সম্পাদকের কথা
কাশেরা ফুটতে শুরু করেছে। ভোরবেলায় স্নিগ্ধ আমেজ। ভীষণ তেজের সেই সে সূর্য একটু যেন ম্রিয়মান। মাঠে এখন সবুজের সমাহার। খরস্রোতা নদীরাও ঢিমি গতিতে চলছে নিজের মতো। এমনই এক সময় যখন ঘরে টেঁকে না মন।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকার অনলাইন এই সংখ্যায় লেখক-লেখিকার তুলে ধরেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা। ভ্রমণ বিষয়ক এই সংখ্যা আধিক্যে নয় আদৃত হবে লেখার গুণমানে এই বিশ্বাস রাখি।
লিখেছেন যাঁরা
কুমকুম ঘোষ, নরেশ রায়, বেলা দে, ঈদারুল ইসলাম, কাকলি ভদ্র, সুব্রত কান্তি হোড়,
শর্মিষ্ঠা রায় চৌধুরী, দেবযানী সিনহা, মণিমা মজুমদার, সমতা দাস বিশ্বাস, মাম্পি রায়,
অনিমেষ সরকার, সোমা বোস, রানা চ্যাটার্জী
ছবিতে ভ্রমণ
শৌভিক রায়, শ্যামলী সেনগুপ্ত
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
যোগাযোগ- হসপিটাল রোড , কোচবিহার , ৭৩৬১০১
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি, অলংকরণ, বিন্যাস- শৌভিক রায়
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
ভারতের নানা দিকে: ছবিতে
শৌভিক রায়
হরিদ্বার
চিলিকা , উড়িষ্যা
পন্ডিচেরী
অঞ্জুনা, গোআ
উদয়পুর , রাজস্থান
উদয়পুর, রাজস্থান
কুতুব, দিল্লী
খুঁড়ি , রাজস্থান
মেহেরানগর ফোর্ট, যোধপুর
জয়সলমীর
সিকিম
লোলেগাঁও, কালিম্পঙ
যোধপুর
কেদার
জয়সালমীর
বদ্রি
আগ্রা
জয়পুর
রাজস্থান
কাঞ্চিপুরাম
রাজস্থান
অমৃতসর
তাজ
মানা গ্রাম, বদ্রি
ওয়াঘা
দিল্লী
ঋষিকেশ
দিল্লী
জয়পুর
ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ, চেরাপুঞ্জি
শৌভিক রায়
পা রেখেছি উত্তর দক্ষিণে কেদার-বদ্রি থেকে কন্যাকুমারী, পূর্ব -পশ্চিমে চেরাপুঞ্জি থেকে ওয়াঘা বা ওখা বা খুঁড়ি গ্রামে সীমান্তে। কিছু ছবি এই ভ্রমণ সংখ্যায়। হয়তো আবার কোনোদিন সুযোগ আসবে আবারো কিছু ছবিতে ভ্রমণের।
হুমায়ুন সমাধি, দিল্লী
হরিদ্বার
চিলিকা , উড়িষ্যা
পন্ডিচেরী
অঞ্জুনা, গোআ
উদয়পুর , রাজস্থান
উদয়পুর, রাজস্থান
কুতুব, দিল্লী
খুঁড়ি , রাজস্থান
মেহেরানগর ফোর্ট, যোধপুর
জয়সলমীর
সিকিম
লোলেগাঁও, কালিম্পঙ
যোধপুর
কেদার
জয়সালমীর
বদ্রি
আগ্রা
জয়পুর
রাজস্থান
কাঞ্চিপুরাম
রাজস্থান
অমৃতসর
তাজ
মানা গ্রাম, বদ্রি
ওয়াঘা
দিল্লী
ঋষিকেশ
দিল্লী
জয়পুর
ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ, চেরাপুঞ্জি
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা , ১৪২৫
বাংরিপোসি ও পঞ্চলিঙ্গেশ্বর-------
রোম্যান্টিক প্রকৃতি ও ভক্তির মেলবন্ধন ।।
কুমকুম ঘোষ
(ছবি- লেখিকা)
-- এবার নাগা ট্রিপে(নারী বর্জিত ট্রিপ আর কি!!) বাংরিপোসি যাচ্ছি আমরা ,কর্তা হাসিহাসি মুখে ঘোষণা করলেন।
---ওমা তাই? কবে?(নিরীহ ভাবে প্রশ্ন)
---- ঐ তো রথের দিন, ছুটি , শনিবার পরদিন রবিবার,সোম আর মঙ্গল দুটো ছুটি নেব।(সব ঠিকঠাক করে রেখেছে!!!)
---- থাকবে কোথায়?
-- ঐ তো যে বাড়িতে বুদ্ধদেব গুহ গিয়ে উঠতেন,এটা বুক করা হয়েছে।
---আমি যাবো ওওও( ঝাঁপিয়ে পড়লাম)
---কি করে? একটা গাড়িতে আমরা পাঁচজন যাবো।
-- তাতে কি? আর একটা গাড়ি নাও?(খরচ বাড়লো তো কি? টাকা নিয়ে সগ্গে যাবো?)
আমি যাবোই যাবো(স্ত্রী কে অখুশি রেখে কোন স্বামী সংসারে টিঁকতে পারে?)
অতএব খানিক মান-অভিমান পালা শেষে চলেছি উড়িষ্যা র পথে, চেনা রাস্তা । NH-6 বা বম্বে রোড ধরে সোজা দীঘার দিকে। সকাল ন'টা নাগাদ কোলাঘাটের কাছে শের ই পাঞ্জাব হোটেলে জায়গা না পেয়ে(অসম্ভব ভিড় সেদিন) পাশের হোটেল থেকে আসকে পিঠের মত (মোটা মোটা) পুরি আর ট্যালটেলে জলে ভাসা আলুর তরকারি (অন্য সময় হলে খেতাম না) গলধঃকরণ করে আবার রওয়ানা দিয়েছি।
আগের গাড়িটা প্রথম থেকেই জোড়ে ছুটছিল বাকি চারজন সওয়ারি নিয়ে। আমার কর্তা মশাই সাবধানী ড্রাইভার, হুড়োহুড়ি না-পসন্দ। আমরা পিছিয়ে পড়েছি। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো চিচিড়া মোড়ের পর। রাস্তা ভাঙাচোরা।এগোচ্ছি তবু।কিছুটা যাওয়ার পর দেখি সেটা আর রাস্তা নয় যেন চাঁদের পাহাড়। ভূগোল বইতে চাঁদের পিঠে যে গর্তের ছবি দেখি ঠিক সেই রকম। উপরন্তু বৃষ্টির জলে সেগুলো ছোটখাটো ডোবার মত।আমাদের ছোট্ট গাড়ি দুলছে নৌকার মত।কর্তার মুখ গম্ভীর। মোবাইল টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে না।অন্য গাড়ীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সামনে পেছনে ট্রাকের সারি।সে এক ভয়াবহ অবস্থা। এগোনো ছাড়া উপায় নেই।সঠিক রাস্তায় যাচ্ছি কিনা তাও জানিনা। (ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছিলাম-একথা বলতে দ্বিধা নেই)।
.............................. .............
কিভাবে এরপরের রাস্তাটুকু পার করেছি তা ঈশ্বর জানেন।দুর্গানাম জপ করতে করতে --"মনে হলো পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ, আসিতে তোমার দ্বারে" (সেদিন এতো কাব্য আসেনি মনে)
অবশেষে এ সেই কাঙ্খিত বাহাড়াগোড়া মোড়, যেখানে আমাদের বন্ধুরা ও আশঙ্কা ও চিন্তায় অপেক্ষা করছিল।
এরপর ছুট ছুট--সোজা বাংরিপোসি লজে পৌঁছে গেলাম। রাস্তা থেকে বাড়িটি দেখা যায়না।ঘাস আর বুনো ফুল বেছানো পথ পেরিয়ে ছোট্ট লোহার গেট খুলে ঢুকলাম। আহা! সামনেই কাঠচাঁপা আর বনটগর গাছ। ফুলে ফুলে ঢাকা। সাধারণ বাড়ি।টিনের চাল। কেয়ার টেকার দিদি ঘর খুলে দিলেন।
ডাইনিং প্রসেসটা সুন্দর করে সাজানো, বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাস দুটি দেওয়ালে স্ট্যান্ডে র ওপর রাখা।হাতপাখা, একতারা ও নানান কুটির শিল্পের শো-পিস দিয়ে রুচিশীল এক গৃহসজ্জা।
.............................. .....
পথের ক্লান্তি তখন উধাও।দেশী মুরগীর ঝোল ও ভাত খেয়েছি চলে গেলাম ২০কিমি দূরে "বিশোই" হাট দেখতে। এটা এ অঞ্চলের বড়ো হাট। প্রতি শনিবার বসে।আসেপাশের গ্রাম থেকে আদিবাসী মানুষজন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সওদা করেন। সেদিন তো আবার রথযাত্রা।সকালেই পুরিতে জগন্নাথ দেবের রথটান হয়ে গেছে। বিশোই হাটের কর্মকর্তারা ও একটি বড়সড় রথ সাজাচ্ছেন দেখলাম। পশ্চিমবঙ্গে যেমন বড়ো বড়ো রথটানের সাথে প্রতি বাড়ির ছোট বাচ্ছরাও ছোট্ট ছোট্ট রথ সাজিয়ে টান দেয় সেটা উড়িষ্যার ঐ অঞ্চলে দেখলাম না।
এই অঞ্চলের অবস্থান সিমলিপাল অভয়ারণ্যে র মধ্যে। হাতি চলাচলে করিডরের আছে। রাস্তা সোজা চলে গেছে বম্বে(মুম্বাই) পর্যন্ত।প্রধানত ট্রাক চলাচল করে।
ফিরতি পথে দাঁড়ালাম দুয়ারসিনি দেবির মন্দিরের কাছে। পাহাড়ের গায়ে মন্দির।রোজ পুজো হয়। ট্রাকচালক রা যেতে যেতে দেবী প্রণাম করে পয়সা ছুঁড়ে দেয় দেখলাম।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে র দিকে ঢলে পড়ছে তখন। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মন্দিরের পাশে একটা দোকানে গরম চা' এ গলা ভেজাচ্ছি । হঠাৎ দেখি পাহাড়ের মাথায় একরাশ কালো মেঘ ঠিক শিবের জটার মত আটকে আছে।যোগীবর যেন নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকেই। আহা! বর্ষার বাংরিপোসি যে এমন হৃদয় মেলে চোখের সামনে রূপের দরজা হাট করে খুলে দেবে তাতো আগে ভাবিনি!! রোম্যান্স ও প্রকৃতির এই অনন্য মেলবন্ধন ই হয়ত লেখক বুদ্ধদেব গুহ কে বারবার টেনে এনেছে এই জায়গায় আর আমরা, পাঠককূল পেয়েছি অনবদ্য সব প্রেমের আকুলতা ভরা কাহিনী-মালা।
..... .............................. .....
পরদিন আমাদের গন্তব্য ছিল ডোকরা গ্রাম।বাংরিপোসি থেকে ১৯ কিমি দূরে। হাইওয়ে ছেড়ে গ্রামের ভেতর ঢুকলাম।সারি সারি মাটির বাড়ী। সেখানেই তাদের স্টুডিও(!!), সেখানেই থাকা। দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট।আলাপ হলো শিল্পী যুধিষ্ঠির রানার সঙ্গে। দেশ-বিদেশের সার্টিফিকেট দেখালেন। কিন্তু ভাঙা টালির চাল আর পাঁজর বের করা শীর্ণকায় চেহারা দেখে বোঝা যায় এদেশে কুটির শিল্পের ও শিল্পীর করুণ চেহারা টা। কয়েকটা ডোকরার গণেশ কিনলাম দরদাম না করেই।
বাংরিপোসি উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি গ্রাম ।
বিখ্যাত ছৌ নাচের উৎপত্তি নাকি এই ময়ূরভঞ্জ অঞ্চলেই, এমনটাই দাবি এখানকার মানুষের।একদা দেশীয় রাজ্য ময়ূরভঞ্জ।এখানকার ছৌ নাচে কোন মুখোশ ব্যবহার করা হয়না পুরুলিয়া বা সরাইকেলা ছৌ এর মত।
লাল মাটির মালভূমি অঞ্চল বাংরিপোসি, এখনো শহুরে হাবভাবে অভ্যস্ত নয় ; ধীর স্থির জীবন বয়ে চলে এখানে।ঠাকুরান পাহাড়ের কোলে সবুজ প্রকৃতির মাঝখানে একটুকরো মরকতকুঞ্জ যেন।
.............................. .............
ট্রেনে সহজেই আসা যায়। হাওড়া থেকে ধৌলি এক্সপ্রেস ধরে বালাসোর স্টেশনে নামতে হবে, সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে বাংরিপোসি স্টেশন। কিংবা বাংলা-উড়িষ্যা বর্ডারে জামশোলা হয়েও আসা যায় কিন্তু চিচিড়ামোড় টু বাহাড়াগোড়া কখনোই নয়।(উৎসাহী ভ্রমণার্থীকে সামান্য উপদেশ নিজ অভিজ্ঞতা প্রসূত)। থাকার জায়গা এই বিখ্যাত বাংরিপোসি হোটেল এবং খৈরি রিসর্ট।
এখানে উৎসাহী পাঠকদের জন্য খৈরি রিসর্ট এর নাম সম্বন্ধে একটু তথ্য দিই।আশি'র দশকে সিমলিপাল জঙ্গলের অধিকর্তা ছিলেন সরোজ রায়চৌধুরী মহাশয়। একদিন স্থানীয় খড়িয়া আদিবাসী কিছু মানুষ একটি ছোট্ট বাঘের ছানা কে খুঁজে পায় ও সরোজ বাবু র কাছে নিয়ে আসে। তিনি ব্যাঘ্র শাবকটিকে নিজ সন্তানের মত মানুষ করেন ও জঙ্গলজীবনের সাথে মানুষের যে গভীর ও নিবিড় যোগাযোগ স্থাপিত হতে পারে তার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেন।খৈরি ওনার সাথে থাকত ঘুরতো ঠিক যেমন আপনার আমার বাড়িতে পোষা কুকুর রকি বা টমি থাকে।
.............................. ..........
ঐতিহাসিক বুড়ি বালাম নদী বয়ে চলেছে এই অঞ্চলের পাশ দিয়ে। ইতিহাসের পাতায় বিপ্লবী বাঘা যতীনের নাম ওতঃপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছে এই নদীর সাথে। জঙ্গলের ভেতর বেশ খানিকটা যাবার পর একটা প্রশস্ত উপত্যকা র মত এলাকা।ধানজমি আছে। দূরে পাহাড় শ্রেণী চোখে পরে।নুড়ি পাথর বেছানো পথ মাড়িয়ে একদম নদীর সামনে এলাম। নৌকা চলাচল করে। কিন্তু আমরা ফিরে এলাম কিছুটা সময় কাটিয়ে। নির্জনতা ও নীরবতা চিরে একটা নাম-না-জানা পাখি শিস্ দিচ্ছিল তখন।
.............................. .............
বাংরিপোসিতে দু'রাত্তির যেন নিমেষের মধ্যে কেটে গেল। তৃতীয় দিন ভোর থাকতে বেড়িয়ে পড়লাম--গন্তব্য পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। উড়িষ্যা র স্টেট হাইওয়ে গুলো অত্যন্ত মেইনটেইন করা হয় দেখলাম।মসৃণ পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চারপাশে র ছবি তোলা হলো। সেদিন সোমবার , বারিপদা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে গলা ভেজানো র আশায় লিকার চা অর্ডার দিলাম। অদ্ভুত তার স্বাদ,গলা জ্বলছে অথচ মিষ্টি।চিনি ও গোলমরিচ দেওয়া চা ওই প্রথম এবং শেষবারের মত খেয়েছিলাম। এখান থেকে আমরা চাঁদিপুর(উড়িষ্যার নামকরা স্পট) এর রাস্তা ধরলাম। সোজা ওটিডিসি র রিসর্ট পান্থনিবাসে এসে পৌঁছলাম।ঘর বুক করা ছিলনা কিন্তু জায়গা পেলাম। সুন্দর রিসর্ট টি, নীলগিরি পাহাড়ের গায়েই। আকাশে তখন মেঘের আলপনা আঁকা--ঠিক শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা যেন---বৃষ্টি পরে এখানে বারোমাস.............
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে.................
.............................. ...........
