মহামারী আর মহাপ্রলয় যে বিপদ আর ধ্বংস নিয়ে এসেছে হয়ত তার থেকে আমরা একদিন মুক্ত হব, কিন্তু মানব মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হল তার থেকে কবে মুক্তি মিলবে তা আমরা কেউ জানি না। এইজন্যই এদের নামের আগে 'মহা' শব্দটি যুক্ত হয়েছে।
এরকম অবস্থা আমাদের স্মরণকালে কেউ দেখে নি। তাই অভিজ্ঞতাও নেই বিরুদ্ধে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করবার। তবু চেষ্টা চলছে। সুখের কথা বহু ক্ষেত্রে সে চেষ্টা সফলও হয়েছে। তবু কিছু প্রশ্ন রয়েই যায়। যেভাবে লক্ষাধিক মানুষকে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হল বা যেভাবে এখনও বহু জায়গায় বহু মানুষকে সামাজিক বয়কটের সামনে পড়তে হচ্ছে, তাতে এটা বলা যেতেই পারে যে, আমরা এখনও প্রকৃত সচেতনতা থেকে বহু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ফলে বিপদ বাড়ছে বৈ, কমছে না।
সবশেষে আবার সেই আশায় বুক বাঁধা, অপেক্ষায় থাকা...একদিন সুদিন আসবে, একদিন সুদিন আসবেই...
মুজনাই অনলাইন জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা, ১৪২৭
মুজনাই অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা
মুজনাই সাহিত্য সংস্থার একটি প্রয়াস
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
ঠিকানা- হসপিটাল রোড, কোচবিহার, ৭৩৬১০১, প ব
ইমেল ঠিকানা- mujnaisahityopotrika@gmail.com
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা, ১৪২৭
মুজনাই জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা, ১৪২৭
গদ্য পর্যায়
শিল্পী- মাধুরী রায় বারুই
আমার একতারার গান
মীরা সরকার
'অপেক্ষায় আছি জীবন ভর'
বলতেই মনে পড়ে একচোখে ছানি
অপেক্ষায় নিদ্রাহীন মা।ফেরারী ছেলেটা তার ফেরে না।
ছেলে বলতে মনে পড়ে সেই
নিশ্চিন্তিপুরের বন বাদাড়ে ঘোরা
হাঁ করা সেই ছেলে। দিদির পিছু ছোটা।
দিদি ভাবতেই মনে পড়ল দুটি করুন পায়ের পাতা।চোখ তুললে দেখতে পেতাম মোহর দিদির মুখ।প্রণাম করি ,প্রাণ চলে যায় তারে। ঝংকারে। তার মানে সেই তার সানাই এর গলা।
"-দূরে কোথায় " দূরে কোথায় চলা।
দূরে বলতেই মন হারাবে আনজানা লাল পথে।
"পথ বেঁধে দেয় বন্ধনহীন গ্রন্থি।" পথ ধরে পথ চলা। চলার সময় ঊর্দ্ধবাহু তাতে না থাকে একতারা ।"আপন মাঝে আপনি কেমনে হারা?" এমনি বুঝি হারায় দুটি পায়ে ঠমক তুলে! বুক ঠুকে ফের হারিয়ে যাবে কেউ। তারে পথ বলে দেয় পথের ঠিকানা। টান দিয়েছে
একতারা দোতারা অজয় নদের পারে। একদিন তো যাবেই তুমি ফিরে।"কোথাও তুমি আছ হে" থাকুক গলার সুরের ভাঁজে।
হা হা সেই খুশিতে পড়ব ফেটে অজয় নদের তীরে। বাজবে নূপুর ঝমক্ ঝমক্।
অবাক আকাশ চেয়ে দেখবে ,শুনবে "সোনা বন্দে আমারে দিওয়ানা বানাইছে।" কে গায় অন্ততঃ জীবনে একবার। সময় কি নাই? আমার একতারা বলো সময় কি নাই ?
অভিজ্ঞতা
" আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা"
কুমকুম ঘোষ
পূর্বাভাস ছিল অন্ততঃ ৪ দিন আগে থাকতেই,১৬ই মে,(২০২০) বঙ্গোপসাগরে এক ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় ঘনীভূত হচ্ছে এবং সেটা আছড়ে পড়তে পারে সুন্দরবন ও বাংলাদেশের মাঝ বরাবর।তাইল্যান্ডের দেওয়া নাম-- আমপান(UM-PUN-- যার অর্থ আকাশ)। উচ্চারণবিলাসী সংবাদপত্র তাকে নিজের নিজের মত ডাকতে লাগলো ,আর ওদিকে প্রকৃতিদেবী আরো একবার উচ্চাভিলাসী আধুনিক সভ্যতার অহংকে চুরমার করে দেবার সব আয়োজন শুরু করে দিল।
১৭ এবং ১৮ (মে'২০২০) মোটামুটি করোনা ভাইরাস আক্রান্ত দেশবাসী এবং পথ দুর্ঘটনায় পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের মুখ্য বিষয় হয়ে থাকলো।চরম দুর্ভোগ ও দুর্দশা গ্রস্ত লাখ লাখ পরিযায়ী ( শব্দের কি উদ্ভাবনী শক্তি!) শ্রমিক হাঁটছে, রক্তাক্ত হচ্ছে, পথদুর্ঘটনায় মরছে( রেললাইনের ওপর ঘুমিয়ে পরে ট্রেনে কাটা পরেছে--এও পুরনো খবরমাত্র!) ,মৃত সঙ্গীর দেহের সাথে এক ট্রাকে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসতে বাধ্য করছে --এসব গা- সওয়া খবর নিয়ে লকডাউন- বিধি ভঙ্গকারী নগরবাসী নিশ্চিন্তে আড়মোরা ভাঙছে, বাজার করছে আর সরকারের সাম্প্রতিকতম আর্থিক প্যাকেজ (রাজবস্ত্র অতীব সূক্ষ্ম, চোখে পড়ছে না যদিও কিন্তু আছে! ) এর গুরুত্ব ও বাস্তবতা আলোচনা করছে পাড়ার মোড়ে মোড়ে।
"ঝড়কে আমি করব মিতে ডরব না তার ভ্রুকুটিতে"................... ..
নগরবাসী এভাবে ভাবতে ভাবতেই ১৯শে' মে থেকে সংবাদপত্রের অভিমুখ ঘুরে গেল। কারণ তখন সেই ঘূর্ণিঝড় আবহাওয়াবিদদের মতে সুপার সাইক্লোন এ পরিণত হয়েছে। সাগরের জলের তাপমাত্রা বেশী থাকায়,( জানুয়ারী তেই ছিল প্রায় ৩২ডিগ্রি) জলীয় বাষ্প তৈরী হওয়ায় তা শুষে শক্তি বৃদ্ধি করে আমপান ঘূর্ণিঝড় অতি দ্রুত প্রবল ,অতিপ্রবল স্টেজ অতিক্রম করে সুপার সাইক্লোন হয়ে উঠেছে। এবং তাঁদের অনুমান বঙ্গে তার হামলা র সময় সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকবে ১৯৫ কিমি প্রতি ঘন্টায়।
প্রসাশনের পক্ষ থেকে উপকূলবর্তী এলাকায় আগাম সতর্কতা জারি করতে শুরু করল প্রশাসন এবং শুরু হলো ইভ্যাকুয়েশন।বেশ কয়েক লক্ষ মানুষকে সরিয়ে আনা হলো ত্রাণ কেন্দ্রে; সুন্দরবনের ঘোড়ামারা ,মৌসুনী দ্বীপের মানুষের কাছে এসব গা সওয়া; পত্রিকার প্রথম পাতায় সেসব ছবি এসে গেল ২০তারিখেই। এমনিতেই লকডাউনে স্কুলগুলো বন্ধ। সেগুলো কাজে লাগলো কিন্তু সোশ্যাল ডিসটান্সিং এর নিয়ম মানা প্রায় অসম্ভব হয়ে পরলো। করোনা আক্রান্ত হলে চিকিৎসা হবে, ঝড়ে প্রাণ গেলে সে সুযোগ টুকুও থাকবে না--মাটীর দেওয়ালে টালি অথবা অ্যাসবেসটাসের ছাউনি সম্বল উপকূলের কাছাকাছি থাকা মানুষগুলো র মনের ইচ্ছে গুলো এমনটাই,টিভি ক্যামেরার সামনে তারা ইন্টারভিউ(বাইট) দিচ্ছে(চ্যানেলের TRP রক্ষা করা মহান কর্তব্যও এই কর্মরত সাংবাদিকদের)।বহু ঝড় বহু উৎখাত এবং এগারো বছর আগের (২০০৯) এর বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আয়লার সাক্ষী এই সব মানুষজন।জল জঙ্গল জমির সাথে তাদের নাড়ীর টান, নাড়ীর টান ভাঙাচোরা বাড়ী আর ভিটেমাটি র সঙ্গে --চিরায়ত টান -- নাহলে কি আর হাজার হাজার মাইল পথ হেঁটে পরিযায়ী শ্রমিক রা বাড়ী ফেরার মরিয়া চেষ্টা করে?
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার.....পরানসখা বন্ধু হে আমার................
২০ তারিখ, বুধবার সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার , ইতিউতি হালকা হাওয়া দিচ্ছে। বৃষ্টি তখনও নামেনি কিন্তু শহরবাসী টিভি চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আবহাওয়াবিদদের গম্ভীর বিবৃতি ও আতঙ্কে র আভাস পেয়েই চলেছে।গত দশ বছরে উপগ্রহ ব্যবস্হা ও আনুষঙ্গিক টেকনোলজি ব্যবস্হার উন্নতির কারণে প্রায় সঠিক সম্ভাব্য অনুমান করা সম্ভবপর হয়েছে।
ফলতঃ প্রশাসনের ঘুম কেড়ে আমপান (উম্পুন) ঝড় রাতারাতি বাহুবলী হয়ে উঠেছে।১৯৯৯ সালের উড়িষ্যার ঘূর্ণিঝড়ের পর এটাই দ্বিতীয় সুপার সাইক্লোন এবং দীঘা থেকে বাংলাদেশের হাতিয়া দ্বীপের মাঝামাঝি, সুন্দরবনের কাছে আছড়ে পরবে দুপুর নাগাদ।
কিন্তু আগের বছরের "ফণী" ও "বুলবুলের" অভিজ্ঞতা র নিরিখে নগরবাসী র ধারণা-- এবারেও ঝড় বুঝি বাংলাদেশ এই আছড়ে পরবে হাওয়া দফতরের পূর্বাভাস মিথ্যে করে।
দুপুর ২টো নাগাদ অবস্থা পালটাতে শুরু করলো। হাওয়া দমকে দমকে পাশের বাড়ির নারকেল আর সুপারি গাছগুলোতে আছড়ে পরছে, সেগুলো দুলছে বিপজ্জনক ভাবে । বেশ কয়েকটা ডাব সশব্দে মাটিতে পড়লো দেখলাম। দুপুরের খাওয়া সেদিন খিচুড়ি ডিমভাজার সাথে টিভি চ্যানেলে দীঘা কাঁথি হলদীয়া অঞ্চলে( পূর্ব মেদিনীপুর)র তুমুল ঝড় ও উত্তাল সমুদ্রের ছবি দেখতে দেখতে। চ্যানেলওয়ালা তখনও বলছে সাগরদ্বীপ নয়, হলদীয়ায় নাকি ৩টে নাগাদ আছড়ে পড়বে "আমপান"( এটাও ভুল প্রমাণিত হলো, শুধু চ্যানেলের TRP বাঁচলো কিছুক্ষন)। তখন ও ইলেক্ট্রিসিটি ও নেটওয়ার্ক ব্যবস্হা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে,আর আমরাও উপভোগ করছি( মাথার ছাদ,পেটে খাবার থাকলে যা করেন আম- নেটিজেনসকল)। বুদ্ধি করে১০০০লিটারের জলের ট্যাঙ্কটা ভরে নিলাম। ( পরের ২দিন ওটাই নিজের ও বাড়ির অন্যান্য দের কাজে দিল খানিকটা)।
বিকেল ৪টে থেকে হাওয়ার গর্জন আর বৃষ্টির দাপট বাড়তে লাগলো ক্রমশঃ।তখনো জানিনা ইতিমধ্যেই (বিকেল ৪.৩০-৫.০০ নাগাদ) "সাগরদ্বীপ(দঃ২৪পরগণা) এর মুড়িগঙ্গা নদীর ধারে ধবলাট পঞ্চায়েতের ধবলাট শিবপুর গ্রামে আছড়ে পরেছে আমপান।( সে খবর পেলাম ঝড়ের ৬ দিন পরে)। সেই গ্রামের বাসিন্দা রা বলেছেন
----------------" সমুদ্রের উপর দিয়ে বিশাল কালো কিছু ঘুরতে ঘুরতে ধেয়ে আসছিল পাড়ের দিকে। সঙ্গে গোঁ গোঁ শব্দ। সমুদ্রের জল আছাড়ি- পিছাড়ি খাচ্ছে। শব্দে কান পাতা দায়।এক সময়ে কালো বস্তুটা প্রবল শব্দে আছড়ে পড়ল মাটিতে। নিমেষে উড়ে গেল অসংখ্য বাড়ির চার, মাটিতে শুয়ে পড়ল শ'য়ে শ'য়ে গাছ"(আনন্দবাজার ২৬ শে' মে,২০২০,শহর সংস্করণ)।
......... ম্যায় হুঁ ডন..............
বিকেল সাড়ে ৪ টের পর থেকে ক্রমশঃ বৃষ্টির বেগ ও হাওয়ার দাপট বাড়তে লাগলো।এরপর বিকেল ৫টা - রাত ৮টা ঝড়ের যে কালভৈরব রূপ প্রত্যক্ষ করলো নগরবাসী তা এককথায় অবর্ণনীয়, অকল্পনীয় এবং অপূরণীয় ( সুন্দরবন ও উপকূলীয় ধ্বংসের কথা বলাই বাহুল্য)।
মনে হচ্ছিল কোনো মহাদানব প্রবল ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে পুরো বাড়িটাকেই উপরে ফেলতে চাইছে ( আমাদের ৬০ বছরের তিনতলা বাড়ি)।বন্ধ ঘরের মধ্যে বসে আছি আর শুনতে পাচ্ছি শনশন- মড়মড় -ঝনঝন শব্দ। প্রথমেই বিকট আওয়াজে একটা সানসেট অর্ধেক ভেঙ্গে ঝুলতে লাগলো ; সিঁড়ি র ল্যান্ডিংএর একটা পুরনো কাঠের জানলার একটা পাল্লা উড়ে গেল,হুড়হুড় করে জল ঢুকতে লাগলো। দড়াম দড়াম করে কাদের দরজা হাওয়ায় পরছে খুলছে বুঝতে পারছিনা।( পরে দেখা গেল সেটাও ছাদের)।জানলার ফাঁক,এসির পাইপের গর্ত দিয়ে প্রবল বেগে জল ঢুকতে লাগলো বেডরুম ও অন্যান্য ঘরগুলো তে। বারান্দা দিয়ে প্রবলবেগে জল ঢুকছে সাথে হাওয়ার ধাক্কা।এক একসময় মনে হচ্ছিল জানলার ছিটকিনি ভেঙে যাবে। ইলেকট্রিক চলে গিয়েছিল বিকেল এর দিকেই( ৭২ ঘন্টা পরে এসেছিল।বহু জায়গায় ১২৭ ঘন্টা পরে, এবং বহুজায়গায় আজ, ১২ দিন পরেও আসেনি) এবার গেল নেটকানেকশনও। বৃষ্টির বেগ সমানতালে বেড়ে চললো।বাড়ীতে জল ঢুকতে শুরু করলো এবং দুঘন্টার মধ্যে নীচের ঘরগুলোতে হাঁটুজল হয়ে গেল।ফ্রিজ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র উঁচু খাটের ওপর তুলে দিয়ে একতলার বাসিন্দারা ওপরতলায় আশ্রয় নিল। হাওয়ার দাপট যেন গর্জিলা সিনেমার সেই ভয়ানক দৈত্য-গরিলার মত গর্জন করতে করতে আছড়ে পড়ছে অনবরত।আছড়াবেই না কেন? সাইক্লোন শব্দটাই এসেছে গ্রীকপুরাণের একচক্ষু দানব "সাইক্লপস"(cyclops) থেকে এবং "হেনরি পিডিংটন" নামের এক ব্রিটিশ নাবিক- বিজ্ঞানী "সাইক্লোন" শব্দটা দান করে গেছেন অভিধানে।তার দাপটে থরহরিকম্প আধুনিক গেজেট ও নেটনির্ভর নগরবাসী ( আয়লার সময়,২০০৯ সালে ও এত ভয় এতো ঝড় প্রত্যক্ষ করেনি শহর কলকাতা ও আশপাশ এলাকা) ; ভীত স্বন্ত্রস্ত আমরা ইষ্টনাম জপ করছি।
টানা ৩ঘন্টা এভাবেই চলল সুপার সাইক্লোন আমপানের তান্ডবলীলা। সাগরদ্বীপে আছড়ে পড়ার সময় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৮৫ কিমি(বিকেল ৪.৩০-৫.০০), কলকাতায় গতিবেগ ঘন্টায় ১১৪ কিমি(সন্ধ্যে ৬টা ৪৭ মিনিট) এবং দমদম অঞ্চল দিয়ে যাবার সময় গতিবেগ ঘন্টায় ১৩৩কিমি(সন্ধ্যে ৭টা২০মিনিট)।
(২০০৯ এর আয়লার সময় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১১২ কিমি।)
.......ইতিহাসের পাতায় কলকাতার ঝড়.....
