মানুষ ও প্রকৃতি
রণিতা দত্ত
"মোলাই, অ মোলাই উঠ বাবা! বেলা যে চড়ে যায়!"
মায়ের ডাকে চোখ ডলতে ডলতে দরমার ওপর ছেঁড়া চাদর পাতা বিছানার ওপর উঠে বসে আট বছরের মোলাই। ভাত ফোটার গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা মারতেই পেটের খিদেটা চাগাড় দেয়। ঘরের দরমার বেড়ায় টানানো দড়ি থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে হুড়মুড় করে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে চাং-ঘর থেকে।
নিচে অনেকগুলো গরু মোষ বাঁধা। ঘরের পেছন দিকে প্রাতঃকৃত্য সেরে এসে মোলাই বালতির জলে মুখ কুলকুচি করতে করতে দেখে বাবা লাখীরামের দুধ দোয়ানো এরমধ্যেই সারা। তিন বালতি দুধ সারি দিয়ে রাখা। ভাত খেয়ে বাবা দুধ বিক্রি করতে বেরবে। লাখীরাম মোলাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, " ইস্কুল যাওয়ার সময় গরু মোষগুলো সঙ্গে নিয়ে যাবি। ইস্কুল শেষ হলে চরাবি। খবর্দার একটাও যেন এদিক ওদিক চলে না যায়।"
ঢক্ করে ঘাড় কাত করে মোলাই আবার আট ধাপ সিঁড়ি বেয়ে চাং-ঘরে উঠে যায়। মায়ের গা ঘেঁসে বসে বলে, "মা ভাত দে।"
ছেলের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আফুলি বলে, "চোখ মেললেই পেটে আগুন ধরে,তাই না?" মোলাই তখন মায়ের আঁচলে মুখ ঘষে।
নামসিং(শুঁটকি মাছ) ভর্তা দিয়ে একথালা ভাত খেয়ে নেয় মোলাই। ঘরের কোনা থেকে স্লেট পেন্সিল আর বইয়ের পুঁটুলি নিয়ে আবার একদৌড়ে নিচে। লাখীরাম ততক্ষণে গরুমোষ গুলোকে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় তুলে দিয়েছে। একটা ছপটি হাতে নিয়ে সবগুলোকে একজায়গায় করে মোলাই ওদের পেছন পেছন চলতে শুরু করে।
ইস্কুলে মোলাইয়ের নাম যাদব পায়েং। ওর ধবধবে ফর্সা রং আর লালচে গোলাপী মুলোর মত গাল আর ঠোঁট দেখে গাঁয়ের সবাই ওকে ছোটবেলায় মোলা (মূলা) বলে ডাকত। সেই থেকে ওর আদরের নাম হল মোলাই। যাদব নামটা আছে শুধু ইস্কুলের খাতায়।
ইস্কুলের বন্ধ ঘরে মন লাগে না মোলাইয়ের। মাস্টারমশাই ছেলেদের নামতা শেখান আর ও জানালা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বহতা ব্রহ্মপুত্রের দিকে। নদীর জলের ঘুর্ণিপাক আর চরে বসে থাকা নানারকম পরিযায়ী পাখির দল ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
ইস্কুল ছুটি হতে না হতে একলাফে মোলাই ওর গরু মোষের পাল নিয়ে চরাতে বেরিয়ে পড়ে। প্রকৃতির মধ্যেই ও খুঁজে পায় ওর আনন্দ আর মুক্তি।
ওদের এই অরুণা চাপোরি গ্রামে ঘাসের বড় অভাব। আর হবে নাই বা কেন। এ তো ব্রহ্মপুত্রের বালির চর বই নয়। চাপোরি মানেই নদীর চর। প্রতি বছর বন্যায় ভেসে যায়। গাছপালা গজানোই ভারি শক্ত এখানে। উজানি অসমের এই মাজুলি দ্বীপ পলি আর নদীর বালি জমে জমে কতকাল আগে তৈরি হয়েছিল কেউ জানে না তা। এটাও আজ কারো মনে নেই যে মিশিং উপজাতির লোকেরা কত হাজার বছর আগে তিব্বত ছেড়ে একদিন এই ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। নদীই ওদের জীবন আবার বর্ষায় এই নদীই প্রমত্ত হয়ে উঠে ওদের ভাসিয়ে নিতে চায়। মোলাইদের মত মিশিং উপজাতির লোকরা তাই বাঁশের লম্বা লম্বা খুঁটির ওপর দরমা দিয়ে বানানো চাং-ঘরে থাকে। তাছাড়া বুনো জন্তুরও তো কিছু অভাব নেই এখানে। গন্ডার, হাতি এমনকি বাঘও মাঝে মধ্যে হানা দেয় এখানে। গরু ছাগল হাঁস মুরগি সবকিছু নিয়ে মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে তাই নিরাপদে ঘর বেঁধে থাকে ওরা।
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘাসের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় মোলাই। গরু মোষ গুলোকে চরতে দিয়ে ও নিজেও গাছপালা ফুল পাখি এসব গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখে। মাঝেমাঝে জামা প্যান্ট নদীর ধারে খুলে রেখে সাঁতার কাটে ব্রহ্মপুত্রের জলে। নদী এখানে বিশাল চওড়া হলেও বর্ষা ছাড়া অন্যসময় স্রোত তত বেশি নয়। নদীর বুকে মাথা তুলে থাকে অগুন্তি ছোট বড় স্লেটরঙা পলিমাটির চর। সাঁতরে সেসব চরে গিয়ে বসে মোলাই। গভীর মনোযোগে দেখে কাঁকড়ার চলাফেরা। নদীর চরের গর্তে কতরকম সাপ খোপ পোকামাকড়ের আস্তানা। মাঝেমাঝে রূপোর মত ঝকঝকে প্রকান্ড সব চিতল মাছ জলে ঘাই দেয়। হাঁ করে সেদিকে চেয়ে থাকে মোলাই।
