সম্পাদকের কথা
নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা মুজনাইয়ের সকল লেখক-কবি, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য। আগামী দিনগুলি প্রত্যাশিত সুখ ও আনন্দ নিয়ে আসবে সবার জীবনে এই আশা করি।
বছর শেষে মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা একটি সংস্থায় পরিণত হয়ে মুজনাই সাহিত্য সংস্থা নামে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ইতিমধ্যে বর্ষশেষের দিন মুজনাইয়ের বার্ষিক মুদ্রিত সংখ্যা ২০১৯ প্রকাশিত হয়েছে প্রথিতযশা লেখক সম্মানীয় অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে ডঃ শেখর চক্রবর্তী, সাহিত্যিক রণজিৎ দেব, সাংবাদিক অরবিন্দ ভট্টাচার্য ও কবি অঞ্জনা দে ভৌমিকের হাত ধরে। মুজনাই সাহিত্য সংস্থার প্রথম প্রয়াস হিসেবে তরুণ কবি শুভদীপ ঘোষের একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য চর্চা, প্রকাশনা ইত্যাদির পাশাপাশি মুজনাই আগের মতোই সেবামূলক কাজ করে যাবে। ইতিমধ্যেই জয়ন্তীর বনবস্তিতে মুজনাইয়ের তরফ থেকে একটি অবৈতনিক বিদ্যালয়কে ব্ল্যাকবোর্ড প্রদান করা হয়েছে। মুদ্রিত বার্ষিক সংখ্যা বিক্রয় করে যে অর্থ সংগ্রহ হবে তাও ব্যয় করা হবে এই জাতীয় কাজে।
সবকিছু মিলে নতুন বছরে মুজনাইয়ের বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। জানা নেই তা কতটা বাস্তবায়িত হবে। তবে স্বপ্ন তো দেখতেই হয়, তা না হলে স্বপ্নপূরণ হবে কিভাবে?
মুজনাই অনলাইন পৌষ সংখ্যা, ১৪২৬
ঠিকানা - হসপিটাল রোড, কোচবিহার, ৭৩৬১০১
ইমেল ঠিকানা - mujnaisahityopotrika@gmail.com
গভ রেজিঃ নাম্বার- S0008775 OF 2019-2020
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন পৌষ সংখ্যা, ১৪২৬
ছবি
মুজনাই বার্ষিক সংখ্যা প্রকাশ
জয়ন্তী বনবস্তিতে মুজনাই থেকে ব্ল্যাকবোর্ড প্রদান
আনন্দবাজার পত্রিকার উত্তরবঙ্গ সংস্করণে প্রকাশিত মুজনাইয়ের খবর
পর্যায়- গদ্য
এই পর্যায়ে যাঁরা আছেন
লক্ষ্মী নন্দী, উদয় সাহা, শেখ এ কে এম জাকারিয়া, বটু কৃষ্ণ হালদার, সঞ্জয় কুমার মল্লিক,
শম্পা সামন্ত, শম্পা চক্রবর্তী, মৌসুমী চৌধুরী, রীতা মোদক
প্রবন্ধ
এক আদর্শ জীবন পৌষে যাঁর জন্ম
লক্ষ্মী নন্দী
অনেক বছর আগের এক একরত্তি মেয়ে। তাঁকে স্মরণ করেই এই লেখা। যাঁর জন্ম হয়েছিল ডিসেম্বর মাসেই, মানে বাংলার পৌষমাস। অর্থাৎ ( ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে ২২শে ডিসেম্বর ১২৬০ বঙ্গাব্দে ৮ই পৌষ) যিনি, জন্মের আগে তার মা স্বপ্ন দেখেছিলেন লাল কাপড় পরা অতিসুন্দরী এক কন্যা তাদের কাছে আসছেন। দরিদ্র, ঈশ্বরের ভক্ত, তার বাবা মা বিশ্বাস করেছিলেন কোনো দেবীর আগমন হতে চলেছে তাদের সংসারে। এই মেয়ের যখন জন্ম হলো হেমন্তের শেষ - শীতের আরম্ভ। গ্রামের জমির ফসল ঘরে তোলার সময়। তাই গ্রামের কৃষকেরা মাঠ থেকে ধান কেটে গোলায় রাখতে ব্যস্ত। রবীশস্যের সবুজ চারিদিকে। বাড়িতে বাড়িতে খুশির হাওয়া। ঠিক সেই সময় আনন্দমুখরিত পরিবেশে বৃহস্পতিরবার - কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে এই- এক রত্তি শিশু কন্যা ভূমিষ্ঠ হল। খুব তাড়াতাড়ি শুভ সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সময় মতোন জন্মপত্রিকা তৈরি হল। কন্যার রাশিগত নাম হল শ্রীমতী ঠাকুরমণি দেবী। তাঁর মা নাম রাখলেন ক্ষেমঙ্করী। আদর্শে আর স্নেহ ভালবাসায় ঘেরা এক দরিদ্র সংসারের প্রথম সন্তান এই মেয়ে। তাঁদের কয়েক বিঘা জমিতে ধান হলেও সংসার চলার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। তাই তার বাবা পুরোহিতের কাজ করতেন। এবং তুলার চাষও করাতেন। সেই ছোট্টো মেয়েটি তাঁর মায়ের সাথে তুলা তুলে আনতে সাহায্য করতেন। যদিও ভাইদের দেখাশুনা করার কাজও ছিল তাঁর প্রধান । তবে সব কাজেই সেই ছোটো বেলা থেকেই একেবারে পাঁকা এই মেয়ে। অবশ্য - তখন সবাই অবাক হতো এই ভেবে যে, এতোটুকু মেয়ে- বুদ্ধি খাটিয়ে কোনও কাজকে কঠিণ এবং কষ্ট মনে না করে প্রতিটা কাজ উদ্যমী হয়ে কিভাবে করে। কে এই মেয়েটি? হ্যাঁ মেয়েটির বাঁকুড়া জেলার ছোট্টো একটি গ্রাম জয়রামবাটীতে জন্ম হয়েছিল। তাঁর মা শ্যামাসুন্দরী দেবী। আর বাবা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, যাঁকে নানান গুণের জন্য সবাই খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। ১৮৬৪-৬৫ দুর্ভিক্ষের সময় যখন এই মেয়েটির বাবা অন্নসত্র খুলেছিলেন। গরম খিচুড়ি ক্ষুধার্ত মানুষের পাতে ঢালা হলে পাখার বাতাস করে খিচুড়ি ঠান্ডা করে দিতেন এই মেয়ে। আরো একটা মজার ঘটনা এই মেয়ের বয়স যখন দুই’ কি তিন বছর। তখন এক কীর্তনের আসরে তাঁকে এক প্রতিবেশী রমণী আদর করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এই যে এত লোক রয়েছে, এদের মধ্যে কাকে বিয়ে করতে ইচ্ছে হয় ?’ কচি হাত উঠিয়ে সে সময় ঐ একরত্তি মেয়ে দেখিয়েছিলেন যাঁকে , পরবর্তী সময়ে তাঁর সঙ্গেই এই মেয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় ছিল পাত্রের বয়স চব্বিশ আর পাত্রির মাত্র পাঁচ। এক বৈশাখ মাসে সদ্য ছয় বছরে পা রাখা এই মেয়ের সঙ্গে চব্বিশ বছরের যুবকের বিবাহ যেন দৈবনির্দিষ্ট নতুন ইতিহাসের সূচনা। কোলে চেপে বালিকাবধু গিয়েছিলেন শ্বশুরালয়ে। খেজুরগাছের তলায় পাকা খেজুর পরে থাকতে দেখে যে বধূ মহানন্দে তা কুড়োতে লেগেছিলেন। তাঁর নামই সারদামণি। আজ সমগ্র মানব সমাজে যিনি শ্রীমা সারদাদেবী। এক বাড়ির থেকে ধার করে আনা গহনায় যাঁকে বিয়েতে সাজানো হয়েছিল। পরে গহনাগুলি তাদের ফেরত দেওয়ার যখন সময় হলো তাঁর শাশুড়িমা চন্দ্রমণি ভেবেই আকুল এই ছোট্টো সরল বালিকার গায়ের থেকে ঐ গহনা কেমন করে খুলে নেবেন। শেষে মায়ের সমস্যা বুঝতে পেরে এই মেয়ের স্বামী গদাধর ( শ্রীরামকৃষ্ণ) নিজেই সারদা ঘুমিয়ে পড়লে গহনাগুলি খুলে মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ঘুম ভেঙ্গে গহনাগুলি নেই দেখে ছোট্ট সারদা কেঁদে একাকার। পরে ভাল অলঙ্কার পাবে বলে চন্দ্রমণি নতুন বউকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। যাই হোক বিয়ের পর সারদা তখন খুব ছোটো বলেই ফিরে আসতে হয়েছিল পিতৃগৃহে। তারপর থেকে জয়রামবাটীর গ্রামীণ পরিবেশে প্রকৃতির কোলে সারদা বড় হতে থাকেন। ধান-ভাঙ্গা, পৈতে তৈরী, গরুর জাবনা দেওয়া, - সংসারে মায়ের নানা কাজে ছোট্ট দুই হাতে সাধ্যমতো সাহায্য করতেন। গলা সমান জলে নেমে গরুর জন্য দলঘাস কেটে আনা থেকে মুনিষদের জন্য মুড়ি নিয়ে ক্ষেতে যাওয়া। ছোট্ট ভাইবোনেদের আমোদর নদীতে স্নান করতে নিয়ে যাওয়া। পঙ্গপালে কাটা ধান কুড়িয়ে ক্ষেত থেকে আনা আরো কতো কি। এই সাদাসিধে সরল মেয়েটার পুতুল খেলাও খুব প্রিয় ছিল। খেলাতে সে প্রায়ই গিন্নী সাজতেন। খেলার সময় অন্যান্য মেয়েদের মধ্যে ঝগরা হলে তিনি সুন্দর করে মিটিয়ে তাদের মধ্যে ভাব করিয়ে দিতেন। বিদ্যাশিক্ষার প্রতিও তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। অবশ্য তখন মেয়েদের লেখাপড়া শেখার বেশি চল ছিল না। তবুও বর্ণপরিচয় একটু একটু পড়তে শিখেছিলেন তাঁর ভাইদের সাথে মাঝে মাঝে পাটশালায় গিয়ে। অথচ আমরা এখন দেখি সেই মেয়ের নামের সাথে যুক্ত হয়েছে সরস্বতী নাম। সারদাস্বরস্বতী। তাঁর যখন সাত বছর বয়স একবার তাঁর স্বামী গদাধর জয়রামবাটী এসেছিলেন। তখন এই বালিকা সারদামণিকে কেউ শিখিয়ে না দিলেও শ্রীরামকৃষ্ণের অর্থাৎ তাঁর স্বামীর দু-পা ধুঁয়ে দিয়ে তাকে বাতাস করেছিলেন। দীর্ঘ তেরো চোদ্দ বছর সারদা কামারপুকুর বা জয়রামবাটী থেকে দক্ষিণেশ্বর আসা যাওয়া করেছিলেন। একবার সারদা তাদের প্রতিবেশী লক্ষীদিদি, শিবুদা ও কিছু গ্রামবাসীর সঙ্গে আসছিলেন কামারপুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বরের উদ্দেশ্যে। আরামবাগে পৌঁছানোর পর সারদার সঙ্গীরা খুনে ডাকাত অধ্যুষিত, কুখ্যাত তেলেভেলোর মাঠ সেইদিনই পেরিয়ে তারকেশ্বরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সারদা তাদের পিছুপিছু হাটলেও অক্ষমতাবশত ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছিলেন। সঙ্গীরা বুঝেছিল যে এত মন্থর গতিতে চললে সন্ধে নামার আগে ঐ কুখ্যাত প্রান্তর পার হওয়া সম্ভব হবে না। তাই সারদাও তাদের তখন বলেছিলেন তাঁর জন্য কোন দুশ্চিন্তা না করে দ্রুত তারকেশ্বরে চলে যেতে। সন্ধে নামার ঠিক আগে একাকীনি সারদার পথ রোধ করে দাড়িয়েছিল এক ডাকাত। তার কর্কশ স্বরে পরিচয় ও গন্তব্য জিজ্ঞাসায় ভীত হননি সারদা। নিজেকে মেয়ে বলে পরিচয় দিয়ে দক্ষিণেশ্বরে তার জামাইয়ের কাছে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। শ্রীমায়ের নিঃসঙ্কোচ সরল, মিষ্টি ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ডাকাতটিও তাঁকে অভয় দিয়ে নিজের স্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেই ডাকাত দম্পতি সত্যিই আদরের সঙ্গে সারদাকে মুড়ি-মুরকি খাইয়ে রাতে নিরাপদে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ও পরদিন সকালে ক্ষেতের কড়াইশুটি খাওয়াতে খাওয়াতে তারকেশ্বরে পৌঁছে দিয়েছিল। সেখানে শ্রীমায়ের সঙ্গীদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে বিদায়কালে ডাকাত দম্পতি ও শ্রীমা, উভয়ের চোখেই জল নেমে এসেছিল। অবশেষে, দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই ডাকাত দম্পতি বিদায় নিয়েছিল।পরবর্তীতে শ্রীমাকে তারা বলেছিল যে শ্রীমায়ের মধ্যে তারা দেখেছিল মা কালীকে। শ্রীরামকৃষ্ণ একবার কামারপুকুরে এসে সারদাকেও তখন শ্বশুরবাড়িতে ডেকে এনেছিলেন। সরলা কিশোরীকে নানা বিষয়ে এবং উচ্চ ধর্মজীবন লাভের জন্য কিভাবে চরিত্র গঠন করতে হয় সেই শিক্ষা দিতে। দৈনন্দিন গৃহস্থালিকর্ম, পুজা -অতিথি সেবা, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটোদের প্রতি স্নেহ, পরিবারের সেবায়, ভালো কাজে আত্মসমর্পণ ইত্যাদি বহু বিষয়ে তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন। যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন – এই নীতিকে ভিত্তি করে লোকব্যবহার, পরিবারের প্রত্যেকের রুচি, স্বভাব ও প্রয়োজন অনুযায়ী তার সঙ্গে আদান প্রদান, নৌকায় বা গাড়ীতে যাওয়ার সময় সতর্কতা, এমনকি প্রদীপের সলতেটিও কেমন করে রাখতে হয় এক নাগাড়ে সাত মাস ইত্যাদি কিছুই সেই সময় অপূর্ব শিক্ষা থেকে বাদ পড়ে নি । এর কিছুদিন পর ফলহারিণী কালীপুজোর দিন সারদাকে শ্রীরামকৃষ্ণ ত্রিপুরাসুন্দরীরূপে পুজো করেছিলেন ও তাঁর চরণে সাধনার ফল, জপের মালা সমর্পণ এবং মঙ্গলঘটের থেকে গঙ্গাজল নিয়ে দেবীকে অভিষেক করে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, "হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরী! সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত করো। ইহার (সারদাদেবীর) শরীর মনকে পবিত্র করিয়া ইহাতে আবির্ভূত হইয়া সর্বকল্যাণ সাধন কর।’ যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের পূজাতেই নাকি রামকৃষ্ণের আদর্শ সারদামণির মানবী শরীরে জগৎকল্যাণকারিণী মহাশক্তিতে বিশ্বমাতৃত্বের বীজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? যদিও কখনো কখনো প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে উত্তর। যে উত্তর পরিস্কার সারদার স্বামীর - মানে রামকৃষ্ণেরর প্রেম, ভক্তি, বিশ্বাস, ভালোবাসাতেই সারদা হয়ে উঠছিলেন সকলের মা, ‘গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়-সত্য জননী’।
বিশেষ গদ্য
ধুনকরেরা আর ঠুং ঠাং করেনা, সুপর্ণা...
