মুজনাই সাপ্তাহিক
নদী সংখ্যা
সই-নদী
মৌসুমী চৌধুরী
আমাদের একটি নিজস্ব নদী ছিল ছোটবেলায়। আমাদের সই-নদী। পুঁথিপত্রে তার কি নাম ছিল তখন জানি নি। আমরা তাকে "সাঞ্জাই" বলে ডাকতাম। দেহে তার জড়ান ছিল টলটলে কাঁচরঙা শাড়ি আর তার শাড়ির দুই পাড়ে সবুজের গভীর ইশারা!
শীতকালে সে নদী যেন বড় শান্ত ঘোমটা পরা পল্লীবধুটি। স্বচ্ছ জলের তলায় তখন দেখা যেত রূপোরঙা বালি আর সবুজ শ্যাওলা। দেখা যেত তাতে খেলে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট মাছেদের ঝাঁক। পাড়ার সুশীল জেঠু বঁড়শি আর মাছ ধরবার চাঁই দিয়ে মাছ ধরতেন। খুব মজা লাগত দেখতে। জেলেরাও ছোট ছোট ডিঙি করে জাল ফেলে মাছ ধরত। বোরোলি, সরপুঁটি সহ কত রকমারি মাছ! দেখে ভারী অবাক লাগত! শীতকালে সেই নদীর পাড়ে জমে উঠত আমাদের খিঁচুড়ি আর হাঁসের ডিম-কষা দিয়ে পিকনিক।
গরমকালে আমরা বন্ধুরা প্রায়শই দল বেঁধে নদীর বুকের মধ্য দিয়ে হেঁটে এপাড় থেকে ওপাড়ে যেতাম। ঠিক সেই সময় প্রতিবারই আমার মনে পড়ত কবিতাটি ___ "আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে..." দল বেঁধে সেই নদীতে হুটোপুটি করে স্নান করা, ডুব সাঁতার আর উল্টো সাঁতার কাটা প্রভৃতি ছিল আমাদের প্রিয় খেলা। ডুব সাঁতার দিয়ে বন্ধুদের পা টেনে ধরে ভয় দেখানোতে ভোলা ছিল ওস্তাদ!
বর্ষায় আমাদের সেই সাঞ্জাই নদী আমূল বদলে যেত। হয়ে উঠত আমাদের একেবারে অচেনা! নদী তখন একেবারে কানায় কানায় ভরে উঠত! তার কালো জলে তখন অশান্ত ঘূর্ণি! সেইসময় আমাদের ছোটদের নদীতে যাওয়া মানা থাকত। একবার ভরা শ্রাবণের এক বৃষ্টি ঝমঝমে দিনে নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মারা গিয়েছিল সুশীল জেঠুর মেয়ে শিখাদি। তারপর থেকে জেঠু আর নদীর ওই ঘাটটিতে কখনও মাছ ধরেন নি। বর্ষায় দুকূল ছাপিয়ে নদীর জল কখনও কখনও ঢুকে পড়ত আমাদের পলাশবাড়ী গ্রামটিতে। অনেক মানুষকে তখন আশ্রয় নিতে হত স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিসে বা লাগোয়া ফ্লাড-সেন্টারে অথবা প্রতিবেশিদের দোতলা বাড়িতে। তখন সই-নদীর সঙ্গে আড়ি-পর্ব চলত আমাদের!
বর্ষার গোমড়ামুখো আকাশ থেকে কালো মেঘেদের আপদ বিদেয় হলে জেগে উঠত ফিকে নীল উদাত্ত আকাশ। তাতে ইতিউতি ফুটে উঠত পেঁজাতুলো মেঘেদের জাড়িজুড়ি। সাদা সাদা মেঘেদের গায়ে কখনও সিংহের হা-মুখ, কখনও বা মা দুর্গার মুখের আদল! নদীর টলটলে বুকে তাদের ছায়া পড়ত। আর ঠিক তখনই কাশফুলের মুকুট মাথায় হেসে উঠত আমাদের সেই সই-নদী! নদীর বুক থেকে এঁটেল মাটি তুলে নিয়ে কুমোরকাকুর বাড়িতে দুগ্গা ঠাকুরের খড়ের কাঠামোতে মাটির প্রলেপ পড়ত। আনন্দে ডগমগ আমরা দিন গুনতাম মায়ের আগমনের।
গ্রামের লোকেরা প্রায়ই নিজেদের মাটির ঘরের দাওয়া নিকোনোর জন্য নদীর বুক থেকে মাটি খুঁড়ে খুৃঁড়ে তুলে নিতেন। ফলে আমাদের গ্রামের মহাকাল মন্দিরের কাছাকাছি নদীর একটি ঘাটে গভীর সুড়ঙ্গ মতো সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সুড়ঙ্গে ঢুকে মাটি কেটে আনতে গিয়ে মাটির চাঙড় চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল আমার বন্ধু রিনা। সেদিন আমাদের নদী-সইও যেন অপরাধী মুখে ধারণ করেছিল আমাদের হাহাকার আর চোখের জল!
এভাবে নদীকে ঘিরেই ছিল আমাদের আলিপুরদুয়ার জেলার সেই পলাশবাড়ী গ্রামটির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাময় যাপন। তারপর নদীর মতোই আমার জীবনও এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে নানা খাতে। নানা সময়ে আমার সখ্যতা হয়েছে নানা নদীর সঙ্গে। কিন্তু মনের কোণে প্রিয় হয়ে থেকে গেছে আমার ছোটবেলার সেই সই-নদী "সাঞ্জাই"।
No comments:
Post a Comment