Thursday, August 3, 2017




এই সংখ্যায় লিখেছেন যাঁরা

তৈমুর খান, শ্যামলী সেনগুপ্ত, গৌতম বিশ্বাস.  সুবীর সরকার, নীপবীথি ভৌমিক, মীরা সরকার, রাহুল গাঙ্গুলী, চৈতালি ধরিত্রীকন্যা, মৃণালিনী ঘোষ, মন্দিরা ঘোষ, কাকলি ভদ্র, মুক্তা নার্জিনারী, রীনা মজুমদার, কৃষ্ণা সাহা, সম্পা দত্ত, স্মৃতি রায়, জিতেন্দ্র, সুপ্রীতি বর্মন, মোনালিসা রেহমান,  কুমকুম ঘোষ, সোমনাথ গুহ, শিপ্রা পাল, সুদীপ ব্যানার্জী, সঞ্চিতা দাস, শিবু, রূপালী গোস্বামী, নবনীতা স্যান্যাল, রাখী বসাক, নিশীথবরণ চৌধুরী, অজিতকুমার দত্ত, দেবপ্রিয়া সরকার, কৌশিক কুমার রায়, বর্ণালী সেন, মৌসুমী চৌধুরী, দেবব্রত তাঁতী, জয়ন্ত চ্যাটার্জী, দেবশ্রী চক্রবর্তী, প্রদীপ কুমার পাইক, গৌতমী ভট্টাচার্য্য, বিনীতা সরকার, তৃপ্তি মিত্র, মাম্পি রায়, উপাসনা চক্রবর্তী 

ছবি পাঠিয়েছেন -  দেবব্রত কুন্ডু, উদয় সাহা

সম্পাদনা, অলঙ্করণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়




সম্পাদকের কথা

হাওয়ায় সঙ্কেত ছিল।
সঙ্কেত ছিল শ্রাবণের।
স্পষ্ট বুঝি নি, তাই শ্রাবণ আসে নি।
সিক্ত হই নি তাই।
অবগাহন করি নি তাই।
অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না।
কথা ছিল শ্রাবণের সাথে আমরাও ভেসে যাবো সৃষ্টির বারিধারায়।
কথা ছিল স্বচ্ছ, পবিত্র বারিধারায় অবগাহনে নামবো।
হবো পবিত্র।
শ্রাবণ আসেনি।
বন্যা হয়েছে।  বানভাসিদের কষ্ট বেড়েই চলেচে
শ্রাবণ আসেনি।
আগুন জ্বলেছে। হিংসায় পুড়ছে কৃষ্টি-সংস্কৃতি।
শ্রাবণ আসেনি।
অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। বধ্যভূমিতে মরছে মনন।

....তবু শ্রাবণ আসে। 
শ্রাবণকে আসতে হয়।
অন্তরাত্মার কাছে দাঁড়ায় শ্রাবণ।
আয়নার সামনে দাঁড় করায় শ্রাবণ।
চিনিয়ে দেয় শ্রাবণ অন্তরের কলুষকে।
শেখায় ঝরে পড়তে।
ঝরে পড়তে প্রেমে, শ্রদ্ধায়, সাহচর্যে....






কবিতা


তৈমুর খানের দুটি কবিতা    

                 ১
     বৃষ্টির নূপুরপরা রাস্তা
    __________________
রাস্তায় ঢেউ তুলে তুলে
ভিজিয়ে দিচ্ছ আমাকে
ছোট ছোট শব্দের মাছ
আর কাগজের নৌকা
ভেসে যাচ্ছে
বুকের ভেতর যেটুকু আকাশ
তুমি মেঘ পাঠিয়ে দিচ্ছ সেখানে
আমি ভিজতে ভিজতে
কাক হয়ে যাচ্ছি
কাচের জানালা থেকে
কেউ দেখতে পাচ্ছে না বৃষ্টি
কেউ পড়তে পারছে না
তোমার ঢেউয়ের ভাষা
শুধু এক অদৃশ্য স্বরলিপি
ধ্বনিত হচ্ছে
বৃষ্টির নূপুরপরা রাস্তায়...


             
বেশ বেশ বর্ষা
_____________
ব্যাঙেদের জাগরণ টের পাচ্ছি
সম্মোহন ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত
ছায়াদের অবকাশে ভাবনাদের ভাসমান প্রাচুর্য
নিরন্তর মেঘেদের প্রসব শুরু হল
দু একটুকরো কান্নার পর জ্বেলে দেয় আলো
যেন কাঠ, কাঠের ধোঁয়ায় পৃথিবী আঁতুড় ঘর

এসো, সোহাগ বিলিয়ে দিই
জানালায় চা খেতে খেতে শুনি
ডমরু বাজিয়ে শিব এল
ঘরের রমণীটিও আজ স্রোতকল্প মন্দাকিনী
আঁচলে তার ঢেউ ওঠে কত !
আমরা তবু কেউ নৌকা ভাসাইনি
নৌকায় ফিসফাস ঘুমিয়ে পড়েছে
রাস্তায় দু চারটে ছাতা, ছোট ছোট গাড়ি

গর্ভবতী বলে বেশ সাবধানে পা ফেলছে দ্যাখো...





দুপুর
সুবীর সরকার

1.
পুতুলটি ছোটবোনকে দেব
কোন আর্তনাদই বিফলে যায় না
অদূরে বেড়ালের মত শুয়ে থাকছে দুপুর
2.
সেইসব ইশারা,গঞ্জনা লাঞ্ছনার দিন
প্রাতঃভ্রমণ অভ্যাস করুন
রাতারাতি ঝুঁকে পড়ছে আমাদের পিঠ




অন্য শ্রাবণ

মৃণালিনী ঘোষ



                 ১

সোনালী সূর্যের মাঠে মেঘের লুকোচুরি খেলায়
                 ঝলসে ওঠে পৌঢ় মাটির বুক
চাতকের অবিশ্বাসী চোখ প্রতীক্ষাহীন- 
ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ঝিমন্ত ডালে
                 খুঁজে  বেড়ায় অতীত গৌরব।
ঘোলা চোখের সান্ত্বনায় 
নড়ে ওঠে ক্লান্ত কয়েকটি পাতা
গরম হাওয়া ছুঁয়ে যায় বিষণ্ন দুপুরের শরীর।

                ২
অভিমানী আকাশের এককোনে জমে ওঠে মেঘ
ছোট ছোট দলে গড়াগড়ি যেন গড়াগড়ি খেলা-
সাদা জামায় অভিমান কালো দাগে 
                            ছাপিয়ে যাচ্ছে কোপ।

কৈকয়ীর চিরকালের আশ্রয় কালো শাড়ির আঁচল
                   ছড়িয়ে পড়ছে আকাশের বুকে। 
রামায়ণের শেষ অধ্যায়ের
                    অনেক আগে বন পর্বের শুরুতে।

           ৩

রোদপোড়া মাঠ চেরা বুকে কাঁদছে
সবুজ ডাল পুষ্টিহীন খয়েরী রঙের শিশু
দুধের সবুজ দাঁত এলিয়ে মাটিতে 
মেহেন্দী পাতায় পাতায়
             বৃষ্টিকে খোঁজে খোলা পিঠে।

ডুবন্ত সূর্যের হাত ধরে 
খোলা মাঠে আমি চাতকের প্রতিবেশী।

       ৪
নীল চাদরে আকাশ
তুলো উড়ছে বালিস ছেড়ে 
        থোকাথোকা সাদা ফুল
দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় ভারি হলে
     কালো মুখে এলিয়ে শরীর 
নেমে পড়ে ঝমঝম
                 ঝমঝম
                         ঝমঝম

জলরঙা কাঁচের দেওয়াল
          স্বচ্ছ আয়নায় পারাপার।

      ৫
প্রথম কয়েকটি ফোঁটায় জ্বলে যায় মাটির বুক
পিপাসার্ত অভিমানী চোখে 
চিরগুলো চাবুকে লাল—

জ্বালাময়ী দেখান বুক চিরে 
বিন্দু
       বিন্দু
                ঝরে ঝরে পড়ে।

উন্মাদিনী পিপাসায় উন্মুক্ত শরীর 
হারিয়ে যাওয়া ধূলো সন্তানেরা স্তব্ধ- 
রাস্তা বদলে মায়ের আঁচল  ফিরে আসে।
ঋতুর প্রথম শ্রাবন
            চাতকের অভিষেকে বরণ 
ঝমঝম শরীরে নেমে আসে শ্রীময়ী বর্ষা।

                  ৬
বৃষ্টি-গাছেদের সাওয়ারের স্নান
নরম ঘাসের সুইমিং পুল
মাটির লুটোপুটি 
        কাঁদা মাখা রাস্তায় রাস্তায় ।

          ৭

বৃষ্টি  রিমঝিম রিমঝিম সুর
যেন কিশোরীর পায়ের নূপুর 
সবুজ শাড়ির আঁচল দুলিয়ে গাছ
           আকাশকে ডাকে ঈশারায়,
মাটি আকাশ মিলেমিশে একাকার
বর্ষা সুতোয় গাঁথা মালায়
রচিত আর এক ইতিহাসের অধ্যায়।




বন্ধন গান

নীপবীথি ভৌমিক


 দ্যাখো বর্ষাজল কত মন্ত্র সাজিয়েছে আজ  যজ্ঞ-হোমানলে !
  বৈবাহিক মধুমন্তীর সুরে আকাশ আজ  সানাই
    রাত স্নাত রজনী,
তবে কেন শোনো আজ  এত বিচ্ছেদের গান
   ভাঙন-শ্লোক-কাহিনী ?
বরং এসো, শ্রাবণ ধারায়,আকাশ পথের তলে
   বৃষ্টিফুল সাজিয়েছে আমাদের পুনঃ বন্ধন শয্যা ;
    মন্ত্র রাখো হৃদি স্পর্শে, বলো
“যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম

   যদিদং হৃদয়ং মম,তদস্তু হৃদয়ং তব ।।“





শ্রাবণে,অভিমানে 
            মীরাসরকার 

কেন এত ক্লান্তি দাও মনে
       ক্লান্তির পাহাড়-?
দুহাতে আন্ধার সরাই,দেখি
       আবার অন্ধকার ।

শ্রাবণই  আনে ফের লুকিয়ে 
        জল ঝাপসা স্মৃতির নাও;
কবে গেছে হারিয়ে সে খাতা
         কত বলি ফিরিয়ে দাও ।

আমার যে আমি হয়ে ওঠা
        কতটুকু শ্রাবণে কে জানে 
অপরূপ জলেভেজা চোখে
     ভীরু ম্লান একা অভিমানে । 

একা! বর্ষা যেন আরো একাকী  করে
      রাখে চিরকাল কতকাল।  
তবু অঝোর ঝরন যদি ঝরে
      ভাবি এইতো সেদিন সকাল।





স্বার্থহীন নিখোঁজ মুখোশ ও ব্যারিকেড
 রাহুল গাঙ্গুলী

@
নিরুদ্দেশ গ্যালোপিং ঠেলে বেড়ে উঠি
ছুকছুক আষাঢ়।ছোয়া শেষে যতিচিহ্নের আস্তানা
আস্তাবল থেকে ঘনত্ব বাড়ানো ঘোড়া
মৌন গিলোটিনে শহিদ হলে : নাছোড়বান্দা স্বভাব
মোমছায়া গলে।ছাইপাঁশ ব্যাকরণের রাত
ল্যাম্পপোস্ট যোগ হলে বেতারজনিত বিপবিপ
নষ্ট হলো স্রেফ কয়েকটুপ তরল ইথার
বরফিলা বোঁটায় : কখনো টিপ বা সিদুর
মেরুন সূর্য জন্মদাগের আদিঅন্ত লিখে ফেলে

@@
সন্দেহ হলে : ঘনত্ব বদলে নেওয়াই যায়
যেমনতেমন রোদ মোছানো গোলাপি শার্ট
বোতামঘরে নিঃশব্দ হারাকিরি ঘটে
বিন্যস্ত ভেজা শীতে তুমুল উল্লাস
এসো।তবেই আরেকবার স্তরবিন্যাস করি
ছেড়া বোতাম (শার্ট) উল্লসিত রোদের চুমুক
এই মুহূর্তে এভাবেই বাজি রেখেছি সাপলুডো







 
বারিস
চৈতালি ধরিত্রীকন্যা

রাত্রির গহীনতায় নিঃশব্দে তোমার কাছে নতজানু আজ
হে হুদুম দ্যাও-
উলঙ্গ এই শরীর সভ্যতা জুড়ে পুরাতনী ব্রত-গান
তুমি লেহন করো।
রজঃস্বলা নারী; উর্বর এই জঠরে বপন করো
বারিস- প্রেম-কথা।
এসো সম্মোহিত হই পরস্পরের নিজস্ব কলায়
কামনার ঝঙ্কারে।
শৃঙ্গারে শৃঙ্গারে সুসজ্জিত সঙ্গীত বেজেছে দেখো
আমি অঙ্গীকারবদ্ধ।
এই পেলবতা-কোমলতার স্পর্শ তোমায় দিলাম
তুমি স্পর্শ করো।
গোপন এই রাতে শ্রেষ্ঠ শিল্প-সৌন্দর্য
তোমায় দিলাম
হে হুদুম দ্যাও! তোমার মেঘাপ্লুত বীর্যরস
বাদল হয়ে ঝরো.....