উদয় সাহা
"It is worth going out in the cold for the sake of comfort of coming in..." দ্য বিশপ ক্যান্ডেলস্টিকস্ নাটকে বিশপ যখন ঘরে ফিরে তার বোনকে এই কথা বলছেন, তিনি শীতের দিনে বাড়ির অন্দরমহলের আভ্যন্তরীণ উষ্ণতার কথাই বলতে চেয়েছেন। এই উষ্ণতার সাথে জড়িয়ে আছে শীতবস্ত্র, ফায়ার প্লেস, রাতে শোওয়ার সময় নরম লেপ,কম্বল কিংবা কাঁথা, বালাপোশ প্রভৃতি। সে তো গেলো প্যারিস থেকে প্রায় তিরিশ মাইল দূরে ফ্রান্সের কথা৷ আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে বিস্তর। ঋতুর গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা কঠিন কাজ এখন। এই পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত নয় আমাদের রাজ্য তথা আমাদের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিও। আর একটু উষ্ণতার জন্য আমাদেরকেও ফিরতে হয় আমাদের নিজস্ব আস্তানায় ; প্রিয় কোন তাঁবুতে।
এখন হেমন্তকাল। হিম কুয়াশার চাদর নিয়ে অনুভবে দাঁড়িয়ে আছে এই ঋতু। ধীরেধীরে শেষ রাতে ভর করছে শীতলতা। ভোরের আলো ছড়ানোর পর শিশির বিন্দু ঝরার টুপটাপ শব্দ আর মৃদু হিম বাতাসে ঋতু বদলের খবর। তাই নতুন আবহ তৈরি হয় সময়টাতে৷
"শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা ?... " শীতের আগমনীবার্তা টের পাওয়া যাচ্ছে উত্তরের জনপদগুলোতে। ভোর রাতে শরীরে উঠছে মোটা কাঁথা বা চাদর। বাক্স বন্দী লেপ-তোষক বের হচ্ছে ঠিক করবার জন্য। আবার কেউ তৈরি করছেন নতুনভাবে। একসময় শীতের প্রকোপের হাত থেকে রক্ষা পেতে কাঁথাই ছিল অবলম্বন। কাঁথা ছিল সে সময় দেখবার মতো নিপুণ শৈলীতে তৈরি। ধনী দরিদ্র প্রত্যেকের বাড়িতেই শোভা পেত কাঁথা। এই কারণেই এখনো একটি কথা লোকমুখে প্রায়ই শোনা যায় --' বর্ষাকালে ছাতা, শীতের দিনে কাঁথা '। আর লেপ? লেপ ছিল সেইসময় আভিজাত্যের প্রতীক।
লেপ তৈরির কারিগরদের এই কাজ ঘিরেই ছিল রুজি রোজগার। মানুষের শরীরের পোশাকে পরিবর্তন আসার সঙ্গে সঙ্গে
ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ধুনকররা। কেউ রিকশা -ভ্যানে,কেউ সাইকেলে, আবার কেউ বা পায়ে হেঁটে ঘুরতেন অলিগলিতে।তুলা,কাপড়, ও ধুনার নিয়ে দরজায় কড়া নাড়তেন ধুনকররা।মুখিয়ে থাকতেন গৃহস্থ বাড়ি থেকে ডাকের আশায়। বাড়ির ছাদ আর পাড়া মহল্লা থেকে শুরু করে খোলা সড়কের মোহনায় লেপ বানিয়িদের ধোনাই যন্ত্রের ঠুং ঠাং ভেসে আসতো। প্রয়োজনের তাগিদায় ডাক পড়ত কোন বাড়ির অন্দর থেকে । এরপর শীতের পরশ লাগার আগেই বাড়ির উঠোনে কিংবা ছাদে এমনকি খোলা মাঠে ত্রিপল বিছিয়ে স্তূপাকৃতি তুলোকে ধুনে তৈরি হত লেপ।
ক্যালেন্ডারের নিয়ম মেনে প্রকৃতিতে এখন আর ঋতুর আসা- যাওয়া ঘটে না, তাই শীতের প্রকোপ সে অর্থে খুব একটা কাবু করতে পারেনা। ফলস্বরূপ ধুনকারদের দিয়ে লেপ-তোষক তৈরি করাবার উন্মাদনাও তেমন ভাবে আর দেখা যায়না। এখন বাজার দখল করেছে আধুনিক জাজিম বা ম্যাট্রেস। এছাড়াও রয়েছে বালাপোশ যা সিন্থেটিক বা হোসিয়ারি কারখানায় বাতিল কাপড় থেকে তৈরী তুলো দিয়ে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে গৃহস্থদের কাছ থেকে সিল্ক জাতীয় দুটো কাপড় নেওয়া হয় ; এই কাপড় দুটির মাঝখানে ওই সিন্থেটিক তুলো দিয়ে সেলাই করে তৈরি হয় বালাপোশ।
এমন অনেক প্রবীণ আছেন, যাঁদের কাছে লাল শালুর লেপের সাথে একটা নস্টালজিয়া কাজ করে। অন্যদিকে এই চটজলদির যুগে বর্তমান প্রজন্মের কাছে কম্বলটাই কমফোর্ট জোন ; ইদানিং কালে বাজারে হরেক রকমের বিভিন্ন দামের কম্বল পাওয়া যায়। তাই দোকানে গিয়ে রেডিমেড অথবা অনলাইন পছন্দ করে কিনে নিতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন তারা।
লাল শালুর লেপ, সুতোর আলপনা এসব এখন অতীত। একটা সময় নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সহ সামর্থ্যবান পরিবারগুলোতে শীত নিবারণে লেপ বানানোর ধূম লেগে যেত। হাঁড় কাঁপানো শীত না এলেও শীতের আমেজটা অল্প অল্প করে প্রতিদিন বাড়ার সাথে সাথে উত্তরের জেলাগুলো থেকে শুরু করে মহকুমা ও গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়ে যেত শীতকে বরণ করে নেবার উজ্জ্বল প্রস্তুতি। 'মাঘের শীতে বাঘে কাঁপে ' প্রবাদবাক্যটি সত্যি হয়ে ধরা দেবার আগেই দেখা যেত ধুনকররা তুলার স্তূপ করে তার ওপর চ্যাপ্টা আকৃতির কাঠের পাটাতন দিয়ে তুলোধুনো করছেন। পুরোপুরি সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে সেই তুলো ঢোকানো হ'ত নানান রঙের কাপড়ের তৈরি লেপ-তোষকের কভারে। এরপর শুরু হ'ত সুঁই-সুতোর নকশা ;সেলাইয়ে বাঁধা পড়ত তুলো। লেপ-তোষক রেডি হয়ে যেত কাঙ্ক্ষিত ওম ছড়িয়ে দেবার জন্য৷
লেপ-তোষক তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন বহু মানুষ। আজ শুধুই হতাশার অ্যানাটমি। প্রতিবছর পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড, মজঃফরপুর, বেগুসরাই, সমস্তিপুর, মোতিহারি থেকে ধুনকররা এসে উত্তরের রাস্তায় রাস্তায়
ঠুং ঠাং শব্দ তুলতেন। এদের পরনে থাকত লুঙ্গি আর হাতওয়ালা গেঞ্জি কিংবা ফতুয়া। একটু বেশি মুনাফা লাভের আশায় ফিবছর তারা শীতের আগ দিয়ে এতদঅঞ্চলে চলে আসতেন লেপ বানাতে৷ সারাদিন কাজ করতেন। নাওয়া খাওয়ার সময় পেতেন না। এক পাড়ায় ঢুকলে সেখানেই চার-পাঁঁচটা লেপ তৈরি করে ফেলতেন৷ সাথে অর্ডার নিয়ে যেতেন পরের কাজের।
তবে এখনও একেবারে লেপ তৈরি বন্ধ হয়ে যায়নি। কারণ এখনো অনেকেই পছন্দ করেন শীতের লেপকে। বিয়ের তত্ত্ব হিসেবে নিয়ম করে লেপ তৈরি করাতে দ্বিধা করেননা তারা। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে একটা লেপ বানাতে অনেকটাই ব্যয় হয়। পাশাপাশি শীতের প্রকোপ আর আগের মতন নেই৷ তাই লেপ তৈরির আগ্রহতে ভাটা পড়ার বিষয়টি যথেষ্ট লক্ষ্যণীয়।
প্রসঙ্গত এই শিল্পের পিছিয়ে পড়ার আরো কিছু বিশেষ দিক রয়েছে। একসময় ছোটবেলায় পারিবারিক সূত্রে কাজ শেখা ধুনকরেরা পরম্পরা মেনেই তাঁদের পূর্বসূরিদের ধারা বজায় রাখতেন। কিন্তু এখনকার প্রজন্ম এই ধুলো ঘাঁটাঘাঁটির কাজ করতে আগ্রহী নয়। এদিকে খোলা বাজারে ক্রমশ বেড়েই চলেছে তুলোর দাম। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে ব্যবসায় লাভ কমে এসেছে। এর মধ্যে আছে সুতো, কাপড় ও মজুরির ব্যয়ভার।
কিন্তু হায়! একটা জীবন থেকে আরেকটা জীবন কতদূর ? ' কথা নেই গানও সব হেসে খেলে হারিয়ে গিয়েছে '... আর এসব ভাবতে ভাবতেই দিন ফুরিয়ে আসে। পাল্টে যায় জীবন। রঙ লাগে আমাদের রুচি এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে। একটা সময় হাফ প্যান্ট পরে এক তারওয়ালা গিটারিস্টদের (পড়ুন ধুনকারদের)
পেছন পেছন দৌঁড়েছি কত কত দিন। সেই লাল শালু আর বস্তা তুলোর শীত এখন শুধুই স্মৃতির পাতায়। নতুন দিন এসেছে ; তাকে বুঝে নিচ্ছি।তার সাথেই বসবাস করছি এখন। ধুনকরেরা আর ঠুং ঠাং করেনা, সুপর্ণা ...
