Sunday, June 7, 2020




আন্তর্জাতিক কবিতায় বাঁকবদল & বাংলা কবিতায় তার প্রভাব ও সমকালীন সময়ে রবীন্দ্রকাব্য 

রাহুল গাঙ্গুলি 

-------------------------------------------------------------------
কিভাবে শুরু হলো / হবে? কবিতা কি? খায় না গায়ে মাখে (পর্ব - ২)
:
:
এই পর্বে ভেবেছিলাম, সরাসরি ১টা কবিতা দিয়ে শুরু করবো।কবিতাই কেনো? কিরকম কবিতা? উত্তর আসার আগে, কিছু কথা বলাটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।তবে, একথা ঠিক ~ লকডাউন / সাইক্লোন : প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে, এসব কথা অতিপ্রয়োজনীয় হতোই না।বরং, আরেকটু এগিয়ে বলাই যায় ~ এই ধারাবাহিকতারই দরকার হতো না।
অনেকেই বলছেন : এই সময়ে 'সাহিত্য' বিষয়টি কিরকম যেনো বিলাসিতা মনে হচ্ছে না? সম্পাদকের কাছে কোনো উত্তর নেই ~ ১টি সাহিত্য পত্রিকা করে কি হয়? কবি জানে না, কবিতা লিখে কি খাবার পাওয়া যাবে? কে বা কারা কিনবে তার কবিতা? চিত্রকর বুঝতে পারছেন না, সময় / প্রকৃতি / দিনগতো অবস্থান ~ কোনটা আঁকবেন তিনি? আসুন, আমরা গোটা শিল্পমাধ্যমটিকে 'কবিতা' নামক ১টি ফ্রেমকরণের ভেতর নিয়ে আসি, কথোপকথনের সুবিধার্থে (যেহেতু, একথা ১টা অভিমুখ থেকে বলাই যায় ~ কবিতা, শিল্পের সবচেয়ে চূড়ান্ত অবস্থান)।এখোন, যখোনই এই ফ্রেমবন্দী সুবিধার্থটি করা হলো, তখোনই : 'কবিতা' কাকে বলবো? এরকম ১টি প্রশ্ন খাড়া হওয়াটাই স্বাভাবিক।অনেকেই বলেন, এই প্রশ্নের আবার উত্তর হয় নাকি! কিন্তু, কি অদ্ভুত ~ যেখানে যুক্তি আছে / যুক্তি থাকা মানেই, প্রতিযুক্তি আছে / যুক্তি ও প্রতিযুক্তি থাকা মানেই, তাদের নস্যাৎ করার অধিকারও আছে ~ সেখানে, মোটামুটি সেই বস্তুটির ১টা আপাত স্বরূপ নিশ্চয়ই নির্ধারন করা যায়।যদি সেই আপাত স্বরূপটি হয় "যা আমাদের সত্ত্বাকে দীর্ঘ চিন্তনে অনুরণিত করে তোলে, তাই কবিতা", তাহলে কেমন হয় (ঋনস্বীকার : সৌমিত্র রায়, আই-সোসাইটি)।প্রসঙ্গত, পরবর্তী যে কথাটা মনে আসতে বাধ্য : দীর্ঘ চিন্তনের সূত্রপাত ঘটায়, সে কেমনতরো ব্যাপার।আসলে, ১টা প্রকাশ তা হয়তো সমকালীন সময়কে ধরছে, আবার আরেকটি প্রকাশ ~ সমকালীন সময়কে পেরিয়ে ধরছে ভবিষ্যৎের কোনো সময়কে।এখানে, সময়টি এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, 'সমকালীন' বিষয়টিতেও ১ অদ্ভুত দ্বন্দ্ব অন্তর্ভুক্ত হয়ে ওঠে।অর্থাৎ, যা দেখতে পারছি : তাকে প্রকাশনার চিন্তনগুলো কোন সময়ের? এর উত্তরে বলা যেতে পারে ~ (১) যে সময় কাটিয়ে এসেছি, (২) যে সময় কাটাচ্ছি, (৩) যে সময় কাটাবো ~ সহজভাবে, অতীত / বর্তমান / ভবিষ্যৎ।সোজাভাবে ~ উদাহরণ হিসেবে খাড়া করা যায় : 
(ক) চলমান সময়কে সংকলিত করে রাখা (কোনো সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু আঁকা / লেখা / প্রভৃতি)।উদাহরণস্বরূপ ~ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন / সমাজ বা রাষ্ট্র কতৃক নিপীড়ন / বিশ্বযুদ্ধের সময় রচিত বিভিন্ন কবিতা, নভেল, ইত্যাদি
(খ) চলমান সময়ের থেকে দৃশ্য-উপাদান নিয়ে, তার কিছুটা ভবিষ্যৎের উপর অভিক্ষেপ (projection) করে : ভবিষ্যৎের কিছু আগাম রূপ নির্ধারনের চেষ্টা।অর্থাৎ, কোনো ১ নির্দিষ্ট সময়ে যাপন করেও, সময়ের ভবিষ্যৎ অনির্দিষ্ট রূপটিকে দেখতে চাওয়া।খুব সহজ উদাহরণে, জুল ভার্ণের ডুবোজাহাজ কনসেপ্ট বা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আকাশযান সংক্রান্ত বিভিন্ন স্কেচ, ইত্যাদি।বাংলাভাষা সহ বিশ্বকবিতায়, নিরীক্ষাধর্মী কবিতাশৈলিতে এরকম বহু কাজ পাওয়া যায়
(গ) সময়পর্বের নির্দিষ্ট চলমান ধারার ভিতরে থেকেও এমন ১ অনির্দিষ্ট সমান্তরাল সময়কে নিয়ে লেখা, যা সর্বদা তার চরিত্র পরিবর্তনে সক্ষম।বাংলা কবিতায় খুব সহজ উদাহরণ হলো 'বনলতা সেন'।যদি কোনো ১টা সময়াংশের শিরোনাম বনলতা সেন হয়, দেখবেন সে গোটা কবিতাটিতে স্বচরিত্রকে ক্রমাগত পাল্টে ফেলছে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গীতাঞ্জলী'তে এরকম বেশকিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে।এমনকি পাশ্চাত্যেও অফুরান উদাহরণ আছে।অবশ্য, সব কবিতারই শুধুমাত্র প্রকাশ করার ভাষা টেকনিক্ দেখলে ~ শব্দার্থরূপে, তা ১সময় ২য় পর্যায়ভুক্ত হবার চেষ্টা করে