একসময় ধীরে ধীরে দিগন্তে ঢলে সূর্য। ব্রহ্মপুত্রের জল লাল হয়ে ওঠে ডুবন্ত সূর্যের রং গায়ে মেখে। ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী হাঁসের দল চরে ফিরে আসে রাতের বিশ্রামের জন্য। জোনাকিদের দেখানো পথ ধরে মোলাইও তার গরু মোষের পাল নিয়ে ঘরে ফিরে আসে।
মোলাই বড় হয়। নদী জল গাছপালার সাথে ওর সখ্যতা আরও নিবিড় হতে থাকে। চার দেয়ালের ভেতরে বসে যে পড়াশোনা সেসব তো মোলাই কোনকালেই ছেড়ে দিয়েছে। ওসব ওর ভালোও লাগে না আর ওর কাজেও লাগে না কোনো। বরং ও রোজ কত কি শেখে খোলা আকাশের নিচে আলো হাওয়া জল মাটি অবিরল গায়ে মাখতে মাখতে কেউ তার কোনো খবর রাখে না।
মোলাই এখন ষোলো বছরের কিশোর। মাঝারি উচ্চতার শক্তপোক্ত শরীর। গায়ের ধবধবে ফর্সা রং রোদ জল মাটি মেখে মেখে এখন সামান্য তামাটে। অবশ্য তাতেই ওকে আরও বেশি আকর্ষনীয় লাগে ময়নার। মোলাই যখন হাসে তখন ওর গোলগাল মুখে ছোটছোট চোখদুটো সবার আগে সে হাসি মেখে নিয়ে কি ঝকঝকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে! ময়না জানে শুধু ও নয় আরো অনেক কিশোরীই আড়ে ঠারে চায় মোলাইয়ের দিকে। তবে মোলাই যে কাকে চায় সেটাই বোঝা যায় না। ও সত্যি কি কাউকে চায়? উদাসী বাউলের মত বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় সে। কোনদিকেই যেন নজর নেই। এই এক ধারা!ময়না ভাবে এইবার আলি আঃয়ে লিগাং এর উৎসবে সে ঠিক মোলাইয়ের সাথে নাচবে।
আলি আঃয়ে লিগাং মিশিংদের বীজবপনের উৎসব। বসন্তের আগমনে ফাল্গুনের প্রথম বুধবার থেকে শুরু হয়ে পাঁচদিন ধরে চলে এই বিরাট উৎসব। সকালে নিয়ম রীতি মেনে ঘরের তাঁতে বোনা নতুন কাপড় পরে ধান বোনে গ্রামের বড়রা। দেবতার কাছে প্রার্থনা করে যেন সারা বছর ভালো ফসল হয়। মোলাইও নিজের মত করে কিছু বীজ পোঁতে গ্রামের রাস্তার ধারে। দুপুরে খোলা মাঠে বসে গ্রামের সবাই মিলে ভোজ খায় ওরা। ইখু সিদ্ধ(বাঁশের কোঁড়), শুঁটকি মাছ আর শুয়োরের মাংস দিয়ে ভাত খাওয়া হয়। আফুলি, মোলাইয়ের মা, অনেক আপং(ভাতের মদ) বানিয়ে রেখেছে। লাখীরাম তো সারাদিন খাচ্ছেই আজ মোলাইও খাবে। ও-ও তো বড় হয়েছে এখন। শহরের মানুষ যেমন চা খায়, কেউ বেড়াতে এলে চা দিয়ে আপ্যায়ণ করে ওরাও তেমনি করেই আপং খায়।
বিকেলে শুরু হল ছেলে মেয়েদের নাচগানের উৎসব। মৃদঙ্গ ঢোল মন্দিরা বাজিয়ে গান গায় ছেলেরা আর মেয়েরা সেই তালে কোমর দুলিয়ে নাচে।
ময়না একফাঁকে সরে এসে মোলাইয়ের হাত ধরে টানে। "নাচবে এসো"।
সরল হাসিতে ভরে ওঠে মোলাইয়ের মুখ।
"আমি নাচলে তোমাদের তালে ভুল হয়ে যাবে তো!"।
"হয় হবে। তবু এসো।"
মোলাইয়ের হাত ধরে ময়না নাচে। তাই দেখে গ্রামের আরো ছেলেরা এসে সেই নাচে যোগ দেয়। হাসি আর আনন্দ ঢেউয়ের মত বয়ে যায় সবার মনে। সে আনন্দের রেশ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নব বসন্তের আকাশে বাতাসে। খুশির হিল্লোল ওঠে সবার প্রাণে।
মোলাই বোঝে ময়নার মনের কথা। কিন্তু ওর মন ওদিকে টানে না। ওর একমাত্র ভালোবাসা প্রকৃতি। এক জ্যোতিষী ওর হাত দেখে একদিন বলেছিল তোমার ভাগ্য বাঁধা আছে প্রকৃতির সাথে। মোলাই ভালো বোঝেনি লোকটা ঠিক কি বলতে চেয়েছিল। তবে এটা বোঝে এই মাজুলির প্রকৃতি ওর শরীরের অনু পরমাণুতে মিশে আছে। এখানকার গাছপালা জীবজন্তু সব্বাই ওর খুব আপন, যেন ওর সত্ত্বার আরেক অংশ।
শ্রাবণমাসে একদিন মোলাই ওর গরু মোষের পাল নিয়ে চরাতে চরাতে পাঁচ মাইল দূরের কোকিলামুখ গ্রামে চলে গিয়েছিল। তখন বেলা এগারোটা হবে, একদল বাবু আর কিছু মজুর এসে কি সব আলোচনা করছিল। মন দিয়ে শুনে মোলাই বুঝতে পারল এরা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক। কোকিলামুখে অনেক গাছের চারা বসানো হবে। প্রতি বছর বানে এদিকের দ্বীপগুলোর অনেকটা করে অংশ ভেঙ্গে নদীর গর্ভে তলিয়ে যায়। গাছপালা শিকড় ছড়িয়ে মাটিকে বেঁধে রাখলে ভাঙ্গন ঠেকানো যাবে। পাতা ঝরে পড়ে পচলে মাটিতে সার হবে তখন সেই মাটিতে অন্য গাছপালাও ভালো জন্মাবে।
