Monday, October 5, 2020


 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

  করুণাকান্তের করোনা সমাচার

                         কিশোর পণ্ডিত

বৃষ্টির জল মানলো । বন্যার জল মানলো না ।কালিগঙ্গা ফুলে ফেঁপে ওঠল । পড়শীদের বন্ধু করে নিল । পড়শীদের মধ্যে নিকট পড়শী করুণা কান্তের বাড়ি।তার অসম্মতিতেও তার বাড়িঘর বানের জলের সাথে পরাজিত বন্ধু হল ।
এমন করোনাকালে করুণাকান্ত বড়ই অসহায় হলো। বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেল তার বাড়ি। অসহায়ত্ব আর না বাড়িয়ে চিন্তা দীর্ঘ না করে মধুপুরে তার শশুর বাড়ি যাবে এ চিন্তায় সকলে স্থির হল ।।

হরিরামপুরের করুণাকান্ত ঘোষ ।বয়স পঞ্চাশ। শ্যাম বর্ণ গায়ের রং লম্বাটে গড়ন । স্বাস্থ্যে বাবা গণেশকে হার মানিয়ে দেয় ।শক্তি-সামর্থে বড়ই জোয়ান ।ঘি এর ব্যবসা করে। স্ত্রী অলকা রানী ঘোষ ।বয়স চল্লিশ। সুন্দরীদের মধ্যে তিন নম্বর ।স্বাস্থ্য সবার যা পছন্দ তাই। পছন্দ এ কারণে যে তার বয়স পঁচিশের কোটায় বললেও কেউ গড়রাজি হবে না। অনেক কষ্টের ধন বিলম্বে  প্রাপ্তি একমাত্র মেয়ে লীলাবতী । বয়স আট । বিভিন্ন লীলায় পারদর্শী ।তারমধ্যে প্রধান লীলা না খেয়ে থাকা। পৃথিবীর সর্বকালের কাজের মধ্যে অপছন্দের কাজ তার খাওয়া ।আর তার জন্যেই তার স্বাস্থ্যের এমন অবস্থা যে জোর বাতাসে সে বের হতে সাহস পায় না ।

করুণাকান্তের পরিবার যখন শ্বশুর বাড়ি পৌঁছালো তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা বলা যায় ।রাতের প্রথম প্রহর ছোবল মেরেছে ।পূর্ণিমা গতকাল পেরিয়ে গেছে বিধায় এ সময়টা অন্ধকার বটে ।তাদের সকলকে দেখে শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেউ মধ্যম কেউ আবার উত্তম আনন্দ দেখালো ।কুকুরগুলো অপরিচিতদের দেখে বাকা লেজ যেন প্রায় সোজা করে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো ।করুণাকান্তের শাশুড়ি শৈলবালা দেবী উত্তম আনন্দের সাথে তিনজনের এ পরিবারকে গ্রহণ করলেন।।

শৈলবালা দেবীর দুই ছেলে এক মেয়ে । বড় ছেলে সুকর্ণ ।অতি ছোট কথা সহজেই শুনতে পায় বিধায় তার নাম সুকর্ণ ।ছোট ছেলে বিকর্ণ ।কানে খাটো বলে তার নাম এমন রাখা হয়েছে ।একমাত্র মেয়ে অলকা। বড় ছেলের বউ পূর্ণিমা ।শুভ কাজগুলো অমাবস্যায় করে খুশি অর্থাৎ কুকর্মের ঢেঁকি। তার একমাত্র ছেলে অসীম ঘোষ কলেজে পড়ে ।ছোট ছেলের বউ শশীকলা দেবী ।তাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন শৈলবালা দেবী। অসম বর্ণের শশী বড় দিদির অভক্ত হলেও শৈলবালায় ভক্তি অঢেল । তার একমাত্র মেয়ে সুফলা প্রাইমারি স্কুলে যাবার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে ।।

