকে মন আকুল
চৈত্র ঝরে যায় পুড়ে শোক!
ছবি
সোমনাথ বণিক
মুজনাই অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৯