বৃষ্টি নামলো পাহাড় জুড়ে। আমরা চা আর গরম চিকেন পাকোড়া সহযোগে আড্ডা দিলাম সেদিন।
পরদিন ভোর থেকেই রিমঝিম বৃষ্টি। আমরা পাঁচজন (ষষ্ঠজন ঘুমিয়ে ছিল) বেড়িয়ে পড়লাম তীর্থ দর্শনে।
পঞ্চলিঙ্গেশ্বর---শিবের পাঁচটি লিঙ্গ যুগ যুগ ধরে জলের নীচে লুকিয়ে আছে।কথিত আছে বনবাসের সময় সীতাদেবী এখানে শিব পূজা করতেন।রাজা বাণাসুর নাকি স্বয়ম্ভু শিবের আরাধনা করেছেন এখানেই।দ্বাপর যুগে জরাসন্ধের জন্ম নাকি এই স্থানে।তিনিও এখানে শিব পূজা র প্রচলন করেন।
এরপর ফেরার পালা। সেদিন ২১ শে জুলাই। জলেশ্বরের কাছে রাস্তা আটকানো। ঘুরপথে দাঁতন-মোগলমারির(মেদিনীপুর/বৌদ্ ধ স্তূপের খননকাজ চলছে যেখানে) পাশ দিয়ে এলাম। কিন্তু দাঁড়ানোর উপায় নেই।কোলাঘাটে লাঞ্চ সেরে কলকাতা র দিকে খানিকটা এগোনোর পরেই আমাদের অন্য গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট হলো।বন্ধুরা রক্তাক্ত। ফার্স্ট এইড, পুলিশ ও অন্যান্য ঝামেলা কাটিয়ে ভাঙ্গা গাড়ি গ্যারেজে দিয়ে ফিরে এলাম নিজের গৃহকোণে।
যাবার দিনে শনিবারের বারবেলায় পথের মাঝে পরেছিলাম এক বিপদে, মঙ্গলবার এর বিকেলে আর এক পথে প্রাণে বেঁচে ফিরে এলাম। অভিজ্ঞতা র ঝুলি যেন পূর্ণ হলো।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা , ১৪২৫
হঠাৎ বদ্রীনাথ ধামে
বেশ কয়েকদিনের জন্য দিল্লীতে বিশেষ কাজে এসেছি তাড়াতাড়ি কাজ মিটে গেল তবে
চটকরে তো আর বাড়ী ফেরা যাবে না । রাজধানীতে রিটার্ন টিকিট কনফার্ম ।কি করা যায় কি করা যায় ভাবতে ভাবতে দুম করে বিনা প্রস্তুতিতে হরিদ্বারের টিকিট কেটে ফেললাম , হরিদ্বার পর্যন্ত তো আগে যাই পরে ঠিক করা যাবে কোথায় যাবো।
খুব ভোরে পৌঁছে গেলাম হরিদ্বার স্টেশানে ।
এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে দেখি স্টেশনের উল্টোদিকে সরকারি বাস আড্ডা জিজ্ঞেশ করে জানতে পারলাম একটু পরে জোশীমঠের উদ্দেশ্যে একটি বাস রওনা দেবে। অগ্রিম টিকিট চাইতে গেলে কেউ সদুত্তর দিলোনা । দৌড়ে আমার শত্রুভাবাপন্ন পরম বন্ধু আমার একমাত্র সহযাত্রী জীবনসঙ্গিনী কে বাসে নিয়ে এলাম । বাসে বিস্তর অশান্তি করে কোনোমতে একটি সীট জোগাড় করে জয়বাবা ভোলেনাথ বলে রওনা সহযাত্রীরা বলাবলি করছিলো রাস্তায় নাকি সীট ফাঁকা হবে এবং সত্যিই তাই হলো । বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর জানতে পারলাম স্টেশানের আর একটু দূরেই নাকি প্রাইভেট লাক্সারী বাস ভলভোর ছড়াছড়ি জানা না থাকলে যা হয় । হৃশীকেশ হয়ে গাড়ী ক্রমশঃ সুন্দর উত্তরাখন্ডের নয়নাভিরাম দৃশ্যের চলমান চলচ্চিত্র দেখাতে দেখাতে এগিয়ে চললো । যথারীতি বিভিন্ন স্টপেজে যাত্রীবদলের সাথে আমাদের কালচারাল একচেঞ্জ চলছিল আধভাঙা
জোড়াতালি দেওয়া রাষ্ট্রভাষায় । মজার ব্যাপার অনেকে বাংলা বেশ বুঝতে পারে এতো বেশী বেঙ্গলের টুরীস্ট বা অনেকে সামরিক বাহিনীতে কাজ বা বিভিন্নভাবে বাংলার সাথে যুক্ত ।
দুপুর দুটো নাগাদ জোশীমঠ ঢোকার আগেই কন্ডাক্টার একটি বাস থামিয়ে আমাদের দুজনকে বদ্রীনাথধাম গামী বাসে উঠিয়ে দিয়ে খুব উপকার করলো । না হলে আমাদের আজকের রাতটা জোশীমঠেই কাটাতে হ’ত ।
সন্ধ্যা সাড়েসাতটা বা একটু পরে বদ্রীনাথ
ধামে পৌঁছলাম । পৌঁছেই আস্তানা খোঁজার পালা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পুড়ো বাসের লোক ফাঁকা।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন ব’লে একেবারে নাকের ডগায় একটি নতুন হোটেল পেয়ে গেলাম । বাসে বসে ভাবছিলাম প্যাকেজ ট্যুরে না এসে বোধহয় মস্ত ভুল করলাম এই অবসর জীবনে এইরকম সফর খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ । কিন্তু আমার উনি আমার তুলনায় খুব সাহসী মাউন্টেনীয়ারিং এ্যডভান্স কোর্স করা রিপাবলিকান ডে তে রাজধানী তে সিনিয়ার এনসিসিতে সামরিক বাহিনীর সাথে প্যারেড করা
শিক্ষিকা আমাকে সাহসের অক্সিজেন যোগান দেয় সবসময় ।
দূর্গাপুজোর সময় শুধু বাঙালী টুরিষ্ট বেশি ভারতের অন্যপ্রদেশের ভক্তরা বর্ষার আগের সময়টাতেই ভীড় করে বিভিন্ন তিথির সময় ধরে । কাজেই নিরিবিলিতে উত্তরাঞ্চলের হিন্দু তীর্থ বা পর্যটন স্থলে এই সময়টা বেছে নেওয়া ভাল মনে হয় ।
বিনা প্রস্তুতিতে আসা তাই কিছু শীতবস্ত্র কিনতে হ’ল । হোটেল থেকে হাঁটাপথে সামান্যদূরে
বদ্রীনাথ মন্দির দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় । কিছুটা
যেন গুম্ফার রঙে রঞ্জিত সুদৃশ্য নয়নাভিরাম । অফ্ সীজন্ তবুও পূজোর লাইন বেশ লম্বা । মন্দিরের পাদদেশে বয়ে চলেছে পূণ্যতোয়া অলকানন্দা । একটি ঘাটে পূর্বপুরুষগণের উদ্দেশ্যে চলছে পিন্ডদান তর্পণ এখানকার পুরোহিতরা বলেন এখানে একবার পিন্ডদান করলে নাকি আর দেওয়ার দরকার পরেনা । দক্ষিণ ভারত থেকে মন্দির বা আশপাশের পূজারী বংশানুক্রমে চলে আসছে ।
কাছেই ভারতের শেষ গ্রাম মানা গ্রাম । মানা গ্রামের পরেই তীব্বত ভূখণ্ড । খালি চোখেই দেখা যায় । প্রায় বরফে ঢাকা । মানা গ্রাম যাওয়ার আগেই পড়বে সরস্বতী নদী । ব্যসদেবের গুহা এখানেই নাকি গণেশ মহাভারত লেখেন । গুহার মধ্যে গণেশ ও ব্যাসদেবের কল্পিত দৃশ্যটি মুর্তি দিয়ে সাজানো আছে যেন ওরা রচনায় ব্যস্ত । সরস্বতী নাকি এখানেই শাপগ্রস্ত হয়ে অন্তসলিলা হয়েছেন । জলের ভীষণ শব্দে নাকি মহাভারত রচনার কাজে অসুবিধে হচ্ছিল ।
কাছেই ভারতের শেষ গ্রাম মানা গ্রাম । মানা গ্রামের পরেই তীব্বত ভূখণ্ড । খালি চোখেই দেখা যায় । প্রায় বরফে ঢাকা । মানা গ্রাম যাওয়ার আগেই পড়বে সরস্বতী নদী । ব্যসদেবের গুহা এখানেই নাকি গণেশ মহাভারত লেখেন । গুহার মধ্যে গণেশ ও ব্যাসদেবের কল্পিত দৃশ্যটি মুর্তি দিয়ে সাজানো আছে যেন ওরা রচনায় ব্যস্ত । সরস্বতী নাকি এখানেই শাপগ্রস্ত হয়ে অন্তসলিলা হয়েছেন । জলের ভীষণ শব্দে নাকি মহাভারত রচনার কাজে অসুবিধে হচ্ছিল ।
মহাপ্রস্থানের সময় দ্রৌপদীর জন্য বিরাট পাথরের
চাঁই দিয়ে বানানো সরস্বতী নদীর উপর ভীম পুল দেখতে পাওয়া যাবে । কষ্ট করে হলেও এত সুন্দর
পাহাড়ী পথে একটা মজার জিনিস দেখে সবাই একটু না হেসে পারবে না ।
একটি অতি ছোট্ট একচালা ঐ সময় বন্ধই দেখেছি
সাইনবোর্ডে লেখা “ভারত কা সর্বশেষ চায় কা দুকান” । একটু ভুলোও হতে পারে শেষ চায় কা দুকান লেখাটা স্পষ্ট ছিল। ছবিটা বর্তমানে নেই নাহলে পোষ্ট করতাম।
যাইহোক খুব দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিয়ে কোন ভুল করিনি । শারীরিক একটু কষ্ট পরে আর মনে হয়নি
এই বয়সে পেরেছি এবং যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি । এখন প্রচুর হোটেল ধর্মশালা লজিং কোন অসুবিধে নাই । চাই শুধু একটু সাহস কিছু প্রয়োজনীয় অষুধ
আর শীত বস্ত্র ।
অবশ্য এর কয়েক বছর আগে কেদারনাথের ভয়ংকর বন্যার একবছর আগে প্যাকেজট্যুরে চারধাম ঘোরা ছিল ।
বাবা বদ্রীবিশাল ভ্রমণ শেষ এবার আগামীকাল ভোরে বাস ধরব কেদারনাথ ধামের উদ্দেশ্যে ।
জয় বাবা কেদারনাথ ।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা , ১৪২৫
পান করলাম স্থাপত্য সুধা
বেলা দে
( ছবি- লেখিকা )
অসমবয়সী কয়েকজন বেড়িয়ে পড়েছি একসাথে এর মধ্যে দুজন খুদে বিচ্ছু। নিউজলপাইগুড়ি থেকে যাত্রাশুরু রাজধানী এক্সপ্রেসে। যাব জয়পুরের খন্ডস্থান মাউন্টাবু হয়ে জয়সলমীর বহুমুখে 'দিলওয়াড়া জৈনমন্দিরের শৈল্পিক সৌন্দর্য্যকথা শুনে শুনে
একেও ফেলেছি এক কল্পচিত্র, মাউন্ট আবু পৌছাই বিকেল পাঁচটায় সূর্য তখন পশ্চিমদিগন্তে জঙ্গলপাহাড়ের মাথায়, উপরে উঠতে উঠতে ঠাণ্ডা ক্রমশ জাকিয়ে ধরেছে
মূল রাস্তা থেকে হোটেল অনেকটা উঁচুতে আগে
থেকেই অনলাইন বুকিং ছিল রাজস্থান টুরিসম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের' হোটেল শিকার',
খানিক সময় বিশ্রামান্তে ছুটেছি সানসেট পয়েন্টে' সানসেট দেখতে ধৈর্যের চুড়ান্ত অপেক্ষাশেষে দর্শনার্থীদের রাঙিয়ে জঙ্গলচুড়োয় মন্দমন্থরে নামছেন সূর্যদেব উল্লাসিত দর্শকদল চেঁচিয়ে ওঠে ওহ অপূর্ব কেউ মোবাইল বন্দী কেউ ক্যামেরা তাক করে ফেলেছে ততক্ষনে, সবাইকে নিরাশ করে একসময় ডুবে গেল জঙ্গলপর্দার আড়ালে।
একে একে ভিউ পয়েন্ট খালি করে হাঁটা দিলাম যে যার গন্তব্যের দিকে, আমাদের হোটেলটা অরন্যবেষ্টনে জড়ানো, প্রকৃতির খেয়ালিপনায় যত্রতত্র দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশালাকার বৃক্ষরাজি
তার পদতলে অজস্র কাঁটাঝোপ, কনকনে হাওয়া দিচ্ছিল পশ্চাৎপট বেশিক্ষণ দেখা হল না টেনে দিলাম কাঁচ লাগোয়া পর্দাগুলো রাত তখন নটা বাজে, পথশ্রান্ত সবাই চটজলদি ডিনার সেরে
বিছানা নিলাম আমি সহ বাকিরাও।
পরের সকালে সাতজনের শেয়ার করা গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে নীচে, প্রথম সফর 'ব্রহ্মকুমারী' মন্দির শুভ্রবেশধারী সন্ন্যাসী সন্নাসিনীরা মন্দির অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি
দিলে কিছুসময় হলঘরে বসে অন্তঃস্থল জুড়িয়ে গেল পবিত্র প্রশান্তিতে সেখানে গুরু ছাড়া আর কোনো বিগ্রহ নেই ধবধবে সাদা শ্বেতপাথরের মন্দিরটায় অনেক সিঁঁড়ি,দুইধারে সাজানো অজস্র চেনা অচেনা রকমারি নানাবর্ণের ফুল,
মন্দিরের সর্বত্র যেন বিরাজ করছে দৈবসত্বা।
সেখান থেকে বাহনে উঠে এবার রওনা দিলাম দিলওয়াড়া'র মন্দিরের দিকে, মন্দির চত্বরে অজস্র রাজস্থানি বিপননের সম্ভার ইতিপুর্বে ভিতরে প্রবেশ করেছে একদল সেকারণে প্রবেশ মুখবন্ধ। আমরা টিকিট কেটে জুতো খুলে অপেক্ষার সময়টুকুতে কিছু কেনাকাটা করে নিলাম পরিজনের উপহার দেওয়ার জন্য দ্বার খুলেগেল ঢুকছি ভাস্কর্য দেখতে দেখতে মন্দিরের সুক্ষ্ণাতি সুক্ষ্ণ কারুশিল্প এককথায় অনবদ্য সে শিল্পীদের কাছে পেলে একবার নিশ্চয়ই কুর্নিশ করতাম অতিবড় শিল্পী না হলে স্থপতি জীবন্ত করে তোলা সম্ভব হতো না শিল্পশৈলী এতটাই মনোগ্রাহী যে কোনো বেরসিক সত্বাও আত্মমগ্ন হয়ে পড়বে মহাশিল্পীরা কত যত্নে নৈপুণ্যমিশিয়ে সুদৃশ্য করে তুলেছেন নিজের চোখকেই সে মুহূর্তে বিশ্বাস হচ্ছিলো না। চাপের মুখে বেড়িয়ে পড়েছে পা কিন্তু একচুল সরতে চাইছিল না মন সন্ধ্যা হয়ে এলো খুব ভোরেই বেড়বো আবার জয়সলমীর উদ্দেশ্যে ভোর ট্রেনে চেপেছি যখন সূর্যদেব সবে আড়মোড়া ভেঙেছেন পোখরানের ধু ধু মরুপ্রান্তর চোখের সামনে ফিরিয়ে দিচ্ছিল
'নিউক্লিয়ার ' প্র্যাক্টিসের রোমহর্ষক দিনের ইতিহাস ট্রেনে বসেই এসব দর্শনলাভ, জয়সলমীর পৌঁছে বহুপ্রতীক্ষিত সোনার কেল্লা পাশটিতে রেখে নামলাম এক হোটেলে লাঞ্চ সারতে, সেখান থেকেই শেয়ার গাড়িতে আবার চলা শুরু জয়সলমীর থেকে ৪৫ কিমি দুরত্বে
থর মরুভূমির স্যাম বালিয়াড়িতে মুল রাস্তার দুইধারে দৃশ্যমান বাড়িগুলো চৌকাকৃতি জানালার উপরে কোনো শেড নেই বোধকরি অনাবৃষ্টির মরুতে এর প্রয়োজন পরে না। এখানে বালিয়াড়ির রূপ নিয়ত পরিবর্তিত স্যাম বালিয়াড়ির বুকে রয়েছে রাত্রিযাপনের
জন্য টেন্ট বা কটেজের ব্যবস্থা ভেতরটা আধুনিকতায় মোড়া ঘরজুড়ে পুরু কার্পেট খাট , টয়লেট, এয়ারকুলার,খাটেখোদাই
করা প্রত্নস্থাপত্য। বিকেলে ক্যামেল সাফারি হল
সানসেট পয়েন্টে সন্ধ্যেয় বালিয়াড়ি বুকে খোলামেলা মঞ্চের জমজমাট নাচের আসর বিরাট কর্মকান্ড, অনুষ্ঠান চলাকালীন চা পকৌড়া সান্ধ্যকালীন জলযোগ ব্যবস্থা রাতে ডিনারের
আয়োজনে হরেক আইটেম পেটপুরে খাও যে যতটা খুশি রাজস্থানির প্রসিদ্ধ খাবার ডাল বাটি চুর্মা তো অবশ্যই থাকে ভোজনপাতে। দর্শকাসনে উপবিষ্ট ভ্রমণকারীদের নৃত্যশিল্পীরা ডেকে নেয় নৃত্যগীত অংশগ্রহণ ও উৎসাহপ্রদানে জন্যে নৃত্যমঞ্চে।অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষিত হবার পর ডিনার হলে ডিনার সেরে আর দেরী নয় ঢুকে পড়লাম টেন্টের সুসজ্জিত শয্যায়।
পরদিন প্রত্যুষে সানরাইস দেখতে বেড়িয়েছি জীপে ধু ধু বালুকারাশির চড়াই উতরাই চেঁচিয়ে
উঠছে সবাই ড্রাইভার ছোকরা কিন্তু বেশ বীরবিক্রমে গাড়ি চালাচ্ছে মুখে রা টিও নেই।
বালিস্তুপে স্থানীয় গ্রাম্যবালাদের নাচ দেখলাম অতি অল্পেই খুশি ওরা বিশটি টাকা হাতে ধরিয়েদিতেই নাচতে নাচতে চলে গেল বালিঢিপির আড়ালে মরুবাসীদের বিড়ম্বনাময় লড়াই করে বাঁচার করুণ অধ্যায়টুকু সেখানেই
শেষ করে ফিরে আসি টেন্টে। থর মরুকে শেষবারের মত বিদায়
জানিয়ে বিষন্নমনে গাড়িতে উঠলাম দারিদ্রতার মোড়কে আবৃত পর্যটক নির্ভরসর্বস্ব
সহজ সরল মানুষগুলোর সব সমস্যা যন্ত্রনা বুকে নিয়ে আবার জয়সলমীর সোনারকেল্লা অভিমুখে রওনা হলাম
যার জন্য হা পিত্যেসে আছি বহুদিন
ত্রিকুট পাহাড়চুড়োয় কেল্লাটি স্যান্ডস্টোন দিয়ে তৈরী দুর্গের ভিতরে রয়েছে মহারাজা মহল এখন সেটা মিউজিয়াম,কেল্লার প্রশস্ত অন্দরে বর্তমানে গড়ে উঠেছে অজস্র বিপননকেন্দ্র
সরু রাস্তা একেবেকে দুধারে বসেছে হস্তশিল্প সামগ্রী পাগড়ি কাঠের পুতুল চটি ব্যাগ। প্রচুর
কেনাকাটা করলাম এর ফাঁকেই দেখে নিলাম সত্যজিৎ রায়ের 'সোনার কেল্লা' খ্যাতনামা কম্পিত চরিত্র মুকুলের বাড়িটা। যতই দেখছি ভাস্কর্যে বিমুগ্ধ হয়ে পড়ছি।কিন্তু উপায়ও নেই
মেয়াদ শেষ শিল্প রাজ্যের ছান্দিক স্বরলিপি সংগে নিয়ে অজানাকে জানা অদেখাকে দেখার
অভিযান শেষে আবার স্বভূম অভিমুখী।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা , ১৪২৫
ভালোবাসার সওগাত
ঈদারুল ইসলাম
(ছবি- লেখক)
আজমের-এর রাস্তায় ভিক্ষাপ্রার্থীর ভীড় এতটাই বেশি যে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করা মানেই বিপত্তির সূচনা। গোটা আজমেরের অলিগলিতে গজিয়ে উঠেছে ভিক্ষাজীবীর দৌরাত্ম্য । হাজারো ভিক্ষুকের আনাগোনা লেগেই রয়েছে, তার উপরে একেকটি গ্রুপের আবার একজন করে সর্দার । অত রাত্রে হোটেল পৌঁছে এ.টি.এম থেকে আর টাকা তোলা সম্ভব হয়নি । সকালে উঠেই আগে টাকা টা তুলতেই পিছু নিল একটি ভিক্ষুকের দল। পকেটে খুচরো টাকা খুব একটা ছিল না। হাতে একটা ১০ টাকার নোট দেখেই শুরু হল - "ইস গরিব কো কুছ দে দো বাবা, জোড়ি সালামত রহে ,আল্লাহ তুঝে চান্দ জ্যায়সা বেটা দেঁ..তেরে হাত মে যো হ্যায় ওহি দে দে, বেটা ! " আমি বিরক্ত হয়ে ওই টাকা টা একজনের হাতে দিতেই বিপত্তির সূচনা। সবাই মিলেই আমায় ঘিরে ফেলে টাকা চাইতে শুরু করে, আমার স্ত্রী একটু দূরেই রয়েছে । আমি উত্যক্ত হয়ে গিয়ে একজনের দিকে একটু গম্ভীর মুখে তাকাতেই সেই পাগলা টাইপের ভিখারি টি রাস্তায় থুঃথুঃ করতে লাগল। কোনও মতে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে খাবারের অর্ডার দিতে গিয়ে হঠাৎই মনে হল, 'দেখি কোথাও খুচরো টাকা পাওয়া যায় কী না ?' অনেক কষ্টে একটু খুচরো ম্যানেজ করে সেই ভিখারির খোঁজে তল্লাশি শুরু করলাম। এক চক্কর মেরেও তাঁর দেখা না পেয়ে মনটা একটু খারাপ ই হল ! আরও একবার খুঁজতেই দেখি যে , সে একটা বাইকে হেলান দিয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাঁর কাছে ছুটে গেলাম। হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়েই বললাম -"অ্যায়সে কিউ করতে হো ? কিসিপে থুকনা মত। হর বক্ত কিসিকে পাস প্যায়সে নেহি রহতে হ্যায় !"