পুরনো কলকাতার ইতিহাসে এরকম বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের খবর পাওয়া যায় বেশ কয়েকটা।২৮৩ বছর আগে --১৭৩৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর ও ১৫৬ বছর আগে-- ১৮৬৪ সালের ৫ই অক্টোবর। ১৭৩৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর ( মতান্তরে ১০-১১ই সেপ্টেম্বর)ঝড়ের বর্ণনা তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠির মন্ত্রণাদাতা স্যার ফ্রান্সিস রাসেলের বিবরণ থেকে ও রাধারমণ মিত্রর "কলিকাতা দর্পণ" এর "ডিঙিভাঙার মোড় কোথায়?" অনুচ্ছেদ থেকে জানা যায়। রাধারমণ মিত্র লিখেছেন --"১৭৩৭ খ্রীস্টাব্দের ১০-১১ সেপ্টেম্বরের মহাঝড় ও ভূমিকম্প কলকাতাকে বিধ্বস্ত করে দেয়। এই ঝড়ে গোবিন্দরাম মিত্রের ( ব্ল্যাক জামিনদার) নবরত্ন মন্দিরের (বর্তমান কুমোরটুলি তে) ও সেন্ট আ্যান গির্জার ( ফোর্ট উইলিয়ামের) চূড়া ভেঙে পড়ে।সেই ঝড় ও ভূমিকম্পে যে সংখ্যায় মানুষ(প্রায় ৩০ হাজার) ও পশুপাখি মরেছিল,বাড়িঘর ভেঙেছিল ও নৌকা জাহাজ ধ্বংস হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। প্রকৃতির সেই প্রচন্ড ধ্বংসলীলা কলকাতার লোকে বহুদিন ভুলতে পারেনি। সেদিনের ঝড় অনেক বড় বড় জাহাজ কে নদীর বুক থেকে তুলে ডাঙার উপর অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে মাটিতে আছড়ে ভেঙে ফেলেছিল।"
সেসময় কলকাতায় কোনো সংবাদপত্র বের হতো না, ইংল্যান্ড এর "জেন্টেলসম্যান ম্যাগাজিন" এ এই ভয়ানক ঝড়ের বিবরণ পাওয়া যায়।
১৮৬৪ সালের ঝড়ের বিবরণ পাওয়া যায় শিবনাথ শাস্ত্রী র লেখা থেকে।তিনি কালিঘাট থেকে তাঁর বাড়ি রাজপুর( অধুনা রাজপুর- সোনারপুর অঞ্চল) যাওয়ার জন্য একটা শালতি ভাড়া করেন। পথে ঝড়ে পড়েন এবং চোখের সামনে দেখেন রানী রাসমণির গৃহ কিভাবে ঝড়ে ধুলিসাৎ হয়ে গেল।এই ঝড় সম্বন্ধে ও কলকাতার কাগজের বদলে বিলেতের " দ্য ডেইলি নিউজ" ও অন্যান্য কাগজের বিবরণে জানা যায় সেই ঝড়ে মূলতঃ দক্ষিণবঙ্গ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। হুগলি নদীর মোহনা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে যে সব জাহাজ ছিল সেগুলি ভেঙে তছনছ হয়ে গিয়েছিল এমনকি কয়েকটা পাশের ধানজমিতে আছড়ে পড়েছিল।
একদিন ঝড় থেমে যাবে... পৃথিবী আবার শান্ত হবে......
২০০৪ সালে থাইল্যান্ড এই আমপান( আমফান/ উম্পুন) ঝড়ের নামকরণ করেছিল। সেই ঝড় আছড়ে পড়লো ২০২০ সালে।এর আগে আয়লা- ফনী- বুলবুল-তিতলি- হুদহুদ ইত্যাদি বহুবিধ ঝড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে মানুষের ঘরবাড়ি ( দক্ষিণবঙ্গ-সুন্দরবন-বাংলাদেশ এবং উপকূলীয় অঞ্চল) বারবার নষ্ট হয়েছে ক্ষেতের ফসল , উড়ে গেছে মাথা গোঁজার একচিলতে ছাদটুকু। সব হারিয়ে ভাঙা ভিটে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়ে কেউ জিতেছে,কেউ হেরেছে প্রাণ বাঁচানোর লড়াইতে। কিন্তু প্রকৃতি দেখিয়ে দিয়েছে তার ক্ষমতার দিগন্ত কতদূর প্রসারিত হতে পারে।
অথচ, যে মানুষ মঙ্গলে যান পাঠায়, যে মানুষ মহাকাশে ট্যুর করায়, চাঁদে আবাসন গড়ার স্বপ্ন দেখায় সে যে প্রকৃতির কাছে কত তুচ্ছ কত নগণ্য তা প্রকৃতি- মাতা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় তাকে। কিন্তু অহংকারী মানুষ তা শেখে না।
সেই শিক্ষাই আরো একবার দিয়ে গেল যেন এই বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়।
ডুয়ার্স:এক প্রাগৈতিহাসিক প্রেমকথা
গৌতম বাড়ই
রাঙালীবাজনা সাতরাইচেঙা মুজনাই এর কোলে কোলে তখন।এক একটা দুরন্ত দিন,কখনো বা দুরন্ত রাত।মাদার গাছের সারি।
সেই তো তখন প্রথম দেখা।লাল শিমূলে জড়িয়ে থাকা আমার অজস্র ভালোবাসা।পলাশ তখন ভীষণ রাঙা।ভূটনীর ঘাটের সুশীল বিজেন তপেন এমন কত বন্ধু আমার চিরদিনের।সমীর কি আর এখন বীরপাড়াতে থাকে? এ জীবনে আর কোনোদিন হয়তো পেলামও না দেখা,আমার হৃদয় জুড়ে থাক তারা।মুজনাই এর সেই দুরন্ত স্নানে ঘোলা জলের গন্ধ এখনো নাকে লেগে।কোনোদিন বা চলে যেতাম শালকুমারের ধারে।শালকুমার কি এখনো আছে বন বাঁদাড়ে ছেয়ে?মাদারীহাট এক মন্থর সন্ধ্যা বেলায়, সাইকেল টায়ার ফেটে কি ঝক্কি বাপরে বাপ! ডুয়ার্সের সেই এ্যামাজনে। কিন্তু হাতী এলো না গন্ডার এলো না হরিণ চিতা বা নিদেন পক্ষে একটি শেয়াল।ফালাকাটা বন্দর পেরিয়ে আরও তিন কিলোমিটার পশ্চিম ফালাকাটায়।জীবনের বেশীরভাগ সাইকেলের টায়ার ফাটার কথা মনে আছে, কিন্তু টায়ারে হাওয়া ভরবার কথা মনে নেই।সেরা ফাটা কিন্তু ঐটাই।শৌলমারি যখন গেলাম,তখন নেতাজী টেতাজী সব ফক্কা।একটা অবিন্যস্ত আশ্রম ধূ ধূ গ্রাম হা হুতাশ ধরাধাম।জটেশ্বর শালবাড়ি ভূটনীর ঘাট ঘুরেছি কতশত,সেই তো আমার এ জীবনের প্রেমের মতন প্রেম আমার ডুয়ার্স।আমার প্রদেশ বনাঞ্চল আমার গ্রাম। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি শেষে, দুরে ভূটানী নীল পাহাড় মনের লেন্সে যে ছবি তুলেছিলো এখনও চল্লিশ বছর পরে অমলিন,স্মৃতির চিপসে কোনো ফোল্ডার বা ফাইলে।স্মৃতি তুমি কতো জিগা বাইট? কতো কতো জিগা হলে গিগা বাইট হয়? চাঁদ তো পৃথিবী সৃষ্টি থেকে উঠেছিলো।আমার এ জন্মে সেরা সেরা চন্দ্রোদয় আছে ডুয়ার্সে। চাঁদের আলোর এ এক এতো প্রাগৈতিহাসিক ভালোবাসা ঝড়ে পড়ে রাতের গভীর অরণ্যে এক এক রাতে। স্মরণীয় থাক।ভালোবাসতে গেলেও ভালোবাসা শিখতে হয়। আজ তো ডুয়ার্স সবারই গন্তব্য।ভার্জিনিটি আর নেই।প্রতিটি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে পদক্ষেপ। আগে নিজ বাসভূমে এ নাম গুলো দুর অজানার হিন্দুকুশ পেরিয়ে আফগানিস্তান বা তারও দুরতম প্রদেশ আফ্রিকার কোনো অঞ্চলের নাম বলে ভাবতো কেউ কেউ।এখন তো গুগলে সার্চ হয় লাখোলাখো। তুমি এখনো আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে ভালোবাসো ডুয়ার্স কে?না ওরা ভালোবাসে ডুয়ার্স কে?
রবীন্দ্রনাথ ও বর্তমান
উদয়ন দত্ত
আজ থেকে ১৫৯ বছর আগে কলিকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেকালে ঠাকুরবাড়িতে চলত বাংলা সংস্কৃতির চর্চা, প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তরে পালিত হতো নৃত্য- গীত - বাদ্য- অংকন সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়। ঠাকুরবাড়ি বাংলাকে রবি ঠাকুর তো দিয়েছেই, আরো দিয়েছে অবনী ঠাকুর, গগন ঠাকুর, সরলাদেবী প্রমূখ। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারেই অভিভাবকের কাছে অংকন -নৃত্য -সঙ্গীত শুধু সময় নষ্ট।মূল্য হারিয়েছে বাংলা সংস্কৃতি। পাঠ্যের কবিতা গল্প পড়তে বাধ্য করলেও, সন্তানেরা নিজে লিখতে গেলে তা শুধুমাত্র সময় নষ্ট।এ ভ্রান্ত ধারণাতে অনেক হবু কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী হারিয়ে যাচ্ছে, যদিও এর ব্যতিক্রমও আছে।
ভাগ্নেকে দেখে বিদ্যালয় যাওয়ার আবদার করলেও, কিছুদিন গিয়েই ঘটে উল্টো ঘটনা।সে কি কান্না! 'যাব না আমি যাব না'। শেষে গৃহ শিক্ষকদের কাছে শিক্ষা পেয়ে তিলে তিলে গড়ে ওঠে আজকের পাঠ্যের আবশ্যক কবি, সাহিত্যিক, লেখক, যার লেখা সহজপাঠে আমাদের শিক্ষা শুরু।তার যুগে প্রাধান্য পেত প্রকৃত শিক্ষা। আর বর্তমান শিক্ষা শুধু ডিগ্রি অর্জন, নতুন শ্রেণীতে উত্তীর্ণ। প্রকৃত শিক্ষিত হোক না হোক , হতে হবে ডিগ্রিধারী। রবীন্দ্র যুগে শিক্ষা বলতে সার্বিক শিক্ষা বোঝাত। শিল্প-সংস্কৃতি ছিল শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।কিন্তু বর্তমানে প্রথাগত পুথিগত শিক্ষাই প্রধান।শিক্ষাক্ষেত্রেও ঘটেছে আমূল পরিবর্তন।
"আমি হিন্দু","আমি মুসলমান" এ কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। কিন্তু "আমি মানুষ" একথা কাহাকেও বলতে শুনি না।যারা মানুষ নয়, তারা হিন্দু হোক, বা মুসলমান হোক, তাদের দিয়ে জগতের কোনো লাভ নেই।"
- রবীন্দ্রনাথ একথা বহুকাল আগে বলেছেন। তিনি বিদেশ ভ্রমণে বহুবার যান এবং সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রচার করেন বিশ্ব ভাতৃত্বের বাণী।বর্তমান সমাজে বহু ক্ষেত্রেই চোখে পড়ে জাতিভেদ, প্রায় পত্রিকায় ছাপা হয় ধর্মের রক্তক্ষরণের কথা, ডাঙ্গার কথা। যেখানে জাতে জাতে এ বিভেদ,সেখানে বিশ্বভাতৃত্ব তো অনেক দূর। তিনি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ধর্মান্ধতার তীব্র প্রতিবাদী ছিলেন।তবুও আমরা, বিশেষত বাঙালিরাই জাতপাত গড়ে তুলি, ভেদাভেদ সৃষ্টি করি।
রবীন্দ্রনাথের সাধনাজাত রবীন্দ্র সংগীত তার আদিসুর হারিয়েছে, সুর বেসুর মিলছে। আধুনিক সুরে তা শ্রুতিমধুর হলেও, হারায় তারা আদি প্রাধান্য। আবার কখনো রবীন্দ্র সুরে রচিত হচ্ছে কুশ্রাব্য সংগীত। না সঙ্গীত বললেও সঙ্গীতের অপমান হয়।তার সাধনা ক্ষেত্র শান্তিনিকেতন ঘটে এ ঘটনা।রবীন্দ্র সংগীত হারাচ্ছে জনপ্রিয়তা, রবীন্দ্র সংগীত এই হচ্ছে উদম নৃত্য। শান্তিনিকেতন চলছে অরাজকতা, রাজনীতি, রবীন্দ্রব্যঙ্গ, এসব আমাদেরই লজ্জা।
রবীন্দ্রনাথের সকল স্মৃতি সমাদর পেলেও, বাংলার বুকে বহু বিখ্যাত ব্যক্তির বাসগৃহ ,স্মৃতি অবহেলিত। হারিয়েছে কালীঘাটের পটের মত বহু শিল্প।বাংলার লোককথা, লোকগীতি, হস্তশিল্প অনেক কিছুর মূল্য বাঙালি দিতে জানে না , বিশ্ববাজারে তার সম্মান পেলে তবে বাঙালির চোখ খোলে।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী। তিনি গাছপালা, পশুপাখি ভালোবাসতেন।চার দেওয়ালে তার দম বন্ধ হয়ে আসত। এমনকি মৃত্যুর পরে বাইশে শ্রাবণ বৃক্ষরোপন দিবস রূপে পালিত হয়। বাংলার সবুজকে রঙকে তিনি বানান উৎসবের রূপে বাঁচাতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত অরণ্য ধ্বংস, বন্যকে বন্দি , বায়ু- মাটি -জল- শব্দ দূষণ করে চলেছি। প্রকৃতির বুকফাটা চিৎকার শুনিনি।আজ করো না তার প্রতিশোধ নিতে এলে আমরা অনুভব করছি বন্দীদশার কষ্ট, শ্বাসকষ্টের জ্বালা, অরণ্য ধ্বংসের ফলাফল।করোনা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করলেও, প্রকৃতিকে তার আগের রূপে, রবীন্দ্র কল্পনায় ফেরাচ্ছে।
প্রতিবছর সারা বাংলা জুড়ে ধুমধাম করে পালিত হয় রবীন্দ্র জয়ন্তী, কিন্তু অবাঞ্ছিত হয় রবীন্দ্র আদর্শ। তাই শপথ নেই গৃহবন্দী থেকে পালন করব রবীন্দ্র জয়ন্তী আর মান্যতা দেবো রবীন্দ্র আদর্শকে। এ বিপদের দিনে গেয়ে উঠব রবীন্দ্রসুরে,
"বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়..... "
করোনা ভাইরাস অভিশাপ নয় আশীর্বাদ'হয়ে নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে
বটু কৃষ্ণ হালদার