আজ শ্রাবণ
মন্দিরা ঘোষ

আজ শ্রাবণ ডাকছে শোন
মেঘলা দিন অবুঝ মন
একটা দিন খুব দুজন
ভীড়ের বাস এড়িয়ে চল

নিঝুম পথ গড়ের মাঠ
দে দোল দোল আসবি বল
ভীষণ টান চুপকথার-
আজকে বেশ তুফান তোল

গল্প বল অনর্গল
রাজনীতির সন্ত্রাসের-
উড়ছে চুল দিচ্ছি ডুব
বাড়ছে চাপ মসনদের

তোর আঙ্গুল ছুঁয়ে থাকি
সে আমার সাধ্যি কৈ
ভুল কথায় কাজ সারি
কবিতায় ফুটল খৈ-

কালো চোখের মেঘ হয়ে
ডাকনা তুই চুপিসারে
দিগ্বিদিক ঝড় তুলে

আমি হব ভবঘুরে


স্মরণ



বাইশে শ্রাবণ:একটি অ্যাকিউট সাইকোসিস
 শ্যামলী সেনগুপ্ত
    

 আমাদের একটা করে ভূবনডাঙার মাঠ আছে।
ঐ মাঠের একপ্রান্তে রবীন্দ্রনাথ
আরেকপ্রান্তে গলায় মালা,বুড়োটে রবিঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দী রবীন্দ্রনাথের জন্য
অর্ঘ্য রাখলাম তাঁর গানগল্পকাব্যউপন্যাসপ্রবন্ধের ডালি
বলি ঠাকুর,তোমার তো হেব্বি দুঃখ ছিলো।
অ্যাকিউট সাইকোসিসের শিকার ছিলে  কি কোনওদিন!

যারা তোমার সামনে না থেকেও দেখা দিতো রোজ---কখনো ছাতের আলসের ধারে,কখনো ঘন বাদল মেঘের আড় থেকে
যাদের কণ্ঠস্বর ইথারে ভেসেআসতো
শুনেছো কি কখনও----কারা যেন বলছে
'ওকে মেরেফেল।কিল হিম;
কারা যেন  ওর মগজ দিয়ে ঢুকে
চোখ দিয়ে বেরিয়েযায়
অন্ধ কুকুরটি মাঠের একধারে বটমূলে  বসেথাকে
ঐ বটের মগজে বোনা হতে  থাকে
সাইকোসিসের   পর্যায়গুলি:এক  দুই  তিন ----------
চার বলার  আগেই বাইশে শ্রাবণের
অবগুণ্ঠন থেকে ঝরেপড়ে  মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি-------

রবীন্দ্রনাথ আর ঠাকুরবাড়ির ছেলেটি
তখন বৃষ্টি বিনিময় করে

হয়তো বা দিক দর্শক!



                               


"তুঁহু মম শ্যাম সমান"
       কাকলি ভদ্র

            শ্রবণা নক্ষত্রের মানসপুত্র শ্রাবণ .... শ্রাবণ মানে                      গুরুগম্ভীর কালো মেঘের ভারে নিরন্তর অবনত আকাশ....    শ্রাবণ মানে  সগর্জন, মেঘবর্ষণের তুমুল দাপট...শ্রাবণ মানে মন থই থই বিষাদিয়া.....আমার কাছে শ্রাবণ মানে বাইশে শ্রাবণ..এক ইন্দ্রপতনের স্মৃতি বিজড়িত মহাকাব্য!বাঙালি জাতি, বাংলা সাহিত্য ও সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের জন্যই  বিয়োগ-বেদনার তীব্র দহন আর সন্তাপে ভরা একটি দিন। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই দিনটিতেই প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন পরলোকে। কিন্তু চলে গিয়েও তিনি বেঁচে রইলেন শাশ্বত মহাসত্যের মতো চিরন্তন হয়ে। তিনিই তো আমাদের শিখিয়েছেন ' মৃত্যু’ জীবনেরই আরেক নাম। তাঁর ভাবনায় জন্মজন্মান্তর অনন্ত জীবনের যাত্রাপথে পরমাত্মীয়ের মতো নতুন নতুন জীবনপথের অনুসন্ধানদাতা সে। আবার কখনো সে মহাকালের মহামিলনদূত।

তাঁর পঁয়ষট্টি বছরের সাহিত্যজীবনে মৃত্যু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই 'ভানুসিংহের ঠাকুরের পদাবলী' থেকে শুরু করে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে লেখা ‘শেষলেখা’র কবিতগুলো পর্যন্ত। তাই জীবনের গোধূলিলগ্নে নির্জ্ঞান স্তরে স্থিতি করেও কবি প্রথমদিনের সূর্য এবং অস্তরাগের সূর্যদেবতার কাছে জিজ্ঞেস করেছেন তাঁর সত্তা, স্বরূপ, স্বঋদ্ধি।

 "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
  তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবুও অনন্ত জাগে।।
   তবুও প্রাণ নিত্যধারা, হাসে চন্দ্র সূর্য তারা,
   বসন্ত নিকুঞ্জ আসে বিচিত্র রাগে।"
গানের কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপন জীবন দিয়ে অনুধাবন করে লিখেছিলেন। তাঁর মতো চোখের সামনে এতগুলো আপনজনের মৃত্যু বিশ্বের দ্বিতীয় কোনো কবি-সাহিত্যিক অথবা কোনো সাধারণ মানুষও দেখেছেন কিনা সন্দেহ!  
তবে কবির তেরো বছর দশমাস বয়সে প্রয়াতা মাতা সারদা দেবীর মৃত্যু (১৮৭৫) থেকে নয় কবির মৃত্যু-দর্শন গড়ে ওঠে তাঁর প্রায়-তেইশ বছর বয়সে  নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু (১৮৮৪) থেকে..... প্রথম বয়সে তাঁর কাছে মৃত্যু ছিল কালো শ্যামের প্রতীক। তিনি লিখেছিলেন,
  " মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান।
   মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
    রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট,
    তাপবিমোচন করুণ কোর তবে
    মৃত্যু অমৃত করে দান।"
      
মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ অনেকভাবেই তার লেখায় টেনে এনেছেন। লিখেছেন- ‘মৃত্যু অজ্ঞাত মোর
আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে
এত ভালোবাসি
বলে হয়েছে প্রত্যয় 
মৃত্যুরে আমি ভালোবাসিব নিশ্চয়।’
কবির অকাল স্ত্রী-বিয়োগ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থটি কবি স্ত্রীর মৃত্যুর কিছু পরেই রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনে মৃত্যুকে বড় গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে কবির স্ত্রী বিয়োগ হয়।  তবে ‘স্মরণ’ কবিতাগুলি পড়ে মনে হয়, স্ত্রী চলে যাওয়ার পরই কবি যেন নতুন করে মৃণালিনী দেবীকে আবিষ্কার করেছিলেন। কবি তার মিলন কবিতায় লেখেন- ‘মিলন সম্পূর্ণ আজি
 হল তোমা-সনে 
এ বিচ্ছেদ বেদনার।’
     জন্মদিন উপলক্ষে শান্তিনিকেতন পাঁচটি চারা রোপণ করে প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসবের আয়োজন করেন।বৃক্ষরোপণ নিয়ে লেখা তাঁর একটি কবিতায় দেখতে পাই সেই অনাগত মৃত্যুচেতনার আভাস- "হে তরু, এ ধরাতলে
রহিব না যবে
সে দিন বসন্তে
নব পল্লবে পল্লবে
তোমার মর্মরধ্বনি
পথিকে রে কবে
ভালোবেসে ছিল কবি বেঁচেছিল যবে।"
‘গীতাঞ্জলি’র  এই কটি লাইন  থেকেও আমরা কবির মৃত্যু দর্শন খুঁজে পাই- 
‘দিবস যদি সাঙ্গ হল
 না যদি গাহে পাখি
 ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে
এ বার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি।’
         রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সত্তর দশক পার হয়েও যেন          মৃত্যুহীন অনন্ত জীবনের স্বাক্ষর বয়ে চলেছেন আজও।
সাজিয়ে বসেছেন উদাত্ত চিত্তে। এসব সম্ভব হয়েছে মৃত্যুকে অবজ্ঞা নয় ....গভীরভাবে উপলব্ধির ভেতর দিয়ে। মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে শাণিত করেছে সৃষ্টিপথে, নির্মোহ করেছে জগৎসংসারে, নস্টালজিক করেছে ক্ষণে ক্ষণে। তাই তো তিনি গাইতে পেরেছেন প্রাণখুলে–
"তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা?
ওই-যে সুদূর নীহারিকা
 যারা করে আছে ভিড়
 আকাশের নীড়,
ওই যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী
গ্রহ তারা রবি,
তুমি কি তাদের মতো সত্য নও?"
     রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনের প্রেক্ষণবিন্দুতে আছে একটি চেতনা, তা হলো- মৃত্যু তার শোক ও দুঃখের মাধ্যমে জীবনের "সত্য, মুক্তি ও শক্তি"এই তিনটি রূপকেই ফুটিয়ে তোলে। সুতরাং সুখের মতো দুঃখকেও স্বাগত জানাও!!!স্বাগত জানাও জীবনের মতো মৃত্যুকেও!!!আর নিজেকে বলো -
"আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো
এই শেষ কথা বলে 
যাব আমি চলে ।"
           শ্রাবণের অনন্ত বিষণ্ণতা তাই কখনো সঙ্গীত, কখনো প্রেম, কখনো বৃষ্টির এক টানা সাহানা সুর..... আবার কখনো সব কিছু মিলিয়ে গেলে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ....প্রেরণা-সুখে-দুঃখে- অভিমানে- ভালোবাসায় যিনি রিনিঝিনি বৃষ্টির মতোই  ছুঁয়ে যান. .. ছুঁয়ে যান...ছুঁয়ে যান...





আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথ  মুক্তা নার্জিনারী
       “ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ” ... আপামর বাঙালির অহংকার । এই নামটাই যেন অনেককিছু বাঙালির জীবনে । তাঁর উপস্থিতি ,বাস্তবিক আমাদের অনেকের জীবনে ধ্রুবতারার মত  কিংবা তার চেয়েও অনেক গুনে বেশি ।           কখন কিভাবে আমি রবীন্দ্রনাথের লেখার প্রেমে পড়েছি টের পাই নি । শুধু জানি আমার হাসিতে আমার কান্নায় আমার গাম্ভীর্যে আমার ভাবনায় আমার স্বপ্নে – সমস্ত হৃদয়জুড়ে কবির ভাবনা । অদ্ভুত লাগে আমার - প্রায় দেড়শো বছর আগে উনি কি করে টের পেয়েছিলেন আমাদের মনের ব্যথা বিস্ময় অপার বিস্ময়ে শুধু ভেবে যাই । কোন কূল কিনারা পাই না ।
       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আমার প্রথম পরিচয় আর অনেকেরই মত সহজপাঠের মাধ্যমে । অবাক হয়ে ভাবতাম একজন মানুষ কি করে একটা গোটা বই লিখেছেন তখন রবি ঠাকুরকে আমার অবশ্য আমাদের মতই ছোট মনে হত ।তাই বিস্ময়আরো বেড়েই যেত । সহজ পাঠ পড়তে পড়তে কত অজানা জিনিস জেনেছি সেই ছোটবেলায় । বেশ মজা লাগত যখন সুর করে পড়তাম –  
“ 
বনে থাকে বাঘ গাছে থাকে পাখি ” কত সহজ সরল সুন্দর লেখা । ভীষণ মজা লাগতো আমার পড়তে। মেয়েকে পড়ানোর সময় নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যেত । সে এক অনন্য স্মৃতি , যা হৃদয়ের মণিকোঠায় রয়ে যাবে চিরদিন ।

