বিশেষ রাখিবন্ধন সংখ্যা
চিঠি
মানুষের মিলনের সেতুবন্ধন করেছে রাখীবন্ধন উৎসব
গৌতম চক্রবর্তী
রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশের প্রায় সব উৎসবের উৎসই পুরাণ। পুরাণের আবার ক্রনোলজি খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। রাখীর শুভ সূচনার পৌরাণিক আখ্যান কিন্তু চার্জড করবে কলির দেবদাসদের। মন্ত্রপূত রাখীর পৌরাণিক বাঁধন ভাইয়ের জন্য নয়, তা বরাদ্দ ছিল পতিদেবতার মঙ্গল কামনায়। ভনিতা না করে আসল কথাটুকু বলা যাক। দেবাসুরের ভয়ানক যুদ্ধে দেবরাজ ইন্দ্রের প্রাণ যাবার উপক্রম হলে পতিঅন্ত প্রাণ ইন্দ্রাণী ধ্যানে বসে কোন এক শ্রাবণ পূর্ণিমায় স্বামীর জন্য তৈরি করলেন মন্ত্রপূত রক্ষাবন্ধন। সেই কবচ পরে অজেয় দেবরাজ ভীমবেগে বঙ্গভূমিতে ধাবিত হয়ে নিধন করলেন অসুরকুল, ফিরলেন স্বর্গপুরীতে। তবে রাখীর রিভাইসড এডিশন বা ভ্রাতৃকরণের শুরু হল মৃত্যুরাজা যম, এবং তস্য ভগ্নী যমুনার রক্ষাবন্ধনের মাধ্যমে। দেবকুলের হয়েও অপ্রিয় মন্ত্রক পাওয়া যমরাজ দিনরাত মরা নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে বিমর্ষ বোধ করেন। দুঃখ ভোলাতে যমুনা রাখী বাঁধলেন ভাইয়ের হাতে, ফোঁটা দিলেন যমের কপালে। রক্ষাবন্ধনের অমর মহিমায় অমর হলেন মৃত্যুরাজা।
শিশুপালের সঙ্গে তখন মারকাটারি বিরোধ শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেবের। কথা দিয়েছিলেন শিশুপালের মাকে যে তার একশত অপরাধকে ক্ষমা করে দেবেন। উদ্ধত শিশুপাল অচিরেই সেই সীমারেখা লঙ্ঘন করল। কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে নারাজ মদমত্ত শিশুপাল কৃষ্ণকে অপমানের সীমারেখা পেরোলে ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে কৃষ্ণ শিশুপালকে বিনাশ করলেন সূদর্শন চক্রের আঘাতে। ঘটনার ঘনঘটায় সূদর্শন চক্রাঘাতে কৃষ্ণের নিজের হাত কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এলে শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাত বেঁধে দেন কৃষ্ণা দ্রেীপদী। শ্রীহরি কথা দেন এই রক্ষাবন্ধনকে তিনি সারাজীবন মনে রাখবেন। কুরু রাজসভায় দুঃশাসনের দুঃসাহসে বেআব্রু ভ্রাতৃবধূর শরীরে কৃষ্ণ প্রদত্ত একটুকরো কাপড়ের বাঁধনই ফিরে এল অন্তহীন আব্রু হয়ে যা মান বাঁচাল ভাই বোনের চিরায়ত সম্পর্কে।
রক্ষাবন্ধন তাই কবে রাখীবন্ধন হলো সেই সন তারিখ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে রাখীর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে রক্ষা পেল এতে তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাখীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও কম উৎসাহব্যঞ্জক নয়। খৃষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে বৃষ্টিভেজা ঝিলমের পাড়ে সুদুর ম্যাসিডন থেকে সসাগরার অধিশ্বর হতে ভারত সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে ঘাঁটি গেড়েছেন সম্রাট আলেকজান্ডার। ভয়াল, ভয়ংকর যুদ্ধশেষে অপরাজেয় আলেকজান্ডারের কাছে বিনাযুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করলেন তক্ষশিলা রাজ অম্ভি। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ নীতিতে গ্রিকরাজের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে আশপাশের আরো কিছু ছোটখাটো পুরুবিদ্বেষী রাজাকে জুটিয়ে প্রতিবেশী শক্তিশালী রাজ্য পুরুকে পরাস্ত করতে চাইল। পুরুর আসল শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন আলেকজান্ডারের ভারতীয় পত্নী রোক্সানা। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এই উপজাতি মেয়েকে বিবাহ করেন আলেকজান্ডার এবং এই রাজকন্যাই হয় তাঁর জীবন মরণের সাথী।