এবারে সারাটা দিন আজমেরের অলিগলিতে ঘুরে পকেটে হাত দিয়ে যেটাই আসে দিতে দিতে হয়রান হয়েই আনা সাগরে পৌঁছতেই আবারও একই অবস্থা ! ভিক্ষুক গুলো কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না ! এবারে পরিস্থিতি সামাল দিতে অভিনব কায়দা নিলাম। অনেক হিন্দি হয়েছে আর নয়, এবারে একটু বাংলা হয়ে যাক। আমি উল্টে ওঁদের কেই বলতে লাগলাম- "আমায় দুটো টাকা দেবে, কই দাও ? ওই যে তোমার হাতে অনেক খাবার রয়েছে, আমায় খেতে দেবে ?" এতেই কাজ হয়ে গেল ! ওরা বলতে শুরু করল- ''কেয়া বলতে হো, কুছ সমঝমে নেহি আতা হ্যায় ?" যাক বাবা একটু বাঁচা গেল। নিমেষেই সবাই উধাও। একটু স্বস্তি পেলাম।
রাস্তায় দু'জনাতে হাঁটছি এমন সময় অকস্মাৎ একটি করুণ আওয়াজ কানে ভেসে এল ! আমি একটু বিস্মিত হলাম ! কে যেন আমার হাত ধরে টানছে আর বলছে " ইয়ে ধাগা আপনে গলে মে বান্ধ লেনা !" পিছু ফিরে তাকাতেই নজরে এল মৃত্তিকালিপ্ত জীর্ণ পোষাকের একটি বছর পাঁচ-ছয়েকের ফুটফুটে মেয়ে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে । কী মায়াবী আওয়াজ আর সম্মোহক দৃষ্টি ! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েই কিছুক্ষণের জন্য ওর পানে চেয়ে থেকে বললাম- "বেটা মেরে পাস তো পহেলে সে হী এক ধাগা হ্যায় !" শিশুটি প্রায় কাঁদো কাঁদো সুরেই বলে ওঠে- " ঠিক হ্যায়, কোই বাত নেহি !" আমি ওর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতেই লক্ষ্য করলাম যে , সে খুশি নয় ! একবার এই হাত তো পরক্ষণেই অন্য হাতের দিকে তাকিয়ে সে অশ্রুসিক্ত নয়নে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে চেয়ে রইল ! আমি উপলব্ধি করলাম যে, সে নিতে নয় দিতেই এসেছে । এই ভালোবাসার 'সওগাত' কী উপেক্ষা করা যায় ! এ সাধ্যি আমার যে নেই ! আমি শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম- "ঠিক হ্যায় বেটা, দে দো । হাম আপনে পাস রাখ লেঙ্গে ।" শিশুটি যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একটু মৃদু স্বরে বলে উঠল- " ঠিক হ্যায় !" আমি ওর হাত থেকে ধাগা টি নিয়ে আরও একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রস্থান করলাম আর সে মৃদু হাসি মুখে চেয়ে রইল।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
একদিন ... ইছামতীর ডাকে!!!
কাকলি ভদ্র
(ছবি- লেখিকা )
কলকাতা গেলে প্রতিবার চেষ্টা করি আশেপাশের কোথাও ছুঁয়ে দেখার।এবারে আমাদের গন্তব্য ছিল ঐতিহ্যমণ্ডিত হেরিটেজ টাউন "টাকি"।দমদম হয়ে সায়েন্স সিটি থেকে বাসন্তী হাইওয়ে ধরে বানতলা ছাড়িয়ে মালঞ্চ...মালঞ্চ পেরিয়ে বাঁদিক ধরে পেরোলাম নাম না জানা আরেকটা নদীর সেতু। খানিকটা চলার পর অবশেষে এল সেই মোড়। বাঁদিকে বসিরহাট। ডানদিকে হাসনাবাদ। সোজা গেলে টাকি।ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের এই ছোট্খাটো আধা শহরটি ইছামতী নদীর তীর ধরে গড়ে উঠেছে। ১৯৪৭ সালের পরে দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে অনেকেই ও পার বাংলা থেকে চলে এসেছিলেন এ পারে। টাকি-হাসনাবাদ-বসিরহাটে নতুন করে সংসার পাতেন তাঁদের অনেকেই।এপারে টাকি, ওপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা। মাঝখানে তিরতির করে বয়ে চলা নদী ইছামতী আর কাঁটাতারের বেড়া!আমার কাছে ইছামতী মানে বিভূতিভূষণের ইছামতী! বিভূতিভূষণের "অপরাজিত" র শেষ পর্যায়ে ইছামতীর ধারে দাঁড়িয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নায়ক অপুর জন্ম, মৃত্যু, সুখ-দুঃখের মালায় গাঁথা জীবনদর্শন...
আর আজ আমার চোখের সামনে উপন্যাসের সেই ইছামতী!!!নৌকো ভেসে বেড়ায় জলের ওপর দিয়ে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কিছুটা অবিন্যস্ত, কিছুটা আনমনা। ওপারের নৌকোর এক রঙ, এপারের আরেক রঙ। দুর্গাপুজোর দশমীতে বহু মানুষ জড়ো হয় দু'পারের বিসর্জনে সামিল হতে। ওপারের নৌকো বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে প্রতিমা আনে নদীতে। এপারের নৌকো ভারতের পতাকা লাগিয়ে দুর্গা ভাসান যজ্ঞে মেতে ওঠে। সেদিন যেন দু'পারের কাঁটাতারের বেড়া এই ইছামতীকে কেন্দ্র করে অদৃশ্য হয় আপাতভাবে। লাগামছাড়া আনন্দে দু'পারের বাঙালীরা বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করে। পাসপোর্ট-ভিসাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মা দুর্গা যেন নিজেই আইন অমান্য কর্মসূচীর বার্তা দেন।ইতিহাস আর পুরাণের যুগলবন্দী এই টাকিতে রয়েছে আরও কিছু দর্শনীয় স্থান।এগুলির মধ্যে রয়েছে প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো টাকি গভর্নমেন্ট হাই স্কুল , ৩০০ বছরের পুরনো কুলেশ্বরী কালী মন্দির , টলটলে পুকুরের গায়ে জোড়া শিবমন্দির,মাছরাঙা দ্বীপ, রামকৃষ্ণ মিশন। আছে সেনাধ্যক্ষ শঙ্কর রায়চৌধুরীদের বাড়ি, নাটমন্দির, দোলমঞ্চ।সেখান থেকে একটু দূরেই "জিরো পয়েন্টে" বিএসএফ জওয়ানদের কাছে সচিত্র পরিচয়পত্র গচ্ছিত রেখে দেখে আসা যায় মিনি সুন্দরবন। টাকি মিউনিসিপ্যালিটি উদ্যোগে জালালপুর গ্রামে ৪০ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই মিনি সুন্দরবন। সুন্দরী, কেওড়া, হোগলা, কাঁকড়া, বাইন, গোল, গেঁও, হরকচা, হেতাল গাছের সারি সেখানে।অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতোই এই মিনি সুন্দরবন।টাকির রাজবাড়ির দুর্গাদালানটিও দেখার মতো। ছোট ছোট গোলাকার ইঁটের তৈরি দালান। তবে ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল ইছামতীর তীরে টাকি রাজবাড়িটি দেখে।ইছামতীর পাড় ঘেঁসেই সে রাজপ্রাসাদ।এখন সেই রাজবাড়ির অলিন্দ বেয়ে নেমেছে বটের ঝুরি।রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণদাস রায়চৌধুরী।মুঘল আমলেও এঁরা রাজত্ব করেছেন।আর ব্রিটিশ যুগেও ছিলেন দাপটের সঙ্গে।রাজবাড়ীর ভগ্নদশা দেখে মন ভারাক্রান্ত।এবারে ফেরার পালা।বিদায় বেলায় ইছামতীর কোল ঘেঁষে ওর গন্ধ নিই। ঠিক যেন দিম্মার গায়ের গন্ধ।সাময়িক নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হলাম।সম্বিত ফিরলো মেয়ে তিতিরের ডাকে।ফিরতে হবে এখন। বসিরহাটের গামছা,টাকির বিখ্যাত পাটালি গুড় আর মনের অলিন্দে ইছামতীর অক্সিজেন পুরে নিয়ে রওনা দিলাম কলকাতার পথে...
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা , ১৪২৫
মনের খাতায়
সুব্রত কান্তি হোড়
(ছবি - লেখক )
একঘেয়েমি জীবন চায় মুক্তি, অনাবিল আনন্দে ভেসে যেতে। উন্মনা মন খুঁজে বেড়ায় বৈচিত্র্য। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে তার স্বাদ পাওয়ার নেশায় মত্ত মনের সামনে কোন বাধাই এসে দাঁড়াতে পারে না।মনের পূর্ণতা মুক্তির আনন্দ উপভোগ করে।
এই উপভোগের নেশাতে কবে থেকে যে পাহাড়-অরণ্য-নদীকে ভালবেসেছিলাম তা মস্তিষ্কের ডাস্টবিনে চলে গেছে। আমার সাথে সাথে আমার পরিবার ও সন্তানও এদের সঙ্গে সখ্যতা পাতিয়ে ফেলেছে। সেই রেশ ধরেই আমি ও আমার বন্ধু দুই পরিবার সন্তানদের হাত ধরে ট্রেনে চেপে বসলাম। গন্তব্য হরিদ্বার।
দিল্লি হয়ে হরিদ্বার যাওয়ার পথে ট্রেন বিভ্রাটের দরুণ বাসে যেতে হল। ফলস্বরূপ রাত ১০টায় হরিদ্বারের পুণ্যভূমি স্পর্শ করা। পরদিন বাসে করে রুদ্রপ্রয়াগ হয়ে উখীমঠ। দূর থেকে ভারত সেবাশ্রম সংঘের আশ্রম দেখে দলের ক্ষুধে সদস্য দুটি চীৎকার করে বলে —দ্যাখো দ্যাখো কি সুন্দর ঝুলনবাড়ি। মুচকি হেসে বললাম - হুম্।
যখন আশ্রমের সামনে নেমে মহারাজের সাথে কথা বলছি ক্ষুধে দুটো অবাক হয়ে গেছে। বলল সত্যিই এই ঝুলনবাড়িতে থাকব আমরা। থাকার সব ব্যবস্থা করে দিলেন মহারাজ। আমাদের মদমহেশ্বর যাওয়ার পরিকল্পনা জেনে তারও ব্যবস্থা করে দিলেন।
পরেরদিন শুরু হল হাঁটা। মদমহেশ্বর-বুড়ো মদমহেশ্বর যাতায়াতের পথে হিমালয়ের সৌন্দর্য্য উপভোগ করে, অরণ্যের নিস্তব্ধতায় অরণ্যচারীদের কথোপকথন শুনে, গ্রামীণ পাহাড়ি জীবনের স্পর্শে মনের সকল গ্লানি ধুয়ে পাঁচদিন পরে বিকেল ৩টেয় আশ্রমে ফিরলাম। আমাদের খাওয়া হয়নি শুনে মহারাজ আমাদের বললেন —হাত মুখ ধুয়ে আসুন। খেয়ে নিন। তারপরে গরম জলে স্নান করে নেবেন। না না আপনারা আগে খেয়ে নিন বলাতে মহারাজ বললেন—সেটা হয় না। একজন অথিতিকেও অভুক্ত রেখে আমরা খেতে পারি না।
সন্ধ্যাবেলায় আশ্রমের পূজার ঘরে মহারাজের সন্ধ্যারতি দর্শনে শরীরের ক্লান্তিও দূর হয়ে গেল।
মহারাজ ও আশ্রমের সেবকদের অতুলনীয় আতিথেয়তায় আমাদের মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল। পরের দিনই হরিদ্বারে ফিরে আসার পরিকল্পনা ছিল। ফেরার ট্রেন দু'দিন পরে শুনে আশ্রমের এক স্বেচ্ছাসেবী বললেন আর একদিন এখানেই থেকে যান। মনস্থির করলাম দুই বন্ধু কাল সারাদিন চোপতা থেকে হিমালয়ের রূপ দেখব। কিন্তু বাসের টাইম জানি না। অগত্যা মহারাজ আবার ত্রাতারূপে একটা অটো ঠিক করে দিলেন।
চোপতার ঘন জঙ্গলের বুনো গন্ধে ফুসফুস যখন আকৃষ্ট, পাইনের শীতল বাতাসে ত্বক আরাম উপভোগ করছে ঠিক সেই সময়ে জঙ্গলে শিঙ্গার প্রচন্ড ধ্বনি। কিন্তু অরণ্যবাসীরা কেউ বিচলিত নয়। আমাদের চালকদাদা বললেন বাবা তুঙ্গনাথ থেকে নামছেন। দেখবেন নাকি।
বাতাসে ভেসে আসা শব্দকে লক্ষ্য করে চালক এই রাস্তা ওই রাস্তা করতে করতে
একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেখি সেখানে এক ধোপদুরস্ত অবাঙালী পরিবার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সামনের পাহাড়ের ঢালের দিকে ১১ জোড়া চোখ। শিঙ্গার আওয়াজ, ডুম ডুম শব্দ, মাঝে মাঝে মনুষ্যকন্ঠের জয়ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। একবার মনে হচ্ছে ডানদিকে আর একবার মনে হচ্ছে পিছনে —আমরাও তখন দিশা খুঁজে পাচ্ছি না। উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি, সুরধ্বনি ক্রমশঃ অস্পষ্ট হতে হতে সুপারসনিক পর্যায়ে। নিজেরাই বলাবলি করছি সব পাপী মন। আর কি হবে চল এগোনোর যাক। অবাঙালী পরিবারটিও গাড়িতে উঠে বসেছে।
বাতাসে ভেসে আসা শব্দকে লক্ষ্য করে চালক এই রাস্তা ওই রাস্তা করতে করতে
একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেখি সেখানে এক ধোপদুরস্ত অবাঙালী পরিবার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সামনের পাহাড়ের ঢালের দিকে ১১ জোড়া চোখ। শিঙ্গার আওয়াজ, ডুম ডুম শব্দ, মাঝে মাঝে মনুষ্যকন্ঠের জয়ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। একবার মনে হচ্ছে ডানদিকে আর একবার মনে হচ্ছে পিছনে —আমরাও তখন দিশা খুঁজে পাচ্ছি না। উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি, সুরধ্বনি ক্রমশঃ অস্পষ্ট হতে হতে সুপারসনিক পর্যায়ে। নিজেরাই বলাবলি করছি সব পাপী মন। আর কি হবে চল এগোনোর যাক। অবাঙালী পরিবারটিও গাড়িতে উঠে বসেছে।
আমাদের ক্ষুধে দুটো একটু এগিয়ে গেছে হাঁটতে হাঁটতে। আমরাও তাই কদম বাড়িয়েছি। দেখি ওরা সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর পাহাড়ের ঢালের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করছে। আবার ক্ষীণ শব্দের আওয়াজ ভেসে আসছে।দেখি সংকীর্ণস্য সংকীর্ণ পথ দিয়ে একটা ছোট্ট বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নেমে আসছে। ডুলিতে চড়ে বাবা তুঙ্গনাথ শীতকালীন আবাসে আসছেন। ভাবছি পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে শব্দের মায়াজালে প্রকৃতির এ কি রূপ!