করুণাকান্ত এক সপ্তাহ কাল আনন্দেই শ্বশুরবাড়ি কাটাল। এ আনন্দকে মহা আনন্দ দান করছিল তার এক প্রতিবেশী শ্যালক শাস্ত্রী স্মরণ পন্ডিত ।শ্বশুরবাড়ির অতিক্রান্ত প্রতিমুহূর্তকে সে সঙ্গ দিচ্ছিল ।বিভিন্ন শাস্ত্র আলাপ আর গল্পগুজবের মধ্যেই‌ চলত দীর্ঘ সময়। একদিন এক রম্য গল্প বলে সে সবাইকে হাসাল। গুরু মহাদেবানন্দ মহারাজ পরম্পরায় তার শিষ্য দেব নারায়ন শ্রেষ্ঠ ছিল শাস্ত্রীর গুরু ভাই। শ্রেষ্ঠ মহাশয় বেশ বয়সী ।একদিন তিনি মোবাইল কলে বললেন শুনেছ শাস্ত্রী, আজকের দিনটা আমি বহু পেরেশানির মধ্যে কাটালাম। আমার পাশের বাড়ির এক যুবক আমাকে দাদু বলে ডাকে ।সে সকাল বেলায় এসে এ করোনা মহামারীকালে আমার সাথে কোলাকুলি করল।আমার গাড়িখানা চাইল ।আমি দ্বিধায় গাড়িখানা দিলাম। মনটা খুব খারাপ। আরে বাপু গাড়ি নিবি নি কোলাকোলির কি প্রয়োজন ।এসময় কেউ কারো সাথে কোলাকুলি করে নাকি ।দুপুর পরে তাদের দু'তলায় জনকোলাহল শুনে বাইরে বেরিয়ে এলাম ।তাদের চেঁচামেচিতে স্পষ্ট শুনলাম রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে ।শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। মনটা আর ভিতরে রইল না একেবারে যেন বাইরে এসে আমার বন্ধ ঘরে কষ্ট ইচ্ছে হল ।কি আর করা এ বয়সে করোনায় মরতে হবে।হতচ্ছাড়াটা আর সময় পেল না ।এ সময়ে আমার বাড়িতে এলো আর বাড়িতেই শুধু এলো না একেবারে কোলাকুলি ।গরম জলে স্নান করে কুসুম গরম জলে গারগিল করলাম ।ঘরে জীবাণুনাশক স্প্রে করছিলাম ।এমন সময় ছেলেটি আবার আমার ঘরে আসছিল ।আমি ভারাক্রান্ত মনে একটু রেগেই তাকে বললাম দূরে যাও বাপু ঘরের ভিতরে ঢুকবে না ।ছেলেটি অসম্ভব করুন সুরে বলল কেন কি হয়েছে দাদু? আপনি এত বিচলিত কেন ?বিচলিত হবোনা? তোমাদের ঘরের রিপোর্ট পজিটিভ আর তুমি এসে আমার সাথে কোলাকোলি করছো। এবার ছেলেটি হেসে বলল, আরে দাদু আমার স্ত্রী কনসেপ্ট করেছে পিটি পজিটিভ । তার কথায় হাফ ছেড়ে বাঁচলাম । বললাম তাই বল বাপু, আমি ভেবেছিলাম করোনা পজিটিভ। তবে এত কোলাহল কেন? এ করোনা মহামারীতে বাবা হতে চাইনি তো তাই ।তাহলে বোঝো শাস্ত্রী, আজকে আমার দিনটা কেমন গেল ?বলেই মোবাইলে কল কেটে দিলেন।করুণাকান্ত তার শ্যালকের এমন রম্য গল্প শুনে নিজে তো হাসলই আর সাথে বাড়ির অন্য উপস্থিত সবাই।

