Saturday, August 21, 2021


 

বিশেষ রাখিবন্ধন  সংখ্যা 




 চিঠি 

রাখির চিঠি (পরদেশী ভাইকে)
নন্দিতা পাল

প্রিয় আবদুল
প্রযত্নে সুলতান খান
শিরপুর স্কয়ার,
নিউ কাবুল, আফগানিস্থান
পিন কোড-২০২১১

কেমন আছিস আবদুল। দেখতে দেখতে কত বছর হয়ে গেল তুই তোর বাবার সাথে আসতিস আমাদের বাড়িতে কত রকমের শুকনো ফলের বাহার নিয়ে। এখনও মনে আছে, বোধহয় প্রথম তোকে কাবুলিওয়ালা মানে তোর বাবা, সঙ্গে নিয়ে এসেছিল সেবার। আমার মা তখন ফল কেনাকাটায় ব্যস্ত, কাবুলিওয়ালা আধভাঙ্গা বাংলায় বিভিন্ন ফল নিয়ে বলে চলেছে। তুই চুপ করে তোর বাবার গা ঘেঁসে বসে ছিলি। আমার মা অনেক বার তোকে কত কথা জিজ্ঞাসা করলেও কোন উত্তর দিস নি তুই। হঠাৎ আমি সামনে আসতেই তুই একগাল হেসে ফিসফিস করে কাবুলিওয়ালাকে কিছু বলেছিলি। কাবুলিওয়ালা পরে বলেছিল, তোর দিদি, আয়েশা, যার সাথে সারাক্ষণ খেলতিস দেশে; ওকে ছেড়ে আসতে তুই খুব কান্নাকাটি করেছিলি। আর সেদিন তুই আমায় দেখে খুশি হয়ে বলে ছিলি ‘ছোটি দিদি’। , কাবুলিওয়ালা তোকে এ দেশে নিয়ে এসেছিল কলকাতা দেখাতে আর কাজ ও শেখাতে। তুই তোর ছোটি দিদিকে সবচেয়ে মিস করতিস। আমাদের বাড়ি এলে যেতেই চাইতিস না। এমন ও হয়েছে কাবুলিওয়ালার কেনাকাটা হয়ে গেলে বসে থাকতে হত, তোর গল্প আর খেলা শেষ ই হত না। পরে তোকে একটা স্কুলে ও ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল কাবুলিওয়ালা । সেই কয়েক বছর রাখি, ভাইফোটায় আমার ভাইয়ের সাথে তোকেও পরাতাম প্রতিবার।

একবার তোরা দেশে চলে গেলি আয়েশার শরীর ভালো নয় শুনে, যাবার আগে এসেছিলি দেখা করতে। খুব মন খারাপ ছিল তোর। সেদিন ছিল রাখি, তোকে রঙ বেরঙের রাখি পরিয়ে দিলাম আর মার হাতের পায়েস খেয়ে একটু তোর মনটা একটু ভাল হল। এরপর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে, আমি তখন পড়াশুনোর জন্য কলকাতার বাইরে। বাড়ি এসে শুনলাম, কাবুলিওয়ালা আসে মাঝে মাঝে ফল নিয়ে, কিন্তু শরীর খুব ভেঙ্গে গেছে। আয়েশা মারা যাওয়ায় তুই আর ফিরে আসিসনি কলকাতায় তোর মাকে ছেড়ে। কাবুলিওয়ালার কাছে একবার আমার জন্য উপহার পাঠিয়েছিলি। কাঠের একটা টুকরোর ওপর তুই বাংলায় খোদাই করে লিখেছিস ‘ছোটি দিদি’। খুব যত্নে রেখেছি ওটা আমার আলমারিতে, যখন ই দেখি চোখ অকারণে জলে ভরে আসে।  

আজ এত বছর পরে পুরনো এক ডায়েরিতে তোর ঠিকানা খুঁজে পেলাম। কোন একদিন ভাগ্যিস লিখে রেখেছিলাম। কাবুলিওয়ালা তো আর আসে না অনেক বছর, দেশে ফিরে গিয়েছে নিশ্চয়ই। তোর পছন্দের ময়ুর রাখি পাঠালাম আবদুল। কদিনেই পৌঁছে যাবে। ভালো থাকিস, এই দুর্দিনে খুব সাবধানে থাকিস এই প্রার্থনা করি।

ইতি
তোর ছোটি দিদি
৬এ এসপ্ল্যানেড। কলকাতা, ৭০০০১৩


রাখির চিঠি (প্রবাসী ভাইকে)
ঝুমক গোস্বামী 

স্নেহের পিকলু,

                 মেক্সিকোর ঘরের পুবদিকের জানলা দিয়ে নরম রোদখানা  এতক্ষনে নিশ্চয়ই তোকে ছুঁয়ে ফেলেছে, তুই হয়তো আধবোঝা চোখে হাতড়ে বেড়াচ্ছিস বিরাটির বাড়ির লম্বা বারান্দাটা l জানি পাশের বাড়ির ইলিশ মাছের সুঘ্রান বড়োই প্রবল, কিন্তু সে ভৌগোলিক দূরত্বের কাছে পরাধীন, নরম রোদের চাদর সরিয়ে তোর আঙুলগুলো স্পর্শ করতে চাইছে যে অক্ষরগুলো তা আসলে অমূল্য স্নেহ, যা বিনি সুতোতেও বটগাছের শিকড়ের মতো অগুনতি পথ পাড়ি দিতে পারে l
যে বন্ধন দুর্যোগের রাতে ছাতা হয়ে যায়, খাবারের গ্রাসে ভেসে ওঠে নিষ্পাপ হাসিমুখ - দুহাতে জড়িয়ে রাখে ভরসার আকাশ.....
দিদি আর ভাইয়ের এই রক্ষাকবচ অনির্বান হোক, আমার আঁচলের সব মমতা, স্নেহ তোকে আজীবন ছুঁয়ে থাক ভাই....
দেখ, সূর্যের আলো তোর আঙুলছুঁয়ে বলে যাচ্ছে "পৃথিবীর সব দুর্যোগের রাতে দিদি স্নেহ দিয়ে আগলে রাখবে "

দিদিমনি 



রাখির চিঠি (বোনকে)
পার্থ বন্দোপাধ্যায় 

প্রিয় সুতপা,

আশাকরি সব কুশল।  প্রতিবারই রাখীবন্ধন এর দিন, রাখি  পরা এবং মিষ্টি খাওয়ার পর এতটাই আড্ডায় মেতে উঠি  যে নব্বই এর দশকে, উত্তর ভারতের প্রত্যন্ত  গ্রামের এক বাড়িতে রাখিবন্ধন  অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা,  বলব বলব করেও বলা হয়ে ওঠে নি।

আজ রাজবাড়ী দিঘির কোনায়, বাদামওয়ালা ছেলেটা তার  উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদের বাড়িতে বোনের  সাথে, মোবাইল ফোনে কথোপকথন  শুনে, সব  মনে  পড়ে গেল। 

কথিত  আছে   যে,  শ্রাবণী পূর্ণিমায় যখন চাঁদের উজ্জ্বল  বর্ণছটা   যখন  কালোমেঘে   অর্ধেক আকাশ ঢেকে   থাকবে,  ভূপৃষ্ঠ   ঢাকা  থাকবে  ভিজে  সবুজ  ঘাসে,  তখন  ব্রাহ্মণ  পুরোহিত স্নান  সেরে অভিষ্ট দেবতাকে জল দান করে,  পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্য বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ করে, রেশমি  বস্ত্রে, গোটা ধান, চাল, শস্যদানা এবং লাল  বা  গেরুয়া  পবিত্র  মাটির পুঁটলি রাজার হাতে  বাঁধবার  সময় বলবেন,  "হে ঈশ্বর তুমি আমাদের মহান রাজাকে অসুরদের হাত থেকে রক্ষা করো।" 

এভাবেই  ব্রাহ্মণ,  ক্ষত্রিয়,  বৈশ্য,  শুদ্রেরা রাখিবন্ধন  উৎসব  পালন  করে  থাকেন।

হিন্দু  মাইথোলজিতে  আমরা  দ্রৌপদিকে দেখেছিলাম,তিনি  তাঁর  নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে শ্রীকৃষ্ণের  হাতে  বেঁধেছিলেন। 

দেশের  বাড়ির  বাইরে  থাকবার  সুবাদে , প্রতিবছরই  নতুন  নতুন বোনেরা, হাতে রাখি পরিয়ে  দেয়, আবার  কালের  স্রোতে  তারা হারিয়েও   যায়। কিন্তু   সেবার  রাখি পরেছিলাম, উত্তর ভারতের একটি পারিবারিক  রাখিবন্ধন অনুষ্ঠানে। উত্তর ভারতে  উপস্থিত  থাকবার  সুবাদে।  প্রকৃতপক্ষে রাখি  পরা  যে  কতটা  ভাগ্যের  এবং  আনন্দের বিষয়, তা   অন্তর দিয়ে  অনুভব করেছিলাম। 

আমরা  যেভাবে  কুলো বরণডালা দিয়ে নতুন জামাই   কে বরণ করি।  ঠিক সেভাবে শুদ্ধতা সহকারে উপবাস থেকে বোন ভাইকে বরণ করবে। সেই বরণকুলোর উপকরণ আর আড়ম্বরের আতিশয্যে আমার চোখ কপালে উঠবার জোগাড়। সম্ভ্রান্ত অবস্থাপন্ন বাড়িতে, অথবা অনেক বোন, একটি মাত্র ভাইয়ের  প্রাপ্তি যোগ সর্বাধিক।  তারা পাবে সোনার রাখি। রূপো বা চাঁদির রাখি বা হাজার হাজার টাকার রাখির তো ছড়াছড়ি। বরণ করবার পর, প্রথমে কপালে তিলক পরিয়ে, মিষ্টিমুখ, উপহার দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে  রাখি পরাবে। সেই মন্ত্রের অর্থ,  " হে ঈশ্বর,  তুমি আমার ভাই কে সর্ব্ব বিপদের থেকে রক্ষা করো, আমার ভাই কে দীর্ঘজীবন দান করো। "

রাখি পরাবার সময় কোথাও কোথাও ভাই সংংগীত  পরিবেশন করে থাকে।  তবে বেশির ভাগ ভাই-ই ,  "এক হাজারো মে মেরী ব্যাহেনা হ্যায়..." গানটি গেয়ে থাকে। সেই দিনটির স্মৃতি কোনো দিন ভুলতে পারব না।

ভালো থেকো।  সর্বাঙ্গীণ শুভকামনায়। 

 পার্থদা




রাখির চিঠি (বোনকে)
স্বপন কুমার দত্ত 

স্নেহের বোন সবিতা,

                         প্রথমেই তোমাকে জানাই আমার আন্তরিক আশির্বাদ ও ভালোবাসা। জামাইকেও আমার আশির্বাদ দিও। ভাগ্নে ভাগনিদের জানাই আমার ভালোবাসা।
                   আজ বারবার তোমার কথা মনে পড়ছে। খুব ছোট্টবেলা থেকেই এই দিনে আমাকে রাখী পড়িয়ে দিতে। সকাল বেলায় স্নান করে সেজেগুজে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিতে, আর বলতে " ও দাদা কখন উঠবে, তোমায় রাখী পড়িয়ে দিয়ে আমি খেতে পারবো।" 
            আমি ইচ্ছে করে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতাম। তুমি রেগে যেতে। এরপর রাখী পড়িয়েই বলতে "দাও এবার কী দিচ্ছ।" 
             আজ এসব অতীত। বিয়ে হয়ে কতদূর চলে গিয়েছ। এখন আর ছোট্ট বোনটি নেই। তুমি নিজে আজ মা হয়ে গিয়েছ। কিন্তু সেই দিনটির কথা ভুলি কী ভাবে। তোমারও নিশ্চয়ই আজকের কথা মনে পড়ছে।
             যাক বোন ভালো থেকো। আজ রাখী বন্ধনের দিনে প্রাণ ভরে আশির্বাদ করি।মনে মনে বিনি সুতোর রাখী পড়িয়ে দিও, তাহলেই আমার রাখী পড়া হয়ে যাবে।  
  আজ এখানেই শেষ করছি।

                                    
ইতি
                          
তোমার দাদা



প্রবন্ধ/নিবন্ধ 

মানুষের মিলনের সেতুবন্ধন করেছে রাখীবন্ধন উৎসব

গৌতম চক্রবর্তী

রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশের প্রায় সব উৎসবের উৎসই পুরাণ। পুরাণের আবার ক্রনোলজি খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। রাখীর শুভ সূচনার পৌরাণিক আখ্যান কিন্তু চার্জড করবে কলির দেবদাসদের। মন্ত্রপূত রাখীর পৌরাণিক বাঁধন ভাইয়ের জন্য নয়, তা বরাদ্দ ছিল পতিদেবতার মঙ্গল কামনায়। ভনিতা না করে আসল কথাটুকু বলা যাক। দেবাসুরের ভয়ানক যুদ্ধে দেবরাজ ইন্দ্রের প্রাণ যাবার উপক্রম হলে পতিঅন্ত প্রাণ ইন্দ্রাণী ধ্যানে বসে কোন এক শ্রাবণ পূর্ণিমায় স্বামীর জন্য তৈরি করলেন মন্ত্রপূত রক্ষাবন্ধন। সেই কবচ পরে অজেয় দেবরাজ ভীমবেগে বঙ্গভূমিতে ধাবিত হয়ে নিধন করলেন অসুরকুল, ফিরলেন স্বর্গপুরীতে। তবে রাখীর রিভাইসড এডিশন বা ভ্রাতৃকরণের শুরু হল মৃত্যুরাজা যম, এবং তস্য ভগ্নী যমুনার রক্ষাবন্ধনের মাধ্যমে। দেবকুলের হয়েও অপ্রিয় মন্ত্রক পাওয়া যমরাজ দিনরাত মরা নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে বিমর্ষ বোধ করেন। দুঃখ ভোলাতে যমুনা রাখী বাঁধলেন ভাইয়ের হাতে, ফোঁটা দিলেন যমের কপালে। রক্ষাবন্ধনের অমর মহিমায় অমর হলেন মৃত্যুরাজা।

 শিশুপালের সঙ্গে তখন মারকাটারি বিরোধ শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেবের। কথা দিয়েছিলেন শিশুপালের মাকে যে তার একশত অপরাধকে ক্ষমা করে দেবেন। উদ্ধত শিশুপাল অচিরেই সেই সীমারেখা লঙ্ঘন করল। কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে নারাজ মদমত্ত শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমানের সীমারেখা পেরোলে ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে কৃষ্ণ শিশুপালকে বিনাশ করলেন সূদর্শন চক্রের আঘাতে। ঘটনার ঘনঘটায় সূদর্শন চক্রাঘাতে কৃষ্ণের নিজের হাত কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এলে শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাত বেঁধে দেন কৃষ্ণা দ্রেীপদী। শ্রীহরি কথা দেন এই রক্ষাবন্ধনকে তিনি সারাজীবন মনে রাখবেন। কুরু রাজসভায় দুঃশাসনের দুঃসাহসে বেআব্রু ভ্রাতৃবধূর শরীরে কৃষ্ণ প্রদত্ত একটুকরো কাপড়ের বাঁধনই ফিরে এল অন্তহীন আব্রু হয়ে যা মান বাঁচাল ভাই বোনের চিরায়ত সম্পর্কে।

 রক্ষাবন্ধন তাই কবে রাখীবন্ধন হলো সেই সন তারিখ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে রাখীর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে রক্ষা পেল এতে তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাখীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও কম উৎসাহব্যঞ্জক নয়। খৃষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে বৃষ্টিভেজা ঝিলমের পাড়ে সুদুর ম্যাসিডন থেকে সসাগরার অধিশ্বর হতে ভারত সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে ঘাঁটি গেড়েছেন সম্রাট আলেকজান্ডার। ভয়াল, ভয়ংকর যুদ্ধশেষে অপরাজেয় আলেকজান্ডারের কাছে বিনাযুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করলেন তক্ষশিলা রাজ অম্ভি। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ নীতিতে গ্রিকরাজের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে আশপাশের  আরো কিছু ছোটখাটো পুরুবিদ্বেষী রাজাকে জুটিয়ে প্রতিবেশী শক্তিশালী রাজ্য পুরুকে পরাস্ত করতে চাইল। পুরুর আসল শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন আলেকজান্ডারের ভারতীয় পত্নী রোক্সানা। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এই উপজাতি মেয়েকে বিবাহ করেন আলেকজান্ডার এবং এই রাজকন্যাই হয় তাঁর জীবন মরণের সাথী।