নিবন্ধ
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা
শেখ একেএম জাকারিয়া
বাঙালি সমাজজীবনে শ্ৰেষ্ঠ একটি শব্দ নারী। পুরুষের পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা অমত প্রকাশ করার কোনও জো নেই। এ দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে নারীর অবদান বিশদ আলোচনা করলে দেখা যায়, নারী তার সব সামৰ্থ্য প্রয়োগ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরিতে। ১৯৭১ সালে জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন অগণিত বাঙালি নারী। অথচ আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর অবদান সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। নারীর অবদান একমাত্র লাঞ্চিত ও ধর্ষিত হওয়ার মধ্যেই নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিবৃতিতে নারীকে মৌলিক-ধারায় নিয়ে না আসার একটি যুক্তি হচ্ছে,এ যুদ্ধে ব্যাপ্ত পরিসরে অসচ্ছল, অশিক্ষিত, নিচুশ্রেণির নারীরা অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এসব নারীদের ইতিহাস শিষ্ট ও বিদ্বজ্জন জাতির কাছে ইতিহাসরূপে গৃহীত হতে শুরু করে বাংলাদেশ হওয়ার প্রায় তিন দশক পর। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহন সম্পর্কে গবেষণাধর্মী কাজ চালু হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে 'মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহন' এমন সংবাদ বিস্তৃত পরিসরে প্রচার হয়নি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, কিছু নারী যোদ্ধা আছেন যাদেরকে নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ হয়েছে, জাতীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন। আবার কিছু নারী যোদ্ধা আছেন যাদেরকে নিয়ে এই সময়ে কাজ শুরু করেছেন কিছু তরুণ গবেষক। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ধর্ষণের ঘটনাই চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে প্রচারিত হয়েছে সব থেকে বেশি। আর এ কারণেই সম্ভবত রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে স্কুলকলেজ-ভার্সিটির ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষিকরা মঞ্চে ওঠেই অনর্গল বলতে থাকেন, তিরিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোন, বউ-ঝির ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। যুদ্ধের সময় বাঙালি নারীরা আমাদের অনেক বড় সহায়-শক্তি ছিল একথা অনেকেই ভুলে গেছেন। এ নারীরা কখনও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নিয়েছেন আবার কখনওবা যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন । দুঃসাহসী নারীরা যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবে কাজ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। বহু নারী আছেন যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন, সেবা-শুশ্রূষা করেছেন,অনাহারী-অর্ধাহারী ক্ষুধার্থ মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কখনও মমতাময়ী মায়ের মত, কখনওবা বোনের মত। নিজে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।এক কথায় মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান অনস্বীকার্য।পুরুষের পাশাপাশি নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সাহসের ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। যুদ্ধের সময় অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক বাঙালি নারী। তাঁদের মধ্যে কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা প্রমুখ উল্লেখ্য। এসব নারীগণ সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গোবরা, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। গোবরা ক্যাম্পে মেয়েদের দেয়া হতো তিন রকম ট্রেনিং। যেমন, সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং, অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসংখ্য নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী শিল্পী। তা ছাড়া যুদ্ধ চলাকালে অনেক নারী কবি, লেখক, সাংবাদিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। তাদের লেখায় ও শিল্পীদের গানে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। শুধু তাই নয় শহর-গ্রামের পথেঘাটে, গান পরিবেশন করে অনেকেই অর্থ যোগাড় করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের এত অবদান থাক স্বত্বেও নারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ কোনও স্বীকৃতি পাননি। অনেক নারীযোদ্ধাই সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছেন কেউ তাদের খবরও রাখেনি।
ইচ্ছাশক্তির ডানায় ভর করে এভাবে শিবাঙ্গী স্বরূপরা জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়
বটু কৃষ্ণ হালদার
নারী সম্পর্কে বিদ্রোহী কবি যথার্থ বাণী"রাজা করিছে রাজ্য শাসন,রাজারে শাসিছে রানী/রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে /রাজ্যের যত গ্লানি"। রাজ্যের রানী যদি ভাল হয় প্রজারা মহা সুখে থাকবে। না এ দেশের রানীরা আজ সুখে নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা বারবার পুরুষদের রোষানলের শিকার হচ্ছে। সেই জায়গা থেকে শিবাঙ্গী স্বরূপ এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি। একটি দেশের জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নারী জাতি মানব সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ সমাজের বুকে নারীর মর্যাদা ও অধিকার পুরুষদের সমান। তাদেরও রয়েছে মৌলিক অধিকার। একটি নারী অদম্য শক্তি ও সম্ভাবনার অধিকারিনী। তাদের মান,মেধা,চিন্তা-চেতনা,প্রজ্ঞা ধী_শক্তি, সৃষ্টিশীলতা ব্যক্তিত্ব ও অভিব্যক্তি একটা পুরুষের চেয়ে কম নয়। তেমনি বর্তমান সমাজের বুকে নারী শুধু মাত্র ভোগ্য,আমদানি-রপ্তানি র পণ্য নয়। তাদের মধ্যে রয়েছে সুপ্ত প্রতিভা।