বড় রাস্তায় নেমে আমাদের সামনে শোভাযাত্রা দাঁড়িয়ে পড়েছে। বাদ্যযন্ত্রের সুরে সবার সাথে আমরাও জয় ধ্বনি করছি। হঠাৎ প্রধান পুরোহিত আমার পরিবারের হাতে একটা মোটা মালা ধরিয়ে দিলেন। আমরা তো হতভম্ব।আমাদের ঘিরে শোভাযাত্রার দল নাচছে,গাইছে। পিছন থেকে ওই অবাঙালী কর্তা আমার স্ত্রীর হাত থেকে ছোঁ মেরে মালাটা তুলে নিয়ে একগোছা টাকা ডুলিতে রেখে দিলেন। শোভাযাত্রার দলটি আমাদের থেকে সরে ওই অবাঙালী পরিবারকে ঘিরে ধরল। ডুলিও আস্তে আস্তে নীচের পথ ধরে এগোতে থাকল। আর অবাঙালী পরিবারটিও গাড়ি নিয়ে হুস করে চলে গেল।
আমরাও ফিরে এলাম গাড়িতে। চালকদাদা সবই দেখেছেন। বললেন ওই অবাঙালী ভদ্রলোকের বিরাট ব্যাবসা। রুদ্রপ্রয়াগ আর হরিদ্বারে বিরাট বাড়ি। ওই মালা ঘরে থাকলে শুভ। তাই অনেকেই অর্থ ব্যয় করেন এটি পাওয়ার জন্য। তবে আপনি যদি জোর করতেন তাহলে উনি নিতে পারতেন না। আমার স্ত্রী বলে- ঠিক আছে। উনি অনেক আশা নিয়ে এসেছিলেন, না পেলে নিরাশ হতেন। হয়তো আমাদের ক্ষতি হত ওঁনার হতাশার দীর্ঘশ্বাসে। আমাদের কোনো আশাও ছিল না, নিরাশ হওয়ারও তাই প্রশ্ন নেই। স্পর্শ পেয়েছি, ওটাই বাবার আশীর্ব্বাদ।আর আমি ভাবছিলাম ঈশ্বরও কি অর্থের বশ!
চালকদাদা বললেন কাল থেকে উখীমঠে মেলা বসবে। কিন্তু এবারে আর হবে না। আগামীকাল সকালে বেরিয়ে যাব। সারাটাদিন চোপতায় বসে পাহাড়ের রূপ দেখে, ওখানের জীবনযাত্রা দেখে ফিরে আসলাম। আবার আসিব ফিরে এই পাহাড়ের কোলে।এই বলে এবারের মত বিদায় নিলাম।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা , ১৪২৫
সিলেরি গাঁও
শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী
(ছবি- লেখিকা)
প্রতিবছর গরমের ছুটিতে কম-বেশি ঘুরতে যাই ।এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি ।কোলকাতা থেকে আমার বোনের পরিবার,ভাই'এর পরিবার আর আমার পরিবারের সবাই মিলে এ বছর ২৭শে মে কোচবিহার থেকে একটা ভাড়ার গাড়ি চেপে রওনা হলাম শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে ।আমাদের এবারের গন্তব্য সিলেরি গাঁও ।সেইমত"সিলেরি গাঁও রিট্রিট" নামে একটা হোমস্টে আগে থেকে বুক করা ছিল ।হোমস্টে'র দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার কোলকাতার অভিজিত সেন একটা গাড়ি পাঠান আমাদের জন্য ।শিলিগুড়ি থেকে হোমস্টে'র পাঠানো গাড়িতে রওনা হলাম ।গাড়িচালক মানুষটি বেশ মজাদার তা তার কথাবার্তায় টের পেলাম ।সেবক ছাড়িয়ে কিছুদূর যেতে গাড়িটা একটা হোটেলের কাছে দাড়ালে সবাই নেমে পড়লাম ।মনটা চা-চা করছিল ,তাই মোমো সহযোগে গরম চা-এ গলা ভিঁজিয়ে এগিয়ে চললাম পাহাড়ি পথে ।
কালিম্পং-এর দশ কিলোমিটার দূরত্বে এই সিলেরি গাঁও ।কালিম্পং থেকে গাড়িতে চৌত্রিশ কিমি.পেরিয়ে এই গ্রাম,পথে আলগারা ।এই অবধি পিচরাস্তা ।এরপর পাথুরে এবড়ো-খেবড়ো পথ ধরে আধঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিট পর গাড়ি পৌছালো সিলেরি গাঁও ।পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কালিম্পং জেলার অন্তর্গত ৬০০০ফিট উচ্চতায় অবস্থিত সিলেরি গাঁও একটি ছোট্ট সুন্দর আদিম গ্রাম যা'কিনা উঁচু উঁচু পাইন গাছের সারি দিয়ে ঘেরা ।সিলেরি নামের চারাগাছ বা ঘাস জাতীয় একধরনের গাছ হিমালয়ের এই অঞ্চলে প্রচুর বৃদ্ধি হত,তা থেকেই এই গ্রামের নাম ।এলাকায় একটি শিঙ্কোনা বাগান আছে যা কুইনাইনের উৎস হিসাবে সাবেক বৃটিশ শাসকরা প্রবর্তন করেন ।
আমরা গিয়ে পৌছাতেই ম্যানেজার অভিজিত সেন স্বাগত জানালেন । আমরা তখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে পাহাড়ি গ্রামটার শোভা দেখছিলাম ।আমাদের জন্য বরাদ্দ ঘরগুলো খুলে দিলে আমরা মালপত্র নি়য়ে যে যার ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চলে এলাম খাবার ঘরে ।ডিমের কারি,ডাল,আলুভাজা,বাঁধাকপি দিয়ে দুপুরের ভোজন সেরে পায়ে হাঁটা পথে ঘুরে দেখলাম গ্রামের আশেপাশের অঞ্চল ।ছোট্ট গ্রামটিতে জনসংখ্যা খুবই কম ।আনুমানিক ২৫-৩০ পরিবারের বাস এখানে ।প্রতিটি বাড়িতেই হোমস্টে'র ব্যাবস্থা রয়েছে ।এখানকার বাসিন্দারা ভীষনই বন্ধুত্ব পরায়ন এবং সবসময় হাসিমুখে অতিথিদের আতিথেয়তার জন্য প্রস্তুত ।বলাবাহুল্য আমাদের হোমস্টে'র বসিন্দারা তার ব্যাতিক্রম নয় ।গ্রামটি মূলতঃ কৃষি নির্ভর,এদের পেশা কৃষি কাজ হলেও গ্রামের মানুষেরা পাশাপাশি পর্যটনকে তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অঙ্গ হিসাবে বেছে নিয়েছেন ।কয়েকবছর ধরে পর্যটকদের কাছে গ্রামটি হটস্পট হিসাবে জনপ্রিয় হয়েছে ।ফিরে এসে সান্ধ্যকালীন চা - পাকোড়া এবং চিকেন ও অন্যান্য পদে রাতের আহার সেরে সে রাতের মত ইতি টানলাম ।
পরদিন সকালে চা খেয়ে গেলাম মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরত্বে থাকা রেমিতি ভিউ পয়েন্টে ।এই পথে গাড়ি চলে না ,এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ি পথে পায়ে হেঁটে যেতে হয় ।পাথুরে পথের চড়াই-উৎরাই সামলে এগিয়ে চললাম ।পাহাড়ি পথে তিন কিমি.অনেকটাই ।মাঝে-মধ্যে জিড়িয়ে নিচ্ছিলাম,হাটার অভ্যেস না থাকায় ।নির্জন পথে দু'পাশের ঘন জঙ্গলকে পেছনে ফেলে এপিয়ে চলা ।চলার পথে মেঘেদের জটলা এত বেশি যে দুরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না ।উঁচু উঁচু পাইনের সারি,পাথরের গায়ে শ্যাওলা আর প্রাচীন ফার্নের বাস ।পথের নির্জনতাকে সাথি করে নানা প্রজাতির পাখির ডাক শুনতে শুনতে প্রায় দেড় ঘন্টা পর পৌছালাম রেমিতি ভিউ পয়েন্টে ।বেশ সমতল কিছুটা জায়গা নিয়ে ভিউ পয়েন্ট ।মেঘমুক্ত পরিস্কার আকাশে এখান থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ অন্যান্য শৃঙ্গগুলি দেখা যায় ।আমরা যে সময় গেছি প্রায় বর্ষাকালই বলা চলে,তাই সে যাত্রায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান হল'না ।দু-তিনটে উঁচু পাথরের চাই ।দূরে তিস্তা নদী মিশেছে রিশি নামের আরেকটি নদীর সাথে ।যতদূর চোখ যায় দেখা যায় তিস্তার আঁকাবাঁকা নদীপথ ।প্রত্যেকেই নিজেদের মুঠোফোনে বন্দি করলাম মুহূর্তগুলি ।ফিরে এলাম হোমস্টে'তে ।সেখানে প্রাতঃরাশ সেরে হোমস্টে'র গাড়িতে চেপে গেলাম রামধুরা ।কালিম্পং থেকে ১৫ কিমি.দূরত্বে রামধুরার নামকরন হয়েছে রামায়নের রাম এবং ধুরা অর্থ গ্রাম থেকে ।অপূর্ব শোভা এই ছোট্ট গ্রামটির ।এখানেও স্থানীয় বাসিন্দাদের হোমস্টে আছে ।এরপর গেলাম জলসা ভিউ পয়েন্ট ।দু'পাশে শিঙ্কোনা আর পাইন গাছের জঙ্গল ।বৃটিশদের তৈরি জলসা বাংলো এখানকার দ্রষ্টব্য স্থান ।
সিলেরি গাঁও থেকে ৪ কিমি. ট্রেক করে গেলে ডামসাং দুর্গ ।১৬৯০সালে লেপচাদের দ্বারা নির্মিত ।লেপচা ও ভূটিয়াদের মধ্যে জাতিগত হিংসার কারণে তৈরি এটি ।দুর্গ নির্মানের আরেকটি কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা আগ্রাসন বন্ধ করা ।দুর্গ থেকে উপরের দিকে অবস্থিত হনুমান শীর্ষ ।যেখানে প্রভু হনুমান'জীর ভাস্কর্য স্থাপিত আছে ।এরপর গেলাম ৫৮০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত ইচ্ছে গাঁও ।সুন্দর সাজানো একটি ছোট্ট গ্রাম,এখানেও বেশকয়েকটি হোমস্টে রয়েছে ।এখান থেকে পাহাড়ি পথে ট্রেক করে পৌছে যাওয়া যায় সিলেরি গাঁও ।যদিও সে পথের যাত্রী নই আমরা ।তাই ফেরার পথে পেডং মনাস্ট্রি আর বাজার ঘুরে ফিরে এলাম হোমস্টে'তে ।যথা- যথা সময়ে দুপুর,সন্ধ্যে ও রাতের খাবার শেষে নিদ্রা গেলাম সে রাতের মত ।
বর্ষাকাল ছাড়া যে কোন সময় আসা যায় এখানকার শান্ত শীতল আবহাওয়া চেখে দেখবার লোভে ।এক ব্যতিক্রমী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা এবং শহুরে ব্যস্ত জীবনের কোলাহলমুক্ত হয়ে কিছুসময় শান্তিপূর্ণভাবে কাটানোর আদর্শ স্থান সিলেরি গাঁও ।হোমস্টে'র ব্যাবসা এখানকার মানুষের বিকল্প উপার্জনের উৎস ।পর্যটকেরা এদের কাছে আদরের অতিথি ।হোটেলের বিলাসীতা পাওয়া না গেলেও ক্ষুদার্থ ভ্রমণপিপাসুদের কাছে ঘরোয়া আরামের আবেশের জন্য আদর্শ । রাতশেষে সকালের আবির্ভাব ।চা -জলখাবার সেরে হোমস্টে আর সিলেরি গাঁও এর মায়া কাটিয়ে রওনা হলাম পাহাড় ছেড়ে সমতলের পথে । ঘরে ফেরার পালা,ফেরার পালা নিত্যকার যাপনে ।অভিজিত সেন এবং হোমস্টে'র বসিন্দাদের মিষ্টি আতিথেয়তায় আমরা আপ্লূত । পাহাড়ি পথ ,পাইনের সারি,শিঙ্কোনার জঙ্গল,তিস্তা নদী একে একে সবটুকু পেছনে ফেলে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল সমতলের দিকে ।গাড়িতে গান বাজছিল,হঠাৎ বেজে উঠলো " চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা ,কাভি আলবিদা না কহেনা " ।গাড়ি এগিয়ে চলল ।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
পাহাড়ের গাঁয়ে
দেবযানী সিনহা
(ছবি- লেখিকা)
ছোটোবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার প্রতি একটা আলাদা রকমের ভালোলাগা ছিলো যা এখনো আছে। যখনই অন্য কোনো লেখকের বই হাতে এসেছে তখনই মনে হয়েছে আগে রবিঠাকুরের সব লেখনী পড়বো তারপর অন্যদের কিন্তু সমুদ্রপ্রমান লেখনীর মধ্যে এখনো অনেকটাই বাকি,কেউ একজন আমাকে বলেছিলো একজীবনে রবিঠাকুরের লেখনী পড়া সম্ভব নয়। তবে আজও রোজকার নিয়ম মাফিক পড়ার মধ্যে নিত্যদিনই কয়েকলাইন হলেও পড়া চাই, রবিঠাকুরের যেকোনো লেখনী।
ঠিক সেরকম ভাবেই যখনই আমার শহরের বাইরে বা আমার জেলা কিংবা রাজ্যের বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা হলে প্রথমেই মনে হয় আমার শহরকে আগে ভালোভাবে ঘুরেফিরে চিনে দেখি তারপর তো অন্যকোথাও।
সত্যিকথা বলতেকি আমার শহরের উত্তর দিকের উঠোন জুড়ে শুধুই পাহাড় আর পাহাড়।
রোজ সকালে পূর্বদিকে সূর্য দেখা আর উত্তরে পাহাড় দেখা দুটোই একটা কয়েনের দুদিক।
যখনই পাহাড়ে মন ছুটে চলে তখনই আর একমুহূর্তেরও অবসর নয়।
এবছরই জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিবারের সবাই মিলে যখন ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়,
তখনই একটা নামই মাথায় আসে সবুজের চাদরে মোড়ানো জয়ন্তী পাহাড়।
আমাদের এবারের গন্তব্য স্থল বক্সাফোর্ট লেপচাখাঁ।
আমাদের যাওয়ার দিনটা ছিলো বৃহস্পতিবার।
আগের দিন বিকালে অর্থাৎ বুধবার দমনপুর হাটে গিয়ে প্রকাশদার সাথে কথা বলে এলাম। বক্সা ফোর্টের কাছে যে সদরবাজার আছে প্রকাশদার সেখানেই বাড়ি,আর টুরিস্টদের জন্য ওনার হোমস্টে আছে।আমরা একদিনের জন্য সেটাই বুক করে নিলাম।আর লেপচাখায় থাকার ব্যবস্তাও উনি করে দিলেন।
ওই পাহাড়িয়া পথ ধরে প্রতি বুধবার আলিপুরদুয়ার শহরের লাগোয়া দমনপুর হাটে প্রকাশদা এবং প্রকাশদার মতো ওই পাহাড়ের অনেকেই সপ্তাহের কেনাকাটা করতে আসে।
যেহেতু অনেকবারই গিয়েছি, প্রকাশ দা আমাদের পূর্ব পরিচিত।
বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা নাগাদ আলিপুরদুয়ার থেকে জয়ন্তীগামী উত্তরবঙ্গ পরিবহনের বাসে আমাদের ১৫জনের দলের এবারের যাত্রা শুরু হল।৷ আলিপরদুয়ার থেকে সান্তালাবাড়ির দূরত্ব প্রায় ৩০ কিমি। তারপর সেখান থেকে বক্সাফোর্টের দূরত্ব প্রায় ৪কিমি আর বক্সাফোর্ট থেকে লেপচাখাঁর দূরত্ব প্রায় তিন কিমি।
এক ঘন্টার মধ্যে ঘন জংগলের পিচঢালা রাস্তার দুপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ি গাঁ সান্তালাবাড়ি।এরপর এখান থেকেই শুরু পায়ে পায়ে হেটে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার পাহাড় পাহাড় অনুভূতি। তবে এখন সান্তালাবাড়ির পর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত কয়েকটা প্রাইভেট গাড়ী যাতায়াত করে। আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রকাশদাই সান্তালাবাড়িতে নেমে এসেছিলো,তাই আলাদা করে আর গাইডের প্রয়োজন হয়নি।।