এসব নিয়ে আরো সাংঘাতিক কিছু তত্ত্ব খাড়া করা যেতেই পারে, যদি কর্পোরেট্ ভাষ্য বা বাজারভাষ্য সংক্রান্ত তথ্যগুলির সঠিক অনুধাবন করা যায়।গোটা বিষয়টি নিয়ে ১টি পর্যবেক্ষণ পরবর্তী গদ্য লিখেছিলাম, শিরোনাম coneptual কবিতা VS perceptional কবিতা।আরো ১টা কথা প্রসঙ্গ পরিবর্তনের আগে, বলে নেওয়া ভালো ~ তাহলো, উপরে আমি কিছু জায়গায় কবিতা বা আপাতভাবে শব্দ দিয়ে নির্মিত সাহিত্যের জায়গায় ছবি বা চিত্র বা painting প্রসঙ্গ তুলেছি।এবিষয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, ছবি কখনো সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে কিনা।উত্তরে, এই মুহূর্তে এটুকু বলা যায় ~ হতেই পারে, যদি তার সারাৎসার পাঠোদ্ধারের পর, তা বিভিন্নজনের কাছে বহুরৈখিক হয়ে ওঠে।অর্থাৎ, যাঁরা দেখবেন এবং পড়বেন : একেকজনের কাছে বিষয়টি বৈচিত্র্যময় অথবা, একেকসময়ে বিষয়বৈচিত্র্য একেকরকম।সুতরাং, "কবিতা কি" প্রসঙ্গটিতে ~ আমরা আরেকটি আপডেটেড্ মাত্রা যুক্ত করতেই পারি (আপডেটেড্ শব্দটির ঋনস্বীকার : প্রভাত চৌধুরি, সম্পাদক কবিতা পাক্ষিক)।তা হলো "যে বহুরৈখিক দৃশ্য প্রকাশমাত্রা, আমাদের সত্ত্বাকে দীর্ঘ চিন্তনে অনুরণিত করে তোলে, তাই কবিতা"

