Tuesday, June 6, 2023




 

সম্পাদকের কথা 

সদ্য পার করে এলাম আর একটি বিশ্ব পরিবেশ দিবস। চতুর্দিকে মহা-সমারোহে পালিত হল দিনটি। পাড়ায় পাড়ায় মঞ্চ বেঁধে, বৃক্ষরোপন করে, শোভাযাত্রা শেষে, জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে, সমাজ মাধ্যমে দুর্দান্ত ছবি দিয়ে আমরা বোঝালাম যে, আমরা প্রত্যেকেই পরিবেশপ্রেমী। সচেতন হচ্ছি সকলে- ভেবে ভাল লাগছে। কিন্তু এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের যে থিম তা নিয়ে খুব কম বলতে শুনলাম প্রায় সকলকেই। একটু মনে করিয়ে দিই। এবারের থিম ছিল  SOLUTIONS TO PLASTIC POLLUTIONS। কয়েকটা তথ্য দিচ্ছি। তাহলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে।  সারা বছরে পৃথিবীতে ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক যায় মহাসমুদ্রে। পরিসংখ্যান বলছে, এই প্লাস্টিকের ফলে অন্তত ১০ লক্ষ জলজ জীবন প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ২৩২ মিলিয়ন মেট্রিক টন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয় প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে। ২.৫ মিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল ফেলা হয় প্রতি ঘন্টায়। চমকানোর মতো আরও একটা তথ্য দিচ্ছি। একটি প্লাস্টিক বোতলের পুরোপুরি নষ্ট হতে সময় লাগে ৪৫০ বছর। পরিবেশ দিবস মানেই গাছ লাগাতে হবে তা কিন্তু নয়। বহুভাবে পরিবেশকে আমরা ভাল রাখতে পারি। প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে পরিবেশের স্বাস্থ্য ঠিক রাখবার জন্য এই মুহূর্তে দরকার reuse, recycle, and reorient and diversify.... প্লাস্টিকের দ্রব্য বা বস্তু যেখানে সেখানে ফেলে দিয়ে দূষণ না ঘটিয়ে পুনর্ব্যবহার করতে পারলে  অর্থনৈতিক দিক থেকেও লাভবান হওয়া যায়। এখানেই দরকার রিসাইক্লিং পদ্ধতি। রিওরিয়েন্ট ও ডাইভার্সিফাই করা মানে এমন এক পরিবেশ তৈরি করা যাতে বিকল্প হিসেবে ধীরে ধীরে প্লাস্টিকের বদলে অন্য কিছু আসে সে চেষ্টা করা। এই বছরের পরিবেশ দিবসে আমাদের লক্ষ্য সেটাই। সাম্প্রতিক এই তাপপ্রবাহের কথাই ধরা যাক। আমাদের রাজ্যের উত্তরে এরকম অবস্থা হবে আমরা কখনও ভাবিনি। কিছুদিন আগেও  ডুয়ার্স অঞ্চলে সারা বছর গায়ে কিছু দিতে হত রাতের বেলায়। টানা বৃষ্টিতে দশ দিন পনেরো দিন সূর্যের মুখ দেখা যেত না। কোচবিহার থেকেই দেখা যেত ভুটান পাহাড়ের নীল রেখা। কোথায় সেসব? বিগত দুই দশকে উত্তরের ৩০ শতাংশ গাছ অরণ্যভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। জঙ্গলে খাদ্য সংকট দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিক বাসভূমি ও খাদ্যের অভাবে বনচররা চলে আসছে লোকালয়ে। বাড়ছে মানুষ পশু সংঘাত। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। পাহাড় থেকে সমতল আজ প্লাস্টিকে মোড়া। সন্দকফু ট্রেক করতে গিয়ে যেভাবে আমরা প্লাস্টিকের বোতল থেকে শুরু করে অন্যান্য বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সেটা মারাত্মক অশনি সঙ্কেত। একই দশা জঙ্গলেও। আমরা যাচ্ছি ফুর্তি করতে। টুরিস্ট হয়ে। কিন্তু ট্রাভেলার হতে পারিনি। ফল? বিষময়। 

থামুক এই দূষণ। সচেতন হই আমরা। সচেতন করি অন্যকে। পরিবেশকে স্বাস্থ্যকর রাখার বার্তা যদি ছড়িয়ে দিই, যদি একজনকেও পরিবেশ নিয়ে ভাবতে পারি তবেই সার্থক দিনটি! 


মুজনাই অনলাইন জৈষ্ঠ্য  সংখ্যা ১৪৩০ 

                                              রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক) 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন জৈষ্ঠ্য সংখ্যা ১৪৩০


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 


জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভাদুড়ী, বেলা দে, চিত্রা পাল, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, 

শ্রাবণী সেনগুপ্ত, উৎপলেন্দু পাল,  রণিতা দত্ত,  

দেবর্ষি সরকার, রাজর্ষি দত্ত, অলকানন্দা দে, 

কাকলি ব্যানার্জী মোদক, লীনা রায়, রীনা মজুমদার, 

সুনন্দ মন্ডল, সারণ ভাদুড়ী, চন্দ্রানী চৌধুরী, 

অভিজিৎ সরকার, এস সাহা (সঞ্জয়), রথীন পার্থ মণ্ডল, 

কবিতা বণিক, জয়িতা সরকার, প্রতিভা পাল, 

দেবদত্তা লাহিড়ী, বিনয় বর্মন, আশীষ কুমার বিশ্বাস, 

রীতা ভদ্র দত্ত, রেজাউল করিম রোমেল, রূপক রায়, 

শ্রেয়সী সরকার, দেবযানী সেনগুপ্ত, মুনমুন সরকার, 

মজনু মিয়া, শঙ্কর জানা, অনুস্মিতা বিশ্বাস






ক্রোড়পত্র 





শিল্পী- অনুস্মিতা বিশ্বাস




জনজীবনে রবীন্দ্রনাথ
দেবর্ষি সরকার

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "বাংলার অসাধু ভাষাটা খুব জোরালো ভাষা এবং তাহার চেহারা বলিয়া একটি পদার্থ আছে। আমাদের সাধু ভাষার কাব্যে এই অসাধু ভাষাকে একেবারেই আমল দেওয়া হয় নাই কিন্তু তাই বলিয়া অসাধু ভাষা বাসায় গিয়া মরিয়া আছে তাহা নহে। সে আউলের মুখে, বাউলের মুখে, ভক্ত কবিদের গানে, মেয়েদের ছড়ায় বাংলাদেশের চিত্তটাকে একেবারে শ্যামল করিয়া ছাইয়া রহিয়াছে। সেইসব মেঠো গানের ঝরনা তলায় বাংলা ভাষার হসন্ত শব্দগুলা নুরীর মত পরস্পরের উপর পড়িয়া টুনটুনি শব্দ করিতেছে। আমাদের ভদ্র সাহিত্য পল্লীর গম্ভীর দিঘিটার স্থির জলে সেই শব্দ নাই, সেখানে হসন্তর ঝংকার বন্ধ। আমার শেষ বয়সের কাব্য রচনায় আমি বাংলার এই চলতিভাষার সুরটাকে ব্যবহারে লাগাইবার চেষ্টা করিয়াছি।" 
জীবনস্মৃতি পড়লে আমরা অবগত হতে পারি যে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার পদ্মার দুপারের ঠাকুরবাড়ির জমিদারির এলাকাগুলো যেমন, শিলাইদহ ,কুষ্টিয়া ,পতিশর এইসব অঞ্চল গুলোতে জমিদারি পরিলক্ষনের ঠিক আগে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথকে পরামর্শ দিয়েছিলেন 'এবার আসমানদারী ছেড়ে জমিদারি দেখো।' এক বক্রতির মাধুর্যপূর্ণ শ্লেষ বাক্য। এই বাক্যই পরিবর্তন করে দিল, পরিবর্তন করে দিল সেটা বলতে কিঞ্চিৎ ভুল বলা হবে বলা চলে মোর ঘুরিয়ে দিল রবি কবির জীবনের সরল সহজ গতিপ্রবাহ কে তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গেল কবি জীবনের লেখালেখির বিস্তৃত পটভূমি কবি মানুষের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি।

রবীন্দ্রনাথের লোকজীবনের ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে যদি শক্ত মেরুদন্ড মাঝখানে দাঁড় করিয়ে সেই মেরুদন্ডকে কেন্দ্র করে কোন সাহিত্য সৃষ্টি করতে হয় তাহলে প্রথমেই বলতে হয় শিলাইদহ পদ্মার জলের সাথে ভেসে চলা কবির সাহিত্য ভাবনা। কবি কেবল পদ্মার জলের সাথে নিজের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন তা নয় তিনি নৌকা থেকে নেমে গিয়ে সহজে সরল ভাবে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেম তাদের জমিদারের বিস্তৃত পরগনাগুলি, কথা বলেছিলেন দুর্ভিক্ষ পীড়িত অভাবগ্রস্থ মানুষদের সাথে তাদের জীবনকে উপলব্ধি করেছিলেন কবি নিজের আসমানদারীর জীবন দিয়ে। বলা চলে এইসব ক্ষুদ্রাদিক্ষুদ্র ঘটনাই অমরত্তের কালি দিয়ে বিজয়গাথা লিখে গিয়েছিল রবীন্দ্র সাহিত্যর বিশ্ব সাহিত্যের নিখিল দরবারের চৌকাঠে, যেই চৌকাঠে মাথা রেখে আমরা দিনরাত বিশ্রাম যাপন করি খুঁজে, পাই মনের আনন্দ আত্মার শান্তি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিস্তৃত বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি যে শিলাইদহে পদ্মার উপর দিয়ে বোটে করে ভেসে চলবার সময় বোটে রবীন্দ্রনাথ এনে জড় করেছিলেন বিচিত্র ভঙ্গির কিছু গ্রাম্য হস্তশিল্পের নিদর্শন। সেগুলোও হয়তো কোন বিস্তৃত পথ একে দিয়েছিল রবীন্দ্র সাহিত্যের বিজয় রথের জন্য। 
কিন্তু কোথা থেকে এই আগ্রহ জন্মেছিল কবির মনে? 
এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে যদি উত্তর খুঁজতে হয় তাহলে প্রথমে উল্লেখ করতে হবে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের কথা। গ্রাম্য জীবন, অভাবের জীবন থেকে উঠে আসা ঠাকুরবাড়ির এই সমস্ত মেয়ে বউ ও দাসীদের থেকেই কবি সমগ্র রবীন্দ্ররচনাবলির পটভূমি নিংরে নিয়েছিলেন। তাদের মুখেই প্রথম রূপকথা ছড়া ইত্যাদি শুনেছিলেন শুনেছিলেন 'শৈশবের মেঘদুত', 'বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান।' রামায়ণের করুন বর্ণনা পড়ে কবিকে চোখের জল ফেলতে দেখলে যে দিদিমা কেড়ে নিতেন রামায়ণ তিনি বিছানায় শুয়ে কবি কে শুনাতেন দৈত্যপুরী রাজকন্যার গল্প। দাসীদের মুখ থেকে তিনি শুনেছিলেন রূপকথার কথা। ছিন্নপত্রাবলী পড়ে জানি সে দাসীর নাম তিনকড়ি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "কোন কালে ছেলেবেলায় তিনকড়ি দাসীর কাছে রাত্রে মশারির মধ্যে শুয়ে রুপকথার প্রসঙ্গে একটা বর্ণনা শুনেছিলাম। তেপান্তরের মাঠ জোছনায় ফুল ফুটে রয়েছে। যখনই জোছনা রাত্রে চড়েবেড়াই তিনকড়ি দাসীর সেই কথাটি মনে পড়ে।" অনুমান করি এরাই রবীন্দ্রনাথের মনে লোকযান বিষয়ে আগ্রহ শিশু বয়সে উসকে দিয়েছিল। কিশোর বয়সের সেই উৎসাহ আরো গভীর হয়ে ওঠে হিন্দু মেলার বাৎসরিক আয়োজনের ফলে, যে মেলায় যাবতীয় দেশী শিল্পের সমাবেশত হতো, মাটির পুতুল, রায়বেশেঁ নাচ, বাঁশবাজি খেলা, শোলার কাজ থেকে কীর্তন কথকতা সব। অভূতপূর্বভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সে লাল বিহারী দের বিখ্যাত 'folk tales of Bengal।' এই বইটি নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন।

জনজীবনের স্পন্দন ধরা পড়েছে লোকসাহিত্যে। লোক সাহিত্য থেকে উদ্ধার করে জনজীবনের স্পন্দনকে রবীন্দ্রনাথ সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন নিজের কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিচিত্র ছন্দবদ্ধ পরীক্ষা নিরীক্ষার পিছনে সব সময় আমরা অনুভব করি বাংলার সেই স্পন্দনকে। উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত বাংলার সব কবিতা লেখা হয়েছে অক্ষরবৃত্তছন্দে। যাকে চলিত ভাষায় বলা হয় পয়ার ছন্দ। এর চেয়েও এগিয়ে গেছেন বিশ্বকবি। লৌকিক জগত থেকে তুলে এনে পৃথক সাহিত্য জগতে ছড়ার ছন্দকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন 'স্বাভাবিকছন্দ' বা 'প্রাকৃতিক ছন্দ।' এক্ষেত্রে কয়েকটি কবিতা উল্লেখ করা চলে,
 
১. তবু শূন্য শূন্য নয়
    ব্যথাময়
    অগ্নিবাস্পে পূর্ণ সে গগন।

২. বোলো তারে বোলো
    এক দিন তারে দেখা হল।
    তখন বর্ষণশেষে
    ছুয়েছিল রৌদ্র এসে
   উন্মীলিত গুলমোরের থোলো।

৩. তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছো আকীর্ণ করি
    বিচিত্র ছলনাজালে
    হে ছলনাময়ী।

কবিতার কথাই এতক্ষণ ধরে আলোচিত হলো। কিন্তু বাংলার লৌকিক সাহিত্যকে সম্পূর্ণ সাহিত্যগত রূপদান করবার প্রয়াসে আমরা রবীন্দ্র কথাসাহিত্যকে সমানভাবে দেখতে পাই। 'গল্পগুচ্ছ' এর 'একটি আষাঢ়ের গল্প' এবং 'জয় পরাজয়' নামে গল্প দুটি নিত্যান্তই রূপকথা হিসেবে উপভোগ করা যায়। যদিও এদের মধ্যে আছে গভীরতর আধুনিক ব্যঞ্জনা। 'অসম্ভব কথা' গল্পটি পড়া মাত্রই সবাই বুঝবেন এতে কবির বাল্যজীবনের কথা মিশে আছে। অপেক্ষারত ব্যাকুল বালকের চোখের সামনে দৈব দুর্যোগও অপরাহত কালো ছাতার নির্মম আবির্ভাব, মায়ের কাছে মিথ্যা অসুখের কথা বলে পড়া থেকে নিষ্কৃতি লাভ, দিদিমার কাছে রূপকথা শোনা এইসব কথাই আছে জীবন স্মৃতিতে 'ছেলেবেলা' বইতে। সেই উপকরণই 'অসম্ভব কথায়' আখ্যান রচনায় ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে একই সঙ্গে আছে রূপকথা এবং রূপকথা শোনা ও বলার নিজস্ব পরিবেশটি। 'গুপ্তধন' ও 'সম্পত্তি সমর্পণ' গল্পের মধ্যেও যক্ষ সংরক্ষিত ধরনের কথায় আছে লোক কাহিনীর আভাস। শুধু তাই নয় রূপকথার মধ্যে বাঙালি বাস্তব জীবনের যেসব পুনরাবৃত প্যাটার্ন থাকে, সপত্নীবিরোধ, ভাইয়ে ভাইয়ে ভালোবাসা বৃদ্ধি , বন্ধুর বন্ধুতা, দরিদ্রের আকস্মিক বা অলৌকিক সৌভাগ্যদয় সেইসব প্যাটার্ন 'গল্পগুচ্ছ' এও মিলে। 'গল্পস্বল্প' বইয়ের মধ্যেও পাচ্ছি আমরা সাতমহলা রাজার বাড়ির কথা, রাজকন্যা স্বয়ম্বরের কথা, সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে রাজা কাঠকুরানি মেয়েকে পছন্দ করার কথা আর অলৌকিক পরি, পক্ষীরাজ ঘোড়া প্রভৃতির প্রসঙ্গ। তবে এখানে নেই 'লিপিকার' নতুন তাৎপর্য 'সে' র অদ্ভুত রসায়ন।

রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছিলেন, "গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্নঅংশ স্বদেশের মাটির মধ্যে অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে, তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয়। তাহা কেবল দেশের জনসাধারণেরই উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য সেখানে বাহিরের লোক প্রবেশের অধিকার পায়না। সাহিত্যের যে অংশ সার্বভৌমিক তাহা এই প্রাদেশিক নিম্নস্তরের থাকটার উপর দাঁড়াইয়া আছে। এইরূপে নিম্ন সাহিত্য ও উচ্চ সাহিত্যের মধ্যে বরাবর ভিতরকার একটা যোগ আছে। যে অংশ আকাশের দিকে আছে তাহার ফুল, ফল ডালপালার সঙ্গে মাটির নিচেকার শিকর গুলার তুলনা হয় না তবু তত্ববিদদের কাছে তাহাদের সাদৃশ্য ও সমন্ধ ঘুচিবার নহে।" রবীন্দ্রসাহিত্যের মহিমান্বিত সার্বভৌমিক অংশ দাঁড়িয়ে আছে লোকসাহিত্যের প্রাদেশিক নিম্ন থাকটার উপর। আর লোকসাহিত্য থেকে দেশীয় সত্তার সেই গভীর গূঢ় উৎস থেকে রস সংগ্রহ করেছে বলেই রবীন্দ্রসাহিত্যের এমন মহত্ব, এমন চিরন্তন প্রাণবন্ততা। 

