মুজনাই সাপ্তাহিক
অনাদি অতীত
সুব্রত দত্ত
"কথা কও, কথা কও,
অনাদি অতীত, অনন্ত রাতে কেন বসে চেয়ে রও?
কথা কও, কথা কও।"
হ্যাঁ, অতীত কথা কয় বই কি? স্মৃতির মণিকোঠায় সে যে বারে বারে উঁকি দেয়! বিশেষ করে ছোটবেলাকার স্মৃতি রোমন্থনে ভিন্ন এক রোমাঞ্চ অনুভূত হয়। শহর গ্রাম নির্বিশেষে সে যতই তুচ্ছ জায়গা বা ঘটনা হোক না কেন, অতীতের ছবিগুলোর কোলাজ মনে ভেসে ওঠে।
শারদোৎসব আসছে। এবারের দুর্গোৎসব কেমন কাটবে, তা সহজেই অনুমেয়। তাই মনে হয় ছোটবেলার পুজোর কথা বেশি করে মনে পড়ছে। সত্যি যদি টাইম মেশিনের অস্তিত্ব থাকতো, তবে চলে যেতাম আমার সব চেয়ে আনন্দময়, নিশ্চিন্ত কিন্তু অনুশাসনে আবদ্ধ সেই জীবনের অংশে।
উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের ছোট্ট এক জনপদের নাম ক্রান্তি। একটু এগোলেই নৈসর্গিক দৃশ্য! চা বাগিচা তিনদিক ঘিরে রেখেছে। আর একদিকে পাহাড়ি 'চেল নদী'। সেই ক্রান্তির 'দেবীঝোড়া হাই স্কুলে'র শিক্ষক ছিলেন আমার বাবা। সেই সূত্রেই আমার স্কুলজীবন ওখানেই কেটেছে। তখন সেটা অজ পাড়াগাঁ। বিদ্যুৎ নেই। মঙ্গলবার বড়ো হাট বসে। হাটবাসে বাইরে থেকে দোকানিরা পসরা এনে সাজাতো। আর শুক্রবারে ছোট্ট হাট বসতো। তা ছাড়া যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ছিল একটা বাস। সকাল ছ'টায় ছাড়ত শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে। আবার সেটাই বিকেল পাঁচটায় শিলিগুড়ি থেকে রওনা দিত।
পূজোর অনেক আগে থেকেই মনে খুশির জোয়ার বয়ে যেত। দু'টো মাত্র পূজো হত। একটা বারোয়ারি কালিবাড়িতে সার্বজনীন পূজো, অন্যটি ওখানকার জমিদার সাহা বাড়ির গোলাবাড়িতে পারিবারিক পুজো। কালিবাড়ির বারান্দাতেই প্রতিমা তৈরি হত।মনে আছে, প্রতিমা তৈরি করতেন গান্ধী পাল। কাঠামো তৈরি শুরু হলেই রোজ ছুটে যেতাম দেখতে। তারপর একে একে কাঠামোর ওপর খড় সুতলী দিয়ে বেঁধে প্রতিমার আদল, মাটি লেপন, সাঁচে প্রতিমার মুখ তৈরি, মাটির প্রলেপে বিভিন্ন ভাঁজ, রঙ করা আর সবশেষে তুলির টান আর চুল লাগানো। সব, সব যেন গোগ্রাসে গিলতাম। কালিবাড়ির পেছনে বিস্তীর্ন ফাঁকা জমি। সেখানে কাশবনের হওয়ায় দুলুনি! রেলগাড়িটাই ছিল না। নয়তো পথের পাঁচালীর সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য স্বচক্ষে দেখা হয়ে যেত।
আর নতুন জামা? সে তো আরো আনন্দের! রেডিমেড জামা কেনা হত না। কাপড় কিনে ওখানকার বিখ্যাত দর্জি সেলিম-এর কাছে বানাতে দিতাম। রোজ ক'বার যে দেখতে যেতাম, আমার জামা-প্যান্টের কাপড় কাটা হল কিনা। দেরি হলে সেলিম চাচাকে তাড়া দিতাম। তৈরি হয়ে গেলে, নিয়ে দৌড় লাগাতাম বাড়ির দিকে। আর বারবার গন্ধ শুঁকতাম। তাতেই যেন পূজোর গন্ধ মিশে থাকত। পূজোর ক'টা দিন সে কি আনন্দ! বাড়ির একদম কাছেই সেই কালীবাড়ি। ঢাকে কাঠি পড়লেই ছুটতাম। বন্ধুদের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় ছোটাছুটি। প্যান্ডেলের জাঁক কিছু ছিল না ঠিকই, কিন্তু নিষ্ঠাভরা পূজো হত। মাইকে পূজো সংখ্যার গান বাজত। শুনতে শুনতে গানের কথা ও সুর মুখস্থ হয়ে যেত। পূজো শেষে মাটিতে পাতা চটের ওপর বসে কলা পাতায় খিঁচুড়ি ঘ্যাট দিয়ে মহানন্দে ভুরিভোজ হত। সন্ধ্যায় আরতি প্রতিযোগিতা হত। আমি ওসব পারতাম না। আমার দাদা দিদিরা পুরস্কার পেত। সাহাদের গোলাবাড়িতেও যেতাম। ওরা নেমন্তন্ন করত। ওদের বিশাল বড়ো একান্নবর্তী পরিবার ছিল। দশমীর দিন সেখানে মেলা বসত। বিভিন্ন খেলনা, বেলুন,চুড়ি ফিতে খাবারের দোকান -- এসবেই ভরে যেত মাঠ। পাঁপড়, পেঁয়াজি এসবই ছিল আমাদের পূজোর বাইরের খাবার! বিকেলে চা বাগান থেকে পুরুষ মহিলা শ্রমিকদের নাচের দল আসত। ওদের ভাষার গান আর মাদলের তাল মনটাকে দুলিয়ে দিত। কিন্তু দিনটা যতই রাতের দিকে ঢলে পড়ত, ততই যেন মনটা বিদায়ের করুণ সুরে ভারাক্রান্ত হতে থাকত।
অবশেষে অমোঘ নিয়মে রাত আসে। গোলাবাড়ির পাশের পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন হত। পুকুরের চারদিকে মানুষের ঢল নামত বিসর্জন দেখতে। তারপর সব অন্ধকার! ক'দিনে আলোকিত হ্যাজাকের আলোও নেই, ঢাকের আওয়াজ নেই। শূন্যতায় ভরা চারদিক। শুধু জোনাকীর আলোই সঙ্গী হয়ে থাকে আরো এক বছরের অপেক্ষায়। বুক ভাঙা একটা ব্যথা আজও অনুভব করি পূজো এলে। কে বলে, অতীত ডুবে যাওয়া বিস্মৃতি? নাঃ, অতীত কথা বলে মনের সংগোপনে। পড়াশোনা আর চাকরিসূত্রে আমার ছোটবেলাকার সুমধুর স্মৃতিধন্য ক্রান্তিকে ছেড়ে আজ ব্যস্ত নগর শিলিগুড়িতে বাস করছি। তবু নদীর তটরেখার মত সেখানকার স্মৃতিরেখা মনের গহীনে ঝিলিক দিয়ে ভেসে উঠে নগরায়ণের গরিমাকে যেন বিদ্রুপ করে।
No comments:
Post a Comment