সারি সারি গাছেদের মিছিলে মন হারিয়ে যেতে চায় বারবার । পাখিদের বিভিন্ন সুরে ডাকাডাকি, নাম না জানা বনলতার শরীরে ফুলেল সমারোহ সে এক অপূর্ব অনুভূতি।
পাহাড় গা বেয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। পথেরবাঁকে নিস্তব্ধ যায়গায় এখন ছোটো ছোটো দু একটা দোকান হয়েছে, ইচ্ছে হলে চা বিস্কুট, মোমো খেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার পথ চলা শুরু করা যেতে পারে।পথে যেতে যেতে কানে ভেসে এলো রবীন্দ্র সংগীত। এখানকার অধিবাসী ইন্দ্রজিৎ থাপার গলার গান, রবীন্দ্র সংগীত শুনিয়ে টুরিস্টদের পথের ক্লান্তি লাঘব করেন।
একটা কথা বলে রাখি আমাদের গ্রুপে ছয় থেকে ছেষট্টি নানা বয়সের মেম্বার ছিলো।
বক্সা ফোর্টের আগে সদরবাজারেই আমাদের থাকার ব্যবস্তা করা হয়েছিল হোমস্টে ""ডোমানা""তে।এখান থেকে দুকিমি দূরে বক্সাফোর্ট।আজ আমরা এখানেই থেকে গেলাম, দিনের আলো পাহাড়ে খুব তাড়াতাড়ি নিভে যায়।রাতের পাহাড় জোনাকি তার আলোতে সাজিয়ে রাখে। ঝিঝিপোকার বিরামহীন সুর আর ঝর্নার নৃত্যে নদীর বয়ে চলার আওয়াজ মনকে চঞ্চল করে। তবে এখন আর হিংস্র জন্তু জানোয়ার নেই বললেই। শোনা যায় অনেক আগে মাঝে মাঝে ভাল্লুক দেখা যেতো। এখন কিছু বন্য শুয়োর দেখা মেলে।তবে জোঁক হতে সাবধান সুযোগ পেলেই রক্ত অন্বেষনে নিভৃতে এগিয়ে আসে।সান্তালাবাড়ি থেকে বক্সাফোর্ট আমাদের হেটে যেতে সময় লেগেছিল একঘন্টার মতো, যদিও আমরা ধীর গতিতেই এগিয়েছিলাম।
ঠিক সেরকম ভাবেই যখনই আমার শহরের বাইরে বা আমার জেলা কিংবা রাজ্যের বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা হলে প্রথমেই মনে হয় আমার শহরকে আগে ভালোভাবে ঘুরেফিরে চিনে দেখি তারপর তো অন্যকোথাও।
সত্যিকথা বলতেকি আমার শহরের উত্তর দিকের উঠোন জুড়ে শুধুই পাহাড় আর পাহাড়।
রোজ সকালে পূর্বদিকে সূর্য দেখা আর উত্তরে পাহাড় দেখা দুটোই একটা কয়েনের দুদিক।
যখনই পাহাড়ে মন ছুটে চলে তখনই আর একমুহূর্তেরও অবসর নয়।
এবছরই জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিবারের সবাই মিলে যখন ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়,
তখনই একটা নামই মাথায় আসে সবুজের চাদরে মোড়ানো জয়ন্তী পাহাড়।
আমাদের এবারের গন্তব্য স্থল বক্সাফোর্ট লেপচাখাঁ।
আমাদের যাওয়ার দিনটা ছিলো বৃহস্পতিবার।
আগের দিন বিকালে অর্থাৎ বুধবার দমনপুর হাটে গিয়ে প্রকাশদার সাথে কথা বলে এলাম। বক্সা ফোর্টের কাছে যে সদরবাজার আছে প্রকাশদার সেখানেই বাড়ি,আর টুরিস্টদের জন্য ওনার হোমস্টে আছে।আমরা একদিনের জন্য সেটাই বুক করে নিলাম।আর লেপচাখায় থাকার ব্যবস্তাও উনি করে দিলেন।
ওই পাহাড়িয়া পথ ধরে প্রতি বুধবার আলিপুরদুয়ার শহরের লাগোয়া দমনপুর হাটে প্রকাশদা এবং প্রকাশদার মতো ওই পাহাড়ের অনেকেই সপ্তাহের কেনাকাটা করতে আসে।
যেহেতু অনেকবারই গিয়েছি, প্রকাশ দা আমাদের পূর্ব পরিচিত।
বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা নাগাদ আলিপুরদুয়ার থেকে জয়ন্তীগামী উত্তরবঙ্গ পরিবহনের বাসে আমাদের ১৫জনের দলের এবারের যাত্রা শুরু হল।৷ আলিপরদুয়ার থেকে সান্তালাবাড়ির দূরত্ব প্রায় ৩০ কিমি। তারপর সেখান থেকে বক্সাফোর্টের দূরত্ব প্রায় ৪কিমি আর বক্সাফোর্ট থেকে লেপচাখাঁর দূরত্ব প্রায় তিন কিমি।
এক ঘন্টার মধ্যে ঘন জংগলের পিচঢালা রাস্তার দুপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ি গাঁ সান্তালাবাড়ি।এরপর এখান থেকেই শুরু পায়ে পায়ে হেটে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার পাহাড় পাহাড় অনুভূতি। তবে এখন সান্তালাবাড়ির পর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত কয়েকটা প্রাইভেট গাড়ী যাতায়াত করে। আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রকাশদাই সান্তালাবাড়িতে নেমে এসেছিলো,তাই আলাদা করে আর গাইডের প্রয়োজন হয়নি।।
সারি সারি গাছেদের মিছিলে মন হারিয়ে যেতে চায় বারবার । পাখিদের বিভিন্ন সুরে ডাকাডাকি, নাম না জানা বনলতার শরীরে ফুলেল সমারোহ সে এক অপূর্ব অনুভূতি।
পাহাড় গা বেয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। পথেরবাঁকে নিস্তব্ধ যায়গায় এখন ছোটো ছোটো দু একটা দোকান হয়েছে, ইচ্ছে হলে চা বিস্কুট, মোমো খেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার পথ চলা শুরু করা যেতে পারে।পথে যেতে যেতে কানে ভেসে এলো রবীন্দ্র সংগীত। এখানকার অধিবাসী ইন্দ্রজিৎ থাপার গলার গান, রবীন্দ্র সংগীত শুনিয়ে টুরিস্টদের পথের ক্লান্তি লাঘব করেন।
একটা কথা বলে রাখি আমাদের গ্রুপে ছয় থেকে ছেষট্টি নানা বয়সের মেম্বার ছিলো।
বক্সা ফোর্টের আগে সদরবাজারেই আমাদের থাকার ব্যবস্তা করা হয়েছিল হোমস্টে ""ডোমানা""তে।এখান থেকে দুকিমি দূরে বক্সাফোর্ট।আজ আমরা এখানেই থেকে গেলাম, দিনের আলো পাহাড়ে খুব তাড়াতাড়ি নিভে যায়।রাতের পাহাড় জোনাকি তার আলোতে সাজিয়ে রাখে। ঝিঝিপোকার বিরামহীন সুর আর ঝর্নার নৃত্যে নদীর বয়ে চলার আওয়াজ মনকে চঞ্চল করে। তবে এখন আর হিংস্র জন্তু জানোয়ার নেই বললেই। শোনা যায় অনেক আগে মাঝে মাঝে ভাল্লুক দেখা যেতো। এখন কিছু বন্য শুয়োর দেখা মেলে।তবে জোঁক হতে সাবধান সুযোগ পেলেই রক্ত অন্বেষনে নিভৃতে এগিয়ে আসে।সান্তালাবাড়ি থেকে বক্সাফোর্ট আমাদের হেটে যেতে সময় লেগেছিল একঘন্টার মতো, যদিও আমরা ধীর গতিতেই এগিয়েছিলাম।
পরদিন বৃষ্টি ভেজা সকালে পাহাড়ি সুস্বাদু স্কোয়াসের তরকারি আর রুটি জলযোগের পর আমাদের আজকের যাত্রা শুরু হল।
বক্সাফোর্টে পৌছে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায় ইতিহাসের পাতা চোখের সামনে ভেসে আসে।ভগ্নদশা এই ফোর্ট আজও সাক্ষী হয়ে আছে শতশত বিপ্লবীর বীরত্বের ইতিহাস হয়ে।। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনী স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্দী বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে লেখা কবিতার স্তম্ভ আজও জ্বলজ্বল করছে।
বক্সাদূর্গের আর এক ইতিহাস হল এক সময় ভুটান রাজারা রেশম বানিজ্যের জন্য এই দূর্গকে ব্যবহার করেছিল এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে শরনার্থী শিবির হিসেবেও ব্যবহার হয়েছিল।
এখানকার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা হল পর্যটন শিল্প আর ধাপচাষ।তবে এখন পড়াশোনা এবং জীবিকার জন্য পাহাড় ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া আসা বেড়েছে।
পাহাড়ের ধাপে ধাপে কাঠের বাড়িগুলোকে ছবির মতো মনেহয়। কিছু কিছু পাকাবাড়ি হয়েছে।বক্সাফোর্টের কাছেই বক্সা মিউজিয়াম এবং ডাকঘর রয়েছে।এখানে দুপুর বারোটা সারে বারোটা পর্যন্ত থেকে আমাদের আবার পথচলা শুরু হল লেপচাখাঁর উদ্যেশে।পথের ক্লান্তি আজ সবুজ পাহাড়ের ডাক শুনতে পাচ্ছে। মন শুধু গুনগুনিয়ে উঠছে দূর পাহাড়ে উদাস মেঘের দেশে....।লেপচাখাঁ গ্রামে ঢোকার মুখেই এখানকার অধিবাসিদের একমাত্র সম্বল ছোট্ট একটা প্রাইমারি স্কুল। শিক্ষকরা এখানকার স্থানীয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার স্বপ্নে সদা সক্রিয়। লেপচাখাঁ মেঘের চাদরে মোড়ানো ছোট্টগাঁ।যেন পাহাড়ের শীর্ষে কোনো চিত্রশিল্পী নিজের মনের মতো করে ছবি এঁকেছে।বক্সা থেকে লেপচাখা এখানে পৌঁছাতেও প্রায় এক ঘন্টাই লেগেছিল, চলার পথে কোনো তারা নেই চলেছি আমরা ধীরে ধীরে।
এখানেও আমাদের জন্য হোম স্টে-র ব্যবস্থা করা ছিল। সবুজ রঙের কাঠের দো’তলা ডুকপা ট্রেকার্স হাট। বিকেলবেলা টা পুরো কুয়াশা মাখা,আজ রাতটা মেঘের আতিথেয়তায় আকাশের খুব কাছাকাছি।মেঘ সরে গিয়ে তারাদের ঝলমলে রূপ সে এক অসাধারন অনুভূতি। আমাদের হোমস্টের সামনের খোলামাঠেই তারাদের সাথে আজ আমরাও রাত পাহারায়। ৷বিদ্যুৎ এবং সৌরবিদ্যুৎ দুটোই রয়েছে।পাশাপাশি মোবাইল পরিষেবা বিএসএনএলও আছে।লেপচাখার প্রাণ হল এখানকার বৌদ্ধ গুম্ফা। গুম্ফা দেওয়াল জুড়ে রয়েছে মনোমুগ্ধকর চিত্র।চারপাশে উড়ছে প্রার্থনা পতাকা।
সবচেয়ে প্রবীণ ব্যাক্তি চেংদুজি ডুকপার ফ্যামিলির অনেকেই এখনো আছে বংশ পরম্পরায়। ব্রিটিশ আমলে দীর্ঘদিন বক্সাফোর্টের খাদ্যযোগানের দায়িত্বে ছিলেন চেংদুজি ডুকপা।
সবুজ পাতার ফাঁকে ভোরের সূর্যদয় চোখকে দেয় সুখতৃপ্তি।এবার আমাদের নেমে আসার পালা পাহাড়ি ঝর্নার মতো।
আবার মনে মনে নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিলাম ফিরে আসার জন্য।
আবার মনে মনে নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিলাম ফিরে আসার জন্য।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পোট্রাকিয়া, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
ভীমভেটকা- আদিম ইতিহাস
মনিমা মজুমদার
(ছবি- লেখিকা)
গত ডিসেম্বর মাসে ঘোরার জন্য মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারীকে বেছে নিয়েছিলাম।ভোপাল থেকে প্রায় পাঁচ ঘন্টার রাস্তা। আমরা দুটো পরিবার গিয়েছিলাম। সকাল সকাল ভোপাল থেকে আমাদের গন্তব্য পাঁচমারীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। গাড়ীর চালকের কাছেই শুনলাম আমাদের পথেই ভীমভেটকা বলে একটি জায়গা আছে। প্রতিদিনই সেখানে পর্যটকদের ভীড়
ইত:স্তত করে জায়গাটা দেখার মন:স্থির করে ফেললাম। পরে আমাদের সবার মনে হয়েছে যে ভীমভেটকা না দেখলে আমাদের এবারের ভ্রমণ অসমাপ্ত রয়ে যেত।
ভীমভেটকা জায়গাটি ভোপাল থেকে ৪৫. কি.মি. দূরত্বে। এটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রাণাধীন একটি আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান। বিন্ধ্যপর্বতমালার পাদদেশে সাতটি পাহাড় ও ৭৫০টির বেশি গুহা যা বহন করছে হাজার হাজার বছর আগের মানব অস্তিত্বের প্রমাণ! সত্যিই শিহরিত হয়ে উঠলাম। গুহাগুলির দেয়াল জুড়ে রয়েছে নানারকম গুহাচিত্র। সভ্য মানুষের সৃষ্টি নয়! এতদিন বইয়ের পাতায় দেখেছি- নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনাতীত। গুহাগুলিকে ১,২ করে নাম্বারিং করা আছে। গুহার ছবিগুলোকে বিশ্লেষণ করলে প্রাচীন প্রস্তরযুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের মনুষ্যজজাতির বিকাশের পর্যায়গুলি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। একটি গুহার দেয়াল জুড়ে নানারকম জীবজন্তুর চিত্র।
একজায়গায় দেখলাম একটি ছোট্ট শিশুর হাতের চিত্র। শিকারের চিত্র রয়েছে এবং তারপাশে একে অপরের কোমর জড়িয়ে নাচছে একদল মানুষ- হয়তো শিকারের আনন্দে! আদিবাসীদের কোমর ধরে নাচ- এই ভাবনা হয়তো সেই যুগেও ছিল! এছাড়া তিরধনুকের ব্যবহার, জন্তুর পিঠে চড়ে শিকার- এই রকম নানা তথ্য উঠে আসে সেই সব চিত্রের মাধ্যমে। ভেষজ উদ্ভিদ ও দুর্লভ বৃক্ষ দিয়ে সাজানো ভীমভেটকার জঙ্গল।পাথরের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে আদিম ইতিহাস- দেখে এলাম, ছুঁয়ে এলাম। প্রায় তিন ঘন্টা সেখানে ছিলাম, তবুও মনের সাধ মেটেনি। কিন্তু আমাদের পৌঁছোতে হবে পাঁচমারী। তাই বেরিয়ে এলাম ভীমভেটকা থেকে। সাথে নিয়ে এলাম শুধু বিস্ময়!
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
পন্ডিচেরী
সমতা দাস বিশ্বাস
(ছবি- লেখিকা)
কেমন যেন ফাঁকা লাগছে
একদম ফাঁকা......
কত না উপকরণ, তবু....