দিনে দিনে পৃথিবীর অসুখটা বেড়েই চলেছে,বাড়ছে গৃহবন্দি মানুষগুলোর চরম উদ্দীপনা। লোকালয়ে ফিরছে জঙ্গলের জীবজন্তু। চেনা পৃথিবী,চেনা পরিবেশে আজ বড্ড অচেনা। সত্যি প্রকৃতি এভাবে তার বদলা নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সৃষ্টিতে সবুজ সতেজ পরিবেশে ছিল অফুরান জীবন বাঁচার রসদ।পৃথিবী ছিল জীবজন্তুদের দখলে। ধীরে ধীরে সেই পৃথিবীর বুকে মানব সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। সেই সভ্যতা শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে থাকে। আধুনিক থেকে আধুনিকতর হওয়ার লক্ষ্যে সবুজ সতেজ জঙ্গল কেটে গড়ে তোলে কংক্রিটের আবদ্ধ জঙ্গল, অবাধে ঘুরে বেড়ানো জীবজন্তুদের সীমানা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশে থাকা শালিক চড়ুই কাক বাবুই, ফিঙে সহ নানান পাখিদের অস্তিত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাদের জায়গা দখল করতে থাকে আধুনিক মনস্কতা দু_পেয় জন্তুরা। তার উপর সভ্য সমাজের দুই পেয় জীব গুলোর অসচেতনতার ফলে, অ্যামাজন ও অস্ট্রেলিয়ার মত দুটি জঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শুধু তাই নয় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৫০,০০০ হাজারের ও বেশি জীবজন্তু, সেইসঙ্গে জঙ্গল থেকেও আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। তার ওপরে কমিউনিস্ট চীন দেশের উহান প্রদেশে জীবজন্তুদের প্রতি অমানবিক অত্যাচারের ভিডিওগুলি প্রকাশ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।আধুনিক হওয়ার লক্ষ্যে মানুষ পরিবেশের সঙ্গে যে চরম বেঈমানী করেছে, তার ফলাফল করোনা ভাইরাস। ভাইরাসের আতঙ্কে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ কার্যত গৃহবন্দি। ইতালি, আমেরিকা,ফ্রান্স,রোম,স্পেন,চীন সহ বহু সমৃদ্ধশালী দেশ মৃত্যুর মিছিলে হাঁটছে। দিনে দিনে মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়া তো,এই সমস্ত উন্নত দেশগুলোতে বাড়ছে কফিনের চাহিদা।সমগ্র বিশ্বের মানুষের চোখেমুখে আতঙ্কের ছায়া। ইরাক,ইরানের মতো দেশগুলোতে গণ কবর খোঁড়া হচ্ছে। তাতেও হুঁশ ফেরেনি ভারতবর্ষের মানুষগুলোর। তার ফলে ভারতবর্ষের গতি পথ সেই দিকেই মোড় নিচ্ছে ধীরে ধীরে। অসচেতনতা ভারতবর্ষ ধ্বংসের একমাত্র মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হবে সে বিষয়টি কিন্তু পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষ আর্থিক দিক দিয়ে তেমন সচ্ছল নয়। তা সত্ত্বেও দেশের সরকার জনগণের কথা ভেবে লকডাউন এর দ্বিতীয় পর্যায় ঘোষণা করেছেন। ক্ষতি হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। ধীরে ধীরে নিঃশেষের পথে ভারতের রাজকোষ। তবুও এই লড়াই থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে ভারত সরকার কোন ত্রুটি রাখছে না। কিন্তু জনগণ সবকিছু জেনে-শুনেও লগ ডাউন কে উপেক্ষা করে বাইরে বেরিয়ে এসে জমায়েত হচ্ছেন।এতে শুধুমাত্র ভারত সরকারের নয় সমস্ত জনগণের ক্ষতি হচ্ছে। দেশের কিছু বিবেকহীন অপদার্থ মানুষগুলোর জন্য সারা ভারতবর্ষের মানুষ আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বর্তমান সময়ে বিশ্বের বুকে করোনা অভিশাপ রূপে বয়ে চলেছে অবিরত আপন ধারায়।
কথায় আছে মন্দের ও কিছু ভালো দিক আছে। মানুষ সেই আশা নিয়ে বাঁচে যে গহীন আঁধারের বুক চিরে সূর্য আবার উঁকি দেবে পূব আকাশে। গৃহবন্দী মানুষজন গাড়ি, কলকারখানা বন্ধ।বিজ্ঞানীরা বলছেন এই কদিনে বিভিন্ন জায়গায় আংশিক বা পূর্ণ লকডাউনে পরিবেশ দূষণের মাত্রা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে কমেছে, আকাশের দৃশ্যমানতা বেড়েছে, গঙ্গা যমুনা ফিরছে স্বমহিমায়। সমুদ্রের ধারে অনেক দিন পর আবার ডলফিন দেখা গেছে, শালিক,চড়ুই,বাবুই,কাক ফিঙে সহ পরিযায়ী পাখিরা আবার ফিরে আসছে। বহু যুগ পর মানুষজন আবার পাখির কিচিরমিচির গান শুনছে মন প্রাণ ভরে। হিমবাহের বরফের গলন কমেছে। প্রকৃতি আবার একটু শ্বাস নিতে পারছে।কর্মব্যস্ততা, বন্ধু বান্ধব, পার্টির জন্য আমরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিলাম। ভুলতে বসেছিলাম পরিবারের লোকজনর কথা। আজ পরিবারই সবার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে। আমরা ভুলতে বসেছিলাম যে আমরা একে অপরের পরিপূরক। একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকারের কথা অসহায়,আর্তপীড়িত মানুষগুলোর স্বপ্নগুলোকে পদদলিত করতে শিখেছিলাম। করোনার প্রকোপে জাতপাত ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে সবার পাশে দাঁড়ানোর আকুল আর্তি নিয়ে হাজির হচ্ছে দুয়ারে দুয়ারে। আমরা বই পড়তে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই আলমারির ধুলো ঘেটে না পড়া বইটা বা ভালোলাগার গল্প গুচ্ছ সমগ্রটা স্পর্শ করে দেখতে শুরু করেছে অনেকেই। যারা ধর্ম ধর্মের বেড়াজালে হত্যা লীলায় মেতে উঠেছিল, যারা সমাজের ভীরু দুর্বলদের উপর নিজেদের জোর জুলুম অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল, আবার আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদীরা,এই মুহূর্তে সবাই ভয় পেয়ে গেছে।পারমাণবিক বোমা, মিগ বা রাফায়েল বিমান দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে মানুষের প্রাণ নেওয়া যে অনেক সোজা কাজ কিন্তু মানুষের প্রাণ বাঁচানো যে অনেক কঠিন কাজ সেটা আজ অনেক রাষ্ট্রনায়করাও বুঝতে পারছেন সেটা প্রমাণ হয়ে গেল। তার সঙ্গে প্রমাণ হয়ে গেল শুধু অর্থ দিয়ে শ্রেণী বৈষম্যের ভেদাভেদ করাটা ভুল। কারণ এই মুহূর্তে টাটা বিড়লা আম্বানির যে জায়গায়় দাঁড়িয়ে, একটা সাধারণ নিম্ন পরিবারও সেই জায়গায়় দাঁড়িয়ে। অর্থ আজ মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। যারা সমাজে নোংরা অপকর্মম করে বেড়াতো, সমাজের হায়নাা নামক ধর্ষকরা, আজ ভয় পেয়ে গেছে, নারীরা কিছুটা হলেও এ সময় নিরাপত্তা বোধ করছে। বিশ্বের পানশালা,মদের আসর,জুয়ার আসর,হোটেল-রেস্টুরেন্ট,সহ বহু কিছুু বন্ধ হয়ে গেছে, করোনা প্রমাণ করে দিয়ে গেল এই সমস্ত আমোদ প্রমোদ ছাড়াও মানুষ বাঁচতে পারে,জন্মনিয়ন্ত্রণের অভাব বোধটা এসময় বেশ বুঝতে পারছে সবাই, সঞ্চয় করাটাও খুব জরুরী তা প্রমাণ হয়ে গেল, আর মানুষ সীমিতভাবে ও জীবন যাপন করতে পারে, সেটাও করোনা বুঝিয়ে দিয়ে গেল। দুঃশাসন দের বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানানোর লোক এখন নেই, কারণ দুঃশাসনীয় এখন ভয়ে সিটিয়ে গেছে। পুলিশ রা ঘুষ খাওয়া ছেড়ে অকাতরে দিন রাত কর্তব্য পালনে ব্যস্ত। এই মুহূর্তে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী দের মারার কথা বলছেনা,তাদের সুস্থতা কামনায় সবাই ব্যস্তত হয়ে উঠছে।
জ্যোতিষী,তান্ত্রিকরা এখন নিজেদের ভাগ্য গণনায় এ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।ঘৃনা নয় ভালোবাসার জয়গান চারিদিকে বিরাজ করছে।মন্দির মসজিদ চার্চের মুখে মাক্স পরিয়ে দিয়ে গেছে করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাস প্রমাণ করে দিয়ে গেল ধর্ম নয়, প্রাকৃতিক শক্তি হলো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তি। তাকে উপেক্ষা করার মত দুঃসাহস বোধহয় আজ কোন ধর্মের কাছে নেই।এর থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় বিজ্ঞান।তাই বিজ্ঞানকে প্রয়োজনে ব্যবহার করুন। করোনাভাইরাস আরো প্রমাণ করে দিয়ে গেল, বিশ্ব পরিবেশের বিশ্রামের প্রয়োজন। আর তাতে লাভ মানব সভ্যতার। এই মুহূর্তে করোনা র আতঙ্কে সারা বিশ্ব মাসের-পর-মাস লকডাউন মেনে নিচ্ছে। হয়তো আজ নয়তো পরশু পৃথিবী আবার শান্ত হবে, তখন নিয়ম করে বছরে মিনিমাম ১০ টা দিন পরিবেশের জন্য লকডাউন বাধ্যতামূলক করা হোক। মানবিক আবেদন করাটা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব ও নৈতিক কর্তব্য মধ্যে পড়ে। করোনা র প্রভাবে হয়তো আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি, কিন্তু আন্তরিকতার সাথে ভেবে দেখার অনুরোধ রইলো, যে হারানোর থেকে অনেক বেশি আমরা ফিরে পেয়েছি শুধু মাত্র করোনা র জন্য।তাই করোনা অভিশাপ নয় আশীর্বাদ হয়ে নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে, সে বিষয়টা কিন্তু পুরো পরিষ্কার। তবে এটা লক্ষণীয় বিষয় যে, করোনা আমাদের যে শিক্ষা গুলো দিয়ে গেল, সেই সুশিক্ষার ধারা সমাজের বুকে কতটা প্রভাব ফেলবে, বা করোনা আতঙ্ক কেটে যাওয়ার পর সেই শিক্ষার ধারা আমরা কতদিন কাঁধে করে নিয়ে বয়ে বেড়াতে পারব,সেটাই দেখার বিষয়।
পরিবেশে রোগব্যাধি ছিল, আছে, থাকবেই; কোভিড ১৯ এবং আপনি ও আমি একসাথেই বাঁচবো
সব্যসাচী নজরুল
কি ভাবছেন? কারো কি জানা আছে বা আমরা কেউ কি বলতে পারবো যে আগামী ১৫ দিন, একমাসের মধ্যেই কোভিড ১৯ সংক্রমণ কমে যাবে, করোনাভাইরাস পরিবেশ থেকে উধাও হবে! নিঃশেষ হয়ে যাবে? আগামী তিনমাস, ছয়মাস, এক বছরের মধ্যেই পুরোপুরি ধ্বংস হবে! না,আমরা কেউ কিন্তু জানি না,তবে এফবিতে অনেক বুজুর্গ আর কুতুব আছেন যারা হয়তো কেউ কেউ ঔষধও আবিষ্কার করে ফেলেছেন। পৃথিবীর কোথাও কিন্তু এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। কিছু ঔষধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হচ্ছে মাত্র। একমাত্র আল্লাহ ই জানেন এ রোগের শেষ কোথায়। তবে সম্মিলিতভাবে চীন, জাপান, জার্মানি, লন্ডন, আমেরিকা, স্পেন, ফ্রান্স, ভারত, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ডসহ আরো অনেক দেশ করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে, খুব শীঘ্রই সারা বিশ্ববাসী আমরা আলোর মুখ দেখতে পাবো। বাংলাদেশও ঔষধ আবিষ্কারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। লন্ডনের ডঃ হার্বি তার আবিষ্কৃত ঔষধ, ভ্যাকসিন প্রায় সারে সাত হাজার করোনা আক্রান্ত রোগীর উপরে প্রয়োগ করে ট্রায়াল চালাচ্ছেন, সফলতা আসবে নিশ্চয়।
এখন যে কথাটি বলতে চাই- কমিউনিটি মেডিসিনের উপরে আমারও ১২০০ মার্কের পড়াশোনা রয়েছে। পরীক্ষা দিয়েই স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদ ডিগ্রি নিয়েছি, তাও আবার ঢাকা আইএইচটি থেকে যেখানে এক কলমও ইংরেজি ব্যতীত বাংলা লেখার সুযোগ ছিল না। বলছি শুনুন পৃথিবীর কোথাও এখনো করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। তবে উন্নত বিশ্বের সম্মিলিত প্রয়াসেই আমরা বিশ্ববাসী সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখবো খুব শীঘ্রই। আর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরে আমাদের বাংলাদেশে ২৬ হাজার ভ্যাকসিন হিরো(আমিও একজন), স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদ, স্বাস্থ্য সহকারীর হাতেই উঠবে, যারা সারা দেশবাসীকে কোভিড ১৯ সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য প্রাণপনে লড়ে যাচ্ছেন, তারাই দেশবাসীকে ভ্যাকসিন পুশ করবে। আচ্ছা, ধরুন আগামীকালকেই শুনলেন করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে চীন, জাপান, লন্ডন, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম বা অন্য কোন দেশে। তবে তার পরের দিনই কি আমরা আমাদের দেশে ভ্যাকসিন পেয়ে যাবো। না, আমার তা মনে হয় না?