 পুরুর বীরত্বে ত্রস্ত আসমুদ্র হিমাচল। চুপি চুপি হাজির  হলেন রোক্সানা পুরুর দরবারে। আলেকজান্ডারের অজান্তেই তাঁর প্রাণভিক্ষা করে গেলেন তাঁর সহধর্মিনী পুরুকে ভ্রাতৃত্বের  রাখীবন্ধনের মাধ্যমে। রোক্সানাকে কথা দিলেন পুরু কোন অবস্থাতেই আলেকজান্ডারের ক্ষতি হতে দেবেন না। বৃষ্টিভরা রাতে ঝিলমের তীরে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধকৌশলে পুরুর সেনারা যখন কোনঠাসা তখন পুরুর বীরত্বের সামনে অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্যেও বেকায়দায় ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন সম্রাট আলেকজান্ডার। উদ্যত তরবারি উঁচিয়ে গ্রিকরাজের বুকটা এফোঁড়-ওফোড় করে দেবার প্রাক্কালে চোখ পড়ল রাখী বাঁধা হাতের ওপর। রোক্সানার দেওয়া রাখী। ভাই পাতিয়ে গিয়েছিল রোক্সানা। কথা দিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর কোন ক্ষতি হতে দেবেন না। কথা রাখলেন তিনি। অন্যমনস্ক হয়ে পড়াতে ভীমবেগে আক্ৰমণ শানালো গ্রীকবাহিনী। বন্দী হলেন পুরুরাজ। আলেকজান্ডারের কাছে দাবি করলেন রাজার প্রতি রাজার মত আচরণ। শৃঙ্খলিত পুরু রাজের প্রতি সশ্রদ্ধ আলেকজান্ডার মুক্তি দিলেন পুরুরাজকে। অন্তঃপুরের পর্দার আড়ালে যে সৈনিক শেকল পরিয়ে এসেছিলেন আগের রাতেই তার খবর ছিলো না ম্যাসিডনাধিপতির কাছে।

 চরম সংকটে চিতোর, গুজরাটের বাহাদুর শাহের আক্রমণে মরণপন যুদ্ধে হার মেনেছেন রাজপুত যোদ্ধারা। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় দিল্লীর মোঘল সম্রাট হুমায়ুনকে ‘খত’ লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন রাণী কর্ণাবতী। চিঠির সঙ্গে রাখী পাঠিয়ে বোনকে রক্ষা করার আবেদন জানালেন রাণী। কর্ণাবতীর এই আবেদনে গলে গেল মোগল সম্রাটের হৃদয়। হিন্দু রাখীর সম্মান রক্ষার্থে মুঘল বাদশাহ মেবার অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করলেন গুজরাট নরেশের আক্রমণ থেকে বহিনকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু মেবার পৌঁছানোর পূর্বেই শত্রুপক্ষের শাণিত তরবারির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রাজপুত যোদ্ধারা বীরের মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যদিকে আত্মসম্মান রক্ষার্থে রাজপুত রীতি মেনে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে ‘জওহর ব্রত’ পালন করে প্রাণত্যাগ করেন রাণী কর্ণাবতী। গণচিতা জ্বলে ওঠে রাজপুতানায়। সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় বোনকে বাঁচাতে না পারার অনুশোচনায় দগ্ধ মোগল বাদশাহ হুমায়ুনের হৃদয়।

 রাখীকে ঘিরে রাখীবন্ধনের প্রেক্ষাপট আবর্তিত হয়েছিল অবিভক্ত বাংলাকে ঘিরে। ‘বাংলার মাটি বাংলার জলে’ পুষ্ট রাখী সেতুবন্ধন রচনা করেছিল এপার বাংলা ওপার বাংলার। ১৯০৫ সাল। বড়লাট লর্ড কার্জন অনুভব করলেন বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে হিন্দু মুসলিম বিভেদ সৃষ্টি করা। ত্রিকালদর্শী রবি কবি বললেন, ‘ইংরেজই মুসলমানকে আমাদের বিরুদ্ধে করিয়াছে...... শনি তো আর ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না, অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্পর্কে সাবধানতা অধিক প্রয়োজন’। সেই ফাটল জুড়তেই প্রয়োজন হয়েছিল রাখীবন্ধন উৎসবের। একজোট হিন্দু মুসলিম বাংলার মাটি বাংলার জলের সুর কণ্ঠে নিয়ে রাখীর বাঁধনে একত্রিত হয়ে উত্তাল বাংলায় মিলনোৎসবে সামিল হয়েছিলেন।

 বঙ্গভঙ্গে ঘর ভেঙেছিল শত্রুপক্ষ। আর আজ আমাদের এই প্রিয় বঙ্গদেশকে ভঙ্গ করছি আমরাই। অন্তর্কলহের জেরে দার্জিলিং-এর বুকে গোৰ্খাল্যান্ডের নামে বা উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য হিসাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবনা মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের রাজনীতিবিদদের কিছু যাবে আসবে না, অঙ্গরাজ্যের তালিকায় নতুন একটি রাজ্যের নাম সংযোজিত হবে। কিন্তু এই বঙ্গদেশ হবে টুকরো টুকরো। সহজ সরল নেপালী ভাষী বোনের হাতে বাঙালী ভাই কি আর রাখী বাঁধতে পারবে না? তাই যুগে যুগে কালে কালে রাখীবন্ধন মানুষের মধ্যে মিলনসেতু রচনা করেছে। এই রাখীবন্ধন উৎসব সবরকম বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরূদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।




একটি রাঙা রাখী
চিত্রা পাল

রাখী বন্ধন উৎসব হয় শ্রাবণী পূর্নিমা বা ঝুলন পূর্ণিমাতে। এই উৎসবে বোন ভাইকে রাখী পরিয়ে দিয়ে জীবনভোর বাঁধা পড়ে এক পবিত্র সম্পর্কে। একবার এক রাখীভাই যেভাবে রাখীবোনের মর্যাদা  রক্ষা করেছিলো সে কাহিনী আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খোদিত। সে কাহিনী রাজপুতানার মেওয়ারের রাণী কর্ণাবতী আর মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের।

রাজপুতানার মেওয়ার রাজ্যের রাণী ছিলেন কর্ণাবতী। তিনি ছিলেন চিতোরের মহারাণা সঙ্গের স্ত্রী। এই রাণীর ছিলো দুই সন্তান-রাণা উদয় সিং আর রাণা বিক্রমাদিত্য। যখন মুঘল সম্রাট হুমায়ুন তাঁর  রাজ্য বিস্তারের জন্য অন্যত্র ব্যস্ত ছিলেন সেই সুযোগে গুজরাটের বাহাদুর শা ১৫৩৩ খৃষ্টাব্দে চিতোর আক্রমণ করেন।

মহারাজা সঙ্গের মৃত্যুর পরে মহারাজা রতন সিং সমস্ত রাজপুত রাজ্যগুলোকে এক পতাকার তলায় নিয়ে এসে চিতোরের সিংহাসনে বসেন। রাণা রতন সিংহের মৃত্যুর পরে তাঁর ভাই চিতোরের মহারাণা হন। বিক্রম তাঁর আর্মিতে সাত হাজার কুস্তি জানা লোক নিয়োগ করলেন। তিনি ভালোবাসতেন কুস্তি শিকার জীব্জন্তুর যুদ্ধ এসব। মেওয়ারের অভিজাতদের এসব পছন্দের ছিলো না। ক্রমে এই নিয়ে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে তাঁরা তাদের রাজ্য পরিত্যাগ করে অনেকে সম্রাট বাহাদুর শা বা আর কারোর কাছে  চলে গেলেন।     

  গুজরাটের শাসক বাহাদুর শা চিতোর আক্রমণ করে এই সব অসন্তুষ্ট দেশত্যাগী লোকদের নিয়ে। যদিও বিক্রম চেষ্টা করে ছিলেনবাহাদুর শাহের সঙ্গে সন্ধি করতে, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। বাহাদুর শা  আরো শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেন। তার বিশাল সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাণা বিক্রমের বাহিনী পারবে না। রাজমাতা সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠালেন। কিন্তু বাহাদুর শা তা পরিত্যাগ করে দিলেন।  

এই পরিস্থিতিতে মহারাণী কর্ণাবতী  মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে প্রস্তাব দিলেন যে রাজপুত আর মুসলিম দুই  দলই তাদের দুজনের শত্রু বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে লড়বে। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন সেই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন কারণ রাজমাতা কর্ণাবতী বুঝে গিয়েছিলেন, মহারাণা বিক্রমাদিত্য ভালো দক্ষ  যোদ্ধাও নয় ভালো শাসকও নয়। সেইজন্য মেওয়ারের সম্মান রক্ষা করার জন্য তিনি  সম্রাটকে রাখী  পাঠিয়ে ভাই হয়ে সাহায্য  করার অনুরোধ করেন। হুমায়ুন ধর্ম ভাই হয়ে তাঁকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। বোনের ভাই সেই রাজত্ব রক্ষার দায়িত্বও নেন। হুমায়ুন রাজমাতার রাখীর মর্যাদা দিয়ে প্রচুর উপহার পাঠান আর তাঁকে  আশস্ত করেন যে তিনি সাহায্য করতে আসবেন।     

যখন চিতোর আক্রমণ হয় তখন হুমায়ুন গোয়ালিওর ফোর্টে ছিলেন। আর তিনি তাঁর দলকে দিল্লি হয়ে আগ্রা যাবার নির্দেশও দিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু যখন সেই দলকে ফিরিয়ে তিনি চিতোরে পৌঁছলেন, তখন দেরী হয়ে  গিয়েছে। রাজমাতা কর্ণাবতী জহর ব্রতে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন প্রাসাদের সব রমণীকে নিয়ে। যাই  হোক জহর ব্রতের আগে তিনি রাজকুমার উদয়সিংহকে নিরাপদে বুন্দি ফোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ধাত্রী পান্নার হাত দিয়ে।

হুমায়ুন দুঃখ পেয়েছিলেন রাণী নেই শুনে,  আর যখন শুনলেন রাজমাতা জহরব্রতে জীবন দিয়েছেন  তখন ক্রোধে আগুন  হয়ে বাহাদুর শা কে আক্রমণ করে তাকে পরাস্ত করলেন। এরপর প্রিন্স উদয় সিংকে  বুন্দি থেকে আনিয়ে তাকে মহারাণা পদে অভিসিক্ত করলেন।  

সম্রাট  হুমায়ুন এদেশে এসেছিলেন ভারতের বাইরের দেশ থেকে। কিন্তু তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিতে ভাইবোনের  পবিত্র সম্পর্কের কথা জানতেন। এক সময় তিনি অমরকোটের রাজপুত শাসক বীরশালের কাছে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। সে সময়   বীরশালের পাটরাণী তাঁকে নিজের ভাই এর মতো দেখতেন। হুমায়ুনের ছেলে  সম্রাট আকবর তাঁর অমরকোটে থাকাকালীন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেজন্য   তিনি চেষ্টা করেছিলেন এই সম্পর্কের  বোন রাণী কর্ণাবতীর রাখীর মূল্য দিতে।জাতি ধর্ম নির্বিশেষে একটি রাঙা রাখী হয়েছিলো সেই মর্যাদার রক্ষক। যে কাহিনী আজও ফেরে লোকমুখে। 

   


ঝুলনযাত্রা ও রাখী পূর্ণিমার ঐতিহ্য 
 অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত 

সুপ্রাচীন কাল থেকে ঝুলন ও রাখী উৎসব ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় এবং সমাজ জীবনে এক অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে চলেছে। এই উৎসবের মুখ্য উদ্দেশ্য হল প্রেম, মৈত্রী, জাতীয় সংহতি, জন জাগরণ, দেশভক্তি ও দেশপ্রেম এবং আধ্যাত্মিকতার বিকাশ সাধন। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন উৎসব। 
আজও ধর্ম প্রাণ নরনারীদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে এই উৎসব হয়ে ওঠে আনন্দমুখর। এই উৎসব বেশ কয়েকদিন ধরে চলে। বর্তমানে কালের বিবর্তনে কিছু পরিবর্তিত রূপ আমরা লক্ষন করি। ভারতবর্ষের সর্বত্রই এই উৎসব ধুমধামের সাথে পালিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মণিপুর, বৃন্দাবন এবং মায়াপুর ও নবদ্বীপ ধাম। প্রতিটি মঠ, মন্দির এবং গৃহাঙ্গনকে আলোকমালা ও ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও মেতে ওঠে উৎসবে। পাড়ায় পাড়ায় দেখা যায় ঝুলন উৎসব। শ্রাবণী পূর্ণিমাকে ‘ঝুলন পূর্ণিমা’ ও ‘রাখী পূর্ণিমা’ বলা হয়।

ঝুলন ও রাখী উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু হলেন শ্রীকৃষ্ণ
ভগবান। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই নানা লীলার কেন্দ্রবিন্দু। তার মধ্যে সর্বোত্তম নরলীলা। ঝুলন তারই মনোরম প্রকাশ। দ্বাপর যুগে বৃন্দাবনে স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে যখন গগন মণ্ডল উদ্ভাসিত, তখন সখা ও গোপীগন পরিবেষ্টিত হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঝোলায় (দোলায়) আরোহণ করে লীলা বিহার করেন এবং ভগবৎ আনন্দের সঞ্চার করেন সমবেত ভক্তদের মধ্যে। এই ঝুলন ‘হিন্দোল ক্রীড়া’ অর্থাৎ ঝুলা বা দোলা খাওয়া। ঝুলন প্রেমের উৎসব। মহামিলনের ‘পবিত্র নীড়’। ভগবানের সঙ্গে মিলিত হবার উৎসব। তাঁকে আপন করে পাওয়ার উৎসব। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মহামিলন উৎসব। যুগ যুগ ধরে আসমুদ্র হিমাচলের কোটি কোটি নরনারী সমস্ত প্রতিকূলতা জয়ের জন্য পরম পুরষোত্তমের নিকট আরাধনা করে চলেছেন।

কেন এর নাম রাখী পূর্ণিমা
শ্রাবণী পূর্ণিমাতে শ্রীকৃষ্ণ গোকুল বাসীদের হাতে এবং গোকুলবাসীরা ভগবানের হাতে মঙ্গলসূত্র রাখী বেঁধে দিয়ে পরস্পরের রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাই এই পূর্ণিমার নাম রাখী পূর্ণিমা। 

বর্তমানে ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনে রাখী বন্ধন এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। জাতি,ধর্ম,বর্ণের সীমা অতিক্রম করে পরস্পর পরস্পরের শুভ কামনায় রাখী বন্ধন করে চলেছে অবলীলাক্রমে।


পুরানে উল্লেখ্য একটি ঘটনা হল যে সত্যযুগে দেবরাজ ইন্দ্র বহু বছর ধরে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হচ্ছিলেন। তখন দেবগুরু বৃহস্পতির নির্দেশে ইন্দের স্ত্রী ইন্দ্রানী শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন ইন্দের হাতে রক্ষা কবচ পরিয়ে দেন। ইন্দ্র যুদ্ধে গমন করলেন। অসুরদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হল। অবশেষে অসুররার পরাজিত হল। 

আবার ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বালী বধের পূর্বে সুগ্রীবও রামচন্দ্রের হাতে লতা পাতা দিয়ে রক্ষা কবচ পরিয়ে দিয়েছিলেন ।

দ্বাপরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবাসীদের হাতে রাখী পরিয়ে দিয়েছিলেন।

ইতিহাসেও রয়েছে রাখী উৎসবের টুকরো স্মৃতি যেমন, কলিতে রাধাকৃষ্ণ মিলিত তনুধারী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও বৃন্দাবন ও নবদ্বীপে ঝুলন এবং রাখী উৎসবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।

ঐতিহাসিক মত প্রচলিত আছে যে, সিকন্দরের পত্নী রৈক্সোনা রাখী পূর্ণিমার দিন রাজা পুরুকে রাখী পাঠিয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে রাজা পুরু যখন সিকন্দরকে হত্যা করার জন্য তরবারি উদ্যত করেন তখন তাঁর নিজের হাতের রাখীর দিকে দৃষ্টি পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে রাজা পুরু তরবারি নামিয়ে নেন এবং সিকন্দরের প্রাণ রক্ষা পায়।

বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরস্পরের হাতে রাখী বেঁধে দিয়ে দেশ রক্ষার সঙ্কল্প করেছিলেন।

পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থণা- ঝুলন ও রাখী পূর্ণিমা উৎসব প্রসারিত হোক সমাজ জীবনের প্রতি কোনে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হোক শান্তি, সংহতি, দৃঢ় হোক মানব মেল বন্ধন।