এ ভরা শ্রাবণে শ্বশুরবাড়িতে করুণাকান্তের এক পক্ষকাল কেটে গেল। দিন বাড়ল আদর কমলো । শশুর বাড়ি মধুর হাড়িতে নিমফল মিশে গেল। এতদিনের উপস্থিতিতে কুকুর পরিচিত হলো মানুষ অপরিচিত হল। পূর্ণিমায় ঘনঘন অমাবস্যা দেখা দিল ।শশীও যেন সূর্য প্রাপ্তি হল ।তার কোমল জোসনার তাপ রৌদ্রতপ্ত হল ।শৈলবালায় অনুরক্ত শশীকলা তাকেও বিরক্তি দেখালো ।খাবার ঘরে দোষ দেখা দিল ।অন্ন বাড়লো ব্যঞ্জন কমলো। মাংসের জায়গায় মাছ মাছের জায়গায় ডাল ধীরে ধীরে সিদ্ধ মাখা। শোবার ঘরেও পরিবর্তন দেখা গেল। বিছানার পরিবর্তন হলো।তোষকের পুরুত্ত কমেছে। অপরিচ্ছন্নতা বেড়েছে। কক্ষের ঝাড়ুও কমেছে। স্নানঘরে সময়ে সময়ে জল কম পড়লো। সুগন্ধি সাবান এর অভাব ঘটলো ।

শাশুড়ি শৈলবালা অনেক জোর খাটিয়েও পরিস্থিতি শান্ত রাখতে ব্যর্থ হয়ে শেষে বউদের কাছে পরাজিত হল। অলকার মুখেও বিরক্তির ছাপ দেখা দিল। লীলাবতী এসে বলল, বাবা আমাদের বাড়ি যাবার সময় হয়েছে কি ?করুণাকান্ত রাশভারী কন্ঠে বলল ,এখনই তাদের বাড়ি ফেরার উপযুক্ত সময় ।শুনে অলকা যান্ত্রিকভাবে ব্যাগ গোছালো। হরিরামপুর থেকে মোবাইলে খবর আসল বাড়ি এখনও উত্তম বসবাসযোগ্য হয়নি তবে অতি প্রয়োজনে খারাপ নয় ।করুণাকান্ত মনে মনে ভাবল এখন গলা জলেও উত্তম বাস।

বিদায় বেলায় মা মেয়ের কান্নার শোরগোল বইল। ওদিকে পূর্ণিমার ছেলে অসীম বলল মা আমি আজ থেকে পিসে মশায়ের ঘরে থাকবো। তার ঘর প্রস্তুত করতে পূর্ণিমা ব্যস্ত হল । বিছানার চাদর ধোয়ার ঠাস ঠাস আওয়াজ আর বালিশ রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে চপাটে আঘাত করতে লাগলো। শশীকলা তার দিদিকে বলল, স্নানঘরে এতো গন্ধ কেন গো দিদি ?সে তার দিদির পরামর্শে খলখল শব্দে স্নানঘরে জলের বন্যা বইয়ে দিল। মা-মেয়েকে আবার আসতে বলে বিদায় জানালো। বাড়িতে আসার পর থেকে করুণাকান্তের শরীর ভালো যাচ্ছিল না ।সে বুঝতে পারছিল তার জ্বর আসছে । কথা সত্য হলো । তার জ্বর আসলো এবং তা শরীরে স্থায়ী হলো ।কয়েকদিন পর কাশির সাথে শ্বাসের ব্যাঘাত ঘটল। করুণাকান্তের বড় ভাই ব্যঙ্গ করে‌ বলল , এটা নিশ্চয়ই শ্বশুরবাড়ির ভাইরাস। সন্দেহের তীর সবার করোনায় স্থির হল। রিপোর্ট আসল। এবার রিপোর্ট করোনা পজিটিভ ।শ্বাসকষ্ট বাড়ল বাড়ির লোক দেরি না করে করুণাকান্তকে ঢাকার একটি ভালো হাসপাতালে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিল। যেদিন করুণাকান্তকে হাসপাতালে নিতে অ্যাম্বুলেন্স আসলো সেদিন বাড়িতে মানুষ না মরলেও মরাকান্না হলো ঠিকই ।অলকা আর লীলাবতী দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল ।বহুকাল নিকটে বাস করলেও আজ তাদের নিকটে যেতে দেওয়া হলো না।স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের রোগী অ্যাম্বুলেন্সে উঠালো। লীলাবতী কিছু না বুঝে বাবার নিকট যেতে চাইলে যেতে পারল না বিধায় তার কান্নার রোল আরো করুণ হলো ।চিৎকার করে বাবাকে আটকে রেখে দেয়ার নিরর্থক চেষ্টা করল। উপস্থিত অনেকেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও লীলাবতীর কান্নায় সামিল হল। করুণাকান্ত ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হল। কয়েকদিনের মধ্যেই একই বাড়ির নিকট সকলের করোনা টেস্ট করা হলো। ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় বাড়ির অন্য কারো নেগেটিভ ছাড়া পজিটিভ হলো না।

