বিবেক
সুদীপ কুমার বোস
চারপাশে প্রচুর লোকজন ভীড় করে আছে। বেশির ভাগ পুরুষ মানুষের
উর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত। মেয়েদের শরীরে ছেঁড়াফাটা শাড়ি জড়ানো। বাচ্চা গুলোর
শরীরেও কাপড় চোপড় নেই বললেই চলে। উঁচু একটা বেদির মত জায়গায় একটা বুড়ো মত
লোক বসে আছে। পাশে গলায় মাদল ঝুলিয়ে কুচকুচে কালো একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।
চারিদিকে বড় বড় গাছ। কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার পরিবেশ। হাইকোর্টের জজ, অজয়
পাল হাত পা বাঁধা অবস্থায় উবু হয়ে বসে আছে। ওর চারপাশে যে কালো মানুষ
গুলোকে ও ঘেন্না করত তারাই ওকে ঘিরে বসে আছে। এর মধ্যেই গলায় মাদল ঝোলানো
লোকটা মাদল বাজিয়ে ঘোষনা করল, হুতুম খুড়োর বিচার সভায় এই হাত পা বাঁধা
শহুরে লোকটার বিচার হবে। এই লোকটা বিনা দোষে আমাদের গ্রামের রতুয়াকে ধর্ষণ ও
খুনের জন্য পয়সা খেয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। বিচার সভা শুরু হচ্ছে।
হুতুম খুড়ো বিচার সভা শুরু করে প্রথমে রতুয়ার মা শনিয়াকে ডেকে বলল, তুমি তোমার বক্তব্য রাখ।
শনিয়া
: হুজুর এই লোকটা আমার একমাত্র ছেলেটাকে বিনা দোষে ফাঁসি দিয়েছে। আমার
শান্ত নিরীহ ছেলেটা দুটো পয়সা উপার্জনের জন্য শহরে যায়। ওখানে একটা বড়
বাড়ির (আবাসন) চৌকিদারের কাজ পায়। ভালই চলছিল। কাজ পাওয়ার একবছর পর
গ্রামেরই একটা মেয়ে ফুলমতির সাথে ছেলেটার বিয়ে দেই। ওদের একটা ছেলে হয়।
আমার ছেলেটার খুব ইচ্ছা ছিল, ওর
ছেলেটাকে পড়ালিখা
শিখাবে, শহরে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার নাতিটার যখন দুই বছর বয়স, তখন খবর পাই
আমার ছেলেটাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। খবর পেয়ে আমি বৌ আর নাতিটাকে নিয়ে
ছেলেটার সাথে দেখা করতে যাই। আমরা অনেক কষ্টে অনেক পয়সা খরচ করে ছেলের দেখা
পাই। আমার ছেলেটাকে আমি চিনতে পারছিলাম না। খুব মেরেছিল। মুখটা ফোলা,
চোখের কোনে রক্ত জমে আছে। ভালো করে দাঁড়াতেও পারছিল না। আমাদের দেখে ছেলেটা
হাঁউমাঁউ করে করে কেঁদে উঠল। বলল, আমি কোন মেয়েকে ধর্ষণ করি নাই, কোন খুন
করি নাই। আমাকে মেরে মেরে একটা কাগজে আমি দোষ কবুল করিয়ে সই করিয়ে নিয়েছে।
মা, ফুলমতি আমাকে ভুল বুঝিস না। ওই আবাসনের মালিক এই খারাপ কাজ করে আমাকে
ফাঁসিয়ছে। পুলিশ অনেক টাকা খেয়েছে। কিছুক্ষণ পর সময় শেষ বলে পুলিশ আমাদের
গেট থেকে হটিয়ে দেয়। তারপরের ঘটনা তো আপনি জানেন। এই লোকটা পয়সা খেয়ে আমার
নির্দোষ ছেলেটাকে ফাঁসির হুকুম শোনায়। আমি চাই এই লোকটাকেও ফাঁসিতে ঝোলানো
হোক।
এবার হুতুম খুড়ো ফুলমতিকে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমার কি বলার আছে বল।
ফুলমতি
: হুজুর এই লোকটা পয়সার জন্য আমাকে বিধবা করেছে, আমার দুই বছর বয়সি ছেলেকে
অনাথ করেছে। আমরা গরীব বলে ভালো উকিল রাখতে পারিনি তাই এক তরফা ভাবে
শাস্তি দিয়েছে। আমার ছেলেটাকে পেট ভরে খেতেও দিতে পারিনি। জঙ্গলি কচু, শাক,
জঙ্গলি আলু সেদ্ধ করে খাইয়ে ছেলেটাকে বড় করেছি। আমি চাই আমাদের জীবন নষ্ট
করার জন্য লোকটার ফাঁসি হোক।
এবার হুতুম খুড়ো রতুয়ার ছেলে ঘনুয়াকে বলে তোমার কি বলার আছে বল।
ঘনুয়া
: এই লোকটার জন্য আমার বাবাকে মিথ্যে বদনাম নিয়ে এই পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে।
আমার মাকে বিধবা হতে হয়েছে, ঠাকুমাকে সন্তান হারা হতে হয়েছে। আমি আমার
বাবার মুখটাও মনে করতে পারিনা। কত কষ্টে বড় হয়েছি আমিই জানি। এই সমস্ত
কিছুর জন্য দায়ী এই লোকটা। আমি চাই লোকটার ফাঁসি হোক, আর ফাঁসি দেওয়ার
দায়িত্বটা আমাকে দেওয়া হোক।
হুতুম খুড়ো এবার লাঠিতে ভর করে উঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য
করে বলল, রতুয়ার মা, স্ত্রী আর ছেলের বক্তব্য শুনে যা বোঝা গেল রতুয়াকে
মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে, পয়সা খেয়ে এই লোকটা রতুয়াকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। এখন
আমার মতে এই লোকটারও ফাঁসি হওয়া উচিৎ। তাই আমি চাই বড় তেঁতুল গাছে ফাঁসি
দেওয়া হবে আর ফাঁসি দেবে রতুয়ার ছেলে ঘনুয়া। তোমরা সবাই আমার সাথে একমত।
সমবেত জনতা উল্লাসে হাততালি দিল আর চেঁচিয়ে উঠল, ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই।
ঘনুয়া হাই কোর্টের জজ,অজয় পালকে টেনে তেঁতুল গাছের ডালে ঝোলানো ফাঁসির
দড়ির দিকে নিয়ে চলল। সাথে সাথে জনতাও চলল। ঘনুয়া অজয় পালকে ফাঁসির দড়িতে
ঝুলিয়ে দিল। অজয় পালের মুখ দিয়ে খুব জোরে গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে।
উপরের তলার অজয় পালের শোবার ঘর থেকে গোঙানির আওয়াজ পেয়ে বাড়ির লোকজন
সব ছুটে এসেছে। ঘরে ঢুকে দেখে, অজয় পাল খাটের উপর ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বসে
আছে, আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, আমাকে তোমরা ক্ষমা কর, হ্যাঁ আমি আবাসনের
মালিকের কাছে এক কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে রতুয়াকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দিয়েছি।
আমি সব টাকা তোমাদের দিয়ে দেব। আমাকে তোমরা ফাঁসি দিওনা। আমি যে বাঁচতে
চাই, আমাকে বাঁচাও।
No comments:
Post a Comment