তথ্যসূত্র:
 
১. রবীন্দ্ররচনাবলী, দ্বাদশ খন্ড
২. রবীন্দ্ররচনাবলী, ত্রয়োদশ খন্ড
৩. তদেব
৪. 'জীবনস্মৃতি',রবীন্দ্ররচনাবলী, দশম খন্ড
৫. অবনীন্দ্ররচনাবলী, প্রথম খন্ড
৬. 'ছিন্নপত্রাবলী ' ১৩৬৭
৭. 'রবীন্দ্রসংগীত' ১৩৭৬
৮. 'রবি প্রদক্ষিণ' ১৩৫৬
৯. 'বাংলা ছন্দ', 'সাহিত্যচর্চা'
১০.Tagore a study, 1972
১১. Bengal Renaissance and other essays, 1970





রবীন্দ্রসঙ্গীতে গ্রীষ্মকাল

     চিত্রা পাল


বাঙালীর জীবনে ও মননে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামগ্রিক অবদান এক কথায় অনস্বীকার্য। তার মধ্যে তাঁর রচিত গান এক বিস্ময়কর অবদান। প্রায় দেড় হাজার গানের সৃষ্টিকর্তা তিনি, যে গান আজও বাঙালী জীবনের সম্পদ। আমি সংখ্যাটা আন্দাজে উল্লেখ করেছি। হয়তো তার চেয়ে বেশী হবে তো কম নয়। এক হাতে এতগান এত ভালো গান এত রকমের  গান জগতের কোন কবি সৃষ্টি করেননি। বাংলাভাষা এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদানে আজ পৃথিবীতে অগ্রণী। গানে তাই বিশ্বকবি রাজা, এখানে তাঁর কোন প্রতিযোগী নেই।

অনেক ধরণের গানের রচয়িতা তিনি।গানের ছলে আমাদের হিসেব হারানো ঐশ্বর্য ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে বাংলার ঋতুবৈচিত্রের আসন পাকা। সব ঋতুই ধরা দেয় তাঁরগানে নানাভাবে। তবে গ্রীষ্ম ঋতুর গান সবচেয়ে কম। তাঁর কাছে গ্রীষ্ম প্রতিভাত হয়েছে মৌনী তাপস রূপে। গ্রীষ্ম যেন হোম হুতাশন জ্বেলে রক্ত নয়ন মেলে তাকিয়ে আছে। ‘বৈশাখ হে মৌনী তাপস’  গানটিতে এমন রূপের দেখা মেলে। কিন্তু শেষ ছত্রে আশার বাণী শোনাযায়, হঠাত্‌ তোমার কন্ঠে এ যে আশার ভাষা উঠল বেজে, দিলে তরুণ শ্যামল রূপে করূণ সুধা ঢেলে’। বৈশাখের কালবৈশাখী তাঁর গানে এসেছে সন্ধ্যা আকাশ ঢেকে কিন্তু কবি ভয় না পেয়ে দ্বার খুলে দিতে বলছেন, কেননা ঘোর হুংকারে যে সে যা যাবার তা যাবে যা রাখবার তা রাখবে বলে। এদিকে প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে,বায়ু করে হাহাকার। তবু বুকে বাজে আশাহীনা ক্ষীণ মর্মর বীণা। সেই আশাতেই কবির প্রাণেসুর উঠে ভরে। কখনও শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙ্গবে বলে কাল বৈশাখীকে তাঁর রাজপুত্র মনে হয়েছে যে বজ্রস্বরে হাঁক দিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। আর রাজকন্যা বসুন্ধরার উতলা হিয়া সজল হাওয়ায় দোলায়িত। আবার মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায় কবির মনে হয়েছে কৈশোরে যে সলাজ কানাকানি খুঁজেছিলো প্রথম প্রেমের বাণী,তাই মর্মরিছে গহন বনে বনে। কখনও বৃষ্টিবিহীন তৃষা জাগানো বৈশাখীদিনে তপ্ত হাওয়ার ঝড় মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়। তবু এই গ্রীষ্মের কঠোর দিনকে কবির মনে হয়েছে যেন তপস্বিনী ধরণীর তপের আসনপাতা মৌন নীলাকাশে। আর তার দীপ্তি তারায় তারায় নীরব মন্ত্রে শূন্য ভরে দেবে। শুষ্ক নীরস গ্রীষ্ম তাঁর কাছে এমন ভাবে ধরা দিয়েছে। যে গ্রীষ্ম আসলে তপস্বিনী ধরণী, কিন্তু অন্তরে প্রাণের লীলা অন্তঃশীলা।


রবীন্দ্রনাথ-বিজ্ঞান ভাবনা ও সমাজ

শ্রাবণী সেনগুপ্ত

বিশ্বকবি যখন সাহিত্যে বিজ্ঞান আলোচনায় মন দেন তখন তাঁর বয়স ছিয়াত্তর।এই বয়সে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি বিষয়ে মনোনিবেশ করার দুঃসাহস তাঁকেই মানায়,তাঁর পক্ষেই সম্ভব।এর পিছনে তাঁর' সহজ ভাষায় বিজ্ঞান ব্যাখ্যার একটা ছাঁচ গড়ে দেবার 'মনের ইচ্ছা কাজ করেছিল।তিনি এই দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন তাঁর অস্তগামী হওয়ার চার বছর আগে।তিনি বিশ্বাস করতেন-বুদ্ধিকে মোহমুক্ত করতে প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার।গরমের ছুটিতে তিনি পরিবারের সঙ্গে
আলমোড়ার নিভৃত শৈলাবাসে গিয়ে দিনরাত এক করে পড়ে চলেছিলেন সেরা সেরা বিজ্ঞানের সব বই।আধুনিক বিজ্ঞানের সব বিষয়ে আলোচনা করে রূপ দিলেন -'বিশ্ব পরিচয়'-এর।
                                            বিশ্ব পরিচয় গ্রন্থটির প্রারম্ভে একটি দীর্ঘ ভূমিকা আছে,সেটিও খুব মূল্যবান।সেখানে কবি প্রচ্ছন্ন অনুযোগের সুরে বলেছেন যে,আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা নিজেদের গবেষণার বাইরে সমাজের লোকেদের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখেন না।বঙ্গ সাহিত্যে বিজ্ঞান আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পথিকৃৎ নন।অক্ষয় দত্ত থেকে জগদীশচন্দ্র বসু পর্যন্ত বঙ্গ সাহিত্যে বিজ্ঞান আলোচনার প্রবাহিত ধারাটির অন্তর্গত ছিলেন তিনি।রবীন্দ্রনাথের এই বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা বা বিজ্ঞান মনস্কতা তৈরি হবার পিছনে রয়েছে তাঁর বাল্যকাল।তাঁর যখন নয় দশ বছর বয়স তখন বাড়িতে মাঝে মাঝে সতীনাথ দত্ত আসতেন।তিনি খুব সাধারণ দৃষ্টান্ত দিয়ে বিজ্ঞানের দুই একটি তত্ব বোঝাতেন যা তাঁর শিশু মনকে আলোড়িত করত।তাঁর পিতা ডালহৌসি পাহাড়ে ভ্রমণের সময় তাঁকে নক্ষত্র চেনাতেন,গ্রহ চেনাতেন,তার সঙ্গে সূর্য থেকে তাদের দূরত্বের মাত্রা,প্রদক্ষিণের মাত্রা এবং অন্যান্য বিবরণও শোনাতেন।সেইসব কথা মনে করে তিনি কাঁচা হাতে প্রথম বৈজ্ঞানিক সংবাদ লেখেন।তারপর বড় হয়ে যখন ইংরেজিতে দড় হলেন তখন পড়ে ফেলেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক বই।তার মধ্যে স্যার রবার্ট বলের বই পড়ে তিনি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন।'বালক' ও 'সাধনা'পত্রিকাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বৈজ্ঞানিক আলোচনায় উদ্যোগী হন।সাধনা পত্রিকার সময় কবির বয়স ছিল তিরিশ,বত্রিশ বছর।এই সময়েও তাঁর লেখায় আমরা বৈজ্ঞানিক তথ্যকে ঝরঝরে ভাবে উপস্থাপিত হতে দেখি।তাছাড়াও জ্ঞানদানন্দিনী সম্পাদিত 'বালক',পত্রিকাতেও তিনি কখনো কখনো 'বিজ্ঞান সংবাদ'লিখতেন।কবির ২৪/২৫বছর বয়সে বালক এ প্রকাশিত বিজ্ঞান সংবাদের একটি নিদর্শন-"আহারান্বেষণ ও আত্মরক্ষার উদ্দ্যেশে ছদ্মবেশ ধারণ কীট পতঙ্গদের মধ্যে প্রচলিত আছে তাহা বোধ করি অনেকে জানেন।তাহা ছাড়া ফুল,পত্র প্রভৃতির সহিত স্বাভাবিক আকার সাদৃশ্য থাকতেও অনেক পতঙ্গ আত্মরক্ষা ও খাদ্য সংগ্রহের সুবিধা করিয়া থাকে।একটা নীল প্রজাপতি ফুলে ফুলে মধু অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছিল।পুষ্পস্তবকের মধ্যে মধ্যে একটি ঈষৎ শুষ্কপ্রায় ফুল দেখা যাইতেছিল।প্রজাপতি যেমন তাহাতে শুঁড় লাগিয়েছে অমনি তাহার কাছে ধরা পড়িয়াছে।সে ফুল নহে,সে একটা সাদা মাকড়শা।কিন্তু এমন করিয়া থাকে যাহাতে তাহাকে সহসা ফুল বলিয়া ভ্রম হয়।"
                   'বিশ্ব পরিচয় 'কবির পরিণত বয়সের লেখা।পরিমাণে অল্প হলেও তাঁর বিজ্ঞান চেতনা জেমস জিন্স,আর্থার এডিংটন, রবার্ট বল, রাসেল,ম্যাক্স বর্ন প্রমুখ ইউরোপীয় লেখকদের সমগোত্রীয়।কবির লেখায় ভাষার সহজতা, সরলতা লক্ষণীয়।দুরূহ তত্ব ও গাণিতিক দুর্গমতার জায়গাগুলোকে তিনি সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন।কয়েক দশক আগে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব পরিচয় গ্রন্থটিকে অ নুবাদ করে'our universe'নামে বের করেছেন লন্ডনের 'মেরিডিয়ান রুশ কোম্পানি'।বিশ্ব পরিচয় গ্রন্থটির একাধিক অধ্যায় হল-পরমাণু লোক','নক্ষত্র লোক',,'সৌরজগৎ','গ্রন্থলোক'ও' ভূলোক'।এখানে একটি উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হল পরমাণুলোক থেকে-কবি আয়নন বা Ionisation বলতে গিয়ে লিখলেন-"পজিটিভে নেগেটিভে যথা পরিমাণে মিলে সন্ধি করে আছে যেখানে সেখানে যদি কোনো উপায়ে গৃহবিচ্ছেদ ঘটান যায়,গুটিকতক নেগেটিভকে দেওয়া যায় তফাৎ করে তাহলে সেই জিনিসে বৈদ্যুতিক পরিমাণের হিসাবে হবে গরমিল।অতিরিক্ত হয়ে পড়বে পজিটিভ বিদ্যুতের চার্জ।মেয়ে-পুরুষে মিলে যেখানে গৃহস্থালির সামঞ্জস্য সেখানে মেয়ের প্রভাবকে যে পরিমাণে সরিয়ে দেওয়া হবে ,সে সংসারটা হয়ে পড়বে পুরুষ প্রধান এও তেমনি।"বর্ণালীর বর্ণনায় 'পরমাণুলোকে ' কবি তাঁর ভাষায় বললেন-"সব রং মিলে সূর্যের আলো সাদা,তবে কেন নানা জিনিসের রং দেখি।তার কারণ সব জিনিস সব রং নিজের মধ্যে নেয়না,কোনো কোনোটাকে বিনা ওজরে বাইরে বের করে দেয়।সেই ফেরত দেওয়া রংটাই আমাদের চোখে লাভ।মোটা ব্লটিং যে রসটা শুষে ফেলে সে কারো ভোগে লাগেনা,যে রসটা সে নেয়না,সেই উদ্বৃত্ত রসটাই আমাদের পাওনা।এও তেমনি।চুনি -পাথর সূর্যকিরণের আর সবরকম ঢেউকেই মেনে নেয়,ফিরিয়ে দেয় লাল রং কে।তার এই ত্যাগের দানেই চুনির খ্যাতি।যা নিজে আত্মসাৎ করেছে তার কোন খ্যাতি নেই।সূর্যের সব ঢেউকেই পাকা চুল ফেরৎ পাঠায়,তাই সে সাদা,কাঁচা চুল কোন ঢেউকেই ফেরত দেয় না..তাই সে কালো।জগতের সব জিনিসই যদি সূর্যের সব রং কে করত আত্মসাৎ তাহলে সেই কৃপনের জগৎটা দেখা দিত কালো হয়ে,অর্থাৎ দেখাই দিত না।কোন খবর বিলোবার সাতটা পেয়াদাকেই পোস্টমাস্টার বন্ধ করে রাখত।"
                         মহাকর্ষের টান প্রসঙ্গে কবির বক্তব্য বড়ই মনোহর-"এই নিয়মের হিসাবটি বাঁচিয়ে আমিও এই লেখার টেবিলে বসে সবকিছুকেই টানছি।পৃথিবীকে,চন্দ্রকে,সূর্যকে,বিশ্বে যত তারা আছে তার প্রত্যেকটিকেই ,যে পিঁপড়েটি এসেছে আমার ঘরের কোণে আহারের খোঁজে তাকেও টানছি।সেও দূর থেকে দিচ্ছে আমায় টান,বলা বাহুল্য আমাকে বিশেষ ব্যস্ত করতে পারেনি।আমার টানে ওর-ও তেমন ভাবনার কারণ ঘটলনা।পৃথিবী এই আঁকড়ে ধরার জোরে অসুবিধা ঘটিয়েছে অনেক।চলতে গেলে পা তোলা দরকার।কিন্তু পৃথিবী টানে তাকে নীচের দিকে,দূরে যেতে হাঁপিয়ে পড়ি, সময়ও লাগে বিস্তর।জন্মকাল থেকে মৃত্য পর্য্যন্ত এই টানের সঙ্গে মানুষকে লড়াই করে চলতে হয়েছে।অনেক আগেই সে আকাশে উড়তে পারত, কিন্তু পৃথিবী কিছুতেই তাকে মাটি ছাড়তে দিতে চায়না।কিন্তু এই টানটাকে নমস্কার করি যখন জানি ,পৃথিবী হঠাৎ যদি তার টান আলগা করে তাহলে যে ভীষণ বেগে পৃথিবী পাক খাচ্ছে তাতে আমরা তার পিঠের উপর থেকে কোথায় ছিটকে পড়ি তার ঠিকানা থাকে না।বস্তুত পৃথিবীর টানটা এমন ঠিকই মাপে হয়েছে যাতে আমরা চলতে পারি, অথচ পৃথিবী ছাড়তে পারিনে।"কি সাবলীল ব্যাখ্যা।

             অনেক অবৈজ্ঞানিক লেখার মধ্যেও কবি বিজ্ঞানের অনেক চমৎকার প্রয়োগ করেছেন।এক্ষেত্রে শেষের কবিতার কথা বলা যায়।যোগমায়া অমিতকে বলছেন-"বাবা,বিবাহযোগ্য বয়সের সুর এখনও তোমার কথাবার্তায় লাগছেনা,শেষে সমস্তটা বাল্যবিবাহ না হয়ে দাঁড়ায়।"জবাবে অমিত বলে,"মাসিমা, আমার মনের স্বকীয় একটা specific gravity আছে।তারই গুনে আমার হৃদয়ে ভারি কথাগুলো ও মুখে হাল্কা হয়ে ভেসে ওঠে,তাই বলে তার ওজন কমেনা।"কুমার মুখুজ্জে এটর্নিকে কেউ বলে কুমার মুখো, কেউ বলে মার মুখো।তবে অমিত তার নাম দিয়েছে ধূমকেতুমুখো-তার একটি কারণ এই যে, সে দলের বাইরে,তবু সে এদের কক্ষপথে মাঝে মাঝে পুচ্ছ ঝুলিয়ে যায়।সকলেই আন্দাজ করে যে গ্রহটি তাকে বিশেষ করে টানছে তার নাম লিসি।
                     বিশাল রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রবন্ধ,উপন্যাসে,গানে কবিতায় ছোটগল্প,নাটকে রম্য রচনায় বিজ্ঞানের কথা অজস্র ছড়িয়ে আছে।পত্রপুট কাব্য গ্রন্থ থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া যায়-
                        "শুনেছি একদিন চাঁদের দেহ ঘিরে
                               ছিল হওয়ার আবর্ত।
                          তখন ছিল তার রঙের শিল্প
                            ছিল সুরের মন্ত্র,
                            ছিল সে নিত্য নবীন।         
                          দিনে দিনে উদাসী কেন ঘুচিয়ে দিল
                              আপন লীলার প্রবাহ।
                       কেন ক্লান্ত হল সে আপনার 
                               মাধুর্যকে নিয়ে
                      আজ শুধু তার মধ্যে আছে 
                       আলো ছায়ার মৈত্রী বিহীন দ্বন্দ্ব-
                                   ফোটে না ফুল।
                       বহেনা কলমুখরা নির্ঝরিণী।"