অলকার জীবন যেন দুঃখের অনলে পোড়ে তিলে তিলে ক্ষয় হতে লাগলো ।মনে মনে ভাবল তার স্বামীর প্রাণ ফিরে পাওয়ার এতোটুকু আশা নেই কি ? কি করে তাকে পাওয়া যাবে ।কি করলে তার রোগ মুক্তি হবে। কি করে তাকে সুস্থভাবে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা যায় এমন ভাবনা চিন্তায় সে গভীর সমুদ্রে ডুবে গেল।মনের মানুষ মনে না থাকলে ,প্রাণের মানুষ প্রাণে না থাকলে ,কাছের মানুষ কাছে না থাকলে, অন্তরের কি যে জ্বালা তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে ।তাই তার একমাত্র অবলম্বনকারীকে ভবিষ্যৎ অবলম্বনের দোহার হতে গ্রামের মুরুব্বিদের উপদেশ মতে শিবের পূজা ,গরিবদের দান, দরিদ্র সেবা ,অনাথ আশ্রমে দান সহ বিভিন্ন প্রকার মানসিকে সে প্রতিশ্রুত হলো।

একদিন অলকা দেবী খবর পেল যে পাশের গ্রামে একজন করোনা রোগী সুস্থ হয়ে ঢাকা থেকে ফিরে এসেছে ।তার খবর নিতে সে পাশের গ্রামে গেল। রোগী রবীন্দ্রনাথ তাকে আশ্বস্ত করে বলল এ আর এমন কঠিন কি রোগ ।এখন আর এ রোগের তেমন ভয়াবহতা নেই।তাছাড়া দুর্বল চিত্ত আর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীরাই কেবল মারা যায়। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী গীতাঞ্জলি বলল দিদি তোমার স্বামী আমার স্বামীর চেয়ে ঢের শক্তি সামর্থ্যবান ।তোমার কোনো চিন্তা নেই ।আর চিন্তা না করে তার ফিরে আসার আশায় নির্ভার হও। আমার তো মনে হয় সে ফিরে আসলো বলে। তার এমন আশ্বস্ততায় অলকা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল।