গল্প 


মায়াডোর
ড.  ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ রাখী পূর্ণিমা।  গোপাল মন্দিরের মাঠে বড় মেলা বসেছে। আলো আর আকাশ  ছুটছে মেলার মাঠের দিকে। কী আনন্দ। আকাশের বাজুবন্ধে আলোর পরানো রাখী, বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।আলো আকাশের হাত ধরে বলে --  ভাই চল্ তোকে  মিষ্টি খাওয়াবো। 
  -- না দিদি আমার খুব শখ  হাতে উল্কি আঁকার। বন্ধুরা মেলার মাঠে  উল্কি আঁকিয়েছে।
  -- আচ্ছা ঠিক আছে কিন্তু মা বকলে আমি জানি না। 
  -- না না আমার চাই চাই চাই। 
নিতান্তই গরীব পরিবারে ওদের দিনাতিপাত। কিন্তু তার জন্য মনে কোন দুঃখ  নেই । ওদের মা চাল কলে কাজ করে বাবা যাত্রা দলে গান লেখে, নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। সংসারের ভালো মন্দ দেখার ফুরসৎ নেই। তবে যখন বাড়ি থাকে ছেলে মেয়েরা আনন্দে মেতে থাকে। 
মেলায় নাগরদোলা,  পুতুল নাচ,  কুয়োর মধ্যে মোটর সাইকেল রেস কত কী। ওদের কাছে অত পয়সা নেই। মিষ্টি খেয়ে উল্কি বুড়োর কাছে গিয়ে দুজনে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে --   একটা ফুল আঁকো তো দাদু। আচ্ছা তার ভিতরে আমাদের নাম লিখে দিতে পারবে? 
  -- লিচ্চয়। খুব পারবো। 
মেলা থেকে নাচতে নাচতে বাড়ি ফেরে দুটি  বালক বালিকা। 
সময় এগিয়ে চলে। আলো মাধ্যমিক দেবে। আকাশ ক্লাস এইট। সংসার চালাতে ওদের মা দিশেহারা। আলোর মত রূপসী মেয়ে এই গোপালগঞ্জে  একটাও নেই। তাই ভয়ে  আরো কাঁটা হয়ে থাকে। চালকলের মালিকের মেয়ের বিয়ে সবাইকে নিয়ে  গেছে আলোর মা। মালিকের এক বন্ধু তার ছেলের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ছেলে দূরে কাজে যাবে তাই তার মা বাবা বিয়ে দিয়ে পাঠাতে চায়। আলোর বাবা বাড়ি ফেরে নি মাস ছয়েক, কোথায় গেছে কবে ফিরবে কে জানে। পাড়ার সবাই পরামর্শ দিল  এমন রূপসী মেয়ে পাত্রস্থ করাই ভালো, সব থেকে বড় কথা বিয়ে তে কোনো দেনা পাওনা নেই। আলো শুধু কাঁদে আর ভাবে  মাধ্যমিক পাস করে আমি একটা কাজ পেয়ে যাবো। ভাই কে আমি ঠিক ভালো করে মানুষ করবো। 
সানাই বাজে। শাঁখ উলু বরণ ডালা.... আলো চললো শ্বশুর বাড়ি।ট্রেনে নতুন বর  আলোর জন্য নিয়ে এল রাতের খাবার আর জল। আলো খায়, ঘুমে চোখ বুজে আসে। 
ঘুম ভাঙে।  আধা অন্ধকার ঘুপচি টিনের চাল। দমবন্ধ লাগে। অনেক কষ্টে চোখ মেলে... কোথায় আছে বুঝতে পারে না, দেয়ালে বিশ্রী ছবি  দেওয়া ক্যালেন্ডার। এক স্থূলা মহিলা এসে  ভালো করে দেখে আলো কে তারপর কর্কশ সুরে বলে  --  আরে চিড়িয়া  ঘুম থেকে উঠেছে রে কমলি বিমলি দেখে যা।  আজ ই ওর নথ ভাঙা হবে। বহুৎ রূপেয়া দিয়ে কিনেছি। খুব খুবসূরৎ আছে লড়কি।উড়ে যায় যদি... 
মা গো বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে আলো। সপাটে এক চড় দেয় স্থূলা মাসী টি। আবার জ্ঞান হারায় আলো।
 আলোর দিন শেষ, এখন চোখ ধাঁধানো বিজলির দিন শুরু। 
রূপে র জৌলুস এ লাইনে এক ডাকে সবাই চেনে বিজলি কে। বিজলি কিন্তু তার ছোট ভাই আর মা কে ভুলতে পারে নি। প্রতি মাসে নিয়ম করে টাকা পাঠায়, চিঠি দেয়  কিন্তু ঠিকানা দেয় না । আর বছরে একটা দিন সুন্দর একটা রাখী পাঠায়।দুঃখে বুক ফেটে যায়, চোখের জলে ভাবে .. রাখী তো  শুধু জরি কাজ ফিতে আর ফুল নয় এ হল মায়ার ডোর।কোনদিন কাটবে না। 
সময় চলে আপন গতি তে। পনের টা বছর কেটে গেছে। বিজলি নিজে ই এখন এই সাম্রাজ্যের কর্ত্রী।  পুলিশ কে বশ করে, চোখে ধুলো দিয়ে এই শহরের বুকে  বড় বড় হোটেলে তিন খানা মধু চক্রের মালকিন। বাড়িতে এখনো টাকা পাঠায় অনেক টাকা। 
খুব ভোরে  দলের ছেলেরা এসে খবর দিল  --  মৌসী   এক নতুন পুলিশের এস. পি এসেছে। খুব খতরনাক।  ঘুষ নেয় না। মধু চক্রের খবর পেয়েছে। আজ রেইড  করতে যাবে।  কি করতে হবে বলো। বডি নামিয়ে দি? 
   -- ছি ছি এইসব কথা বললে মার খাবি আমার কাছে। আমি নিজে যাবো। কত বড় বড় অফিসার কে কাৎ করে ফেলেছি আমি। তোরা আমার উপর ভরসা রাখ। 
সন্ধে বেলায় সুন্দর করে সাজলো  বিজলি, পরনে স্বচ্ছ মসলিন শাড়ি। হোটেল ব্লু ভিউ এ ঢুকে সোজা চলে গেল চব্বিশ নম্বর ঘরে। এ ঘরটা ওর নামে সারা বছর বুকড  থাকে। আজ মধু চক্র বন্ধ। ওর ডাক পড়ল ম্যানেজারের অফিস ঘরে সেখানে এস. পি অপেক্ষা করছেন, ওর সাথে কথা বলবেন। 
বিজলি ঘরে ঢুকল। এস পি বিপরীতে চেয়ারে বসে। রাগে মুখ থমথমে। বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন  --  আগে থেকে খবর পেয়ে আজ মধু চক্র বন্ধ রাখলেন? ভেবেছেন আমি ধরতে পারবো না। আমার ভয়ে  এ শহরে সবাই কাঁপে এটা জানেন নিশ্চয়ই। 
বিজলি শরীরে একটা হিল্লোল তুলে ভুরু ধনুকের মত বেঁকিয়ে মধুর হাসল। তারপর বলল --  এত রাগ করছেন কেন। শরীর খারাপ হবে। চলুন আমার ঘরে কপালে  ওডিকোলন লাগিয়ে দি। শরবত বানিয়ে দেব। পান খাবেন ঠান্ডা পান? আর কিছু? 
ধনুকের ছিলার মত ছিটকে উঠলেন এস. পি  --   ছিঃ ছিঃ কি বলছেন আপনি? দেখুন আপনি বয়সে বড় বলে  সম্মান দিয়ে কথা বলছি। আরে আপনি তো তার যোগ্য ই নন। চরিত্র খারাপ হলে এ ধরনের ঈঙ্গিত দেয় তোদের মত মেয়ে ছেলেরা। লজ্জা করেনা এ সব কথা বলতে। জেনে রাখ তোর মধু চক্র আমি ভাঙব ই। নিজের মহল্লা য় গিয়ে যা খুশি কর। উফ্ফ্ আই কান্ট টলারেট..  উত্তেজিত হয়ে মুঠো শক্ত করে  শার্টের হাতা তুলছে এস. পি। হঠাৎ চোখ চলে গেল বিজলির....  হাতে উল্কি আঁকা তার মধ্যে লেখা আকাশ। 
পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে পড়ে যাবে এক্ষুনি, ভিতরে অসহ্য কাঁপুনি। চেয়ারের হাতল টা শক্ত করে ধরে দাঁড়াল বিজলি অস্ফুট মুখ থেকে বের হল  . .  ভাই
 -- ওই ডাক তুই মুখে আনবি না  , তোর পাপী মুখে মানায় না। আমার নিজের দিদি  স্বর্গের আলো বুঝলি। কত কষ্ট করে অন্যের সেবা করে আমার পরিবারকে হেল্প করেছে আমাকে মানুষ করেছে। তার প্রতিটি চিঠি আমার মুখস্থ। তাকে আমি খুঁজে বার করব ই। দেবী র মত ভক্তি করি তাকে। তুই পাঁকে থাকিস। সেখানে ফিরে যা। এই পাপ মুখ আমাকে আর দেখাস না। যা যা নরকের কীট। 
বিজলি দু চোখ ভরে দেখে ভাই কে। চোখ মুছে সিঁড়ি আঁকড়ে ধরে উঠে যায় উপর তলায়। 

ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজে। ভোরের ট্রেন ধরে আকাশ গ্রামের বাড়ি যাবে। আজ রাখী পূর্ণিমা, দিদি নিশ্চয়ই খুব সুন্দর রাখী পাঠিয়েছে। ফোন বেজে উঠল হঠাৎ। থানা থেকে মেজ বাবু  জানাল হোটেল ব্লু ভিউ  এ কে যেন ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। লোক জানাজানি হবার আগে ওরা ব্যাপার টা মিটিয়ে নিতে চায়। 
জিফ থেকে নেমে এস. পি আকাশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখেন এক মহিলা উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। মাথার চারপাশে মাটিতে রক্তের  চিহ্ন। 
   --  স্যার আপনি  শুধু  দেখে নিন বেঁচে আছে কিনা তারপর আপনি বাড়ির দিকে রওনা দেন। আমরা সব মিটিয়ে নেব.....বলে মেজ বাবু ডেড বডি চিৎ করে দিলেন
চারদিকে চাপা গুঞ্জন। আকাশ বলে উঠলেন -- ওহ সেই মধু চক্রের মালকিন। এভাবে  আত্মহত্যা করল কেন? 
সামনে এগিয়ে নাড়ি ধরতে ই তীব্র শক লাগল যেন... খোলা সাদা হাত টা এলিয়ে পড়ে আছে... উল্কি আঁকা ফুল, ফুলের মধ্যে লেখা আলো... 
দুলছে সারা পৃথিবী দুলছে আকাশের... .... 



 টান 
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

কি দুঃসহ জীবন!!  চাপ চাপ অন্ধকার চারিদিকে। ঘরের জানলাগুলো পুরোপুরি ঢেকে দেওয়া হয়েছে। একফালি আকাশ, একমুঠো রোদ্দুর, এক টুকরো টাটকা বাতাস, কিছু চেনা মুখের সারি, কিছু বলা,না বলা কথা  সবই বড় দুর্মূল্য এখানে। নিজের চলার স্বাভাবিক ছন্দকে ভুলে যেতে হয়েছে, ভুলে যেতে হয়েছে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততাকে। কোনো দুরাচারির ইঙ্গিতে তর্জনী স্থায়ী ভাবে এসে ঠেকেছে বন্ধ ঠোঁটে। আতঙ্ক.. অদ্ভুত এক আতঙ্ক গ্রাস করছে সবসময়; এই বুঝি ওরা এল; আরও, আরও ভয়াবহতায় টেনে নিয়ে যাবার জন্য। 
                                  শবনমের নির্দেশে এবার চোখ বন্ধ করলো জয়। জয়ের বন্ধ চোখের পাতার দিকে আড় চোখে তাকাতে তাকাতে ওর কোলের ওপর নিজের হাতে এঁকে ফোড় তুলে সেলাই করা রুমালটা সাবধানে রেখে দিল শবনম। একটু আগে জয় যখন ওর দিকে ডানহাতটা হাসিমুখে বাড়িয়ে দিয়েছিল ; সেটা ছিল শবনমের আজকের এই পবিত্র দিনের সেরা মুহূর্ত। রাখিটা যত্ন করে পরিয়ে দিতে দিতে ভাইজানের দীর্ঘায়ু, সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করেছিল শবনম।  যেমন করে এসেছে সেই ছোট্টটি থেকে। রাখিবন্ধন ওদের উৎসব নয় আদৌ। কিন্তু আব্বুর সঙ্গে কলকাতায় আসবার পর থেকে এই বাড়িটার এতগুলো পরিবারের মধ্যে বড়মা আর ভাইজান ওকে এমন আপন করে নিল যে ওরা হিন্দু আর ও নিজে মুসলমান সেই বোধই তৈরি হলোনা ওর মধ্যে সেই ছেলেবেলা থেকেই। নিয়ম করে নামাজ পড়বার সঙ্গে সঙ্গে তাই বড়মায়ের দুলে দুলে পড়া লক্ষ্মীর পাঁচালির শব্দগুলোও ওর মনে চিরতরে গেথে গিয়েছিল। ভাইজানের কপালে ওরই পরানো চন্দনের ফোঁটা। এবার চোখ খুলেছে ভাইজান। প্রদীপের আগুনকে হাতের পাতায় স্পর্শ করে জয়ের মাথায় ছুঁইয়ে দিল শবনম। বোনের মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে মঙ্গলময়ের কাছে ওর সুখী জীবনের প্রার্থনা করলো দাদা। জয়ের পায়ের পাতা ছুঁয়ে শবনমের মন বলে উঠলো 'তুমি চিরটাকাল আমার রক্ষাকবচ হয়ে থেকো, ভাইজান।' বাটিভরা সেমাই থেকে এক চামচ তুলে দিল প্রিয় দাদার মুখে। তারপর সেই ছোটবেলার মতোই হাত বাড়িয়ে দিল জয়ের দিকে....  'আমার তোফা? 'বড়মার শঙ্খ বাজানোর আওয়াজ তখন ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বাড়িটায়। 
‌                               কলকাতার ইসমাইল স্ট্রিটের তিনতলা পুরোনো বাড়িটায় জয় ও তার মা বাবাকে নিয়ে যে বাড়িওয়ালার পরিবার,ওনারা হিন্দু, মুসলিম মিলিয়ে তাদের কয়েকঘর ভাড়াটের সঙ্গে এমনই একাত্ম হয়ে বসবাস করেন। শবনমের আব্বা আবদুল একবার দেশে গিয়ে ফিরবার সময় যখন ছোট্ট শবনমকে নিয়ে ফিরে এসেছিল; তবে থেকেই শবনম  বড়মার মেয়ে আর জয়ের ছোটবোন হয়ে গেছে। এখানেই গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা শেখা সবটাই তার।দূরদেশে আরও কয়েকটি সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকা মায়ের অভাব কোনোদিন টের পায়নি শবনম।  সদাব্যস্ত আবদুল কাবলিওয়ালারও বড় ভরসার জায়গা ছিল শবনমের প্রতি জয় ও তার মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা। শবনম যেন এক রঙিন প্রজাপতি। তিনতলা বাড়িটার সকলের ঘরেই কমবেশি ওর অবাধ বিচরণ। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর সে। জোরে জোরে হেসে হেসে কথা বলে,  বাড়ির এঘর থেকে সেঘরে ছুটে ছুটে বেড়ায়। এখানকার সকলেই চোখে হারায় শবনমকে। তবে ভাইজানের নয়নের মণি সে।বয়সের বেশ অনেকটা ফারাক থাকলেও অবাধ ভালোবাসার এক নিবিড় বুনোট নিজেদের অজান্তেই কখন যেন তৈরি হয়েছিল ওদের এই সুন্দর সম্পর্ককে ঘিরে।এরপর এল সেইদিন। শবনমের একান্ত অনিচ্ছায়, এখানকার সকলের অমতে আবদুল কিছুটা চাপে পড়েই পনেরো বছরের মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দিল নিজের দেশের পথে। 
                                বেশ কিছুদিন হলো বড় অস্থির লাগে জয়ের। শবনম চলে যাবার পর থেকে মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকানো যায়না আর। কিছুটা স্বাভাবিক ছন্দে যদিওবা ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল ওরা সকলে মিলে; সাম্প্রতিক এই ভয়াবহ পরিস্থিতি ক্রমশ হতাশ করে তুলছে জয়কে। শবনমটার কথা বড় বেশি করে মনে পড়ে এই অস্থির সময়ের নিরিখে।এতগুলো বছর ধরে শবনমের দেওয়া রাখিগুলোকে মেলে ধরে চোখের সামনে। নতুন আশায় বুক বাধে আবার।যতটুকু পারছে ওদের খোঁজখবর রাখবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে সবসময়। তবুও, মনে জোর এনে, সমস্ত সূত্রকে কাজে লাগিয়ে শবনমকে ওই ভয়াবহতা থেকে বের করে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে শবনমের ভাইজান.... এরপর শুধু অপেক্ষা.... 
                       বোরখার আড়ালে মুখ লুকিয়ে, সর্বাঙ্গ ঢাকা পোশাকে এগিয়ে যাচ্ছিল একজন। উদ্ধারকারী একটি দলের বিমান পরিসেবার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ওর মন বলছিল, ও ঠিক পৌঁছে যাবে ওর অভিষ্ট লক্ষ্যে, আলোর ঠিকানায়। আজকের এই তিথিই ওকে মিলিয়ে দেবে ওর বিশ্বাস, নিরাপত্তা ও ভালোবাসার বন্ধনের সঙ্গে। স্বপ্ন.. স্বপ্ন দেখছিল শবনমের মন। এই নিরাপত্তাহীনতার জীবনে স্বপ্নই একমাত্র আশ্রয়, বেঁচে থাকার। বন্ধ ঘরে বসে চোখ বন্ধ করে ভাইজানের মুখ মনে করে তার হাতে রাখি বেঁধে দিল ও। মন বলল আজকের এই দিন,যার বহু ছবি আঁকা হয়ে রয়েছে ওর স্মৃতির পাতায়, ওদের ভাইবোনের পবিত্র সম্পর্কের নিবিড় উদযাপনের দিন হয়ে উঠবে  আবারও,খুব শিগগির। সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে যেখানে ওর রক্ষাকবচ হয়ে উঠবে ওর প্রাণের ভাইজান। কলকাতার আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদে আঁকা শবনমের চাঁদমুখটিকে শ্রাবণের ঘন মেঘ এসে আড়াল করে দিচ্ছে বারবার। 