রবীন্দ্র সাহিত্য জুড়ে,বিশেষতঃ কবির সরাসরি বিজ্ঞান রচনাগুলিতে 
বৈজ্ঞানিক তথ্যের দুর্বলতা কখনো চোখে পড়েনি,অথচ তথ্য কখনো বোঝা হয়ে ওঠেনি।'বিশ্বপরিচয়'এর ভূমিকায় তিনি যা বলেছেন নয়নের রচনায় তার ব্যবহারও তিনি করেছেন-'তথ্যের যথার্থে এবং সেটাকে প্রকাশ করার যথার্থ্যে বিজ্ঞান অল্পমাত্র স্খলন ক্ষমা করেনা।"
 এ বিশ্ব যেন ছন্নছাড়া নয়, বিচিত্র হলেও ছন্দময় ও নিয়মের অধীন,অতি প্রাকৃতের রঙ্গভূমি নয়,সে বিষয়ে কবি সরাসরি বিজ্ঞান আলোচনায়  না হলেও অন্যত্র বলেছেন-"বিশ্ব রাজ্যে দেবতা আমাদের স্বরাজ দিয়ে বসে আছেন।অর্থাৎ বিশ্বের নিয়মকে তিনি সাধারণের নিয়ম করে দিয়েছেন।এই নিয়মকে নিজের হাতে গ্রহণ করার দ্বারা আমরা প্রত্যেকে যে কর্তৃত্ব পেতে পারি তার থেকে কেবলমাত্র আমাদের মোহ আমাদের বঞ্চিত করতে পারে,আর কেউনা, আর কিছুতে না।এইজন্য আমাদের উপনিষদ এই দেবতা সম্বন্ধে বলেছেন'যাথাত তোহর্থান ব্যদধাৎ শাশ্বতীভ্য সমাভ্য।'অর্থাৎ অর্থের বিধান তিনি যা করেছেন সে বিধান যথাযথ,তাতে খামখেয়ালি এতটুকুও নেই এবং সে বিধান শাশ্বতকালের,আজ এরকম,কাল এরকম নয়।এ না হলে ,মানুষকে চিরকাল তাঁর আঁচলধরা হয়ে দুর্বল হয়ে থাকতে হত।কেবলই এ ভয়ে,ও ভয়ে,সে ভয়ে পেয়াদার ঘুষ যুগিয়ে ফতুর হতে হত।...তিনি তাঁর সূর্য্য-চন্দ্র-গ্রহ-নক্ষত্র এই কথা লিখে দিয়েছেন, বস্তুরাজ্যে আমাকে না হলেও চলবে।এখন থেকে আমি আড়ালে দাঁড়ালুম।একদিকে রইল আমার বিশ্বের নিয়ম,আর একদিকে রইল তোমার বুদ্ধির নিয়ম,এই দুইয়ের যোগে তুমি বড় হও।"
                                আজকাল বলা হয় যে,পরিভাষার  অভাবেই নাকি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করা সম্ভব নয়।এর খুব সুন্দর উত্তর দিয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ-"যাঁরা বলেন বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়,তাঁরা হয় বাংলা জানেন না,না হয় বিজ্ঞান বোঝেন না।"কবি বাংলাভাষার আরোপিত এই দীনতাকে কবিও স্বীকার করে নিতে পারেননি।বাংলায় তাঁর করা কয়েকটি বৈজ্ঞানিক পরিভাষা -spectograph:বর্ণলিপি যন্ত্র,radioactive:তেজস্ক্রিয়, stratosphere:স্তব্ধ স্তর,ultraviolet light: বেগনিপারের আলো,infrared light:লাল উজানি আলো,binary star:যুগ্মতারা ইত্যাদি।পরিভাষা সম্পর্কে কবির মন্তব্য-"বিজ্ঞানের সম্পূর্ন শিক্ষার জন্য পরিভাষিকের প্রয়োজন আছে,কিন্তু পারিভাষিক চর্ব জাতের জিনিস,দাঁত ওঠার পর সেটি পথ্য।"   কবি এতোদূর বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন যে, বিজ্ঞানের ভাষা কে সহজ করার লক্ষ্যে সবসময় পরিভাষা খুঁজে বেড়াতেন না,প্রয়োজনে বিদেশী নাম গ্রহণ করতে পিছ পা হতেন না।সামগ্রিকভাবে কবির বিজ্ঞান সাহিত্যকে বিচার করলে দেখা যায় যে,পরিভাষার খুঁটিনাটি নয়,মনোজ্ঞ ভাষা,স্বচ্ছ প্রকাশভঙ্গি,সাহিত্যরস এবং সর্বোপরি তথ্যের যথার্থটাই লক্ষ হিসেবে কবি নির্বাচন করেছিলেন।অধুনা কোনো কোনো লেখক বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে পরিবেশনের চেষ্টায় বিষয়বস্তুকে ক্ষুণ্ন করেন।তাঁদের উদ্দেশ্যে কবি বলেছেন-"দয়া  করে বঞ্চিত করাকে দয়া বলবেন না।..যাদের মন কাঁচা তারা যতটা স্বভাবত পারে নেবে,না পারে আপনি ছেড়ে দিয়ে যাবে,তাই বলে তাদের পাতটাকে ভোজশুন্য করে দেওয়া সদ্ব্যবহার নয়।"
       কবির বৈজ্ঞানিক প্ৰবন্ধগুলি পাঠ করলে এইকথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে,তিনি বরেণ্য কবি তো অবশ্যই,তার সঙ্গে যশস্বী বিজ্ঞানীও তিনি হয়ে উঠতে পারতেন।            




বিকীর্ণ আঁধারে

রাজর্ষি দত্ত

একজন কবি যিনির বিরছটার মতআলোকিত করেছেন বাংলা তথা নিখিল বিশ্বকে তিনি কখনই দিনের আলো-কে চূড়ান্ত সত্য বলে মানেননি। আলো ‘প্রত্যক্ষকে প্রমাণ করে’,তিনি দীপহীন পথে সেই ‘অপ্রত্যক্ষকের’ দিকে ক্রমশঃ ঝুঁকে পড়েছেন কালের বিবর্তনে।

কোন এক প্রভাতে হয়েছিল ‘নির্ঝরেরস্বপ্নভঙ্গ’! তখন জগৎ উদ্ভাসিত রবির কিরণে। সময় নিয়ে এল অস্তাচলের বাণী। চারিপাশে ঘিরে এল ঘন আঁধার। কবি তখনও আনন্দে মাতোয়ারা, তিনি লিখছেন ‘আজি যত তারা তব আকাশে, মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে…’। কিন্তু যতই হৃদয়ের প্রকাশ হতে লাগলো, অভিজ্ঞতার ছায়া দীর্ঘ হল, বেদনার বোঝা ভারী হয়ে উঠল – ততই বাড়ল আঁধারের গভীরতা – ‘নীরব নিশি তব চরণ নিছায়ে/ আঁধার-কেশভার দিয়েছে বিছায়ে…’।

 কবির উপলব্ধি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে লাগলো। সূর্যের প্রখর তেজের চাইতেও মনে হল অন্ধকারের শক্তি অসীম! তা দিনের আলোর মত স্বল্পায়ু নয়। ভাবতে গেলে আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে আলোর ভাগ কতটুকু? অন্তহীন মহাশূন্যের সমস্তটাই যে অন্ধকারে আচ্ছন্ন! তাঁর লেখনী জানালো  ‘আজ তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নি ঝরে, নিদ্রাবিহীন গগনতলে’; অনুভব করলেন এ ধরণীর অতি ক্ষুদ্র সঞ্চারণে সাথে অনন্তের যোগাযোগ–এক অতীব বিস্ময়কর সৌর-সাযুজ্য, যা তাঁর লেখায় বারংবার  ধরা দিয়েছে। ‘বিশ্ব যখন নিদ্রামগন’ তখন কবি নিমিলিত আঁখি মেলে সমাহিত করছেন অতল শোক,  নিদারুণ হতাশা, তীব্র অপমান– ‘আমার চোখে ঘুম ছিল না গভীর রাতে/  চেয়েছিলেম চেয়ে থাকা তারার সাথে’। এভাবেই উপনিষদের মন্ত্রে দীক্ষিত রবীন্দ্রের উত্তরণ ঘটলো। গভীর অন্ধকারের মধ্যে ‘উৎসারিত আলো’-র মত তিনি পেলেন জীবন উৎযাপনের অমোঘ মন্ত্র। মধ্যরাতের রাগমালকোষে বিধৃত হল ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’।

                              গীতিনাট্য ‘শাপমোচন’- এক মলিকা দিনের আলোয় দেখা পায় না সৌরসেনের। আঁধারে একলা ঘরে তার মন মানেনা। তার চেতনায় – “ আকাশে আকাশে তারাগুলি যেন তামসীতপস্বিনীর নীরব জপমন্ত্র। বীণাধ্বনি যেন আজ বাইরে নেই। এসেছে তার অন্তরের তন্তুতে তন্তুতে। বীণার গুঞ্জরন আকাশে মেলে দেয় অন্তহীন অভিসারের পথ…” -সে পথেই কমলিকা খুঁজে পায়, অন্তর থেকে বরণ করে নেয় প্রিয়ের যাবতীয় কুশ্রীতাকে !

                              ‘ঘরেবাইরে’ উপন্যাসের সে রাতের কথা !নিখিলেশ বুঝতে পেরেছে স্ত্রী বিমলা আর তার নিজের অংশ নেই – অনুরক্ত দ্বিতীয় পুরুষে। প্রবল অন্তর্দাহে তার বুক ফেটে যাচ্ছে অনুক্ত যন্ত্রণায়। রাত বাড়ছে কিন্তু সে কিছুতেই পারছে না নিজেকে প্রবোধ দিতে। এমনি সময়“ জানলার সামনের আকাশে শ্রাবনের মেঘ হঠাৎ একটা জায়গায় ছিন্ন হয়ে গেল – আরতারইমধ্যেথেকেএকটাতারাজ্বলজ্বলকরেউঠল।আমারমনেহলআমাকেসেবললে, কত সম্বন্ধ ভাঙছে গড়ছে স্বপ্নের মতো, কিন্তু আমি ঠিক আছি;…”

                              এ এক চূড়ান্ত আত্মদর্শন যা ধীরে ধীরে রূপ নিল মৃত্যু চেতনাকে উপেক্ষা  ও অস্বীকা রকরার। ‘চারঅধ্যায়’-র অতীন যখন বলে “আচ্ছা এলি, রাত্রে একেলা বসে কখনওমৃ ত্যুরসুগভীর মুক্তি অনুভব করেছ ? যার মধ্যে আছে চিরকালের ক্ষমা ?” তখন স্রষ্টার এক অদ্ভুত প্রত্যয় ও উপলব্ধির কথা মনে আসে। যেখানে কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদ নেই। রয়েছে এক ধ্রুব সত্যের কাছে শর্তহীন আত্মনিবেদন !পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর – “শমী যে রাত্রে গেল তারপরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েচে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি,  সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে…”। একই সুর তাঁর অন্য লেখায় – “ যখন আমি শুতে গেলুম তখন এই কথাটি মনে নিয়ে নিদ্রিত হলুম যে, আমি যখন সুপ্তিতে অবচেতন থাকব তখনও সেই জাগ্রত বীণকারের নিশীথ রাতের বীণা বন্ধ হবে না – তখনও তাঁর যে ঝংকারের তালে নক্ষত্রমণ্ডলীর নৃত্য চলছে সেই তালে তালেই আমার নিদ্রানিভৃত দেহ-নাট্যশালায় প্রাণের নৃত্য চলতে থাকবে –”

                              এভাবেই সকল জাগতিক চেতনা ও ক্ষুদ্রতাকে তুচ্ছ করে নিশীথের অন্ধকারে জীবনের অভ্রান্ত সত্য ও সারাংশ অনুভব এবং তার নির্ভীক বাণীকে নিরলস প্রচার – রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বসভায় এক অদ্বিতীয় আসনে বসিয়েছে। তাঁর চলার পথ সহজে ফুরোবার নয় !              



গুরু দেবের চারণভূমিতে তিনদিন

বেলা দে 


মেয়েবেলা থেকে এক অপূর্ণ ইচ্ছে বয়েছি বহুদিন  গুরুদেবের চারণক্ষেত্র শান্তিনিকেতন আর তাঁর  অনবদ্য সৃষ্টিকে ধরে আনবার। সে ইচ্ছের দাম দেয়নি কেউই, আমার সব চাওয়া পাওয়া পুরণ করে চলেছে মেয়ে,ডাক্তার দেখাতে গেলাম কলকাতায় এবছরের ২০শে ডিসেম্বর, ডাক্তার পর্ব শেষ করে মেয়ে আর ভাগ্নী যুক্তি করে ফেলেছে পৌষমেলা যাওয়া একরকম আমাকে না জানিয়েই তিনটা দিন কলকাতা ভাগ্নীর বাড়িতে থেকে রওনা  হলাম শিয়ালদহ  রামপুরহাট এক্সপ্রেস এ সহযাত্রী  সিংহভাগ স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রী ট্রেনে ওদের অভব্য আচরণ সভ্যতার সীমারেখা পার করে চলেছে একটু বিরক্তির চোখে তাকালাম কয়েকবার হেলদোল নেই তাদের, দুই মেয়ে আমাকে শাসায়  ছাড়ো তো যুগ অনেক বদলে গেছে, ভাবলাম হবে হয়তো, চুপ করে গেলাম, বোলপুরে নামার পর গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি হোটেল মালিক ভাগ্নীর পূর্ব পরিচিত অনেকবার সে হোটেলে উঠেছে ওরা,মালিক নিজের ছোট গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে এর মধ্যে লক্ষ্য করেছি এঁচোড় পাকা ছেলেমেয়েগুলো  সিগারেট ধরিয়ে একে অন্যের মুখে আঁধপোড়া খন্ডটা ধরিয়ে দিচ্ছে, কোন বাবামায়ের যে সন্তান ওরা করুণা হলো অচেনা মানুষগুলোর জন্য।  ততক্ষণে গাড়ি হাজির হয়েছে হোটেলে "নবরূপে  নববসন্ত " প্রান্তিকের সমৃদ্ধ হোটেল নিসর্গ প্রকৃতির মাঝে চেনা অচেনা নানা ফুলের সম্ভারে মোহময়ী করে দিয়েছে হোটেলের মনোরম স্থাপত্যকে। মালিক দম্পতি অতিশয় অমায়িক স্বভাবের, মহিলা বিশ্বভারতীর অধ্যাপিকা তার বাবা ড:,সুব্রত অধিকারীও অধ্যাপক। বেশ তৃপ্তিদায়ক তাদের  রন্ধন প্রনালী তদারকী বর্ননা করলেও কম হবে। রেটটাও সাধ্যের মধ্যেই। বিকেলে সোনাঝুরী হাটে  জমিয়ে কেনাকাটা খুব সস্তার বিপনন। আদিবাসী  নাচে সবাই পা মিলিয়েছি,মেয়ে তো নাচ পেয়ে বেরোতেই চায় না। মনকাড়া গান গাইছে বাউলভাই সে দেখেই নাতি আমার একতারা, দোতারা দুটোই কিনে ফেলেছে। পরের দিন সকালে ছুঁয়ে দেখতে গেলাম পরম প্রশান্তির ছাপ যেথায় বিরাজ করে  গেছেন বাংলা ও বাঙালির অহংকার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বারংবার কানে বাজছিলো " যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে"। ঘুরে নিলাম তাঁর নিবাস,মিউজিয়াম, ছাতিমতলা উপাসনা গৃহ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, আশ্রমিক আবাস,প্রতীচী ভবন, নাট্যঘর, কলাভবন। পরের দিন রেখেছি মেলার জন্য এবার মেলা বসেছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শখের ভুবনডাঙায়।  এবার আর কোনো আফসোস রইলো না, নোবেলের শুন্য জায়গাটা দেখে কেবল খাঁ খাঁ করে উঠেছে ভেতরটা। একবুক কান্না যেনো জমে ঠেলে ওঠে ক্রমশ ওপরে  সেই এলাম বৈকালিক বেলা পার করে, আগে কেন এলাম না চোখজোড়া সার্থক হতো। কোন পাপিষ্ঠ  পাপের হাতে ছুঁয়েছে দেবতার সেই অমৃতকলস।



কৃষ্ণকলি
অলকানন্দা দে


এই তো, এই তো প্রায় এসেই গেছি আমার অন্তঃশীলা অপেক্ষার তীরে!
আর একটু ধুলো উড়িয়ে চল মন!
ঐ যে দেখা যায় গাছে গাছে সবুজের স্রোত,
তার পাশে ঐ যে ভালোবাসা প্রান্তর জাগে সারা রাত্রি সারা দিন,
ওটাই তো ময়নাপাড়ার মাঠ!
ঐ আলোর বাগানেই তো থাকে কবির ছলছলে কালো ভূমিকন্যা কৃষ্ণকলি!
যার অদেখায় এ মাঠের বুক কাঁপে আজও!
হাওয়ার ছোঁয়ায় আমরা এগিয়ে চলি চল।রোমাঞ্চ দোলে বুকে!
পায়ের নিচের লাল কাঁকর খিলখিল ক’রে ঠাট্টা ছড়ায় আমার অস্থির অবস্থার সুযোগে।কি দেখবো আমি আর একটু পরেই!
পিঠের পরে মুক্ত বেণী লোটা কৃষ্ণকলিকে?
দুদিকে দিগন্ত ছোঁয়া মাঠের বুকে অম্লান যে কুটির দেখি, কৃষ্ণকলি কি করে এখন সেখানে?
একটি লাজুক পাখি গাইছে শুনি এক ফুলপাগল গাছের শাখে।
এই নিটোল নিস্তব্ধতায় সে কী অমিয় মধুর বার্তা দেয় অতিথি আসার?
কঠিন প্রহেলিকা বুঝেও বুঝি না যেন!
বাতাসের স্পর্শে পাই আর্দ্র কোমলতা।
এ বাতাস নির্ঘাত কৃষ্ণকলিকে ছুঁয়ে এসেছে, না হলে এত সুগন্ধি কেন সে!
আকাশটা বড় হয়ে ছড়াতে ছড়াতে স্বাগত জানায়!
সত্যি মন, কৃষ্ণকলির দেশে কত আয়োজনে ক্লান্তপদ আতিথ্য-প্রত্যাশী কোন পর্যটকের হয় অভিবাদন দেখো তুমি!
ধুয়ে মুছে দেয় যত সত্তার ক্ষত!
শুভ্র সন্তোষের ভাষা খুঁজে আনে হৃদয়ের আহ্লাদ!
কিন্তু এতটুকু পথ পেরোতে এত সময় লাগে যে কেন আমার কে জানে!
কিছু কি ভুল চুক হল? না না তা কেন হবে।আমি জানি এটাই সঠিক পথ।
আসলে বশে আনতে পারছি না উৎসাহে আবৃত মনকে।
স্পন্দিত হচ্ছে এক অচেনা হৃদয়, সেই মেয়ের টানে!
কালো হরিণ-চোখের ইন্দ্রজালের কথা তো জেনেছি কবির গানে কত!
দীর্ঘ প্রতীক্ষায় সেই দারুণ স্ফটিক আভা কি গান,কি সুর,কি নিষ্কম্প আলোর মাধুরী ছড়াবে যার মায়ায় পরাজিত হবে পৃথিবী দেখব তাই!
যুগল ভুরু কি আজও ছড়ায় কালো মেঘের ঘটা আকাশ- মনে?
এই অর্ধবৃত্তাকার মেঠো পথে তার শ্যামল গাই কি ফেরে বাঁধনহারা আজও?
রুদ্ধশ্বাস এইসব জিজ্ঞাসার দুরু দুরু চলছে শুধু বুকে।
আচ্ছা, এত উতলা কেন হয়ে চলেছি?
এভাবে কেন ভাবছি হুবহু দেখবো সবটা!
দূর তেপান্তরে ফেলে আসা কবির কৃষ্ণকলির কি স্ব-ছন্দে বাড়ে নি বয়স?
পৃথিবীর নিয়ম বিরুদ্ধ হয়ে সে কি করে ছটফটে আয়ুকে বেঁধে রাখবে সময়ের পাটাতনে?
তবে কি শিকারী সময়ের কারসাজিতে ক্ষয়ে গেছে তার সেই রূপ!
অনেক পুরোনো এক পৃথিবীর নারী সে?
নাকি স্নিগ্ধ লঘু যৌবন প্রান্তে আজও দাঁড়িয়ে আছে অবিকল, কবির সৃষ্টির যাদু গুনে!