কারন সারা বিশ্বের আটশো কোটি মানুষেরই কিন্তু প্রটেকশন লাগবে, ভ্যাকসিন লাগবে। এতো ভ্যাকসিন একসাথে আবিষ্কার করাও সম্ভব নয়। তাই সবার প্রথমে উন্নত বিশ্বের প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী, শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোই আগে ভ্যাকসিন পাবে। এর পরে পর্যায়ক্রমে থার্ড ওয়াল্ডের আমাদের মতো রাষ্ট্রগুলোতে আসবে। তবে মানবতার জননী খ্যাত আমাদের সাহসী রাষ্ট্র নায়ক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি চলমান এ ক্রান্তিকালে সারা দেশবাসীকে, জাতিকে সুস্থ রাখতে, ভালো রাখতে রাতদিন, নিরলস ভাবে খেটে যাচ্ছেন, একটি সেকেন্ডের জন্যও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না, আমাদের কল্যাণেই যিনি প্রতিটি রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিচ্ছেন। আমরা তাঁর সাহসী সৈনিক হিসেবে দুর্বার সাহসের সাথেই করোনা মুক্তিযুদ্ধ করে যাচ্ছি। সেই মহান ব্যাক্তিত্ব, মহিয়সী নারী, ভ্যাকসিন হিরো, বঙ্গোত্তম, জননেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারনেই আমরা ভ্যাকসিন আগে পাওয়ার আশা করতে পারি।
আল্লাহ মহামারি এ রোগ দিয়েছেন, আর আল্লাহ ই মাফ করবেন। কিছু লোক তো মারা যাবেই, এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন মহামারিতে যুগে যুগে যা হয়েছে, আজও তাই হবে। আমাদের কর্তব্য করোনা মুক্তিযুদ্ধের সাহসী যোদ্ধা হিসেবে ঘরে থাকা। রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিনিষেধ, স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা। দুঃখের বিষয়, গতকাল শরীয়তপুরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে আসলাম, হাঠ-বাজারে, রাস্তা ঘাটে এতো লোকজন যে দেখে মনে হলো কেউ আর লকডাউন মানছে না। মুদি দোকান, কাপড়ের দোকানগুলোতে চাঁদ রাত লেগে গিয়েছে (অন্যান্য দোকানেও ভীর লক্ষনীয়)।
কি বলবো! অগ্রিম বলছি মিলিয়ে নিয়েন, আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি। যার ভয়াবহ মাশুল আমাদের দিতে হবে! মাননীয় সরকার প্রধান, সরকার, প্রশাসন, আর্মি, র্যাব, পুলিশ, লকডাউন, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদ, স্বাস্থ্য কর্মী, সর্বোপরি স্বাস্থ্য বিভাগ আমাদের সকলের সম্মিলিত চেষ্টায়, রাতদিন এক করা নিরলস পরিশ্রমে জাতিকে সুস্থ রাখার, ভালো রাখার প্রচেষ্টায়ই আনুপাতিক হারে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় আমরা ভালো আছি। মরক লাগলে গুনে কুল পাওয়া যাবে না। দুঃখের বিষয়, এখন যে কেউ যে কোন রোগে মারা গেলেই আমরা তাকে করোনার কারনে মৃত্যু বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছি। আর করোনায় বা করোনা সন্দেহে মারা গেলেতো কথাই নেই, কেউ লাশের কাছেও যাচ্ছি না। গোসল, জানাজা দিতে দিচ্ছি না, এমনকি নিজ গ্রামেও অনেকের দাফন কাফন করতে দেওয়া হচ্ছে না। সন্দেহজনক কেউ পরীক্ষা নিরীক্ষায় করোনা পজিটিভ হলে তাদের সাথে শহর বা গ্রামে যাচ্ছে তাই আচরণ করা হচ্ছে, যেন তারা এদেশের নাগরিক নয়! শহর বা গ্রামের কেউ নয়, পৃথিবীরই বাসিন্দা নয়! সবাই যেন এলিয়েন, কোন ভিনগ্রহের প্রাণী! কেন কেন কেন রে ভাই এমন আচরণ?
রোগ হবে, আল্লাহ চাহে তো সুস্থ হবো,এটাই স্বাভাবিক। ভয়ের কি আছে? বেশি বেশি সচেতন হতে হবে। আপনি যদি করোনা আক্রান্ত পজিটিভ ব্যক্তির কাছ থেকে কমপক্ষে ৬ ফিট দূরত্ব বজায় রাখতে পারেন, করমর্দন, কোলাকোলি না করেন তবে আপনি নিরাপদ। সর্বোবস্থায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। স্বাস্থ্য বিধি, বিধিনিষেধ, নিয়মনীতি মেনে চলে তো নড়িয়ার বারোজন করোনা পজিটিভ রোগীই সুস্থ আছে, ভালো আছে। গতকাল ঢাকা থেকে করোনা পজিটিভ রোগী পালিয়ে এসেছে, ওরে আল্লাহ এলাকাজুড়ে সে কি আতংক, যেন সে কয়েকশো লোককে মার্ডার করে এসেছে। আক্রান্ত মহিলা এলাকায় আসার সাথে সাথেই খবর পেয়ে টিএস স্যারের নেতৃত্বে আমি ও স্যার এলাকার মেম্বার কে নিয়ে সে মহিলার বাসায় যাই, তার কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করি, তাকে তার করনীয় সম্পর্কে বলি, স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে বলি, তার পরীক্ষার ব্যবস্থা করি, তিনি সুস্থ হবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করি। এভাবেই ছুটে যাচ্ছি সন্দেহজনক মানুষের মাঝে। আচ্ছা, একবার ভাবুনতো একজন মানুষ করোনা রোগী বা পজিটিভ রোগী তার মনের অবস্থাটা কেমন হতে পারে? আর যদি তার সাথে ভীন গ্রহের প্রাণীর মতো আচরণ করা হয়? ভাবুন তো! সে তো এমনিতেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পরবে। গত দুমাস ধরেই সন্দেহজনক মানুষ, রোগীদের সংস্পর্শে যাচ্ছি, একটিবারের জন্যও ভয় পাইনি, ভয় লাগেনি। ভয় পেলে তো আর মানবসেবা করা যাবে না। বারো বছর হলো মানবসেবায় রয়েছি, চলমান এ ক্রান্তিকালে মহামারি করোনাভাইরাসের সময়েও আছি, আমৃত্যু থাকবো ইনশাআল্লাহ। মরতে তো হবেই একদিন, তবে সাহসের সাথেই লড়বো, বাঁচবো না হয় মরবো। বিধাতার লিখন না যায় খন্ডন, কপালে যা আছে তাই হবে।
কি মনে হয়? আগামী একমাসের মধ্যে, তিনমাস, ছয়মাস, একবছরের মধ্যেই করোনা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার মনে হয় না। আল্লাহ ই আমাদের হেফাজতকারী। কার মাঝে করোনাভাইরাস আছে আর কার মাঝে নেই, এখন আর তা ভাবার সুযোগ নেই, পরিবেশের সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে পরেছে করোনাভাইরাস। তবে কি ভাবছেন আগামী তিনমাস, ছয়মাস, একবছর লকডাউন থাকবে আর সরকার আপনাকে আমাকে ঘরে বসিয়ে বসিয়ে ত্রাণ দিবে! কেউ কেউ ত্রাণের চাল গম আটা তেল চিনি চুরি করে আঙুল ভুলে কলাগাছ হবে, ঔষধের দোকানী, ফল ব্যবসায়ী, মুদি দোকানী কেউ কেউ পঁচাবাসী পোকায় কাটা নষ্ট জিনিস, ভালোখারাপ মিলিয়েমিশিয়ে একাকার করে আগামী দশ বছরের ব্যবসা করে নিবে(যে সব দোকানে সারা মাসেও একদুলাখ টাকা বিক্রি হয়নি তারা এখন ঘন্টায় বিক্রি করছেন একলাখ দুলাখ টাকা), কেউ কেউ বিভিন্নজন, সংস্থা থেকে ত্রাণ পেয়ে ৪/৫ মাসের খাদ্য মজুদ করে ফেলবে, যারা চাইতে পারে না সে সব মধ্যবিত্ত পরিবার কি খেয়ে না খেয়ে মারা যাবে? খেটে খাওয়া কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান কে করবে, কিভাবে হবে? কেউ কি সুদ ঘুষ খাওয়া বন্ধ করেছে, কারো পাপ করার প্রবণতা কি কমেছে, মিথ্যা বলা কি কমেছে, পন্য-মুদ্রা বাজারে সিন্ডিকেট করে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া কি বন্ধ হয়েছে? রাষ্ট্রের আয়ের উৎস সরকারী টেক্স ফাঁকি দেওয়া কি বন্ধ হয়েছে? বড় বড় ঋনখেলাপী কি ঋণের টাকা পরিশোধ করেছে? শেয়ার বাজারে চুরি কি বন্ধ হয়েছে? গরীবের হক মেরে লুটেপুটে খাওয়া কি বন্ধ হয়েছে? সামাজিক অবক্ষয়,পরক্রীয়া কি বন্ধ হয়েছে? সর্বক্ষেত্রে যে যার প্রাপ্যতা কি বুঝে পাচ্ছে? ভন্ড মুক্তিযোদ্ধা কি রাষ্ট্রীয় ভাতা খাওয়া, সন্তানের চাকুরীবাকরিতে সুবিধা নেওয়া কি বন্ধ করেছেন? কই না তো! আমিও কিন্তু কবিতা লেখা বন্ধ করি নাই। সব ঠিকঠাক চলছে! করোনা কাউকে কাউকে কোটিপতি করছে, আর কাউকে ভিখারী, কারো জান নিবে, কারোটা নিবে না, কেউ কেউ নতুন ধান্ধাবাজিতে সামিল হবে এরুপ বহু প্রশ্ন, উত্তর কে দেবে!
আপনি আমি যেমন পরিবেশে থাকি তেমনি রোগ জীবাণু, ভাইরাসও পরিবেশে থাকবে। কালে কালে যুগে যুগে নতুন নতুন সমস্যা, রোগব্যাধি আসবে, আসতেই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্য দিয়েই আপনাকে আমাকে মানিয়েগুছিয়ে নিয়ে চলতে হবে, বাঁচতে হবে। ধরে নিন, কাল থেকে লকডাউন নেই! তবে কি পালিয়ে অন্য গ্রহে চলে যাবো, না মাটির তলায় আশ্রয় নিবো। না ভাই কিছুই করতে হবে না। আপনি নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচান, নিজের গ্রাম, নিজের পরিবেশ, নিজের দেশকে বাঁচান। আপনি নিরাপদে সুস্থ থাকলেই ভালো থাকবে পরিবার, পরিবেশ, ভালো থাকবে দেশ। আজকাল আমরা বড্ড বেশি ময়লা হয়ে গিয়েছি, আমাদের মন মানসিকতাও পঁচে গিয়েছি। করোনা আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সুস্থ থাকতে হলে, ভালো থাকতে হলে, নিরোগ থাকতে হলে কি কি করতে হবে। পয়পরিস্কার থাকতে হবে, চাই পুষ্টিকর সুসম খাদ্যাভ্যাস, ব্যক্তিগত পয়পরিস্কারে আরো বেশি সচেতনতা, আরো বেশি সাবধান হতে হবে। নিজের পোশাকআশাক, বাড়ির আশপাশ, ঘরদোর, যাপিত জীবনের সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির পরিষ্কার পরিছন্নতায় অত্যাবশ্যকতা ইত্যাদি ইত্যাদি। করোনা শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সারাপৃথিবীবাসী বিশ্ব মানবতার একটা গ্রাম হয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে, সুখেদুঃখে একে ওপরে মিলেমিশে, ভয় ডরহীন, যুদ্ধ বিগ্রহ বিহীন, পরম মমতায়, ভালোবাসায় থাকো। কেউ কারো ক্ষতি করোনা! যা আরো সারে চৌদ্দশত বছর আগে নুরুন আলা নূর, নূর নবী, বিশ্ব মানবতার কাণ্ডারি, সরদারে দোআলম, দোজাহানের বাদশাহ, মায়ার নবী, শাফায়াতের নবী, বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) শিখিয়ে গিয়েছেন। আজ আমরা বিশ্চুত হয়ে গিয়েছি ধর্মীয় বিধান,বিধিনিষেধ, নিয়মনীতি, আইনকানুন থেকে, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন, নিয়মনীতি, বিধিনিষেধ, করনীয় স্বাস্থ্য বিধি থেকেও। সবাই যেন সবটা করে ফেলেছি, মানি আর না মানি, সবকিছুই জানি এমন ভাব। শংশয়,ভয়, ডর, আতংক নয়, করোনাকে হারাতে হবে। করোনা মুক্তিযুদ্ধে আমরাই জয়ী হবো ইনশাআল্লাহ। আসুন সামাজিক দূরত্ব, ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখি, যার তার সাথে করমর্দন, কোলাকোলি না করি, লোকালয়ের বাইরে অপরিচিত পরিবেশে কম যাই, যেখানে সেখানে কফথুথু না ফেলি, হাঁচি কাশিতে টিসু বা রুমাল ব্যবহার করি, বারবার সাবান পানিতে হাত ধুই, ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিছন্নতা বজায় রাখি, হাইজিন মেনে চলি, ঘরেই থাকি। অপ্রয়োজনে বাইরে কম বের হই। পরিবেশে রোগব্যাধি ছিল, আছে, থাকবেই ; করোনাভাইরাস এবং আপনি ও আমি একসাথেই বাঁচবো। আপনি আমি সুস্থ থাকলে, ভালো থাকলেই সুস্থ থাকবে, ভালো থাকবে প্রিয় মাতৃভূমি, প্রাণের বাংলাদেশ।
স্বপ্ন দেখে মন
সোমা বোস
আকাশপানে যতদূর নজর যায় ততদূর চেয়ে চেয়ে শুধু হাল্কা কালো মেঘের সারি দেখা যায় আর গতরে লাগে উল্টাপাল্টা পাগলা হাওয়া। এদিকে আজ এখনও হাঁড়িতে চড়েনি কিচু। চড়বে কি করে? শুধু রেশনের মোটা চাউল ক'দ্দিন আর চার চারটে পেট ভরাতে পারে! তাও যেটুকু এখনো বাকী আছে তা দিয়ে আজ নাহয় কোনওমতে হয়ে যাবে। এদিকে আনাজপাতি ঘরে কিছুই নাই, বাজারে গিয়ে যে কিনবে তার পয়সাও নাই। মাচানের লাউডগা, কুমড়োডগাও কেটে খাওয়া শেষ। এদিকে ঘরে ঢুকলেই হাঁ করে গিলতে আসবে তিনখানা পেট। তাই কিছু কল্মিশাক না তুললেই নয়। কাল খেয়াল করেচিলো ওদিকপানে বেশ বড়ো একটা কল্মিশাকের ঝোপমতো আচে। মনে হয় এর মধ্যে আর কারোর নজরে তা আসেনি। তাই হয়তো বা কেউ সেগুলানকে তুলে নিয়েও যায় নি। যাই, তাড়াতাড়ি যাই… এই ভেবে কবিতা তাড়াতাড়ি পা চালায় সেদিকে। আজ প্রায় দু'মাস হতে চললো যাদবপুরে দাদাবাবুদের বাড়ীতে সে আর কাজে যায় না। যাবে কি করে? ডেলি পেসেঞ্জারি করতো যে টিরেনে চেপে সেই টিরেনলাইনটা কেমন ব্যাবাক একা একা বোকার মতো পড়ে আচে। টিরেন চললে তবেই না কাজে যাওয়া! তো লকডাউন হয়ে টিরেনে করে কাজে যাওয়া বন্ধ। বাবুদের ভরসা যেমন আমরা, তেমন আমাদের ভরসাও তেনারা। তো কি করোনা না মরোনা বলে একটা সর্দি-কাশির রোগ এয়েচে বলে নাকি এই লকডাউন। বাপের জম্মে এমন কতা শোনেনিকো কবিতা। ক্যান্সার, এইডস এসব বড়ো বড়ো রোগ থাকতে নাকি বাবুদের এই সর্দি-কাশির মতো আকচার হওয়া রোগে এতো ভয় ধরলো যে সরকারও সব বন্ধ করে দিলে! শুনচে নাকি এ রোগ বড়ো ছোঁয়াচে, তা সর্দিকাশি তো চিরকালই এমন ছোঁয়াচে! এ আর নতুন কতা কি! বড়োলোকেদের যতোসব আতুপুতুপনা! মরণ!