 

স্মৃতিচারণা 

রাখীবন্ধন -কিছু চিত্র

     শ্রাবণী সেনগুপ্ত 

এক 

একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে কবেই।তবু রাখীবন্ধনের দিনটি এলেই মনে পড়ে কতো কথা।সব ভাইয়েরা (জ্যেঠ্তুতো,খুড়তুতো)মুখিয়ে থাকতো কখন বোনেরা তাদের হাতে বেঁধে দেবে রাখী।বোনেরাও তাদের সামান্য সঞ্চয় থেকে কিনে রাখতো বা কখনো নিজেরাও বানিয়ে রাখতো রাখী।বেশ কিছুদিন আগে থেকেই চলতো তার প্রস্তুতি।কমদামি,সামান্য আয়োজন তাও অমূল্য।আজও ভাইদের নামে রাখী কেনা হয়-বেশ দাম দিয়ে আর শুভেচ্ছা আদানপ্রদান হয় ভিডিও কলের মাধ্যমে।কেউ দূরে,অথবা কারোর সময় নেই।তাই এইভাবে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বন্ধনকে ধরে রাখার চেষ্টা।তবুও অতীতের সেই সহজ সরল আনন্দ কোথাও যেন অধরাই থেকে যায়।


দুই 

ভাইয়ের ভেসে ওঠা রাখী পরা হাতটা আজও চোখে ভাসে দিদির।এমনই এক রাখীপূর্ণিমার দিনে পুরীর সমুদ্র কেড়ে নেয় একমাত্র ভাইকে বাবা মা আর দিদির চোখের সামনে।সেদিন সকালে উঠে ভাইকে রাখী পরিয়ে মিষ্টি খাইয়েছিলো দিদি।সমুদ্র স্নানে যাবার সময়ও তার হাতে বাঁধা ছিলো তা।ভাইয়ের  নিথর দেহটা যখন পাড়ে তোলা হলো হাতে তখনো জ্বলজ্বল করছে ভাই বোনের বন্ধন।আজ এই রাখীপূর্ণিমায় অনাথ আশ্রমের ভাইদের রাখী পরানোর মধ্যে দিয়ে আবার সেই ভালবাসার বন্ধনকে ফিরে পেলো দিদি।

তিন 

সোনু আজ কারখানার মালিকের দেওয়া জলখাবারের টাকা বাঁচিয়ে রাখী আর মিষ্টি কিনেছে।এক কামরার ঘরে ফিরে এসে খাটে শুয়ে থাকা চলৎশক্তিরহিত দিদির হাতে রাখী বেঁধে দিয়ে একটু মিষ্টি খাইয়ে দেয় সে।ছোটো থেকে তাকে বড়ো করে তোলা দিদির কোনোদিন ভুল হয়নি আজকের দিনে তার হাতে রাখী বাঁধতে।আজ অপারগ পঙ্গু দিদির হাতে রাখী বেঁধে ভাই সে বন্ধনকে আরো দৃঢ় করলো।


চার 

মালবিকা বসে আছেন জানলার ধারের চেয়ারে।আকাশে আজ গোল থালার মতোন চাঁদ।বড্ড মনে পড়ছে ছেড়ে আসা নাতির কথা।এই বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসার আগে পর্যন্ত উনি নাতির হাতেই পরিয়ে দিতেন রাখী।বসে বসে সেই কথা ভেবে ভিজে উঠছে চোখের কোল।হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শুনে চেয়ার থেকে উঠে দরজা খুলে দেখেন সামনে দাঁড়িয়ে এক ক্ষুদে হাতে তার একটি রাখী আর তার পিছনে রয়েছেন এই বৃদ্ধাশ্রমের মালিক কেশব বাবু। তিনি ওর সামনে দাঁড়াতেই ওনার হাতটি নিজের কাছে টেনে নিয়ে রাখিটি পরিয়ে দিলো সেই ক্ষুদে। মনোরমা দেবীকে বিস্মিত হতে দেখে পেছন থেকে কেশব বাবু বলে উঠলেন-"ম্যাডাম এই বাচ্চাটি সামনের অনাথ আশ্রমের। আজ আমি আপনাদের একটু মন ভালো করবার জন্য চুপি চুপি এই ব্যবস্থা টি করেছি।ঐ আশ্রমের বাচচারা এসেছে আপনাদের হাতে রাখী পরিয়ে নতুন বন্ধনে বাঁধতে।"মন ভরে গেলো মনোরমাদেবির। সত্যিই এমন হয়-যেখানে আপনেরা ছেঁটে ফেলতে চায় সমস্ত বন্ধন,সেখানে অনাত্মীয় কেশববাবু এগিয়ে এসেছেন দুই ভালবাসার কাঙালের মধ্যে সেতু বন্ধনের উদ্দেশ্যে।নীচু হয়ে কোলে তুলে নিলেন সেই একরত্তি কে।কোনোখান থেকে ভেসে এলো গান 'চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে,উছ্লে পরে আলো ....।'


এবার রাখিহোক অন্যরকম

মনামী সরকার

তখন আমি অনেকটাই ছোট বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। রাতে ঘুমোতে যাওয়া মানে মায়ের কাছে গল্প শোনা। রূপকথার গল্প,রাজা রানীর,গল্প ইতিহাসের গল্প সবি থাকতো মায়ের ঝুলিতে।তারমধ্যে মনে আছে রাখি বন্ধন নিয়ে ছোট ছোট গল্প শোনাতো মা।রানা প্রতাপ এর গল্প, কর্মাবতীর গল্প, এমনকি বঙ্গভঙ্গের সময় রবীন্দ্রনাথ কিভাবে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন সেই সমস্ত গল্প। ইতিহাস সাক্ষী আছে বারবার বোনেরা নিজেদের রাজ্য,রাজ্যবাসীর প্রাণ, নিজেদের সম্মান সম্ভ্রম রক্ষার প্রার্থনায় ,ভাই বা দাদার মঙ্গল কামনা করে দীর্ঘায়ুর জন্য হাতে বেঁধে দিয়েছে রাখি। কখনো বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটাতে ভাই ভাইয়ের হাতে পরিয়ে দিয়েছে রাখি।আসলে রাখি একটা বিশ্বাস একটা অঙ্গীকার,প্রতিশ্রুতি।
                গল্প শুনতে শুনতে আমি শুধু ভাবতাম আমি তো একা আমার তো ভাই বা দাদা কেউ নেই, তবে আমায় কে রক্ষা করবে? রাখির নির্দৃষ্ট দিনটায় খুব মন খারাপ হোত। মা কিছু রাখি কিনে দিয়ে বলতো বাড়ির আশেপাশে প্রতিবেশী  যে দাদা বা ভাইরা রয়েছে তাদের রাখি পড়াতে। আমি খুব আগ্রহ করে ছুটতাম ওদের কাছে। কিন্তু সেখানেও ঘটে যেত কিছু বিরম্বনা।আগে ওদের নিজেদের দিদি,বোনরা রাখি পড়াতো তারপর আসতো আমার পালা।রাখির উপহারের ক্ষেত্রেও হত অনেক তারতম্য।শিশু মনে সত্যিই খুব আঘাত লাগতো।      
             ইতিমধ্যেই আমার একাকীত্ব ঘুচিয়ে চলে এসেছে আমার ছোট বোন। সে আমার খেলার সঙ্গী। কিন্তু বোনকে কি রাখি পরানো যায়? পড়ানো হয়ে ওঠেনি কখনো।সময়ের সাথে সাথে সে হয়ে উঠেছে আমার পরম বন্ধু। বাড়িতে দুষ্টুমি করলে বাবা-মার কাছে বকা খাওয়ার সময় আমরা দুই বোন দুজনকে রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠতাম।বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের বিচরণক্ষেত্র অনেক বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নানান সমস্যা,বিপদ। আমরা সব সময় একে অপরের ঢাল হয়ে থেকেছি। দাদা বা ভাই থাকলে এর বেশি কিছু করতে পারতো বলে আজা আর মনে হয় না।
       আর একটু বড় হওয়ার পর পেয়েছি একজন দিদিকে।রক্তের সম্পর্কের কেউ না হলেও তার সাথে আত্মিক সম্পর্ক টা অনেক গভীর।রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় সে এখনো আমাকে নিজের বাঁ দিকে রাখে।যত বড় বিপদ আসুক না কেন নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে চিন্তা করিস না এই দিদি টা তো আছে,বিপদ মুক্তি,মঙ্গল কামনার প্রার্থনায় যে বোনের হাতে বেঁধে দেয় বিপত্তারিণীর সুতো।কোন এক বছর শেষের শীতের রাতে তার জীবনে নেমে আসে আচমকা এক অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা। দিশেহারা হয়ে প্রথমেই তার মনে পড়েছিল এই বোনটার কথা।সেই বিপদ থেকে দিদিকে উদ্ধার করতে যা যা করণীয় তাই করেছিলাম। আমার ছোট বোন আমি আমার দিদি আমরা সবাই সব সময় সব অবস্থাতে একে অপরের জন্য রয়েছি।
                      ভাই বোনের সম্পর্কটা সত্যিই অন্যরকম,সুন্দর মিষ্টি একটা সম্পর্ক কিন্তু সেই সমস্ত রকম ভালোবাসা,নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আজকের দিনে একজন বোন আরেকজন বোনকে দিতে পারে।বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে যখন প্রতিনিয়ত আমরা নিজেদেরকে উন্নত করে চলেছি তখন কিছু নিয়ম,প্রথা, উৎসবেরও আধুনিকীকরণ হওয়া প্রয়োজন।রাখি শুধু ভাই-বোনের উৎসব,মিলন উৎসব না হয়ে দুই বোনের ভালোবাসা একে অপরের প্রতি দায়িত্বের অঙ্গীকারের উৎসবও হয়ে উঠুক। 




অমর কথারা

অলকানন্দা দে


মন নিঙড়ালে যেসব স্মৃতির সুঘ্রাণ মেলে তাতে কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যায় নিমেষে। তাদের সাথে ভাব-ভাব সম্পর্ক ফিরিয়ে নিয়ে যায় প্রাক্তন দিনে যাকে রেখেছি ভালোবাসার ছাউনিতে, নিশ্চিন্ত আরামের নীচে কর্তব্য-বোধে। রোদে-জলে মলিন না হয় এতটুকু বর্ণ যেন তার! আজ অনুভবের দেরাজ খুলে বের করে আনলাম পূর্ণিমাময় সেই দিনটাকে। আলো-বিচ্ছুরণ করে যাচ্ছে একইভাবে দেখছি। রসদপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে ভাদ্রের রোদ্দুর মাখিয়ে নিচ্ছি সংরক্ষণের তাগিদে আরও একবার।

 

ছেলেবেলায় সোনা-সোনা এই ছুটির দিনটাকে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই। কারণ, রাখির হাত ধরে আসতো ঝুলন। যেন দুই ভাই বোন। তাকে তো সাজিয়ে গুছিয়ে প্রস্তুত করতে হবে উৎসবের ডাঙায়। তাই সারল্য সম্বল করে বারান্দাময় কাজ চলতো দিনরাত্রি একজোটে। নিজহাতে তিল তিল করে স্থাপত্য গড়ে তোলার সে কি অমল আনন্দ! পাহাড়ের পাদদেশে থাকতাম বলে পাহাড় গড়ার আর্দ্র ইচ্ছেটাই প্রশ্রয় পেতো বারবার। তাই আতিপাতি খুঁজে শ্যাওলা জোগাড় করে আনা যা নাকি পাহাড়কে দুর্দান্ত সবুজ করে, কি জমাট উল্লাসের কাজ ছিল! গাছের ছোট ছোট ডাল এনে তাকে সাজিয়ে সার সার পাহাড়ী পাইন তৈরী করা আনন্দ-ঘাম ঝরানো একটি গর্বের সৃষ্টি। এ পাহাড় ও পাহাড় সংযোগকারী ব্রীজ কিন্তু ভীষণ জরুরী। বস্তুত সেটি দেখাতো যেন কাঠের তৈরী। নির্মাণ হোত পিসবোর্ড সহযোগে। তলা দিয়ে বয়ে যেত সরু নদী-ধারা, বুকে থাকতো ছোট ছোট নুড়ি-পাথরের নক্সা। বেশ একটু উচ্চতায় পাত্র বসিয়ে তাতে জল ভরাট করে এবং আশেপাশে সবুজের ছোঁয়া দিয়ে লেক তৈরী করা হোত। আর থাকতো পাহাড়ের গা বেয়ে লতিয়ে ওঠা সরু পথ। যাত্রীদের অভ্যর্থনা ত্বরে ছোট ছোট ল্যাম্পপোষ্টগুলি প্রতিশ্রুতি দিতো সাধ্যমতো আলো ছড়ানোর। কাগজ কেটে তৈরী হোত আলোস্তম্ভ। সরু তারের সাহায্যে এ পোষ্ট ও পোষ্টে সংযোগ ঘটানো হোত। এই পথে কিন্তু ব্যবধানে গাড়িও চলতো। ছোট ছোট ঘর বানিয়ে মৃদু দূরত্বে বসিয়ে তৈরী হোত পাহাড়ী গ্রাম। যার উঠোন ঘর-দোরে দু একটি পুতুল মানুষ ঘরকন্না সেরে নিচ্ছে। একটি দুটি ফুলেল গাছ পাহাড়ের ঢালে সমৃদ্ধ করছে তার রূপ। ঘাসের তৈরী ফসলী জমিতে কাজ করতো মশগুল কৃষকেরা! এই ভালোবাসার  রেপ্লিকাটি ভারী অহংকারে দাঁড়িয়ে থাকতো কিন্তু! স্বস্তির শ্বাস ফেলতাম তখন, যখন বড়রা দেখে বলতেন, ”ভীষণ সুন্দর বানিয়েছিস্ রে তোরা!”

 

পাঁচদিন ব্যাপী ঝুলন সাজানোর শেষের দিনটি ছিলো সেই সু-তিথি রাখির। উৎসব বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ক্লান্তি নেই। হাতময় রাখি নিয়ে নিটোল সুখের মুহুর্ত! কটা বড় রাখি কটা ছোট, গোনাগুন্তির পর্ব মিটতো না যেন! ইস্কুলে শেখানো হোত রবি ঠাকুরের রাখিবন্ধনের মর্মকথা! বুঝতে চাইতাম মশগুল হয়ে। এই শেষের দিনটিতে মা কাকিমারা খাবারের আয়োজন করতেন। চোঁ চোঁ খিদে নিয়ে সারি বেঁধে খেতে বসার আনন্দের যে অনুভূতি তা মনের মাটিতে আজও রাজত্ব করে! রাশ-টানিনা তার! চলুক না তল্লাট জুড়ে দহরম-মহরম! ফেলে আসা টুকরো টুকরো কথার দল আজকের বয়সের কিনারে দাঁড়িয়েও উইশ করে রমরমে জ্যোৎস্না রাতের! আলো-চলকানো রূপসী তিথিটা আজও যে বড় পুণ্যের সাড়া ফেলে মর্মজুড়ে!