শুরু হয় গাছের চারা পোঁতা।
মজুরদের কাছে গিয়ে মোলাই বলে, "আমাকে কিছু চারা দাও। আমিও পুঁতবো।"
তারা জানায় সাহেবের হুকুম না হলে ওরা চারা দিতে পারবে না।
সরাসরি এবার মোলাই গিয়ে হাজির হয় সাহেবের কাছে। ফরেস্ট অফিসার বাবুটি ভাবলেন, ভালোই হল। আরেকজন মজুর থাকলে কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হবে। মোলাইকেও লাগিয়ে দিলেন গাছ পোঁতার কাজে।
মহা উৎসাহে মোলাই গাছ পুঁততে শুরু করে। কত রকম গাছ! শাল, শিশু, শিমূল, বাবলা, অর্জুন....... বড় হলে ছায়া দেবে এরা। মাটি বেঁধে রাখবে। মাটিতে কত ঘাস জন্মাবে.......অনেক স্বপ্ন মুলাইয়ের দুচোখে আঁকা হয়ে যায়।
সাতদিন পর সব গাছের চারা পোঁতা শেষ হয়ে যায়। মজুরদের দল পাওনাগন্ডা বুঝে নিয়ে ফিরে যায় নিজের নিজের কাজে। মোলাই কিন্তু ফিরতে পারে না। ওর মনে হয় কত খালি জায়গা পড়ে আছে এখনও। সব গাছ দিয়ে ভরিয়ে দিতে হবে। গ্রাম তন্নতন্ন করে বীজ সংগ্রহ করতে থাকে সে।
শ্রাবণের শেষে তুমুল বৃষ্টি নামে। নাগাড়ে বৃষ্টি চলতে চলতে একসময় ফুঁসে ওঠে ব্রহ্মপুত্র। নদীর বিস্তার দেখে বুকে তখন ভয়ের কাঁপন জাগে। সাপের ফনার মত বিশাল বিশাল ঢেউ নিষ্ফল আক্রোশে মাথা কুটে মরে। ঘোলা জলের স্রোত দুরন্ত বেগে ঘূর্ণি তুলে ছুটতে থাকে। নদীর বুকে জেগে থাকা ছোট খাটো সব দ্বীপগুলোকে গিলে নেয় রুদ্র কালভৈরবের মত ভয়ংকর ব্রহ্মপুত্র। তারপর সে ভাসিয়ে দেয় কোকিলামুখ, অরুণা চাপোরি আরও কত শত গ্রাম। মোলাইদের মত সকলে তখন আশ্রয় নেয় চাং-ঘরে। খাদ্য বলতে গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে রাখা কন্দ, বীজ আর শুকনো মাছ মাংস।
পনেরো কুড়িদিন কি একমাস পর ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে সর্বগ্রাসী জল। জেগে ওঠে ডাঙ্গা। ভয়ে গুটিয়ে থাকা মানুষগুলো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে শুরু করে। কারো চাষের ক্ষেত তলিয়ে গেছে নদীগর্ভে। কারো গরু বাছুর ভেসে গেছে বানের জলে। আরও কত সর্বনাশের হাহাকার ধ্বনি ওঠে ঘরে ঘরে। তবে এসবও ওদের গা সওয়া হয়ে গেছে। নিরুপায় মানুষগুলো জানে ফি বছর এই বিপদ ঘাড়ে নিয়েই চলবে ওদের জীবনযাপন। প্রকৃতির এই রোষ ওদের ভবিতব্য। তবে এবারের ক্ষয় ক্ষতি যেন অন্যান্য সব বছরকে ছাপিয়ে গেছে। এরকম বন্যা বহুকাল দেখেনি ওরা। অপেক্ষাকৃত উঁচু গ্রামগুলোও এবার জলের গ্রাস থেকে রেহাই পায় নি।
মোলাই আবার বেরিয়ে পড়ে ওর গরু মোষ নিয়ে। কিন্তু কোথায় ঘাস? দূর দূরান্তেও একফোঁটা সবুজ চোখে পড়ে না। গাছপালা ভেঙ্গে মুচড়ে তলিয়ে গেছে নদীর জলে। বন্যার পর বৃষ্টি থেমে অসহ্য রোদ উঠেছে। দুঃসহ রোদের তাপে বেশিক্ষণ পথ চলাও দুষ্কর। তবু মোলাই চলতে থাকে কোকিলামুখ গ্রামের দিকে। ওখানে ওরা অনেক গাছ লাগিয়েছিল। কেমন আছে ওগুলো? দেখতে হবে।
কোকিলামুখে এসে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায় মোলাই। আদিগন্ত ধূ ধূ করছে স্লেট রঙা পলি মাটি। সবুজের কোনো চিহ্ন নেই কোথাও। চোখ ফেটে জল আসে মোলাইয়ের। ভূতগ্রস্হের মত চলতে থাকে ও। ওদের সব চেষ্টা বানের জলে ভেসে গেছে। হঠাৎ একজায়গায় এসে থমকে দাঁড়ায়। কী ওগুলো? আরও সামনে এগিয়ে বুঝতে পারে অগুন্তি সাপ মরে পড়ে আছে এখান ওখানে ছেঁড়া দড়ির মত। স্তব্ধ হয়ে যায় মোলাই। এত সাপ মরল কেন? কি করে? সাপগুলোর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে চোখের জলে ভেসে যায় মোলাইয়ের গাল আর বুক। কি অসহায় মৃত্যু! সহ্য করতে পারে না মোলাই সে দৃশ্য।
ঝড় ওঠে মোলাইয়ের মনে। যোরহাটের কাছে এক বনকর্মীর সাথে পথে দেখা হয়ে যায় ওর। কথায় কথায় সাপ মরার প্রসঙ্গ তুলতেই লোকটি বলে সাপগুলো আশ্রয়ের অভাবে মারা গেছে। বন্যার সময় ওদের গর্তগুলো সব জলে ভরে গিয়েছিল। তার মধ্যে এখানে কোন উঁচু গাছপালা নেই যাতে ওরা আশ্রয় নিতে পারে। তারপর আবার অসহ্য রোদে গরমে আর খাদ্যের অভাবে সাপগুলো মারা গেছে।
অধীর হয়ে মোলাই বলে, "তবে তো ওখানে অনেক গাছ পোঁতা দরকার। তোমরা আমাকে কিছু গাছের চারা দিতে পারো? আমি পুঁতব!"