তা সে যাকগে যাক। দাদাবাবু বলেচিলেন যে তিনি আমাকে কাজ ছেড়ে দিতে বলচেন না, শুধু এখন ক'দিন যেতে না করচেন। তেনার কথামতো ব্যাঙ্কের পাসবই নে গেচিলাম একদিন, দাদাবাবু তেনার মোবাইলে পাসবইয়ের পেত্থম পাতার ছবি তুলে নিয়ে বললেন নাকি ঘরে বসে বসে মাইনে পেয়ে যাবো। তো পেত্থম মাসে আমার মোবাইলে বৌদিমণি ফোন করে জানালেন যে টাকা নাকি আমার অ্যাকাউন্টে ঢুকে গেচে। কিন্তু টিপছাপ কবিতা কি কোনওদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তুলেচে যে আজও যাবে? যে মহাজনের কাচে টাকা ধার করে আচে, সে-ই গিয়ে তুলে আনবে'খন সেখান থেকে। কিন্তু এ'মাসে তো বৌদিমণির ফোন এখনও এলো না। টাকাটা ঢুকলো কি ঢুকলো না কে জানে! বৌদিমণিকে ফোন করে যে জানবে তারও উপায় নেই। তার ফোনে পয়সা নাই, ভরা হয়নি। এদিকে মাস তো শেষ হতে চললো, চলবে কি করে! তার মধ্যে বড়ো মেয়েটা পাঁচমাসের পোয়াতি। পোয়াতি হয়ে ইস্তক তার কাচেই এয়ে রয়েচে। জামাই পেত্থম পেত্থম টাকা পাঠাতো, এখন আর পাঠায় না… খোঁজও নেয় না। ঝামেলা বিদেয় করেচে যেন! ছোট মেয়েটা সরকারী ইস্কুলে পড়ে বলে সরকার থেকে অবশ্য চাল আর আলু পেয়েচিলো। কিন্তু এতগুলো পেট! তার মধ্যে পোয়াতি মেয়েটা একটু বেশীই খায়। আর ঘরে বসে বসে যেন বাকীগুলানেরও আর মনিষ্যির পেট নাই… রাক্কসের পেট হয়ে গেচে! ছোটমেয়ে মঞ্জু তো সারাক্ষণ খাই খাই করেই চলেচে। আর মঞ্জুর বাপটা, একটা জোয়ান মরদ। শহরে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতো। এখন কাজ খুইয়ে চব্বিশঘণ্টা ঘরে বসে শুধু বৌ'য়ের সাথে কুঁদুলেপনা করে চলেচে আর খাওয়ার অর্ডার করেই চলেচে। এ জীবন আর ভালো লাগে না হে ঠাকুর… তুলে নাও আমায়, তুলে নাও। আরে এই তো, এই তো… সেই কল্মিশাক তেমনটিই রয়েচে এখানে, কেউ নেয়নিকো। ঠাকুর, এমনি করেই আমাদের তুমি বাঁচিয়ে রেখো গো ঠাকুর! একটু বেশী করেই তুলে নে যাই, আজ বিকেলে নাকি আবার আম্পান নামে কি একটা ভয়ানক ঝড় আসবে একখানা… বলচে সবাই। ঝড়েরও আবার নাম! কালে কালে কি যে সব হলো! তা যাকগে, কাল যদি আবার বেরোতে না পারি! এখনই যা জোরে হাওয়া চলচে… পা চালাই তাড়াতাড়ি।
- হেই মা, ভাত দে।
- এই যে দিই বাপ। আরেকটু বাকী।
- এখনো বাকী? খিদা লাগচে যে বড়ো!
- তোর এতো খিদা পায় কেন রে?
- কে জানে!
- নে, আমায় খা। খেয়ে শেষ কর!
- কী বললি মঞ্জু'র মা? খেতে দিতে পারিস না আবার আমার মেয়েকে এসব কতা বলিস! আগে আগে রান্না শেষ করতে পারিস না? বিকেল হয়ে গেলে রোজ ভাত খাওয়াবি?
- চুপ, ঘরে বসে বসে একদম বড়ো বড়ো কতা বলবি না। এতই দরদ যখন, তখন নিজেও তো রান্নাটা করতে পারিস!
- কি বললি মাগী? আমি? আমি করবো রান্না! তুই মাগী রান্নাটাও করবি না? আয় এদিকে, আজ তোর একদিন কি আমারই একদিন!
- আহ্ লাগে! চুল ছাড়, চুল ছাড় বলচি। নাহলে কিন্তু...।
- নাহলে কী? বল কী? আজ তোকে মেরেই ফেলবো।
- উহ্ লাগচে! তাই কর, একদম মেরেই ফ্যাল। একটু একটু করে রোজ মারার চাইতে একবারে মেরেই ফ্যাল!
- মাআআআ… ভাতে পোড়া গন্ধ!
- অ্যাঁ! দ্যাখো দিকিনি! ছাড়, চুল ছাড়। ভাত যে পুড়ে গেলো! এই নামাই রে মা। এই তো, ভাত নেমে গেলো। বেশী পোড়েনি। আয়, খাবি আয়।
- মাআআআ… বাইরে সুপুরি গাছটা কি জোরে জোরে দুলতে লেগেচে দ্যাক! ওই… ওই দ্যাক কোতা থেকে কার শাড়ী এসে আমাদের জবাগাছে পড়লো। আমি নে আসি মা?
- ওরে না, ঝড়টা এসেই গেলো রে! খবরদার বাইরে বেরোস না! আয় চটপট খেয়ে নে গরম গরম ভাত।
- মাআআআ… বুনু বাইরে গেলো যে! আর দেকতে পাচ্চি না যে! বোধহয় আম কুড়োতে গেলো। আমিও যাই মা...।
- আরে দ্যাখো কান্ড! তোরা কী চাস বলতো! এই তো খিদা পেয়েচে বলে ব্যস্ত হচ্চিলিস! এখন আবার গরম ভাত ফেলে ঝড়ের পেচনে ছুটলি সব! বলিহারি যাই তোদের! ওরে আম খেয়ে পেট ভরবে না! মঞ্জু'র বাপ, বসে না থেকে যা না ওদের নিয়ে আয় না, যা। কিচু তো কর! মরণ!
- হ্যাঁ, এই যাই...।
কিছুক্ষণ পর…
- মঞ্জু'র মা, শীগগির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আয়!
- ঘর! ঘর আর কোথায় রইলো রে মঞ্জু'র বাপ, ঘরের চাল, জানালা-দরজা সবই তো উড়ে গেলো! দেওয়াল ধ্বসে গেলো। আর কিচ্ছু যে রইলো না আমাদের! (কান্না)
- আরে কতা বলবি পরে। ওপরে তাকিয়ে দ্যাখ তোর মাথার ওপরে যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা ভেঙে পড়চে রে! শীগগির এদিকপানে সরে আয়!
কবিতা একদৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে মঞ্জু'র বাপের চওড়া বুকে। শক্ত করে চেপে ধরে তার সুঠাম কাঁধ। মঞ্জু'র বাপ একহাতে মঞ্জুকে ধরে আরেকহাতে কবিতা'র মাথাটা চেপে ধরে শক্ত করে। পোয়াতি বড়োমেয়েটা মা'য়ের পিঠে আছড়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। মঞ্জু'র বাপের লোমশ বুক ভিজিয়ে কবিতা বলতে থাকে "আমরা যে সব্বোসান্ত হয়ে গেলাম রে মঞ্জু'র বাপ! আর কিচ্ছুটি যে রইলো না আমাদের! কিভাবে বাঁচবো আমরা!"
- বাঁচবো, আমরা সবাই বাঁচবো! তাকিয়ে দ্যাখ চারদিকের চারটে খুঁটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে ঠিক। ওখানে আবার আমরা আমাদের ঘর তৈরী করবো। দেখিস মঞ্জু'র মা, আবার আমাদের সব হবে আগের মতো!
- বলছিস? সব আবার আগের মতো হবে?
- হ্যাঁ রে, হবে। তোরা সবাই শুধু আমায় শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাক। ছাড়বি না একদম, কিছুতেই ছাড়বি না কিন্তু।
- না, ছাড়বো না রে মঞ্জু'র বাপ। ছাড়বো না।
চারজনে পরস্পরকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে…। ঠিক যেন এক ভাস্কর্য! আর ওদের অলক্ষ্যে বিধাতা যেন মাথায় বৃষ্টিরূপী আশীষ বর্ষণ করে চলেন। প্রবল আম্ফান-ঝড়ের ঝাপটা তাই ওদের একটুও হেলাতে পারে না। ওদের চোখে যে তখন করোনা, আম্ফান সবকিছু ছাপিয়ে এক নতুন জীবনের স্বপ্ন! বৃষ্টির জল আর চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেই স্বপ্নদর্শনের জগতে। থাকুক, ওদের চোখে স্বপ্ন থাকুক... সব হারিয়েও ওরা ভালোবাসায় দু'দন্ড বুঁদ হয়ে থাকুক! সবকিছু হার মানলেও ভালোবাসা যে হার মানে নি ওদের জীবনে!
ছোট্ট প্রশ্ন
লকডাউন ও বারান্দা
কাকলি ভদ্র
হাততালির শব্দ কানে আসতেই দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে রোশনি দেখল সবাই "উই শ্যাল ওভারকাম’' গান গাইছে বারান্দার ফুরফুরে হাওয়ায়। মনেই হচ্ছে না যে, এই বাতাসে মিশে থাকতে পারে মারণ বিষ। সময় মেপে রোজকার ছুটোছুটিতে এখন লকডাউন। শেষ কবে এই বারান্দায় বসেছে মনেই করতে পারছে না রোশনি। অথচ মফস্বলের মেয়ে রোশনির কলকাতায় বিয়ের পর এই এক চিলতে বারান্দাই ছিল নকশিকাঁথার মাঠ। স্কুল, সংসার সামলে সে ফুরসত আর হয় না এখন। দলছুট এই বিকেলে এ বারান্দা, ও বারান্দা, সে বারান্দা! নানা মানুষ! ছোট, বড়, মাঝবয়সী! চেনা, অচেনা বা আধচেনা। ঘরবন্দী জীবনে মুক্তির খোলা জানলা যেন এই বারান্দা।সবাই যে যার বারান্দায় থেকে হাততালি দিয়ে চিৎকার করে গাইছে "উই শ্যাল ওভারকাম"। স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে রোশনি বহুবার গলা মিলিয়েছে এই গানটা। ১৯৬৩ এর অগাস্টে ওয়াশিংটনে মার্টিন লুথার কিং এর পদযাত্রায় এই গান পৃথিবী জুড়ে দারুণ সাড়া ফেলেছিল।হৃদয় ছুঁয়েছিল সবার। এই গান গেয়েছেন রবার্টা মার্টিন, পিট সিগার, জিলফিয়া হর্টন, ফ্রাঙ্ক হ্যামিল্টনের মত গায়কেরাও।গানটা শুনে রোশনির মনে হচ্ছে পুরো কমপ্লেক্সটাই যেন একটা পৃথিবী। বারান্দাগুলো একেকটা মহাদেশ। সবাই মিলে গাইছে সৃষ্টির আগমনী গান। দু'হাত মেলে দিয়ে গান ধরল রোশনিও। গেয়ে উঠল –"আমরা করব জয়"। রোশনির পৃথিবীটা চুপ করে রইলো।তারপর... সবাই একসঙ্গে গেয়ে উঠল-"আমরা করব জয়"...
অর্পিতা গুহ মজুমদার
লকডাউন পর্বের চল্লিশ দিন কেটে গেছে। গৃহবন্দি দশ বছরের ছোট্ট তিন্নি পড়াশোনা, লুডো খেলা,দাবা খেলার পাশাপাশি মা,বাবার সাথে নিয়মিত টিভিতে খবর শোনার অভ্যাস করে নিয়েছে। কতজন করোনা পজেটিভ ধরা পড়লো,কতজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলো,স্কুল খোলার সম্ভাবনা আছে কিনা সবকিছুই যেন তিন্নি বুঝে নিতে চায় খবরের মাধ্যমে। বৈজ্ঞানিকরা মোটেই মন দিয়ে কাজ করছে না, নাহলে এতদিনেও একটা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলো না -- এইসব কতকিছু যে আপনমনে ভেবে চলে তিন্নি। ট্রলি ব্যাগে ঘুমন্ত ভাইটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া মায়ের ছবি দেখে তিন্নির চোখে জল এসে যায়। এই তো সেদিন খবরে দেখলো ট্রেনের হকার কাকুদের একেবারেই রোজগার নেই। আরো কতরকম কষ্টের কথা মায়ের মুখে শুনতে পায় তিন্নি। মনে মনে ভাবে তার হাতে যদি একটা যাদুদন্ড থাকতো তাহলে তাহলে 'করোনা ' নামের জীবাণুটাকে অনেক অনেক দূরে পাঠিয়ে দিত।আরো একটা প্রশ্ন আজকাল তিন্নিকে খুব ভাবায়।স্কুলে একদিন ম্যাম বলেছিলেন যে, মোবাইল ফোনের বাংলা প্রতিশব্দ নাকি মুঠোফোন। আর এই মুঠোফোনের মধ্যে নাকি সারা পৃথিবী বন্দি আছে। তাই তিন্নি ভাবে মানুষের হাতের মুঠোতে যদি সমস্ত পৃথিবী বন্দিই থাকে তাহলে এত মানুষের হাতের মুঠোতে খাবার কেন নেই ? মা ও বাবা দুজনকেই তিন্নি এই প্রশ্নটা করছিল কিন্তু তাঁদের উত্তর তিন্নির মনোমত হয়নি। তিন্নি তাই মনে মনে ভেবে রেখেছে স্কুল খুললেই ম্যামের সাথে এই ব্যাপারে একটু কথা বলবে......।
হারানো সুর
মৌসুমী চৌধুরী
আজ রবীন্দ্র জয়ন্তী। লক-ডাউনের জেরে কলেজ বন্ধ ভাদোর। বেরোনোর সময় শাওন দেখছিল অন-লাইনে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের তোড়জোড় শুরু করেছে ভাদো। সকাল সকাল মিউজিক সিস্টেমে মৃদু বাজছিল, "তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ/ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া...।"
হসপিটাল-ওয়ার্ডে পৌঁছে পিপিই সেফটি কিট, হুড ক্যাপ, থ্রি-প্লাই মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পরে করোনাযুদ্ধের রণসাজে সজ্জিত হতে হতে গানের সুরটা যেন বার বারই বুকে বাজছিল শাওনের। বড় মায়াময় সুর...বুড়ির সুতোয় উড়ে উড়ে আসছিল স্মৃতি-গুঁড়ো, সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল মনের আনাচে-কানাচে--- শাওনের গলায় এ গান শুনতে খুব ভালোবাসতেন অধ্যাপক সুতনু সান্যাল। গানটা শোনানোর জন্য শাওনকে প্রায়শই পীড়াপীড়ি করতেন। সুতনু সান্যাল তাদের কলেজের বোটানির তরুণ অধ্যাপক। তাঁর গমগমে কন্ঠস্বর, স্পষ্ট উচ্চারণ, ফুল- ফল-লতাপাতা বিষয়ে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কবিতার পংক্তি আওড়ে যাওয়া প্রভৃতি বড়ই আবিষ্ট করত লালগড়ের বাঁধগোড়া গ্রামের মেয়ে শাওন হেমব্রমকে।
এইভাবেই একদিন কবে যে ভালোবাসা আলো হয়ে জ্বলে উঠেছিল সুতনু ও শাওনের মনে, বুঝতে পারে নি কেউই। কিন্তু সুতনুদের যে অভিজাত পরিবার! তাঁরা সম্ভ্রান্ত রাঢ়ী বারেন্দ্র ব্রাক্ষ্মণ। কিছুতেই মেনে নেন নি জঙ্গল মহলের দরিদ্র ট্রাইবাল মেয়ে শাওনকে। সুতনু নিজেও কি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না?? হয়তো ভালোবাসা নয়, শাওনের অপূর্ব গানের গলা তাঁকে সাময়িক আচ্ছন্ন করেছিল!
তারপর...দারিদ্র্যের সঙ্গে তীব্র লড়াই করে বহু কষ্টে নার্সিং ট্রেনিং শেষ করেছিল শাওন। চাকরি পেয়েছিল কলকাতায়। সেই থেকেই শাওন আর তার বোন ভাদো পাকা- পাকিভাবে কলকাতায় ফ্ল্যাটে থাকে।
ওয়ার্ড বয়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল শাওন। আজ দু'মাস হল কোভিড-পজেটিভ পেশেন্টদের ওয়ার্ডে কর্তব্যরতা সে। দিন দিন সংক্রমণ বেড়েই চলেছে! মনটা বড় ভারী হয়ে আসে শাওনের! কবে যে সারবে পৃথিবীর এই অসুখ! আজ আবার নতুন পেশেন্ট এসেছে দু' নম্বর কেবিনে। চিন্তিত মুখে ফাইলটা দেখতে দেখতে পেশেন্টের নামে হঠাৎ চোখ আটকে যায় শাওনের ---- সুতনু সান্যাল!!!