তখন হঠাৎ বুঝি, আমি কাকে খুঁজতে চলেছি মানবচক্ষে! সে যে কেবল মানসনেত্রের মাধুরী!
ওগো কৃষ্ণকলি! তুমি যে সেই কল্যাণী মায়া যাকে টেনে আনা যায় না দৃষ্টির দরবারে!
যাকে শুধু বেঁধে রাখা যায় অনুভবের আঁচলে এই কোমল অন্তর ভুবন তীরে!
তুমি তো দু-চোখ বিভোর করা সেই প্রেম কবির, যে শুধু আরাম দেয় মনকে মধুর দুপুরে শীতলপাটিতে ক্ষণ-বিশ্রাম সম!
তুমি আষাঢ়ের বনজ্যোৎস্না! শ্রাবণের আকুল করা প্রেমের নির্ঝর!
তুমি এক ও অবিকল্প থাকবে নিঃসন্দেহে!
যুগে যুগে মানুষ এসে চিনে নেবে তোমাকে আত্মার গহিনে!
সময় যতই ধাবিত হোক,
তবুও কবির প্রেমের বয়স বাড়ে না যে!




কবি প্রণাম
কাকলি ব্যানার্জী মোদক 

 প্রতি বছরের মতন ,ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে, ঘর পরিষ্কার করে স্নান সেরে, ছোট্ট বৈঠকখানায় এসে দাঁড়ালো সুচরিতা,গত রাতেই জোগাড় করে রেখেছিল মালা,কাপড়ের আঁচল দিয়ে ফটোটা একবার মুছে নিতে নিতে দু কলি গেয়ে উঠলো গুনগুনিয়ে, নিমেষে চারিদিকে তাকিয়ে সুচরিতা অপরাধ বোধে  চুপ করে গেল।
সবাই ঘুমে ব্যস্ত, বরের সারাদিন অফিসের প্রচন্ড কাজের চাপ তাই একটু দেরিতে  ......ভাবতে ভাবতে থেমে গেল । 


সুচরিতার জীবনটা সংসারের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, ছেলের সারারাত কম্পিউটারের কাজ, মেয়ের কলেজ, সব সামাল দিতে দিতে হিমশিম খায় সুচরিতা ।

তবুও সকালে উঠেই রেডিও টা চালানো চাই, ওটাই যেন তার এক টুকরো নিঃশ্বাস। সকল থেকে রাত্রি কত দায়িত্ব, দিনের শেষে যখন বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয় ,তখন পাশের মানুষটি ঘুমে আচ্ছন্ন, খুব সন্তর্পনে শুয়ে থাকে ,পাছে মানুষটির ঘুম  ভেঙে না যায় । এককোনে শুয়ে ভাবতে থাকে কালকের কথা ,কি রান্না হবে, কি জামা কাপড় কাচা হবে,বাজার ,দোকান ছেলের খাবার,মেয়ের কথা, কখন যে ঘুম এসে যায়......,.
 
আজ পঁচিশে বৈশাখ, সুচরিতার প্রানের ঠাকুর রবি ঠাকুরের জন্ম, ফটোতে মালা পড়িয়ে প্রনাম করলো ,রেডিও‌টা চালিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো কাজে। 
"যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা"
গানটা রেডিও তে বাজছে, সেই কবে শিখেছিল 
 সুচরিতা, সঙ্গীত ভবনের পাশের ঘরটিতে বসে। গোটা পনেরো ছাত্র ছাত্রী তার মধ্যে সুচরিতা সেদিন পরনে  ছিল হলুদ শাড়ি  সামনেই বিশাল শতরঞ্জিতে বসে একমনে সুরের মূর্ছনায় মোহিত হয়ে। ছিলো। সুচরিতার মনে পড়ে শিখতে  শিখতে দু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল চোখের জল ,চোখ খুলতেই মনে হয়েছিল সামনে বড়ো ফটোতে যিনি বসে আছেন তার প্রানের ঠাকুর যেন তাকে দেখছেন । সবাই তখন গান শিখে বেড়িয়ে গেছে। সামনে দাঁড়িয়ে আরো একবার চোখের জল ফেলে ছিল সুচরিতা  রবি ঠাকুরের ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে।।
 ,
আজ মন দিয়ে গান শুনতে ব্যস্ত সুচরিতা, শত কাজের মধ্যে রেডিওটা তার সঙ্গী ভোরে ভোরে উঠেই সমস্ত কাজের মাঝেই শুনতে থাকে গান ,এটা তার পুরনো অভ্যেস তার জন্য কম মুখ ঝামটা সহ্য করতে হয়নি সুচরিতার। 


মেয়ের চিৎকারে হুঁস ফিরে এল সুচরিতার
 মেয়ের বলে উঠলো....   গেল গেল ধরে য়ে  দিলে তো তরকারিটা? তোমার বদঅভ্যাসটা একটু ছাড় মা, আজ বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাব এখনো কিছু রেডি হলো না? 
সুচরিতা যেন কুন্ঠা বোধ করলো, বলল দাঁড়া দাঁড়া এক্ষুনি হয়ে যাবে, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি বলে তাড়াতাড়ি  রান্নাঘরে  গিয়ে ব্যস্ত  হলো পড়লো নিজের কাজে ।
  অপরাধ বোধে মনে মনে ভাবতে লাগল সত্যিই আমি গান গান করে পাগল হয়ে যাব একদিন , বার কতক নিজেকেই দুস্তে লাগলো সুচরিতা।
     
পরক্ষনেই ঠোঁটের কোণে হাসি এসে গেল ....             একদিন ছেলে কে বলেছিল এইবার স্টার জলসায় যে মেয়েটা ফাস্ট হল আমাদের বেহালায় থাকে জানিস.... নিয়ে যাবি, দেখে আসব ওকে ....গান শুনে আসবো মেয়েটার.... কি মিষ্টি গলা ।
         ছেলে হাসতে হাসতে বলেছিল মা তুমি পারো বটে ,লোকে পাগল বলবে তোমাকে। 
               

       সত্যি একসময় পাগল ছিল সুচরিতা,  গান তার ছিল প্রান  নেশার মতন লাগতো, রবীন্দ্রভারতী থেকে সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করার পর ,কত অনুষ্ঠান করেছে সুচরিতা । সুচরিতা মা বালা বন্দক দিয়ে সেই ছোট্ট মেয়ের ‌ জেদের কাছে হার মেনে কিনে দিয়েছিল একটা হারমোনিয়াম। সুচরিতা গলার গান শুনে সবাই  মুগ্ধ  হতো , তিল তিল করে তৈরি করেছিল নিজেকে ।
           
     যখন  সুচরিতার বিয়ের হয়.
 সুচরিতার স্বামীকে ডেকে  সুচরিতার মা বলেছিলো , ও কিন্তু  গানপাগল,  বিয়ের পর ওকে গান করার সুযোগ টা দিও ।আর মেয়ের বিয়ের পর যখন  অষ্টমঙ্গলায়  আসে তখন জোর করে পাঠিয়েছিল সুচরিতার হারমোনিয়ামটা  আর এক বস্তা গানের খাতা।

প্রথম প্রথম নতুন বউয়ের গান করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি ,স্বামী বলেছিল তুমি না.... নতুন বউ সকাল সকাল গলা ছেড়ে গান করলে লোকে কি বলবে ।আর পর ছেলে, মেয়ে, আর সেভাবে  সুযোগ হয়ে উঠেনি, এখন গান  তার রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ।   আজ সকাল গড়িয়ে কখন যে বেলা  হয়েছে টেরই পাইনি ,রেডিওটা বেজে গেছে আপন খেয়ালে। 

          দু গ্রাস ভাত মুখে দিতেই .....
  ও ঘর থেকে ভেসে এলো "সে ছিল আমার স্বপ্নচারিণী আমি বুঝতে পারিনি "নিজের অজান্তেই নির্জন ঘরে দু কলি  গেয়ে উঠলো সুচরিতা শত ব্যস্ততার মধ্যেও  সুচরিতার চোখের দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল  আজ রান্না ঘরের মেঝেতেই।।



 কবি তুমি
 লীনা রায়

একলা তুমি ভাসাও আমায়
মাঝ রাত বা সাত সকালে,
একলা আমি ভাসছি কেমন
ভালো লাগার অথৈ জলে।
একলা আমি মন সঁপেছি
হাত ধরেছি কল্পনায় ,
তোমায় ঘিরেই কান্না হাসি
রঙের ছোঁয়া স্বপ্নটায়।
তোমার গদ্যে বাঁচতে শেখা
ছন্দে,সুরে প্রেমের শুরু,
আমার জগৎ একলা তুমি
প্রাণের ঠাকুর কবি গুরু।




 চিত্রকর ও ঈশ্বর
রীনা মজুমদার

প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে
একটা ছবি আঁকতে পারে সবাই 
কিন্তু,
যে প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের উপন্যাস গড়ে
একটু সবুজ তুলে আনতে পারে
তারপর তাকে রঙতুলিতে নির্মাণ করে!
   তুমি কি সেই চিত্রকর?

  নরম মাটিতে নদী পাড় ভাঙে
নিঃশব্দে বয়ে চলাই নদীর রাজকীয়তা নয়
বাকঁ ঘুরিয়ে প্রতিবাদী শক্ত মাটি খোঁজে
  পদ্মার চরে দাঁড়িয়ে
একটা জলছবি আঁকতে পারে সবাই 
কিন্তু,
 যে যাপনের সঙ্গে বিদ্রোহী কবিতা গড়ে
তারপর তাকে রঙতুলিতে নির্মাণ করে!
   তুমি কি সেই চিত্রকর?

তুমি সে কারিগর সেই  চিত্রকর হও!
 দাও দেখি এঁকে... একই বৃন্তে দুটি ফুল
       রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। 



 বাঁচার আখর
        সুনন্দ মন্ডল

প্রতি ভাষায় জাগে রবীন্দ্রনাথ
প্রতি স্পর্ধায় নজরুল।
আগামীর সংকটে বাঁধি গান তাঁরই
বুদবুদ ওঠে বিলকুল।

প্রতি সত্যে নির্ভীক উচ্চারণ
নজরুল নিয়ে ঘর।
প্রতি আবেগে, মন খারাপে
আছে বিশ্বকবির বর।

রবীন্দ্রনাথ দুচোখে ভাসে
নজরুলে গাঁথা হৃদয়।
ঠোঁটে ফোটে কত প্রেম-বিরহ
স্বপ্ন উভয়েরই লেখায়।

আমরা বাঁচি তোমাদের নিয়ে
তোমরা বাঁচার আখর।
এপাশে যদি রবীন্দ্রনাথ থাকে
ওপাশে নজরুলের ঘর।



কবির প্রতি
সারণ ভাদুড়ী

কবি, তুমি সুন্দর
সুন্দর তোমার সাধনা।
অশ্রুও যদি আজ পদতলে আঘাত করে,
সেদিন বলবে, " আমি সত্যের পূজারী।।"
অশ্রু যদি আঘাত না করে,
কেবল তার ফোঁটাগুলো তোমার কপল দিয়ে বইয়ে দেয়
সেদিন বলবে " আমি সত্যের প্রেমিক।।"
ক্রন্দন বাঁশি থেকে যেদিন সপ্তধারায় বেজে উঠবে সুর,
গড়িয়ে পড়বে শোক;
সেদিন বুঝবে এ হলো তোমার সত্য পূজার নৈবেদ্য।
আর যবে শূন্য থেকে খসে পড়বে গোলাপ,
তখন সেটা কুড়িয়ে নিও --
সেদিন বুঝবে সেটা মানব দেবতার অশ্রুরুপী গোলাপ।।




রবি ঠাকুর 

 চন্দ্রানী চৌধুরী 


রবি ঠাকুর রবি ঠাকুর 

জন্ম আমার দেশে 

তবু বিশ্ব জুড়ে সব বাঙালী

তোমায় ভালোবাসে  


বোশেখ মাসের পঁচিশ তারিখ 

তোমার জন্মদিন 

রবিঠাকুর আজ আমাদের 

বড়ই খুশির দিন 


খড়খড়ে তাপ দাবদাহে

এসেছিলে তুমি 

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে 

ভিজিয়েছিলে ভূমি 


নাচে গানে মাতি সবাই 

তোমার জন্মদিনে 

প্রনাম জানাই কবিগুরু 

তোমার চরণ ছুঁয়ে। 





বিদ্রোহী কাজী

অভিজিৎ সরকার

বিদ্রোহ আজ হারিয়ে গেছে
হয়না বিদ্রোহের আজ গান,
মুখে সবার তালাবন্ধ
বাঁচাতে নিজের প্রাণ।
চোখে চোখ রেখে কথা বলার
সাহস দেখায়না কেউ,
দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকে
তুফান আসুক কি ঢেউ।
প্রতিবাদের ভাষা গুলো
দুমড়েমুচড়ে গিলে খায়,
পালতোলা নৌকার ন্যায়
স্রোতে ভেসে যায়।
কাজীর গানে ভেসে বেড়াতো
বিদ্রোহের যত গান,
কলম ধরে লড়াই চলতো
বাঁচার আশায় বুক বাঁধতো শত শত প্রাণ।
জাতি ভেদের পড়োয়া
ছিল না তাঁর কাছে,
উলুখাগড়ার প্রাণ যেতো
রাজারা তার পাছে।
দুঃখের জীবন দুখুমিঞার
বুকে ছিল লড়াই করার বল,
আমরা সবাই অন্ধ আজ
খুঁজে বেড়াই ছল।




আমি তোমার গীতালি হব 
               এস.সাহা (সঞ্জয়) 

রবি, তুমি আমার কথা কাহিনীর খেয়া 
আমি তোমার গীতালি হব !
আমায় তুমি চিত্রা ভেবে লিখে রেখো শেষ কবিতায় 
না হয় প্রতীক্ষায় রব পত্রপুটে পুনশ্চ বলাকায় 
 প্রহসিনী চারুলতার ভানুসিংহের পদাবলীর রূপান্তরিত হয়ে।
শিশুরা বেলাশেষে সপ্তক সানাই সুরে গাইবে গান 
স্ফুলিঙ্গ উঠবে তোমার গানে ও সুরে...  প্রদীপের প্রকাশ করিও কবি, কোমল তোমার ক্ষণিকার গীতিমাল্যে।
না হয়, তুমি আমায় চৈতালির ছবি ও গানে নবজাতক শিশুর মতো ভোলানাথ রোগসজ্জায় শায়িত করে বীথিকার সোনার তরীতে ভাসিয়ে দিও বিচিত্রিত মহুয়া রূপে...
তবুও মনে রেখো রবি,যদি জল আসে আঁখিপাতে, একদিন যদিও সব সব থেমে যাবে মধু রাতে, 

                আমি তোমার গীতালি হব !!