পুরুর বীরত্বে ত্রস্ত আসমুদ্র হিমাচল। চুপি চুপি হাজির হলেন রোক্সানা পুরুর দরবারে। আলেকজান্ডারের অজান্তেই তাঁর প্রাণভিক্ষা করে গেলেন তাঁর সহধর্মিনী পুরুকে ভ্রাতৃত্বের রাখীবন্ধনের মাধ্যমে। রোক্সানাকে কথা দিলেন পুরু কোন অবস্থাতেই আলেকজান্ডারের ক্ষতি হতে দেবেন না। বৃষ্টিভরা রাতে ঝিলমের তীরে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধকৌশলে পুরুর সেনারা যখন কোনঠাসা তখন পুরুর বীরত্বের সামনে অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্যেও বেকায়দায় ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন সম্রাট আলেকজান্ডার। উদ্যত তরবারি উঁচিয়ে গ্রিকরাজের বুকটা এফোঁড়-ওফোড় করে দেবার প্রাক্কালে চোখ পড়ল রাখী বাঁধা হাতের ওপর। রোক্সানার দেওয়া রাখী। ভাই পাতিয়ে গিয়েছিল রোক্সানা। কথা দিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর কোন ক্ষতি হতে দেবেন না। কথা রাখলেন তিনি। অন্যমনস্ক হয়ে পড়াতে ভীমবেগে আক্ৰমণ শানালো গ্রীকবাহিনী। বন্দী হলেন পুরুরাজ। আলেকজান্ডারের কাছে দাবি করলেন রাজার প্রতি রাজার মত আচরণ। শৃঙ্খলিত পুরু রাজের প্রতি সশ্রদ্ধ আলেকজান্ডার মুক্তি দিলেন পুরুরাজকে। অন্তঃপুরের পর্দার আড়ালে যে সৈনিক শেকল পরিয়ে এসেছিলেন আগের রাতেই তার খবর ছিলো না ম্যাসিডনাধিপতির কাছে।
চরম সংকটে চিতোর, গুজরাটের বাহাদুর শাহের আক্রমণে মরণপন যুদ্ধে হার মেনেছেন রাজপুত যোদ্ধারা। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় দিল্লীর মোঘল সম্রাট হুমায়ুনকে ‘খত’ লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন রাণী কর্ণাবতী। চিঠির সঙ্গে রাখী পাঠিয়ে বোনকে রক্ষা করার আবেদন জানালেন রাণী। কর্ণাবতীর এই আবেদনে গলে গেল মোগল সম্রাটের হৃদয়। হিন্দু রাখীর সম্মান রক্ষার্থে মুঘল বাদশাহ মেবার অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করলেন গুজরাট নরেশের আক্রমণ থেকে বহিনকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু মেবার পৌঁছানোর পূর্বেই শত্রুপক্ষের শাণিত তরবারির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রাজপুত যোদ্ধারা বীরের মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যদিকে আত্মসম্মান রক্ষার্থে রাজপুত রীতি মেনে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে ‘জওহর ব্রত’ পালন করে প্রাণত্যাগ করেন রাণী কর্ণাবতী। গণচিতা জ্বলে ওঠে রাজপুতানায়। সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় বোনকে বাঁচাতে না পারার অনুশোচনায় দগ্ধ মোগল বাদশাহ হুমায়ুনের হৃদয়।
রাখীকে ঘিরে রাখীবন্ধনের প্রেক্ষাপট আবর্তিত হয়েছিল অবিভক্ত বাংলাকে ঘিরে। ‘বাংলার মাটি বাংলার জলে’ পুষ্ট রাখী সেতুবন্ধন রচনা করেছিল এপার বাংলা ওপার বাংলার। ১৯০৫ সাল। বড়লাট লর্ড কার্জন অনুভব করলেন বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে হিন্দু মুসলিম বিভেদ সৃষ্টি করা। ত্রিকালদর্শী রবি কবি বললেন, ‘ইংরেজই মুসলমানকে আমাদের বিরুদ্ধে করিয়াছে...... শনি তো আর ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না, অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্পর্কে সাবধানতা অধিক প্রয়োজন’। সেই ফাটল জুড়তেই প্রয়োজন হয়েছিল রাখীবন্ধন উৎসবের। একজোট হিন্দু মুসলিম বাংলার মাটি বাংলার জলের সুর কণ্ঠে নিয়ে রাখীর বাঁধনে একত্রিত হয়ে উত্তাল বাংলায় মিলনোৎসবে সামিল হয়েছিলেন।