পেশেন্ট কেবিনের দিকে ছুটে যায় শাওন। কাঁচের জালানা চুঁইয়ে সকালের হলদে নরম আলো তখন লুটোপুটি খাচ্ছে দু'নম্বর কেবিনে। সুতনুর ভেঙে পড়া ছ'ফুটের সেই অভিজাত শরীরটা দেখে চোখ ফেটে জল চলে আসে শাওনের !
পাঁজর ভেঙে শাওনের বুকে যেন ঝাপটা দিতে থাকে সুদূর অতীতের হারানো সেই সুর---
"...আমায় পরশ ক'রে প্রাণ সুধায় ভ'রে/ তুমি যাও যে সরে---/ বুঝি আমার ব্যথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাক/ওগো দুখজাগানিয়া।"
ফোনকল
অনিমেষ সরকার
বহুদিন পর একটা বিরক্তিকর ফোন কল ঘুম ভাঙালো। এমনিতেই সারাদিন খেটে মরা তার উপর এইসব ফোন। ঝাপসা চোখে ফোনের স্ক্রীনে তাকাতেই ভেসে উঠলো দীপ্তর নম্বরটা।বিরক্তিকর হয়ে ওঠা পরিবেশটা একটু ঝিমিয়ে গেলো মৃদু খুশীর মেজাজে।
ফোনটা কোনোভাবে তোলা হলো। প্রথমেই কানে বাজলো সমস্ত শব্দের গহ্বর চিড়ে "আমি এসে গেছি" "কী বলছিস!"
- "হুম বাগডোগড়া এয়ারপোর্টে।"
-"গাড়ি পেয়েছিস !"
- " তোকে না বলেছিলাম সময় মতো ড্রাইভার পাঠিয়ে দিবি গাড়ি শুদ্ধ!"
- "হ্যাঁ!হ্যাঁ ! মনে আছে
মনোজ ওখানেই আছে"।
প্রায় দুইবছর পর দীপ্ত ফিরছে।
এখন শুধু দীপ্ত নয় বিখ্যাত পরিচালক দীপ্তময় মল্লিক। গতকাল থেকে লোডশেডিং চলছে শহর জুড়ে।তারমধ্যে দীপ্তর ফিরে আসা।যা চলছে গত কদিন আর এতকিছুর মধ্যে দীপ্ত যে ফিরছে সেটা মাথায় রাখাই মুশকিল।তবুও ভাগ্যিস মনোজদা ওখানেই ছিলো।
শেষবার দীপ্ত অনেক বার বলেছিলো চলে আয় মুম্বাই ওই জলপাইগুড়িতে কিচ্ছু নেই।এখানে আয় আমার সাথে কাজ কর। অভিনয়ে সুযোগ আমিই দেবো করে। না যেতে চায়নি সৌম্য। এই শহরে অনেক স্মৃতি ওর। দীপ্ত বোধহয় আগের মতো নেই!সৌম্যর আরও মনে পড়ে যাচ্ছে দীপ্ত আর ওর সম্পর্কটা।আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো নয়। বাড়িতে সেবার ওদের দুজনকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিলো সৌম্যর মা ।তারপর দীপ্তর ঠিকানা বদলে মুম্বাই। দিন রাত কেঁদেছিলো সৌম্য। বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে কত মেয়ে দেখা হলো।ছেলের মেয়েদের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। ওর ওই দীপ্তকেই চাই অবশেষে ওদের যুক্তিই খাটলো। মা বাবা চলে যাওয়ার পর। ভাবতে ভাবতে আনন্দে শিহরিত হচ্ছিল সৌম্য। আবার একটা ফোন এলো।সৌম্য রিসিভ করতেই
-" কী রে কখন আসছিস ! কতক্ষণ বসবো। দীপ্তোর বডিটা নিতে হবে তো! জলদি আয়"...
কালোয় আলোয়
সুপর্না চৌধুরী
সাতবছরের তিতলির আলোময় জীবনটা হঠাৎ অন্ধকারপূর্ণ হয়ে গেল ।মারণব্যধি করোনায় দেশজুড়ে লকডাউন। তিতলিকেও হতে হল ঘরবন্দী। নার্স মা ও পুলিশ বাবাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল করোনা যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে। বাড়িতে ঠাম্মা আর তিতলি। ঠাম্মা বয়সে ভারগ্রস্ত শরীরটা নিয়ে কোন রকমে জীবনের অতি প্রয়োজনীয় কাজটুকু করেন। সারাদিনের সাহায্যকারিনী পারুলদিও লকডাউনের জেরে আসতে পারছে না।
ঠাম্মাকে তাই কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করে তিতলি। ঠাম্মার প্রতিদিনের একই রান্না প্রায়ই পছন্দ হয়না তার। মায়ের কথা মনে করে চোখ ফেটে জল আসে। কখনও প্রতিবাদ করে। আগের মত ঠাম্মাও তাকে আদর করে ভালোভাবে না বুঝিয়ে রাগ দেখান। রোগজ্বালায় ঠাম্মা খিটখিটে হয়ে গেছেন। তবু তিতলি মাকে বলে, "আমি ভাল আছি মা, সব ঠিক আছে। তুমি কোন চিন্তা কর না।"
এরমধ্যে তিতলি অনেক কাজ শিখে গেছে--- জামা গোছান ,জলভরা, থালাবাসন সাজিয়ে রাখা়, সবজি তুলে রাখা, মাছ ধুয়ে দেওয়া, জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা। মা তো বাড়িতে আসেন না, ফোনে কথা বলেন। তিতলি যা যা শিখেছে সব বলে মাকে। মাকে সে জিজ্ঞেস করে, "কবে আসবে, মা? তাড়াতাড়ি এস না।"
মা বলেন, " আমি একটু সুযোগ পেলেই আসব, সোনা।" মা ছাড়া অসহ্য লাগে তিতলির ঘরবন্দি জীবন! তার বাবারও তো দিন-রাতের ইমারজেন্সী ডিউটি। একাকি হাঁপিয়ে ওঠে ছোট্ট তিতলি। কাঁদে আর ছবি আঁকে।
একদিন মা ফোনে বললেন, "আমি নববর্ষের দিন ছুটি নিয়ে বাড়ি যাব। দুদিন থাকব তোমার সঙ্গে।"
তিতলির তো আনন্দের সীমা নেই। মা এলে কি কি করবে, কিভাবে করবে তারই পরিকল্পনা করতে লাগল মনেমনে।
কিন্তু মা আসার আগের দিন খবর এল মা তার করোনা-সাসপেক্টেড । আলোটা মুহূর্তে গাঢ় অন্ধকার হয়ে যায়। ছোট্ট তিতলির পৃথিবী ডুবে যায় চোখের জলে।
সকাল থেকে এগিয়ে যেতে থাকে সময়, কিন্তু তিতলি বা ঠাম্মার খেয়াল থাকেনা। একসঙ্গে বসে থাকে দুজনে। দুজনের চোখে জল, সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কারও কাছে নেই। তখনই হঠাৎ ফোন বাজে, ঠাম্মা ফোন ধরেন। টুকরো টুকরো কথা কানে যায় তিতলির "না, ও আসেনি এখানে। ও হসপিটালেই আছে শুরু থেকেই।" তিৎলি বোঝে পাড়ার কেউ হবেন। তারা জানলাও খোলে না আর। ক' দিনেই তিতলি যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন কোনকিছু নিয়ে বায়না করে না, যা পায় তা দিয়ে সময় মত সব কিছু করে নেয়। করোনা বিষে আক্রান্ত যে তিতলির শৈশব।
তারপর একদিন খবর আসে তার মা কোভিড-নেগেটিভ । তিতলি আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে, "হুররে!" কিন্তু প্রতিবেশীর আজও তাদের সংশয়ের চোখে দেখে! ছোট্ট তিতলি কিছুতেই বুঝতে পারে না, কেন?
জার্মান কানেকশন
মানস রায়
পদ্মনাভ বাবু আজ সকালে খবরের কাগজ পড়ার সময় থেকেই খানিকটা অন্যমনস্ক ছিলেন। বাড়ির পাশেই সকালবেলায় বাজার বসে, প্রতিদিনের রোজনামচা মতন এই রিটায়ারড লাইফে সে পায়ে হেঁটেই বাজার করে এনে, গ্রিন টিতে চুমুক দেয় রোজ।
স্ত্রী ওঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন - "কিগো ট্যাক্সি ড্রাইভার কে তো আজ কল করার কথা ছিল সকাল দশটায় ",
পদ্মনাভ বাবু হয়তো সেই কথাটা আবছা শুনতে পেলেন বা পেলেন ই না।
বিকেল পাঁচটায় তার অতি প্রিয় একমাত্র মেয়ে স্বামীকে নিয়ে জার্মানি যাচ্ছেন।যাবেনই তো, ওখানে তার মেয়ে -জামাই সস্ত্রীক হামবোল্ট ইউনিভার্সিটি তে গবেষণার সুযোগ পেয়েছেন। বার্লিনে থাকবেন। হয়তো গবেষণা শেষে তারা সেখানে প্রফেসর পদে যোগ দিয়ে , পাকাপাকি ভাবে সেটেল ও হবেন।
"এ বছর জন্মদিনে আসবিনা মা? "- পদ্মনাভ বাবু তার মেয়েকে বললেন।
'বাপি, সেদিন ভিডিও কলে তোমাদের থেকে আশীর্বাদ নেব' - মেয়ে জবাব দিলেন। গলা কেমন জড়িয়ে এলো পদ্মনাভ বাবুর।
সেদিনের সেই ছোট্ট বাবলি যে কিনা এই সেদিনও রাজা বাজার সায়েন্স কলেজে মাস্টার্স এ ভর্তি হয়েছিলেন সাক্ষী ছিলেন তার বাবা ,তাকে আবার কবে শিলিগুড়ি র এই দুইকামরার ঘরে তিনি দেখতে পাবেন....
এই ভেবেই কি পদ্মনাভ বাবু সকাল দশটায় তার স্ত্রীর সেই কথাটা আর শুনতে পাননি বা শুনেও সেই আবছা শুনেছেন?????
অন্ধিকা
লুবনা আখতার বানু
মাত্র দুই বছর বয়সের সুরভী কোথা থেকে একটা ছুটে এসে অন্ধিকার পিঠে ভর করে বললো, "ও মা বাবা কবে আসবে গো?"অন্ধিকা তখন বসে বসে কাপড় কাঁচছিলো।সাবান মাখা কাপড়গুলোর উপর থেকে হাত সরিয়ে অন্ধিকা সুরভীর কথার উত্তর দিতে পারলো না।কিছুটা সময় সুরভীর মুখের পানে তাকিয়ে থাকলো মাত্র।তারপর হাতটা ধুয়ে ছোট্ট সুরভীকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,"তোর জন্য অনেক চকলেট এনেছি।তুই খাবি?"
ছোট্ট সুরভী মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে হাতটা পেতে বললো দাও তবে।আর তারপর চকলেটগুলো হাতে পেতেই ছুটে আবার বাইরে চলে গেলো সে।
অন্ধিকা মাত্র তেইশ বছর বয়সের একটি মেয়ে। তার নামটার সাথে তার জীবনের গল্পটারও পুরো মিল আছে।মানে তার জীবনটাও অন্ধকারেই ঢাকা।অন্ধিকা তার বাপের বাড়ীতেই একটি রুমে তার মেয়ের সাথে থাকে।দিল্লীর সুলতানপুরী নামক একটি স্থানে অন্ধিকাদের বাড়ী।সুরভীর বয়স যখন মাত্র ছয় মাস তখন অন্ধিকা হারিয়েছে তার স্বামী ও সংসার।সুরভী তার একমাত্র কন্যা সন্তান বলেই হয়তো স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ীতে ঠাই হয় নি অন্ধিকার।তারপর থেকেই তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে নতুন সংসার বাপের বাড়ীর একটি রুমে।বাপের বাড়ী থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত মোতিনগর নামক একটি স্থানে বেশ কয়েকটি বাড়ীতে কাজ করে অন্ধিকা।লেখাপড়া শেখা হয়নি অন্ধিকার।অন্য দিকে মোট চার বোন ছিলো বলেই হয়তো কম বয়সেই বিয়েও হয়ে যায় তার।আর তাই মানুষের বাড়ীতে বাসনমাজা,কাপড়কাঁচা,ঘরমোছা এইসব কাজই করতে হয় তাকে।আর এভাবেই কঠোর পরিশ্রম করেই চালাতে হয় তাকে তার ছোট্ট সংসার।
রোজ ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে পড়ে অন্ধিকা।তারপর বাড়ীর সব কাজকর্ম সেরে,মেয়েকে স্নান করিয়ে তাকে খাইয়ে তারপর নিজের স্নান খাওয়া সেরে নেয় সে।এরপর ভীষণ দ্রুত সুরভীর সারাদিনের খাবার টিফিন বক্সে প্যাক করে নিয়ে অন্ধিকা নিজের মায়ের কাছে ছাড়ে সারাদিনের জন্য ছোট্ট সুরভীকে।তারপর ঠিক সকাল আটটায় সে ও বাড়ী থেকে বেড়িয়ে পড়ে নিজের কর্মক্ষেত্রে।এভাবেই কঠোর পরিশ্রম করেই কাটতে থাকে তার দিনগুলি।
অন্যদিকে ছোট্ট সুরভীও বিদ্যালয়ে যাবার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।অন্ধিকার মা অন্ধিকার আবার বিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন।কিন্তু অন্ধিকা তার মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সে আর বিয়ে করতে চায় না।সে তার ছোট্ট মেয়েটিকে সুন্দর করে মানুষ করে তুলতে চায়।এভাবে রোজ ভোর পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করার পরও অন্ধিকা মুচকি হেসে ছোট্ট সুরভীকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার স্বপ্ন দেখে।সুরভী তার অন্ধকার জীবনের একমাত্র আলো।আর সেই আলোকে কিছুতেই নিভতে দেবে না সেই প্রতিজ্ঞা করে অন্ধিকা।
ঐতিহাসিক এক ভুতুড়ে ঘটনা
শ্রেয়সী দে
ইতিহাস, এই বিষয়টা খুব প্রিয় আমার।
ইতিহাস- এ মোড়া একটা ভয়ানক,রোমাঞ্চকর ঘটনা আমারি জীবনের একটা খুব বড় অঙ্গ।
আমার নাম মাধুরী। ক্লাস ওয়ান থেকেই পড়াশোনার প্রতি আমার খুব ঝোঁক। কোনোদিনই ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হইনি। যেদিন ক্লাস ফোরের রেজাল্ট বের হলো, সেদিন ফার্স্ট হলেও আমার মনটা খুব খারাপ ছিল। কারণ, পুরোনো স্কুল ছেড়ে নতুন স্কুল-এ, নতুন পরিবেশ-এ চলে যেতে হবে।
অনেক বন্ধুদের সঙ্গে হয়তো আর কোনোদিনও দেখা হবে না। তারপর যেদিন নতুন স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম, সেদিনি হলো ইতিহাস-এর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট পিরিয়ডেই ছিল ইতিহাস।ধীরে-ধীরে বুঝতে শুরু করলাম ইতিহাস-কে। ইতিহাস মানেই পুরোনো ঘর-বাড়ি, যুধ্য-বিদ্রহ, রাজ-রাজাদের গল্প।যখন আমি মিউজিয়ম-এ যেতাম, তখন ওখানে রাখা বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখে আমার খুব ভালো লাগতো। মনে হতো ইতিহাসই আমার ভবিষ্যত।
যেকোনো ভ্যকেশনে আমি মিউজিয়ম, রাজবাড়ি এরকম ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান-এ বেড়াতে যেতাম। ইতিহাসই আমার বেস্ট ফ্রেইন্ড।
ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়েই আমার বড়ো হওয়া।
এখনও সুযোগ পেলেই আমি ছুটে যাই নতুন কোনো ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের খোঁজে। আর নানান মূর্তি ও নানান ঐতিহাসিক বস্তুর ছবি বন্দী আছে আমার ক্যামেরায়।
তবে এবার বলি সেই রোমাঞ্চকর ভুতুড়ে ঘটনার কথা-----‐---------
দিনটা ছিল খুব সুন্দর, ফুরফুরে। আমার তাই খুব ইচ্ছে হলো কোথাও বেড়াতে যাওয়ার। শীতকালে রোদের মুখ দেখলে, সবকিছুই ভালো লাগে। বেরিয়ে পড়লাম। আমার একটা গাড়ি আছে, সেই গাড়ি করেই আমি বেড়াতে যাই। সেদিনও আমি এই গাড়ি করেই বেরিয়েছিলাম।
আমি যেতে-যেতে অনেকটা দূরে চলে গেলাম।
বেলাও পড়ে এসেছিল, হঠাৎ-ই বিনা মেঘে বজ্রপাত। শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। কিছুই দেখতে পারছিলাম না। কী হলো----- আমার গাড়িটা কোন এক জঙ্গলে ঢুকে পড়ল এবং সঙ্গে-সঙ্গে থেমে গেল। চারিদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার।
বৃষ্টিও প্রায় কমে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। যদি কোনো বাড়ি পাই, তাহলে রাতটুকু আশ্রয় নেব। মোবাইলের ফ্ল্যাস জ্বালিয়ে ঘুরতে লাগলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল, বার-বার ঘুরে একই জায়গায় ফিরে আসছি। ঘুরতে-ঘুরতে হঠাৎই দেখি এক বিরাট বাংলো। দেখে ঐতিহাসিক বাংলো বলেই মনে হলো। সামনে গিয়ে ডাকতে লাগলাম---" কেউ আছেন--------", অনেকবার ডাকলাম, কেউ নেই। এরপর যখনই বাংলোতে ঢুকতে গেলাম, বাংলোর দরজা একা-একাই খুলে গেল। অবাক লাগলো, ঢুকে পড়লাম। আবার সেই দরজা একা-একাই বন্ধ হয়ে গেল। সে এক বিরাট ঘর, আলো জ্বালানো চারিদিকে। হঠাৎই দেখি এক বিরাট টেবিল, আর তার ওপর সাজানো আছে নানা রকমের খাবার। খিদেও পেয়েছিল খুব, এই ভেবে একটু খেয়ে নিলাম। তারপর যতই চলি, ঘরও যেন ততই বড়ো হয়। হঠাৎ এমন একটা জায়গায় চলে গেলাম, দেখে মনে হলো, একটা সাজার জায়গা। চারিদিকে নানান ধরনের বাক্সতে ভরা, সামনে পর্দা ফেলানো একটা আয়না, তারপাশেই আছে একটা কাঠের আলমারি। কিসের একটা আওয়াজ----------- পেছনে তাকাতেই দেখি, একজোড়া ঘুঙুর। এটা একটু অদ্ভুত হলেও, আমি ভয় পাইনি, মনে সবসময় সাহস রেখেছি।
কেন যেন একটু ভুতুড়ে মনে হচ্ছিল সবকিছু। ইতিহাসের সঙ্গে-সঙ্গে ভুত জিনিসটাও জানার শখ ছিল আমার। যাইহোক গল্প-এ ফিরে
আসি-------। আবার একটা শব্দ পেলাম---।
সামনে তাকাতেই দেখি, আলমারিটা খোলা। সামনে গিয়ে দেখি, নানা রঙের শাড়িতে ভরা সেই আলমারি। পাশে যে বাক্সগুলো ছিল, সেগুলো খুলতেই দেখি---- কতরকমের গয়না---।সাজতেও বড়ো ভালোবাসি আমি‐--, সেজে ফেললাম কিছু গয়না দিয়ে। ছোটবেলা থেকে নাচ করার শখ ছিল, তবে সেটা ঠিক হয়ে ওঠেনি। ঘুঙুরজোড়াও পড়লাম দু-পায়। তারপর, আয়নার পর্দা সরাতেই দেখি---------
অন্য একজন-এর মুখ অর্থাৎ অন্য একটি
মেয়ে-----! একটু ভয় পেয়ে যাই, তবুও মনকে শক্ত করে বলি----"কে তুমি?-----"
আয়নার মেয়েটি বলে- "আমি মেঘা--"।
আমি দেখি, তার চোখে জল। জিজ্ঞেস করি
"তুমি কাঁদছো কেন?---"
উত্তরে সে বলে-" সে এক লম্বা কাহিনী----। জানো তো ত্রিশ বছর ধরে এই আয়নায় আমি বন্দী।" অবাক হয়ে বলি- "ত্রিশ বছর !"
