মুজনাই সাপ্তাহিক
নদী সংখ্যা
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
টেমসের মত নদী আছে এ শহরে
দুই তীরে নদীটির শোভা ঝরে পড়ে
ইছামতী নদীর তীরে জন্ম এবং শৈশব কেটেছে। রায়ব্রীজ এবং বোটের পুল ( কাঠের নৌকো জোড়া দেওয়া ব্রীজ) এর স্মৃতিমাখা শৈশব অামার। কেননা মামার বাড়ি ছিল বনগাঁয়। দাদু দিদা কে খুব একটা মনে না পড়লেও ইছামতীর স্মৃতি রয়েই গিয়েছে।
গোবরডাঙা হিন্দু মহাবিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুবাদে যমুনা নদীর তীরে জমিদার বাড়ি এবং গোটা এলাকা জুড়ে গোষ্ঠ বিহারি র মেলা সার সার নৈকা। বৈঠা হাতে মাঝি, হাঁঁটুর ওপরে ধুতি পরে জেলে জাল ফেলছে। নদীর পারে চা এবং মুড়ি বাদাম সহ গান, কবিতার আড্ডার কথা স্মৃতির গোটা ক্যানভাস জুড়ে আজও বিদ্যমান।
১৯৯৭ সালে কর্মসুত্রে জলপাইগুড়ি এসে পরিচয় সুন্দরী করলার সাথে। তার তীর বরাবর যেখানে যাই, যতদুর যাই, মুগ্ধতায় মন ভরে যায়। ঠাঁই মেলে করলার পাড়ে, কি সহজ, কি সরল এই মানুষজন। রুটি, রুজির টানে শত দুঃখে, বুকফাটা কষ্টে, একবার তার কাছে আসলেই লাঘব হয়ে যায় সব বেদনা। আমার একান্ত স্বজন তখন আমার দিদি। তার চোখেই এ শহর দেখা। নদী এবং নারী যে সমগোত্রীয় তার প্রথম পাঠ মেলে এই সুন্দরী করলার পাড়ে।
মহালয়ার ভোরে পিতৃতর্পণের সময় মনে হয়, প্রথম রবি কিরণের ছটায় এই সংস্কৃত শ্লোক এর মানে বোঝার মত ক্ষমতা একমাত্র সর্বসহা, সর্বজয়া, পতিতপাবনী, পূন্যদায়ীনি করলার পক্ষেই সম্ভব।
করলা ভ্যালির বুকের ওপর অধিষ্ঠাত্রী দেবী তখনই খুশি হন, যখন বকের ডানায় আঁধার নেমে আসে আর কলার খোলে ধুপ, দ্বীপ, ফল, মিষ্টি ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
ছট পুজোর ভোরে করলা ফিসফিসিয়ে কথা বলে কিং সাহেবের ঘাটে। সুন্দরী ষোড়শীর সে কি সাজের বাহার। এই কিং সাহেবের ঘাটেই সুন্দরী করলা, তিস্তাবুড়ী র কাছে মনের কথা কইত। তিস্তা সই কে বলত যে এই শহরের মানুষ, শ্মশানের আধপোড়া কাঠ, কয়লা, আধপোড়া লাশ, পচা গলা সারমেয়, গবাদি পশু,দিনবাজারের গ্লানি মাখা দীনতায় ভরা ভ্রুণ, সারা শহরের প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ, ফুল,বেলপাতা মা দুর্গা র কাঠামো দিয়ে তার দেহকে বিষাক্ত করেই ক্ষান্ত হয় নি। ২০১১ সালে তাকে বিষ পান করিয়েছে। সেবার ৪৩ রকম প্রজাতির মাছ তার বুকে ছটফটিয়ে মরেছে। এন্ডোসাফলান,মিথাইল প্যারাথিয়ন,ডাইল্ড্রিন, ডিডিটি কেন তাকে পান করানো হ'ল এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর, তিস্তা সই দিতে পারে নি।
তিস্তা সই দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে একটা কথাই বলেছে যত দিন মানুষ গোপন কথাটি জানতে পারবে না, যে, " এই শহরের মানুষ দিবারাত্র করলার জল পান করে ততদিন এই অত্যাচার চলতেই থাকবে।"
আজও তিস্তাবুড়ী র মেলায়, মেছেনী নাচের তালে করলা নেচে ওঠে রবীন্দ্র ভবনের দরজার কাছে এসে চুপটি করে গান শোনে, "ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা ', " ও নদী রে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে ", আবার কখনো নিজেই গুন গুন করে গেয়ে ওঠে, " আমি ও নদীর মত হারিয়ে যাব, আসব না ফিরে আর, আসব না ফিরে কোন দিন।
ছবি- সংগৃহিত
No comments:
Post a Comment