স্মরণে নজরুল 
 রথীন পার্থ মণ্ডল

আনতো ফুল সোনামণি
আনতো তোরা মালা,
নজরুলকে করব স্মরণ
এবার ধূপ জ্বালা। 

'অগ্নিবীণা'র কবি তিনি
শ্রমিক থেকে চাষীর, 
তাইতো তিনি আছেন জুড়ে 
আট থেকে আশির।

গান লিখেছেন সাম্যবাদের
নীল গগনে সুর,
গানের সুরে হৃদয় দোলে
বিভেদ হয় দূর।





পরিবেশ ও ভ্রমণ 






শিল্পী- শঙ্কর জানা 






মানুষ ও প্রকৃতি 
রণিতা দত্ত

"মোলাই, অ মোলাই উঠ বাবা! বেলা যে চড়ে যায়!"
মায়ের ডাকে চোখ ডলতে ডলতে দরমার ওপর ছেঁড়া চাদর পাতা বিছানার ওপর উঠে বসে আট বছরের মোলাই। ভাত ফোটার গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা মারতেই পেটের খিদেটা চাগাড় দেয়। ঘরের দরমার বেড়ায় টানানো দড়ি থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে হুড়মুড় করে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে চাং-ঘর থেকে।

নিচে অনেকগুলো গরু মোষ বাঁধা। ঘরের পেছন দিকে প্রাতঃকৃত্য সেরে এসে মোলাই বালতির জলে মুখ কুলকুচি করতে করতে দেখে বাবা লাখীরামের দুধ দোয়ানো এরমধ্যেই সারা। তিন বালতি দুধ সারি দিয়ে রাখা। ভাত খেয়ে বাবা দুধ বিক্রি করতে বেরবে। লাখীরাম মোলাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, " ইস্কুল যাওয়ার সময় গরু মোষগুলো সঙ্গে নিয়ে যাবি। ইস্কুল শেষ হলে চরাবি। খবর্দার একটাও যেন এদিক ওদিক চলে না যায়।" 
ঢক্ করে ঘাড় কাত করে মোলাই আবার আট ধাপ  সিঁড়ি বেয়ে চাং-ঘরে উঠে যায়। মায়ের গা ঘেঁসে বসে বলে, "মা ভাত দে।"
ছেলের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আফুলি বলে, "চোখ মেললেই পেটে আগুন ধরে,তাই না?" মোলাই তখন মায়ের আঁচলে মুখ ঘষে।

নামসিং(শুঁটকি মাছ) ভর্তা দিয়ে একথালা ভাত খেয়ে নেয় মোলাই। ঘরের কোনা থেকে স্লেট পেন্সিল আর বইয়ের পুঁটুলি নিয়ে আবার একদৌড়ে নিচে। লাখীরাম ততক্ষণে গরুমোষ গুলোকে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় তুলে দিয়েছে। একটা ছপটি হাতে নিয়ে সবগুলোকে একজায়গায় করে মোলাই ওদের পেছন পেছন চলতে শুরু করে। 

ইস্কুলে মোলাইয়ের নাম যাদব পায়েং। ওর ধবধবে ফর্সা রং আর লালচে গোলাপী মুলোর মত গাল আর ঠোঁট দেখে গাঁয়ের সবাই ওকে ছোটবেলায় মোলা (মূলা) বলে ডাকত। সেই থেকে ওর আদরের নাম হল মোলাই। যাদব নামটা  আছে শুধু ইস্কুলের খাতায়। 
 ইস্কুলের বন্ধ ঘরে মন লাগে না মোলাইয়ের। মাস্টারমশাই ছেলেদের নামতা শেখান আর ও জানালা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বহতা ব্রহ্মপুত্রের দিকে। নদীর জলের ঘুর্ণিপাক আর  চরে বসে থাকা নানারকম পরিযায়ী পাখির দল ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। 
ইস্কুল ছুটি হতে না হতে একলাফে মোলাই ওর গরু মোষের পাল নিয়ে চরাতে বেরিয়ে পড়ে। প্রকৃতির মধ্যেই ও খুঁজে পায় ওর আনন্দ আর মুক্তি।

ওদের এই অরুণা চাপোরি গ্রামে ঘাসের বড় অভাব। আর হবে নাই বা কেন। এ তো ব্রহ্মপুত্রের বালির চর বই নয়। চাপোরি মানেই নদীর চর। প্রতি বছর বন্যায় ভেসে যায়। গাছপালা গজানোই ভারি শক্ত এখানে। উজানি অসমের এই মাজুলি দ্বীপ পলি আর নদীর বালি জমে জমে কতকাল আগে তৈরি হয়েছিল কেউ জানে না তা। এটাও আজ কারো মনে নেই যে মিশিং উপজাতির লোকেরা কত হাজার বছর আগে তিব্বত ছেড়ে একদিন এই ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। নদীই ওদের জীবন আবার বর্ষায় এই নদীই প্রমত্ত হয়ে উঠে ওদের ভাসিয়ে নিতে চায়। মোলাইদের মত মিশিং উপজাতির লোকরা তাই বাঁশের লম্বা লম্বা খুঁটির ওপর দরমা দিয়ে বানানো চাং-ঘরে থাকে। তাছাড়া বুনো জন্তুরও তো কিছু অভাব নেই এখানে। গন্ডার, হাতি এমনকি বাঘও মাঝে মধ্যে হানা দেয় এখানে। গরু ছাগল হাঁস মুরগি সবকিছু নিয়ে মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে তাই নিরাপদে ঘর বেঁধে থাকে ওরা।

গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘাসের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় মোলাই। গরু মোষ গুলোকে চরতে দিয়ে  ও নিজেও গাছপালা ফুল পাখি এসব গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখে। মাঝেমাঝে জামা প্যান্ট নদীর ধারে খুলে রেখে সাঁতার কাটে ব্রহ্মপুত্রের জলে। নদী এখানে বিশাল চওড়া হলেও বর্ষা ছাড়া অন্যসময় স্রোত তত বেশি নয়। নদীর বুকে মাথা তুলে থাকে অগুন্তি ছোট বড় স্লেটরঙা পলিমাটির চর। সাঁতরে সেসব চরে গিয়ে বসে মোলাই। গভীর মনোযোগে দেখে কাঁকড়ার চলাফেরা। নদীর চরের গর্তে কতরকম সাপ খোপ পোকামাকড়ের আস্তানা। মাঝেমাঝে রূপোর মত ঝকঝকে প্রকান্ড সব চিতল মাছ জলে ঘাই দেয়। হাঁ করে সেদিকে চেয়ে থাকে মোলাই। 
একসময় ধীরে ধীরে দিগন্তে ঢলে সূর্য। ব্রহ্মপুত্রের জল লাল হয়ে ওঠে ডুবন্ত সূর্যের রং গায়ে মেখে। ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী হাঁসের দল চরে ফিরে আসে রাতের বিশ্রামের জন্য। জোনাকিদের দেখানো পথ ধরে মোলাইও তার গরু মোষের পাল  নিয়ে ঘরে ফিরে আসে।

মোলাই বড় হয়। নদী জল গাছপালার সাথে ওর সখ্যতা আরও নিবিড় হতে থাকে। চার দেয়ালের ভেতরে বসে যে পড়াশোনা সেসব তো মোলাই কোনকালেই ছেড়ে দিয়েছে। ওসব ওর ভালোও লাগে না আর ওর কাজেও লাগে না কোনো। বরং ও রোজ কত কি শেখে খোলা আকাশের নিচে আলো হাওয়া জল মাটি অবিরল গায়ে মাখতে মাখতে কেউ তার কোনো খবর রাখে না। 

মোলাই এখন ষোলো বছরের কিশোর। মাঝারি উচ্চতার শক্তপোক্ত শরীর। গায়ের ধবধবে ফর্সা রং রোদ জল মাটি মেখে মেখে এখন সামান্য তামাটে। অবশ্য তাতেই ওকে আরও বেশি আকর্ষনীয় লাগে ময়নার। মোলাই যখন হাসে তখন ওর গোলগাল মুখে ছোটছোট চোখদুটো সবার আগে সে হাসি মেখে নিয়ে কি ঝকঝকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে! ময়না জানে শুধু ও নয় আরো অনেক কিশোরীই আড়ে ঠারে চায় মোলাইয়ের দিকে। তবে মোলাই যে কাকে চায় সেটাই বোঝা যায় না। ও সত্যি কি কাউকে চায়? উদাসী বাউলের মত বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় সে। কোনদিকেই যেন নজর নেই। এই এক ধারা!ময়না ভাবে এইবার আলি আঃয়ে লিগাং এর উৎসবে সে ঠিক মোলাইয়ের সাথে নাচবে। 

আলি আঃয়ে লিগাং মিশিংদের বীজবপনের উৎসব।  বসন্তের আগমনে ফাল্গুনের প্রথম বুধবার থেকে শুরু হয়ে  পাঁচদিন ধরে চলে এই বিরাট উৎসব। সকালে নিয়ম রীতি মেনে ঘরের তাঁতে বোনা নতুন কাপড় পরে ধান বোনে গ্রামের বড়রা। দেবতার কাছে প্রার্থনা করে যেন সারা বছর ভালো ফসল হয়। মোলাইও নিজের মত করে কিছু বীজ পোঁতে গ্রামের রাস্তার ধারে। দুপুরে খোলা মাঠে বসে গ্রামের সবাই মিলে ভোজ খায় ওরা। ইখু সিদ্ধ(বাঁশের কোঁড়), শুঁটকি মাছ আর শুয়োরের মাংস দিয়ে ভাত খাওয়া হয়। আফুলি, মোলাইয়ের মা, অনেক আপং(ভাতের মদ) বানিয়ে রেখেছে। লাখীরাম তো সারাদিন খাচ্ছেই আজ মোলাইও খাবে। ও-ও তো বড় হয়েছে এখন। শহরের মানুষ যেমন চা খায়, কেউ বেড়াতে এলে চা দিয়ে আপ্যায়ণ করে ওরাও তেমনি করেই আপং খায়। 
বিকেলে শুরু হল ছেলে মেয়েদের নাচগানের উৎসব। মৃদঙ্গ ঢোল মন্দিরা বাজিয়ে গান গায় ছেলেরা আর মেয়েরা সেই তালে কোমর দুলিয়ে নাচে। 
ময়না একফাঁকে সরে এসে মোলাইয়ের হাত ধরে টানে। "নাচবে এসো"।
সরল হাসিতে ভরে ওঠে মোলাইয়ের মুখ। 
"আমি নাচলে তোমাদের তালে ভুল হয়ে যাবে তো!"।
"হয় হবে। তবু এসো।"
মোলাইয়ের হাত ধরে ময়না নাচে। তাই দেখে গ্রামের আরো ছেলেরা এসে সেই নাচে যোগ দেয়। হাসি আর আনন্দ ঢেউয়ের মত বয়ে যায় সবার মনে। সে আনন্দের রেশ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নব বসন্তের আকাশে বাতাসে। খুশির হিল্লোল ওঠে সবার প্রাণে।

মোলাই বোঝে ময়নার মনের কথা। কিন্তু ওর মন ওদিকে টানে না। ওর একমাত্র ভালোবাসা প্রকৃতি। এক জ্যোতিষী ওর হাত দেখে একদিন বলেছিল তোমার ভাগ্য বাঁধা আছে প্রকৃতির সাথে। মোলাই ভালো বোঝেনি লোকটা ঠিক কি বলতে চেয়েছিল। তবে এটা বোঝে এই মাজুলির প্রকৃতি ওর শরীরের অনু পরমাণুতে মিশে আছে। এখানকার গাছপালা জীবজন্তু সব্বাই ওর খুব আপন, যেন ওর সত্ত্বার আরেক অংশ।

শ্রাবণমাসে একদিন মোলাই ওর গরু মোষের পাল নিয়ে চরাতে চরাতে পাঁচ মাইল দূরের কোকিলামুখ গ্রামে চলে গিয়েছিল। তখন বেলা এগারোটা হবে, একদল বাবু আর কিছু মজুর এসে কি সব আলোচনা করছিল। মন দিয়ে শুনে মোলাই বুঝতে পারল এরা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক। কোকিলামুখে অনেক গাছের চারা বসানো হবে। প্রতি বছর বানে এদিকের দ্বীপগুলোর অনেকটা করে অংশ ভেঙ্গে নদীর গর্ভে তলিয়ে যায়। গাছপালা শিকড় ছড়িয়ে মাটিকে বেঁধে রাখলে ভাঙ্গন ঠেকানো যাবে। পাতা ঝরে পড়ে পচলে মাটিতে সার হবে তখন সেই মাটিতে অন্য গাছপালাও ভালো জন্মাবে। 
শুরু হয় গাছের চারা পোঁতা। 

মজুরদের কাছে গিয়ে মোলাই বলে, "আমাকে কিছু চারা দাও। আমিও পুঁতবো।"
তারা জানায় সাহেবের হুকুম না হলে ওরা চারা দিতে পারবে না।
সরাসরি এবার মোলাই গিয়ে হাজির হয় সাহেবের কাছে। ফরেস্ট অফিসার বাবুটি ভাবলেন, ভালোই হল। আরেকজন মজুর থাকলে কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হবে। মোলাইকেও লাগিয়ে দিলেন গাছ পোঁতার কাজে। 
মহা উৎসাহে মোলাই গাছ পুঁততে শুরু করে। কত রকম গাছ! শাল, শিশু, শিমূল, বাবলা, অর্জুন....... বড় হলে ছায়া দেবে এরা। মাটি বেঁধে রাখবে। মাটিতে কত ঘাস জন্মাবে.......অনেক স্বপ্ন মুলাইয়ের দুচোখে আঁকা হয়ে যায়। 
সাতদিন পর সব গাছের চারা পোঁতা শেষ হয়ে যায়। মজুরদের দল পাওনাগন্ডা বুঝে নিয়ে ফিরে যায় নিজের নিজের কাজে। মোলাই কিন্তু ফিরতে পারে না। ওর মনে হয় কত খালি জায়গা পড়ে আছে এখনও। সব গাছ দিয়ে ভরিয়ে দিতে হবে। গ্রাম তন্নতন্ন করে বীজ সংগ্রহ করতে থাকে সে। 

শ্রাবণের শেষে তুমুল বৃষ্টি নামে। নাগাড়ে বৃষ্টি চলতে চলতে একসময় ফুঁসে ওঠে ব্রহ্মপুত্র। নদীর বিস্তার দেখে বুকে তখন ভয়ের  কাঁপন জাগে। সাপের ফনার মত বিশাল বিশাল ঢেউ নিষ্ফল আক্রোশে মাথা কুটে মরে। ঘোলা জলের স্রোত দুরন্ত বেগে ঘূর্ণি তুলে ছুটতে থাকে। নদীর বুকে জেগে থাকা ছোট খাটো সব দ্বীপগুলোকে গিলে নেয় রুদ্র কালভৈরবের মত ভয়ংকর ব্রহ্মপুত্র। তারপর সে ভাসিয়ে দেয় কোকিলামুখ, অরুণা চাপোরি আরও কত শত গ্রাম। মোলাইদের মত সকলে তখন আশ্রয় নেয় চাং-ঘরে। খাদ্য বলতে গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে রাখা কন্দ, বীজ আর শুকনো মাছ মাংস।

পনেরো কুড়িদিন কি একমাস পর ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে সর্বগ্রাসী জল। জেগে ওঠে ডাঙ্গা। ভয়ে গুটিয়ে থাকা মানুষগুলো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে শুরু করে। কারো চাষের ক্ষেত তলিয়ে গেছে নদীগর্ভে। কারো গরু বাছুর ভেসে গেছে বানের জলে। আরও কত সর্বনাশের হাহাকার ধ্বনি ওঠে ঘরে ঘরে। তবে এসবও ওদের গা সওয়া হয়ে গেছে। নিরুপায় মানুষগুলো জানে ফি বছর এই বিপদ ঘাড়ে নিয়েই চলবে ওদের জীবনযাপন। প্রকৃতির এই রোষ ওদের ভবিতব্য। তবে এবারের ক্ষয় ক্ষতি যেন অন্যান্য সব বছরকে ছাপিয়ে গেছে। এরকম বন্যা বহুকাল দেখেনি ওরা। অপেক্ষাকৃত উঁচু গ্রামগুলোও এবার জলের গ্রাস থেকে রেহাই পায় নি। 

মোলাই আবার বেরিয়ে পড়ে ওর গরু মোষ নিয়ে। কিন্তু কোথায় ঘাস? দূর দূরান্তেও একফোঁটা সবুজ চোখে পড়ে না। গাছপালা ভেঙ্গে মুচড়ে তলিয়ে গেছে নদীর জলে। বন্যার পর বৃষ্টি থেমে অসহ্য রোদ উঠেছে। দুঃসহ রোদের তাপে বেশিক্ষণ পথ চলাও দুষ্কর। তবু মোলাই চলতে থাকে কোকিলামুখ গ্রামের দিকে। ওখানে ওরা অনেক গাছ লাগিয়েছিল। কেমন আছে ওগুলো? দেখতে হবে। 

কোকিলামুখে এসে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায় মোলাই। আদিগন্ত ধূ ধূ করছে স্লেট রঙা পলি মাটি। সবুজের কোনো চিহ্ন নেই কোথাও। চোখ ফেটে জল আসে মোলাইয়ের। ভূতগ্রস্হের মত চলতে থাকে ও। ওদের সব চেষ্টা বানের জলে ভেসে গেছে। হঠাৎ একজায়গায় এসে থমকে দাঁড়ায়। কী ওগুলো? আরও সামনে এগিয়ে বুঝতে পারে অগুন্তি সাপ মরে পড়ে আছে এখান ওখানে ছেঁড়া দড়ির মত। স্তব্ধ হয়ে যায় মোলাই। এত সাপ মরল কেন? কি করে? সাপগুলোর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে চোখের জলে ভেসে যায় মোলাইয়ের গাল আর বুক। কি অসহায় মৃত্যু! সহ্য করতে পারে না মোলাই সে দৃশ্য।

ঝড় ওঠে মোলাইয়ের মনে। যোরহাটের কাছে এক বনকর্মীর সাথে পথে দেখা হয়ে যায় ওর। কথায় কথায় সাপ মরার প্রসঙ্গ তুলতেই লোকটি বলে সাপগুলো আশ্রয়ের অভাবে মারা গেছে। বন্যার সময় ওদের গর্তগুলো সব জলে ভরে গিয়েছিল। তার মধ্যে এখানে কোন উঁচু গাছপালা নেই যাতে ওরা আশ্রয় নিতে পারে। তারপর আবার অসহ্য রোদে গরমে আর খাদ্যের অভাবে সাপগুলো মারা গেছে। 

অধীর হয়ে মোলাই বলে, "তবে তো ওখানে অনেক গাছ পোঁতা দরকার। তোমরা আমাকে কিছু গাছের চারা দিতে পারো? আমি পুঁতব!"