তারাও শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি লাভ করে জলে,স্থলে অন্তরীক্ষে তাদের অবদানের স্বাক্ষর রেখেছে। পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উঠে আসছে সমাজের উচ্চ স্তরে। মেরি কম,পি টি ঊষা,কল্পনা চাওলা,দীপিকা কর্মকার,হিমা দাস, বুলা চৌধুরী, ঝুলন গোস্বামী রা নিজেদের ইচ্ছা শক্তির জোরে বারবার দেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে। নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে নজির গড়েছেন।তবুও পুরুষতান্ত্রিক শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারীকে কেবল ব্যথা-বেদনা নির্মম অভিশাপ বহন করতে হচ্ছে। পুরুষদের পক্ষপাত দুষ্ট তার জন্য নারীসমাজ মুক্তির মিছিলে সামিল হতে পারেনি। বন্ধ্যা শাসন ও নিপীড়ন নির্যাতিত বঞ্চনার শিকার হয়ে ধর্ষণের মতো চরম দুর্ভোগে কে বরণ করে নিচ্ছে। একটি গাছের মধ্যে যেমন রয়েছে সম্ভাবনাময় অন্তর্নিহিত শক্তি। তেমনি এই সমাজের জীবন চক্রের এক বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে নারীর অবদান। একথা অনস্বীকার্য।তাইতো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চিত্রাঙ্গদা নাটকে চিত্রাঙ্গদার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন"মোরে পূজা করবে সেও আমি নই/বিপদে সংকটে মরে পাশে রেখো/তবে পাইবে মোর পরিচয়"।
বর্তমান সমাজ পরিস্থিতি ধর্ষণ কাণ্ডে উত্তাল। ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে চলছে অনশন,আন্দোলন। ঠিক সেই মুহুর্তে সমাজের বুকে এক নারী ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। বিহারের কন্যা শিবাঙ্গী স্বরূপ। দেশের প্রতিরক্ষায় নিবেদিত তার গোটা পরিবার। বাবা জ্ঞান স্বরূপ নৌসেনার অফিসার।মা কল্পনা স্বরূপ বিশাখাপত্তনমে নেভি চিল্ড্রেন স্কুলের শিক্ষিকা। ছোট্ট শিবাঙ্গী র কাছে বাবা-মা ছিল তার প্রেরণা। খুব ছোটবেলা থেকেই বাবাকে নিজের কর্তব্যে একনিষ্ঠ থাকতে দেখেছেন। তবে সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে এমন স্বপ্ন কল্পনা করতে পারেনি। নৌ সেনা অফিসারের মেয়ে শিবাঙ্গী ছোটবেলা থেকে শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় ছিলেন সমান পারদর্শী। জাতীয় তাইকোন্ডো চ্যাম্পিয়নশিপে সোনার মেডেল জয়ী শিবাঙ্গী একজন দক্ষ ড্রাইভার। বিহারের অগ্নিকন্যা ইতিহাস লিখেছেন শিবাঙ্গী স্বরূপ। ডরনিয়ে টুইন টার্বোপ্রপ এয়ারক্রাফটের ককপিটে বসে চব্বিশের তরুণী বলেছেন_"দেশ বিশ্বাস করেছে আমাকে।অনেক দায়িত্ব।জীবনের অনেক বড় সম্মান"।সবকিছু তোমার পিছনে ফেলে দেশের প্রতিরক্ষায় এক নতুন মাইলফলক সাব-লেফটেন্যান্ট শিবাঙ্গী স্বরূপ। ভারতীয় নৌসেনার প্রথম মহিলা পাইলট।যিনি ভারতের গর্ব। প্রশিক্ষণ পর্ব যথেষ্ট কঠিন ছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। নৌ বাহিনী একাডেমিতে ২৭ এনওসি ব্যাচ এ প্রশিক্ষণ শুরু হয়। শিবাঙ্গীর কথায় "একবারও মনে হয়নি আমি একা মেয়ে বাকিরা পুরুষ"। স্কোয়াড্রন ও প্রশিক্ষকদের ব্যবস্থা,সহযোগিতায় সব বাধা বিপত্তি কাটিয়ে স্বপ্নের উড়ানে নিজেকে ভাসিয়ে দেন। প্রশিক্ষনে কোথাও লিঙ্গ ভেদ করা হয়নি। যতটা কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে পুরুষদের ঠিক ততটাই আমাকে। প্রশিক্ষণ কমান্ডারের কথা অনুযায়ী শিবাঙ্গী ফিজিক্যালি খুব ফিট। প্রচণ্ড সাহসী একটা মেয়ে। বিপদ দেখলেই মোকাবিলা করবে। অফিসারদের এই আত্মবিশ্বাস তার চলার পথকে আরও সুগম করে তুলবে, এটা নিশ্চিত। শিবাঙ্গী স্বর্গের মতো দেশের অন্যান্য মহিলারা এমনিভাবে সমস্ত বাধা বিপত্তি কাটিয়ে দেশের উচ্চস্তরের মনি কোঠায় উঠে আসবে এমনটাই আশা করা যায়।
ধর্ম ও বিজ্ঞান
সঞ্জয় কুমার মল্লিক
পুরান মতে জলকে বলা হয় গঙ্গা।গঙ্গা যেদিকে বয়ে যায় তাকে বলছে গঙ্গা নদী।এখানেও নাম নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বলি গোদাবরী নদীকেও দক্ষিণের গঙ্গা বলা হয় । জলে হাত পা ধুয়ে নিলে বা স্নান করলে শরীর পবিত্র হয়ে যায়।এখানে পবিত্র হয়ে যায় মানে, নোংরা বা জীবাণু মুক্তের কথাই বলা হয়েছে।
বিজ্ঞান মতে প্রায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক জিনিসে ছোঁয়া লাগলে জলে ধুয়ে নিলে তার ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।কারন জলে দ্রবীভূত হওয়া।আবার জীবাণু থাকলে তা জলে ধোয়া হয়ে যায়।
এবার আসি জলের উৎস নিয়ে।পুরান মতে জল বা গঙ্গা তিনপ্রকার আকাশগঙ্গা,মর্তের গঙ্গা ও পাতাল গঙ্গা। বিজ্ঞান মতে জল বাষ্প আকারে মেঘ হয়ে আকাশে ঘুরে বেড়ায়, পৃথিবীর উপরিভাগের জলস্তর ও ভূগর্ভস্থ জলস্তর।বেশীর ভাগ সময় পাহাড় চূড়ায়(কৈলাশ পর্বতে শিবের জটায়) মেঘ জমে বরফ হয় ও সেই বরফ গলে নদী(ভাগীরথী,ভগীরথ শঙ্খ বাজিয়ে মর্তে বা সাগরের নিয়ে যায়, ও গঙ্গা ) আকারে সাগরে গিয়ে মিশে যায়।
কাউকে পুরান দিনের দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা মাথায় রেখে এই লেখাটি নয় বরং জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইন্টাইনের নিম্নলিখিত উক্তিটির কথা মাথায় রেখে এই লেখাটি লিখতে ইচ্ছে করল।
"Science without religion is lame, religion without science is blind." Albert Einstein
নিথর দেহ
শম্পা সামন্ত
হিন্দু সম্প্রদায়ের সন্তান,তবু আজও তারা মাটির নিচে শায়িত।শুধুমাত্র বিচারের আশায়, দুই মা বুকে পাথর চেপে তাদের মৃত সন্তানদের কবর আঁকড়ে বসে আছে।
কি হয়েছিল সেদিন, স্কুল থেকে কেন ফিরলো তাদের মৃত দেহ?এর কোনো উত্তর কারোর জানা নেই। তবে সেইদিন সবাই কেন চিৎকার করে বলেছিল আমরা এর বিচার চাই!যে দল এই ঘৃন্য অপরাধ করেছে তাদের শাস্তি চাই, এমনকি দিনের পর দিন ধর্মঘট চললো। আজ এক পার্টির লোকেরা এসে বলে আমরা তোমাদের পাশে আছি, কাল আর এক পার্টির লোক বলে অপরাধীরা শাস্তি পাবে।
মৃত সন্তানের বাবা-মা নির্বাক হয়ে তাদের মুখপানে তাকিয়ে অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকে।আর চিৎকার করে বলে,"ঈশ্বর এ কোন অপরাধের শাস্তি"!!!