শব্দ দিয়ে তাকে যাচ্ছে না
আঁকা ।
মেঘ পাহাড়ের কানাকানি, অরন্য আর বন্যপ্রানী , তিস্তার ছলাৎছল.....এবার কাকে ধরবি বল। আমার খুব ভালো বাসার নীল সফেন সমুদ্র রয়েছে যে.........নেই সমুদ্রে ভেসে চলছি টালমাটাল , ওগো মাঝি শক্ত করে ধর হাল।
সমুদ্রের অগাধ জলরাশি মানবমনের মতোই রহস্যময়।তল পাওয়া কঠিন।ওই নীল জলের দিকে বেশি ক্ষন তাকিয়ে থাকলে চোখে ঘোর লাগে, মনে নেশা ধরে। পুরীর সমুদ্র যেন উচ্ছ্বল কিশোরী। কত হুটোপুটি, কত জলকেলী তাতে ।আধাঁর রাতে সাদা ফ্যানার মুকুটে উর্মিমালা রাশি রাশি ছুটে আসে বেলাভূমিতে। , অন্ধকার বিহ্বলতা জাগায়।
পন্ডিচেরী তে এই সমুদ্রের ভিন্ন রূপ। সকাল বেলা টলমল চোখে উদ্বেলিত। লোনা হাওয়া গায়ে মেখে তাকিয়ে আছি সমুদ্রের দিকে।নত হয়ে আসে মাথা । রাতে ভয়ংকর রূপ ধারণ করল সমুদ্র। কত রোষ, কত আস্ফালন ,বজ্রমুষ্ঠি তে ছুটে এসে ধাক্কা দেয় কালো পাথরের অনড় বুকে।ভয়ে বুক দুরুদুরু , একি তান্ডব নেমেছে আজ ধরিত্রীর বুকে। শোঁ শোঁ হাওয়ায় জলের ঝাপটা চোখে মুখে।দ্রুত ফিরলাম আশ্রয়ে। তুমুল বারিবর্ষন ,শুরু মেঘ গর্জন.... সখা সখীদের পেয়ে সমুদ্র আরো দুরন্ত। হাওয়া পাক খেয়ে হেসে উঠলো হা হা রবে।রাত কাটল অনিদ্রায়।
সকালে সব শান্ত। ক্লান্ত সমুদ্রে আবার মাদলের দ্রিমি দ্রিমি। সলজ্জ্ব ভঙ্গিতে তাকালো সে আমাদের দিকে।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
দার্জিলিং সফর
মাম্পি রায়
(ছবি- লেখিকা)
সময়টা ছিল জানুয়ারির প্রথম দিক, ঠান্ডার মধ্যে বেড়াতে যাওয়ার ধুম। আমি তখন আমার মা, বাবার কাছে এসেছিলাম সময় কাটাতে। আমার দেওর জ্যোতির্ময় আমাকে ফোন কল করে বাড়ি ফেরার কথা বলে, কি না কি সারপ্রাইজ দেবে আমায়। রীতিমতো চলে গেলাম আমি শ্বশুর বাড়ি। গিয়ে অনুপমের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সবাই বেড়াতে যাচ্ছি দার্জিলিং। অনুপম আমার স্বামী, দেওর,ননদ,শাশুড়ি,মামা শ্বশুর, ভাসুর, আরও অনেকে মিলে একটা বড় দল নিয়ে মনের আনন্দে বেরিয়ে পরলাম সকাল ৬ টায়।
মাথাভাংগা বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে চেপে সোজা শিলিগুড়ি পৌঁছে ওখান থেকে ট্যুরিস্ট প্লেস থেকে গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম দার্জিলিং আর সফর শুরু হয়ে গেল।
সবাই মিলে মোট ১৩ জনের একটা দল আনন্দের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। যাত্রাপথে কত সব সৌন্দর্য্য দেখে মন আনন্দে ভরে গেল।সুকনা ফরেস্ট পার করে দার্জিলিং সফর শুরু হয়, যেতে যেতে প্রাকৃতিক দৃশ্য আহা কি মমনোরম। পাহাড় ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পথের আড়াল করে মাথার ওপর খোলা নীলাকাশটা কখন যেন ধোঁয়াশে হয়ে গেল, কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ, মৃদু শীতল বাতাস, মনের সব খারাপলাগা গুলো যেন ধুয়ে গেছিল।অবশেষে ৫ ঘন্টার সফরে দার্জিলিং এ প্রবেশ করলাম সবাই।
প্রায় ২০০০ ফুট উঁচু একটা ৩ তলার লজে আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হল, প্রথমদিন সবাই সন্ধ্যেবেলা যে যার মত কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়লো, সমতলে এসে প্রায় ৫ কি,মি হেঁটে যাওয়া আসা উফফ কি যে কষ্টের সেটা বলে বোঝানো যায় না। টুকিটাকি কেনাকাটা করে লজে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে সময় মত সবাই শুয়ে পড়লাম। পরদিন ভোর ৩ টে নাগাদ বেড়োতে হবে যে, গাইড আসবে নিতে সময় মত না বেড়োতে পারলে যে সেগুরে বালি।
কথামত ভোর ৩ টে নাগাদ সবাই তড়িঘড়ি স্নান সেরে তৈরী হয়ে নীচে নেমে পড়লাম।লজের ওপর থেকে মেঘ বৃষ্টির খেলা দেখতে ভালই লাগছিল। ঘুম স্টেশন এর ওপরের লজেই থাকতাম, টয় ট্রেনের কু-ঝিক-ঝিক আওয়াজটাও বেশ মনমাতানো, আর এ তো যে সে টয়ট্রেন নয় সিনেমা বরফির শ্যুটিং হয়েছিল, আর সেই যে শর্মিলা ঠাকুরের জন্য গাওয়া "এ মেরি স্বপনোকি রানি কব আয়েগি তু, সেই গানটিও তো শ্যুটিং করা হয়েছিল, আবার ২০০০ ফুট উঁচুতে মেঘ গুলো যেন হাতের কাছে চলে আসে। বেয়াদব মরশুমি আবহাওয়ার জন্য মেঘলা আকাশ মাথায় করেই বেড়িয়ে পড়লাম বেড়াতে।
ঘুম ঘুম চোখ, মেঘলা আবহাওয়া, হালকা বৃষ্টি, মাঝে মাঝে রোদের ঝিলিক তবুও কোথাও কোনো আক্ষেপ না রেখে বেড়িয়ে পাড়লাম। মোট ৬ টা জায়গায় ঘোরানোর জন্য গাইড নেওয়া হয়।সাথে প্রয়োজনীয় খাবার আর জল নিয়ে সফর শুরু হয়ে গেল।
গাইড প্রথমে টাইগার হিল নিয়ে গেল,রাস্তা জ্যামে ভরেছিল তাই ২ কি,মি হেঁটে ওপরে উঠতে হল সবাইকে, কি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ ইয়াব্বড়ো সব ঝাউগাছের বন মাথার ওপর, কি বিশাল সব পাহাড়,চারিদিকে নীল ভরে গেছে, কানে শুনেছি বটে সেবার চাক্ষুষ দর্শন হল, সবথেকে উঁচু স্থান টাইগার হিলে পা রাখতেই গা শিউরে উঠল, মেঘলা আকাশ বলে প্রায় অন্ধকারে ছেয়ে গেছিল চারিদিক, কুয়াশার মধ্যে কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছিলনা,কত আশা নিয়ে সূর্য ওঠার বাস্তব চিত্র দেখব ভেবেছিলাম আর দেখা হলনা আমাদের আশা অপূর্ণ থেকে গেল।
টাইগারহিল থেকে চলে গেলাম বাতাসি গার্ডেন, কি অপূর্ব সাজানো বাগিচা। প্রায় একটা গোটা শহর জুড়ে আছে যেন,বিশালাকার বাগিচা, কোথায় যে শুরু করি আর কোথায় শেষ বলা মুশকিল।বৃষ্টি মাথায় নিয়েও খুব আনন্দের সাথে ঘুরেফিরে দেখলাম বাগিচা, সেখানে কত যে হিট সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল তার ব্যানার টাংগানো রয়েছে, পুরোনো দিনের শর্মিলা ঠাকুর এর সিনেমা থেকে শুরু করে বরফি সিনেমার গান ও বাতাসি গার্ডেনে শ্যুটিং হয়েছিল।
বাতাসি থেকে বেড়িয়ে রওনা দিলাম দার্জিলিং এর জনপ্রিয় রক গার্ডেনে। পাহাড়ি আঁকাবাকা পথ গা গুলোনো পাহাড়ি রাস্তা একধারে গভীর খাল আর একধারে পাহাড়চূড়া একটু বেগতিক হলেই ৮/১০ হাজার ফূট নীচে গড়িয়ে পড়ার ভয়, একদিকে যেমন আনন্দ অন্যদিকে ভয়, দুদিক সামলে পোঁছে গেলাম রক গার্ডেন, রক বললেই চলে, পাহাড়ের গা বেঁয়ে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে গেছে সেই গার্ডেন, এক একটা রাস্তায় ঝরনার জল এসে পড়ে, খুব সুন্দর ঝরঝরে ঝরনাধারা বয়ে চলছে সেখানে, দেখবার মত জায়গা, যত উপরে ওঠা যায় ততই যেন প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোরম হয়ে ওঠে,তবে পাহাড়ে ওঠা অভ্যস্ত না বলেই ২/৩ ধাপ ওপরে গিয়ে গায়ে ব্যথা,পায়ে ব্যথা নিয়ে ওখান থেকে নেমে ফিরে এলাম লজে, পরেরদিনের জন্য একটু শক্তি সঞ্চয় করার জন্য।
দ্বিতীয় পর্বে সকাল সকাল চলে গেলাম বৌদ্ধ টেম্পলএ। রাস্তায় গাইড আমাদের বলতে লাগল "ও যো কলেজ হ্যাঁয়না লরেটো উহাপর ম্যায় হু না শ্যুটিং হুয়া থা, ঊ যো ঘর দিখ রাহা হ্যাঁয়না ঊহাপর রনবির কাপুর কা বরফি সিনেমাকা শ্যুটিং হুয়া থা, তভি উ ঘর ভারেমে লিয়াথা রনবির কাপুর কা ঝোপড়ি দিখানেকে লিয়ে, ব্যাস সবাই আমরা হুমড়ি খেয়ে সেসব দেখার জন্য তাকঝাক করতে লাগলাম।কথায় কথায় পোঁছে গেলাম বৌদ্ধ মন্দির। গিয়ে সবার মুখে বিশাল একটা ভ্যবাচ্যাকা মত চেহারা, উফফ আবার সেই এত এত ফুট উঁচু উঠতে হবে, হাজার সিরি বেঁয়ে বৌদ্ধ দেবের পরিক্রমা সেরে সেখান থেকে চলে গেলাম দার্জিলিং এর আর এক জনপ্রিয় জায়গা চা বাগান।
কুয়াশার মধ্যে যে পাহাড়ি পথ ধরে টি স্টেট সুন্দর লাগবে ভাবাই যায়না, বিশাল জায়গা জুড়ে শুধু দার্জিলিং চা পাতার গাছ। সবাই বেশ আনন্দে দার্জিলিং আদিবাসীদের মত পোশাক পড়ে ছবি তুললাম, বেশ ভালই ঘুরে ঘুরে দেখলাম চা বাগান।
চা বাগানের থেকে বেড়িয়ে রওনা দিলাম আমরা মিউজিয়ামে।সেখানে প্রথমে চিড়িয়াখানায় গেলাম, হাজার প্রজাতির জন্ত,পশু, পাখি, জ্যান্ত ঘুরে ফিরছে, রয়াল বেংগল টাইগারের হালুম বলে হুনকার, চীতা বাঘের পায়ের থপ থপ আওয়াজ, ঘরিয়ালের ভয়নকর লাল লাল চোখে তাকানো, শিম্পাঞ্জির মশ মশ পায়ের আওয়াজ, নানান দেশ বিদেশের পাখির কলরব সারাদিন ধরে এই সব কিছু নিয়েই সময় চলে গেল,।
চিড়িয়াখানা থেকে বেড়িয়ে রওনা দিলাম পাশের মিউজিয়ামে, ঐতিহাসিক অস্ত্রসস্ত্র, আদিম যূগের পোশাক পরিচ্ছদ, অলংকার, আসবাবপত্র দেখবার মত, শতাধিক সাপ, মাকড়শা,ফড়িং, বাঁদুর,ইঁদুর,পেঁচা,মাছ,মাছি, মশা, পশু,পাখির মৃতদেহ সংরক্ষণ করা আছে, পর্বতারোহীদের জীবন কাহিনী, নদ-নদী,সাগর -উপসাগর সব বিষয়ে লিখিত ইতিহাস রয়েছে,গডউইন-অস্টিনের কথাও বাদ যায়নি। মোট কথা মিউজিয়ামে কোনোকিছু অজানা বলে কিছু নেই।
মিউজিয়াম ঘুরে দেখা শেষ করে পরের দিন সকাল সকাল বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দিলাম। দার্জিলিং সফর শেষ করে ফেরার পথে পড়ে পাহাড়ি বাঁকানো পথ,সাথে মেঘলা আবহাওয়া দু - ধারে চা বাগান আর মাঝখানে খাড়া পথ, সেই আঁকানো পথের বাঁকে বাঁকে নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম, এই পথের নাম দিয়েছি একটা "স্নেক রোড" কি বেশ না! নামটা?।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
চাপড়ামারির পথে
অনিমেষ সরকার
(ছবি- শৌভিক রায়)
সেই দৃশ্যের পর সন্ধ্যা হতেই আবার গাড়ি ছুটলো ট্রাইবাল ডান্সের দিকে | পানঝোড়া রিসোর্ট এ যেখানে জঙ্গল সুদূর বিস্তৃত প্রায় ৮ কিলোমিটার ভেতরে | নেপালি নৃত্য দেখতে|
এইভাবেই সময়ের স্রোতে আমরা ভেসে যাই ভ্রমণের পথে | ঘরের সামনে ঘোড়ার জায়গা থাকতে কেন তাকাতে যাবো আগে সুদূর বিদেশে |
মণ বিষয়টাই খুব আনন্দের | আমাদের ছোট থেকেই বিভিন্ন জনের বিভিন্ন শখ | সেরকম ই ভ্রমণ ও মানুষের জীবনের এক আত্মতুষ্টির জায়গা বা বলা যেতে পারে Delicious dish | সবকিছু হবে শেষ পাতে চাটনি বা মিষ্টি হবেনা তাই কি হয় ? ভ্রমণ সেক্ষেত্রে তাই | খুব একটা বেশিদূর কোনোদিনে যাইনি বা যাওয়ার সুযোগ ঘটেনি কিন্তু যেহেতু ডুয়ার্সের ছেলে এবং বাবার কর্মসূত্রে চালসার মতো জায়গায় থেকে বড়ো হওয়া সেক্ষেত্রে অরণ্যের প্রতি টান আর ভ্রমণের প্রতি ভালোবাসা থেকেই যায় |
চাপড়ামারি জঙ্গলময় এলাকা পর্যটকদের জন্য সেরা জায়গা | চিতা বাঘ , হাতি , একশৃঙ্গ গন্ডার ,ময়ূর ,বাইসন এর মূল টান | তাই প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এর টানে ছুটে আসেন watchtower থেকে এই সব বন্যজন্তু দেখার জন্য | চালসার ফরেস্ট অফিস থেকে ৬ বন্ধু বান্ধবী মিলে বিকেলে ৪টার টিকিট কেটে নিলাম সেই জায়গা দেখার জন্য | যদিও আমার একবার নয় বহুবার এই অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য ঘটেছে তবুও বন্ধুদের অনুনয় বিনয়ে না করতে পারিনি | ৪জন ছেলে ২জন মেয়ে এই হলো দল আমাদের | সেই টিকিট কাউন্টার থেকে জিপসি যার মধ্যে রাইনো নম্বর দেওয়া এবং একজন গাইড আমাদের দেওয়া হলো | বাইরের কোনো গাড়ি প্রবেশসিদ্ধ নয় | ৩.৩০ মিনিটে গাড়ি রওনা দিলো কাউন্টার থেকে | চালসা গোলই হয়ে নিউ খুনিয়া , পানঝোড়া বস্তি হয়ে খুনিয়া মোর বা ঝালং মোর হয়ে গাড়ি বাঁ দিকে ঘুরে গেলো | রাইলিনে পেরিয়ে সুন্দর অপরূপ প্রকৃতিকে মাপতে মাপতে এসে পৌঁছলাম চাপড়ামারি গেট এ | স্বাক্ষর করে ভেতরে ২কিলোমিটার এর মতন পেরিয়ে পৌঁছলাম চাপড়ামারি watchtower এ | সেই গাইড আমাদের নিয়ে গেলো কাঠের একটা ছোট সাঁকো পার করে কাঠের তৈরী দোতলায় | এই কাঠের দোতলাটির গায়ে সাপের মতন একটি কাঠেরমূর্তি বানানো | দেখলেই শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে | তার পাশেই গেস্ট হাউস যেখানে রাত কাটাতে হইলে আপনাকে অনলাইন টিকেট বুক করতে হবে | সেই watchtower থেকে ৫০০ মাইটার দূরত্বে একটি বড়ো জলাশয় যার আসে পশে জঙ্গল এবং মাঝে একটি লবন রাখার জায়গা | জেক সল্টলেক ও বলা হয় | সেই watchtower এর আসে পাশে ইলেকট্রিক খুঁটি এবং তার দেওয়া যাতে কোনো বন্যজন্তু প্রবেশ করতে না পারে | তারপর সেই সল্টলেকের ধারে অপরূপ দৃশ্য দেখতে পেলাম এক পাশে দুটি দাঁতাল হাতি আর একপাশে বাইসন জল খেতে এসেছে | জঙ্গল থেকে ময়ূরের ডাক ভেসে আসছে স্পষ্ট |
"এই মোহনায় ভেসে উঠি আমি
কোনো জীবন্ত ক্যানভাসে "
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
গুন্ডিচা : ছবিতে
শ্যামলী সেনগুপ্ত
গুন্ডিচা : ছবিতে
শ্যামলী সেনগুপ্ত
সমুদ্দুরের মৃদুপরশ
সোমা বোস
-
মাম্মাম, আমরা তাহলে সত্যিই আজ বেড়াতে যাচ্ছি? বাপি সত্যিই আমাদের
নিয়ে যাচ্ছে?
-
হ্যাঁ
সোনামা,
আমরা সত্যিই
আজ বেড়াতে যাচ্ছি।
নাও নাও, আর দেরী নয়। চট করে নিজের ব্যাগ একবার
চেক করে নাও।
সব ঠিকঠাক
আছে তো?
তাহলে কাঁধে
নিয়ে নাও শীগগির।
-
বৌমা, সাবধানে যেও আর সবসময়
মেয়েকে কিন্তু চোখেচোখে রেখো।
যা দুরন্ত, তার ওপরে আবার যাচ্ছ
সমুদ্রে।
-
না
মা, তুমি নিশ্চিন্তে থেকো…। আমি সবসময় ওর খেয়াল রাখবো।
-
কই
গো? তোমাদের হল? এবারে তো আমাদের বেরোতে
হবে, নাহলে সিওর ট্রেনটা মিস
করবো…….।
-
বাপি আমরা কোন ট্রেনে যাবো?
-
ধৌলী
এক্সপ্রেসে মামণি।
চলো এখুনি
বেরোতে হবে।
তুমি রেডি?