রাখী বন্ধন
চম্পা বিশ্বাস 
     
         বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হওয়ার সুবাদে প্রতি বছর এক সুন্দর রাখী বন্ধন উৎসবের সাক্ষী থাকি। আমাদের বিদ্যালয় মাধ্যমিক পর্যন্ত। বিদ্যালয়ের পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রী ও বেশ কিছু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী রাখী পূর্ণিমার দিন রাখীবন্ধন উৎসবে মেতে ওঠে। একে অপরের হাতে রাখী পরিয়ে আনন্দ উৎসব পালন করে। বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীবৃন্দের হাতে রাখী পরিয়ে প্রণাম করে সকল ছাত্রছাত্রী এক আনন্দঘন মুহূর্ত তৈরী করে। 

           রাখী পূর্ণিমার দিন সকাল থেকেই বিদ্যালয়ে যাওয়ার এক অদ্ভুত টান অনুভব করি। বিদ্যালয়ে প্রবেশের সাথে সাথে শুরু হয় ওদের রাখী পরানো। দেখতে দেখতে সকলের মতো আমার ও দুই হাত রাখীতে ভরে যায়। সে এক অদ্ভুত ভালোলাগা। এরপর বিদ্যালয়ের কমন রুমে প্রবেশ করলে বাকি ছাত্রছাত্রীরা এসে লাইন করে রাখী পরিয়ে যায়। রাখী ভর্তি সেই হাতের দিকে তাকিয়ে আমার মন সত্যিই আনন্দে নেচে ওঠে। কবির ভাষায়--- "হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচেরে। "
আর এই আনন্দ উপভোগ করবার জন্যই প্রতি বছর এই বিশেষ দিনটির জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকি। ছাত্রছাত্রীদের রাখী বন্ধন সমাপ্ত হওয়ার পর শুরু হয় আমাদের উদ্যোগে সকল ছাত্রছাত্রীদের মিষ্টিমুখের পালা। 
   
     বিদ্যালয়ের অনতিদূরে অবস্থিত শ্রী শ্রী ঠাকুর নিগমানন্দের আশ্রম। রাখী পূর্ণিমার দিন আশ্রমে বিরাট বড়ো উৎসবের আয়োজন করা হয়। আমাদের বিদ্যালয়ের উৎসব শেষের পর সকল ছাত্রছাত্রী আশ্রমের  উৎসবে যোগ দিয়ে প্রসাদ গ্রহণ করে। 
 
        রাখী পূর্ণিমার প্রাক্কালে আজ মন ভারাক্রান্ত। গত বছরের ন্যায় এ বছর ও বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন বন্ধ , স্তব্ধ হয়েছে বিদ্যালয় জীবন। বিদ্যালয়ে রাখীবন্ধন আজ অতীত। আগত রাখী পূর্ণিমা তাই আজ মনে বেদনার সঞ্চার করে। 


ছবি  

তানভী দাম




Saturday, August 14, 2021


 

মু না ই 

বিশেষ সংখ্যা  

১৫ আগস্ট ২০২১


মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)


প্রচ্ছদ- অভ্রদীপ ঘোষ 

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 


স্বাধীনতার অন্য গল্প 


লোকাল ট্রেন

রীনা সাহা


কবি কাম হকার অবিনাশ লোকাল ট্রেন বন্ধের দুঃখে দূরপাল্লার এক ট্রেনে চেপে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই । ঘুম ভাঙতেই দেখে যন্তরমন্তরের সামনে দাঁড়িয়ে । ওকে দেখে এলিয়েন ভাবা দিল্লি পুলিশের জেরায় দুহাত তুলে সটান আকাশে ,

---এই নিন সারেন্ডার । জেলে নিয়ে যান । খাওয়া-পড়া ছাড়া কিচ্ছুটি দিতে হবে না । আর হ্যাঁ আমার এই লিটল ম্যাগাজিনের ঝোলাটা সঙ্গে রাখতে দেবেন । এতে আমি ছাড়াও অনেক উঠতি কবির কবিতা আছে । জেলের  সবাইকে পড়ে শোনাবো । 
জাতীয় ভাষার পুলিশ কি আর বাংলা বোঝে  ! কবির ঘাড়ে দে দনাদন । পিকে সিনেমার আমির খানের মতো আলু আলু চোখে দু'চারখানা রদ্দা হজম করে বেমালুম ছাড়া পেয়ে যায় অবিনাশ । ছাড়া পেয়েই ভাবে "হুকুম মেরি আকা" না বলতেই যখন দিল্লি এসে গ্যাছে তখন লালকিলার ওই তিরঙা না দেখে কিছুতেই ঘরে ফিরবে না । পঁচাত্তরের বুড়ি কাপড়টা কড়কড়ে না ন্যাতিয়ে ত্যানা , অশোক চাকার নাট-বোল্ট গুলো শক্ত না লটরপটর , দেখতে হবে না ! হাজার হলেও পেঁদিয়ে , খেদিয়ে পাওয়া "আ মরি" হিন্দুস্তান ! আচ্ছা দিনের দূষণ ফ্রী সাচ্চা বাতাস আর সিংহবাহিনী টাইট থাকলে অশোকের চাকা ঘোরা CEAT টায়ারের ফোর্টিন জেনারেশনেরও ক্ষ্যামতা নাই আটকায় । এসব খেলা খেলা কথা ভাবতে ভাবতে রেডরোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সিধা কেল্লার মাথায় । সেখান থেকে দন্ডের মুন্ডে উঠতে গিয়ে বারে বারে পিছলে , রামভকত্ হনু নাচ নেচে ,  পতাকা ছোঁওয়া মাথায় তুলে হাঁটা পথে এক্কেরে কুতুব মিনারের পায়ের নীচে । খানিক জিরিয়ে অবিনাশের ইচ্ছে হ'ল যে করেই হোক আইফেল টাওয়ারে চড়ার অপূর্ণ সাধ আজই মিটিয়ে নেবে । স্পাইডারম্যানের চেয়েও কতটা স্বাধীন এবং পারঙ্গম একবার পরখ করে দেখবে না ! ভাবাও শেষ আর অমনি অলিম্পিকের হাইজাম্প ইভেন্টের যোগ্যতা অর্জন পর্বের সুখস্বপ্নে বিভোর অবিনাশ জম্পেশ একখানা জাম্প মেরে কুতুবের মগডালে । আহ্ কি ভীষণ কুতুবুদ্দিন আইবক আইবক লাগছে ! এখানে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে স্বাধীন দেশের মডেল প্রজেক্ট সেন্ট্রাল ভিস্তার বিল্ডিং বানানো দেখবে । কারিগররা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে কি না , হাজার পনেরো মাস মাইনের ইঞ্জিনিয়াররা নকশায় ভুল করছে কি না  , কন্ট্রাক্টারের প্রোমোটাররা এক্সপায়ার্ড মাল-মেটেরিয়াল ঠুসে দিচ্ছে কি না , খুল্ যা সিমসিমের খাজানা লুঠ হচ্ছে কি না ----- সব হিসেব নিকেশ নিয়ে তবেই নামবে ।  হাজার হলেও ওই প্রাসাদ তো তারও । ভিস্তার ভেতরে না হোক , কোনো একদিন দিল্লির হোটেলে ঘর না পেয়ে পদ্মলোচন অট্টালিকার মার্বেল মোড়া সিঁড়ির কোণায় নেড়ি কুত্তার সঙ্গে বেড শেয়ার করে বিনে পয়সায় দিল্লি কা এক রাত কাটাতে তো পারবে !  কুত্তা - শেয়াল - পিঁপড়ে জাতীয় মনুষ্যেতর প্রাণীকূলের সৌভাগ্যের কথা ভেবে জ্বলে খাক হয় অবিনাশ । মনের কষ্টে সুর ভাঁজে ---- " মেরে দেশ কি ধরতী সোনা উগলে , উগলে হিরে মোতি .... "   

গান থামিয়ে বিড়বিড় করে ,
       আচ্ছা ওই প্লেট প্লেট সাজানো ধরতী ভেদ করে হিরে - মোতি তো আর এমনি এমনি উগলায় না ! যারা উগলায় , সেই লোকগুলো কি করছে এখন ? খবরের কাগজে পড়েছে ওরা সব লাঙ্গল গুঁতানি ছেড়ে আশেপাশেই কোথায় যেন ঘাপটি মেরে বসে আছে । কাল একবার স্কাইওয়াক করে ওদের সঙ্গেও দেখা করে আসবে ।

         ছোট্ট মগজে এত সব ভেবে হাই উঠছে অবিনাশের । সারাদিন ছোটাছুটি করে ঘুম পাচ্ছে । মিনারের মাথায় ঝোলা পেতে শুতে গিয়ে নীচে তাকাতেই  দেখে পিলপিল লোক হাত-পা নেড়ে  নামতে বলছে ওকে । ছোট , বড় , মাঝারি কিশোরী সিং -য়ের মতো পুলিশ , গন্ধ শোঁকা কুকুর , জলকামান , কান্নাগ্যাস এতসব নিয়ে হঠাৎ কখন হাজির হয়েছে ওরা টের পায়নি তো ! আরে ! ওদের ভিড়ে ওই তো আমাদের ঢাল-তরোয়াল ভারভারাকেও দেখা যাচ্ছে । চোখ কচলে ফের তাকায় । কই হাতে-পায়ে শিকল দেখছে না তো ! শহীদ মিনার থেকে পড়ে তার মতো ছাগলের তিন নম্বর বিপ্লবী বাচ্চা শহীদ হ'লে স্বাধীনতার আমেজে চোনা পড়বে বলেই কি ওনাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে ওকে নীচে নামাতে পাঠিয়েছে ? কোনমতেই  নামবে না সে । মিনারের নীচ থেকে ওপর অবধি তুমুল ভাইব্রেশন শুরু হলেও নামবে না । জীবনে প্রথমবার মওকা পেয়েছে তার আইডল কবিকে কবিতা শোনানোর । নিজেকে বেশ শোলে সিনেমার বীরু বীরু লাগছে । হেলেদুলে ডায়লগবাজি করে কবিতা পড়বে । পটাপট ঝোলা থেকে বেরিয়ে বিক্রি হয়ে যাবে কবিতার বেড়ালছানারা । ভাবতেই ভারতরত্ন ভারতরত্ন অনুভব হচ্ছে। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার পাওয়ার ছবিস্বপ্নে ,  ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ক্লিক ক্লিক অবিনাশ চিৎকার করে নিজের লেখা কবিতা পড়তে শুরু করে ,

           বার্লিন প্রাচীরের মতো
           ভাঙবার কিছু নেই ব'লে
             ভাঙতে শিখিনি আমরা।

             আমাদের চোখের রঙ সাদা ব'লে
               মানুষের অধিকারের প্রতিটি মৃত্যু দিনে
                সাদা ফুলে রঙিন হই আমরা।

             ভারভারারা না চাইলেও
          ডান হাতের বুড়ো আঙুল এবং তর্জনীর বিনিময়ে
                  হাতের শেকল , পায়ের বেড়ি
                    খুলিয়ে নিই আমরা ।

     দু'লাইন কবিতা পড়া বাকী থাকতেই ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী কাটা ঝোলা বাহক অবিনাশ পতাকার কার্টুনের সঙ্গে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আনলোড হয় ।  সাদা দাড়ি-চুল বেতালের মতো পতাকার পালে চেপে "আজ ম্যায় উপর , আসমা নীচে..." গানের ভেলায় দিল্লি-হিল্লি দুলতে থাকা অজর অবিনাশ নীচে তাকিয়ে দেখে ---- লোকাল ট্রেন তখনও বন্ধ ।  
                                        


ভাবনায় স্বাধীনতা 

সহিষ্ণুতার পতাকার সামনে দাঁড়ানোর সময় এসেছে

গৌতম চক্রবর্তী

দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পা দিলাম আমরা। সাত দশক পার করেও সবই কী রকম ভোরের কুয়াশার মতোই আবছা আর অনিশ্চিত হয়ে রয়ে গেল আমাদের দেশে। দেশের উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদেশ নীতি, স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবসের হরেকরকম লোভনীয় ছাড়ের জাঁকজমকের আড়ালে সেই একই জং ধরা গড়িয়ে গড়িয়ে চলা নিরাপত্তাহীনতা। অপুষ্ট, অশিক্ষিত, নির্যাতনের শিকার দরিদ্র দেশবাসীর সেই অন্তহীন লড়াই। কর্মসংস্থানের বিবিধ সরণি উন্মুক্ত হলেও স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়েই পড়ে থাকলেন দেশের অজস্র মানুষ কর্মহীন, খাদ্যবস্ত্রহীন, নিরাপত্তাহীন অবস্থাতে। নারী নিরাপত্তা, দুর্নীতি রোধ ইত্যাদি প্রশ্নে লড়াই ফুরোল না সাধারণ মানুষের। শুধু শাসকের রং বদলায়, নীতি বদলায়, কিন্তু দিন বদলায় না। জাতীয় দিবস পালনের গুরুত্ব জানতে পারিনি দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষকে প্রশ্ন করে। তাদের বরং আতঙ্কিত প্রশ্ন ‘কতবার ভিটে হারাব আর? আবার কি দেশ ভাগ হয়ে যেতে পারে? কোথায় যাব?’ ভারত মানে যদি অখণ্ড এক চেতনায় বাঁধা কোটি কোটি নাগরিকের একাত্মতাই হয়, তবে খুব জরুরি জাতীয় দিবসের ঠিকঠাক পর্যালোচনা, খুব জরুরি এর গুরুত্ব সাধারণ মানুষকে বোঝানো। যে সহিষ্ণুতার কথা সংবিধান ঘোষণা করেছে তা থেকে যেন কোনও মূল্যেই আমরা বিচ্যুত না হই। ঠিক কতটুকু সহিষ্ণুতা আর কতটুকু স্বাধীনতার সীমা টপকে গেলে আচরণ উগ্রতায় রূপান্তরিত হতে পারে এই সূক্ষ্ম ভেদাভেদটুকু জানাও খুবই জরুরি। না হলে সংবিধানের ভুল ব্যাখ্যার অবকাশ থেকে যায় যে কোনও ভুল পাঠের মতোই।

 ওরা স্কুলে আসত প্রতি বছর। সরকারি প্রকল্পের স্কুলপোশাকে ১৫ ই আগস্টের বৃষ্টিবিঘ্নিত আবহাওয়ায় অথবা ঝলমলে দিনে হাল্কা শীত রোদের উষ্ণতায় মণীষীদের সম্মানজ্ঞাপক কোন অনুষ্ঠানে অথবা প্রজাতন্ত্র দিবসে হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে কুয়াশা জড়িয়ে। ছোটরা হাতের মুঠোয় ভরে আনত টগর, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, ডালিয়া আরও কত-কত নানা মরসুমি ফুল আর পাতা। গেরুয়া-সাদা-সবুজ রঞ্জিত ত্রিবর্ণ পতাকার সামনে উত্তেজনা-মাখা এক ঝাঁক নবীন এসে ভিড় করত দুটো বছর আগেও। ড্রিল, মার্চ পাস্ট, দেশাত্মবোধক গান, নাচ আবৃত্তি, একদিবসীয় ফুটবল- সারাদিনব্যাপী কত অনুষ্ঠান। সেদিন ওদের মিড-ডে মিল থাকত না। গোটা বা আধখানা ডিমের জন্য আসেনি সেদিন ওরা। স্কুলে যে লাড্ডু, লজেন্স বা বিস্কুট দেওয়া হবে তার জন্যও না। ওরা শুধু জানত সেদিন একটা বিশেষ দিন। ছুটি, কিন্তু ছুটি নয়। স্কুলে দিনটা পালন করা হয়। এখনও জানে। কিন্তু আসার অনুমতি নেই। অভিভাবকেরা এবং সেই সঙ্গে সমাজপতিদেরও বিধান বাইরে বেরোনো যাবে না। ভয়ঙ্কর করোনা আবহ সবকিছুকেই ওলোট পালট করে দিয়েছে।

 ওরা জানে স্বাধীনতা দিবস মানে জাতীয় পতাকাকে অভিবাদনের দিন। আবেগতাড়িত বাচ্চাগুলোর ধর্ম-বর্ণ-জাতি-শ্রেণি যেমন এই স্কুল পোশাকের কাছে তুচ্ছ ও অপ্রয়োজনীয়, ঠিক তেমনই ‘ভারতবাসী’ পরিচয়ের কাছেও তুচ্ছ মনে হয় যাবতীয় অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। এই আবেগটার নামই স্বাধীনতা, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র। এখানে প্রজার বিপরীতে কোনও ‘রাজা’ নেই। আছে শুধু এক জাতীয় চেতনা। ওরা ইতিহাস বইয়ে পড়েছে অনেক লড়াইয়ের পর স্বাধীনতা এসেছিল এই দেশে। ওরা দেখেছে, ইতিহাস পড়াতে গিয়ে স্কুলে শিক্ষকেরা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন আজও। তাঁরা বলেন ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক সার্বভৌম এক ধারণার কথা। শুধু স্বাধীন হলেই তো সবটুকু পাওয়া হয় না, স্বাধীনতা উপভোগ আর উদযাপনের আবশ্যিক শর্ত হল নিজের মৌলিক অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ে একই সঙ্গে সচেতন এবং উদ্যোগী হওয়া। পতাকাকে অভিবাদন করা আর জাতীয় সঙ্গীতের উচ্চারণ আমাদের যে মানসিক তৃপ্তি দেয়, জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের মর্যাদার প্রতি উন্মুখ করে, ছাত্রছাত্রীদের সেই স্পর্শটুকুই দিতে চাই আমরা।

 যখন প্রশ্ন তোলে কোনও কৌতূহলী মুখ স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র কথাগুলোর মানে আসলে ঠিক কী? তখন বোঝাতে হয় এ আসলে  সাধারণের জন্য সাধারণের তৈরি শাসনব্যবস্থা। ‘আমরা সবাই রাজা/আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। সংবিধান নাগরিকদের সেই অধিকার দিয়েছে। তাঁরা দাবি করতে পারেন রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। প্রতিটি নাগরিকের সংশয়ের সবকিছু নিরসন করা আদর্শ হলেও হয়তো সব সময় তা সম্ভব নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের মূল ভাবনা তো এটাই যে সংখ্যাগুরুর সুর-স্বরের আড়ালে যেন সংখ্যালঘুর সুর-স্বর ঢেকে না যায়। তা না হলে যে জাতীয় সঙ্গীতের প্রাথমিক শর্তটিই বিঘ্নিত হয়। এ শর্ত বজায় রাখার ঐতিহ্য ভারতের চিরকালীন আর তাকে মান্যতা দিতেই স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র দিবসের উদযাপন। সম্প্রদায় নির্বিশেষে আমাদেরই পূর্বপ্রজন্ম স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিয়ে চূড়ান্ত নির্যাতন সহ্য করে প্রাণের মূল্যে এই স্বাধীনতা এনেছে। তাই এই স্বাধীনতা, এই সাধারণতন্ত্র আমাদের প্রত্যেকের। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মূল সুর ছুঁয়ে থাকুক আমাদের। আরও বেঁধে বেঁধে থাকা, আরও নম্রতা, আরও সহমর্মিতা আশা করে, দাবি করে জাতীয় পতাকা। সহিষ্ণুতার অভিজ্ঞান সেই পতাকার সামনেই দাঁড়িয়ে আমরা, আমাদের বাচ্চাগুলো।