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে 
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে ।
পার হয়ে যায় গোরু পার হয় গাড়ি দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি ।” কিংবা 
“ 
নাম তার মোতি বিল বহুদুর জল
 হাঁসগুলি ভেসে ভেসে করে কোলাহল ” ...
  পড়তে পড়তে কোথায় যেন হারিয়ে যেত মন ।সুন্দর সব মুহূর্তের ছবি শব্দ দিয়ে আঁকা যেন । একবার পড়লে বারবার পড়তে ইচ্ছে করত । আর এভাবেই বারবার সাঁতরে বেড়াতাম কল্পনার নদীতে ।
           আরেকটু বড় হয়ে মানে হাই স্কুলে পড়ার সময় আবিষ্কার করলাম যে রবিঠাকুর শুধু সহজপাঠের দুটো খন্ড লিখেই থেমে থাকেন নি উনি আরো অনেক অনেক কবিতা উপন্যাস নাটক গল্প গান লিখেছেন । তখন অবাক হওয়ার পালা ছিল অন্য রকম ! তখন ভাবতাম ,কি করে ঐ একা মানুষ সবার সুখ-দুঃখ হাসিকান্না মিলন - বিচ্ছেদের মুহূর্ত এত গভীরভাবে এত তীব্রভাবে উপলব্ধি করেছিলেন উনি কি অন্তর্যামী  জানি না উনি অন্তর্যামী ছিলেন কি না তবে এটা বুঝি এবং বিশ্বাস করি যে রবীন্দ্রনাথ মানে জীবন দর্শন ।
    আমি কোনকালেই গান আবৃত্তি কিংবা নাচে পারদর্শী ছিলাম না । কিন্তু তাই বলে রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসার মধ্যে এতটুকু কোন খামতি কোনোদিন ছিল না এখনোও নেই । তবে ছোটবেলায় জ্যেঠতুতো দিদি অবিতাদির পাল্লায় এবং ওরই অত্যুৎসাহে দুএকবার নাচ কিংবা নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলাম হাই স্কুলে পড়ার সময় । একবার দিদির হুজুগ উঠলো যে পাড়ার ক্লাবে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করা হবে । তখন আমি ক্লাস ফাইভে । ভীষণ উদ্দীপনা আমাদের কিশোর বাহিনীর মধ্যে ।নাচ গান ,আবৃত্তি নাটক – ইত্যাদির রিহার্সালে মেতে রইলাম কয়েকদিন স্কুল থেকে ফেরার পর । সেবার আমাদের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল পেটে ও পিঠে” নাটকের মঞ্চস্থ ।মুখ্য ভূমিকায় স্বয়ং দিদি ( তিনকড়ি )ও আমি ( বনমালী )। দারুণ উত্তেজনার মধ্যে শুরু হল অনুষ্ঠান দিদির নেতৃত্বে উদ্বোধনী সঙ্গীতের মাধ্যমে । তারপর একে একে নাচ,  আবৃত্তি আর সবশেষে মুখ্য আকর্ষণ আমাদের নাটক । বেশ ভালোভাবেই সব মিটলোবেশ মজা করেছি সবাই মিলে । তবে আমাদের নাটকের কথা ভুলবো না কোনোদিন । পরেরদিন অনেকে যারা অনুষ্ঠানে আসেন নি, তাদের সবার একই জিজ্ঞাস্য ছিল – “ কাল রাতে কে এত জোরে কাঁদছিল বল তো ?” আসলে, বনমালীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে তিনকড়ির হাতে পিঠে থাপ্পড় খেয়ে এমন জোরে কেঁদেছি যে গোটা পাড়া আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল কে এত কাঁদছে ! “ পিঠে খেলে পেটে সয় ” ... এই পিঠে খাওয়ার যে কি ব্যাপক মজা তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম সেই অনুষ্ঠানের রাতে । 
    আরেকটা স্মরণীয় ঘটনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার জীবনে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায় এখনো । তখন ক্লাস টেনে পড়ি । সেদিন ছিল বাইশে শ্রাবণ । আমাদের ক্লাস টিচার ইংরেজির কিব্রিয়া স্যার ক্লাসে এসে বললেন – “ আজ বাইশে শ্রাবণ চল কিছু করা যাক ।” মুহূর্তের মধ্যে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। ঠিক হল – আমরা ক্লাস টেনের বিদায়ী ছাত্রছাত্রীরা মিলে প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রী হয়ে “ সহজপাঠ ” করবো ।পাশের প্রাইমারী স্কুল থেকে যোগাড় হল বই । ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে রিহার্সাল পর্ব সেরে কোন এক্সট্রা মেক-আপ ছাড়াই স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে আমাদের বিশেষ অনুষ্ঠান সহজ পাঠ” গোটা অনুষ্ঠান পর্বে সবচেয়ে মনোজ্ঞ এবং অভিনব হয়েছিল ।হল ভর্তি ছাত্র ছাত্রী এবং শিক্ষক – শিক্ষিকা এবং উপস্থিত সবার হর্ষ ধ্বনি এবং করতালিতে সেদিন তীব্রভাবে অনুভব করেছিলাম যে কবি শুধু সামান্য কবি নন উনি আমাদের জীবনের ধ্রুবতারা যার তুলনা শুধু উনি নিজে ।   
   রবি ঠাকুরকে নিয়ে লিখলে কবির গান নিয়ে লিখবো না , তা কি হয় ? আর রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে ভাবতে বসলেই একটা নাম অবশ্যম্ভাবীভাবে আমার মনে চলে আসে সেই এক চেহারা ... ছোট সাদা চুলে ব্যক্ত্বিত্বময়ী নির্মল একটা মুখ – সুচিত্রা মিত্র । কলেজে পড়ার সময় সৌভাগ্য হয়েছিল এই অসাধারণ এবং অতুলনীয়া শিল্পীর গান শোনার ।  একেরপর এক গান গেয়ে চলেছেন উনি । সত্তর পেরিয়েও কি অদ্ভুত জাদু তাঁর গলায় ।আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি । যখন উনি ধরলেন ,
“ কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলিকালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণচোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটেমুক্তবেণী পিঠেরপরে লোটে।
কালোতা সে যতই কালো হোকদেখেছি তার কালো হরিণ
চোখ।” ...
 গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো যেন ।এখনো চোখ বন্ধ করলে যেন শুনতে পাই সেই কণ্ঠস্বর । সে এক পরম অভিজ্ঞতা আমার জীবনে ।
    আরেকটা ঘটনা উল্লেখ না করলে কবিকে নিয়ে আমার লেখাটা অসম্পূর্ণ-ই থেকে যাবে । সেটা হল প্রথমবার শেষের কবিতা” পড়ার অভিজ্ঞতা । বইটা আমার কলেজের বন্ধু ঊর্মি আমাকে গিফট করেছিল । যেদিন পড়লাম সেদিন আর কিছু ভালো লাগে নি কিছু খেতেও ইচ্ছে করে নি আমার । প্রেম এমন কষ্ট দেয় মানুষকে বার বার বন্যার শেষ কবিতা পড়ছিলাম আর নিজে থেকেই চোখের কোণ চিক চিক করে উঠছিল । কি অদ্ভুত সেই অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবো না কাউকে ...। 
“হে বন্ধুবিদায়।
তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি।
মর্তের মৃত্তিকা মোরতাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাকতাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা,পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;তৃষার্ত আবেগ-বেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে।
তোমার মানস-ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধনযা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজো তুমি নিজে
হয়তো-বা করিবে রচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন।
ভার তার না রহিবেনা রহিবে দায়।
হে বন্ধুবিদায়।
মোর লাগি করিয়ো না শোক,আমার রয়েছে কর্মআমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাইশূন্যেরে করিব পূর্ণএই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি,এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,হে ঐশ্বর্যবান,তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দানগ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধুবিদায়। ” 
    ...এখনো কেমন যেন ফাঁকা লাগে শেষ লাইন কটা মনে পড়লে । আবার এই লাইনগুলোই যেন সবচেয়ে বড় শক্তি আমার মত আরো কতজনের । তার কি কোন হিসেব আছে  
    যতদিন বাঙালি বেঁচে থাকবে ততদিন আমাদের সবার শয়নে স্বপনে জাগরণে শুধু রবীন্দ্রনাথ । তাঁর গানের কথাতেই বলি ঃ 
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখকোথাও মৃত্যুকোথা বিচ্ছেদ নাই।।
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপদুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ,তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই।।
হে পূর্ণতব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে
নাই নাই ভয়সে শুধু আমারইনিশিদিন কাঁদি তাই।
অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই।।



স্বপ্নে দেখা রাজা ঘুমাচ্ছেন
রীনা মজুমদার

এক মেঘে ঢাকা শ্রাবণের বাইশ। বইছে শ্রাবণের ধারা, বইছে প্রজাদের চোখের ধারা।
দুপুর বারোটা দশ। শেষ নিঃশ্বাস।
রাজবেশ, রাজা ঘুমাচ্ছেন রাজপালঙ্কে। জোড়াসাঁকোর রবি অস্তাচলে গেলেন। অসংখ্য মানুষের স্রোতের ঢল। কেউ উন্মাদ, কেউ আকুল, সবাই তাদের প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো প্রণাম করতে চায়। কেউ বা শেষ স্মরণচিহ্ন নেওয়ার আশায় তাঁর শ্বেতশুভ্র কেশদামে হাত রাখছেন, কেউ বর্বরের মতো ছিঁড়ে নিচ্ছেন!!
শান্ত স্থির বুকে কান্না চেপে এক মুঠো ফুল সাদা চাদরে ঢাকা রাজার পায়ের ওপর রেখে দিলাম। এক অনন্ত শান্তির ছোঁওয়ায় শ্রাবণের ধারার মতো আমার দু'গাল বেয়ে ঝরলো অশ্রু।
বিধুশেখর শাস্ত্রী মন্ত্র পড়ছেন,
"ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি
নমস্তেহস্তু মা মা হিংসীঃ।"
পৃথিবীর আলো, আঁধারে, সবেতেই আছো। আছো অন্তরে, আছো মননে....তোমাতেই শ্রাবণের ধারার মতো তোমার সৃষ্টি ঝরে পড়ছে। হে কবি, এক জীবনের তোমার সৃষ্টির ঢেউ পড়ছে আছড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। শুধু কুড়িয়ে নেওয়ায় পথ চলা...."আছে জন্ম, আছে মৃত্যু।"
শিষ্য নজরুল লিখছেন,
"দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে
অস্ত-পথের কোলে
শ্রাবণের মেঘ ছুটে এল দলে দলে
উদাস গগন তলে।
বিশ্বের রবি, ভারতের কবি
শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি
তুমি চলে যাবে বলে।" 




শ্রাবণের ধারার মতো
কৃষ্ণা  সাহা

দিয়ে গেছো বহু কিছু

গ্রহন করেছি তার কতটুকু,,?

করেছি যা গোন্ডুস ভরিয়া পান

তা তোমার  অপার সাগরের বিন্দু  সমান,,,,

বাইশে শ্রাবণের স্মরণে প্রয়াত বিশ্ব কবিকে মন-মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেই
চলতে থাকে আমার দিন যাপন,,," তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা/এ
সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।" জীবনের প্রতিটি আবেগঘন মুহূর্তের সঙ্গী
তিনি। তাঁর মধুর সত্ত্বাকে অস্বীকার করা মানে নিজেকেই অস্বীকার করা।

তিনি মননে, আত্মার আত্মীয়তায়, একান্ত সুখ-দু্ঃখ যাপনে বটবৃক্ষের ছায়ার মতন।

নূতন করে প্রতিবারে, প্রতিপলে জীবনের নানা আত্মিক সঙ্কটে আমি তাঁর
সাহচর্যের স্পর্শে ধন্য হই। তাঁর মহাপ্রয়াণ যেন শ্রাবণ ধারার মতো অন্তর
কেঁদে চলে,,,,"আমি শ্রাবণ আকাশে ওই দিয়েছি পাতি/মম জল-ছলো-ছলো আঁখি মেঘে
মেঘে।"

সারাবেলা অবিরাম শ্রাবণ ধারায় মন যখন আবিষ্ট হয়ে ওঠে।তখন কখনো তাঁর
কবিতায়, কখনো তাঁর গানে জমা রাখি হৃদয়াবেগ। খোলা জানালায় শ্রাবণ ধারা
ছুঁয়ে মেঘদূত মন যেনো গেয়ে ওঠে,,,,, "আজি ঝরোঝরো মুখর বাদর- দিনে /জানি
নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না। "

  প্রকৃতি গাছে গাছে কদম ফুলের পসরা সাজিয়ে শ্রাবণকে রূপ লাবণ্যে ভরিয়ে
দেয়।সেই সঙ্গে মন গুনগুনিয়ে ওঠে,,,,"বাদল  দিনের  প্রথম কদম ফুল করেছ
দান। / আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।" গ্রীষ্মের খরতাপে যখন আকাশ বাতাস
উতপ্ত , চাতকের তাড়স্বরের চিৎকার "ফটিক জল", ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে,,,,বরিষ
ধরা মাঝে শান্তির বারির  মতো শ্রাবণ তার ধারায় আমাদের সিক্ত ও তৃপ্ত
করে। আকাশ সজল মেঘে ছেয়ে যায়। কচুপাতায় শ্রাবণের ধারা ছিটকে ছিটকে
পড়ার মতো দুঃখ গুলো যেন বুকে মোচড় দিয়ে তার সুরে সুরে মিলিয়ে যেতে
চায়,,,,,",আছে দু্ঃখ ,আছে  মৃত্যু ,বিরহদহণ লাগে/তবু্ও শান্তি, তবু্ও
আনন্দ জাগে।"

 হে কবি, শ্রাবণের প্রতি ধারার মতো তোমার অতলান্তিক সৃষ্টি ধারায় যেন
আমি ভেসে চলি আমৃত্যু। তোমার প্রয়াণ দিবসে এই আমার নিজের কাছে নিজের
অঙ্গীকার।,,,,,, 



