Tuesday, April 18, 2023

 




। পাঠ প্রতিক্রিয়া।


শ্রাবণ মুখর সন্ধ্যা: মনোমিতা চক্রবর্তী 


করলা ভ্যালি চা বাগানে বসে শিক্ষিকা মনোমিতা চক্রবর্তী সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন। সম্প্রতি তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ `শ্রাবণ মুখর সন্ধ্যা` হাতে এসেছে। এর আগে লেখকের `জীবনের গল্প' গ্রন্থটি পড়বার সুযোগ হয়েছে। প্রথম গ্রন্থের তুলনায় দ্বিতীয় গ্রন্থে মনোমিতাকে অনেক বেশি অভিজ্ঞ মনে হয়েছে। যে কোনও গল্পকারের কাছে এই উত্তরণ জরুরি। যদিও দ্বিতীয় গ্রন্থে গল্পকার নিজেকে সেভাবে ভাঙতে পারেননি। তবে মাত্র দুটি গ্রন্থে কিছু গল্প পড়ে গল্পকারকে বিচার করা উচিত না। সেটি করছিও না। বরং অপেক্ষা করছি পরবর্তী জন্য। 

`শ্রাবণ মুখর সন্ধ্যা` গ্রন্থটিতে ঊনচল্লিশটি গল্প মলাটবন্দি হয়েছে। কিছু গল্প অণুগল্পের পর্যায়ভুক্ত। বাকিগুলিও কলেবরে খুব বড় নয়। 

মনোমিতার গল্পের যে দিকটি সবচেয়ে ভাল লাগে তা হল, তাঁর গল্পে আরোপিত কোনও কৃত্রিমতা নেই। তিনি যা দেখেছেন, যা বুঝেছেন সেটিই তুলে ধরেছেন। ফলে তাঁর গল্পগুলির চরিত্রদের খুব চেনা লাগে। আনন্দবাবু, মলয়বাবু, ফুলমতি, নুপুর, দীপ প্রমুখরা প্রত্যেকেই যেন আমাদের আশেপাশে রয়েছেন। তাদের কথা বলার ভঙ্গি, যাপন, ভাবনা ইত্যাদি সবকিছুর সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন পাঠকেরা।  কিছু কিছু গল্পে আবার তারা যেন নিজেকে খুঁজেও পান। আবার কিছু গল্পে মনোমিতা সম্ভবত তাঁর নিজের কোনও অভিজ্ঞতাও গল্পের বুননে পাঠকের সামনে রাখেন। আসলে এমনটাই হওয়ার কথা। কেননা অভিজ্ঞতা ও কল্পনার মিশেলেই সৃষ্টি হয় গল্প।  

উপস্থাপনার ক্ষেত্রে মনোমিতা সহজ সরলভাবে গল্পগুলিকে আখ্যায়িত করেছেন। চমক সৃষ্টির আলগা প্রয়াস তাঁর নেই। যেটুকু আছে, গল্পের প্রয়োজনেই সেটুকু এসেছে। যেমন `শিক্ষা' গল্পটিতে অমিত ও রিনি বাবা-মা`কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার পর জানতে পারে তাদের বাড়ি ছাড়তে হবে, কেননা বাড়িটা আগে থেকেই অনাথ আশ্রমে দান করা। `ধ্বংস' গল্পটিতে মীরা দেবীর নিজের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাইপো অজিতের স্ত্রী রিমির গর্ভপাতে খানিকটা চমক থাকলেও, ছবিটি যেন অত্যন্ত চেনা। `ভালোবাসা আসলে অনুভূতি` গল্পের শ্রেয়া শেষ পর্যন্ত নিজের মৃত্যুতে যেন ভালবাসার খেলায় জিতে যায় অন্যভাবে। এভাবেই একের পর এক গল্পে নানা প্লট ও ঘটনা পরম্পরা পাঠককে গল্পগুলি পড়তে বাধ্য করে। পাঠ শেষে একটি হালকা রেশ রয়ে যায়। 

ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে মনোমিতাকে আরও যত্নশীল হতে হবে। `কান্না মিশ্রিত গলা', `সম্পর্কযুক্ত`, `চির নিদ্রার পথযাত্রী` `চুম্বন দিয়ে শক্ত করে ধরে` ইত্যাদি শব্দবন্ধের ব্যবহার গল্পের গতিকে রুদ্ধ করেছে। আবার, প্রেমকে বোঝানোর জন্য জনপ্রিয় `কেয়া হুয়া তারা বাদা...` জাতীয় প্রয়োগ কিন্তু শেষ অবধি ভাল লাগে না। 

মনে রাখতে হবে, নিজস্ব ভাষা ও স্টাইল সৃষ্টি না করা অবধি কিন্তু সাহিত্যের কোন শাখাতেই স্থায়ী আসন পাওয়া যায় না। প্রশ্ন আসতে পারে নিজস্ব ভাষা ও স্টাইল সৃষ্টি হবে কীভাবে? সব কিছুই তো বলে ফেলা হয়েছে। শব্দও তো নতুন কিছু সৃষ্টি হচ্ছে না। তাহলে পূর্বের সৃষ্টির সঙ্গে পার্থক্যটা ঘটবে কীভাবে? উত্তর হল, প্রয়োগে। যেখানে পূর্ববর্তীদের লেখা থেমেছে, সেখান থেকে এগিয়ে নিতে হবে নিজের সৃষ্টিকে।  

তবে এই দুর্বলতা (একান্তই আমার মতে) মনোমিতা আগামীতে অবশ্যই কাটিয়ে উঠবেন। এটা আশা করি। মনোমিতার বয়স অল্প। লেখার জন্য বহু সময় পড়ে আছে। তবে দ্বিতীয় গ্রন্থ হিসেবে মনোমিতার যাত্রার রেখাচিত্র অবশ্যই উর্দ্ধগামী। 

বইটির প্রকাশক শব্দ সাঁকো। সুমন হাজরার প্রচ্ছদ ভাল লেগেছে। কিছু কিছু লাইনের শুরুতে দাড়ি (।) থাকাটা ভয়ঙ্কর দৃষ্টিকটু। কোথাও কোথাও স্পেসের অভাবে সৌন্দর্য মার খেয়েছে। `মলয় বাবুর ছাত্ররা` গল্পটি সহ বেশ কিছু গল্পে ইনভার্টেড কমার উল্টো ছাপা প্রমাণ করে যে প্রুফ ঠিকমতো দেখা হয়নি। এই বিষয়েও সচেতন হওয়া দরকার।

আলোচক: শৌভিক রায়       

  

No comments:

Post a Comment