অবশ্য এখনই, এইসব কথাগুলোকে মান্যতা না দিলেও চলে ~ কারণ, আমরা যতোই বাঁকবদল বিষয়বস্তুটির মেজাজের ভিতরে ঢুকবো, চেষ্টা করবো ~ কথাগুলোর আকরটির মূল প্রয়োগটিকে মিলিয়ে নেওয়ার।
যাইহোক, এই পর্বের প্রান্তভাগে আসুন ১টা কবিতা পড়া যাক।এই কবিতাটি মধ্যবর্তী সাহিত্য মাসিক পত্রিকার বইমেলা ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত ১টি কবিতাবিষয়ক গদ্য 'শুঁয়োপোকা' শিরোনামে প্রকাশিত।লেখক দিল্লীনিবাসী পীযূষকান্তি বিশ্বাস এবং পত্রিকা সম্পাদক বিশ্বরূপ দে সরকার, উভয়ের প্রতি ঋনস্বীকার করছি।
:
:
দুদিকে বিকেল নিয়ে দৌড়ালো বাইক
দুই চোখে স্বপ্ন নিয়ে একক সড়ক
পুকুরে ডুবছে জলে রক্তিম সুরজ
ফেসবুকে, হে যুবক সহস্র লাইক।

বিদ্ধ চাহনির মধ্যে রয়েছে জিজ্ঞাসা
যুবক! কি বলতে চাও এভাবে তাকিয়ে
এই রক্তে খেলছে যে দৌড়, স্বপ্ন, কথা
জেনো তার নাম দিতে পারি ভালোবাসা।

এই চোখে কথা আছে কবিতা কাজল
জ্বলে পুড়ে যেতে চাই আগুন মাফিক
এঘর বারান্দা থেকে দূরে যেতে চাই
পথ ডাকে, সঙ্গী হলে ছুটে যেতে পারি
হে নবীন, চাও নাকি পড়তে সে কথা
যে কবিতা এ পর্যন্ত পড়া হয় নাই?
:
:
খেয়াল করে দেখুন, ওপরের কবিতাটি অন্ত্যমিল ছাড়া ১৪টি অক্ষরবিশিষ্ট, ১৪ লাইনের (৪+৪+৬) ১টি উৎকৃষ্টতম সনেটের উদাহরণ, যা উনবিংশ / বিংশ শতাব্দী পার করে লেখা হয়েছে ২০২০সালে।এখোন, ভালো / মন্দ জাতীয় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছেড়ে দিলে, এখানে চমকানোর মতোন কিছু নেই।কিন্তু যদি বলি : এই কবিতাটি কোনো মানুষ লেখেনি, লিখেছে কম্পিউটার ~ হয়তো একটু চমকাবেন বই কি? আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই বললাম।গদ্যটির কেন্দ্রীয় চরিত্র কমলিকা, যে কিনা দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ে।তার উড-বি প্রেমিককে উৎসর্গ করে, তাকে ১টি সনেট ফেসবুকে পোস্ট করতে হবে।তাকে সাহায্য করলো 'কম্পিউটার এইডেড পোয়েট্রি', সফটওয়ার লিপিকা (গদ্যটিতে থাকা, সফটওয়ারটির স্ক্রিনশট্ তুলে দেওয়া হলো)।

     <<<< স্ক্রিনশটের ছবি >>>>

এবার প্রশ্ন উঠবে, এও কি সম্ভব? কিভাবে? তাহলে কি ভবিষ্যৎে মানুষের পরিবর্তে কম্পিউটার লিখে দেবে আস্তো কবিতা? তাহলে মানুষ কি লিখবে? তাহলে কি ভবিষ্যৎ সময়ে 'কবি' শব্দটি বিলুপ্ত হতে চলেছে? এরকম আরো আরো, কতশত প্রশ্ন।কিন্তু বিশ্বাস করুন এর সব উত্তর পাওয়া সম্ভব।আসলে ~ সৃজনশীলতার কাছে কোনো কিছুই কিছু না।তাই, উত্তর গড়ে নিতে সৃজনশীল কবিতার ইতিহাস চর্চায় ঢুকতেই হবে, সেই আদি গুহামানুষের যুগ থেকে।অনুভব করতে হবে, প্রকৃত সৃজনশীলতা।অতএব ~ কোনো ইতিহাসবিদ হয়ে নয় / কোনো সিলেবাস তৈরি করতে নয় / কোনো পাশফেলের জন্য নয় / কোনো সাহিত্য শেখানোর তাগিদ থেকে নয় / কোনো সস্তা সোডার বোতলের ছিপি খোলার দায়বদ্ধতা থেকে নয় || স্রেফ ১টা পথ চলতেচলতে পথিকের দৃষ্টি নিয়েই, শুরুর থেকে একটু লুক্-থ্রু।

(আরো আলোচনা সামনের পর্বে)

No comments:

Post a Comment