শ্রাবণ তোমার মেঘলা আকাশ
সম্পা দত্ত

রোদ মেঘের লুকোচুরি,
ভেসে ভেসে যাওয়া, উড়ে উড়ে
আসা মেঘের উড়ো চিঠি----
আমি আকাশ ভালবাসি, দেখতে--
ভালবাসি মেঘেদের ভেসে যাওয়া।
আমি শ্রাবণের ঝরঝর ঝিরিঝিরি
ঝরে পড়া দেখতে ভালবাসি---
টিনের চালে শ্রাবণের ধারার টুংটাং
ঝম্ ঝম্ ছম্ ছম্ ভালবাসি---
রিম্ ঝিম্ ধারার সাথে,
ভেসে যেতে ভালবাসি উৎস হতে মোহনায়।
কবির গান গাইতে গাইতে নিজেকে,
হারাতে ভালবাসি। "মন মোর মেঘের
সঙ্গী, উড়ে চলে দিগ দীগন্তে-----"
অথবা, "পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগল আমার মন নেচে ওঠে---"
যতই মেঘ ঘন হয়ে আসুক, সে আকাশে সূর্য হেসে উঠবে--- মেঘের পর রোদ উঠবে। রোদ মেঘের অন্তরঙ্গ লুকোচুরি।
প্রকৃতি ঈশ্বরের দান, তার অপরূপ রূপ ঝলমল করে হাসবে। প্রত্যেক ঋতুর একটি নিজস্ব রূপ আছে। শ্রাবণ যে বড্ড অভিমানী। প্রকৃতির দ্বিতীয় ঋতুসন্তান, ঘন বরষায় কখনো ভাঙ্গনের জয়গানের উল্লাসে মাতে আবার কখনো বৃষ্টিতে ভিজে রোমান্টিকতার মাদকতায় মাতে। এমনি----শ্রাবণের দিনে বহু খন্ডচিত্র মনের কোণে উঁকি দিয়ে মন ভারাক্রান্ত করে।
আমার সেদিনের অবুঝ মনে, এক বৃষ্টিভেজা  বিকেলে  কবির গান গাইছি
বাইরে আওয়াজ সবাই চিৎকার করছে তোর্ষা তাদের ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়েছে। বাঁধ ভেঙ্গেছে । ছুটোছুটি। ভরা শ্রাবণে তাঁদের চোখের জলের বাঁধভাঙ্গা, হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে গেছে। অসহায় ওরা।
ঘন বর্ষায় ছোট্ট দুবছরের ভাই 'শুভ' মায়ের কোল থেকে চীরবিদায় নিয়ে চলে গেল। মা বাবা আমরা একরাশ শুণ্যতা ভাই নেই। চোখের জল।
আজ পড়ন্ত বেলায় নিজের একফালি ব্যলকনি দিয়ে উদার উন্মুক্ত শ্রাবণের মেঘলা আকাশ তাকিয়ে দেখি। আবার স্বচ্ছ ঘননীল আকাশ চেয়ে দেখি, ঝিরিঝিরি নারকেল পাতার ফাঁকে----মেঘমুক্ত নীলাকাশ ভীষণ ভাললাগে। আবার হঠাৎ করে কখন যেন একটুকড়ো বিষাদ মেঘ এসে ধীরে ধীরে ঢেকে দেয় সেই নীলরং।
তখন মনের কোন বিষন্নতায় আর এক অভিমানীআকাশ। একটু পরেই সূর্য হেসে মেঘের সাদা ভেলায় ভাসিয়ে নিবে দূরে। কত হিজিবিজি কথা।
মনে পড়ে যায় আজই তো ২২শে শ্রাবণ কবিগুরুর শেষ শয়নের দিন। মনের কোণে  মেঘলা মনের রংতুলিতে আরও এক বিষাদ শ্রাবণ উঁকি দিয়ে যায়।ছুঁয়ে যায় বৃষ্টির কান্নাভেজা দীঘল চোখের পাতা। কবি গানে গানে মনে প্রানে।
হৃদয়ে বেঁচে আছে সবার।
শ্রাবণ ও একলা আমি, আর আমার এক উন্মুক্ত উদার আকাশনীল।
ঐ দূরে  বিস্তৃত একটুকড়ো সাদা মেঘের দিকে চেয়ে থাকি। ভেসে যাই মন শান্ত হয়।
এ' যে এক-----দূরন্ত চঞ্চল মন,   শ্রাবণের উড়ে আসা মেঘপাহাড়।।





শ্রাবন শীত
স্মৃতি রায়

মোম মিছিলে বাইশবার
একটুকরো শ্রাবন শীত
মৌন দশমিক ভেঙে,অনুপম
ইলশে গুড়ির ,ক্রমশ কেঁপে ওঠা খেলা
পরিচিত বন্ধনী থেকে দূরত্বে, বহুবার
অজস্র হয়ে ওঠা  নিশ্বাস , স্বচ্ছতায়
বেগুনী দোপাটির ছেলেবেলা --
পাতিহাঁস ফাঁদ পাতে ফাঁকে ,তাকায় না
সম্পূর্ণ বাতাসের সাড়া শব্দে.......




দুঃখের বরষায়...
জিতেন্দ্র

শ্রাবণে আজ আকাশ ঢেকে আসে
মনের ভিতর যেন ঘুমের ঘোর;
কালো মেঘের প্রতিচ্ছবি ভাসে,
কোথায় বল সূর্য ওঠা ভোর !

ক্ষুদ্র জীবন একলা ধুঁকে মরে
মাথার ভিতর পোকামাকড় বাস
ভাবের ঘরেও চুঁইয়ে জল পড়ে
কেমন ধারা বল শ্রাবণ মাস !

শ্রাবণ মানে আমিতো তাই বুঝি
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল!
কেয়াপাতার নৌকো চ'ড়ে খুঁজি
জীবনগাঙে কোথা মনের ভুল !

বিরোধ যত প্লাবন ডেকে আনে
পূণ‍্য ত্রাণে ভালোবাসার রেশ 
ঝোড়ো হাওয়ায় যুক্তি হার মানে
ঝড়ের মুখে যেন তাসের দেশ !

বৃষ্টি পড়ে গাছের পাতা নড়ে
ঠাণ্ডা লড়াই জীবন কাটে বেশ
রবিঠাকুর বুকের ভিতর মরে।
বুঝি, শ্রাবণ বাইশ দিনেই শেষ !


নিষিদ্ধ পাঁচিল

সুপ্রীতি বর্মন



নিষিদ্ধ পাঁচিল আমি রাজমিস্ত্রীর পরিশ্রমের ঘাম আমার সাজানো সংসার।
বহুযুগের পরিত্যক্ত রাজবাড়ি প্রাক্তন সংস্কারে হাততোলা,
পড়েই আছি কবে থেকে জড়তার বদ্ধমূল গোছাখানেক শেকড়
আমার ফোঁকরে ভরে কেমন নিরিবিলি সংসার ঐ কচি বটগাছের।
কদিন বাদে জমিয়ে শেকড় বিস্তারে করবে আধিপত্য।
এই যাকে বলে পরের ধনে পোদ্দারি।।

এদিকে ঝরঝর বৃষ্টির অখিল সমুদ্রে আমার শরীর ধৌত
ও বৃষ্টিও অসহায় আমাকে ভিজাতে থেকে আমি পাষানপ্রস্তর নিশ্চুপ,
দীর্ঘকাল অব্যক্ত অনিশ্চয়তা বুকে জমতে থেকে ভয়,
এই যদি খোলস ছাড়তে থাকে জীর্নতার উন্মোচন,
নগ্ন ইঁট সুড়কি আড়ালে মারবে সকলে উঁকি।
বৃষ্টি একগুঁয়ে প্রেমিকা ছেড়ে ছাড়ে না আমায়,
বলি যাও না যাও চলে মেঘের কোলে আবার,
মেঘ তোমাকে কাছে না পেয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর দিয়েছে জুড়ে,
তোমাকে ফিরে পেতে তাই বলছি তুমি খুব বেহায়া,
মেতে উঠেছো এলোপাথারি চুম্বনে আমাতে পরকীয়া।।

হে নতুন দেখা দাও আবার জন্মের প্রথম শুভক্ষন,
ঐ দেখো বিশ্বকবি হেঁট করে রয়েছে তার মাথা,
মনেতে জমেছে তার দীর্ঘদিনের অব্যক্ত দীর্ঘশ্বাস,
পরিত্যক্ত যন্ত্রনার বস্তাপচা ধারনার ধুলো ঝুলে এখনো সে কারাগারে বন্দী।
যত্নের অভাবে সাঁকোতে সে কেবল একটি ইতিহাসের
প্রদর্শনী বস্তু।।
আমার প্রেমিকা দিয়েছে গড়িয়ে জলে সকল বিদ্বেষ গরল।
আসলে আবার তাকে নিয়ে সবাই করবে লাফালাফি,
আসছে কদিন বাদে বাইশে শ্রাবন,
ঠিক যেন এও একরকম বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বন।।
রবি ঠাকুর রয়েছে মুখে কুলুপ এঁটে,
কি আর বলবে বলো,
চারিদিকে অবৈধ প্রনয় বিয়ের দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর আগেই প্রাক্তন।
অন্যদিকে শরীরি ছোঁয়ায় সহবাস বিনা প্রতিশ্রুতি,
এঁটো মৌখিক প্রনয়ালাপ।।
লিখেছিলাম একদা ছন্দ গান নাচের সুর লহমায় প্রেমের স্বর্গ।
বুঝতে চেয়েছিলাম তার সঠিক যথার্থতা,
সখী ভাবনা কাহারে বলে, সখী যাতনা কাহারে বলে,
তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা, ভালোবাসা,
সখী ভালোবাসা কারে কয়?
সে কি কেবলি যাতনাময়।।
আমি পাষানপ্রস্তর আমার দেওয়াল ও ফেটে চৌঁচির হয়,
হে মহাপ্রভু তোমার না বলতে পারা কথা শুনে,
সত্যি বৃষ্টি আমি তোমারি মতন অসহায়।
শুধু এইটুকু স্বস্তি আমার,
গ্রীষ্ম শেষে তোমার ছমছম পায়ে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া,
আর আমার চোরাগলিপথে সন্তর্পনে তোমার সুখের সহবাস।
কিন্তু নবাঙ্কুর জঠরে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দিয়েছো ঠাঁই,
আমার দৃষ্টির অলক্ষ্যে শ্যাওলা,
যে এক গরাসে আমাকে গিলে নিয়ে
করেছে নিজস্ব পরিধি বিস্তার।।
বৃষ্টি তুমি তো অচেনা অতিথি পরকীয়া অন্যের সম্পত্তি,
আসো বারবার আর চলে যাও করে দিয়ে বুক খালি,
এর থেকে নাই এলে পারো,
আমি সত্যি বড় অসহায়,
শত ইচ্ছা থাকলেও দিতে পারিনা তোমার ডাকে সাড়া।।
ঐ রবি ঠাকুরের মতন তোমার বছর ঘুরে আসার প্রতীক্ষায়,
মুখটি ভার করে জরাজীর্নতার অব্যক্ত সাদা পাতা,
প্রেমের শাশ্বত আলিঙ্গনে অভুক্ত থেকে যায়।।


গল্প


সাদা 
গৌতম বিশ্বাস

আজও রাত এমনি গেলো।সামনে সাদা পাতা। কিছু এলনা মনে। গদ্য পদ্য কিছুনা। কলম রেখে শুয়ে পড়লেন কুশ।

ক'দিন ধ'রেই এমন হচ্ছে। কাগজ কলম নিয়ে বসেন, কিন্তু আসেনা। কিচ্ছু আসেনা। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন। কিছু আসেনা মাথায়।
রাত হয়। চাঁদের দিনে চাঁদ ওঠে। ডোবে। যেদিন না ওঠার, ওঠেনা। রাত হয়। 
অথচ ;;;;
একসময় ক্লান্তি আসে। শুয়ে পড়েন কুশ।


আজকাল একটা ব্যাপার হচ্ছে। শুয়ে পড়লে ঘুম ঘুম আসতে না আসতে লেখা আসে। পদ্য গদ্য সব। আসে, আসতেই থাকে।বালিশ জড়িয়ে আসে সব লাইন। গল্প, ছন্দ, যেন বাঁধ ভেঙে আছরে আসতে থাকে।
এসব তার গল্প, তার পদ্য, কুশ জানে।
এইবার লিখে ফেললেই হয়। 

পারে কই! 
কিছু মনে থাকলে তো। অথচ স্পষ্ট আসে লাইন কমা যুক্তাক্ষর।

যে সময় আসে, স্পষ্ট দেখা যায়, মনেও হয়, এই উঠি, লিখে রাখি সব।

কিন্তু কোথায় কী, হাজার চেষ্টায় ওঠা কই যায়!  জড়িয়ে আসে গা পা। হাত দুটো উঠে কী যেন কী নির্দেশ করে। চেষ্টার চুড়ান্ত হয়। শরীর ওঠেনা।

গলায় নাকি একটা গোঁগোঁ শব্দ ওঠে।

কুশ বলে, মা, তাহলে গল্পগুলো, পদ্যগুলো আর কখনো ধরা দেবেনা!