হা হা করে হাসে বনকর্মীটি। 
"অনেক চেষ্টা হয়েছে আগে। ওই বন্ধ্যাভূমিতে কোন গাছ জন্মাবে না। চারা পুঁতলেও বাঁচবে না। বেগার খেটে কোন লাভ নেই ভাই। বাড়ি যাও। যেমন গরু মোষ চরিয়ে খাচ্ছ তাই করো গে বরং।"

মোলাই দমে না। পরদিনই সোজা গিয়ে হাজির হয় কাছের এক গ্রামের বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী যদুনাথ বেজবরুয়ার বাড়িতে। মোলাই এর অবশ্য যদুনাথের আসল পরিচয় জানা ছিল না। স্কুল ছুট মোলাই শুধু এটুকু জানত যদুনাথ বেজবরুয়ার গাছপালা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান আছে। 

যদুনাথ সব শুনে  ওকে বুঝিয়ে বলেন, "দেখো, ওই বালি মাটিতে সাধারণ কোন গাছ তো প্রথমেই জন্মাবে না। তবে বাঁশ গাছ লাগিয়ে দেখতে পার। যত্ন করে যদি বাঁচাতে পারো তবে বাঁশগাছের শেকড় খুব শক্ত করে মাটি আঁকড়ে ধরবে আর সাপখোপের ভালো আশ্রয়ও হবে ওই বাঁশ গাছই। পরে ধীরে ধীরে অন্য গাছ লাগানো যেতে পারে।"
"তাই সই।"
 মোলাই মোটে পঁচিশটা বাঁশের চারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করতে পারে।

পরদিন থেকেই শুরু হয় মোলাইয়ের একাগ্র সাধনা। বাঁশ গাছ লাগায় মোলাই। দিনরাত এক করে যত্ন করে তাদের। বেঁচে যায় তারা। মোলাই কিন্তু থামেনা। নিরন্তর গাছ লাগাতে থাকে, লাগাতেই থাকে........ প্রতিদিন গাছের অতন্দ্র পাহারায় থাকে সে। বিশ্ব সংসার ভুলে প্রতিটা গাছকে সন্তানের অধিক যত্ন করে। একদিন নয়, দুদিন নয়, মাস বা বছরও নয়........ একটানা তিরিশ বছর! হ্যাঁ, তিরিশ বছর!

তিরিশ বছর পর......
যে বিস্তীর্ণ জায়গা একদিন ছিল ধূ ধূ বালির চর সেখানে এখন সাড়ে পাঁচশো হেক্টরের গভীর অরণ্য। কত শত বৃক্ষ, গুল্ম, লতারা সব জড়াজড়ি করে থাকে সেখানে! মৃত সাপের স্তুপ দেখে যে মোলাই একদিন কেঁদে ভাসিয়েছিল আজ সে তাদের আশ্রয় দিতে পেরেছে।  শ খানেকের ওপর প্রজাতির পাখি বাসা বেঁধেছে গাছে গাছে। ছোটখাটো অজস্র রকমের জন্তু জানোয়ার তো আছেই তাছাড়া হরিণ এসেছে সে জঙ্গলে, বুনো মোষ আছে, গন্ডার আছে এমনকি বাঘ, হাতিও থাকে এখন সে অরণ্যে। আর থাকে মোলাই। হ্যাঁ সেও জঙ্গলের ভেতরেই চাং-ঘর বেঁধে থাকে। গরু মোষ পোষে। দুধ বিক্রি করে বাপের মতই। বাকি সময়টা জঙ্গলই ওর ধ্যান জ্ঞান। এই অরণ্যের সৃষ্টিকর্তা সে একা। পালকও সে একাই। বাইরের পৃথিবী জানে না এই মহা অরণ্যের খবর, জানাতেও সে চায় না। নিজের সৃষ্টিতে নিজেই নিমগ্ন সে। 

**************

জিতু কলিতা নৌকা ভাড়া নিয়ে একটা ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে সারাদিন নদীতে ঘুরছেন। পেশায় তিনি ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার এবং ফ্রি লান্স সাংবাদিক। ব্রহ্মপুত্রের বুকে নানা রকম পরিযায়ী পাখির ছবি তুলে বেড়াচ্ছেন তিনি এবার। হঠাৎ চোখে পড়ে আকাশে কিছু শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। শকুন? শকুন কোত্থেকে এল এখানে? এদিকে তো শকুন দেখা যায় নি এর আগে? শকুনের গতিবিধি লক্ষ্য করতে করতে তাঁর নজরে আসে নদীর  অদূরে ঘন সবুজ অরণ্যের রেখা। থোকা থোকা সাদা ফুলের মত বকের ঝাঁক বসে আছে ঘন সবুজ গাছের মাথায় মাথায়। গলায় ঝোলানো ক্যামেরা ওদিকে তাক করতে করতে আশ্চর্য হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন,
"ওইটা কিসের জঙ্গল মাঝি ভাই? এখানে কোন জঙ্গল আছে বলে তো শুনিনি কোনদিন!"
"ওঃ! ওইটা? ও তো মোলাই কাঠনি (মোলাইয়ের জঙ্গল)!
"মোলাই কাঠনি? কে এই মোলাই?"
"আছে এক পাগল। তিরিশ বছর ধরে গাছ লাগিয়েই যাচ্ছে।
"একা?"
"হ্যাঁ, একাই।"
"নৌকা ভেড়াও। আমি যাব ওখানে।"
"পাগল নাকি? অনেক হিংস্র জন্তু জানোয়ার আছে ঐ জঙ্গলে। আমরা ঢুকি না ওখানে।"

যোরহাট ফিরে জিতু সটান পৌঁছে যান ফরেস্ট অফিসে। 
"মোলাই কাঠনি সম্পর্কে কি তথ্য আছে আপনাদের কাছে?"
"মোলাই কাঠনি? সে আবার কি? নাম শুনিনি তো এই জঙ্গলের? কোথায় পেলেন আপনি এ খবর?"
"খবর পাই নি। নিজে চোখে দেখে এসেছি। কোকিলামুখের কাছে এত বড় একটা জঙ্গল অথচ আপনারা কোনো খবরই রাখেন না?"
বনকর্মীরা এ ওর মুখের দিকে তাকান। 

কিছুদিনের মধ্যেই নৌকায় করে সরেজমিনে তদন্ত করতে বেরোন বনকর্মীরা। গিয়ে তাদের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। এত বড় একটা জঙ্গল এখানে অথচ তারা জানতেই পারেন নি!! ভারী আশ্চর্য তো!
তবে একটা রহস্যের সমাধান হল।  এতদিন তাঁরা বিস্তর মাথা ঘামিয়েও বুঝতে পারেন নি  যোরহাটের কাছ থেকে মাজুলির দ্বীপে যাবার পথে হাতির পালগুলো চার পাঁচ মাসের জন্য কোথায় গায়েব হয়ে যায়! তারপর আবার তাদের প্রকাশ্যে দেখা যায় বাচ্চা কাচ্চা সমেত। এই মোলাই কাঠনি তাহলে ওদের বাচ্চা দেবার সেই নিভৃত  নিরাপদ জায়গা! 
না,বনকর্মীরা সেবার মোলাইয়ের দেখা পান নি। সে তখন এতবড় জঙ্গলের কোন প্রান্তে কোন গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত তা কেউ জানে না।

তবে জিতু কিন্তু হাল ছাড়েন না। জাত সাংবাদিক তিনি। স্টোরি পেয়ে গেছেন। এত সহজে তো হাল ছাড়লে চলবে না। মোলাই কাঠনির আশে পাশে ঘুরঘুর করেন। সাহস করে ঢুকেও যান কখনো সুঁড়িপথ ধরে জঙ্গলের ভেতর। 
এরকমই একদিন হঠাৎ জিতুর চোখে পড়ে হাতে পায়ে কাদা মাটি মাখা গামছা পরিহিত  একজন মধ্যবয়সী মানুষ হাতে শাবল নিয়ে এদিকেই আসছে। ঘাবড়ে গিয়ে জিতু একটা মোটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। অচেনা মানুষ! কি উদ্দেশ্য বলা তো যায় না! আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখেন মানুষটার ওপর।
একটু পরেই সেই মানুষটা চিৎকার করে ওঠে, 
"তোমার ঠিক পেছনেই বুনো মোষ! পালাও!"
জিতু আরও ঘাবড়ে গিয়ে এতক্ষণ যাকে ভয় পাচ্ছিলেন দৌড়ে এসে তার ঘাড়েই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। 
মোলাইয়ের সাথে এভাবেই প্রথম মোলাকাত হল জিতুর। 

ধীরে ধীরে পরিচয় গভীর হয়। মোলাই তার কুঁড়েতে নিয়ে যায় জিতুকে। সেখানে এখন মোলাইয়ের নববিবাহিতা স্ত্রী বিনীতাও থাকে মোলাইয়ের সাথে। জঙ্গলের বাঁধন আলগা করে সাত পাঁকের বাঁধনে বাঁধা পড়তে বেলা অনেকটাই গড়িয়ে গেছে মোলাইয়ের।

জিতু কলিতা মোলাইকে জানান যে তিনি মোলাইয়ের কর্মকান্ডের কথা সারা পৃথিবীর মানুষকে জানাতে চান। মোলাই যে একা হাতে কি অসাধ্য সাধন করেছে তা পৃথিবীর জানা দরকার। 
মোলাই আশ্চর্য হয় এ কথায়। 
"আমি একা তো এ জঙ্গল সৃষ্টি করি নি! আমি শুরু করেছিলাম বটে তারপরে তো নদী, বাতাস, পাখি, বনের পশুরা সবাই মিলেই এই জঙ্গল তৈরি করেছি আমরা। এখন তো গাছে ফল ধরে, বীজ পাকে সেই বীজ মাটিতে পড়ে আপনা আপনি জঙ্গল বেড়ে যাচ্ছে। তবে এটা ঠিক আমি এখনও রোজ কম পক্ষে একটা করে গাছ লাগাই।"

মোলাই ভাবে, এ তো যে কেউই করতে পারে। এটা কি আবার বলবার মত কোনো কাজ হল? ওকে কে বোঝাবে যে, আসলে এই সহজ কাজটাই অন্য সবার কাছে কত কঠিন! 

মোলাই চায় না ওর কথা সবাই জানুক। কারণ এসব কথা বাইরে বেশি প্রচার হলে দুষ্ট লোকের ভীড় হবে জঙ্গলে। বুনো জীবজন্তুর ক্ষতি করবে তারা। তাছাড়া মোলাইয়ের বেশি কথা বলারও সময় হয় না। সে কথা বলার চাইতে দা শাবল কোদাল নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। নিঃশঙ্ক বনদেবতার মত বনের অতন্দ্র প্রহরী সে। 

জিতু দিনের পর দিন নানা সময়ে বিনীতার সাথে কথা বলে জেনে নেন মোলাইয়ের কর্মকান্ড। মস্ত কোন জারুল বা শিমূল গাছের নিচে আলো ছায়ার জাফরিতে বসে জিতু শোনেন কিভাবে বুনো জন্তুর উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রামবাসীরা বনের গাছ কাটতে এলে মোলাই বুক চিতিয়ে গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ায়। মোলাই বলে, "আগে এখানে আমাকে কেটে টুকরো টুকরো কর। তারপর তোমরা জঙ্গলের গাছে কুড়ালের কোপ বসাতে পারবে। তার আগে নয়।"
গ্রামবাসীরা হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেছে তারপর।
বিনীতা দুঃখ করে বলে, "আমাদেরও অনেক গরু মোষ বাঘের পেটে গেছে। তবে তার জন্য মোলাইয়ের কোনো তাপ উত্তাপ নেই। বুনো জন্তু জানোয়ারের সামান্য ক্ষতিও ও সহ্য করতে পারেনা।"
জিতু বিনীতার কাছেই শোনেন মোলাই এখন আরও একটা নতুন নদী চরে ক্রমাগত গাছ লাগাচ্ছে।  ভূমি ক্ষয় থেকে পৃথিবীর সবচাইতে বড় নদী দ্বীপ মাজুলিকে রক্ষা করার অসম্ভব এক প্রতিজ্ঞা নিয়ে মোলাই নিঃশব্দে লড়াই করে যাচ্ছে।

কিছুদিন পর জিতু সমস্ত তথ্য দিয়ে একটা স্টোরি লেখেন। যাদব পায়েং এর এই আশ্চর্য কাহিনী জমা দেন 'দৈনিক জন্মভূমি'র দপ্তরে। সম্পাদক মশাই তো সেই স্টোরি দেখে হেসে অস্থির। জিতুকে বলেন, "এসব উদ্ভট গল্প কোত্থেকে যোগাড় করেন মশাই! কল্পনারও তো একটা লাগাম পরাবেন, নাকি? ইচ্ছেঘোড়া ছোটালেই হল? যত্ত সব!"
জিতু কলিতার সেই স্টোরি সম্পাদকের ড্রয়ারের অন্ধকারে পড়ে থাকে দীর্ঘ আট মাস। তারপর হঠাৎ একদিন সম্পাদক মশাইয়ের টনক নড়ে।  তিনি জানতে পারেন জিতু মোটেই কল্পনার জাল বোনেন নি। সত্যিই যাদব পায়েং ওরফে মোলাই বলে একজন মানুষ আছে এই ধরাধামে। সত্যিই সে এক অদ্ভুত কীর্তি ঘটিয়ে ফেলেছে। 
জিতু কলিতার সেই লেখা প্রকাশ পায় আসামের এক সংবাদপত্রে। তারপর সর্বভারতীয় ইংরেজী দৈনিকে।

এরপরেই সৃষ্টি হতে থাকে এক আশ্চর্য ইতিহাস। না, ভুল হল একটু। ইতিহাস তো তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে সৃষ্টি হচ্ছিলই লোকচক্ষুর অন্তরালে। এবার যবনিকার আড়াল সরে যায় সেই ইতিহাসের ওপর থেকে। মানুষ জানতে পারে অরণ্য-মানব যাদব পায়েং এর কথা। দেশে বিদেশে মাতামাতি শুরু হয়ে যায় অতি সাধারণ মিশিং উপজাতির স্কুল ছুট এক মধ্যবয়সী মানুষকে নিয়ে। যে নিজেও হয়ত জানত না যে কি অসাধ্য সাধন সে করে ফেলেছে একেবারে একক প্রচেষ্টায়! পরিবেশ রক্ষায় কি অসামান্য অবদান তাঁর! 

আজকাল যখন তখন যাদব পায়েং এর ডাক পড়ে গৌহাটি, দিল্লি, ফ্রান্স,ইটালিতে। তাকে বাধ্য হয়ে জুতো জামা কিনতে শহরে ছুটতে হয়। খালি গায়ে খালি পায়ে কি আর দেশ বিদেশের বাঘা বাঘা লোকের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো যায়!
পুরস্কার আর সম্মানের ঝুলি উপছে পড়তে থাকে যাদবের। পদ্মশ্রী খেতাব দেন সরকার বাহাদুর। 

মোলাই কিন্তু আগের মতই নির্বিকার। সে অবলীলায় বলে, "দয়া করে আমাকে এপ্রিল থেকে জুন কোথাও যেতে বলবেন না। জঙ্গলে তখন আমার অনেক কাজ।"
দেশ বিদেশ থেকে লোক আসে তার সাক্ষাৎকার নিতে, ডকুমেন্টারী বানাতে। মোলাই কাদা মাটি মাখা হাত পা নিয়ে খালি গায়ে গামোসা (গামছা) গলায় ঝুলিয়ে বসে যায় কথা বলতে, গল্প করতে। সে যে মাটিরই সন্তান! এতেই সে স্বচ্ছন্দ!

মোলাইয়ের আজকাল মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় ওর হাত দেখে বলা সেই জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎবাণী, "তোমার ভাগ্য বাঁধা আছে প্রকৃতির সাথে।" এখন যেন তার অর্থ কিছুটা বুঝতে পারে সে।

মোলাই চলে নতুন চরে নতুন গাছের চারা বুনতে। সাংবাদিকের দল তার পিছু নেয়! মোলাই তাদের বলে, "আমার কাছে এসে সময় নষ্ট না করে আপনারা বরং চেষ্টা করুন যাতে প্রতিটা স্কুলের প্রত্যেকটা  বাচ্চা যেন অন্তত একটি করে গাছ লাগায় আর যতদিন স্কুলে থাকবে তারা নিজের নিজের সেই গাছের যত্ন নেয়। ছোট থেকে গাছের প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠলে ওরা আর কোনদিন গাছ কাটবে না। পরিবেশ ধ্বংস করবে না।"

মোলাই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যায় সামনে। ওর এখনও অনেক কাজ বাকি। আরো অনেক অনেক গাছ লাগাতে হবে যে! গাছ বাঁচলে জীব জন্তু বাঁচবে। জীব জন্তু সবাই বেঁচে থাকলে তবেই না মানুষ সুস্থ ভাবে এই পৃথিবীতে আরও বহু বহুদিন বেঁচে থাকতে পারবে। 

গ্রাম্য অশিক্ষিত অতি সাধারণ মানুষ মোলাই পেয়ে গেছে পৃথিবীর সুস্থতার চাবিকাঠি।  
কিন্তু আমরা.......?