তবে প্রশ্ন হল, জনগণের সেবায় যারা নিয়োজিত সেই পুলিশের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও স্কুল প্রাঙ্গণে এমন মর্মান্তিক ঘটনা কিভাবে ঘটলো।
অনেক দিন হয়ে গেল কিন্তু আর কেউ আসেনা সেই স্থানে যেখানে বিষাক্ত বোমায় নীল হয়ে গিয়েছিল দুই তাজা প্রাণ। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেছে তাদের শরীর থেকে বয়ে যাওয়া রক্তের স্রোত। হয়তো সেখানে অনেক আগাছাও গজিয়ে উঠেছে।
সবাই ভুলে গেছে কিন্তু সেই মৃত সন্তানদের বাবা-মা,আজও শুনতে পায় কবর থেকে কারা যেন বলতে থাকে,"মা আমি তো কিছু করিনি, তবে কেন..?"
কোথায় গেল মুখোশ পরা মানুষের দল ...
গল্প
"আহ্বান"
শম্পা চক্রবর্তী
( মফস্বলের অনিন্দ্য ভালোবেসেছিল সল্টলেকের সুলগ্নাকে। আট বছরের নিটোল প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিল ওরা। ভাস্কর অনিন্দ্য মূর্তি গড়তে গড়তে অগোছালো জীবন বেছে নিয়েছিল।শিক্ষিতা ও সুন্দরী সুলগ্নাকে বাধ্য হয়ে বাড়ির কথামতো মালাবদল করতে হয়েছিল অপছন্দের এক পাত্রের সঙ্গে। ও এখন বিবাহসূত্রে মার্কিন নাগরিক। সানদিয়াগোর স্বচ্ছল পরিবারের গৃহিণী এবং তিন সন্তানের জননী। আপাত সুখের সংসারে নিমজ্জিতা।ওদিকে অনিন্দ্য অবিবাহিত। বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে বাস। কয়েকবার ঠিকানা জোগাড় করে চিঠিও লিখেছিল সে কিন্তু সাড়া দেয়নি সুলগ্না। প্রায় পঁচিশ বছর পর ফেসবুকে একে অপরকে খুঁজে পায়। অন্তত একবারের জন্য হলেও এই পড়ন্তবেলায় অনিন্দ্য কাছে পেতে চায় সুলগ্নাকে। ই-মেইলে একদিন হঠাৎ সে সুলগ্নাকে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করে। তারপর…..)
সুলগ্নাঃ- ভাঙাচোরা সময়ের হাত ধরে এই স্তিমিত বেলায় চুপিচুপি আবার কেন এলে? কতবার আমাকে জাগাবে অনিন্দ্য? যতবার জাগিয়েছ ততবার আমার ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে নদীর দীঘল বাঁকে কিশোরী পাতাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া আমাদের বল্গাহীন বিগত যৌবন।
অনিন্দ্যঃ- জাগানো নয় সুলগ্না, দুরন্ত আহ্বান। হয়তো শেষবারের মতো।কুয়াশা ভেঙে ভেঙে যে পথ চলে গেছে তারাখসা দিগন্তের দিকে, সে পথে এখন বেদনার ভারে নত অলকানন্দার সপ্তস্বরা রাগিনীর মূর্চ্ছনা।আঁজলা ভরে জল তুলি।জলের ভিতরে নেফারতিতির মতো চেয়ে থাকো তুমি।
একেক সময় মনে হয় তোমার হৃদপিন্ডের ভিতর ভালোবাসার পতাকাটা ওড়াতে চেয়েও পারিনি। ভাবতাম পতাকা উড়ছে—আমি স্বর্গরাজ্য জয় করেছি কিন্তু সে ভাবনা ছিল ভুল। তাই হয়তো ছিন্ন সুতোয় নিজেকে গেঁথে মৎস্যগন্ধা কিংবা শঙ্খচিল হয়ে চলে গেছো সানদিয়াগোয়। তোমাকে প্রতিদিন ছুঁয়ে যায় সমুদ্রসৈকত— অনন্তজল। আমাকে দিয়ে গেছো সূর্যডোবা অগাধবিকেল।
সুলগ্নাঃ- ভুলিনি কিছুই। সবটুকু জড়িয়ে রেখেছি মেহগনি জ্যোৎস্নায়।আষাঢ়ের মেঘবৃষ্টিতে ভিজে বুকের কলস ভরে শূন্যতা রেখেছি শুধু। ইচ্ছে করছে তেইশের বর্ষার মতো একবার….. আরো একবার…… সেই মধ্যদুপুর— ঘাসডোবা জল— থইথই মেঠোপথ— আকাশভাঙা বৃষ্টির নিচে হাতের পরে হাত। আলিঙ্গনে শরীর বেয়ে সুগন্ধী নীলজল— তোমার অবগাহন— কাগজের নৌকায় ভেসে যাওয়া আমাদের ঠিকানা। মনে আছে বাড়ি ফিরে ইনফ্লুয়েঞ্জা, বিছানায় ঘর।অনিন্দ্য, তুমি কি আজও বৃষ্টিভেজা ধূ ধূ বালুচর?
অনিন্দ্যঃ- আগের মতোই কবিতার শাড়িতে মোড়া রয়েছ দেখছি। বদলাওনি একটুও।বয়স বেড়ে গেছে আমাদের তবুও অকারণ হাসি থেকে অভিমানী কান্না— আগলে রেখেছি সব।এখনো চিলেকোঠার ঘরে থরেথরে সাজানো দুপুরের ডাকে আসা সাদা-নীল খাম— ভিতরে তীব্র দহন— পাট পাট করে তুলেরাখা আমার ধূলোঝড় জীবন।
থাক ওসব।
হাসি-গান, আলো, কাজ সব নিয়ে তোমার গোছানো গৃহকোণের গল্প বলো।
সুলগ্নাঃ- গৃহকোণের গল্পে যে একটাও বৃষ্টির ফোঁটা নেই নিজেকে ভেজাবার। একটাও নদী নেই নিজেকে ভাসাবার।অথচ… অথচ জানো অনিন্দ্য, প্রায়ই জানলা খুললেই ভিজে অন্ধকারে শুনতে পাই জীবনের জল কেটে ছপ্ ছপ্ করে এগিয়ে চলা দাঁড়ের শব্দ।কোথা থেকে কোথায় যে ভেসে যায় কার সুরের সাম্পান জানিনা (দীর্ঘশ্বাস)।ভেসে যায় কোন এক জনহীন ঘাটের কাছে !!
অনিন্দ্যঃ- নির্জনতার ভিতরেই তো বয়ে চলে দীর্ঘ একটা নদী আর তার নিচে পড়ে থাকে বিচিত্র সম্পর্কের নুড়িপাথর।ছুঁতে চাওয়ার এবং ছুঁতে না পারার সম্পর্ক।
সুলগ্নাঃ- ওসবে আমি বিশ্বাস করি না। বেশিরভাগ সম্পর্কই জীবনের শেষপ্রান্তে গিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়, ধূলো হয়ে মিশে যায় হেমন্তের সন্ধ্যায়। সম্পর্কের গভীরে থেকে যায় বিবর্ণ শালিখের শব্দহীন ডানার ঝাপট। সে বড় কষ্টের।তার চেয়ে সম্পর্কহীন জীবন ঢের ভালো।
অনিন্দ্যঃ- ভুল। মস্তবড়ো ভুল সুলগ্না। সম্পর্কহীন জীবনের রঙ পাংশুটে, নিস্প্রভ।মানুষ নিজের অজান্তে নিজেরই মধ্যে বিষাদের ও আনন্দের, বিনিসুতোয় সম্পর্কের গাঢ় নকশা বোনে— সে সম্পর্ক ভালোই হোক আর মন্দই হোক, কাছেরই হোক বা দূরের।
সুলগ্নাঃ- এবার সম্পর্কের কথা না হয় থাক। জায়মান ভালোবাসার কাছে সমর্পণের প্রত্যাশায় ক্রমশ ভাঙতে থাকে যে জীবন তার গল্প বলো।
অনিন্দ্যঃ- ধূলোয় ধূলো ওড়া সেই লালপাহাড়ের গল্প বলি তাহলে ? যোগীমারা গুহা…..যোগীমহেশ্বরের মন্দির….. যেখানে খোদাই করা— "সুতনুকা নাম দেবদাসিক্য ত্বং কাময়িত্থ বালানশেয়ে দেবদিন্নে নাম লুপদকখে।" (দেবদাসী সুতনুকা তরুণ রূপদক্ষ দেবদিন্নকে ভালোবেসেছিল।)
সুচারুদার বাড়িতে কিন্তু দারুণ আড্ডা জমতো এদের নিয়ে। মনের মধ্যে দেবদিন্ন উঁকি দিত। সেদিন আড্ডা শেষ…... জ্যোৎস্নাভেজা ত্রয়োদশীর চাঁদ ..……হাস্নুহানার গন্ধ…... আচ্ছা, তোমার পিঠের সেই জরুলটা এখনো সেরকমই আছে?