হা হা করে হাসে বনকর্মীটি।
"অনেক চেষ্টা হয়েছে আগে। ওই বন্ধ্যাভূমিতে কোন গাছ জন্মাবে না। চারা পুঁতলেও বাঁচবে না। বেগার খেটে কোন লাভ নেই ভাই। বাড়ি যাও। যেমন গরু মোষ চরিয়ে খাচ্ছ তাই করো গে বরং।"
মোলাই দমে না। পরদিনই সোজা গিয়ে হাজির হয় কাছের এক গ্রামের বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী যদুনাথ বেজবরুয়ার বাড়িতে। মোলাই এর অবশ্য যদুনাথের আসল পরিচয় জানা ছিল না। স্কুল ছুট মোলাই শুধু এটুকু জানত যদুনাথ বেজবরুয়ার গাছপালা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান আছে।
যদুনাথ সব শুনে ওকে বুঝিয়ে বলেন, "দেখো, ওই বালি মাটিতে সাধারণ কোন গাছ তো প্রথমেই জন্মাবে না। তবে বাঁশ গাছ লাগিয়ে দেখতে পার। যত্ন করে যদি বাঁচাতে পারো তবে বাঁশগাছের শেকড় খুব শক্ত করে মাটি আঁকড়ে ধরবে আর সাপখোপের ভালো আশ্রয়ও হবে ওই বাঁশ গাছই। পরে ধীরে ধীরে অন্য গাছ লাগানো যেতে পারে।"
"তাই সই।"
মোলাই মোটে পঁচিশটা বাঁশের চারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করতে পারে।
পরদিন থেকেই শুরু হয় মোলাইয়ের একাগ্র সাধনা। বাঁশ গাছ লাগায় মোলাই। দিনরাত এক করে যত্ন করে তাদের। বেঁচে যায় তারা। মোলাই কিন্তু থামেনা। নিরন্তর গাছ লাগাতে থাকে, লাগাতেই থাকে........ প্রতিদিন গাছের অতন্দ্র পাহারায় থাকে সে। বিশ্ব সংসার ভুলে প্রতিটা গাছকে সন্তানের অধিক যত্ন করে। একদিন নয়, দুদিন নয়, মাস বা বছরও নয়........ একটানা তিরিশ বছর! হ্যাঁ, তিরিশ বছর!
তিরিশ বছর পর......
যে বিস্তীর্ণ জায়গা একদিন ছিল ধূ ধূ বালির চর সেখানে এখন সাড়ে পাঁচশো হেক্টরের গভীর অরণ্য। কত শত বৃক্ষ, গুল্ম, লতারা সব জড়াজড়ি করে থাকে সেখানে! মৃত সাপের স্তুপ দেখে যে মোলাই একদিন কেঁদে ভাসিয়েছিল আজ সে তাদের আশ্রয় দিতে পেরেছে। শ খানেকের ওপর প্রজাতির পাখি বাসা বেঁধেছে গাছে গাছে। ছোটখাটো অজস্র রকমের জন্তু জানোয়ার তো আছেই তাছাড়া হরিণ এসেছে সে জঙ্গলে, বুনো মোষ আছে, গন্ডার আছে এমনকি বাঘ, হাতিও থাকে এখন সে অরণ্যে। আর থাকে মোলাই। হ্যাঁ সেও জঙ্গলের ভেতরেই চাং-ঘর বেঁধে থাকে। গরু মোষ পোষে। দুধ বিক্রি করে বাপের মতই। বাকি সময়টা জঙ্গলই ওর ধ্যান জ্ঞান। এই অরণ্যের সৃষ্টিকর্তা সে একা। পালকও সে একাই। বাইরের পৃথিবী জানে না এই মহা অরণ্যের খবর, জানাতেও সে চায় না। নিজের সৃষ্টিতে নিজেই নিমগ্ন সে।
**************
জিতু কলিতা নৌকা ভাড়া নিয়ে একটা ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে সারাদিন নদীতে ঘুরছেন। পেশায় তিনি ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার এবং ফ্রি লান্স সাংবাদিক। ব্রহ্মপুত্রের বুকে নানা রকম পরিযায়ী পাখির ছবি তুলে বেড়াচ্ছেন তিনি এবার। হঠাৎ চোখে পড়ে আকাশে কিছু শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। শকুন? শকুন কোত্থেকে এল এখানে? এদিকে তো শকুন দেখা যায় নি এর আগে? শকুনের গতিবিধি লক্ষ্য করতে করতে তাঁর নজরে আসে নদীর অদূরে ঘন সবুজ অরণ্যের রেখা। থোকা থোকা সাদা ফুলের মত বকের ঝাঁক বসে আছে ঘন সবুজ গাছের মাথায় মাথায়। গলায় ঝোলানো ক্যামেরা ওদিকে তাক করতে করতে আশ্চর্য হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন,
"ওইটা কিসের জঙ্গল মাঝি ভাই? এখানে কোন জঙ্গল আছে বলে তো শুনিনি কোনদিন!"
"ওঃ! ওইটা? ও তো মোলাই কাঠনি (মোলাইয়ের জঙ্গল)!
"মোলাই কাঠনি? কে এই মোলাই?"
"আছে এক পাগল। তিরিশ বছর ধরে গাছ লাগিয়েই যাচ্ছে।
"একা?"
"হ্যাঁ, একাই।"
"নৌকা ভেড়াও। আমি যাব ওখানে।"
"পাগল নাকি? অনেক হিংস্র জন্তু জানোয়ার আছে ঐ জঙ্গলে। আমরা ঢুকি না ওখানে।"
যোরহাট ফিরে জিতু সটান পৌঁছে যান ফরেস্ট অফিসে।
"মোলাই কাঠনি সম্পর্কে কি তথ্য আছে আপনাদের কাছে?"
"মোলাই কাঠনি? সে আবার কি? নাম শুনিনি তো এই জঙ্গলের? কোথায় পেলেন আপনি এ খবর?"
"খবর পাই নি। নিজে চোখে দেখে এসেছি। কোকিলামুখের কাছে এত বড় একটা জঙ্গল অথচ আপনারা কোনো খবরই রাখেন না?"
বনকর্মীরা এ ওর মুখের দিকে তাকান।
কিছুদিনের মধ্যেই নৌকায় করে সরেজমিনে তদন্ত করতে বেরোন বনকর্মীরা। গিয়ে তাদের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। এত বড় একটা জঙ্গল এখানে অথচ তারা জানতেই পারেন নি!! ভারী আশ্চর্য তো!
তবে একটা রহস্যের সমাধান হল। এতদিন তাঁরা বিস্তর মাথা ঘামিয়েও বুঝতে পারেন নি যোরহাটের কাছ থেকে মাজুলির দ্বীপে যাবার পথে হাতির পালগুলো চার পাঁচ মাসের জন্য কোথায় গায়েব হয়ে যায়! তারপর আবার তাদের প্রকাশ্যে দেখা যায় বাচ্চা কাচ্চা সমেত। এই মোলাই কাঠনি তাহলে ওদের বাচ্চা দেবার সেই নিভৃত নিরাপদ জায়গা!