অলকা আত্মবিশ্বাসে আত্মস্ত‌ হয়ে স্বামীতে মন স্থির করে নিশ্চিত ফিরে আসার নির্ভার মনে বিভিন্ন প্রস্তুতি গ্রহণ করল । কলা গাছে কলা বাদুড়ে ছোয়েছে তাই কলাগুলি পেকেছে । কলার ছড়ি গাছ থেকে নামিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে রাখল ।চাল কুমড়া গুলির বয়স হয়েছে ।নোনা ইলিশ দ্বারা সে খেতে ভালোবাসে তাই কুমড়াগুলি চোখে চোখে রাখে যাতে কাঠবিড়ালি বা অন্য কিছুতে নষ্ট না হয়। ।বানের জলের ভয়ে সুগন্ধি চাল উঁচুতে রেখেছিল ।নামিয়ে গন্ধ শুঁকে নষ্ট হয়েছে কিনা ।চাল রোদে শুকিয়ে রাখে ।বানের জলে তুলসী গাছটি নষ্ট হয়ে গেছে তার স্বামী এলে কোথায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাবে তাই অন্য বাড়ি থেকে তুলসী গাছ এনে রোপন করল ।তিনি এলোমেলো পছন্দ করেন না তাই ঘর দুয়ার প্রতি দিন গুছিয়ে রাখল ।সবশেষে নিজের দিকে খেয়াল করল ।মধ্যপথের যৌবনকে পথরোধ করল যেন তা আর সামনের পথে অগ্রসর না হয় ।চেষ্টা করল পূর্ব যৌবনে ফিরে যেতে ।আসল বয়স কমাতে না পারলেও মনের বয়স কমিয়ে দিল ।সুগন্ধি সাবানে বারবার গা ধুইলো।যুবতীদের পরামর্শে ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুচ্ছে। মুখে স্নো পাউডার এর আস্তরণ বাড়াল।নখে নেইল পলিশ এর নতুন প্রলেপ দিতে থাকলো ।পায়ে আলতা সিঁথিতে নতুন আঙ্গিকে সিঁদুর ফোটা দিতে থাকলো। চুলে সুগন্ধি তেলের প্রলেপ দিয়ে বেণী গেঁথে যোগল বেণী দুলাতে থাকলো।এই বুঝি আজকেই তার প্রিয় সখা অলকা অলকা বলে ডাকবে। একদিন বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতে বড় আমগাছটায় প্যাঁচা ডাকল। বাড়ির অন্যান্যরা গভীর ঘুমে। লীলাবতী তার আয়েসি ঘুমে নাক ফরফর করে শব্দ করছে। এরমধ্যে তাদের মোবাইলে রিং বাজলো ।অলকা দেবীর বহুদিনের প্রতীক্ষিত চঞ্চল মন ধপাস করে স্থির হয়ে গেল।অন্তরে কেমন যেন ভয় ঢুকলো ।ভয়ে ভয়ে সে মোবাইলটা ধরল ।ওদিক থেকে বলা হল ঘন্টাখানেক আগে আপনাদের রোগী মারা গেছেন।নিয়ম মতে লাশ ফেরত পাঠানো হবে না। এখানকার স্বেচ্ছাসেবক দল তার দাফন কাজ সম্পন্ন করবে ।

অলকার ঘুমের নেশা কেটে গেল ‌।চোখের অশ্রু অঝর ধারায় ঝরতে লাগলো ।আকাশ ভেঙে যেন মর্ত্যে পড়লো আর মর্ত্যের কান্নার গর্জন আকাশে বাতাসে কম্পিত হতে লাগল ।এমন কান্নার চিৎকারে বাড়ির অন্যরাও জাগল এবং কান্নার এ আয়োজনে তারাও যোগ দিল। কান্নায় কান্নায় রাতের শেষ হলো। ভোরে বাকিদের কান্নার আওয়াজ বন্ধ হল। যে কাঁদবার সে কেদেঁই চললো। বিরহিনী অলকার বিভিন্ন পূর্ব স্মৃতি খণ্ডে খণ্ডে হৃদয়ে আবির্ভূত হতে লাগলো আর দম ফাটা কান্নার চিৎকারে ভূমন্ডল প্রকম্পিত হতে থাকলো। তার সকল আশার আলোকবর্তিকা নিরাশার অন্ধকারে যেন ডুবে গেল।সে বুঝল আগের ছোট ছোট অপূর্ণতা আর অপ্রাপ্তিগুলো তার স্বামীর অনুপস্থিতি ভবিষ্যতের প্রাপ্তিকে নিশ্চিত ব্যাঘাত ঘটাবে। সারাটা জীবন একলা কেমনে কাটাবে। তার মেয়ের ভবিষ্যত কি হবে ইত্যাদি ভেবে অলকা বিলাপ বন্ধ করলো। জাগতিক এ সংসার অপরিচিত মনে হল। অজাগতিক গন্তব্যেই চির পরিচিতির প্রকৃত লক্ষ্য মনে হল। সে কেবলি এ জীবন সংসার অনর্থক আর জগতকে মিথ্যা মনে করে নিজের মৃত্যু কামনা করে আরেকবার নিঃশব্দ অশ্রু ঝরাল।