প্রকৃতি, পরিবেশ  ও আমরা
       কবিতা বণিক

 মানুষ ,জীব, জন্তু, গাছপালা, কীটপতঙ্গাদি পৃথিবীর ভৌগলিক অবস্হার উপর নির্ভর করে বাঁচে। ঠাণ্ডা, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, গরম, মরুভূমি, নাতিশীতোষ্ণ, বনাঞ্চল জলভূমি ইত্যাদি জায়গার প্রাণী সমস্ত, গাছপালা সবই প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে  বাঁচে। মানুষের সংখ্যা  দ্রুত বাড়ছে সেইমত মানুষের চাহিদাও বাড়ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার ও বাড়ছে। অথচ  প্রাকৃতিক সম্পদ তো বাড়ছে না।  কারণ যুগ যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসা প্রাকৃতিক সম্পদ এর সংরক্ষণের কথা কোনদিনই যেমন ভাবা হয়নি  তেমনি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।  আমরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে দেখি খোলা বিদ্যুতের তারে কত মানুষের কত ভাবে মৃত্যু হচ্ছে। তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা বা অতিরিক্ত  সাবধানতা নেই। এক ই ভাবে আজও  বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ হচ্ছে  মানুষ। 
সরকার এর  তরফ থেকে  বিকল্প হিসেবে মিউনিসিপ্যালিটি র  সমস্ত ওয়ার্ডে  হসপিটাল, কারখানা , চা- বাগান  গুলিতে , বাস , ট্রেন গুলিতে বিদ্যুৎ এর পাশাপাশি সোলার বিদ্যুৎ  চালু করা উচিত।  আবাসন  গুলিতে ও সোলার বিদ্যুৎ  চালু করা  উচিত। বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বারে বর্ষাকালে।  আজ পর্যন্ত এর কোন সুরক্ষার সেভাবে কোন ব্যবস্থা করা যায়নি।  সৌর বিদ্যুতের পাশাপাশি বায়ু বিদ্যুৎ এর  ও প্রয়োজন খুব বেশি।  পাহাড়ের উচ্চতায় যে হাওয়া বয় সেখানে  বায়ু চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কে কাজে লাগানো যেতে পারে। সূর্যের রশ্মি বা বাতাসের প্রাচূর্য আমরা জানি। এখানে দূষনের ব্যাপার নেই।  কিন্তু কয়লা, তেল, গ্যাস খনিজ পদার্থ পুড়লে প্রতিনিয়ত  বাতাসে মিশে যায়  বিষাক্ত  কার্বনডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, হেক্সা ক্লোরোকার্বন। এসমস্ত  কারণে বায়ু স্তরে  তাপমাত্রা বাড়ে। বায়ুস্তরে ছিদ্র হয় ফলে অতিবেগুনী রশ্মি ভুমণ্ডলএ প্রবেশ করে। এতে  নানান সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।  এর মধ্যে অসুখ বিসুখ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মারণ ব্যাধির সৃষ্টি হয়েছে। কার্বন নিঃসরণ এর মাত্রা কমানোর একান্ত প্রয়োজন।  মরুভূমি হওয়ার  থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র গাছ। গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নিয়েও সাহায্য করতে পারে। একজন মানুষের জন্য একটা বড় গাছের প্রয়োজন। সেইমত গাছের সংখ্যা কোথায়?  জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ এই বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা ও গাছ কাটা। প্রকৃতি  প্রয়োজনে নিজেকে ঠিক করে নেয়। ভয়ংকর খরা, বন্যা, মহামারী, ভুমিকম্প ইত্যাদি নানাভাবে।  আমরা প্রকৃতির ব্যাথা বুঝে কাজ করলে  এমন  পরিস্থিতিতে আমাদের পড়তে হত না।  এখন তো সময় ও নেই তবুও আমরা  প্রকৃতির  দূষণ রোধ করে প্রকৃতির সাথে চলার চেষ্টা করলে যদি আমাদের  হাঁপানি, ফুসফুসের রোগ ( যা এখন ঘরে ঘরে)  মারণ রোগের হাত থেকে কিছু যদি  রক্ষা করা যায় সেই চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য।





দক্ষিণের গালিচায়- মুন্নার 
জয়িতা সরকার 

সবুজ কার্পেট, নীল আকাশ,  সাদা মেঘের আনাগোনা, পিচ কালো রাস্তা, বাহারি জংলী ফুলে ভরা দক্ষিণের পাহাড়ি ছোট্ট  শহরটি  মন কাড়বে দেশ-বিদেশের যে কোন পর্যটকের। শরতের নীলাকাশ, সাদা মেঘ, পুজোর ছুটি ঘন্টা মানেই বেড়িয়ে পড়ার ডাক আসে। বাঙ্গালী-র হৃদয় জুড়ে তখন নদী- পাহাড়-সমুদ্রের হাতছানি। সেই বেড়িয়ে পড়ার টান উপেক্ষা করা যখন সাধ্যাতীত, অগত্যা বেড়িয়ে পড়তেই হল।  এবারের গন্তব্য চা গালিচায় মোড়া পশ্চিমঘাট পর্বতশ্রেণির ভগবানের নিজের দেশের অন্যতম সুন্দর শহর মুন্নার। 

দেশের পর্যটন মানচিত্রে স্বমহিমায় নিজেকে পরিচিত করেছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ কিংবা পূর্ব থেকে পশ্চিম সব প্রান্তের ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে মুন্নার পরিচিত। ভোর থেকে সন্ধ্যে মুন্নার-এর রূপ বদলায় প্রতি প্রহরে। বাহারি ফুল, চা-গালিচা, মেঘের খেলা, প্রথম রোদের ছটা, সব মিলিয়ে নৈসর্গিক মুন্নার। ছোট থেকে চা-এর শহরে বড় হলেও, দক্ষিণের এই বাগিচা শহর মন কেড়েছে অনেক বেশি। স্বাদে-গন্ধে দার্জিলিং-এর থেকে পিছিয়ে থাকলেও শৃঙ্খলিত বাগিচায় আর সবুজে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে এই শৈল শহরটি। 

পুজো মানেই বাঙ্গালির বেড়ানো, তবে বেশ কিছু বছর রাজ্যের বাইরে থাকায় সেই অভ্যেসে ভাঁটা পড়েছে, কিন্তু পিছুটান যাদের জন্য সেই বন্ধুরা যখন বলে, চল পুজোতে কোথাও একটা বেড়িয়ে পড়ি, তখন মনও বলে, 'বাজল ছুটির ঘন্টা।' চলো বেড়িয়ে পড়ি, তিন বন্ধু প্রায় দু'হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছল সিলিকন ভ্যালি অফ ইন্ডিয়া-তে, আমাদের বর্তমান ঠিকানা এখানেই। আমরা কর্তা-গিন্নি তো আগেই তৈরি। 








দশমীর দিন রাতে আমরা পাঁচমূর্তি বেড়িয়ে পড়েছিলাম মুন্নার-এর উদ্দেশ্যে। এবারের ট্রিপের বাড়তি উত্তেজনা ছিল সেল্ফ ড্রাইভিং, আমি নই, আমার কর্তার। মাঝ রাতেই বেড়িয়ে পড়লাম আমরা। গাড়ি ছুটছে হুসুর-ধর্মপুরী-কৃষ্ণাগিরি হয়ে সালেম এর দিকে। জাতীয় সড়ক -44 দিয়ে গাড়ি চলছে বেশ দ্রুত গতিতেই। পেছনে বসে থাকা এক বন্ধু বলে উঠল- ' আমরা longest highway দিয়ে যাচ্ছি।'   শ্রীনগর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত এই পথ, বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি হল। সালেম পৌঁছতেই মুন্নার যাওয়ার রাস্তা দু'দিকে ভাগ হয়ে গেল। একটি আনামালাই রিজার্ভ ফরেস্ট এর মধ্যে দিয়ে, অন্যটি দিন্দিগুল হয়ে। দিন্দিগুল হয়ে মুন্নার পৌঁছতে বেশ কয়েক কিলোমিটার বেশি হলেও, পাহাড়ি পথ কিছুটা কম। আমরা সেই রাস্তাই ধরলাম। মাঝে বেশ কয়েকবার চা-এর বিরতি, হাসি ঠাট্টায় ঘুম খুব বেশি থাবা বসাতে পারেনি।

দিন্দিগুল ছাড়িয়ে থেনি-র কিছু আগে ইডলি, ধোসা-যোগে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার রওনা হলাম আমরা। থেনি পেড়িয়ে যেতেই কিছুটা চড়াই শুরু হল, পপ্পুরা পেড়িয়ে আরেকটু ওপরে উঠতেই পাহাড়ি গন্ধ ভেসে এলো, রাস্তায় হালকা মেঘের আনাগোনা, পাখিদের কিচিরমিচির জানিয়ে দিল, 'ওয়েলকাম টু হিল্স।' ঘন সবুজ জঙ্গলের মাঝে কালো পিচ রাস্তা, আর নিস্তব্ধতায় মোড়া চারিদিক প্রথমেই মন কেড়ে নিয়েছে। গাড়ি ছুটছে মুন্নার-এর দিকে, যতদূর চোখ যায়, শুধুই সবুজ। পাহাড়ের ঢাল ধরে সুসজ্জিত চা বাগান। সবাই যেন নিয়ম মেনে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে এখানে। কিছুটা যেতেই গ্যাপ রোড, যেই পথে না এলে মুন্নারের সৌন্দর্য্য অধরা থেকে যায়। মসৃণ পথ, দু'ধারে সবুজ গালিচা আর দূরে পশ্চিমঘাট পর্বতের নীলাভ মহিমা। 









আমাদের হোটেল ছিল মুন্নার মার্কেট-এর কাছেই। চার্চ-এর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেই রেইনবার্গ হোম-স্টে হল আমাদের দু-দিনের ঠিকানা। ফুল দিয়ে সাজানো ছোট্ট বাগান মন কেড়েছে প্রথম দেখাতেই। এজিলিয়া, দেব-কাঞ্চন ফুলে ভরা বাড়ির উঠোন। চটজলদি ফ্রেশ হয়ে, দুপুরের খাবার পর্ব সেরেই বেড়িয়ে পড়লাম পথামেদু ভিউ পয়েন্টের দিকে। আকাশে তখন মেঘের আনাগোনা, তাই তড়িঘড়ি আমরা রওনা হলাম আত্তুকাড ওয়াটার ফলস-এর দিকে। পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে জলরাশি। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে পা বাড়ালাম হোটেলের দিকে। ডিনার সেরে ঘরে যেতেই দু-এক পশলা বৃষ্টি, কিছুটা আতঙ্ক নিয়েই ঘুমোতে গেলাম, কি জানি কাল মুন্নার যদি মুখ ভার করে থাকে। 

সকাল হতেই চার্চ-এর ঘন্টার আওয়াজ কানে এলো, এক ফালি রোদের ছটা দূরের পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে হোম-স্টে- এর উঠোনে। হালকা কুয়াশা আর রোদের মাখামাখিতে এক মায়াবি সকালের সাক্ষী হলাম আমরা। মনটাও বেশ খুশি, মুন্নার হাসছে। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে সাতটা। আমরা সবাই তৈরি, বেড়িয়ে পড়লাম টপ স্টেশনের উদ্দ্যেশ্যে। মুন্নার শহর থেকে টপ স্টেশনের দূরত্ব 34কিলোমিটার, অব্যক্ত এক সৌন্দর্য্য। একের পর এক চা-বাগানের অবর্ণনীয় রূপ, দূরের পাহাড়গুলো যেন আরও মোহময়ী করে তুলেছে মুন্নারকে। এই রাস্তা ধরে যেতেই পড়বে ফটো পয়েন্ট, মাত্তুপেট্টি ড্যাম, ইকো পয়েন্ট, কুন্ডালা লেক। আমরা প্রথমেই পৌঁছই টপ স্টেশন ভিউ পয়েন্টে, 20টাকা করে টিকিট কেটে মিলল টাওয়ার-এ ওঠার অনুমতি। চারিদিকে ওয়েস্টার্ন ঘাটের অপরূপ শোভা, মোহিত করবে সকলকে, বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে নেমে এসে ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম মাত্তুপেট্টি ড্যাম এর দিকে। ফিরতি পথে চোখে পড়ল ইন্দো-সুইস ডেয়ারি ফার্ম, তবে সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই, বেশ কিছুটা সময় ওই পথে কাটিয়ে আমাদের এবারের গন্তব্য এরাভিকুলম ন্যাশনাল পার্ক। মুন্নার মূল শহর থেকে 8 কিলোমিটার দূরে। পৌঁছাইতেই দেখি লম্বা লাইন, টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে তখন শুধু একটাই কথা ভেবে চলেছি, একবার যেন দেখা পাই।


 





একশো সত্তর টাকা করে প্রতিজনের টিকিট, আর ক্যামেরার জন্য 50টাকা, টিকিট কেটেই নিয়ম-নীতি পড়তে গিয়েই প্রথম চোখ আটকাল, তার দেখা পাওয়া নাকি নিয়মিত নয়, একটু মনটা খারাপ হল, এদিকে আকাশও তখন মুখ ভার করছে। সে যা হোক, বাসে উঠে বসতেই কুয়াশা ঘিরে ধরছে চারিদিকে। মূল পার্কের গেটের সামনে বাস থেকে নেমে হেঁটে উঠতে হবে অনেকটা। শুরু হল আমাদের যাত্রা, বহু রকমের ছোট বড় গাছে ভরা পাহাড়ের গা। হঠাৎই থমকে গেলাম, ওই তো ওপরে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা, ওদের দেখতেই তো এতদূর আসা। সেই নীলগিরি তাহর  (nilgiri tahr )। দল বেঁধে নীচের দিকে নামছে ওরা। একটু আশঙ্কা থাকলেও জানা ছিল এদের দেখা মিলবে। পশু-পাখি আমাকে কখনও নিরাশ করেনি। এই অবলুপ্তির পথে যাওয়া প্রাণীটির যে দেখা পাব, সে ভরসা আমি সকলকে দিয়েই এসেছি। চলল ফটো-সেশন। ঠান্ডা বাড়ছে, এবার নীচে নেমে আসার পালা। যদিও  বিশেষ এই প্রাণীটিকে চাক্ষুষ করে মনে তখন উষ্ণ উন্মাদনা। 

রাতে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম হোমমেড চকলেট কিনতে, সঙ্গে টুকিটাকি আরও কিছু। আজই শেষরাত এই সবুজ মলমল চা-এর গালিচা শহরে। তবে এখনও কিছুটা বাকি আছে, সকাল হতেই আবার গ্যাপ রোড। মুন্নার-এ আমাদের শেষ সকালের আকাশ ছিল নীলে মোড়া। আর তাতেই গ্যাপ রোডের শোভা বেড়েছে দ্বিগুণ। পুরো রাস্তায় দু' পাশে চা-বাগান আর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা হৃদয়ের ভ্রমণ কুঠুরিতে যত্নে রাখব কথা দিলাম। 

(ছবি- কিংশুক সরকার)






সন্ধান 


ছবি- সংগৃহীত 




মোনালিসা
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভাদুড়ী

পৃথিবীর প্রতিকৃতির নাম মোনালিসা। বিখ্যাত বিজ্ঞানী চিত্রকর লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ১৫৩ থেকে ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই চিত্রটি তৈরি করেন।

এবারে আমরা মোনালিসার পরিচয় কী তা নিয়ে আলোচনার আসব। দেলগিওকোন্ডার নামের এক  ভদ্রলোকের স্ত্রীর নাম ছিল মোনালিসা । এই চিত্রটি তারই প্রতিকৃতি বলা হয়। ইতিহাস তো এই কথাই বলে কারণ ইতিহাস কখনই মিথ্যা বলে না। তাই এটা শুধু কল্পনার উপর ভিত্তি করে চিত্রকর লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এই চিত্রটি আঁকেননি। তিনি তাঁর ছবিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক প্রাণবস্তু নারীকে। পৃথিবী বিখ্যাত জাদুঘর পারিসের 'লুভরে' এই বিশ্ববিখ্যাত চিত্রটি রক্ষিত আছে এখনও পর্যন্ত। চিত্রটির মূল্যমান সব মূল্যায়নের উর্দ্ধে। 'মোনালিসার' মুখের রহস্যময় হাসিটির সঙ্গে পৃথিবীর অসংখ্য চিত্রমোদীকে অভিভূত করে রেখেছে। আজকাল রহস্যময় কিছুকেই 'মোনালিসার হাসির সঙ্গে তুলনা করা হয়।  সেই মৃদুহাসির কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। আগামিদিনেও কি পাওয়া যাবে এটা শুধুই প্রশ্ন প্রশ্নই আমাদের ।

চিত্রকর লিওনার্দো মৃত্যু পর্যন্ত নিজের সঙ্গে রাখতেন এই চিত্রটি। তাঁর মৃত্যুর পর চিত্রটি ফ্রান্সের রাজার অধিকারে আসে। চিত্রটির মধ্যে দিয়ে লিওনার্দো আজও বেঁচে আছেন আমাদের মধ্যে। মরেও তিনি মরেননি। এক কথায় বললে বলতে হয় তিনি অক্ষর ও অমর। প্রসঙ্গ ক্রমে মনে পড়ে গেল সপ্ত তুলসী দাসের সেই বিখ্যাত দোঁহাটির কথা- তুম বা জগমে আরা, জগ হাসে, তুম রোঁয়ে। এইসা কাম কর চলো সকে তুম হাসো। জগ রোঁয়ে । এই উদাহরণটি লিওনার্দোর পক্ষো প্রযোজ্য বটে।