মেঘা বলে- " হ্যাঁ ত্রিশ বছর ।"
আমি জানতে চাই- " কিন্তু কেন? "
সে বলে- " তবে শোনো--------- যখন আমার পাঁচ বছর বয়স, তখন থেকেই আমি নাচ শিখতাম।
নাচ আমার খুব ভালো লাগতো। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় আমি অংশগ্রহণ করতাম এবং অনেক ট্রফি, মেডেলও পেতাম। একসময় এমন এক প্রতিযোগিতার কথা শুনি, যেখানে চ্যম্পিয়নকে দেওয়া হবে সোনার মেডেল।
আমার এর প্রতি কোনো লোভ ছিল না, শুধুমাত্র প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর জন্যই আমি সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। আমার পাশাপাশি অনেকেই, সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল। তার মধ্যে কল্যানী নামে একটি মেয়ে ছিল, যে কিনা কালো জাদু জানতো। তার উদ্দেশ্য ছিল, সেই সোনার মেডেল জেতা। এরপর শুরু হলো প্রতিযোগিতা।
প্রথমে পঞ্চাশ জনের মধ্যে থেকে, বেছে নেওয়া হলো বিশ জনকে। তার মধ্যে আমার এবং কল্যাণীর নাম ছিল পাশাপাশি। আবার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। এরপর, বেছে নেওয়া হলো দশ জনকে। তখনও আমাদের দু- জনের নামই সেখানে ছিল। শেষে, দশ জন থেকে সেরা পাঁচ জনকে বেছে নেওয়া হলো। তার মধ্যে প্রথম নাম ছিল আমার এবং তারপরেই ছিল কল্যাণীর নাম। এরপর, শুরু হলো ফাইনাল রাউন্ড। প্রথম নাম আমার, তাই আমিই উঠে গেলাম স্টেজে।
ভালোই করছিলাম নাচটা----এই দেখে, কল্যাণী কালো জাদুর সাহায্যে, আমার ডান পায়ে কিছু একটা ফুটিয়ে দেয়। তখন আমি নাচ করছিলাম।
প্রচণ্ড ব্যথা হয়, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিইনি।
কোনো ভুল না করেই নেমে আসি স্টেজ থেকে।
এরপর শুরু হয় কল্যাণীর নাচ। অবশ্য কল্যাণীও ভালোই নাচ করছিল। তারপর যখন
রেজাল্ট ঘোষণা হলো, তখন শুনতে পেলাম, চ্যম্পিয়ন হয়েছি আমি। কল্যাণীর মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। আমার গলায় ওঠে সোনার মেডেল।
বুঝতে পারি, কল্যাণী খুব কষ্ট পেয়েছে। এরপর আরও শুনি-- ফার্স্ট রানার্সআপ হয়েছে কল্যাণী।
উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় কল্যাণী কালো জাদুর আশ্রয় নেয়।
এটা আমারই বাড়ি।
প্রতিযোগিতা থেকে ফিরে, এই আয়নায় নিজেকে দেখছিলাম। হঠাৎই আমার শরীরের মধ্যে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই আমার মনুষ্য জীবন-এর সমাপ্তি ঘটে----।
এরপর কল্যাণী আমার আত্মাকে কালো জাদুর মাধ্যমে এই আয়নায় বন্দী করে রাখে। যাতে, কেউ আমার মৃত্যুর রহস্য খুঁজে না পায়।
কল্যাণী সোনার মেডেলটা পায়নি বলে, আমাকেও পেতে দেয়নি।
ধীরে-ধীরে, আমার বাড়িটাও পরিণত হয় ভুতুড়ে বাংলোতে। এই বাংলো অদৃশ্য, কেউ যদি এই বাংলোর চারিদিকে পাঁচ-বার ঘোরে, তবেই সে এই বাংলো দেখতে পায়। তুমিও নিশ্চই এভাবেই এখানে এসেছ ?" উত্তরে বলি-"হ্যাঁ,মানে আমি রাতটুকু আশ্রয় নেওয়ার জন্য, আশ্রয়স্থল-এর সন্ধানে ঘুরছিলাম। ঘুরতে-ঘুরতে চোখে পড়ে এই বাংলো।" মেঘা বলে- "এখন তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ------ আমায় তুমি মুক্তি দাও--।" আমি বলি- " কিন্তু, কী করে--?" সে বলে-" আমার মুক্তির উপায় কল্যাণীই বলেছিল আমায়, কারণ ও ভেবেছিল আমায় মুক্তি দেওয়ার জন্য কেউ কোনোদিনও এই ভুতুড়ে বাংলোতে আসবে না। আমি তোমাকে একটা মন্ত্র বলে দিচ্ছি, তার আগে তুমি যেখানে খেলে, সেখানে গিয়ে দেখ--- টেবিল-এর ওপর জল-এর জগ আছে,আর তার পাশেই আছে নুন-এর কৌটো। জলের মধ্যে নুন মিশিয়ে আনো।"
আমি গেলাম নুন-জল আনতে। নুন-জল নিয়ে ফিরে এসে বললাম-" এবার তুমি সেই মন্ত্রটা আমাকে বলো।" মেঘা বলল -" বলছি শোনো--
'হিং টিং ছটফট-ছটফট আয় মুক্তি---' - এই মন্ত্র পাঁচ-বার বলে এই আয়নার চারিদিকে নুন-জল ছেটাতে-ছেটাতে পাঁচ-বার ঘুরলেই, আমার মুক্তি ঘটবে।"
ওর কথা মতো, আমি তাই করলাম।হঠাৎই মেঘা অদৃশ্য হয়ে গেল। বুঝলাম যে ওর মুক্তি ঘটেছে।
' ইস কী শব্দ-----' এক পলক ফেলতেই দেখি---
আমি আমার গাড়িতে---, জ্যামে আটকেছি--।
হর্ন বাজছে চারিদিকে। জ্যাম কাটতেই দেখি---,
এক বিরাট মিউজিয়ম। ছুটে যাই সেখানে। ভেতরে ঢুকতেই দেখি---এক বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীর ছবি। আর তার নীচেই লেখা মেঘা চ্যাটার্জি।
অবাক হয়ে যাই--। একটু আগেই তো আমি বাংলোতে ছিলাম কিন্তু হঠাৎ কী করে এখানে এলাম। কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। একটু এগিয়ে যেতেই দেখি--- সেখানে রাখা আছে, মেঘার সোনার মেডেল। ছানাবড়া চোখে তাকিয়ে থাকি। অবাক কান্ড !
এও যে এক ঐতিহাসিক ভুতুড়ে ঘটনা। বাড়ি ফিরে সকলকে বলি , এই ঘটনার কথা।
কেউ বিশ্বাস করে না। এখন শুধু একটাই অনুরোধ, আপনারা অন্তত আমার কথাটা বিশ্বাস করুন-----------।।
শাস্তি
বুদ্ধদেব চক্রবর্তী
সকালে ঘুম থেকে উঠেয় ঋজু প্রতিদিন তার ঘরের সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। এটাই ওর রোজকার রুটিন। ওদের দোতলার বারান্দা গা ঘেঁষে একটা সুন্দর সাজানো বাগান।
ঋজু ওর বাবার মুখে শুনেছে বাগানের বেশিরভাগ গাছ নাকি ওর দাদুর হাতে লাগানো। ঋজুর ওর দাদায়ের কথা খুব বেশি মনে নেই। ও যখন খুব ছোটো তখন ওর দাদায় মারা যায়। ঋজু স্থানীয় একটা কনভেন্ট স্কুলের ক্লাস ওয়ানের ছাত্র। ওদের স্কুল সকাল ন টায় শুরু হয়ে চলে সেই দুপুর আড়াইটে পর্যন্ত।
ঋজুদের বাড়ী থেকে ওদের স্কুল টা একটু দূরে তাই ঋজুর বাবা একটা স্কুল ভ্যান কে ঠিক করে দিয়েছেন। ঋজু একাই যায় না স্কুলে, সেই ভ্যানে চেপে। ওদের পাড়ার আরো পাঁচ ছয় জন ঋজুর ক্লাসের বন্ধু ও যায় ওতে চেপে।
এই ভ্যানটা ঋজুর খুব অপছন্দের, কেমন যেন দমবন্ধ করা খাঁচা খাঁচা দেখতে লাগে।
ভ্যানটা চালাই ওদের বাড়ীর পিছনদিকের মুচি পাড়ার হরেন মিস্ত্রি । ঋজুরা ওকে হরেন দা বলে ডাকে। বেশ রাশভারী লোক এই হরেন তার উপর সে যখন তার লাল লাল চোখগুলোকে আরো বড় বড় করে পাকিয়ে ঋজুদের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন যেন ওদের বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। ঋজুর ভয়ে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসতে চাই কিন্তু পারে না বন্ধুরা দেখে হাসবে বলে।
লোকটা খুব কড়া সেই যে ঘরের সামনে থেকে ঋজুকে তুলে নিয়ে যায় খাঁচায় পুরে থামে সেই স্কুলের গেটের ভিতর। মাঝে রাস্তায় কোথাও থামে না এত টুকু। ঋজুদের নামতেও দেয় না গাড়ি থেকে। পথে কত চকলেট, লেজ,কুরকুরে দোকান পড়ে তবুও থামে না লোকটা।ঋজু দের ছাদে উঠলে হরেন এর টালির খাপরা দেওয়া দুকামরার ঘরটা দেখা যায়। বিকেলে যখন ঋজু ছাদে ওঠে তখন দেখতে পাই হরেন দার ঘর। সামনে স্কুল ভ্যানটা দাঁড় করানো থাকে। ওর পেটমোটা পাঁজর উগরানো ছেলেটা সিটে বসে প্যাডেলে পা দেওয়ার চেষ্টা করে। ছেলেটার বয়স ঋজুর থেকে বড় কিন্তু লম্বায় একটুকুও বাড়েনি। ঋজু শুনেছে বড়দের কাছে ওর যেন কি একটা রোগ আছে। ঋজুর মা বলে ওকে নাকি প্রতিমাসে রক্ত দিতে হয়, না হলে ও আর বাঁচবে না। ঋজু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে মানুষকে আবার রক্ত দিতে হয় না কি, কই তাকে তো দিতে হয় না।
মাঝেমাঝে হরেন দা রেগে গিয়ে ছেলেটাকে মারতে যায়, শেষে রুগ্ন ছেলেটার মা এসে ওকে বাঁচায়।
ঋজুর খুব কষ্ট হয় ছেলেটার কথা ভেবে, বেচারি । আর আরো বেশী করে রাগ হয় ওই হরেন লোকটার উপর। লোকটা একদম বাচ্চাদের দেখতে পারে না। ঋজু মনে মনে ঠিক করে লোকটাকে শাস্তি দেবে। কিন্তু কিভাবে?