"এমন দিনে তারে বলা যায়".........
মৌসুমী  চৌধুরী



শ্রাবণ-আকাশ কেঁদে কেঁদে বেজে চলেছে অপরূপ মেঘ-মল্লার রাগে। আকাশের বুকেও কি জমা ছিলো এক সমুদ্র কান্না?সেও কি হৃদয়ভার নামিয়ে রেখেছিলো প্রেমাস্পদ কালো মেঘদূতের বুকে? অঝোর শ্রাবণধারা যেন ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে চাইছে পৃথিবীর যত কালিমা - কলুষ। গাছগুলোও আকন্ঠ ভিজছে শ্রাবণের অকৃপণ ধারায়। একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ছে তারা বড়ই আদরে-সোহাগে। কুচকুচে কালো পিচ রাস্তার ওপর টুপটাপ ঝরে পড়ছে বৃষ্টি-আদর। জানালা দিয়ে দূরে জল ভরা আকাশের দিকে জল ভরা চোখে চেয়ে বসে আছে মণিমালা । এমন সঘন বাদল দিনে তিনিও  কি কাউকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন? 
 ....."তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার /নামাতে পারি যদি মনোভার। /শ্রাবণ-বরিষনে একদা গৃহকোণে /দু কথা বলি যদি কাছে তার....."। যে কথা বলা হয় না, যে কথা বলার জন্য আকুল হয়ে ওঠে প্রাণ,সে কথা কি আদৌ এ জীবনে বলা যায়? বললেও কেউ কি বুঝতে পারে?..... 
       বুকের ভেতরের ঘন মেঘ চোখ উপচে বেড়িয়ে আসতে থাকে মণির। এমন অতলান্ত শ্রাবণ ধারা বার বারই তাকে ভাসিয়ে নেয়। উথালি -পাথালি হয় মন।এমনই এক ঘনঘোর শ্রাবণে তার চার বছরের জন্মদিনের দিনই নাকি নতুন সংসার পেতে  তাকে আর তার মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন  তার বাবা, নামকরা স্ত্রী-রোগ-বিশেষজ্ঞ । তখন তো সে বোঝে নি। অস্পষ্ট শুধু মনে পড়ে বাবা তাকে গাল টিপে আদর করে একটা ঢাউস ব্যাগ কাঁধে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন। বাবা তাঁর সহকর্মী প্রখ্যাত ডারমাটোলজিস্টের সঙ্গে নতুন সংসার পেতেছিলেন।  শুনেছে দুজনেই ওঁরা All India Institute of Medical Science এ জয়েন করেছিলেন, দিল্লীতে।  মণি বড় হতে সজল চোখে মা-ই একদিন সব জানিয়েছিলেন তাকে, সেও এমনই এক বৃষ্টিভেজা শ্রাবণ  দিনে.. ... ......"এমন দিনে মন খোলা যায়---/এমন মেঘস্বরে বাদল- ঝরোঝরে /তপনহীন ঘন তমসায়।।"...... আচ্ছা, তিনি সব্বার মনের কথাটি কিভাবে জেনে বসে আছেন, সেই কত বছর আগে থেকেই? 
       আসলে, মা তার বড্ড  ঘরোয়া, সাদা-
সিধে, সেকেলে ,দুর্বল চিত্তের। বাবার ব্যক্তিত্বের কাছে মা কেমন যেন ফিকে পড়ে গিয়েছিলেন। বাবা চলে যেতে মা তাকে নিয়ে দাদুর বাড়িতে চলে এসেছিলেন। তাই ছোট থেকেই "বাবা" নামক বোধটির প্রতি তীব্র ঘৃণা দানা বেঁধে বেঁধে আজ তা পাহাড় প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মণি দেখেছে, সে ঘুমিয়ে পড়লে প্রতি রাতে মা বাবাকে চিঠি লিখতেন। কিন্তু কোনদিনই সেই চিঠি পোষ্ট হোত না। মা সেগুলো ফুল লতা-পাতা আঁকা একটি কাঠের হাত বাক্সে তুলে রাখতেন।একটু বড় হতে সে দেখেছে গোলাপী প্যাডে মা কবিতা লিখতেন। তারও ঠাঁই হোত সেই কাঠের হাত বাক্সেই।তাই  " বিয়ে" নামক প্রতিষ্ঠানটির প্রতি আজীবন  এক বুক ঘৃণা লালন করেছে মণি। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে ছেলেরা তার বন্ধু হলেও, তার বুকের একান্ত জায়গাটা ছুঁতে পারে নি কেউই। কিন্ত ঐ যে শ্রাবণ, সে যে তাকে  বার বারই ভিজিয়ে, ভাসিয়ে একাকার করেছে।
               ইউনিভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে  মণিমালা দেখেছিলো রাস্তায় হাঁটু ছাড়ানো জল দাঁড়িয়ে গেছে। অগত্যা কি আর করা জল ভেঙ্গে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছিলো সে। চারিদিকে খানা-খন্দ, পা চিরে যাচ্ছিলো। হঠাৎ একটা গর্তে পা পড়তে ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পা হড়কে জলে পড়ে যাচ্ছিলো সে। সহসা পেছন থেকে একটা শক্ত হাত যেন তাকে আগলে  ধরে।এক লহমায়  নিজেকে সামলে নিয়ে পেছন ফিরে সে দেখেছিলো এক জোড়া গভীর চোখ। সেই দিন, সেই মুহূর্তে হাঁটুর্ধ জলে দাঁড়িয়ে কেমন বিহ্বল হয়ে পড়েছিলো সে...... 
                 অভীক ব্যানার্জি, তাদের ইউনিভার্সিটির কেমিষ্ট্রি ডিপার্টমেন্টের
সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর। পেছনে সবাই যাকে বলতো খ্যাপাটে। মণি অবশ্য ক্ষ্যাপামির কিছু বোঝেনি। শুধু ওই দিনের পর থেকে বিনা কারণেই সে দেখেছে এক জোড়া গভীর চোখ তাকে অনুসরণ করে। করিডরে, লাইব্রেরীতে, ক্যান্টিনে............ ফেরার পথে উঁনি প্রায়ই মণির সাথে হেঁটে আসেন বাস রাস্তা পর্যন্ত। কথা তেমন কিছু বলেন না। শুধু সে বাসে উঠলে নীরবে ফিরে যান তিনি।
        ক্রমে  জানতে পারে অভীকের মা
একজন ডাক্তার।  আর বাবা  মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, মার্চেন্ট নেভিতে ছিলেন। ছ' মাস বাড়িতে থাকতেন, ছ' মাস জাহাজে।এক জাহাজ দুর্ঘটনায়ই তার মৃত্যু হয়। তারপর অভীকের মা দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন,তখন অভীকের বয়স বারো। অভীকেরছোটবেলা কেটেছে হোষ্টেলে হোষ্টেলে, বড় অবহেলায়। সদা ব্যাস্ত মায়ের কাছে তাকে দেবার মতো সময় ছিলো না। আর স্টেপ ফাদারের প্রতি তার শিশু হৃদয়ে ছিলো তীব্র ঘৃণা, যে তার মাকে কেড়ে নিয়েছে। মা চেয়েছিলেন অভীক ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক।কিন্তু সে জেদ করে জেনারেল স্ট্রীমে ভর্তি হয়েছিলো। না, সে মা বা বাবা কারও মতোই হতে চায় নি। সে চেয়েছিলো ভালোবাসার ঘেরাটোপে স্নিগ্ধ একটি জীবন। তার কল্পনায় আসত কেউ একজন..."পড়নে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদূর...।" সব শুনে বড় বিচলিত বোধ করেছিল মণি। তার অন্তর্বাসিনী উন্মুখ হয়েছিলো....জীবন্ত লাশের কাছে এ কোন্ জীবনের আহ্বান?........তবে কি জ্বলে উঠছে আলো গভীরে, গোপনে?...... নির্জন রাতে শিরা- দপদপ- করা চিন্তাগুলো জোরালো ঝাপটা মারে মণিকে.... সে যে চিরদিন ভেসে চলেছে অতল-অকূল ঘৃণার সমুদ্রে! ছাই হয়ে যাওয়া বুক দিয়ে কিভাবে মেটাবে জীবনের দাবী! 
                   ক্রমে অভীক আর তার সম্পর্কের  পরতে পরতে খেলে যেতে লাগলো রামধনু রঙ। গুঞ্জন উঠলো ক্যাম্পাসে।অভীক বললো,
"চলো,বন্ধ করি  গুঞ্জন। আমরা বিয়ে করি।" চুপ করে থেকেছিলো মণি।  তারপর এক পড়ন্ত বিকেলে.... তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে  হঠাৎ অভীক বলে ওঠে, "আচ্ছা মণি, এই যে আমরা, আমাদের বাবা-মায়ের ছেলে-মেয়েরা, আমাদের অস্তিত্বের পেছনে কি প্রেমের অপরূপ আয়োজন ছিলো?  নাকি আমরা সবাই যৌন ফসল?" বড়ই উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলো মণির অন্তর্বাসিনী,এ যে তারও প্রশ্ন!সেইদিনই প্রথম ছলছলে  চোখে অভীককে বাবার কথা বলে সে, মায়ের কষ্টের কথা বলে। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাস -
হীনতার কথা বলে। অভীকের হাত উঠে আসে তার কাঁধে...... তাদের বাড়িতে অভীকের যাতায়াত বাড়ে।মা অভীককে বিশেষ পছন্দ করেছিলেন।এভাবে বেশ কেটে গিয়েছিলো এক বছর। ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করেছিলো  মণিমালা।
               তারপর আসে সেই অঝোর ধারার কালো শ্রাবণ দিন।কর্মসূত্রে তখন অভীকের মা-বাবা থাকতেন পাটনায়।কলকাতায় এসেছিলেন মূলত মণিমালার সাথেই আলাপ করতে।  অবিরাম বর্ষণ আর মাতাল হাওয়ার দাপাদাপিকে অগ্রাহ্য করে সবুজ তাঁতের শাড়িতে মণিমালা যখন অভীকের ফ্ল্যাটে পৌঁছায় তখন বেলা প্রায় তিনটে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।দরজা যিনি খুললেন তাঁর কপালের কাছে পাকা চুলের ভাগ বেশি।মুখে হালকা প্রশান্তি।স্মিত মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্নও। মণি জিজ্ঞেস করে, "অভীক আছে?" তখনই ভদ্রনহিলা এক গাল হেসে বলেন,"ওহো মণিমালা, এসো এসো। অভি ফোন করেছিলো। আধ ঘন্টার মধ্যে চলে আসবে। ইস! ভেজোনি তো, যা বৃষ্টি!" অভীকের মাকে বেশ আন্তরিক মনে হয়েছিলো। ড্রইং রুমটা বেশ বড় আর পরিপাটি করে সাজানো। দেওয়াল জোড়া একটা বড় টিভি। রিমোট হাতে পেছন ঘুরে টিভি দেখছেন অভীকের স্টেপ ফাদার। তাদের আওয়াজ পেয়ে মুখ ঘোরান ভদ্রলোক........ সহসা টলে ওঠে মণির পৃথিবী! বুকের ভেতরে গুড়ুম গুড়ুম বাজ পড়তে থাকে..... কে ওঁ?..... তাকে গাল টিপে আদর করে চলে যাচ্ছে, পিঠে ব্যাগ! অবিকল সেই মুখ.... চোখে পুরু চশমা। ডান গালে একটা লাল জরুল চিহ্ন।নাঃ, মণিকে তিনি চিনতে পারেন নি। অভীকের মায়ের গলা শুনে সম্বিত ফিরে পেয়েছিলো , "ইনি আমার হাজব্যান্ড। ডঃ দেবকুমার সান্যাল...... "। বাবা!!! মণি আর কিছু শোনে নি। দৌড়ে বেড়িয়ে এসেছিল। বাইরে অঝোর শ্রাবণধারা ধুয়ে দিচ্ছিলো তার চোখের শ্রাবণ.......
                      পরদিন অভীককে সব জানিয়েছিলো মনি। মুখোমুখি স্তব্ধ হয়ে বসেছিলো সেও।  মরিয়া  হয়ে  মণিকে বোঝাতে চেয়েছিল তাদের তো  ব্লাড রিলেশান নেই...... কিন্তু মেনে নিতে পারে নি সে।সে আর অভীক কেউই প্রেমের ফল নয়, এ পৃথিবীর যৌন ফসল......
             বাইরের স্নিগ্ধ  শ্রাবণধারাও যেন তপ্তধারা হয়ে বিষাদ- সুর তুলছিলো দুজন মানুষ-মানুষীর বুকে...... "সে কথা শুনিবে না কেহ আর,/নিভৃত নির্জন চারি ধার।/দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,/আকাশে জল ঝরে অনিবার-----/জগতে কেহ যেন নাহি আর।।"  


কবিতা



একলা শব্দেরা 
মোনালিসা রেহমান 


বৃষ্টি হলে ভেজে মাটির বুক 
সরেস হ'য় মাটি
বিভোর কোন রাতে
শব্দেরা পিছু ডাকে 
ভিজবে নিঃশব্দে 
তারারাও প্রতিবাদে

আমি তখন তোমাতে মগ্ন 
রাতের কারাবাসে 

      তারপর সাদা পৃষ্ঠায় গল্প
লেখা হয় আনমনে 
নিঝুম দুপুর খুনসুটি করে 
আয়াসে।   বিস্তারে তার 
মাঠ ঘাট প্রান্তর 
গিদালেরা দোতারা
বৃষ্টির গান ধরে।