ভারতের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার অঙ্গীকারের কথা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উল্লেখ করে থাকলেও সুযোগ পেলেই যারা অন্য দেশে চলে গিয়ে উপার্জন করা বা জীবন কাটানোর কথা ভাবেন না, তাদের বোঝান দরকার যে সংবিধানের প্রতিটি শব্দ তাঁদের জীবনমন্ত্র হতে পারে। দেশকে দশের করে তোলার ব্রত ওই কাঁচা মুখগুলোই একদিন নিতে পারে, নেবেও। যারা অন্যদিকে বসে সামান্য হলেও অর্জন করেছি অথবা সুযোগ পেয়েছি স্বাধীনতার দিবসের অর্থ উপলদ্ধির তারা যেন শুধু নেতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখি এই দিনটিকে বা শুধু ক্যালেন্ডারের একটি পালনীয় ছুটি বলে রঙ্গে না মেতে উঠি। এর প্রবাহ বজায় থাকুক সারা বছরের সচেতনতায়। দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, সম্প্রীতি যদি নতুন করে প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয় তা হলে যেন তা নিয়ে রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা ও সংশয় প্রকাশের অবকাশ থাকে। রাষ্ট্রেরও বাধ্যবাধকতা আছে প্রতিটি নাগরিকের প্রতি। গণতন্ত্রে শাসক কখনওই রাজা নন, আর তাই প্রশ্নাতীতও নন। প্রজাদের ক্ষমতাতেই শাসকের ক্ষমতা নির্মিত হয়। নাগরিকেরও তেমন অধিকারের সীমা বুঝে নেওয়ার মতোই আছে কর্তব্য এবং দায়িত্ব। ক্ষমতা আর দায়িত্ব হাত ধরাধরি করে চলে বলেই অধিকারের সীমা জেনে নেওয়া জরুরি। নিরঙ্কুশ, নিঃসংশয় প্রশ্ন করার স্বাধীনতা চেয়েই তো একদিন পথে নেমেছিলেন পরাধীন ভারতের মানুষ। সংবিধান সেই পবিত্রতম গ্রন্থ, যা আমাদের নিজস্ব মত প্রকাশের আর অন্যের মতের প্রতি সহিষ্ণুতার কথা একই সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছে।

তাই পঁচাত্তরের স্বাধীনতার শপথ হোক আবার শুরু হোক উপযুক্ত নিরাপত্তা নিয়ে পঠন পাঠন সহ দৈনন্দিন কাজকর্ম। সকাল সাতটা থেকে ন'টা পড়া মুখস্থ করুক বাচ্চাটা অথবা যন্ত্রের মতো তৈরি হয়ে স্কুল বাস ধরুক শিশুটা। ইস্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে আসার পথে আবার ঠোঁট দিয়ে আইসক্রিমের কমলা রং গড়িয়ে পড়ুক নীল-সাদা স্কুল ইউনিফর্মে। লেফট রাইট লেফট শোনা যাক স্কুলের প্যারাড গ্রাউন্ডে। শিশুরা আবার পাক ‘বসে আঁকো’ য় পেনসিল বক্স পুরস্কার। আবার গলিতে আসুক অচেনা মানুষ, ডেকে উঠুক পাড়ার কুকুরটা। ছোট ভাই চেনা দাদার থেকে কিনে নিক পাঁচ টাকায় দশটা ঝাল লজেন্স। আবার এয়ারপোর্টে ছেলেকে ওয়েলকাম করতে অথবা ছলোছলো চোখে বিদায় জানাতে যান বাবা মা। রাস্তার কুকুরকে আদর করে হাত ধুতে ভুলে যাক মেয়েটা। কিশোরী আবার হাতের চেটোয় পরীক্ষা করে নিক লিপস্টিকের শেড। ছাদে দাঁড়িয়ে দূর থেকে আবার শুনে নিই ট্রেনের শব্দ। আবার ফুচকার ঝাল কম-বেশি নিয়ে ঝগড়া হোক দুই বন্ধুর। আবার মিছিলে পা মেলাক ছাত্রদের নিয়ে কলেজ ইউনিয়নের লিডার। আবার রিহার্সাল হোক স্টেজ কাঁপিয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে। আবার জন্মদিনে নিভুক মোমবাতি। আবার অষ্টমী পুজোয় ধুতি পাঞ্জাবী পড়া ছেলেটার সঙ্গে চারচোখের মিলন হোক গরদের শাড়ি পড়া মেয়েটার। সন্ধে হলে ক্লাবঘরে জমিয়ে মাখা হোক মুড়ি চানাচুর আর চলুক তাস, দাবা, ক্যারাম। চলো আবার আমরা জড়িয়ে ধরি পরস্পরকে। আবার মাথা রাখি কাঁধে। আবার মেলাই হাতে হাত। দুঃস্বপ্নের কালবৈশাখী মেঘ সরে যাবে। পৃথিবীর বুক থেকে উঠবে আরামের দীর্ঘ নিশ্বাস।

 

 স্বাধীনতার সাতকাহন 

পার্থ সারথি চক্রবর্তী 


প্রায় দু'শো বছরের পরাধীনতার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হলেও তার চিহ্ন সর্বত্র বিরাজমান ছিল। আর আঘাতের চিহ্ন এতটাই প্রকট ছিল যে, তার জন্য দরকার ছিল দীর্ঘমেয়াদি সুচিকিৎসা এবং মোক্ষম দাওয়াই। দেশভাগ ও জাতিদাঙ্গার আঘাত তো ছিলই; সেইসঙ্গে জুড়ে যেতে থাকে রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ও নিজের ফায়দালাভের ঘৃণ্য চক্রান্ত। তাই তো আজো ৭৫ বছর পরেও আমাদের দেশে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বলি হয় প্রচুর মানুষ। শাসকের রঙ বদলায়, জামার রঙ বদলায়; কিন্তু সাধারণ মানুষের দিন বদলায় না। আজো কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন। মাথা পিছু গড় আয় তলানিতে। ন্যুনতম জীবনধারণের সামগ্রী ধরাছোঁয়ার বাইরে। সবচাইতে অবহেলিত দুটি দিক- শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। একের পর এক শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব এসেছে, সেগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো স্কুলছুট বা ড্রপআউট বন্ধ করা যায়নি। মধ্যাহ্নকালীন ভোজনের মতো কিছু ব্যবস্থা নিয়েও পরিস্থিতি পুরোপুরি আয়ত্তে আনা যায় নি। অধিকাংশ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কোন সুফল আজো পৌছাতে পারে নি। সম্প্রতি প্রকাশিত রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্টে অনুযায়ী স্বাস্থ্য সূচকে দেশের অবস্থান ক্রমশঃ নিম্নমুখী। স্বাস্থ্য কাঠামোর অপ্রতুলতা ও স্বাস্থ্যবীমার আওতার বাইরে থাকা  বিপুল দেশবাসীর সব সঞ্চয় চিকিৎসাখাতে নিমেষে নিঃশেষ হয়ে যায়। সামান্যতম চিকিৎসার অভাবে প্রচুর মানুষ প্রাণ হারান। আর্থিক সহায়তা প্রকল্পের কোন সুফল নিচুতলার মানুষের কাছে পৌছনো সম্ভব হয় না। শিল্প পরিকাঠামো, রাস্তাঘাট ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হলেও আজো বহুপথ যাওয়া বাকী। এত বিপুল মানবসম্পদ অবহেলিত, অব্যবহৃত। স্বাধীনতার সুফল কেবল কিছু মানুষের কুক্ষিগত হয়ে রয়ে গেল। গত দেড় বছরের অতিমারির মধ্যেও দেখা যাচ্ছে, যে ১৫% মানুষের কাছে দেশের ৮৫% সম্পদ রয়েছে; তাদের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ পথেঘাটে, স্টেশনে অনাহারে,  অর্ধাহারে প্রচুর মানুষ প্রাণ হারান। দরকার এক অর্থনৈতিক স্বাধীনতার। সংবিধান মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিলেও প্রায়শই তার বিপ্রতীপ ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায়। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা মাঝেমধ্যে সমাজকে আড়াআড়ি ভাগ করে দিতে উদ্যত হয়। অথচ " ধর্ম যার যার " হওয়ারই কথা!

স্বাধীনতা শুধু বিদেশী শত্রুর হাত থেকে নয়, দরকার সব ধরণের সংকীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা, স্বার্থের রাজনীতির হাত থেকে। সব স্তরের মানুষের হাতে জীবনধারণের ন্যুনতম সংস্থান যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের পৌছানো সুনিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার দলমতনির্বিশেষে। নাহলে প্রকৃত স্বাধীনতা অধরাই থেকে যাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারত গোটা বিশ্বে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছে। কিন্তু ইলেক্ট্রনিক চিপ, সেমিকন্ডাক্টর, কম্পিউটার সামগ্রী ইত্যাদির জন্য  এখনো আমদানির উপরেই নির্ভর করে থাকতে হয়। বাজেটের খুব সামান্য অংশই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে ব্যবহার করা হয়। ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন করা আশু প্রয়োজন। আইনকক্ষগুলোকে আরো বেশি দায়িত্ববোধের পরিচয় রাখতে হবে। রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতা যেন সবস্তরের মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনে, সেটা সুনিশ্চিত করতে হবে।
আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও সাবালক হয়ে উঠতে পারিনি। সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আজ দরকার  এক নতুন সংগ্রাম। সম্পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে।



স্বপ্নের স্বাধীনতা

শ্রাবনী সেনগুপ্ত


আজ ১৫ই অগাস্ট ২০২১,ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৪তম বর্ষ পূর্তি, ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস। অতিমারীর নানা আশঙ্কা এবং বিধি-নিষেধের মধ্যেই দেশবাসী এই বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছেন।  বহু শহীদের  আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে, শোণিতবাহিত পথে স্বাধীনতা এসেছে। আমরা ভারতবাসী স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচিত করছি। ভারতবাসীর অনেক প্রত্যাশা আর স্বপ্নকে সাথী করে আজ থেকে ৭৪ বছর আগে স্বাধীনতা এসেছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও বরাবরই ভারতবাসী স্বাধীনতার ধারণাটিকে মালায়, পতাকায়, সংগীতে এমন ভাবে আবৃত করে রাখে যে পুষ্পশোভিত মানচিত্রের মধ্যে কোথাও যে দেশের মানুষ থেকে গিয়েছে , তা প্রায়শই দৃষ্টিগোচর  হয় না। স্বাধীনতা সার্থক হয়ে ওঠে দেশবাসীর জীবন-জীবিকা-ভাষা-সংস্কৃতি ও মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই। মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র, মৌলনা আবুল কালাম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন প্রমুখ মনীষী এবং দেশনায়কদের কণ্ঠে বারবার ধ্বনিত হয়েছে দেশের  মানুষের জয়গান; বিভিন্ন মত ও পথের স্বীকৃতি। তাই আজ তাঁদের স্বপ্নের স্বাধীনতা উদযাপিত হোক অতি বিচিত্র অতি সমৃদ্ধ ভারতীয় গণদেবতার আরাধনায়।

নিঃসন্দেহে গত ৭৪ বছরে আমার দেশ অগ্রসরমান। আমরা সাফল্য পেয়েছি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে, কিছুটা এগিয়েছি প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিক শিক্ষার বিকাশে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায় আমরা এগিয়েছি,ভারত পৌছে গিয়েছে  পরমাণু শক্তিধরদের এলিট ক্লাবে। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শিখর ছুঁয়েও কাটেনি নিরক্ষরতার অভিশাপ।উচ্চশিক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমরা গর্ব করলেও তার প্রায় কোনওটিই আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তুলনা করার যোগ্য নয়।ক্রীড়া ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের দরবারে পরিচিত হয়েছি ঠিকই ,কিন্তু সাফল্য সর্বব্যাপী ক্রীড়া পরিসরে  নয়। আবার শিল্প-সংস্কৃতির চর্চায় ভারতীয় ধারার পাশাপাশি, আমরা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছি। আমাদের সাহিত্যচর্চা আজ বিশ্বের দরবারে সমাদৃত।  স্বাধীনতার পর উন্নতি-প্রগতির পথে অনেকদূর এগিয়েছে দেশ। বেড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান। কিন্তু, সমৃদ্ধির পথে সবাইকে সামিল করতে পারিনি আমরা।  স্বাধীনতার পর খাদ্যশস্য উতপাদনে অর্জিত হয়েছে স্বনির্ভরতা। সবুজ বিপ্লবের কল্যাণে রুক্ষ-কঠোর মাটিতে ফলেছে সোনার ফসল। দুধ উৎপাদনেও  এখন আমরা স্বনির্ভর। অপারেশন ফ্লাডের দৌলতে বিশ্বের বৃহত্তম দুধ উতপাদনকারী দেশটির নাম ভারত। কিন্তু, এরপরেও তো পেটে খিদে নিয়ে রোজ ঘুমোতে যান এ দেশের লাখো মানুষ। বিদেশিদের ক্যামেরাবন্দি হয়ে লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট করে দেয় কালাহাণ্ডি-বুন্দেলখণ্ডের বুভুক্ষা। অপুষ্টিতে মৃত্যু হয় অমৃতের পুত্রকন্যার।

জিডিপির নিরিখে বিশ্বে দশম স্থান। ১৩০ কোটি জনসংখ্যা। ক্রয়ক্ষমতার বিচারে বিশ্বে চতুর্থ। বৈদেশিক বাণিজ্যের হিসাবে প্রথম কুড়িটি দেশের মধ্যে জায়গা বাঁধা। মিশ্র অর্থনীতির বুনিয়াদে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ। আর্থিক মন্দায় আমরা ভেঙে পড়ি না। বিশ্বের কোনও শক্তির ক্ষমতা নেই আমাদের অবহেলা করে। কিন্তু, এই সত্য যে শেষ সত্য নয়। প্রদীপের নিচে লুকিয়ে আছে গাঢ় অন্ধকার। স্বাধীনতার প্রায় সাত দশক পরও যেখানে পড়েনি কোনও আলো। দারিদ্র্যসীমার নীচে দিন কাটাতে বাধ্য হন সহ-নাগরিকেরা। শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক ব্যর্থতায় অদক্ষ শ্রমিকের রূপান্তর ঘটে না দক্ষ মানবসম্পদে।

জাতীয় নমুনা সমীক্ষার হিসাব বলছে দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২ কোটির উপর।  বিশেষত করোনা কালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই সঙ্গে রয়েছে বিপুল বৈষম্য। আয়-লিঙ্গ-শ্রেণী, সবদিক দিয়েই  দ্বিখণ্ডিত জীবনযাপন।প্রান্তিক মানুষ রোজ হারাচ্ছেন জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার। উন্নয়নের জোয়ারে ভিটে-মাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছেন স্বাধীন দেশের নাগরিকেরা।

দেশ পোলিও মুক্ত হয়েছে,একথা সত্য। কিন্তু শিশুমৃত্যুর হার এখনো নিম্নগামী হয়নি।সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হচ্ছে। দেশে যত মোবাইল আছে তত শৌচালয় নেই। সরকারি ইঁদারা থেকে খাবার জল আনতে যে মহিলাকে রোজ পেরিয়ে আসতে হয় কয়েক ক্রোশ পথ, তাঁর কাছে কোন অর্থ বহন করে আনে এই স্বাধীনতা?

রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৯টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩১-এ। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে রাষ্ট্রনেতাদের মুখে ইনক্লুসিভ গ্রোথ বা সকলকে নিয়ে উন্নয়নের কথা কত বড় প্রহসন। এক দেশের মধ্যে কী ভাবে লুকিয়ে থাকে আর একটা দেশ।৭৪ বছর অতিক্রম করেও আমরা পারিনি জাতিভেদের মতো সামাজিক বৈষম্যকে রুখতে। সাম্প্রদায়িকতার ভ্রূকুটি আমাদের তাড়া করে ফেরে।  ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনা সংবিধানের মলাট পেরিয়ে ভারতীয় সমাজে সর্বগ্রাহী হয়ে উঠতে পারেনি।

তাই লক্ষ্যভেদ করার জন্য গন্তব্যের সন্ধানে আমাদের যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। স্বাধীনতার সংগ্রামীদের স্বপ্ন পূরণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কতদিন? কত দিন লাগবে আর, সোনার ভারত গড়তে ?