শৈল বালা দেবী তার জামাতার মৃত্যু সংবাদ শুনে পরদিনই মেয়ের বাড়ি এসে উপস্থিত হলেন। মা মেয়ে আরেকবার কান্নায় মিলিত হল। শৈল বালা দেবী অলকাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন ,মৃত্যু আসলে নিছক শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা নয়। জীবন থেকে যখন সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা চলে যায় আর যখনই জীবনের কাছে নিজেকে পরাজিত হতে হয় তখনই হয় আসল মৃত্যু। আশা-আকাঙ্ক্ষা নির্বাপিত হলেও জীবনের কাছে এখনই পরাজিত হইও না ।সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দাও সময়ই বলে দিবে সংসারে কে জয়ী আর কে পরাজিত। কারণ সংসারের পরিবর্তন করাই সময়ের ধর্ম। গীতাঞ্জলি দেবী ঘরে প্রবেশ করে দেয়ালের দিকে কিছু ছবি নির্দেশ করে বলল ,ওই দেখো তোমার শ্বশুর শাশুড়ি আরো পূর্বপুরুষরা তারা চলে গেছে তাই বলে কি সংসার থেমে আছে? আবার বলল, যে কৃষক বৃষ্টির জন্য মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে কোন কোন সময় মেঘ জল না দিয়ে বজ্রপাত ঘটায় মৃত্যু হয় কৃষকের তাই বলে কি তার জমি পতিত থাকে ?
এতসব শাস্ত্রের কথা অলকার কাছে মধুর মনে হল কিন্তু মানুষের শরীরতো। মন মানে না । আশা জাগে প্রাণে, আর একটিবার যদি সে আসত, একবার যদি তার দেখা পেতাম বলে আফসোস করে।

ভাদ্র মাসের তেরো তারিখ । শ্রাদ্ধের ঠিক দু'দিন আগে সূর্য পাটে নেমেছে। গোধূলি লগ্নে লীলাবতী আর এক লীলায় মাতল। চিৎকার করে বলতে লাগল মা মা শুনেছ ,কালি গঙ্গার ঘাটে বাবা নেমেছে। মিথ্যের মায়াজাল ভেঙ্গে সত্যিই করুণাকান্ত বলল শুনেছ অলকা, যে মরল ওদের গ্রামীন নম্বরের ডিজিট আর আমাদেরটার ডিজিট প্রায় একই ।শেষের দুই ডিজিট ওদের এইট সেভেন আর আমাদের ডাবল এইট। হাসপাতাল থেকে এইট সেভেনে ফোন না করে ফোন করল আমাদের ডাবল এইটে।

অলকা দক্ষিণ দিকে কালীগঙ্গার প্রবাহের দিকে তাকালো দেখল নদীর জল কমেছে পাশে ধানের সবুজ চাড়ারা বেড়েছে। ভবিষ্যৎ অন্ন যোগানোর কথা তারা ভুলেনি ।মৃদু বাতাসে দোল খেয়ে খেয়ে দিগন্তে থামছে । এ শরতে আশ্বিন মাসে দোষ আছে তাই দুর্গাপূজা কার্তিকে । লীলাবতী চেঁচিয়ে বলল এবার পূজায় কিন্তু আমি দামি সেট কিনব। অনাগত পূজার আগত দিনের অপেক্ষায় রইল করুণাকান্তের পরিবার। এখনো পূজার অনেক দিন বাকি। (সমাপ্ত)


No comments:

Post a Comment