-শ্রাবণ-শর্বরী--
কুমকুম ঘোষ

কথা ছিল
কথা ছিল--রোদের ক্ষত গভীর হলে দিক্পাল সময়ের হাত ধরে চিরহরিৎ অরণ্যে যাবো শ্রাবণ-মেঘের অনেষ্বণে :
তুমুল জ্যোৎস্নাকে একপাশে সরিয়ে রেখে মেঘের দেশ যখন সেজে উঠবে বর্ষণ-উৎসবে;
মাধুকরী সাঙ্গ করে বৃষ্টির একতারায় বাউলের প্রাণভোমরা বেজে উঠবে রাগ মল্লারে।
কথা ছিল--আজানের সুরে মঙ্গলশঙ্খ উঠবে বেজে :
নিনাদিত হবে পত্রে -পল্লবে, একান্ত আশ্লিষ্ট নয়নে-নয়নে;
আশরীর ভিজিয়ে নেব কস্তুরী-ভালোবাসার নিবিড় আলাপনে।
কথা ছিল
কথা ছিল--নক্ষত্রমালার পুষ্পহার সাক্ষ্য দেবে সেই অলৌকিক গান্ধর্ব-অভিসারের :
শুকতারা জেগে উঠে করবে উলুধ্বনি;
সূর্যমুখী সকালের খোঁজে সময়কে করবো অতিক্রম,
যাবো পর্যটনে--অবিরল যাপিত রোজকার জীবনে।
কথা ছিল-- পীড়িত বকুলগুলি তারা হয়ে ঝরে যাবে;
বিনির্মীত আলপনায়, চিরায়ত লোক-পুরাণের নক্শিকাঁথায়;
সাক্ষী থাকবে আদিগন্ত জুড়ে।
কথা ছিল
কথা ছিল---
অথচ মহাপতনের শ্রাবণ-শর্বরী
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে।
ভেসে গেল সোনার তরী স্রোতের  বাঁকে :
পড়ে থাকলো শুধু--রাশি রাশি দেওয়া কথা : অভিমানী হরিণীর মত --যেন ধান কাটা মাঠ,--পরিত্যক্ত নবান্নের উৎসাহ যত।




 বৃষ্টি      
সোমনাথ গুহ   

এখন আর বৃষ্টি হয় না আগের মতো
কেমন যেন বদলে গেছে সব
অনেক রাত্রির গল্প গুলো এভাবেই হারায়
আমাদের মেঘলা দিনের সরু পথ

এখন আর বৃষ্টি হয় না আগের মতো
চোখের আড়ালেই হারায় মন
ঢেউ কেটে কেটে যায় কাগজের নৌকো
ভিজে যায় আমাদের আয়োজন

এখন আর বৃষ্টি হয় না আগের মতো
দেখা হয় শুধু মাঝেমাঝে
মেঘেদের বাড়ি ঘেঁষে থাকে ছেড়া ছাতা
জলের ঝাপটা লাগে চশমার কাঁচে




শ্রাবণে 
 শিপ্রা পাল

শ্রাবণের ধারা একরাশ মেঘে এলোকেশী
যেন কোন নয়না চোখে সর্বনাশী,
চারিদিকে টইটুম্বুর মেঘ যৌবনে
ভরা পোয়াতির সারা শরীর যাতনে। 
চমকিত তড়িৎ আলোর আকাশে
কাজল দিঘি উথাল বধূর পিয়াসে,
জোনাকবাতি প্রকৃতিস্নাত পথঘাট
কিশোরী মন আনমনা পঙ্কিল মাঠ। 
কদম সুবাস ঝরঝর একাকার
কেকার ডাকে রাধিকার অভিসার,
এলোমেলো বরষার রঙ চারধার
কাগজের নৌকো সুদূরে তোলপার। 
রিনিঝিনি শব্দ বাজে মধুর সৃষ্টি 
পাগল হাওয়া ওগো অপূর্ব বৃষ্টি,
এসেছে শ্রাবণ তনু মন চঞ্চলা 
সিক্ত শ্রাবণী তুমি প্রাণরস অঞ্চলা।




শ্রাবণে ভেজা গুচ্ছকবিতা...
সুদীপ ব্যানার্জী

       (১)
কেউ শোনেনি কেউ দেখেনি এ ভাবে
মেঘের ওপার থেকে সুরেলা সে জাগে
ছবির ওপর আসমানি নাভিদেশ
ডুবিয়ে দাও শ্রাবণ
আমার আপন স্মারকগুলি
আজও নড়েচড়ে
তোমার ধারার অঝোর ফোঁটার সাথে
নেমে আসে ভেজা ভেজা
অস্ফূট উচ্চারণ যৌবনের

         (২)
ছিঁচকাদুনি মেয়ে কান্না মানায় তোকে,
আকাশের বুকে মাথা রেখে।
ওরা মেঘ নয়...
পরিচয় লুকোলেও চিনি তোর ফুল সাজ...
আলুথালু মনে গুমরাস কোনে...
চোখের জলে বিজলিরা চমকাস...
জানে সে জন জানে...
ব্যথার বাঁধণ প্রাণে...
এমন বাদল দিনে...
শুধু পেতে তাকে...
রোজ এ ধারাস্নান..
দারুন আগুণ বুকেতে,
তরী ভিড়েছে সোনার।
শ্রাবণ খোঁজে কাকভেজা
সেই দস্যি প্রেমিকাকে...

          (৩)
ক্যালেন্ডারে জলপ্রপাতের ছবি।
এগার মাস পাশাপাশি লাইনে দাঁড়িয়ে...
খুব ভেজা প্লাবন প্লাবন চৌরাস্তা।
এমন দিনেই তাকে বলা যায়...
বুকে জমা মেঘ, ছাই রঙের আবেগ
ঢেলে দাও...
মুহুর্তে ঘোলাটে বণ্যা নামাও
বর্ষা ভেজা না দেখা সব ছবিতে...




শ্রাবণ আর আমি
সঞ্চিতা দাস 

জীবন ছন্দ আঁকব না আর
তুলির টানে,
শ্রাবণ আছে সঙ্গে আমার
মনে-প্রাণে।
মন মাতালো ও আমাকে
আপনভোলা-
তাই রেখেছি সবখানেতে
দুয়ার খোলা
মানব না আর বিধি নিষেধ
করেছি পণ-
ঝরিয়ে দিয়ে ভরাও জীবন
তুমি শ্রাবণ।





মন খারাপের একটা দেশ চাই                                                                    শিবু

মন খারাপের একটা ‘দেশ’ চাই যেখানে
বিকেল হলেই কোন শব্দ না করে বৃষ্টি ঝরবে
খেয়ালী আড্ডাঘর গড়ে উঠবে আমাকে ঘিরে
গুটি গুটি পায়ে ডাহুক পাখি, শীর্ণ সাদা বক আর
হাত-পা ছড়ানো আষাঢ়ের ব্যাঙ আসর বসাবে।

পাশেই ছাই রঙ মেখে সন্ধ্যেকবি সুকান্ত হয়ে বসে থাকে
এ আসর পাছে ভেস্তে যায় আকাশমণির পাতাও নড়ে না,
বারবেলার কাকেদের হই হুল্লোড়ে পথবাতি গুলি জ্বলে ওঠে ঠিকই-
                                                     অনিচ্ছায়
গোধূলির আভাসে সেই সুযোগে আবার ঘরে ঢুকে যায়।

মন কেমনের একটা চলে আসা চাই, কোন আমন্ত্রণ ছাড়াই
হৃদয়ের অলিন্দে এসে ডোর-বেল বাজিয়ে চমকে দিক –
খবর না দিয়ে চলে আসা প্রিয়জনের মত !





এমনি বাদল দিনে
রূপালী গোস্বামী


আকাশের আজ বড্ড গোঁসা,
মুখখানা করেছে হাঁড়ি;
চোখের জলের বাঁধ মানেনাা,
সূর্যের সাথে আড়ি ।
মেঘের ঘনঘটা দোসর আজ,
রাগ মল্লারে বাদন;
স্থূল দেহ থাক রুদ্ধ ঘরে,
ভাসিয়ে দিলাম মন।
মলিনতা সব ধুয়ে মুছে যাক ,
সজীবতায় ভরুক ধরা;
নতুন সুর ধরেছে শোনো
বাদল বাউলের একতারা ।
চলো, এমন দিনে সবে মিলে,
মেঘের সঙ্গী হই ।।


ব্যক্তিগত গদ্য



শ্রাবণ
নবনীতা স্যান্যাল

কাল রাতে (আধোঘুমে আচ্ছন্ন যখন ), হঠাৎই খুঁজে পেলাম "হৃদয় দেবনাথ" নামে কারো বাড়ি। ,পেলাম মানে লোকজন বলল, অথচ তাকে আদৌ চিনি
নি কিনা বুঝতে পারলাম না. . . .তার চেয়েও বড়ো হল, বাড়িটার কোন দরজা আমি দেখিনি! এখনও মনে  পড়ছে   সাদা নিঝুম   বাড়িটা।, কিন্তু কী অদ্ভুত  দরজার কোন ছবি মনেই পড়ছে  না . , . .'হৃদয়ে দাঁড়ের শব্দ,' শুনতে পাচ্ছি  আর  বঙিকমের মন্ত্রের ফিসফিস   "তোমার কী হারাইয়াছে. . ?"কিন্তু কথাটা এই যে, হৃদয়বাবুর বাড়ির দরজার হদিশ দেয় কে?
এদিকে তখন ঘোর বৃষ্টি , ঝড় তুফান নেই তো কী! !বৃষ্টি তো কান্নার মতো অঝোর ধারায় পড়ে চলেছে, একা একা নেমে পড়লে এইই হয়, সঙ্গীসাথী কেউ নেই কান্না তো আসবেই।হৃদয়বাবুর বাড়ির দরজার হদিশ না পেয়ে ফিরে আসবার সময় আমার ও এমন অঝোর ধারা হতে ইচ্ছে করেছিল।




শ্রাবণের রাত গুলি-----
রাখী বসাক

শ্রাবণের জলের সাথে ভেসে ওঠে থিতিয়ে থাকা রাতগুলি।অন্য মাস গুলি কেটে যায় যদিও বা কোন ক্রমে।শ্রাবণের বর্ষামুখর রাত গুলি যেন কেঁড়ে নেয় ওদের শান্তির ঘুম।আমরা যখন সখ্যতা করে বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দে ঘুমের সাথে মিশে যাই,ঠিক তখনই ওরা ইঁট গুলি নিয়ে করতে থাকে ছুটোছুটি।হবেই বা না কেন ? নদীর বাঁধ ঘেঁসা ওই মাটির,বাঁশের তৈরী ছোট্ট,ছোট্ট ঘর গুলি যে কোন সময় তলিয়ে যেতে পারে নদীর গর্ভে।তাই তো ইঁটের উপর ইঁট দিয়ে ছোট্ট চার হাতের চৌকি টা কে জল থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা।ওটার এধারে আছে আ্যালমুনিয়ামের বাক্সে জীবন যাপনের টুকিটাকি সরঞ্জাম।অন্যদিকে শরীর টাকে কোন ভাবে ভাঁজ করে শুয়ে থাকে নীরুবালা,সনেকা তাদের বাচ্চাগুলি বুকে জড়িয়ে ধরে।ভোরের বেলায় ওদের কামিনী,বেলী ফুলের গন্ধে ঘুম ভাঙে না,ওদের মাথার ওপর ,সরু দড়িগুলি তে ঝুলছে বিবর্ন,ছেড়া,তেলচিটে গন্ধ আঁধভেজা কাপড় গুলি। সব ভুলে গিয়ে সকালে রোদের আলোয় হেসে ওঠে। ঘরের ভাঙা চূড়ো জিনিসগুলির সাথে নিজেদেরও একটু শুকিয়ে নেওয়া।রাত হলেই যে আবার ভিজতে হবে---।দূর্বল বাঁশের বেড়াগুলির জলের ঝাপটায়।মাথার উপর টিনের ছিদ্র গুলিতে প্লাসটিক বেঁধে ধরে রাখা।
    শ্রাবণের বৃষ্টি মুখর রাতে আমরা যখন ভাবি মুখের স্বাদ বদলানোর কথা (খিচুড়ী,ডিমভাজা,পাপড় ভাজা,আলুভাজা ) সে সময় নীরুবালা পুরোনো আটাগুলি জল,লবন দিয়ে গুলে মুঠো,মুঠো করে গরম জলে সেদ্ধ করে নেবার কথা।ভিজে কাঠ ও আগুনে দেয় না ধরা।অনেক চেষ্টা করে ধোঁয়া,ধোঁয়া গন্ধে গরম করে নেওয়া।আটার মন্ডাগুলো লবন দিয়ে মুখের স্বাদে নয়,পেটের টানে মুখে গুজে নেওয়া।শ্রাবণের ধারা ওদের অভিশাপ হয়ে ওঠে।একবুক জল পেরিয়ে রোজগার়ের সন্ধানে বের হওয়া----
            প্রতিটি শ্রাবণ চলে যায় এভাবেই।শুধু মনের কোনে একটু আশা জেগে থাকে।কখন থেমে যাবে শ্রাবনের অঝোর ধারা।জমে থাকা দুঃখের পলি গুলিকে সরিয়ে একটু হাসি নিয়ে বেঁচে থাকা----