-
রেডি
বাপি।
-
গুড
গার্ল।
-
কিন্তু
এখনও কেমন সান রাইজ করেনি,
আর আমরা
কেমন বেরিয়ে পড়ছি।
-
হ্যাঁ, আমরা আজ সূর্যের ঘুম
ভাঙার আগেই চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ছি।
লেটস গোওওও…….। তোমার মাম্মামকে আসতে
বলো…….। মা আসি, বাবা আসি।
-
দুগগা
দুগগা...।
যাক
বাবা অবশেষে হাওড়া থেকে এই শনিবারের ভোর ছ’টার
ধৌলী এক্সপ্রেসে চেপে বসা গেলো…
একথা ভেবে
মনে মনে স্বস্তি পেলো রাজশ্রী।
বিয়ের পর
এই প্রথম তার বাইরে বেরোনো।
খুব সাধারণ
মেধার ছাত্রী ছিল সে,
জীবন নিয়ে
কোনো আলাদারকমের স্বপ্ন ছিল না তার মনে। তার বাবা-মায়ের মনেও...। তাই গ্র্যাজুয়েশনের পড়া পড়তে
পড়তে গড়পড়তা বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারের নিয়ম অনুসারে তার বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করে
এবং বিএ ফাইনালের রেজাল্ট বেরোনোর পরপরই বিয়ের পর্বও সাঙ্গ হয়ে যায়। শ্বশুর, শাশুড়ি, অতনু আর তাকে নিয়ে তার
শ্বশুরবাড়ির ছোট্ট সংসার।
শ্বশুরমশাই
রিটায়ার্ড আর শাশুড়ি-মা কর্মরতা। তাই প্রত্যহ সকালে মা
আর ছেলের অফিসে যাওয়ার সমস্ত তোড়জোড় সামলে শ্বশুরমশাইয়ের দেখভাল আর সংসারের অন্যান্য
টুকিটাকি কাজের মধ্যে দিয়ে সময় যে কিভাবে পার হয়ে যেতো… সে বুঝতেই পারতো না। বিয়ের আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রতিবছরই
সে অন্তত একবার করে বেড়াতে যেতো।
তাই বিয়ের
পর এতগুলো বছর না-বেড়ানোর একরাশ অভিমান
তার বুকে জমে গিয়েছিলো।
কেন অতনু
একবারও তাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা মুখ ফুটে বলে না!
এর
মাঝেই মেয়ে ঊশ্রীর আগমন তাদের সংসারে। তারপর তো সময়ের আরো অভাব হয়ে
যায় তার জীবনে।
তবে তার
কথা চিন্তা করে সবসময়ের কাজের জন্যে মালতীকে রাখা হয় তাদের সংসারে। তারপর এই বছরেই ঊশ্রী
ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে কাছের এক ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে। সেখানে তার প্রচুর বন্ধু, তাদের কাছেই সে শুনেছে
যে এবারের উইন্টার ভ্যাকেশনে নাকি সবাই কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। মূলত এই মেয়ের আব্দারেই
এবারে তাদের এই বেরোনোর প্রোগ্রাম।
কিন্তু
অতনুর অফিসে ছুটি পাওয়া দুষ্কর,
তাই শনি-রবি মাত্র দু’দিনের জন্যে এই বেরোনো। তাও আরেকটু হলেই ভেস্তে
যাচ্ছিলো আর কি!
কারণ বেরোনোর
ঠিক তিনদিন আগে ঊশ্রী এমন জ্বর বাধিয়ে বসলো যে অতনুর বাবা নাতনীকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে
আপত্তি করে বসলেন।
মেয়ে তো
যাওয়া হবেনা শুনে জ্বরের মধ্যেই কেঁদেকেটে একসা। তারপরে জ্বর সারলো বটে, কিন্তু দাদাইয়ের এক কথা... সদ্য অসুখ থেকে ওঠা এই
ছোট্ট শরীরে সে নাকি যাওয়ার ধকল মোটেই নিতে পারবে না, অযথা আরো ভয়ানক শরীর খারাপ হবে। শ্বশুরের
আজ্ঞাবহ অতনুও তাই বেঁকে বসলো শেষ মূহুর্তে। নিরুপায় ঊশ্রী তখন ঠাম্মুর শরণাপন্ন
হলে পরে সেই ঠাম্মুই এযাত্রা বাঁচিয়ে দিলেন। তাই এখন সে এই ধৌলী এক্সপ্রেসের
জানালায় চোখ লাগিয়ে যাত্রাসুখ উপভোগ করতে পারছে। মনে মনে সেই শাশুড়ি-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায়
তার চোখে জল চলে এলো।
-
মাম্মাম, কেক দাও না... ক্ষিদে পেয়েছে।
-
হ্যাঁ, এই যে দিই সোনামা। হ্যাঁ গো, কোন স্টেশন এলো?
-
খড়গপুর
স্টেশন এটা।
জল কিনতে
লাগবে নাকি?
দাঁড়াও
একটা জল কিনে আনি।
আমি চা
খাবো, তুমি কি খাবে?
-
চা? হ্যাঁ খাবো। আর কতক্ষণ লাগবে গো সেখানে
পৌঁছাতে?
-
এই
তো, সাড়ে ন’টায় পৌঁছে যাবো।
রাইট
টাইমেই তারা বালেশ্বর স্টেশনে নামলো।
তাদের সাথে
একই কামরায় বসে যে ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের দলটি আসছিলো, তারাও তাদের সাথে হৈহৈ
করে নামলো।
তাদের কথাবার্তায়
বোঝা গেলো যে তাদের গন্তব্যস্থল হল অদূরেই সিমলিপালের অভয়ারণ্য। আর রাজশ্রীদের গন্তব্যস্থল
হল চাঁদিপুর অন সী।
এরপর ১৬
কিমি যাত্রার উদ্দেশ্যে দরদাম করে এক অটো ধরে একেবারে সমুদ্রের তীরের ওড়িশা পর্যটন
উন্নয়ন নিগমের ছিমছাম পান্থনিবাসে নির্বিঘ্নে পৌঁছানো গেলো ঠিক দশটা নাগাদ।
OTDC-র
কলকাতা অফিস থেকে রুম বুক করাই ছিলো।
সেই বুকিংয়ে
ব্রেকফাস্ট ইনক্লুডেড।
রুমে চেকইন
টাইম বেলা ১২টা।
তাই আগে
ডাইনিংয়ে বসে হাতমুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া গেলো। তারপর যথাসময়ে রুমে গিয়ে
ফ্রেশ হয়ে তারা বের হল হোটেলের সামনের সীবীচ উপভোগ করতে। শীতের রোদ গায়ে মেখে
কিছুটা দূর পর্যন্ত গিয়ে তারা ফিরে এলো। পায়ের নীচে প্রচুর ঝিনুক আর শামুকের
খোল ছড়িয়ে।
মাঝে মাঝে
লাল লাল অতি ক্ষুদ্র কিছু কাঁকড়ার বালির ভেতর থেকে বেরিয়ে আবার বালিতেই প্রবেশ নজরে
এলো।
বীচে দাঁড়িয়ে
সমুদ্রের গর্জন শোনা গেলো,
কিন্তু
দেখা মিললো না।
পান্থনিবাসের
কর্মচারীরা বললো “সাব, এখন মাইলের ওপরে হেঁটেও
সমুদ্রের দেখা পাবেন না।
সন্ধ্যের
পরে দেখবেন সমুদ্র এই হোটেলের গায়ে আছড়ে পড়ছে। তাই চিন্তা করবেন না।”
দুপুরের
লাঞ্চ সেরে ওটিডিসির গাড়িতেই তারা বেরোলো তিন কিমি দূরত্বের বুড়িবালাম নদীর মোহনার
উদ্দেশ্যে।
যেতে যেতে
সেস্থানের মাহাত্ম্য শোনা গেলো।
১৯১৫ সাল… ব্রিটিশ ভারতে জার্মানি
থেকে আগত অস্ত্রের অপেক্ষায় চারসঙ্গী নিয়ে এস্থানে কাল গুনছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী
যতীন্দ্রনাথ সেন।
কিন্তু
বিধি বাম।
তাঁর গতিবিধি
ব্রিটিশের গোচরীভূত হয়।
তৎকালীন
কূখ্যাত চার্লস টেগার্টের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে এই বুড়িবালামের তীরে চষাখন্ডে এক অসম
যুদ্ধে নীরেন্দ্র,
মনোরঞ্জন, জ্যোতিষ, চিত্তপ্রিয় ও যতীন্দ্র
তাঁদের রক্তে বুড়িবালামের তীর রাঙিয়ে দেন। আহত যতীন্দ্রনাথকে স্থানান্তরিত
করা হয় বালাসোর হাসপাতালে।
১০/০৯/১৯১৫ তে তিনি মৃত্যুবরণ
করেন।
তাঁর শেষকৃত্য
হয় জেলখানায়।
গল্পটি
শোনার পরে সেই স্থানটি দেখে শিহরিত হয়ে ওঠে রাজশ্রী। ফেরার সময়ে দেখানো হল
কাছেই অবস্থিত আব্দুল কালাম দ্বীপস্থিত ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ইন্টিগ্রেটেড
টেস্ট রেঞ্জ।
যেখান থেকে
আকাশ, অগ্নি, পৃথ্বী প্রমুখ মিসাইল
উৎক্ষেপণ হয়েছিল।
সন্ধ্যের পর হোটেলে ফিরে তারা রীতিমতো তাজ্জব! পান্থনিবাসের গায়ে সমুদ্রের
ঢেউয়ের মৃদু পরশ দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো ঊশ্রী। বাপির হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে
সমুদ্রের কাছে যেতে উদ্যত হতেই মায়ের হাতের টানে পিছিয়ে এলো সে। তারপর তারা তিনজনে পাতলা
চাদর গায়ে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকলো সমুদ্রের ধারে বাঁধানো সিমেন্টের সীটে। সমুদ্রের ধারে এই শীতেও
ঠান্ডার প্রকোপ কম থাকে,
বসে বসে
রাতের সমুদ্রের শান্ত স্নিগ্ধ রূপ উপভোগ করা গেলো। জোয়ারের প্রকোপে সমুদ্রতট
বেশ কিছুক্ষণ এই জলের স্পর্শ পায় এসময়। তারপর ভাঁটার টানে এই জল আবার
দূরে চলে যায়।
এখানকার
এই জোয়ারভাঁটার খেলা যেন অনেকটা আমাদের জীবনের মতই। সারাদিনের অদর্শনে বালুকাবেলারূপী
প্রিয়া যেন অধীর আগ্রহে সমুদ্ররূপী দয়িতের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে এই সময়ে। অনুরূপভাবে দয়িত সমুদ্রও
যেন বালুকাবেলারূপী প্রিয়ামিলনের জন্যে এই সময়ে তার ওপরে আছড়ে পড়ে আর মৃদুপরশে তাকে
আবেশিত করে তোলে।
রাজশ্রীর
মন এক ভালোলাগায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।
কিন্তু
এতদিনের অভিমান ভেঙে সে কেন অতনুর কাছে স্বাভাবিক হতে পারছে না? কেন পারছে না?
পরদিন
রবিবার কাকভোরে উঠে তারা দেখলো সমুদ্র আবার গায়েব। সমুদ্রগর্জনের শব্দ লক্ষ্য
করে তারা এগিয়ে গেলো অনেকটা পথ।
পূর্বরাতের
প্রণয়াসক্তে সিক্ত বালুকাবেলায় হাঁটতে মন্দ লাগছে না রাজশ্রীর। মেয়ে ঊশ্রীর সাথে পাল্লা
দিয়ে বালির মধ্যে থেকে প্রচুর বিরলদর্শন ঝিনুক কুড়িয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগ ভরানো হলেও
সমুদ্রদর্শন হল না।
তবে কেয়া, কাজু ও ঝাউয়ে ছাওয়া শান্তস্নিগ্ধ
বালুকাবেলা এক মুগ্ধতার আবেশ এনে দিলো তার মনে। বাতাসে নেই কোনো নোনা
বা সোঁদাগন্ধের অস্তিত্ব,
নেই কোনো
চোরাবালির অস্তিত্ব…
যা কিনা
নিঃসন্দেহে একে একমেবাদ্বিতীয়ম করে তুলেছে। একসময়ে পান্থনিবাসে ফিরে এসে
ব্রেকফাস্ট সেরে ওদেরই গাড়িতে করে আবার বেরোনো হল ৪৫ কিমি দূরের পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দিরের
উদ্দেশ্যে।
একঘন্টার
এই যাত্রায় তারা ঘন বনানীর ঠাস বুনোটের ভেতর দিয়ে অবশেষে পৌঁছলো নীলগিরি পর্বতের ওপরের
পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে।
পাহাড়ের
নীল আর দিগন্তের নীল মিলেমিশে নীলাভ এই পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। শোনা যায় জ্যোৎস্নারাতে
নাকি মায়াবীরূপ দেখা যায় এখানে।
এখানেও
পান্থনিবাস আছে।
সেখান থেকে
অনেকসময়েই বন্যহাতি মায় বাঘেরও দেখা মিলতে পারে। পান্থনিবাসের কাছেই ২৫৬টি
সিঁড়ি বেয়ে উঠে শিব-মহেশ্বরের থান বা মন্দির। মহাদেবের পাঁচটি মূর্তি
এখানে বিদ্যমান।
পাহাড়ি
খাদের ছোট্ট এক ফাটলে মিষ্টি মধুর তানে ঝর্ণাধারা বয়ে চলেছে। ঢালের তালে শরীর হেলিয়ে
এই ঝর্ণার জলে হাত ডোবালেই পরশ মেলে তার কোলে থাকা পাঁচ শিবলিঙ্গের। কথিত আছে এই পঞ্চলিঙ্গ
জরাসন্ধের দ্বারা পূজিত।
দর্শনশেষে
এবারে আবার ফেরার পালা।
এবারে দীর্ঘ
একঘন্টার যাত্রাপথে গাড়ি যখন চাঁদিপুরের পান্থনিবাসে ফিরে এলো, তখন সেখানে লাঞ্চ রেডি। লাঞ্চশেষে নিজ নিজ ব্যাগ
গুছিয়ে এবারে বালেশ্বর স্টেশনের জন্যে প্রস্তুতি সেরে নেওয়া গেলো। বিকেল ০৪.২১এর ধৌলী এক্সপ্রেস
তাদের হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেবে রাত ০৮.১৫তে। স্টেশনের পথে গাড়ীতে
একপাশে জানালার ধারে অলস ভঙ্গীতে গা এলিয়ে বসে অতনু গুনগুনিয়ে উঠলো ---
এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু
একটি সে নাম আমি লিখেছিনু
আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে
তারে যেন মুছিয়া দিলাম।।
কেন তবু বারে বার ভুলে যাই
আজ মোর কিছু নাই
ভুলের বালুচরে যে বাসর বাঁধা হল
জানি তার নেই কোন দাম।
আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে
সবকিছু মুছিয়া দিলাম।।
এই সাগরেরই কতো রূপ দেখেছি
কখনো শান্ত রূপে
কখনো অশান্ত সে
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে থেকেছি।
মনে হয় এ তো নয় বালুচর
আশা তাই বাঁধে ঘর
দাঁড়ায়ে একলা শুধু
ঢেউ আর ঢেউ গুনি
এ গোনার নেই যে বিরাম।
আজ সবকিছু দিয়ে আমি
জানিনা তো কি যে নিলাম।।
একটি সে নাম আমি লিখেছিনু
আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে
তারে যেন মুছিয়া দিলাম।।
কেন তবু বারে বার ভুলে যাই
আজ মোর কিছু নাই
ভুলের বালুচরে যে বাসর বাঁধা হল
জানি তার নেই কোন দাম।
আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে
সবকিছু মুছিয়া দিলাম।।
এই সাগরেরই কতো রূপ দেখেছি
কখনো শান্ত রূপে
কখনো অশান্ত সে
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে থেকেছি।
মনে হয় এ তো নয় বালুচর
আশা তাই বাঁধে ঘর
দাঁড়ায়ে একলা শুধু
ঢেউ আর ঢেউ গুনি
এ গোনার নেই যে বিরাম।
আজ সবকিছু দিয়ে আমি
জানিনা তো কি যে নিলাম।।
কাঁধের
ওপরে এক আলতো হাতের অভিমানী ছোঁয়া অনুভব করে অতনু, কিন্তু তার দৃষ্টি তখন কাঁচের
জানালার বাইরে অনেক দূরে নিবদ্ধ...।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
ভ্রমণ বিভ্রাট
রাণা চ্যাটার্জীহঠাৎ করে বেরিয়ে পড়াটা বাঙালিদের এক প্রকার নেশা বলা যেতে পারে ।বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের কাছে এটা একটা অক্সিজেনের মতো কাজ করে, দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর। আর ভ্রমণপ্রিয় বাঙালিদের কাছে এই বেরিয়ে পরা টা একটু সুযোগের অপেক্ষা। অনেকে হয়তো ভাবি হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লো পরিবারটা, কিন্তু এর পেছনে থাকে একটু একটু করে অপেক্ষা আর এই বেড়ানোর পরিকল্পনা,বেড়ানোর প্রস্তুতি। টুকটাক কেনাকাটা,ঘোরা সেসবের একটু একটু সঞ্চয়ের করার প্রবণতা।
কোথাও একবার যাচ্ছিলাম বেড়াতে, ট্রেনের সামনের সিটে বসা এমনই এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সাথে বেশ আলাপ হয়ে গেল। কোন এক কথা প্রসঙ্গে বেড়ানোর কথা উঠতে মধ্যবয়স্কা মাসিমা বলেছিলেন , "সাধারণ মধ্যবৃত্ত পরিবারের মানুষ হয়েও ওনারা নিয়ম করে চেষ্টা করেন বেরিয়ে পড়তে আর এই পরিকল্পনাটা খাবার টেবিল থেকে শুরু করেন । চার দিন মাছের পরিবর্তে তিন দিন করে দিয়েছেন ,ওই স্রেফ বেড়াতে যাব, বেড়াতে যাবার খিদে টাকে মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা"। শুনে বেশ নাড়া দিয়েছিল মনটা,সত্যিই তো,এই দায়িত্বের সংসারে মাস মাইনের বেতনে সব কিছু সামলে বেড়াতে যাওয়া সত্যিই বেশ চাপের! অথচ বছরে দু চার দিনের ছোট্ট ভ্রমণও কত্ত এনার্জির ,কত প্রশান্তি এনে দেয় মনে,তাই সম্মান জানাই ওই অপরিচিত মাসিমার জীবন দর্শন কে।
মেয়ের তখন আড়াই বছর বয়স। চোখের এলার্জি টা বেশ বেড়েই চলেছে! স্থানীয় ডক্টর ,ওষুধের পর ওষুধ দিয়েই যাচ্ছেন। একদিন হটাৎ করে চেন্নাই এর ডক্টর বাবুর এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ফেললাম তিন মাস পরের পুজোর ছুটিতে । টিকিট ও পেয়ে গেলাম সহজেই। আজ থেকে কয়েক বছর আগে দুর্গাপুজোর নবমীর দিন, ঠিক এই ভাবে আমাদের তিনজনের বেরিয়ে পড়া প্রথম বার দক্ষিণ ভারতের রাজ্যে।
পরিকল্পনা ছকে ফেললাম,চেন্নাই এ দু রাত তিন দিন থেকে চলে যাবো ব্যাঙ্গালোর।সম্ভব হলে মাইসোর স্পর্শ করবো,আর যদি সময় না হয়,ব্যাঙ্গালোর থেকেই ব্যাক করবো এই হিসাবে ফেরার টিকিট ব্যাঙ্গালোর ও মাইসোর উভয় জায়গা থেকেই করে রেখে ছিলাম।
বর্ধমানের বাড়ি থেকে রাতের গণ দেবতা এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া পৌছালাম ঘড়িতে তখন প্রায় পৌনে দশটা।রাতের ট্রেনে পাড়ি দিলাম চেন্নাই। যখন পৌছালাম, ভোরের আলো ফোটেনি,বেশ রাত।এক অচেনা শহরে অচেনা ভাষী অটো ওয়ালার ওপর ভরসা করে বসে পড়লাম অটোতে।
ভেতরে আলো ঝলমল জমজমাট স্টেশন আর বাইরে আলো-আঁধারি গা ছমছম পরিবেশের সুনসান রাস্তা পেরিয়ে,কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পূর্বনির্ধারিত স্থান গ্রীমস লেন। কিন্তু একি! এই স্বনামধন্য জায়গার নাম,পত্র পত্রিকায়,
চিকিৎসা করতে যাওয়া বাঙালিদের মুখে মুখে,সে কিনা এত্ত অন্ধকার ঘুট ঘুট নিয়ে বিরাজমান! দেখে একটু যেন ভয় ভয় শঙ্কা নিয়ে নামলাম !