স্বাধীনতা ও বাপুজি 


পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

১৯৪৭   সালের  ১৫ ই আগষ্টের  স্বাধীনতা  দিবস  যদি  প্রজ্জ্বলিত  প্রদীপ   শিখা  হয়, তাহলে সেই  প্রদীপের  সলতে  পাকানোর  কাজটি  করেছিলেন  মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী । ১৯৪২  সালের  ভারত ছাড় আন্দোলনের মধ্যে  দিয়ে। ১৯৪২  এর  ৮  ই  আগষ্ট বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত  ভারতীয়৷ জাতীয়৷ কংগ্রেসের অধিবেশনের৷  পর,  তিনি   গোয়ালিয়র  ট্যাংক ময়দানে  ( আমরা  যাকে আগষ্ট ক্রান্তি ময়দান নামে জানি)  বৃটিশ  শাসকের  অত্যাচারে জর্জরিত  ভারতীয়দের  পরাধীনতার  শৃংখল মোচনের  জন্য  ভারত ছাড় আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন।  তাঁর  আহবানে  সাড়া দিয়ে দেশনায়ক সুভাষ চন্দ্র বসু, বাল  গঙ্গাধর তিলক, বিনয়, বাদল, দিনেশ  সহ  শত  শত  শহীদ এই আন্দোলনে  ঝাঁপিয়ে  পড়েন।  তারা নিজেদের প্রাণ  বলিদান  দিতেও  পিছপা  হন নি। ক্ষমতা লোভী  বৃটিশ  সরকার  বুঝতে পেরেছিল যে এই আন্দোলন  তাদের  ভারত ছাড়তে বাধ্য করবে। 

বাপুজি  উচ্চ  শিক্ষায়  শিক্ষিত  হয়ে, ব্যারিস্টার হয়েও  নিজের  বেশভূষা, পোশাক  পরিচ্ছদের আড়ম্বর  বিসর্জন  দিয়ে,  সাধারণ  মানুষের একজন  হয়ে  উঠেছিলেন।  

তাঁর  নেতৃত্বে  ডান্ডি অভিযান ও এক ঐতিহাসিক  মিছিল।  যে জনজোয়ারের রেকর্ড আজও  অবধি  কোন  দেশনেতা  বা দেশনেত্রী ভাঙতে  পারেন নি।  ডান্ডি  অভিযানের  মতই  লবন  অাইন  ভঙ্গ  এবং  করেঙ্গে  ইয়ে  মরেঙ্গে ( Do or Die)  ভারতীয়  দের  মনে  প্রাণবায়ু  জুগিয়েছিল।  তার  প্রেরণায়  মানুষ  সৎ ভাবে জীবন  যাপন  করত।  মানুষের মূল্যবোধ এতটাই   সুদৃড়  হয়েছিল  যে  বৃটিশ শাসকদের মনে  ভীতির  সঞ্চার  ঘটিয়েছিল। 

দেশবন্ধু  চিত্তরঞ্জন  দাস  এবং  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী  কে  ঈশ্বরের আসনে  বসিয়েছিলেন।  নেতাজি  সুভাষ চন্দ্র বসুর  চরমপন্থা  এবং  মহাত্মা গান্ধীর নরমপন্থা একযোগে  ভারতবর্ষের  স্বাধীনতা কে তরান্বিত করেছিল। 

১৯৪৭  সালের  ১৫ ই  আগষ্ট  যখন  দিল্লিতে লালকেল্লায়  স্বাধীনতা  দিবসের  উৎসব হচ্ছে,  গান্ধীজী  তখন  কোলকাতায়  জাতি  দাঙ্গার আগুন নেভানোর  কাজে  ব্যস্ত ছিলেন।  

তিনি  দেশ  ভাগের  বিরুদ্ধে৷ ছিলেন।  দেশ ভাগের  বিষয়ে  তিনি  বলেছিলেন,  " You can cut me into two,  but don't divide India. 

আজ  গান্ধীজীর  মৃত্যুর  ১৭৬  বছর  পরেও   তিনি   সমান  ভাবে  প্রাসঙ্গিক।  তার সেবার আদর্শ  মানুষ  কোনদিন  ভুলতে  পারবে না। আজও  আামাদের   স্বচ্ছ  ভারত অভিযানে তার চশমা  কেই  লোগো  করতে  হয়।  আজ  মহান পবিত্র  দিনে  আপনাকে  স্মরণ  করি,  প্রণাম জানাই।




মুক্ত ধারায় এসো  
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী 

আকাশের শুভ্রতার সঙ্গে দিগন্তের শ্যামলীমা ও সূর্যোদয়ের কোমল গেরুয়া আভাস মিলেমিশে জানান দিল এক নতুন ভোরের। ভারতের স্বাধীনতার ভোর, স্বপ্নপূরণের ভোর,আনন্দের ভোর। স্বাধীনতা তুমি.... তোমার জন্য,তোমাকে ভালোবেসে, তোমার সম্মাননায় কত আয়োজন। তুমি যে দেশবাসীর পরম আকাঙ্খার, যত্নের, নতুন প্রত্যয়ের, নতুন শপথ গ্রহণের দিন। জাতীয় পতাকার উত্তোলনে, কুচকাওয়াজের ছন্দবদ্ধতায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সাড়ম্বরে সেজে ওঠো তুমি।
 
      তোমার এই আসবার পথ একদিনে প্রশস্ত হয়নি। ভারত মাতার বহু বীর সন্তান তোমাকে পরিপূর্ণ করে পাওয়ার আকাঙ্খায় দেশপ্রেমের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতির নেশায় মেতে উঠেছিলেন। ক্ষুদিরাম বোস থেকে শুরু করে বিনয়- বাদল - দীনেশ,  সূর্যসেন তথা ভগৎ সিং ও পরবর্তীতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সমেত আরও বহু দেশপ্রেমিক ইংরেজদের শোষণ ও অত্যাচারের নাগপাশ থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করে পরম আন্তরিকতায় তোমাকে নিয়ে আসবার গভীর বুনোট ধাপে ধাপে তৈরি করেছেন। অবশেষে নানান ঘটনা পরম্পরায় তুমি এলে। তবে বিভাজনও এল। ভারতবর্ষ ভাগ হলো ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি দেশে। ইংরেজরা যে বিভেদের বীজ বপন করেছিল, তা শাখাপ্রশাখা বিস্তার করলো সংঘাত, ধর্ম বৈষম্য, হিংসা ও হানাহানি রূপে। দেশবাসীকে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে যে হাজার হাজার বীর সন্তানেরা জীবনের তোয়াক্কা করেননি তাঁদের মূল্যবোধ ও কর্মযজ্ঞ এই অসহায়তার, বিপন্নতার, অবসাদের টালমাটাল সময়ে শুধুমাত্র স্মৃতি হয়েই রয়ে গেল। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিঃস্বার্থ দেশসেবার ব্রত এখন শুধুই স্বপ্ন। 

রাজনৈতিক দলগুলির পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব,রেষারেষি, বিদ্বেষ ও ঘৃণ্য চক্রান্তে গোটা জনজীবন আজ স্তব্ধ। তোমাকে জয় করার এত বছর পরেও মানুষ তাঁর স্বাভাবিক গনতান্ত্রিক অধিকারগুলি প্রয়োগ ও উপভোগ করতে অনেকাংশেই দ্বিধাগ্রস্ত ও বিফল হয়ে পড়ছে। ধর্মে, ভাষায়, জাতিতে,  পরিধানে, মতাদর্শের বৈচিত্র্যে কত সুন্দর দেশ আমাদের। এখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের আদর্শ, ভাবনা,  ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলিকে যদি শ্রদ্ধার চোখে দেখে ও সম্পূর্ণ স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ ভাবে সেগুলো পালনের অধিকার যদি সকলের থাকে, তবেই স্বাধীনতা তোমার সার্থকতা।
 
                                  অযুতকাল থেকে মেয়েদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে পদে পদে। নারী উন্নয়নের এ যুগেও, সমস্ত স্বাধীনতা অর্জন করেও নারীরা শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে কোনো জায়গাতেই পুরোপুরি নিরাপদ নন এখনও। বয়সের কোনো ভেদাভেদ নেই সেখানে। প্রভাবশালী মানুষদের হাতে পুতুল নাচের সুতো। সেই সুতোর নানান কারসাজিতে নেচে চলেছে সমাজের একেকটি অংশের কিছু কিছু স্বার্থলোভী মানুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্যায়কারীর শাস্তি নেই সেখানে। স্বাধীনতা তুমি আরও সোচ্চার হও, আরও অবাধ, আরও স্বচ্ছন্দ। যাতে জীবনের অবরুদ্ধ গোপন লজ্জা, অপমান ও যন্ত্রণার আগল নিজেদের হাতেই সমাজের সর্বস্তরের নারীরা অকপটে খুলে দিয়ে অন্যায়কারীকে সামনে আনতে সক্ষম হয়। যে নারীর সঙ্গে অন্যায় হলো, তাঁর উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়,  প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয় যেন অন্যায়কারীর সাহস বাড়িয়ে দিয়ে তাকে ক্রমশ অদম্য না করে তোলে। প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাস ও সঠিক শিক্ষা নিয়ে প্রতি পদক্ষেপে নারীদের সাথ দিও ,স্বাধীনতা তুমি।
 
                         ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাত ধরে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করতে সমস্ত বিভেদ ভুলে, জীবনের জয়গান গেয়ে,ভালোবাসার পশরা সাজিয়ে তুমি নতুন দিনের নতুন আলোর দিশারী হয়ে পথ দেখাও। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি দিনের আবেগ না হয়ে প্রতিদিনের যাপনে, মননে মিলেমিশে আশার বাণী শোনাও তুমি। খেটে খাওয়া মানুষের হাসিমুখে, নিরন্নের ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালায়, লেখকের সোচ্চার কলমে, শিল্পীর প্রতিবাদী ক্যানভাসে,  চলচ্চিত্রকারের সাহসী উপস্থাপনায় বলিষ্ঠ হও; স্বাধীনতা তুমি। আমাদের দেশমাতৃকা তাঁর হৃত গৌরবকে ফিরে পাক তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতিকে সঙ্গে নিয়ে। তাঁর সন্তানেরা সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের হাত ধরে এগিয়ে আসুক শক্ত হাতে হাল ধরতে। 

'মার অভিষেকে এস এস ত্বরা, মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা
সবার- পরশে - পবিত্র করা তীর্থ নীরে -
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।। '



 গল্পে স্বাধীনতা 

বন্দেমাতরম...

সুদীপা দেব

নার্সিংহোম থেকে আজ বাড়ি যাব। সঙ্গে আমার বারো দিনের বাচ্চা। খুব ভালো লাগছে।  

ভোরবেলা থেকে দূরে কোথাও মাইকে বাজছে এ আর রহমানের "মা তুঝে সালাম....."। দেশাত্মবোধক গান। সিস্টারস ডেস্কের সামনে বড় দেয়াল ঘড়িতে এখন পৌঁনে আটটা। একটু পরেই পতাকা উত্তোলন হবে। আজ পনেরই আগস্ট। স্বাধীনতা দিবস। দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কি দৃঢ় প্রত্যয় দেখিয়েছিলেন সে সময়কার ভারতবাসী। এসব ভাবতে ভাবতে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আজ আমরা স্বাধীন। আমাদের দেশের নিজস্ব সংবিধান আছে। 'স্বাধীনতা' শব্দটার কি বিশাল ব্যপ্তি! 

সিস্টার এসে বাচ্চাদের ইঞ্জেকশন দিয়ে গেল। সকালবেলায় খবরের কাগজে দেখেছি গতকাল অলিম্পিক গেমসে ওয়েট লিফটিংয়ে সোনা জিতেছে দেশের মেয়ে মৌমিতা পালধি। রাষ্ট্রপতি শুভেচ্ছাবার্তা জানিয়েছেন। টিভিতে সারা পৃথিবী দেখছে। প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্স করে সম্মানবার্তা পাঠিয়েছেন। দেশের মানুষ মেয়ের ঘরে ফেরার অপেক্ষায়। চারদিকের বাতাসে এক খুশি খুশি অনুরণন।

ডিউটি সেরে যাওয়ার আগে ওয়ার্ড বয় এবং সিস্টাররা মিলে আমাদের কেবিন তিন-রঙা বেলুন দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। পাশের বেডে সাতদিনের বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে জুঁই। ফুলের নাম। কি সুন্দর নাম! দেখতে ও খুব সাধারণ তবে মুখে খুব সুন্দর একটা মিষ্টি কোমল  ভাব আছে। গত তিন চার দিন ধরে জুঁইয়ের সাথে বেশ গল্প করছি। বয়সে ছোট বলে ওকে নাম ধরেই ডাকছি। ও ওই দিক ফিরে শুয়ে আছে। বললাম
–এই তুই শুয়ে আছিস কেন? উঠে বস। দেখ কি ভালো লাগছে বাইরে! জানলার কাছে আয়।
তবু শুয়ে আছে। এবার বললাম
–আজ আমার ছুটি রে। এইযে ফোন নম্বর দিলাম। বাড়ি গিয়ে আমাকে ফোন করবি। জুঁই ফুলের কুঁড়ি কেমন থাকে জানাবি অবশ্যই।
ওর চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ছে।
–কি হয়েছে রে?
– এবারও মেয়ে হয়েছে শুনে শাশুড়ি বাড়িতে আসতে বারণ করেছে। ওদের বংশ, ব্যবসার জন্য ছেলে চাই।
–তোর বর? সে কি বলে?
–ভালো করে বুঝতে পারি না দিদি। মনে হয় আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আজ ফোন করে বলেছে প্রথম কয়েক দিন বাপের বাড়িতে থাকতে। পরে ওর বাবা মাকে বুঝিয়ে আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। বুকের ভেতরটা কাঁপছে। খুব ভয় করছে গো!

বাইরে নার্সিংহোমের মালিক পতাকা উত্তোলন করছেন। সমবেত করতালি। তারপর
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে
ভারত ভাগ্যবিধাতা.....



 কবিতায় স্বাধীনতা 

স্বাধীনতা

শ্রাবণী সেন

সেই ছোটবেলায় মা ঘুম থেকে তুলে বলতেন তাড়াতাড়ি উঠে পড় সোনা, 
আজ বড় আনন্দের দিন...
ফুল তুলতে হবে, মালা গাঁথতে হবে, 
এসো সাজিয়ে দিই প্রভাতফেরীতে
যেতে হবে যে....
লালপেড়ে সাদা শাড়িতে সেজে ফুলেরমালা চুলে দিয়ে প্রভাতফেরীতে যেতাম.... 
ভারতমাতা সেজে কল্যাণী শুকতারার মত জ্বলজ্বল করত মধুরিমা দিদির মুখ...
আমরা ভারতবাসী, নানা পরিধানে সেজে, বিবিধের মধ্যে মিলন মহান রূপকল্প হয়ে অর্চনা করতাম ভারতমাতার... 
" ওঠো গো ভারতলক্ষ্মী, ওঠো আদি জগতজন পূজ্যা"
"এতো স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধুম্র পাহাড়.. "
পতাকা উত্তোলনের পর মিষ্টিমুখ করে ঘরে ফেরা।
আজ পনেরোই আগষ্ট। 
আমাদের স্বাধীনতা দিবস।
কি সেই স্বাধীনতা মা?
উত্তোলিত পতাকার তিনরঙ, পতাকায় বাঁধা ফুলের পাপড়ির ছড়িয়ে পড়ার স্বাধীনতা!
ক্ষুদিরামের গল্প শুনে অবিরল চোখে জল আসার স্বাধীনতা! 
"হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী "
কোন হাসিতে ফাঁসি পরা যায়?  
বিনয় - বাদল - দীনেশের বারান্দা যুদ্ধের
শেষে পরিণতির স্বাধীনতা! 
বাঘা যতীন, সূর্য সেন, প্রীতিলতা, মাতঙ্গিনীর ত্যাগে আনা স্বাধীনতা!
আমাদের হৃদয়ের সুভাষের উদাত্তস্বরে  
যুদ্ধ আহ্বানের পথে স্বাধীনতা - " তোমরা আমায় রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব"....
আলোচনা ক্লান্ত রক্তস্নাত স্বাধীনতা।
অনেক পথ চলে আজ বিজয়িনী আমাদের স্বাধীনতা... 
ফসলের ক্ষেতে, কৃষকের হাসিতে,
কলে- কারখানায় শ্রমিকরমণীর আঁচলের খুঁটে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের অর্থে বাঁধা আছে স্বাধীনতা। ছেলের উচ্চ শিক্ষায়, 
মেয়ের উপার্জনের স্বাধীনতায়,
বৃদ্ধ বাবার  নিরাপত্তায়, 
অশক্ত মায়ের চিকিৎসায় বাঁধা পড়েছে স্বাধীনতা!
স্বাধীনতা এগিয়ে চলে চিন্তায়, মননে, যাপনে, শিক্ষায়,  পরিযায়ী শ্রমিকের পথচলায়, ঘুর্ণিঝড়ে, অতিমারীতে, প্রতিষেধকে!
আমাদের স্বাধীন চিন্তায়...
 আজ বোধহয় বুঝি, স্বাধীনতার অর্থ... 
আজ পনেরোই আগষ্ট। 
পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে আমাদের স্বাধীনতা...
এগিয়ে যায় অগণিত বছরের দিকে,  
অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রান্ত  
তবু এখনো অনেক চলা বাকি!