সুলগ্নাঃ- কেবলই ফেলে আসা স্মৃতি-মঞ্জুষার আবরণ উন্মোচন !! কেবলই টুকরো টুকরো আবেগের ভাস্কর্য নির্মাণ !! দুষ্টু কোথাকার।
অনিন্দ্যঃ- দুষ্টুমি করার সুযোগ দিলে কোথায়? তার আগেই তো রাজপুত্তুরের পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে সাতসমুদ্র তেরো নদীর পারে চলে গেলে আরেকটা বর্ণিল জীবনের আশায়।
সুলগ্নাঃ- যেতে চাইনি। বাধ্য হয়েছিলাম । চলতে চলতে কখন যে ভিড়ের মধ্যে হাত ছেড়ে দিয়েছিলে !! হারিয়ে গিয়েছিলাম। খোঁজোনি।
অনিন্দ্যঃ- ইচ্ছে করে হারিয়ে ফেলেছিলাম বলেই খুঁজিনি। কারণ তোমাকে রাখার উপযুক্ত ঘর আমার ছিল না।
সুলগ্নাঃ- সিংহাসন চাইনি তো, চেয়েছিলাম স্বপ্নে মোড়া একটা খড়কুটোর বাসা। না হয় ঝড়ে সে বাসা ভাঙত, আমরা সব নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তাম, তারপর ডানার আদরে নতুন বাসা বাঁধতাম। খুব কি ক্ষতি হোত অনিন্দ্য? চাওনি সে জীবন?
অনিন্দ্যঃ- চেয়েও চাইনি।
সুলগ্নাঃ- কেন?
অনিন্দ্যঃ- বাসা বাঁধার জীবন আমার নয় সুলগ্না।
তোমার বিয়ের খবর পেয়েছিলাম প্রতীকের কাছে। তারপর থেকে আমিও ভালো থাকিনি। ওয়ার্কশপ্ , এক্সহিবিশন্ সব—স-অব উপেক্ষা করেছি। একটা অসম্পূর্ণ মূর্তি তৈরী করেছিলাম যার প্রতিটি খাঁজে তোমার আঁচলখোলা রৌদ্রস্নাত যৌবন।রেখায় রেখায় আলিঙ্গনের অঙ্গীকার ও স্বপ্নের প্রত্যাশা। চিবুকে দুঃসাহসিক প্রেম।
সুলগ্নাঃ- আজও বুকের ভিতর এক অযুত ভালোবাসা নিয়ে বসে আছো তুমি!! এখন বুঝি বাসার ছোট পরিসরে তোমাকে ধরে না।তুমি যে শিল্পী।
অনিন্দ্যঃ- সুলগ্না, আর একটিবার সুতনুকা হও। শেষবারের মতো তোমার মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে শিহরিত হই, তোমার মৃত্যুঞ্জয়ী মূর্তির নিচে হাঁটুমুড়ে বসি।নিরাবরণা হয়ে একবার এসে দাঁড়াও আমার সামনে।আঘাতে আঘাতে গড়ে তুলি অহঙ্কারবিহীন অলঙ্কারে মোড়া তোমাকে যাতে আলো থাকবে কিন্তু দহন থাকবে না।
সুলগ্নাঃ- হয়তো কিছুই থাকবে না, হয়তো বা থাকবেও। আমারও যে ইচ্ছেহয় এই অবেলায় আমার তৃষিত ঠোঁটে প্লাবন হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো, অবিরাম স্রোতের মতো সন্তর্পণে মিশে যাই জলের ভিতর।
অনিন্দ্যঃ- এখনো— বিশ্বাস করো— প্রতি পলে তোমার ছবি আঁকি, মুছি। ভেনাসের মূর্তির মতো তোমাকে গড়ি, আবার ভাঙি। কখন যেন রাত নামে। শিশিরের জলে ঘাসফুল যৌবনবতী হয়। সপ্তপর্ণী ঝরে পড়ে গভীর স্তব্ধতায় আর আমি নক্ষত্র ছুঁতে যাওয়া ব্যর্থ প্রেমিকের মতো শূন্যে ঝুলে থাকি।
সুলগ্নাঃ- ভাঙব বললেই কি সবটুকু ভাঙা যায় অনিন্দ্য? কিছুটা অস্তিত্ব পড়ে থাকে বৈকি।
জীবন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। বাকি সময়ে সেই অস্তিত্বটুকু সঙ্গে নিয়ে আমরা কি পারিনা পরিব্রাজকের জীবনবৃত্তে মিশে যেতে? পারিনা ছড়িয়ে দিতে প্রেম ও বিশ্বাসের নিখাদ নির্যাস?
অনিন্দ্যঃ- পারব বলেই অন্ধকার দেশ ছেড়ে শব্দহীন জলস্রোতে অনেকটা ভেসে এসেছি।এখন শুধু তোমার সান দিয়েগোর "সান ক্লিফট্" এ দাঁড়িয়ে গোধূলির আলোয় ভিজতে চাইছি যেমন করে বকেরা ভেজে।
সুলগ্নাঃ-
"প্রগাঢ় মুগ্ধতা দিয়ে ধুয়ে দেব অপেক্ষার দিন
এসো আজ চোখ রাখো চোখের ভিতর
সমুদ্র উঠুক কেঁপে জলের ডানায়
ডেকে নিক জলোচ্ছ্বাস আমাদের সামান্য জীবন।"
-------------+++-----------++ ----------
কবিতা ঋণ— কবি রেহান কৌশিক।
বিচার
মৌসুমী চৌধুরী
তখন তার বয়স ছিল বছর দশ। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। নন্দিতার ঊনত্রিশ, সদ্য যোগদান করছে বিদ্যালয়ে। প্রথম থেকে সে মেয়েটির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করত। অদ্ভুত এক চোরা টান যেন!
এ বছর মেয়েটি ছিল নবম শ্রেণিতে।
--"কি রে খেয়েছিস?"
আড়ষ্ট মুখখানি নীচু। মাটিতে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটছে। একেবারে নীরব, আরক্ত মুখ।
--"সকালে প্র্যাকটিসে গিয়েছিলি?"
মুখ নিচু। নিচু স্বরে উত্তর দিল, " না।"
-"কেন?"
মাথা যেন একেবারে মিশে যেতে যেতে চাইছে
মাটিতে, "মা বারণ করেছে। তাই লুকিয়ে যাই প্র্যাকটিসে।"
--"কেন? কেন?"
উত্তর আসে, "ওসব নাকি ছেলেদের খেলা।"
অসহায় গলায় নন্দিতা জিজ্ঞেস করে, "তোর খেলতে ইচ্ছে করে না?"
মাথাটা একেবারে নব্বই ডিগ্রী ঘুরে গেল, "হ্যাঁ--আ--তো!"
--"বেশ, এখন বাড়ি যা। আজ বিকেলে তোর মায়ের সঙ্গে কথা বলব ছুটির পর। নে, এখন এই খামটা ধর।"
--"এর ভেতরে কি আছে, দিদিমণি?"