শ্রাবন; আমার ঋতুমাস
দেবব্রত তাঁতী
 

।। ১ ।।
জানলার পাশে বুকভরা শূন্যতা নিয়ে বসে বসে ভাবছি বৃষ্টি কি কেবল বাইরে ঝরে ! মনের ভেতরেও তো নিঃশব্দে কেঁদে চলে গর্ভবস্তার ইচ্ছেরা । আকাশের কান্না দেখে বিষণ্ণতা অভিমান , আসলে মনের চাপা কান্না । কেউ দেখেনা । বৃষ্টির ঝাপটা আসছে ...প্রথম ছোঁয়াতে কেমন শীতল স্পর্শ । শরীরে কেমন রোমাঞ্চ ! খোলা জানলায় দেখি দূর সীমান্তে মেঘেদের নারী মূর্তি । কখন গুরুদেবের ও ছবি যেন মনের ঘরে কড়া নেড়ে যায় । এখন আর বৃষ্টি তে ভিজি না । বৃষ্টির সাথে প্রেমের এক নিবিড় সম্পর্ক । গভীর ভালোবাসা । আজকাল বিস্বাসের হাত পাওয়া মুশকিল । কোনদিন তুমুল ঝড় আসতে পারে । ভয় লাগে আবার কাউকে হারাতে হবে । আপন ভেবে নিলে সে পর হতে চাই আর পর হটাত করেই বড্ড আপন হয়ে যায় । সেই কবি বলেছিল – “আমি প্রলয় , সৃষ্টি আর স্তিতি কে মানি না” । সত্যি কি ? স্কুল ছুটি ফেরা ভেজা ছেলে টা বই পত্র উনানের আঁচে দিতো নেহাত পূর্বের অবস্থায় ফিরবে বলে । ম্যা বলত – “ বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করে” । দেখো কথাটা সত্যি । প্রাক্তনের কাছে ফেলে আসা মনের ঠিকানায় বিকেল আসে রোজ যেভাবে প্রতিদিন নিয়মে চলে । একজনের সর্দি নিয়ে অপর জনের সাথে খুন সুটি । একজনের সর্দি নিয়ে অপর জনের সাথে অকারন অপ্রয়োজনীয় আদান প্রদানে মেতে থাকে একে অপরের সাথে । কিন্তু দেখ যে বৃষ্টি , যে সৃষ্টির খোঁজে হন্যেহারা পাগলপারা মন তাকেই পাচ্ছে না । যদিও বা শ্রাবনের খোঁজ আষাঢ়ে ঢেউ । কেউ আবার মিথ্যে প্রতিস্রুতি দেয় – আষাঢ় প্রথম দিবস থেকে তোমার চোখ আমার ঘুম চুরি গিয়েছে । মন চুরি কি সবাই পারে নাকি ? ওই দেখ এখুনিই এক ফড়িং ফুলের মধু নিয়ে উড়ে গেল ।
শ্রাবন আমার ঋতু মাস । আমার প্রথম যৌবন অনুভুতি আর কল্পনার কাব্যে ঠাণ্ডা পরশে জেগে ওঠে ভেতরের নারী শরীর । এই একবিংশ শতাব্দী তে এসেও দেখতে হয় বেহুলা ভেলা নিয়ে গঙ্গায় ভেসে চলেছে স্বর্গ রাজ্যে যাওয়ার জন্য । তাই প্রকিতির নীরব বোবা কান্না কাঁদতে কাঁদতে গর্জন করে ওঠে । মুখরিত হয় ত্রিভুবন । গতকাল বর্ষায় আমার এক বান্ধবী ফিরে গেছে দূরে অজানায় হয়ত আসতেও চাইনা । আসলেও আমিও কুঁড়ে কেবল ঘুমিয়েই থাকি কখন কৃষ্ণ এলো । বাঁশি বাজাল । ঘুঙুরের আওয়াজ তুলে চলে গেল বুঝতে পারলাম না । আর ওই বেশ্যা চাঁদ যাকে যাকে এতদিন নিজের বলে ভেবে ছিলাম সেও ফাঁকি দিয়েছে । আর ফেরাতেও চাইনা । কাউকে জোর করে আটকে রাখা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ । স্রাবনমাস আমার প্রেমিকা সেও আমাকে শিখিয়েছে দিয়েই যাও । ঢেলেই যাও প্রেমের সুধা । ধরিত্রি ঋতু ময়ী না হলে আমরা বাঁচবো কিভাবে ? কেন আমি দিই নি আমার সকল শূন্য করে যেন বলতে হয়না । 

।। ২ ।।
কচুরি পানার বেড়ে ওঠা । ব্যাঙের ডাক । রাতের ঝি ঝি পোকার ডাক । দোপাটি ফুলের মাথা দোলা বৃষ্টির ফোঁটা দেখতে দেখতে ধরতে ধরতে কখন যেন মায়াবী ফাঁদে পরে গেছি । বাতাবি লেবুর গন্ধ । জামরুল – কালোজামের স্বাদে ভিন্নতা । ছাতা বিহীন মানুষের ভিজে বাড়ি ফেরা দেখি রোজ এ জানলা দিয়ে । ইচ্ছে করে ওই পাখি হয়ে উড়ে বেড়ায় আর বৃষ্টিতে ভিজি । ডুবু ডুবু পুকুরে মাছেদের লুকোচুরি খেলা । পাশের বাড়ির কাকিমার ছেগুন জালে চুনো মাছ বাড়িতে শাক চচরি বাজপরা আর বিদ্যুৎ চমকালে ওই মেয়েটি বড্ড আনন্দ পায় ।
যে সব বান্ধবীর কাছে ভুল করে মন চেয়ে বসেছিলাম তারা সবাই ফিরিয়ে দিয়েছে গুচ্ছ কবিতা দিয়ে । কেউ বা শরীর দিয়ে মন ভরাতে চেয়েছে । সারাজীবনের জন্য কাউকে চেয়ে বসাতেই মহাভুল । কিছুদিনের জন্য কেবল খেলা ঘরে খেলে ফিরে যাও যে যেদার দিকে পথে ... । ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকিতি ও বদলে যায় । বদালনয় ত নিয়ম । কেউ আসে কথা দেয় আর ফিরে যাওয়ার পথে শুভ কামনা জানায়- ভাল থেকো । তুমি আমার থেকেও ভাল কাউকে জীবনে পাবে । ঠিক এই শ্রাবনের ধারার মত ঝরে পড়ে । দুচোখে যে সমুদ্র লুকানো রয়েছে জেনেও আঘাত দিতে বিন্দু মাত্র কেউ দ্বিধা করে না । করবেই বা কেন সবাই তো স্বার্থের জন্য ভালোবাসে । বৃষ্টি না হলে যে সোনার ফসল ফলবেই না । সে কথা আর বলতে । তবে মা আমার স্বার্থ ছাড়া ভীষণ রকম ভালোবাসে । কি র বলব ! ভিজেই অসুখ হলেই মায়ের আদর পেতে বেশি ইচ্ছে করে । বান্ধবিরা যেন চোখের বিষ ।
এ শ্রাবন আবার আমার জন্মদাতার প্রিয় মাস । নইলে এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে লাঙল কাঁধে মাঠে যায় । এদিকে আবার বাবা তারেকস্বরের মাস । সবাই বাঁকে করে শেওড়াফুলি থেকে জল নিয়ে হেঁটে যায় বাবার মাথায় জল দিতে ।
শুধু যে আনন্দ তা নয় । কষ্ট ও মিশ্রিত এই শ্রাবণ মাস আর মুষল ধারার বৃষ্টির সাথে । নিয়ম অনুসারে জল সর্বদা গড়িয়েই চলে উপর থেকে নিচের দিকে । কখনও দেখেছি টালি ফুঁড়ে জল টপটপ করে এখানে ওখানে । ভাতের থালায় । কিংবা বিছানায় । মা ডেকে দিতো । একসাথে জড়সড় ভাবে চারজনে শুয়ে পড়তাম । কখন আধো ঘুম সেরে বাকিটা ওই অন্ধকার ঘর আর বিছানায় ফেলে রেখে উঠে আসতে হতো । একান্ত কাজের জ্বালায় । অল্প বৃষ্টি এলেই কিংবা মাঠে জল কাদা হলেই ধাপাস বল নিয়ে বন্ধুরা কজন বেড়িয়ে পড়তাম খেলতে । খেলা , কাদাজল আর পায়ে লাগা । শামুকে কাটা রক্ত , ব্যাথা নিয়েই ফিরে আসা । মায়ের বকুনি আর বাপের চোখে ফাঁকি দিয়ে দিব্বি ঘুরে বেড়াতাম । বাপের সেই কঞ্চির বাড়িটা সা সা আওয়াজ তুলত মাঝে মাঝে । আমার কান্নার আওওাজে সাড়া পাড়া জেনে যেত যে কি ঘটছে । ঠাকুমা ঠাকুর দাদা অস্থির হয়ে পড়ত । ভীষণ ভালবাসত আমার । তাই বেশির ভাগ সময় টা ওনাদের সাথেই ছোটবেলাটা কেটেছে । কখন স্কুল যাওয়ার পথে ইচ্ছে করেই ভিজে যেতাম । স্কুল ছুটি । বাড়ি ফেরা । আবার মাছ ধরতে খালের দিকে কিংবা বল নিয়ে মাঠে । এই তো আমার শ্রাবণ মাস আবার কি চাই । এর চেয়ে বেশি কিছু তো আশা করিনি । করতেও নেই । আশা নিরাশা ।


কবিতা



    শ্রাবণের চিঠি
   নিশীথবরণ চৌধুরী


         নির্জন দুপুরে শ্রাবণের চিঠি এল
      ক্রন্দিত আকাশ হতে অবিরাম বারিষ ধারা,
          আপন মনে ঝরছে বিদ্যুৎ ঝলকে--
          আমি পরিশ্রান্ত পান্থ হই পথ ভোলা।
জল আর বাতাসের স্বর মিলেমিশে একাকার,
        স্তব্ধ দুপুর ঘনায়ে এসেছে আঁধার।
         জন হীন পথঘাট গৃহ বন্দী মানুষ
  ফসল বপনের ডাকে কৃষকের নেই কোনো হুঁশ।
              দুই কূল ছাপানো জলোচ্ছ্বাসে
          নীরব পায়ে বন্যা নামে চারপাশে।
     গগণ ললাট ঢেকে কালো মেঘের অবগুণ্ঠণ
              সিক্ত কৃষ্ণচূড়ার সলাজ আনন,
       আপন স্মৃতির সরণিতে করি অন্বেষণ।
     খুঁজে দেখি সেই চোখ, রাগ ,মুখে হাসি নিয়ে,
         অপলক দৃষ্টি আমার হৃদয়ে করেছে ঠাঁই।
        তোমার একরাশ সিক্ত কেশের আড়ালে,
         প্রেম সলজ্জ বদনে যেত হারায়ে।
       মোর অশ্রু সজল,দুই চক্ষু ছল ছল,বিষণ্ণ অধর,ম্লান মুখ---
    ভুলে গিয়ে অভিমান প্রত্যক্ষ করিতে যদি অন্তরের ব্যথা,
    নীরবে প্রকাশ হতো বুকে জমে থাকা সব কথা।




শ্রাবণ এলো 
সুস্মিতা কুন্ডু

ছয়টি ঋতু বাংলা মাসে
     আষাঢ় শ্রাবণ  বর্ষাকাল ,
       আকাশ জুড়ে থাকত ছেয়ে
                কালো মেঘের দল  ;
       রিমিঝিমি টাপুর টুপুর 
              শব্দে আবেশ ধরা ,
      থৈ থৈ জল ,পথ ঘাট সব 
                   বৃষ্টি জলে ভরা ;
           নদীনালা উপচে যেত 
           জল কলকল ছোটে ,
              অনেক সময়ই জলের তোড়ে 
                       বাঁধ ভেঙ্গে গঞ্জ ডোবে  ;
             
           মুষলধারায় বৃষ্টি ঝরে
                        ঝাপসা চারিপাশ ,
                বাদলা দিনের ঠান্ডা মেখে 
                        ঘুমের দেশে  কাত ;
             
         এমনি করেই বড় হওয়া 
                           বাংলা মায়ের বুকে ,
                 ছোট্ট খোকন গল্প শোনে 
                             ঠাকুরদাদার মুখে  ;
        
     কোথায় গেল সুখের সে দিন 
                  পাই না খুঁজে আর ,
                      আষাঢ় গেল ,শ্রাবণ এল 
               গরম এমন ! উঠছে নাভিশ্বাস ;
                
  ঠাকুরদাদার কষ্ট ! খোকন সোনার
                          বুকে  বিষম বাজে  ,
                      কালো মেঘের দলের খোঁজে  
                         বার্তা পাঠায় ডাকে ;
                  
     সাজিয়ে গুছিয়ে লিখল শুধু 
                    একটি কথাই ভেবে ,
     বৃষ্টি তুমি রাগ কোরো না এসো আমার  
     দেশে ,
      সব শ্রাবনেই ঝোরো তুমি ঝরঝরিয়ে  
      হেসে ...|| 





বৃষ্টি মানে
অজিত কুমার দত্ত

বৃষ্টি মানে মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি মানেজল আর কাঁদা,
বৃষ্টি মানেদমকা বাতাস
ঝড় জলে এক কালো-সাদা।
বৃষ্টি মানেউলট-পালট
আছাড়-খাওয়া পিছল পথে,
বৃষ্টি মানেমেঘের গর্জন
পথ আধার হয় বজ্রপাতে।
বৃষ্টি মানেআষাঢ়ে ঢল
জলভরা সব মাঠ আর ঘাটে,
বৃষ্টি মানেআলসে-পাওয়া
কাজ যতসব যাকনা লাটে।
বৃষ্টি মানেগরম ভাতে
দই-সর্ষে আর ইলিশ-ভাজা;
বৃষ্টি মানেগুণ-গুণে-গান
আপন মনে গাইতে মজা!
বৃষ্টি মানেনিজের ভিতর
সৃষ্টি-শক্তি খুঁজে পাওয়া,
বৃষ্টি মানে সকল ভুলে
আপন মনে হারিয়ে যাওয়া।