না,বনকর্মীরা সেবার মোলাইয়ের দেখা পান নি। সে তখন এতবড় জঙ্গলের কোন প্রান্তে কোন গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত তা কেউ জানে না।
তবে জিতু কিন্তু হাল ছাড়েন না। জাত সাংবাদিক তিনি। স্টোরি পেয়ে গেছেন। এত সহজে তো হাল ছাড়লে চলবে না। মোলাই কাঠনির আশে পাশে ঘুরঘুর করেন। সাহস করে ঢুকেও যান কখনো সুঁড়িপথ ধরে জঙ্গলের ভেতর।
এরকমই একদিন হঠাৎ জিতুর চোখে পড়ে হাতে পায়ে কাদা মাটি মাখা গামছা পরিহিত একজন মধ্যবয়সী মানুষ হাতে শাবল নিয়ে এদিকেই আসছে। ঘাবড়ে গিয়ে জিতু একটা মোটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। অচেনা মানুষ! কি উদ্দেশ্য বলা তো যায় না! আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখেন মানুষটার ওপর।
একটু পরেই সেই মানুষটা চিৎকার করে ওঠে,
"তোমার ঠিক পেছনেই বুনো মোষ! পালাও!"
জিতু আরও ঘাবড়ে গিয়ে এতক্ষণ যাকে ভয় পাচ্ছিলেন দৌড়ে এসে তার ঘাড়েই হুমড়ি খেয়ে পড়েন।
মোলাইয়ের সাথে এভাবেই প্রথম মোলাকাত হল জিতুর।
ধীরে ধীরে পরিচয় গভীর হয়। মোলাই তার কুঁড়েতে নিয়ে যায় জিতুকে। সেখানে এখন মোলাইয়ের নববিবাহিতা স্ত্রী বিনীতাও থাকে মোলাইয়ের সাথে। জঙ্গলের বাঁধন আলগা করে সাত পাঁকের বাঁধনে বাঁধা পড়তে বেলা অনেকটাই গড়িয়ে গেছে মোলাইয়ের।
জিতু কলিতা মোলাইকে জানান যে তিনি মোলাইয়ের কর্মকান্ডের কথা সারা পৃথিবীর মানুষকে জানাতে চান। মোলাই যে একা হাতে কি অসাধ্য সাধন করেছে তা পৃথিবীর জানা দরকার।
মোলাই আশ্চর্য হয় এ কথায়।
"আমি একা তো এ জঙ্গল সৃষ্টি করি নি! আমি শুরু করেছিলাম বটে তারপরে তো নদী, বাতাস, পাখি, বনের পশুরা সবাই মিলেই এই জঙ্গল তৈরি করেছি আমরা। এখন তো গাছে ফল ধরে, বীজ পাকে সেই বীজ মাটিতে পড়ে আপনা আপনি জঙ্গল বেড়ে যাচ্ছে। তবে এটা ঠিক আমি এখনও রোজ কম পক্ষে একটা করে গাছ লাগাই।"
মোলাই ভাবে, এ তো যে কেউই করতে পারে। এটা কি আবার বলবার মত কোনো কাজ হল? ওকে কে বোঝাবে যে, আসলে এই সহজ কাজটাই অন্য সবার কাছে কত কঠিন!
মোলাই চায় না ওর কথা সবাই জানুক। কারণ এসব কথা বাইরে বেশি প্রচার হলে দুষ্ট লোকের ভীড় হবে জঙ্গলে। বুনো জীবজন্তুর ক্ষতি করবে তারা। তাছাড়া মোলাইয়ের বেশি কথা বলারও সময় হয় না। সে কথা বলার চাইতে দা শাবল কোদাল নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। নিঃশঙ্ক বনদেবতার মত বনের অতন্দ্র প্রহরী সে।
জিতু দিনের পর দিন নানা সময়ে বিনীতার সাথে কথা বলে জেনে নেন মোলাইয়ের কর্মকান্ড। মস্ত কোন জারুল বা শিমূল গাছের নিচে আলো ছায়ার জাফরিতে বসে জিতু শোনেন কিভাবে বুনো জন্তুর উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রামবাসীরা বনের গাছ কাটতে এলে মোলাই বুক চিতিয়ে গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ায়। মোলাই বলে, "আগে এখানে আমাকে কেটে টুকরো টুকরো কর। তারপর তোমরা জঙ্গলের গাছে কুড়ালের কোপ বসাতে পারবে। তার আগে নয়।"
গ্রামবাসীরা হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেছে তারপর।
বিনীতা দুঃখ করে বলে, "আমাদেরও অনেক গরু মোষ বাঘের পেটে গেছে। তবে তার জন্য মোলাইয়ের কোনো তাপ উত্তাপ নেই। বুনো জন্তু জানোয়ারের সামান্য ক্ষতিও ও সহ্য করতে পারেনা।"
জিতু বিনীতার কাছেই শোনেন মোলাই এখন আরও একটা নতুন নদী চরে ক্রমাগত গাছ লাগাচ্ছে। ভূমি ক্ষয় থেকে পৃথিবীর সবচাইতে বড় নদী দ্বীপ মাজুলিকে রক্ষা করার অসম্ভব এক প্রতিজ্ঞা নিয়ে মোলাই নিঃশব্দে লড়াই করে যাচ্ছে।
কিছুদিন পর জিতু সমস্ত তথ্য দিয়ে একটা স্টোরি লেখেন। যাদব পায়েং এর এই আশ্চর্য কাহিনী জমা দেন 'দৈনিক জন্মভূমি'র দপ্তরে। সম্পাদক মশাই তো সেই স্টোরি দেখে হেসে অস্থির। জিতুকে বলেন, "এসব উদ্ভট গল্প কোত্থেকে যোগাড় করেন মশাই! কল্পনারও তো একটা লাগাম পরাবেন, নাকি? ইচ্ছেঘোড়া ছোটালেই হল? যত্ত সব!"