স্বাধীনতা দিবসের ভাবনা
নির্মাল্য ঘোষ

স্বাধীনতা দিবসে খাঁচা বন্দী পাখি ভাবে -
'আমিও তো স্বাধীন রয়েছি খাঁচার ভেতরে '
স্বাধীনতা দিবসে রজ্জুবদ্ধ পতাকা ভাবে -
'রজ্জুবদ্ধ হলেও আমিই তো স্বাধীনতার
ধারক ও বাহক'
স্বাধীনতা দিবসে ঋণগ্রস্থ কৃষক ভাবে-
' আরে, আমিও তো স্বাধীন এই খোলা মাঠে '
ঠিক তক্ষুনি-
খোলা মাঠের ওপর দিয়ে, স্বাধীনতার ধারক উড্ডীয়মান পতাকার ওপর দিয়ে, সীমানার
কাঁটা তারের ওপর দিয়ে - উড়ে
চলে যায় একঝাঁক পাখি...
দূরে কোথায় যেন ভেসে আসে..
' জন গন মন.... '



স্বাধীনতা 
উমা শঙ্কর রায় 

বয়সের ভারে তুমি এখন জড়সড় 
কোনো ফসল তুমি গোলায় তুললে না --
                                    সব গোল্লায়! 
যে ৠজু পথ তুমি দেখিয়ে ছিলে --
যে ‌শপথ তুমি দিয়েছিলে বিপথের তিরস্কারে -
সে সব আজ শ্রাবণের মেঘ হয়ে ঝরে! 

এবার তোমার ছানি অপারেশন করাবো! 
চতুর্দিকে দেখবে কেমন ডাহুক দৌড়
তবু তোমার জন্মদিনে ভুলি না 
                                সাদা পায়রা ওড়াতে ----!




স্বাধীনতা দিবস

মাথুর দাস


স্বাধীনতা যে কী সুখ আনে জানতে হলে

জানতে হবেই  তার ইতিহাস  কৌতূহলে ।

জন-জীবনের বিভীষিকা  সে পরাধীন দিনগুলি

লাগামছাড়া অত্যাচারে স্বাধীনতায় লাগায় ঠুলি ।


বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ,  অগ্নিঝরা আন্দোলন,

মহান নেতার অভয়বাণী,  গর্জে ওঠা জনগণ,

সব মিলিয়ে অবশেষে রক্ত-রাঙা পুব আকাশ

আনলো নতুন সূর্যোদয় নবকেতনের সুপ্রকাশ ।


মুক্তির স্বাদ স্বাধীনতার  যুক্তিহীনে বুঝবে কী !

শুক্তি মাঝে  মুক্তোটুকু  মুক্ত মনে খুঁজবে কি ?

যে দিবসটি  দূর করে সব  মনঃকষ্ট স্বাদ-হীনতা,

সে দিবস পনেরো আগস্ট, বহু সাধের স্বাধীনতা ।



স্বাধীনতা এলে
বিপ্লব গোস্বামী

            

স্বাধীনতা এলে মনে পড়ে যায়
নীলাভ দিনের কথা ।
স্বাধীনতা এলে মনে পড়ে যায়
দাসত্বের সেই প্রথা।
স্বাধীনতা এলে মনে পড়ে যায়
মা বোনের কান্না।
স্বাধীনতা এলে মনে পড়ে যায়
রক্ত নদীর বন‍্যা।
স্বাধীনতা এলে মনে পড়ে যায়
অপমান আর গ্লানি।
স্বাধীনতা এলে মনে পড়ে যায়
বীর নেতাজির বাণি।
স্বাধীনতা এলে মনে পড়ে যায়
শহীদের বলিদান।
স্বাধীনতা এলে মনে পড়ে যায়
জাতির পিতার আহ্বান ।


স্বাধীনতা 

দীপ মুখার্জি  

মুক্তির বাণী আজ ধ্বনিত

দিকদিগন্তে..

আকাশ বাতাস আজ মুখরিত

             নব আনন্দে...
নবসৃষ্টির প্রভাতী কিরণে সুর উঠেছে
           জাগরণী গানের
শ্রাবনধারায় নবসজ্জিতা প্রকৃতিতে
           যেন রঙের খেলা..
     আজ যে স্বাধীনতার দিন!!


     মুক্ত আকাশে উড়ে চলা সেই
            শুভ্র হংস বলাকা..
    স্নিগ্ধ বাতাসে উড়তে থাকা সেই
           গর্বের জাতীয় পতাকা
শান্ত সকালের সেই প্রভাত ফেরীর
             বন্দেমাতরম গান..
আর ওই যে ছোট ছেলেটা দৌড়ে আসছে
             হাতে লাড্ডু নিয়ে..
                সত্যি তো!!
        আজ যে স্বাধীনতার দিন।।


 স্মরণ করবো তোমাদেরই আজ
          দিয়েছ প্রাণ ঢেলে..
  লাঞ্ছিতা মায়ের সন্মান ফেরাতে
            দিয়েছ রক্তবিন্দু
নবযৌবন প্রাতে নবচেতনার বরণডালা
            সাজিয়ে রেখেছি
নুতুনের মাঝে আজ তোমাদের ভাব
               বর্ষিত হোক
        আসুক নুতুন সূর্যোদয়।।



স্বাধীনতা মানে 

 চন্দ্রানী চৌধুরী 


স্বাধীনতা মানেই দেশপ্রেমবুকে ভেতর দোলাচল

বীর শহীদের রক্তে রাঙা আসমুদ্রহিমাচল।


স্বাধীনতা মানেই বলিদানশূন্য হয়েছে মায়ের কোল 

ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করেছে  দামাল ছেলের দল 


স্বাধীনতা মানেই সংগ্রামস্বপ্ আঁকে চোখের জল 

তিনরঙা পতাকা হাতে এগিয়ে চলে ছেলের দল 


স্বাধীনতা মানেই বন্দেমাতরম , বাতাস জুড়ে জয়গান

ঐক্য আর সম্প্রীতিতে উজ্জ্বল হো দেশের নাম। 


স্বাধীনতা মানেই প্রত্যাশা,বিভে মুছবে রাম  রহিম

মানুষ সত্য বিশ্বাস নিয়ে স্বাধীনতা হোক সীমাহীন 




আমার স্বাধীনতা
বিজয় বর্মন

হে আমার মাতৃভূমি, আমার ভারতবর্ষ,
দেখি এক লহমায়,
চোখ বুজলেই আমার সাম্রাজ্য,
বুকের উপর বিষন্ন পায়ের ছাপ।

আমার উনুনে, দারিদ্র্যের আগুন,
যেন দাবানল,
সোনার ফসল, ধুঁকছে তৃষ্ণায়,
প্রকৃতির কাছে এ কোন পরাজয়।

হাতের মুঠোয় এ কোন স্বাধীনতা,
সব ভুলে যাই,
লাগামছাড়া ভাষা, খিস্তিখেউড়ে,
শব্দ ভান্ডারে কেন যে শিকল পরা।

এ কেমন আমার যাপনকাল,
বুক দুরু দুরু,
হিরিকের ভেলায় লক্ষ্য মানুষের ভিড়,
বিপদের মুখে আমি যে একলা।

পথ কুকুরের সাথে মানুষের লড়াই,
ভাগের টানাটানি,
আলোয় ঝলসানো রাজপথ জুড়ে,
ফুটপাতে বিছানা সারি সারি।

ধর্মের সুরসুরি, হুজুগে বানভাসি,
বিভেদের দাগ স্পষ্ট,
জ্বলন্ত কুন্ডে ঘৃতাহুতি, মিথ্যা শান্তির,
জিগির তুলে, কুণ্ডলী পাকায় ধোঁয়া।

হে, স্বাধীনতা , আবারও শপথের দিন,
জাগ্রত চেতনার,
উড়িছে নিশান, তিন রঙের বিধান,
মুছে যাক গ্লানি,একতার বানী হোক উজাগর।



স্বাধীনতা, তুমি
           ‎    সুনন্দ মন্ডল

তুমি কোথায়?
স্বাধীনতা!

প্রাণপণ লড়াইয়ের ময়দানে
তুমি বর্শা, কাস্তে, ছুরি, পিস্তল,
দেখেছো জীবনের একটা অংশ।

তোমার সাথে ছিল 
ভগৎ, মাষ্টারদা, বিনয়, বাদল, দিনেশ
বিজয় তুর্য নেতাজি।

আজ কেউ নেই সাথে
একা, উত্তরসূরী
স্বাধীন ভারতের পতাকাধারী।

হে বীর সৈনিকেরা
বাংলা মায়ের সন্তানবৎ
আরেকটিবার রক্ত ঝরাও, স্বাধীন করো আমাদের।

চুয়াত্তরেও পরাধীন মানবিকতায়
এখনো মানসিকতায় কত বিভেদের প্রাচীর।



স্বাধীনতা 
  বুলবুল দে


পরাধীনতার গ্লানি বইতে বইতে, শৃঙ্খলের জ্বালা সইতে সইতে,
কোটি কোটি সন্তানের লাঞ্ছনা বঞ্চনা দেখতে দেখতে,
দুঃখের দহনে যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে তোমার বুক।
প্রতিকারের পথ হাতরে বেড়াচ্ছ হন্যে হয়ে,
ঠিক তখনই হে ভারতমাতা,তুমি অনুধাবন করলে
নারীর একান্ত আপন শক্তিকে লাগাতে হবে কাজে।
এক নতুন আশার আলোয় উদ্ভাসিত হল তোমার মুখ।
সর্বতভাবে ভাবে নারীর নিজস্ব, প্রবল প্রগাঢ় মাতৃত্ব উঠল ফুটে তোমার শরীরে।
রত্নগর্ভা হয়ে উঠলে তুমি,তোমার গর্ভখনি থেকে একে একে হল নির্গত,
মহামূল্যবান, আপন তেজে উজ্জ্বল সব মানব রত্ন। দেশমাতৃকার অশ্রু মোচনে হল তারা দৃঢ় অঙ্গীকার বদ্ধ!
একে একে ,ধাপে ধাপে ,তারা গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন খাদের থেকে তুলল টেনে ,
সংকীর্ণ ,ধর্মান্ধ ,মেরুদন্ডহীন, ভীত, শোষিত ভারতীয় ভাই বোনদের
তমসা ঘন, ক্ষয়িষ্ণু ,ধর্ম -সমাজ সংস্কার করে,  লেখনী শক্তি দিয়ে উদ্দীপিতকরে,
তাদের এগিয়ে দিল ব্যক্তিত্বের ,চেতনার উন্মেষের পথে।
সমগ্র ভারতবাসীর মনে জাগ্রত হল স্বাধীনতার স্বপ্ন।
দিকে দিকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল বিপ্লবের তীব্র মশাল।
কেউ হানল অহিংস চাবুকের তীব্র কষাঘাত, কেউ প্রবল সহিংস বজ্রাঘাত!
আঘাতের পর আঘাতে শাসকের সিংহাসন হল টালমাটাল।
শত শত শহীদের রক্ত গঙ্গায় প্লাবিত হল ভারতভূমী।
সেই শনিত সাগরের নোনা জলে আর ঝাঁঝাল গন্ধে,
শ্বাস রুদ্ধ ওষ্ঠাগতপ্রাণ ব্রিটিশ বাধ্য হলে বশ্যতা স্বীকার করতে তুমি!
অবশেষে এল সেই বহু আকাঙ্খিত স্বপ্নপূরণের দিন।
সাতচল্লিশের পনেরই আগষ্ট, ভারতমাতা হল শৃঙ্খল মুক্ত,ভারতবাসী হল স্বাধীন!


শপথ
রীতা মোদক

কন্যা বলে মাগো তুমি
ছুঁড়ে ফেললে আমারে!
ভয় করে যে থাকতে আমার
নোংরা স্তূপের পাহাড়ে।

শেয়াল কুকুরের চিৎকারে মা
কাঁপছি ভয়ে ধুক ধুক
নাও না আমায় ফিরিয়ে মাগো
পাবে তুমি মাতৃ সুখ।

প্লাস্টিকেতে বন্দী আমি
প্রাণ যে কাঁদে বাঁচার তরে
সাহস করে তুলো আমায়
দেব তোমায় আলো করে।

ভয়কে আমি করবো জয়
গ্রহণ করবো শপথ,
আমার হাতে তৈরী হবে
ক্ষমতায়নের নতুন পথ।

জীবনের পথে এগিয়ে যাবো
দূর করবো সব যন্ত্রনা...
আমার মধ্যে লুকিয়ে আছে
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

ভিতুর মত থাকবো না আর 
পড়াশুনা করবো ,
পণ প্রথায় আর হবো না বলি
নিজের পায়ে দাঁড়াবো।


স্বাধীনতা দিবস
 অদিতি মুখার্জি সেনগুপ্ত 

স্বাধীনতা দিবসে হয় মনটা খুশিতে বিগলিত, 
আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিনে সকলেই যে উচ্ছ্বসিত। 
ইংরেজ পরাধীনতার থেকে মুক্তি পেয়েছিল সকল ভারতীয়, 
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ত্যাগ সত্যিই অবিস্মরণীয়। 

আজ খুশিতে বিহ্বল হয়ে ওড়াই জাতীয় পতাকা, 
স্বাধীন দেশের নাগরিক বোধে মনে খুশির রেখা। 
দৃপ্ত কণ্ঠে আজ আমরা জয় হিন্দ বলে ফেলি, 
কত শহীদের রক্তে রাঙ্গানো দেশের মুক্তি কি করে ভুলি। 

খুশি যদিও স্বতন্ত্রতায় নই খুশি অনেক কাজে, 
ভারতবর্ষ এগিয়ে চলুক নতুন এক সাজে। 
সচেতনতায় আধুনিকতায় জ্ঞানে আর প্রযুক্তিতে, 
হোক ভারতবর্ষ সেরার সেরা এই বিশ্বতে।



অন্য ভাবনার স্বাধীনতা  

পরাধীনতার উৎসব 
সুশান্ত পাল 

একটা রাষ্ট্র কোনোদিন স্বাধীন হতে পারে?? যতদিন না অনেকগুলো সমাজ স্বাধীনচেতা হচ্ছে,, পরাধীনতা শব্দটার জন্ম স্বাধীনতা শব্দের বহু আগে তাই পরাধীনতা ঘুচবে এটা হতেই পারে না,, জিনগত ভাবে আমরা ভীষণ প্রাচীন যেমন শিম্পাঞ্জির সঙ্গে আমাদের ৯০ শতাংশের বেশি সাদৃশ্য, তাই আমরা সেভাবে আধুনিক হতে চাইলেও সেটা আদতে সিকিমাত্রই,, আমরা অনেকটা খাদ্য খাদকের সারণীর মতো পরাধীনতার  সারণী জাতীয় কিছু একটা আবিষ্কার করতেই পারি,, ধরুন উচ্চবিত্ত -সাধারণ উচ্চ্যবিত্ত -মধ্যবিত্ত -নিম্নমধ্যবিত্ত -নিম্নবিত্ত -অন্তদ্বয় এটা নিশ্চই রাষ্টের কেউ তৈরী করেছিলেন,, আর এখানেই বোঝা যায় রাষ্ট্র ব্যাপারটাই ভাওতা ব্যাক্তিই ক্ষমতার অধিকারী আর জিনগত গুনে সে নিচু তলাকে শোষণ করবে এটাই চিরন্তন,, সেটা গ্রহের সকল প্রান্তে সমান ভাবে কার্য্যকর,,, তাহলে স্বাধীনতা ব্যাপারটা আসলে আমরা কিভাবে ধারণ করি ... স্বাধীনতাটা আসলে কতগুলো ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত যেগুলো ব্যাক্তি নিজেই তৈরী করে তার পরিশ্রম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে,, আর আমরা পরাধীনতায় জর্জরিত মানুষ সেটাকেই স্বাধীনতা বলে চালিয়ে দেই,, বাস্তবে কিন্তু আমরা সর্বক্ষণ নিপিড়িত, বঞ্চিত,, রাষ্টের স্বাধীনতা আমাদের শুধু একটা বিশেষ তারিখ মনে করিয়ে দেয়,, এর থেকে বেশি কিছু কী??? 



হাতের কাজে স্বাধীনতা 

শিল্পী- দেবাঞ্জনা রুদ্র 
(চাল, ডাল ও পাতা দ্বারা নির্মিত)









ছবিতে স্বাধীনতা 

শিল্পী- অদ্রিজা বোস 







শিল্পী- তানভি দাম 





শিল্পী- অনুষ্কা প্রামাণিক 




শিল্পী- প্রীতম কর 


শিল্পী- পরেশ সাগ্নিক বেরা 





শিল্পী- প্রিয়দর্শিনী দাস






শিল্পী- সৃজা রায়








শিল্পী- ষোড়শী গুহ





শিল্পী- উৎসব সাহা



শিল্পী- শৌভিক  কার্য্যী