মধ্যবিত্ত বাবার লেখিকা কন্যা
পিয়াংকি মুখার্জী
বাবা ,তোমার কথায় মেনে নিয়েছিলাম বিয়ের পিঁড়ি, সেই ছোট্ট আমার কান্নাভেজা অবেলায় ;
তোমার "পত্রলিপি" খাতার প্রেমে পড়ে বেছে নিয়েছিলাম কবিতা লেখার প্রতিদিনের নির্দিষ্ট একটা সময় !
বাবা , তোমার অসহায় আর্থিক অবস্থা আমায় সাড়ে পনেরোতেই করেছিল "নববধূ",
একটা "তিথি-নক্ষত্র"এর ব্যাবধানে তোমার আদরের "মিঠুয়া"র হলো নবজন্ম...কুলীন বন্ধ্যোপাধ্যায় বাড়ির ছোট পুত্রবধূ!
আজ অনেকগুলো বছর পেরিয়েছে বাবা , অনেকগুলো ঘন্টা - মিনিট - সেকেন্ড ;
জীবন - খাতাটা আজ ও আক্ষেপের জ্বরে ভোগে , হয়ে গেছে রোগী পারমানেন্ট!
কষ্ট নেই আর্থিকে - সামাজিকে - বৈষয়িকে -প্রেমিকে,
সত্যিই তো কোন কষ্ট নেই আমার মানসিকে,
তবুও ফাটিয়ে গলা , চিত্কার করে উচ্চস্বরে ;
বলতে কেন পারি না ? আমি সুখী সম্পূর্ণা???
সারাদিন সবকিছু পেয়ে ও মন পড়ে রয় গভীর বনের হারানো পথে...
দিন - রাত জুড়ে চলে মনের সাথে মনের দোটানা ॥
তোমার চির অসুখ সুগার, ব্লাড প্রেসার ,ব্রেন স্ট্রোক ,
প্রতিমুহূর্তে করে আমায় চিন্তাগ্রস্থ ,
কোন এক অচেনা বৃক্ষের মগডালের পাখির বাসায় মন পড়ে রয় ,
ভাবতে চাই সব অসুখ বোধহয় ভগবানের করানো কোন চরম অভিনয় !
আত্মারা তো নির্বাক বাবা ,তবুও কেন প্রতি ক্ষণে ক্ষণে...
ওরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় আমায় যুগের বিবর্তনে!
আমি স্বপ্নের ঘোরেই থাকতে চাই...
ঘুম না ভাঙ্গার ওষুধ বেশী বেশী করে খাই ,
ঘুম ভাঙ্গলেই অতৃপ্ত আত্মারা করে তাড়া...
ছুটতে পারি না ওদের এড়িয়ে ,
তাই , অকারন হয়ে থাকি ঘুমন্ত যুগান্তরের গভীরে !
শ্বশুরবাড়ির পাঁচের সংসার শেখালো অনেক কিছু ,
একাকী জীবন পথে চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আরো শিখলাম নিজের পিছু পিছু !
কিছু হলো না এ জীবনে ,কেন বারং বার মনে হয় ?
বোধকরি সবটাই তোমার মিঠুয়ার নীরব পরাজয় !
তুমিই তো শত সহস্র বার চেয়েছিলে বাবা , আমায় জয়ী দেখতে...
আমার জেতার আনন্দ...আনন্দে দুগালে মাখতে !
ছিলাম তোমার ছোট্ট রাজত্বের রাজকন্যা ,
কেন হতে পারলাম না জীবন - লড়াইয়ের রানী মা ?
মাধ্যমিকের সাতটা লেটার , পঁচাশি শতাংশ নম্বর সমেত যে কাগজের টুকরোটা তোলা আছে আলমারির গোছানো ফাইলের ভাঁজে ;
আজ এত বছর পরেও আলমারি খুললেই সেটা আমায় দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে আর আমায় গিলে খেতে আসে !!!
ওকেও তো বোঝালাম কত শত করে আদরে আবদারে শাসনে ,
ওরে কাগজ ,আমি হতে চেয়েছিলাম ডাক্তার...
সেটা কজন ই বা জানে ?
মধ্যবিত্তের স্বপ্ন এভাবেই মরে জলে ডুবে নদীর মাঝখানে!!!
হাজার কাজের ভিড়ে ও...
বাবা ,মন পড়ে থাকে তোমার মাঝে ,
ভাবি কত কষ্ট করেছিলে তুমি সকাল - সাঁঝে !
দুর্বল শরীর আর অক্লান্ত পরিশ্রম নিয়েও করে গেছ শুধু চেষ্টা ,
কিভাবে ভাল থাকবে তোমার রাজকন্যা আর তার সুখের তৈরী দেশটা ॥
"সব পেয়েছির আসরে" আজ গিয়েছিলাম বাবা সেজেগুজে ,
স্বামী - সংসার - সন্তান সব পেয়েছি এই ভেবে নিশ্চিন্তে চোখ বুজে !
কিন্তু বাবা ,তোমার মেয়ে আজ প্রতারিত হলো...
অসম্পুর্ন জীবনের জন্য প্রতিযোগীর তকমা পেল না যখন ,
তখন কেও তো ওকে পিছু ডাকলো না ,বুঝলো না ওর মনের বেদন !
তখন ও দেখি আসরের বাইরে তুমি দাঁড়িয়ে আছ একা ,
ভাবছ মিঠুয়া কাঁদবে ফুঁপিয়ে....ছোট্ট বেলার মতন...
এখনও বুঝি ও বড্ড বোকা ॥
কান্নারা সব বিদায় নিয়েছে বাবা চোখের জলে ভেসে ,
দিয়ে গেছে শুধু লেখনীশক্তি , তোমার মেয়েকে ভালবেসে !
আজ বৃদ্ধ বয়সে ভর দুপুরে একা তোমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ,
ভীষণ রকম উত্সাহ পাই আনন্দে - কষ্টে - আবেগে !
পড়ন্ত বিকেল সাঁঝে তোমার চোখে তোমার মিঠুয়া জয়ী...
তোমার দেওয়া বাস্তব শিক্ষায় আজ সে সত্যিই প্রত্যয়ী ॥
আর কাঁদিনা বাবা ,জানি যে কটা বছর আছে তোমার হাতে...
তার মধ্যেই একটু হলেও প্রতিষ্ঠা করতে হবে নিজেকে তোমার শান্তির স্বার্থে !
সব অভিমান আর অতৃপ্তিগুলোকে ধাক্কা দিয়েছি গভীর জলে ,
শেষ হাসি হাসব আমিই ,হয়ে উঠব আবার ঝলমলে !!!
সেইজন্য ই...
তোমার দেয়া শিক্ষা মতো বাবা ,আঁটচালাতেই আছি আমি ;
মনকে গড়েছি ঠিক্ অট্টালিকা,
আজ আমার লেখা পড়ে কাঁদে পাঠক যখন...
তখন মনে হয় আমি স্বপ্ন পূরণের পথে
সফল এক লেখিকা ॥
হ্যাঁ বাবা ,তোমার আশীর্বাদে আমি শুধু সংসার সামলানো গৃহবধূ নই...
উনুনের গনগনে লালচে আগুন রাঙ্গা জয়িতা হতে চাই...
মধ্যবিত্ত বাবার আদুরে রাজকন্যা লেখিকা হতে চাই...
আমি লেখিকা হবার স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছি তাই !!!
No comments:
Post a Comment