জিতু কলিতার সেই স্টোরি সম্পাদকের ড্রয়ারের অন্ধকারে পড়ে থাকে দীর্ঘ আট মাস। তারপর হঠাৎ একদিন সম্পাদক মশাইয়ের টনক নড়ে। তিনি জানতে পারেন জিতু মোটেই কল্পনার জাল বোনেন নি। সত্যিই যাদব পায়েং ওরফে মোলাই বলে একজন মানুষ আছে এই ধরাধামে। সত্যিই সে এক অদ্ভুত কীর্তি ঘটিয়ে ফেলেছে।
জিতু কলিতার সেই লেখা প্রকাশ পায় আসামের এক সংবাদপত্রে। তারপর সর্বভারতীয় ইংরেজী দৈনিকে।
এরপরেই সৃষ্টি হতে থাকে এক আশ্চর্য ইতিহাস। না, ভুল হল একটু। ইতিহাস তো তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে সৃষ্টি হচ্ছিলই লোকচক্ষুর অন্তরালে। এবার যবনিকার আড়াল সরে যায় সেই ইতিহাসের ওপর থেকে। মানুষ জানতে পারে অরণ্য-মানব যাদব পায়েং এর কথা। দেশে বিদেশে মাতামাতি শুরু হয়ে যায় অতি সাধারণ মিশিং উপজাতির স্কুল ছুট এক মধ্যবয়সী মানুষকে নিয়ে। যে নিজেও হয়ত জানত না যে কি অসাধ্য সাধন সে করে ফেলেছে একেবারে একক প্রচেষ্টায়! পরিবেশ রক্ষায় কি অসামান্য অবদান তাঁর!
আজকাল যখন তখন যাদব পায়েং এর ডাক পড়ে গৌহাটি, দিল্লি, ফ্রান্স,ইটালিতে। তাকে বাধ্য হয়ে জুতো জামা কিনতে শহরে ছুটতে হয়। খালি গায়ে খালি পায়ে কি আর দেশ বিদেশের বাঘা বাঘা লোকের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো যায়!
পুরস্কার আর সম্মানের ঝুলি উপছে পড়তে থাকে যাদবের। পদ্মশ্রী খেতাব দেন সরকার বাহাদুর।
মোলাই কিন্তু আগের মতই নির্বিকার। সে অবলীলায় বলে, "দয়া করে আমাকে এপ্রিল থেকে জুন কোথাও যেতে বলবেন না। জঙ্গলে তখন আমার অনেক কাজ।"
দেশ বিদেশ থেকে লোক আসে তার সাক্ষাৎকার নিতে, ডকুমেন্টারী বানাতে। মোলাই কাদা মাটি মাখা হাত পা নিয়ে খালি গায়ে গামোসা (গামছা) গলায় ঝুলিয়ে বসে যায় কথা বলতে, গল্প করতে। সে যে মাটিরই সন্তান! এতেই সে স্বচ্ছন্দ!
মোলাইয়ের আজকাল মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় ওর হাত দেখে বলা সেই জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎবাণী, "তোমার ভাগ্য বাঁধা আছে প্রকৃতির সাথে।" এখন যেন তার অর্থ কিছুটা বুঝতে পারে সে।
মোলাই চলে নতুন চরে নতুন গাছের চারা বুনতে। সাংবাদিকের দল তার পিছু নেয়! মোলাই তাদের বলে, "আমার কাছে এসে সময় নষ্ট না করে আপনারা বরং চেষ্টা করুন যাতে প্রতিটা স্কুলের প্রত্যেকটা বাচ্চা যেন অন্তত একটি করে গাছ লাগায় আর যতদিন স্কুলে থাকবে তারা নিজের নিজের সেই গাছের যত্ন নেয়। ছোট থেকে গাছের প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠলে ওরা আর কোনদিন গাছ কাটবে না। পরিবেশ ধ্বংস করবে না।"
মোলাই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যায় সামনে। ওর এখনও অনেক কাজ বাকি। আরো অনেক অনেক গাছ লাগাতে হবে যে! গাছ বাঁচলে জীব জন্তু বাঁচবে। জীব জন্তু সবাই বেঁচে থাকলে তবেই না মানুষ সুস্থ ভাবে এই পৃথিবীতে আরও বহু বহুদিন বেঁচে থাকতে পারবে।
গ্রাম্য অশিক্ষিত অতি সাধারণ মানুষ মোলাই পেয়ে গেছে পৃথিবীর সুস্থতার চাবিকাঠি।
কিন্তু আমরা.......?
মানুষ ,জীব, জন্তু, গাছপালা, কীটপতঙ্গাদি পৃথিবীর ভৌগলিক অবস্হার উপর নির্ভর করে বাঁচে। ঠাণ্ডা, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, গরম, মরুভূমি, নাতিশীতোষ্ণ, বনাঞ্চল জলভূমি ইত্যাদি জায়গার প্রাণী সমস্ত, গাছপালা সবই প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে বাঁচে। মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে সেইমত মানুষের চাহিদাও বাড়ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার ও বাড়ছে। অথচ প্রাকৃতিক সম্পদ তো বাড়ছে না। কারণ যুগ যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসা প্রাকৃতিক সম্পদ এর সংরক্ষণের কথা কোনদিনই যেমন ভাবা হয়নি তেমনি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আমরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে দেখি খোলা বিদ্যুতের তারে কত মানুষের কত ভাবে মৃত্যু হচ্ছে। তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা বা অতিরিক্ত সাবধানতা নেই। এক ই ভাবে আজও বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ হচ্ছে মানুষ।