এই দুর্মূল্য চিত্রটির নিরাপত্তার জন্য যাদুঘরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সজাগ রাখা হয়েছিল তবুও ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে যাদুঘর থেকে এই চিত্রটি চুরি হয়ে যায়। অনুসন্ধানের পর দুবছর পর অবশ্য ইতালিতে আবার সেটি পাওয়া যায়।

মোনালিসা ছবিটি বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির দীর্ঘ সাধনা ও অধ্যবসায়ের ফসল। ১৫০০ থেকে ১৫০৭ খ্রিষ্টদের মধ্যে তিনি নিপুণ তুলির টানে যুবতী মোনালিসাকে ক্যানভাসের উপর ফুঁটিয়ে তুলেছিলেন। মোনালিসা থেরের ডাক নাম ছিল ম্যাডোনা সংক্ষেপে মোনা। তিনি ছিলেন রাজকর্মচারী ফ্রান্সেসকো দেলগিও কোঙা নামক এক যুবকের সহধর্মিনী। দেলগিও কোন্ডা শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে মোনা বা ম্যাডোনার একটি প্রতিকৃতি আঁকার ফরমাস দেন। পারিশ্রমিকও ধার্য হয়ে যায় তখনই । প্রতিকৃতি এঁকে আসার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীর প্রাপ্য মজুরি হাতে হাতে মিটিয়ে দেওয়া হবে। নৈপুণ্য, নিষ্ঠা, ধৈর্য্য ও অধ্যবসায় সম্বল করে শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি রূপসী মোনালিসাকে তুলির টানে ক্যানভাসের ওপর তুলে ধরলেন এবং সমাপ্তও করলেন অতি প্রফুল্ল চিত্তে।

এবার তিনি সদ্য আঁকা প্রতিকৃতিটি নিয়ে ফরমাসদাতা রাজকর্মচারী দেলগিওকোন্ডার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। দেলগিওকোন্ডা ছবিটাতো নিলেন না, এমন কি শিল্পীকে একটি কানাকড়িও মজুরি স্বরূপ দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছবিটি। বগলে নিয়ে ধীর পায়ে ফরমাসদাতার ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন। বছর দশেক মোনালিসা পড়ে রইল শিল্পীর ষ্টুডিওতে । শিল্পী লিওনার্দো বড়ই আদরে বুকে আগলে রাখতে লাগলেন বুকের পাজরের তুল্য ছবিটিকে কিন্তু তার ভবিষ্যত বড়ই অনিশ্চিত হয়ে রইলো।

দীর্ঘ দশ বছর কারাবাসের পর মোনালিসা বেড়িয়ে এলেন (প্রতিকৃতি) স্টুডিও থেকে। ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস শিল্পকর্মটির সম্বন্ধে উৎসাহিত হলেন। ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দের শেষার্থে ৪০ হাজার ফ্লোরিনের বিনিময়ে মোনালিসাকে কিনে নিয়ে তুললেন প্রাসাদে। মোনালিসা প্রাসাদে স্থান পেল বটে, কিন্তু রাজদরবারে বা রাজার শয়ন কক্ষে অবশ্যই নয় স্থান পেল রাজার স্নানাগারে ।





কবিতা 


ছবি- সংগৃহীত 


 




স্তাবকতা 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

রাজপথ  জুড়ে এম এ ডিগ্রির  মেলা
ধুলোয় লুটোনো এলেকেশ অবহেলা। 
শিক্ষার  নামে  প্রহসন  হেলা  ফেলা, 
মাটি - মানুষের কান্না ঝরানো পালা।

আঠারো বছর কিনে কিনে ভরো ঝুলি
এ কোন রাজ্য ? রাজার শেখানো বুলি
এর চেয়ে  ভালো  বেয়নেট আর গুলি, 
মুখ খোলো যারা হাতে নিয়ে রঙ তুলি।

কবির কলম চলে আজ কোন দিকে ? 
সংবর্ধনা,  আলু, কলা,  পাঁচ   সিকে।
স্বপ্নের ঝুলি চারিদিকে আজ  ফিঁকে
স্তাবকতা আজ স্তাবকতা দিকে দিকে।



খরা

প্রতিভা পাল

 

জ্যৈষ্ঠর খরতাপে খরা আজ লেখনীর শব্দেও,

সম্পৃক্ততা মাত্রা ছাড়ালে যেমন জট বাঁধে, 

দানাদার অবয়বে তেমন 

ভাবনারাও আজ অসদৃশ !   


জ্যৈষ্ঠর দাবদাহে দাহ্য আজ ইচ্ছেদের শরীর ;

বাষ্পায়নের তীব্রতায় অসহায় যেমন নদী,

স্রোতের গভীরে মনেরও তেমন 

থেমে থাকার অভ্যাস, অহর্নিশ !

  

ধুলো-ধূসর অরণ্যর হাহাকার সবুজে আজ !

ছিঁটেফোঁটা বৃষ্টির পশলায় 

দগ্ধতার আঁচড় আরও গাঢ় ক্রমশ ;

মন বর্ষা চায় অঝোর ধারায়

আসন্ন আষাঢ়ে বৃষ্টিস্নাত, 

যেন ভিজে যায় চরাচর, ভাবনার 

আর আমার কবিতার শব্দ যত….. 





চিত্রগুপ্তের প্রতি 

উৎপলেন্দু পাল 

মৃত‍্যুগুলো লেখা হয়ে গেলে 
তোমার জাবদা খাতার সামনে 
এক মুহুর্ত চোখ বুজে বোসো 

মৃতদেহগুলির ময়না তদন্তে 
মুছে দিও সব সেলাইয়ের দাগ 
অযথা রবার ঘোষোনা যেন 

ব‍্যালেন্স শিট মেলাবার পর 
যদি আবারো জের টানতেই হয় 
প্রয়োজনে আমাকেও গুনে নিও 

এখন মৃত‍্যু কেবলই সংখ‍্যামাত্র 
অবশ‍্য তা নিয়েও কাড়াকাড়ি খুব 
ফাঁক গলে বেরোনোর জো নেই 

মৃত‍্যুর সংখ‍্যাতেও অনেক জল 
তদন্ত কমিশনে ওড়ে ভূষন্ডী কাক 
রক্তের দাগ খোঁজে লোলুপ শৃগাল 

যত্ন করে ভাঁজ করে রেখে দিও 
নদীতে ভেসে আসা ওই মৃত‍্যুগুলোও 
এমনকি বেওয়ারিশ হলে পরেও 

সব মৃত‍্যুই লিখে রেখো সঠিক 
আজকাল মৃত‍্যুতেও অনেক রঙ 
বর্ণান্ধতা বিপদ ডেকে আনতে পারে 

দরকারে চশমাটা বদলে নিও 
আজকাল দৃশ‍্যদূষণও বেড়েছে খুব 
তার সাথে পাল্লা দিয়ে কারচুপিও 

আজকাল মৃত‍্যু বড়োই দামী 
তাই হিসেব ঠিকঠাক কষে রেখো 
তোমার অন্তহীন জাবদা খাতায় 

সব মৃত‍্যু লেখা হয়ে গেলে পরে 
আরও একবার চোখ বুজে বোসো 
দেখতে পাবে নতুন মৃত‍্যুর মিছিল ।



 কবিতা নয়
দেবদত্তা লাহিড়ী 

এমন মড়ক তো অন্য কোথাও আসতে পারে|
অন্য ভাবে,অন্য স্তরে|
মনে করনা |
 সব কুশ্রীতাকে মুছে দিচ্ছে
তাতে ঈর্ষার মানসপুত্রী রা হারাচ্ছে দম্ভ,ক্ষমতা|
কেড়ে খাওয়া ,বুভুক্ষু নয় লোলুপ,
নীচ কলুষ অস্তিত্ত্ব ধীর পায়ে পিছু হঠতে হঠতে হারিয়ে যাচ্ছে নরকের গভীরে|
বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কেবল পবিত্রতা|
অভিশাপ নয়|
মনে মনে প্রার্থণা করি|
সেই মড়ক আসুক|
মুছে যাক  শয়তানের পুজা|
আর তার একনিষ্ঠ ভক্তেরা|



আমার নদীরা
 বিনয় বর্মন


নদীরা আমার জীবনে ঘুরে ফিরে আসে,
 শৈশবে ড্রইং খাতার নদী চরের কাশবনে চড়ে বেড়াবার রায়ডাক ,
 যৌবনে জীবনের বিচিত্র রূপ দেখাবার ভাত জোগাবার  গদাধর ,
 অ্যাডভেঞ্চার আর প্রকৃতি পাঠের রায়মাটাং, 
বিষাদগাথার নীরব শ্রোতা জয়ন্তী l
 সবার কাছেই ঋণী আমি l
 সবাই আমার কাছে দামি l
কারও ডাকই উপেক্ষা করতে পারিনা আমি l
শুধু ছুটে চলি এর কাছ থেকে ওর কাছে l আজীবন - 
নিরন্তর l
আর এখন আরও একজন আছে -
  কালজানি , যার পারে তোমার ঘর !





যুদ্ধ
 আশীষ  কুমার  বিশ্বাস


যুদ্ধ !
একদিন না একদিন শেষ হয় -
কিংবা , একদিন না একদিন শেষ হবে ।

কিন্তু লোভ , ক্ষমতার দখল , মসনদ -
তুষের আগুনে মন !

অফুরন্ত ধন সম্পদ , বিলাসবহুল জীবন ,
নিরাপত্তার ঘেরাটোপ -
কয়েক প্রজন্মের জন্য সুখের জীবন ।

তাতে হোক না , হাজার হাজার মৃত্যু -
প্রতিপদে লঙ্ঘন জেনেভা চুক্তি  । 
রাসায়নিক অস্ত্র , ক্ষত-বিক্ষত জীবন ,
তবুও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে ।

যেন তেন  উপায় রাজ্য দখল , রাষ্ট্র দখল ।

ধ্বংসে ধ্বংসে  বিভীষিকা রূপ -
আঁতকে উঠছে আমজনতা !
তবুও যুদ্ধ , উল্লসিত মন !

কিসের হাতছানি ?



বর্ষা যাপন
রীতা ভদ্র দত্ত 

আজ সারাদিন বর্ষা যাপন ওই আকাশের কোণে, 
গুরু গুরু মেঘ,মেঘের মাদল একলা মনের কোনে। 
জল ছপ- ছপ কিশোরী মেয়ে, হঠাৎ ছুটি পেয়ে,
মেঠো পথ ধরে ঠিকানায় ফেরে খুশির উজান বেয়ে।
উঠোন গাঙে  নৈকো ভাসায় পসরা বোঝাই করে, 
রাশি রাশি হাসি, মজা আর খুশি আনন্দ গান দিয়ে। 
তখন কেবলই  ঝম  ঝম  ঝম  বৃষ্টি  সুরের তান
ঝরো ঝরো সুরে  মুখর  শুধু  বাদর দিনের গান।
কবির  কেবলই আখর যাপন মেঘ মল্লার রাগে
রঙ  তুলিতে  ছবি  আঁকে  আজ কিশোর স্বপ্ন জাগে
টাপুর - টুপুর  বৃষ্টি নুপুর  হৃদয়  ওঠে   নেয়ে
ঝাপসা চোখে ভিজছে কেবল কিশোরী সেই মেয়ে।




নিজেকে  খুঁজি
রেজাউল করিম রোমেল

আমি আমার মধ্যে আমার আমিত্বকে খুঁজি।
প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নিজেকে খুঁজি, খুঁজতে হয়।

শত প্রলোভনের মাঝখানে থেকেও
আমি আমাকে খুঁজি।

স্বর্গের সমস্ত সুখ হাতের মুঠোয় নিয়ে
আমি আমাকে খুঁজি,
আবার দোজখের আগুনে পুড়ে খাক
হতে হতে নিজেকে খুঁজি।

খুঁজি... । আমার অস্তিত্ব , আমার আমিত্ব।
কে আমি? কোথায় আমি? কার আমি? কিসের আমি?

পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতায় দাঁড়িয়ে
খুঁজে ফিরি নিজেকে,
পাতালের অতল গহবরে গিয়েও 
নিজেকে খুঁজি।

খুঁজি... । খুঁজতে হয়।
আমার আমি-কে... আমার আমিত্ব-কে...



পেয়ারা গাছের নীচে
রূপক রায়

পেয়ারা গাছের নীচে
বেদীতে বসে ছিলাম রাতে
একা নির্জনে, আকাশে জ্যোৎস্না ভরা
একটা উল্কা খসে পড়ছে অন্ধকারে
হয়তো এভাবে নির্জনে রাতের অন্ধকারে
        কত উল্কাদের খসে পড়তে হয় !
মৃদু শব্দে কত আনন্দে নদীর বয়ে চলা
কত সহজ এই জীবন অথচ
       ভাবলেই কত কঠিন হয়ে ওঠে
বর্ষার চঞ্চলা নদী কত ভয়ংকর
নিমেষে তলিয়ে নিয়ে যায় সব ইতিহাস
কত পথ চলা এখনো বাকি থেকে গেছে
কত পাড় ভাঙা বাকি সমুদ্রে মেশার আনন্দে
কত সুর জেগে ওঠে কত কোলাহল
সবাই চলছে নিজের গতিতে                  
                    নিজ নিজ কক্ষপথে
আমার গতি থমকে গেছে
পেয়ারা গাছের নীচে।


বর্ষা প্রেমের বিরহ

শ্রেয়সী সরকার 

এক সন্ধ্যা দুঃসহ হয়ে ওঠে 
আকাশে ঘন কালো মেঘ।
চন্দ্রপ্রভার কুড়ি এসছে ,
বজ্রের জয়ঢঙ্ক , ঈশান কোণের হাওয়া
কুঞ্জখাঁচার পাখিটা কেঁপে উঠে,
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে ।
ব্যাঙেরা প্রেমের সুর খোঁজে,
আমি ঘরে বসে গল্প লিখি তোমার 
পাল ভাঙা কাগজের নৌকা বয়ে যায় চিঠি নিয়ে।
জোরালো লোডশেডিং , কেরোসিনের কুপি ঢিপ ঢিপ করে ,
আঁধার ঘনিয়ে আসে , তোমার প্রেমের টানে 
ঝোড়ো কাকের মত হয়ে আছি ।
বৃষ্টির দমকা হাওয়া , গল্পের চিঠি গুলো উড়ে যায় 
বিরহের কান্না তোমার , আকাশ ভেঙ্গে পড়ে 
প্রেম অসম্পূর্ণ , কাব্য আমার ছন্দ খুজেঁ পায় না ।।



অলস দুপুর
দেবযানী সেনগুপ্ত

একটা দুপুর 
উদাস নিঝুম
 অবুঝ মন
 উথাল পাথাল
 ক্লান্ত ঘুঘুর
 একটানা ডাক
 সবুজ ঝালোর
 পাতার গান
বুকের ভিতর 
গুমরে মরে
 নাম না জানা
 অচিন সুখ
মনের পাতায়
 দুলতে থাকে 
না  ছোঁয়া কোন
 দুখের শ্লোক।
 একটু হাওয়া 
একটু কাঁপন
 মনের ঘরে
 বৃষ্টি পড়ে !
বৃষ্টি তো নয় 
জল নুপুর 
বেজেই চলে
বেজেই চলে-
কোন সে দূর 
 অলস দুপুর।।



নিমন্ত্রণ
মুনমুন সরকার 

জৈষ্ঠ্যে প্রস্তুত আমি 
হই আদুরে আর দামী 
এক আকাশ ভালোবেসে 
কোমল স্পর্শে চিঠি আসে 
দীর্ঘ প্রতীক্ষায় আবদার
ষষ্ঠীতে স্বর্গ পাড়ি দেবার....।


ঠাঁই দাঁড়িয়ে সামনে 
ধৈর্য্য ধরে ছলছল নয়নে
কথা দিয়ে আসি প্রতিবার
খুব শীঘ্রই ফিরব আবার 
আমিও অজুহাত শিখেছি 
মিথ্যে সান্ত্বনা বুঝিয়েছি....।


যাওয়া হয় না আর 
সময় পাইনি যাওয়ার 
কত রাত জাগিয়েছি আমি 
তাঁর কাছে তবুও দামী
কিছুই দেয়নি বিনিময়ে 
জিতিয়েছে সব লড়াইয়ে....।


এবার চড়ুই হবো
তোমার চালে বাসা বাঁধব
গল্প করবো দুজনে কত
রাত-দিন, দিন-রাত
হাওয়ার পথে ডানা মেলে
বহুদূরে যাব চলে....।


"মা"- গো তোমায় নিয়ে 
সমুদ্রের ঢেউ খেয়ে 
পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে 
নদী,মরুভূমি দেখিয়ে 
সবুজ গাছের দেশে 
ফিরব বেলা শেষে....।





স্বাদ যখন ভেতরে
মজনু মিয়া 

জৈষ্ঠ্যমাস মধুমাস রসে ভরা কারণ 
আম কাঁঠাল লিচু জাম রসনার মূলে
ফলগুলো স্বাদে ভরা বাংলায় ধারণ 
স্থল ও জলে অর্থের হয় জোগান কূলে। 

হাসি খুশি চলঘর আনন্দের সাথে বাস
পরিজন সুখী হয় স্বাদ ভেতরে পরিপূর্ণ 
চারিদিকে মউ মউ ঘ্রাণ ফলের এই মাস
জৈষ্ঠ্য যেন মিষ্ট অধিক জীবন নয় চূর্ণ। 

সেজে আছে গাছে গাছে ফলের বাহার
মজার স্বাদ লয় পেটপুরে করে আহার।



মুজনাই অনলাইন জৈষ্ঠ্য সংখ্যা ১৪৩০


No comments:

Post a Comment