---"কিছু টাকা। এটা দিয়ে কলা, ডিম, দুধ, চিকেন কিনে খাবি একটু। বলবি মাকে। মনে রাখিস, এ বছর তুই জেলা মহিলা ফুটবল দলে চান্স পেয়েছিস।"
মাথা নেড়ে নীরবে সম্মতিসূচক ভঙ্গি প্রকাশ করে চলে গিয়েছিল বিপাশা। চলার ছন্দে খুুশির ঝিলিক। যেন বিপাশা একটি তরঙ্গিনী নদীর নাম।
ঘন সবুজ মাঠে বিপাশা যখন ফুটবল খেলতে নামত চোখ জুড়িয়ে যেত নন্দিতার। অসাাধারণ একজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। ট্যাকলিং, ড্রিবল, শ্যুট, পাসিং-এ অত্যন্ত দক্ষ।একজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার খেলোয়াড়ের মূল দায়িত্ব হল নিজ দলের জন্য গোলের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। এমনকি বিপক্ষকে গোল দেওয়াও। তাই বিপাশা মাঠে নামা মানেই ছিল অন্য পক্ষকে গোল দিয়ে হারিয়ে ভূত করে দেওয়া।
খবরের কাগজে, পত্রপত্রিকায়, টিভিতে বুঁদ হয়ে মেয়েটা শুধু খুঁজতে থাকত ফুটবলের খবর। বর্তমান সময়ের সেরা অ্যাটাকিং মিড ফিল্ডার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, সেস ফ্যাব্রিগাস, ডেভিড সিলভা, লুকা মাদ্রিচ -- এইসব নামগুলো শুনলে মুখ চকচক করে উঠত। বিপাশার স্বপ্ন ছিল ওঁদের উচ্চতাকে ছোঁওয়ার।
বিপাশাদের গ্রামে সেদিন "এম.পি কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট"-এর সাজো সাজো রব। সকাল থেকে ছটফটে হরিণীর মতো আনন্দে ছুটে বেড়াচ্ছিল বিপাশা। বিভিন্ন ব্লকের বহু ক্লাব অংশ নিয়েছিল সেই ফুটবল প্রতিযো- গিতায়। দিন-রাতের খেলা। খেলা শুরু হয়ে- ছিল বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ। খেলাকে কেন্দ্র করে সেখানে বহু বহিরাগতর সমাগম হয়েছিল। আর ছিল এম.পি তহবিলের বদান্যতায় মাঠের পাশে স্টল। সেখানে ঢালাও খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন --- চিকেন পাকোড়া, কফি, কুলফি ইত্যাদি। তাই গোটা এলাকায় ছিল থিকথিকে ভীড়। খেলার বিরতিতে বিপাশা গিয়েছিল পাকোড়া খেতে। সেখান থেকে ভীড়ের মধ্যে মুখ চেপে তাকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছিল নিজের গ্রামেরই একজন যুবক আর তার ষাট বছর বয়সের বাবা।
পরেরদিন পুলিশ এসে বাবা-ছেলেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। কিছুদিন পর তাদের জামিনও হয়ে যায় । ষাট বছর এখন নাতির হাত ধরে প্রাতঃভ্রমণে বের হন। আর, তার পঁয়ত্রিশ বছরের ছেলেটি সপরিবারে পুরী ভ্রমণে যান ।
ফি-মাসে সুবিচারের আশায় আদালতের দোরগোড়ায় চক্কর কাটে বিপাশার মা-বাবা। পাড়ার রাজনৈতিক দাদারা ঝামেলায় না গিয়ে কেস তুলে নেবার পরামর্শ দেন। বিপাশার ধর্ষণকারীরা গ্রামের প্রতিপত্তিশালী পরিবার। তাই বিপাশাদের রাজ্যে পুলিশ এনকাউন্টারে নয়, মহামান্য আদালতের দীর্ঘসূত্রী ন্যায় বিচারের ওপর ভরসা রাখেন।
আর ফি-সপ্তাহে নন্দিতা বিপাশাকে দেখতে যায় অন্তরা হোমে । ধর্ষিতা, রক্তাক্ত বিপাশা দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর, এখন সরকারী হোমে দিব্যি বেঁচে আছে। একটা ঝোলা নিয়ে সে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় হোমের যত্রতত্র। আর, খবরের কাগজ থেকে খেলার খবরগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে জমিয়ে রাখে ঝোলার ভেতর। মুদির দোকানের ঠোঙা, চপ-সিঙারার ঠোঙা সবকিছুতেই খুঁজতে থাকে ফুটবল খেলার খবর। শুধু কাউকে আর চিনতে পারে না ফুটবল পাগল সেই উচ্ছ্বল মেয়েটি। নন্দিতাকেও না।
তারপর পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিকগতি চলতে থাকে ভৌগোলিক নিয়ম মেনেই।
ঋণশোধ
রীতা মোদক
আজ ছোট্ট তুলসীর হাত থেকে সুধার সখের কাপটি পরে ভেঙ্গে গেলো।কাপ ভাঙতেই তুলসী থতমত খেয়ে গেল।শব্দ পেয়েই সুধা দৌড়ে এলো -- আরে একি কান্ড! কি সর্বনাশ করলি? আমার এতো সুন্দর কাপটা তুই ভেঙ্গে দিলি? বের হ ছোটলোকের বাচ্চা? সকাল সকাল এতোগাল খেয়ে তুলসী ভেঙ্গে পড়লো।তাকে যদি সুধা মা কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়, তাহলে তুলসীর ভাইএর কি হবে? ভাইকে যে এবার স্কুল এ পাঠাতে হবে।তুলসীর মা মারা যাওয়ার সময় তুলসীকে বলেছিল -- তুই যদি আমার দূধ খেয়ে থাকিস, তাহলে ভাইকে বড় করে আমার ঋণ শোধ করিস।
কথাটা মনে পরতেই তুলসী সুধা মার পা দুটো জড়িয়ে ধরলো।বলল -- সুধা মা,আমাকে ছেরো না।আমার ভাই বড় হলে তোমাকে এর চেয়ে সুন্দর কাপ কিনে দেবে।আমি তোমার সব কাজ করে দেবো।সুধামার মনটা একটু ঠাণ্ডা হলে বলল, -- ঠিক আছে কাজে মন দে।কিন্তু কথাটা যেনো মনে থাকে।
প্রায় পনেরো বছর পর।তুলসী সুধা মার বাড়িতে কাজ করে রাতে সেলাই মেশিন এ কাজ করে।
তুলসীর ভাই বিক্রম শ্রমিক কল্যাণ দপ্তরে চাকরি পেয়ে ছে। এপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে বিক্রম চিৎকার করে বলছে -- দিদি দিদি আমি চাকরী পেয়ে গেছি।তোর আর কারো বাড়িতে কাজ করতে হবে না। আমি তোর বিয়ে দেবো। তোর সুন্দর একটা সংসার হবে।
দিদি আনন্দে আত্মহারা হয়ে মায়ের ছবির কাছে গিয়ে বলছে -- মা আমি পেরেছি তোমার ঋণ শোধ করতে।আজ ভাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে।
তারপর ভাইএর কাছে গিয়ে বলছে -- ধূর পাগল ছেলে, আমাকে এ বয়েসে কে আর বিয়ে করবে?
তার থেকে ভালো হয় তোর জন্য একটা সুন্দর বউ ঘরে আনবো। ছেলে পুলে হবে ,তাদের বড় করতে হবে না? শোন, সুধা মার বাড়িতে আমার একটা ঋণ রয়ে গেছে, তুই আমাকে একটা সুন্দর দেখে কাপ কিনে দিবি?
পরের দিন তুলসী এক বাক্স সুন্দর কাপ নিয়ে
সুধা মার বাড়ি গেলো।সুধামা একসাথে এতগুলো কাপ পেয়ে চোখ দিয়ে আনন্দে জল পরছে, আর মনে মনে বলছে -- মেয়েটা সুধে আসলে সব ঋণ শোধ করে দিয়ে গেলো।
No comments:
Post a Comment