সরকার এর তরফ থেকে বিকল্প হিসেবে মিউনিসিপ্যালিটি র সমস্ত ওয়ার্ডে হসপিটাল, কারখানা , চা- বাগান গুলিতে , বাস , ট্রেন গুলিতে বিদ্যুৎ এর পাশাপাশি সোলার বিদ্যুৎ চালু করা উচিত। আবাসন গুলিতে ও সোলার বিদ্যুৎ চালু করা উচিত। বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বারে বর্ষাকালে। আজ পর্যন্ত এর কোন সুরক্ষার সেভাবে কোন ব্যবস্থা করা যায়নি। সৌর বিদ্যুতের পাশাপাশি বায়ু বিদ্যুৎ এর ও প্রয়োজন খুব বেশি। পাহাড়ের উচ্চতায় যে হাওয়া বয় সেখানে বায়ু চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কে কাজে লাগানো যেতে পারে। সূর্যের রশ্মি বা বাতাসের প্রাচূর্য আমরা জানি। এখানে দূষনের ব্যাপার নেই। কিন্তু কয়লা, তেল, গ্যাস খনিজ পদার্থ পুড়লে প্রতিনিয়ত বাতাসে মিশে যায় বিষাক্ত কার্বনডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, হেক্সা ক্লোরোকার্বন। এসমস্ত কারণে বায়ু স্তরে তাপমাত্রা বাড়ে। বায়ুস্তরে ছিদ্র হয় ফলে অতিবেগুনী রশ্মি ভুমণ্ডলএ প্রবেশ করে। এতে নানান সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে অসুখ বিসুখ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মারণ ব্যাধির সৃষ্টি হয়েছে। কার্বন নিঃসরণ এর মাত্রা কমানোর একান্ত প্রয়োজন। মরুভূমি হওয়ার থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র গাছ। গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নিয়েও সাহায্য করতে পারে। একজন মানুষের জন্য একটা বড় গাছের প্রয়োজন। সেইমত গাছের সংখ্যা কোথায়? জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ এই বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা ও গাছ কাটা। প্রকৃতি প্রয়োজনে নিজেকে ঠিক করে নেয়। ভয়ংকর খরা, বন্যা, মহামারী, ভুমিকম্প ইত্যাদি নানাভাবে। আমরা প্রকৃতির ব্যাথা বুঝে কাজ করলে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের পড়তে হত না। এখন তো সময় ও নেই তবুও আমরা প্রকৃতির দূষণ রোধ করে প্রকৃতির সাথে চলার চেষ্টা করলে যদি আমাদের হাঁপানি, ফুসফুসের রোগ ( যা এখন ঘরে ঘরে) মারণ রোগের হাত থেকে কিছু যদি রক্ষা করা যায় সেই চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য।
সবুজ কার্পেট, নীল আকাশ, সাদা মেঘের আনাগোনা, পিচ কালো রাস্তা, বাহারি জংলী ফুলে ভরা দক্ষিণের পাহাড়ি ছোট্ট শহরটি মন কাড়বে দেশ-বিদেশের যে কোন পর্যটকের। শরতের নীলাকাশ, সাদা মেঘ, পুজোর ছুটি ঘন্টা মানেই বেড়িয়ে পড়ার ডাক আসে। বাঙ্গালী-র হৃদয় জুড়ে তখন নদী- পাহাড়-সমুদ্রের হাতছানি। সেই বেড়িয়ে পড়ার টান উপেক্ষা করা যখন সাধ্যাতীত, অগত্যা বেড়িয়ে পড়তেই হল। এবারের গন্তব্য চা গালিচায় মোড়া পশ্চিমঘাট পর্বতশ্রেণির ভগবানের নিজের দেশের অন্যতম সুন্দর শহর মুন্নার।
দেশের পর্যটন মানচিত্রে স্বমহিমায় নিজেকে পরিচিত করেছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ কিংবা পূর্ব থেকে পশ্চিম সব প্রান্তের ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে মুন্নার পরিচিত। ভোর থেকে সন্ধ্যে মুন্নার-এর রূপ বদলায় প্রতি প্রহরে। বাহারি ফুল, চা-গালিচা, মেঘের খেলা, প্রথম রোদের ছটা, সব মিলিয়ে নৈসর্গিক মুন্নার। ছোট থেকে চা-এর শহরে বড় হলেও, দক্ষিণের এই বাগিচা শহর মন কেড়েছে অনেক বেশি। স্বাদে-গন্ধে দার্জিলিং-এর থেকে পিছিয়ে থাকলেও শৃঙ্খলিত বাগিচায় আর সবুজে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে এই শৈল শহরটি।
পুজো মানেই বাঙ্গালির বেড়ানো, তবে বেশ কিছু বছর রাজ্যের বাইরে থাকায় সেই অভ্যেসে ভাঁটা পড়েছে, কিন্তু পিছুটান যাদের জন্য সেই বন্ধুরা যখন বলে, চল পুজোতে কোথাও একটা বেড়িয়ে পড়ি, তখন মনও বলে, 'বাজল ছুটির ঘন্টা।' চলো বেড়িয়ে পড়ি, তিন বন্ধু প্রায় দু'হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছল সিলিকন ভ্যালি অফ ইন্ডিয়া-তে, আমাদের বর্তমান ঠিকানা এখানেই। আমরা কর্তা-গিন্নি তো আগেই তৈরি।
দশমীর দিন রাতে আমরা পাঁচমূর্তি বেড়িয়ে পড়েছিলাম মুন্নার-এর উদ্দেশ্যে। এবারের ট্রিপের বাড়তি উত্তেজনা ছিল সেল্ফ ড্রাইভিং, আমি নই, আমার কর্তার। মাঝ রাতেই বেড়িয়ে পড়লাম আমরা। গাড়ি ছুটছে হুসুর-ধর্মপুরী-কৃষ্ণাগিরি হয়ে সালেম এর দিকে। জাতীয় সড়ক -44 দিয়ে গাড়ি চলছে বেশ দ্রুত গতিতেই। পেছনে বসে থাকা এক বন্ধু বলে উঠল- ' আমরা longest highway দিয়ে যাচ্ছি।' শ্রীনগর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত এই পথ, বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি হল। সালেম পৌঁছতেই মুন্নার যাওয়ার রাস্তা দু'দিকে ভাগ হয়ে গেল। একটি আনামালাই রিজার্ভ ফরেস্ট এর মধ্যে দিয়ে, অন্যটি দিন্দিগুল হয়ে। দিন্দিগুল হয়ে মুন্নার পৌঁছতে বেশ কয়েক কিলোমিটার বেশি হলেও, পাহাড়ি পথ কিছুটা কম। আমরা সেই রাস্তাই ধরলাম। মাঝে বেশ কয়েকবার চা-এর বিরতি, হাসি ঠাট্টায় ঘুম খুব বেশি থাবা বসাতে পারেনি।