কিছুক্ষণের মধ্যে ঠান্ডায় চাদর ঢাকা দেওয়া এক দালাল ঘরের সন্ধান দিতে হাজির,তার পিছু নিলাম ঘর দেখতে। কিন্তু আজও ভেবে খারাপ লাগে যে, ওই অন্ধকারে, অচেনা পরিবেশে,একাকী
সহধর্মিনী ও বাচ্চাকে লাগেজ নিয়ে দাঁড় করিয়ে অচেনা ব্যক্তির পিছু নিয়ে অন্ধকারে ঘর খোঁজা মোটেও ঠিক হয়নি,বরং অবিবেচকেরই কাজ হয়েছিল । কিছু যদি অঘটন ঘটে যেত সেদিন!
পরে সকালে ওই জায়গায়,অবাক হয়ে দেখেছিলাম, কে বলবে রাতের অন্ধকারে অমন স্তব্ধতার এলাকা ছিল ওটা! দোকানপাট ,সবজি বিক্রেতা,মাছের দোকান,ট্রাভেল এজেন্সি,লোক জনে হই হই যেন ,কলকাতার এক চিলতে বাজার টা উঠে এসেছে!
দ্বিতীয় দিনে অটো নিয়ে হাজির হলাম শংকর নেত্রালয় । দুপুরের মধ্যে ডক্টর দেখিয়ে মারিনা বিচের উদ্দেশ্যে গমন। পুরীর সমুদ্রের মতো উত্তাল ঢেউ ছিল না বটে কিন্তু মেরিনা বিচের মধ্যে একটা শান্ত মন খারাপ করা শূন্যতা যেন লুকিয়ে আছে !রয়েছে প্রচুর দোকান-পাট মানুষের হই হই আর সিনেমা আর্টিস্টদের বড় বড় কাট আউট নিয়ে স্থানীয়দের ছবি তোলার ধুম।
ফেরার পথে আরো দুচারটে প্রাচীন মন্দির দেখে,স্থানীয় বাজারে কিছুক্ষন শাড়ি নাড়াঘাটা করে হোটেল রুমে ফিরলাম।সমুদ্র তীরবর্তী এক প্রাচীন শহরের বুকে প্রথম রাত্রি কাটানোর এক আলাদা অনুভব হচ্ছিল বেশ।আসার পথে রাত্রেই বুক করে ফিরেছিলাম,পরের দিনের ভ্রমণের পরিকল্পনা।
প্রচন্ড গরম তবুও এসেছি যখন নতুন শহরে, নতুন মানুষজন ।আর কিছু বাঙালি পর্যটকও তো যে প্রান্তেই ঘুরতে যান অবধারিত ভাবে সঙ্গী হবেই।গোল্ডেন বিচ,কুমিরের প্রকল্প সহ আরো বেশ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান দেখে পৌঁছেছিলাম প্রাচীন শহরের অলি গলিতে কাঞ্চীপুরমের। বেশ ভালোই গেল সারাটা দিন,মন্দির ময় কাঞ্চীপুরম ।
তৃতীয় দিনে স্থানীয় আরো কিছু স্থানীয় জায়গা ঘুরে ,কিছু টুকিটাকি কেনাকাটাতে ব্যাগ ভর্তি করে রাতের ট্রেন ধরলাম ব্যাঙ্গালোর যাবার। স্টেশনে নেমে কি ভীষণ ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে প্রিপেড অটো নিয়ে পৌঁছে গেলাম আমার শ্যালকের বাড়ি। সারাদিন গল্প হাসি মজায় কাটিয়ে পরের দিন বিকালে গাড়ি নিয়ে দর্শনীয় কিছু স্থান দেখে , ইসকন মন্দিরে কাটিয়েছিলাম অনেকটা সময় ।
ব্যাঙ্গালোরে পদার্পণের তৃতীয় দিনে সকাল সকাল মাইসোরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাইরের প্রচুর নারকেল গাছ, সবুজ গাছপালার সারি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম আমরা সত্যিই পাখির থেকে কোনো অংশে কম নয়! এই তিনদিন আগেও ট্রেনে বসে সফর করছিলাম, আর আজ কিনা কিছুক্ষন পরেই দক্ষিণের তিনটি শহর ছোঁয়া হয়ে যাবে।
বিশেষ বেশভূষা পরিহিত এই দক্ষিণে রাজ্যটিতে বাসের উপর যে প্যাসেঞ্জার নির্ভর করে বোঝাই যাচ্ছিল। উপরি পাওনা হিসেবে ছিল দীপাবলীর ছোঁয়ায় সুসজ্জিত দোকান,বাড়ি ঘর আর নেতাদের নাম সজ্জিত বিশাল বিশাল ফেস্টুন! রাস্তার ধারে ধারে প্রচুর সিঁদুর মাখা বলি দেওয়া ছাচি কুমড়া গড়াগড়ি অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে অবাক লেগেছিল ।
দুপুরের আগে নেমে পড়লাম রীতিমতো ঝাঁ-চকচকে মাইসোর বাসস্ট্যান্ডে।আশেপাশে প্রচুর হোটেল থাকায়, রুম খুঁজে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি । স্ট্যান্ডে বসার জায়গা, নির্দিষ্ট স্থানে বাস দাঁড় করানো সহ,দোকানপাট সবকিছুর খুব সুন্দর সফল রুপায়ন ছিল বাসস্ট্যান্ডটিতে।আফসোস হচ্ছিল,ইশ আমাদের হাওড়াতে যদি এরকম একটা বাস স্ট্যান্ড হতো!
সন্ধ্যায় ফ্রেশ হয়ে গেলাম মাইসোর রাজবাড়ী দেখতে । এত্ত সুন্দর আলোকসজ্জা পুরো রাজপ্রাসাদ টা যেভাবে মুড়ে ফেলেছে সেটা দেখে জনসমুদ্রের মাঝে মনে হচ্ছিল জোড়ে জোরে বলি," মাইসোর সুন্দরী,ধন্য তোমার সাজ,ধন্য তোমার সৌন্দর্য্য"! তখনও ভাবতে পারিনি আগামীকাল আমাদের জন্য কি প্যান্ডরার বাক্স অপেক্ষা করে আছে!
চারিদিকে ছোট ছোট বাটি সাজানো সাউথ ইন্ডিয়ান থালি খেয়ে রাতের একটা দুর্দান্ত ঘুম দিলাম। সকাল হতেই ট্যুর অপারেটরের সাহায্যে নিয়ে মাইসোর রাজপ্রাসাদের মিউজিয়াম রাজাদের ব্যবহৃত সামগ্রী দেখে আপ্লুত হলাম।রাজ রাজাদের ব্যবহৃত দ্রব্য কি অপূর্ব ভাবে আজও যত্ন করে রাখা হয়েছে।
পরের দিন রাতে বাড়ি ফেরার ট্রেন ।ঠিক করলাম হোটেলে রুম ছেড়ে বাসস্ট্যান্ডে ক্লকরুমে যাবতীয় লাগেজ রেখে টুরিস্ট বাসে ঘুরবো সিটি ট্যুর। সেই মতো রুম ছেড়ে ছোট্ট ট্যুরিস্ট বাসে করে ঘুরে দেখলাম চামুন্ডা হিলস,নন্দী হিলস, টিপু সুলতান মসজিদ ,চার্চ হয়ে সন্ধ্যায় বৃন্দাবন গার্ডেনস। ফেরার সময় বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে ।বাস স্ট্যান্ডে নেমে লাগেজ নিলাম আর দক্ষিণ ভারতীয় থালি সহযোগে ডিনার সেরে রওনা স্টেশনের দিকে।পরের দিন ব্যাঙ্গালোর থেকে যে টিকিট ছিল তা আরএসি থাকায়,আজ বেলাতেই ক্যানসেল করে ছিলাম।
স্টেশনে পৌঁছে এত সুনশান দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, স্টেশন বলতেই আমরা যেটা দেখে অভ্যস্ত, ঘিনঘিনে, ভিড় ভাট্টা দোকান বাজার ,সে সব থেকে আলাদা মাইসোর স্টেশনটি। এই চত্বরের মধ্যে নেই , কোন দোকান, পান, বিড়ি, গুটকা সজ্জিত গুমটি ,কেবল গাড়ি রাখার সুন্দর ব্যবস্থা আর দুটি ব্যাংকের এটিএম।
সাড়ে এগারো টা বাজলো,ট্রেনের টাইম হবার সময় অথচ ট্রেন ও নেই প্যাসেঞ্জারও ।কিচ্ছু না দেখতে পেয়ে চিন্তিত মুখে স্থানীয় পুলিশকে জিজ্ঞাসা করতেই উত্তরে চমকে উঠলাম ,বলেন কি আমাদের ট্রেন কিনা কাল চলে গেছে ! আজকে নয় কালকে ছিল আমাদের ট্রেন ! একি সর্বনাশের কথা!
সহধর্মিনী যতবার জানতে চেয়েছিল ট্রেনের টাইম কি, স্মার্টলি উত্তর দিয়েছিলাম রাত সাড়ে এগারোটা, ত্রিশ তারিখ। একটা লোকাল ট্রেন ঢুকছিল ব্যাঙ্গালোর যাবার ,মাথা কাজ করছিল না কিন্তু কি করব এই ট্রেনে চেপে! ব্যাঙ্গালোর থেকে ট্রেনের টিকিটও তো ক্যানসেল করেছি সকালে। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি বাড়তে থাকলো,ক্লান্ত হয়ে কোলে আমার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে,সন্ধ্যা থেকে ওর গা টা আবার গরম হয়েছে! আমরা দুজন হতভম্ব হয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি আর যত রাগ যেন উগরে পড়ছে আমার ওপর!
তবুও ভরসা করে অনুসন্ধান কাউন্টারে গিয়ে বুঝলাম ,আজ ত্রিশ তারিখ তো কি হয়েছে আমাদের ট্রেন ছিল ত্রিশ তারিখ রাত সাড়ে বারোটা যেটা আমি বারংবার সাড়ে এগারোটা বলে ভুল করেছি। সেই হিসেবে গতকাল রাতে মানে, ত্রিশ তারিখ প্রবেশ করতেই, রাত সাড়ে বারোটায় ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে! রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করেছিল।এই বিষয় টা নিয়ে আমি নিজে কতজনকে সতর্ক করি আর না দেখার কারণে আমিই কিনা ভুক্তভোগী!
ডক্টরের এপয়েন্টমেন্ট পেয়েই সেই যে টিকিট কেটে লকারে রেখে দিয়েছিলাম,আর ভুল টাইম স্মরণ করে, ওটাই মস্ত ভুল হয়েছে আমার। কেউ ট্রেনের টাইম যতবার জিজ্ঞাসা করেছে ততবার বলে গেছি একই সময়! এতো দিনে উল্টেপাল্টে দেখার প্রয়োজনও বোধ করিনি । কোনো সহধর্মিনী অপরিচিত সুদূরের রাতের স্টেশনে,অসুস্থ মেয়ে কোলে,সারা দিনের ক্লান্তি, হোটেলের রুম ছেড়ে দিয়ে আসা ,বাইরে বৃষ্টি,ঘড়িতে পৌনে বারোটা ছুঁই ছুঁই, মাথা ঠান্ডা করে বসে থাকবে বলতে পারেন! সুতরাং আমার কপালেও জুটেছিল ভোগান্তি সেটা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন সবাই!
রাতের অচেনা শহরের একমাত্র পরিচিত , হোটেল ম্যানেজারকে ফোন করে সব বলতেই উনি রাতেই হোটেলে আসতে বললেন। হোটেলের রুমে লজ্জা মুখ নিয়ে ফিরলাম । কি করে যে বাড়ি ফিরব আর ঠিক দুদিন পর গিন্নির স্কুল,আমার অফিস খুলে যাচ্ছে আর আমরা কিনা এতো দূরের হোটেলে রাত জাগছি চিন্তায়! টিভি টা খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ একি কান্ড , নীলম নামক সাইক্লোন ঝড়ের সূতর্কতা জারি হচ্ছে যা কিনা তীব্র বেগে আছড়ে পড়তে চলেছে তামিলনাড়ু,কর্ণাটক জুড়ে!
যত সতর্ক বাণী দেখছি টিভির পর্দায়, তত যেন মুষড়ে পড়ছি আমরা! শ্যালক ও আমার দাদা কে টিকিটের জন্য অনুরোধ করতে ওরা দুজন প্লেন,ট্রেন যা পায় তার চেষ্টা করেও বিফল হচ্ছিল। অবশেষে প্রায় দুটোর সময় দিল্লি থেকে দাদা জানালো চেন্নাই থেকে পরশু সকালের ট্রেনের টিকিট আছে। সেটা তৎক্ষণাৎ কেটে নেওয়া হলো কিন্তু এখান থেকে চেন্নাই পৌছাবো কি করে মাথা কাজ করছিল না!
ভোর হতেই পাশেই, বাস স্টান্ডে গেলাম যদি কোনো বাস থাকে চেন্নাই যাবার। কর্মীদের কথা শুনে আরো হতাশ হলাম। মাইসোর থেকে বাসে এগার ঘন্টা লাগে চেন্নাই আর এই ঝড়ের খবরে কোনো বাসই ওই রুটে যাবে না! রুমে ফিরে ডকুমেন্টস নিয়ে স্টেশন চলে গেলাম,যদি তৎকালে কোনো ট্রেনে চেন্নাই পৌঁছানো যায় এই আশায়।
তৎকালের ভিড় লাইনে দাঁড়িয়ে রইলাম বহু ক্ষন, হাতে আমার অরিজিনাল ভোটার কার্ড। সামনে তখন আর,পাঁচ জন মাত্র,কানে এলো কাউন্টারে সকলের জেরক্স কপি জমা নিচ্ছে! আমার তো শুনে বজ্রাঘাত অরিজিনাল আইডি নিয়ে আমি। দৌড় লাগালাম জেরক্সের দোকানের খোঁজে।আসে পাশে কোনো দোকান না পেয়ে সেদিন যে কত দূর দৌড়ে গেছি একমাত্র আমি জানি! দূর থেকে কাউন্টার খালি দেখে ,চেন্নাই যাবার টিকিট আছে কিনা জানতে , উনি জানালেন ,দুপুরে জন শতাব্দী এক্সপ্রেসের মাত্র দুটি টিকিট অবশিষ্ট।সেইদিনটা কোনদিন ভুলবো না দুটো টিকিট যেন টিকিট নয় কোটি টাকার সম্পত্তি ছিল আমার কাছে!
হোটেল রুম ছেড়ে ট্রেনে চেপে বসলাম। রাত্রে যখন চেন্নাই পৌছালাম,স্টেশন জুড়ে কাতারে কাতারে মানুষ,অনেক লাইন ভারী বৃষ্টি তে ডুবে গেছে! সৃষ্টি কর্তার নাম স্মরণ করে ,কাঁধে মেয়েকে বসিয়ে,আর এক হাতে ভারী লাগেজ উঁচু করে তুলে প্রায় কোমর পর্যন্ত জল টপকে হোটেল খুঁজতে বেরুলাম অতি সাবধানে একটু বৃষ্টি কমতে। হোটেলে খুঁজতে গিয়ে দেখি,নিচের তলার সব রুম জলে পরি পূর্ণ। কোনরকমে রাত কাটিয়ে,পরের দিন সক্কালে কলকাতা যাবার ট্রেনে চেপে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম ,আকাশ তখনও কালো মেঘের দখলে,থমথম করছে। সেবার এমন বিভ্রাট হলেও কি জানি এমন এডভেঞ্চার যখনই ভাবি এক অন্য রকম রোমাঞ্চিত হই, যদিও মজা লেগেছিল একথা মোটেও গিন্নি কে বলা যাবে না!
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, ভাদ্র সংখ্যা, ১৪২৫
No comments:
Post a Comment