একটা কার্টুন চ্যানেল দেখতে দেখতে ঋজুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। সকালে ঋজুদের ইস্কুলে পৌঁছে হরেন দা ভ্যানটাকে একটা গাছের ছাওয়ায় রেখে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার আরো কিছু ছেলেদের আনতে যায়। আসলে সে যতজন ছেলেমেয়েকে পৌঁছাতে পারে সেই হিসাবে মাথাপিছু কুড়িটাকা করে পায়। এটাই ওদের স্কুলের নিয়ম। হরেন ছাড়া আরো কয়েকজন আছে যারা এই স্কুল ভ্যান চালায়। সবাই চাই বেশি টাকা রোজকার করতে। তাই একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা সব সময় লেগে থাকে হরেনদের মাঝে। ঋজু হরেন লোকটাকে জব্দ করার জন্য ঠিক ওই সময় টায় বেছে নেয়। সেদিন সোমবার হরেন দা ঋজুদের স্কুলে পৌঁছে ভ্যান টাকে অন্যদিনের মতো বড় আমাগাছটার তলায় রেখে স্কুলের পাশের দোকানে চা খেতে গেল।
তখন প্রেয়ার শুরু হয়নি, ছেলে মেয়েরা যে যার মতো খেলছে,হুড়োহুড়ি করছে। স্কুলের ম্যামরা সবাই তখনো আসেনি। শুধু হেড মিস্ট্রেস অর্চনা দি এসেছেন। তিনি নিজের রুমে বসে আছেন। স্কুলের ঝাড়ুদার হারুদা স্কুলের রুমের তালাগুলো খুলে একে একে পরিষ্কার করছে। তবে বাগানের দিকে যেদিকে হরেনদার ভ্যানটা আছে সেদিকটা বেশ ফাঁকা। ঋজু চারদিক দেখে নিয়ে একটা লম্বা পেরেকের মত ছুঁচালো জিনিস বের করে তারপর সবার অলক্ষ্যে হরেনদার ভ্যানের পিছনের দুটো চাকাতে অনেকগুলো ফুটো করে দেয়। এখন ঋজুর রাগ কিছুটা কমেছে। বেশ হয়েছে এবার লোকটা বুঝবে। মনে মনে হাসে ছোট্ট ঋজু।
সেদিন ফেরার সময় আর হরেনদা আসেনি। অন্য একজন ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। তবে রাত্রে ঘুমাতে গিয়েও ঘুমাতে পারেনি সেদিন ঋজু। নরম বিছানাতে ডোবানো ওর সারা গায়ে যেন কিসের কাঁটা ফুটছিল সারারাত। সারারাত কেন কে জানে হরেনের কথা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল ঋজুকে।
পরদিন সকালে উঠে স্কুলে যেতে গিয়ে ঋজু দেখে হরেন নয় অন্য একজন এসেছে আজ ওকে নিতে। তারপর আরো কিছুদিন যায় কিন্তু হরেন দা আর আসে না। ঋজুকে ছোট্ট মনে কেমন যেন এক অপরাধ বোধ গ্রাস করে। বিকেলে ছাদে উঠে ঋজু হরেনদের ঘরের দিকে তাকায়। ঘর টাকে দেখতে পেলেও কিন্তু ঘরের সামনে স্কুলভ্যানটাকে দেখতে পাই না। ছেলেটাও আর খেলে না বাইরে। তাকেও আর দেখতে পাই না ঋজু।
রাত্রে যখন ঋজুর মা ওকে ঘুম পাড়াতে আসে ঋজু জানতে চাই হরেনের কথা। জানতে চাই কেন সে আর আসছে না। মা উওরে বলে হরেন নাকি তার স্কুলেরভ্যান বিক্রি করে দিয়েছে, আর আসবে না সে কোনোদিন। আসলে সেদিন কে যেন ওর ভ্যানের পিছনের দুটো চাকার টায়ার- টিউব কে নষ্ট করে দিয়েছিল। আবার সেদিন ওর ছেলেটাকে রক্ত দিতে হত। তবুও হরেন ওর স্কুলের বাচ্চারা যাতে ঠিক সময় বাড়ী ফিরতে পারে তাই সেদিনের ওর রোজকারের সব টাকা দিয়ে নতুন টায়ার টিউব লাগালো। এমন কি ওর ছেলের রক্তের বোতলের টাকাটুকুও দিয়ে দিল। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে সেদিন আর টাকা জোগাড় করতে পারেনি হরেন। ছেলের শরীরে রক্ত দেবার টাকাটাও যোগাড় হয়নি তার । রক্ত না পেয়ে হরেনের থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুটির দ্রুত শরীর খারাপ হতে থাকে রাতে তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। চিকিৎসা অবৈতনিক হলেও যাতায়াত, আরো কিছু ঔষধ কিনতে বেশ কিছু টাকা দরকার হয়ে পড়ে তাই সে একান্ত নিরুপায় হয়ে তার প্রিয় স্কুল ভ্যানটা বেচে দিয়েছে অন্য একজনের কাছে।
সব কথা শুনে ঋজুর চোখ ফেটে বাঁধভাঙ্গা জল আসে। মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। মা আদর করে, বলে দূর বোকা ছেলে এভাবে কারোর কস্ট দেখে কাঁদতে আছে,সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু ঋজু জানে আর কিছু ঠিক হবে না। হরেন দা আর কোনো দিনো আসবে না তাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে এবং এর জন্য সে নিজেয় দায়ী। তার সামন্য দুষ্টুমির মূল্য যে এত বড় ভাবে হরেন দা চোকাতে হবে তা ঋজু কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। ঋজু মনে মনে ঠিক করে সে সাহস করে সব কিছু বলবে হরেন দা কে তারপর যা হাবার হবে। হরেন দা হয়ত তার বাবাকে বলে দেবে, তার মিস কে বলে দেবে,অর্চনাদিকে বলে দেবে। সব্বাই তাকে বকবে,মা আর আদর করবে না। বন্ধুরা ও আর খেলবে না।
তবুও সে বলবে। পরদিন সে স্কুল থেকে ফিরে হরেন দার বাড়ীর দিকে গেল একাই। হরেন দা তখন তার বাড়ীর সামনের দাওয়ায় বসেছিল। ঋজুকে দেখে অবাক হয়ে তার বড় বড় লাল লাল চোখ দুটি দিয়ে তাকিয়ে রইল ঋজুর দিকে। ঋজুর খুব ভয় করছে তবু সে সাহস করে কথাটা বলে দে এক ছুট। উর্ধশ্বাস এক ছুটে তার ঘরে ঢুকে পড়ে ঋজু। আর পিছন ফিরে দেখেনি। সে অপেক্ষা করছিল বাবার অফিস থেকে আসার। হরেন দা নিশ্চয় তার বাবাকে সব বলবে।
একসময় তার বাবা অফিস থেকে এলো। ঋজুর বুকে তখন ড্রাম বাজচ্ছে। কিন্তু কই বাবা তো তাকে ডাকল না,বকলোও না । এমনকি রাত্রেও না।
মাও আগের মতোই আদর করল তাকে।
সবই একরকম রইল। সবাইকার ব্যাবহার। এমন কি তার পর দিন তার স্কুলেও। বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসতে ঋজুর মা একটা ক্যাডবেরি তার হাতে দিয়ে বলল্লেন, এটা তার হরেন দা তাকে দিয়ে গেছে। আর বলে গেছে এটা তার সত্যি কথা বলার সাহস দেখানোর পুরস্কার। ঋজু অবাক হলো হরেন দার কাণ্ড দেখে এ আবার কেমন শাস্তি দিল রাগি লোকটা?
দাদু
তৃণা মুখার্জী
পড়ে আছে অনেক স্মৃতি ।
পড়ে আছে ভাঙা লাঠি , ধুলো জমা জুতো। হয়েছে ঝোল দেওয়া তরকারি ও রুটি।
শুধু দাঁত ছাড়া সেই চোয়াল দুটো আর নেই।
প্রেমিকা
শ্যামল কুমার রায়
বছর পঁচিশ আগের তারুণ্যে ফিরে গেলেন ডঃ প্রিয়তোষ সান্যাল। একি কাকে দেখলেন আজ? সেই চেনা মুখ, চেনা হাসি। নিশ্চিন্তপুরের বিনোদ বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি যাকে দেখতেন সে নয় তো? পিছনের বেঞ্চে বসা ক্লাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল চেহারার মেয়েটাকে তিনি বারবার ঘুরে ঘুরে দেখতেন, তাঁর প্রথম ক্রাশ।
খাতার মলাটে যার নাম তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে লিখে রাখতেন; যার হাসি তাঁর চোখে মনে লেগে থাকতো। এতো সেই ঊর্মি। হাঁ নিশ্চিত ঊর্মি। সেই সময়ও মুখ ফুটে বলতে পারলেন না, আজও চুপ থেকে গেলেন ব্লুমহার্ট স্কুলের আজকের রাশভারী প্রিন্সিপাল ডঃ সান্যাল। ঊর্মি এসেছে সিঙ্গেল পেরেন্ট হিসেবে মেয়ের ভর্তির জন্য ইন্টারভিউ দিতে।
চোখাচোখা প্রশ্ন দক্ষ হাতে সামাল দিয়ে চলেছেন মিসেস ঊর্মি ব্যানার্জী। মুখ ফস্কে ডেকে ফেললেন ' পুলু' বলে। পুলু হলো প্রিয়তোষের ডাক নাম, বন্ধুদের দেওয়া। ব্যাস, চোখাচোখি, মুচকি হাসি অষ্টাদশী প্রেমিকা ঊর্মি ফিরে এলো পুলুর কাছে।
মুক্তগদ্য
অবাক পৃথিবী
শম্পা সামন্ত
পৃথিবীটা ছিল শান্ত, শিষ্ট সবুজ গালিচা মোড়া। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। আবার কোথাও নীল সমুদ্রের সাথে সব কিছু যেন এক সূত্রে বাধা। হঠাৎ একদিন শোনা গেল আমাজন বনভূমি অগ্নিদগ্ধ , পৃথিবীর ফুসফুস বলে যে ছিল চির পরিচিত। সকলের চোখের সামনে দাউদাউ করে জ্বলে প্রায় সব শেষ হল। কত বন্য প্রাণীর প্রাণ কেড়ে নিল সেই আগুনের লেলিহান শিখা। দিন অতিবাহিত হয়েছে, হয়তো আবার পৃথিবীর ফুসফুসের মাঝে একটু একটু করে প্রাণের সঞ্চার শুরু হয়েছে।
এমন সময় প্রাণঘাতী এক ভাইরাস ঘটিত মারণ রোগের শিকার হল বহু মানুষ। একটু একটু করে পুরো পৃথিবীটাকে গ্রাস করে নিল এই রোগ। বিঞ্জানীদের ভাষায় এই ভাইরাসের নাম কোভিড ১৯, যার পোশাকি নাম করোনা ভাইরাস। যাকে চোখে দেখা যায় না। তাকে বিনাশ করত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বহু বিঞ্জানী, ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীরা।যার ভয়ে কোটি কোটি মানুষ আজ গৃহবন্দি। গাড়ি বন্ধ, চারিদিক শুনশান। কিন্তু কান পাতলেই শোনা যায় পাখির ডাক , ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। এগুলো মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছিল, কিন্তু আজ তারাই মানুষের সময় কাটানোর একমাত্র সঙ্গী।
দেখতে দেখতে বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হয়েছে মানুষ যখন ঘরবন্দী থাকতে অভ্যস্ত, ঠিক সেই সময় ৩রা মে কাশ্মীরের হান্দ ওয়াড়ায় ঘটে গেল লোমহর্ষক ঘটনা! ছয়জন সৈনিকের প্রাণ, এক নিমিষেই শেষ । রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষ যেখানে মরিয়া সেখানে কিসের প্রয়োজন যুদ্ধের ?পুলওয়ামায় ঘটে যাওয়া সৈনিকদের কথা মানুষ যেভাবে ভুলে গেছে ঠিক সেভাবেই এই ঘটনাকেও আমরা ভুলে যাব।
এত কিছুর পরও করোনা কিন্তু আমাদের পিছু ছাড়েনি। সে একে একে গোটা পৃথিবীকে তার মৃত্যু জালে জড়িয়ে ফেলেছে। বহু মানুষ যখন মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচার জন্য দিন গুনছে, ঠিক তখনই প্রকৃতিও এক ধ্বংস লীলায় মেতে উঠল। প্রবল ঝড় বৃষ্টির তান্ডব চালিয়ে পথে বসিয়ে দিল বহু অসহায় মানুষকে। বহু মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে , অভুক্ত থেকে রাতের পর রাত জেগে দিন গুনছে পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক তার আশায়। জানিনা আর দেখা যাবে কিনা ওই অসহায় মানুষগুলোর ঠোঁটের পাশে লুকিয়ে থাকা মৃদু হাসি । ওদের প্রাণ খুলে হাসতে মানা কারণ ওরা গরীব , ওদের পাকা ঘর নেই, মাথার ওপর ছাদ বলতে খোলা আকাশ । কেন ওদের সঙ্গে বারবার এমন হয়? প্রকৃতির কি ওদের জন্য কোনো মায়া দয়া নেই ?
প্রকৃতি যেন অট্ট হাসি হেসে চিৎকার করে উঠল তোমরা কখনও কেউ কি আমার কথা একটুও ভেবেছ ? নিজেদের ইচ্ছামত গাছ কেটেছ, পরিবেশ দূষণ করেছ, পলিথিন ব্যবহার করে আমার শ্বাস বন্ধ করতে চেয়েছ , প্রয়োজন ছাড়া অনেক জল নষ্ট করেছ। তোমরা কি ভেবেছ এতো কিছুর পরেও আমি শান্ত থাকব ? না ! আমি পৃথিবী, আমি কারো দাস নই! আমি আমার নিয়মে চলব, যদি সেই নিয়ম মেনে তোমরা থাকতে না পার, তবে চলে যাও আমি কাউকে আটকাবো না।
ছেলেবেলার একটা দরজার কথা মনে পড়ে। একটা কাঠের দরজা। আমাদের বাড়ির প্রধান প্রবেশ দ্বার। গায়ে ছিল তার টিয়া পাখি সবুজ রং, রোদে জলে ধুয়ে ক্রমে হালকা নীল বরণ হয়ে গিয়েছিল এক সময়। মাঝে মাঝে রং খসে পড়ত পুরাতন ফোস্কার ছালের মতো। দরজার গাটাও আর আগের মতো মসৃণ ছিল না। বয়স হলে চামড়ায় ভাঁজ পড়লে যেমন শিরাগুলো শুধু ফুলে ফুলে জেগে থাকে তেমন কাঠেরও উপরের স্তর উঁচু নীচু হয়ে থাকত, বেরঙ হয়ে সেসব জায়গায় কালচে খয়েরী ভাঙনের ছাপ। দরজার দৈর্ঘ্য বরাবর ছিল সরু সরু লোহার শিক। তাদেরও গায়ে জং পড়েছে ততদিনে। কতো পুরানো দরজা। দেশ ভাগের সময় দাদু বাড়িটি যখন কিনেছিলেন, মুসলিমরা তখন এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। তাদেরই কারোর কাছ থেকে কেনা। লাল ইঁটের পাঁচিল, সুরকির গাঁথুনি।
দরজার মাথায় ওপর দিয়ে একটা আচ্ছাদন তৈরি করেছে এই দেওয়াল। তাকে ভালোবাসায় আঁকরে জরিয়ে রয়েছে কাগজ ফুলের শাখা প্রশাখা। দাদুর কাছেই শুনেছি কাগজ ফুলের ভালো নাম বাগানবিলাস। বিলাসিনী সেই গাছ যেন পাঁচিল আর দরজার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সোহাগ করছে এক অলস নিঝুম দুপুরে। আলুথালু তার শাড়ির আঁচল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। আর সেই আঁচলেই যেন লাল লাল ফুল ছাপের মতো কাগজ ফুল ফুটে আছে। এই আমার মফস্বলের বাড়ির প্রবেশ দ্বার। অনেক দিন পর এসে দাঁড়িয়েছি তার সামনে। তপোজার আঁকা ছবির হাত ধরে। কতদিন হয়ে গেল তার খেয়াল রাখা হয়নি।
শীতের সূর্য হেলে পড়েছে অবেলায়। তেরছা কিরণের রেখা এসে পড়েছে এই দরজায়, দেওয়ালে। দরজার শরীরে আর জোর নেই তেমন। তবু সে আগলে রেখেছে দরজার ওপারের উঠোনে ফেলে যাওয়া আমার অনাড়ম্বর সরল শৈশবকে।
No comments:
Post a Comment