দিন্দিগুল ছাড়িয়ে থেনি-র কিছু আগে ইডলি, ধোসা-যোগে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার রওনা হলাম আমরা। থেনি পেড়িয়ে যেতেই কিছুটা চড়াই শুরু হল, পপ্পুরা পেড়িয়ে আরেকটু ওপরে উঠতেই পাহাড়ি গন্ধ ভেসে এলো, রাস্তায় হালকা মেঘের আনাগোনা, পাখিদের কিচিরমিচির জানিয়ে দিল, 'ওয়েলকাম টু হিল্স।' ঘন সবুজ জঙ্গলের মাঝে কালো পিচ রাস্তা, আর নিস্তব্ধতায় মোড়া চারিদিক প্রথমেই মন কেড়ে নিয়েছে। গাড়ি ছুটছে মুন্নার-এর দিকে, যতদূর চোখ যায়, শুধুই সবুজ। পাহাড়ের ঢাল ধরে সুসজ্জিত চা বাগান। সবাই যেন নিয়ম মেনে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে এখানে। কিছুটা যেতেই গ্যাপ রোড, যেই পথে না এলে মুন্নারের সৌন্দর্য্য অধরা থেকে যায়। মসৃণ পথ, দু'ধারে সবুজ গালিচা আর দূরে পশ্চিমঘাট পর্বতের নীলাভ মহিমা।
আমাদের হোটেল ছিল মুন্নার মার্কেট-এর কাছেই। চার্চ-এর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেই রেইনবার্গ হোম-স্টে হল আমাদের দু-দিনের ঠিকানা। ফুল দিয়ে সাজানো ছোট্ট বাগান মন কেড়েছে প্রথম দেখাতেই। এজিলিয়া, দেব-কাঞ্চন ফুলে ভরা বাড়ির উঠোন। চটজলদি ফ্রেশ হয়ে, দুপুরের খাবার পর্ব সেরেই বেড়িয়ে পড়লাম পথামেদু ভিউ পয়েন্টের দিকে। আকাশে তখন মেঘের আনাগোনা, তাই তড়িঘড়ি আমরা রওনা হলাম আত্তুকাড ওয়াটার ফলস-এর দিকে। পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে জলরাশি। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে পা বাড়ালাম হোটেলের দিকে। ডিনার সেরে ঘরে যেতেই দু-এক পশলা বৃষ্টি, কিছুটা আতঙ্ক নিয়েই ঘুমোতে গেলাম, কি জানি কাল মুন্নার যদি মুখ ভার করে থাকে।
সকাল হতেই চার্চ-এর ঘন্টার আওয়াজ কানে এলো, এক ফালি রোদের ছটা দূরের পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে হোম-স্টে- এর উঠোনে। হালকা কুয়াশা আর রোদের মাখামাখিতে এক মায়াবি সকালের সাক্ষী হলাম আমরা। মনটাও বেশ খুশি, মুন্নার হাসছে। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে সাতটা। আমরা সবাই তৈরি, বেড়িয়ে পড়লাম টপ স্টেশনের উদ্দ্যেশ্যে। মুন্নার শহর থেকে টপ স্টেশনের দূরত্ব 34কিলোমিটার, অব্যক্ত এক সৌন্দর্য্য। একের পর এক চা-বাগানের অবর্ণনীয় রূপ, দূরের পাহাড়গুলো যেন আরও মোহময়ী করে তুলেছে মুন্নারকে। এই রাস্তা ধরে যেতেই পড়বে ফটো পয়েন্ট, মাত্তুপেট্টি ড্যাম, ইকো পয়েন্ট, কুন্ডালা লেক। আমরা প্রথমেই পৌঁছই টপ স্টেশন ভিউ পয়েন্টে, 20টাকা করে টিকিট কেটে মিলল টাওয়ার-এ ওঠার অনুমতি। চারিদিকে ওয়েস্টার্ন ঘাটের অপরূপ শোভা, মোহিত করবে সকলকে, বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে নেমে এসে ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম মাত্তুপেট্টি ড্যাম এর দিকে। ফিরতি পথে চোখে পড়ল ইন্দো-সুইস ডেয়ারি ফার্ম, তবে সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই, বেশ কিছুটা সময় ওই পথে কাটিয়ে আমাদের এবারের গন্তব্য এরাভিকুলম ন্যাশনাল পার্ক। মুন্নার মূল শহর থেকে 8 কিলোমিটার দূরে। পৌঁছাইতেই দেখি লম্বা লাইন, টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে তখন শুধু একটাই কথা ভেবে চলেছি, একবার যেন দেখা পাই।
একশো সত্তর টাকা করে প্রতিজনের টিকিট, আর ক্যামেরার জন্য 50টাকা, টিকিট কেটেই নিয়ম-নীতি পড়তে গিয়েই প্রথম চোখ আটকাল, তার দেখা পাওয়া নাকি নিয়মিত নয়, একটু মনটা খারাপ হল, এদিকে আকাশও তখন মুখ ভার করছে। সে যা হোক, বাসে উঠে বসতেই কুয়াশা ঘিরে ধরছে চারিদিকে। মূল পার্কের গেটের সামনে বাস থেকে নেমে হেঁটে উঠতে হবে অনেকটা। শুরু হল আমাদের যাত্রা, বহু রকমের ছোট বড় গাছে ভরা পাহাড়ের গা। হঠাৎই থমকে গেলাম, ওই তো ওপরে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা, ওদের দেখতেই তো এতদূর আসা। সেই নীলগিরি তাহর (nilgiri tahr )। দল বেঁধে নীচের দিকে নামছে ওরা। একটু আশঙ্কা থাকলেও জানা ছিল এদের দেখা মিলবে। পশু-পাখি আমাকে কখনও নিরাশ করেনি। এই অবলুপ্তির পথে যাওয়া প্রাণীটির যে দেখা পাব, সে ভরসা আমি সকলকে দিয়েই এসেছি। চলল ফটো-সেশন। ঠান্ডা বাড়ছে, এবার নীচে নেমে আসার পালা। যদিও বিশেষ এই প্রাণীটিকে চাক্ষুষ করে মনে তখন উষ্ণ উন্মাদনা।
রাতে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম হোমমেড চকলেট কিনতে, সঙ্গে টুকিটাকি আরও কিছু। আজই শেষরাত এই সবুজ মলমল চা-এর গালিচা শহরে। তবে এখনও কিছুটা বাকি আছে, সকাল হতেই আবার গ্যাপ রোড। মুন্নার-এ আমাদের শেষ সকালের আকাশ ছিল নীলে মোড়া। আর তাতেই গ্যাপ রোডের শোভা বেড়েছে দ্বিগুণ। পুরো রাস্তায় দু' পাশে চা-বাগান আর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা হৃদয়ের ভ্রমণ কুঠুরিতে যত্নে রাখব কথা দিলাম।
No comments:
Post a Comment