              

     

একাত্ম শ্রাবণ
দেবপ্রিয়া  সরকার

 রাতভর দুর্যোগের পর
 বেদনা প্রবাহে উঠলো জোয়ার
 প্লাবিত হলো আমার সুখের নগর,
                                   স্বপ্ন ঘেরা পথ প্রান্তর।

রাত পেরিয়ে যখন সকাল হলো
 আকাশের মুখ তখনো কালো।
বুকে জমে আছে মেঘ থোকা থোকা,
                                    আড়ালে তাদের চাপা কান্নারা ঢাকা।

সারাদিন ব্যাপী অভিমানের মৃদু অনুরণন
ঝিরঝিরে বারিপাত ;
অন্তরে আমার সুখ-দুঃখ
                                   স্মৃতিদের অবিরাম সংঘাত।

প্রহর শেষে এলো হঠাৎ
উথাল -পাথাল দমকা পবন,
মাঝ সন্ধ্যায় নামলো ঝেঁপে
                                দুই নয়নে অঝোর শ্রাবণ। 



  
  বৃষ্টির সাথে

কৌশিক কুমার রায়

জানালার ধারে নীরবে দাড়িয়ে,
হাত বাড়িয়ে ছুতে চাই তোকে l
তোর স্নিগ্ধতায় অনুভবের জাহাজে ,
বৃষ্টি , নিয়ে চল তোর রূপনগরে l
কথা ছিলো, শ্রাবণের সান্ধ্য বেলায় ,
জ্বলবে যখন প্রদীপের শিখা  l
ঝিরি ঝিরি চুপিসারে  আসবি তবে ,
বৃষ্টি , উলু ধ্বনির সুরে ভেসে যা l
নিয়ে যাবার আগে ,নতুন ভাবে সেজেছিস !
গায়ে মেখে রজনীর সুগন্ধি l
তেষ্টায় গলা ভিজিয়েছে মাটি ,
পদ্ম এখনও যে স্নান সারে নি l
জানালার ধারে নীরবে দাঁড়িয়ে ,
চোঁখে চোঁখ অনেকক্ষন l
হিমেল সুবাসে নতুন জন্ম, মনের ...
বৃষ্টি ,নিয়ে চল এবার তোর রূপনগরে l




দাঁড়াই তবে
বর্ণালী সেন


কথা হয়ে ঝোরে গেলাম বৃষ্টি তোকে ছাড়াই
আসবি নাকি আরেকবার?
বল তবে একটু দাড়াই।
একলা মেঘের দল এসেছে
শুনছি তোকে ছাড়াই,
আর কতবার মন খোঁয়াবি?
অভিমান আর কাকে দেখাবি
কেউ কি বোঝে বৃষ্টি ছাড়া
মাটির জীবন লড়াই
চল না আবার নতুন করে
চেনা মেঘেই কাছে দূরে
একটুখানি ছোটখাট নবীন যত
মনের ঘরে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে
নিজের মত একটা আকাশ আর
কিছু স্বপ্ন সাজাই,
আসবি নাকি আরেকবার?
বল তবে একটু দাড়াই


আমার শ্রাবণ
                গৌতমী ভট্টাচার্য্য

      শ্রাবণ আমায় দু হাত ভরে
      বৃষ্টি দিল উপহার
      শ্রাবণ আমার কাজল চোখে
      খুঁজে বেড়ায় পলক তার । 
      শ্রাবণ  আমায় জড়িয়ে ধরে 
      শ্যামল  বীথির পরশতায়
      শ্রাবণ এখন উথালপাথাল 
      আমার মনের সরসতায়। 
      শ্রাবণ আমার খোলা চিঠি
      প্রথম প্রেমের কদম ফুল 
      শ্রাবণ আমার ভালবাসায়
      রাগ-অনুরাগ হাজার ভুল। 
      শ্রাবণ আমার উঠোন জলে
      কেয়া পাতার ছোট্ট নাও
      দু হাত দিয়ে ভাসিয়ে তাকে
      আগলে রাখি বাঁধনটাও । 
      শ্রাবণ আমার এলো চুলে
      যুঁথির গন্ধ-বাতাস -ভোর
      শ্রাবণ আমার উদাস মনে
      আলতো ছোঁওয়ায় খুলল দোর। 
      শ্রাবণ আমার ময়ূর পেখম
      কথ্থক আর মণিপুরী
      শ্রাবণ আমার কথকতায়
      কত কথার ফুলঋুরি। 
      শ্রাবণ আমার পাহাড়ী গান
      মেঠো বাঁশির করুণ সুর
      শ্রাবণ আমার ভালবাসার  
      সকাল-সন্ধ্যে রাত-দুপুর।



আজ শ্রাবণে
জয়ন্ত চ্যাটার্জী

ক্লান্তিতে ডুবে থাকা এলো চুলে,
যে সুনামি দেখেছিলাম-
সে ঝড়ের আঁচ বুঝিনি কোনোদিন।
শ্রাবণের এমন সন্ধ্যাতেই তো বলেছিলে 
আমি বৃষ্টি হলে ভালো হতো। 
অন্তরের অন্তঃস্থল ভিজিয়ে, হয়ে উঠতাম সকলের সোহাগী
আমার পরমেশ্বরীর রূপে মেতে উঠতো পৃথিবী।
আজ,স্বপ্নসন্ধানি এমন হাজারো বুকের তিতাস তুমি। 
একান্ত আপন করেও,যে চিতায় একলা ফিরে গেলে, 
আজ শ্রাবণে, কোথা থেকে এক অজানা বৃষ্টি এসে  
ফিরিয়ে নিয়ে গেলো সেই সুনামিপ্রবাহে। 




অঝোর
দেবশ্রী চক্রবর্তী

শ্রাবনের ধারা ঝরছে ,
শুধু ঝরছে,
নিজেকে যখন একদম
একা, প্রান্তরে খুঁজে পাই
তুমুল ধারায় জমাট বাঁধা
ব্যাথা গুলো মনে পড়ছে।

শ্রাবনের ধারা ধুয়ে দিল  সারা প্রান্তর
সিক্ত আমি লুকিয়ে রেখেছি-
কিছু মেঘ
ঝরতে তাকে দেবনা
যদি ভুলে যাই
জীবনের দেওয়া বেদনা
তাতে যে রেখেছি সযত্নে কিছু মুক্তো

রক্ত মাখা হৃদয় খানি
আবৃত করে রেখেছি,
দুধ সাদা মুক্তো দিয়ে
কালো মেঘ গুলো ঢেকেছ,
তবু বিন্দু বিন্দু রক্তের ফোঁটা
ঝরছে আর ঝরছে ,
শ্রাবন আমার দুই চোখে
তুমি বইছ
সযত্নে এই রক্তের ফোঁটা
অঝোর ধারায় ধুইছ।





দু'টি কবিতা

প্রদীপ কুমার পাইক

অক্ষরবৃত্তের আধারে 
               
 জানলায় জানলায় বৃষ্টির রূপকথা লেখা হয়।
ঝাপটায় তোমার হাত ঘেমে ওঠে।
হোম থিয়েটারে বেজে ওঠে হারানো সুর।
শ্রাবণঘন আমেজ।আশাবরী রাগ।

আষাঢ়ের ঝড়ে ফুল কুড়ানোর কথা ছিল।
কথা ছিল বকুল ফুলের মালা গাঁথার।

তাইতো পীচগলা গ্রীষ্মের চোখ রাঙানি 
উপেক্ষা করে সূর্যকে নিকষ আঁধারে 
ঢেকে দিয়ে বর্ষার গোপন অভিসার,
ঠোঁট বাড়িয়ে চুমু খায় মাটিকে।

আমি তোমার ঠোঁটের উষ্ণতা ধরে রাখতে 
অবাধ্য হই -অক্ষরবৃত্তের আধারে।



 বৃষ্টি বিকেল 

গ্রীষ্মের খুন করা চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেও
আজ যখন দূর আকাশে জমে থাকা মেঘ
তোমার চোখের আকুতি মেনে নিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে,মুষলধারে।
তখন যে তুমি মেতে ওঠো বৃষ্টি স্বাদে।
চায়ের কাপটাও খুঁজে পায় ওই ঠোঁটের উষ্ণতা।

কাঁচের জানলা দিয়ে হাত বাড়াও তুমি।
বৃষ্টির ছটায় তোমার আঙ্গুল ভেজে,ভেজে চৌকাঠ।
তুমি তখন হাসতে থাকো,ভিজিয়ে নাও হাত।
কখনো আবার চমকে ওঠো,যখন ভীষণ বজ্রপাত।

ওরে ও কমলি মেয়ে..
শ্রাবণ ধারায় ভিজবে নাকি?
তবে দাঁড়িয়ে কেন দূরে?

চলো তুমি আমি হাঁটবো খানিক
বুঝবে বৃষ্টি বিকেলকত দামী,
ভয় কেন পাও বজ্র-ছটায়?
আমিও যে জাপটে ধরতে জানি।



  

হঠাৎ বৃষ্টি
বিনীতা সরকার


তোমার ঠোঁটের কোন বেয়ে নেমে এলো
আলতো একটু হাসি
আর আমায় ভিজিয়ে গেলো অঝর ধারায়

আকাশের নীল মেঘে কি জানি কি ছিল
আলোর ঝলকানি ছিল না
তুমি বৃষ্টি হয়ে নামলে
অলস দুপুর ডুবলো I
গোলাপের মাদকতা শ্রাবণের গায়ে
নেশাতুর ঘুমহীন
তোমার গন্ধ যে বাতাস নিয়ে এলো
সেও ভিজলো l
কথা ছিল না , তবু বৃষ্টিরা এলো
ফেরি করে নিয়ে গেলো, বাতাস
তোমার কথার রেশ ,
মুঠো করা সুখ ,
আর খুব পরিচিত গন্ধ ..
বৃষ্টিরা থেমে গেছে l



 অপ্রত্যাশিত     তৃপ্তি মিত্র 

আমি বৃষ্টিতে একটু ভিজতে চাইলাম 
তুমি নদী নিয়ে এলে 
বললে , বৃষ্টি ধারায় ভরলো নদী 
চলো , ভাসিয়ে দি মনটাকে । 

আমি নদীতে গা ভাসাবো ভাবলাম 
তুমি সাগর নিয়ে এলে 
বললে ,উথাল-পাথাল ঢেউ এর দোলায় 
চলো যাই নিরুদ্দেশে । 

আমি সাগরকে একটু ছুঁতে চাইলাম 
তুমি বাড়িয়ে দিলে হাত 
বললে , সময়ের টানে সাগর একদিন 
নদীকে ডেকে নেবে 
যখন , মোহনায় যাবে মিশে ।।



শ্রাবণধারাপতন 
মাম্পি রায়
    

            সে এক বাধল দিনে
   মনবালিকা হাঁটল সুখের সাঁকোয়,
        নাম না জানা অজানা এক
              আনন্দেরই ভেলায় ;
      অমনি করে বারিস্রোতোবহা
              ধেয়ে এল হট্টতীরে
            কান্নাড়ি দমকা জোয়ার;    
          উতাল_পাতাল হৃদ সমুদ্র  
       ফাঁপিয়ে দিয়ে উজানভাটায়
          উঠলো রে বাণ হৃদয়বাঁকে ;
       মিলি সবেগ আনন্দসুখ খেলায়
               "শ্রাবণ আর আমি"
     মেতে উঠি সুখ শ্রাবণী মেলায়।।
   
          বারিকোষ ভেসে যায়
           শ্রাবণের নোনাজলে, 
              মনমেঘে ডুবে রয়
         আঁখিকোণ মায়াজালে।।

        সুখের সাঁকো ভেসে গেল,
            বাধনহারা স্পর্শদোষে ;
       বিধানপুরুষ  বাতলে দিলেন 
            সকলদিক রুষ্ট রোশে।।




এক পশলা বৃষ্টি
উপাসনা চক্রবর্তী

শ্রাবণের এক পশলা বৃষ্টিতে
পরিচয় তোর সাথে।
হাত ধরে পার করেছিলি 
শহরের জনবহুল রাস্তা।
আমার নব যৌবনের প্রথম 
পুরুষ স্পর্শ,
যেন বর্ষার স্নিগ্ধ ধারায় 
বসন্তের অনুভূতি,
মেঘের কোল থেকে বারিধারা নয়
যেন লাল পলাশের বৃষ্টি।
আকাশ জুড়ে গন কালো মেঘের চাদর
আমার হৃদয়ে এক চিলতে রোদের ঝিলিক,
আমি আজ পূর্বরাগের অভিসারিণী,
প্রিয় দর্শনে ব্যাকুল।
জনবহুল রাস্তা তবে কোথায় সে প্রাণপুরুষ
দৃষ্টির অগোচরে আজ সে, 
আজ আমার চোখে এক পশলা বৃষ্টি।।


ছবি

                                      উদয় সাহা


                                                 ছবি- দেবব্রত কুন্ডু
                                      লেখা- সুস্মিতা কুন্ডু

No comments:

Post a Comment