বঙ্গভঙ্গে ঘর ভেঙেছিল শত্রুপক্ষ। আর আজ আমাদের এই প্রিয় বঙ্গদেশকে ভঙ্গ করছি আমরাই। অন্তর্কলহের জেরে দার্জিলিং-এর বুকে গোৰ্খাল্যান্ডের নামে বা উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য হিসাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবনা মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের রাজনীতিবিদদের কিছু যাবে আসবে না, অঙ্গরাজ্যের তালিকায় নতুন একটি রাজ্যের নাম সংযোজিত হবে। কিন্তু এই বঙ্গদেশ হবে টুকরো টুকরো। সহজ সরল নেপালী ভাষী বোনের হাতে বাঙালী ভাই কি আর রাখী বাঁধতে পারবে না? তাই যুগে যুগে কালে কালে রাখীবন্ধন মানুষের মধ্যে মিলনসেতু রচনা করেছে। এই রাখীবন্ধন উৎসব সবরকম বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরূদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।
রাখী বন্ধন উৎসব হয় শ্রাবণী পূর্নিমা বা ঝুলন পূর্ণিমাতে। এই উৎসবে বোন ভাইকে রাখী পরিয়ে দিয়ে জীবনভোর বাঁধা পড়ে এক পবিত্র সম্পর্কে। একবার এক রাখীভাই যেভাবে রাখীবোনের মর্যাদা রক্ষা করেছিলো সে কাহিনী আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খোদিত। সে কাহিনী রাজপুতানার মেওয়ারের রাণী কর্ণাবতী আর মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের।
রাজপুতানার মেওয়ার রাজ্যের রাণী ছিলেন কর্ণাবতী। তিনি ছিলেন চিতোরের মহারাণা সঙ্গের স্ত্রী। এই রাণীর ছিলো দুই সন্তান-রাণা উদয় সিং আর রাণা বিক্রমাদিত্য। যখন মুঘল সম্রাট হুমায়ুন তাঁর রাজ্য বিস্তারের জন্য অন্যত্র ব্যস্ত ছিলেন সেই সুযোগে গুজরাটের বাহাদুর শা ১৫৩৩ খৃষ্টাব্দে চিতোর আক্রমণ করেন।
মহারাজা সঙ্গের মৃত্যুর পরে মহারাজা রতন সিং সমস্ত রাজপুত রাজ্যগুলোকে এক পতাকার তলায় নিয়ে এসে চিতোরের সিংহাসনে বসেন। রাণা রতন সিংহের মৃত্যুর পরে তাঁর ভাই চিতোরের মহারাণা হন। বিক্রম তাঁর আর্মিতে সাত হাজার কুস্তি জানা লোক নিয়োগ করলেন। তিনি ভালোবাসতেন কুস্তি শিকার জীব্জন্তুর যুদ্ধ এসব। মেওয়ারের অভিজাতদের এসব পছন্দের ছিলো না। ক্রমে এই নিয়ে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে তাঁরা তাদের রাজ্য পরিত্যাগ করে অনেকে সম্রাট বাহাদুর শা বা আর কারোর কাছে চলে গেলেন।
গুজরাটের শাসক বাহাদুর শা চিতোর আক্রমণ করে এই সব অসন্তুষ্ট দেশত্যাগী লোকদের নিয়ে। যদিও বিক্রম চেষ্টা করে ছিলেনবাহাদুর শাহের সঙ্গে সন্ধি করতে, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। বাহাদুর শা আরো শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেন। তার বিশাল সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাণা বিক্রমের বাহিনী পারবে না। রাজমাতা সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠালেন। কিন্তু বাহাদুর শা তা পরিত্যাগ করে দিলেন।
এই পরিস্থিতিতে মহারাণী কর্ণাবতী মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে প্রস্তাব দিলেন যে রাজপুত আর মুসলিম দুই দলই তাদের দুজনের শত্রু বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে লড়বে। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন সেই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন কারণ রাজমাতা কর্ণাবতী বুঝে গিয়েছিলেন, মহারাণা বিক্রমাদিত্য ভালো দক্ষ যোদ্ধাও নয় ভালো শাসকও নয়। সেইজন্য মেওয়ারের সম্মান রক্ষা করার জন্য তিনি সম্রাটকে রাখী পাঠিয়ে ভাই হয়ে সাহায্য করার অনুরোধ করেন। হুমায়ুন ধর্ম ভাই হয়ে তাঁকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। বোনের ভাই সেই রাজত্ব রক্ষার দায়িত্বও নেন। হুমায়ুন রাজমাতার রাখীর মর্যাদা দিয়ে প্রচুর উপহার পাঠান আর তাঁকে আশস্ত করেন যে তিনি সাহায্য করতে আসবেন।
যখন চিতোর আক্রমণ হয় তখন হুমায়ুন গোয়ালিওর ফোর্টে ছিলেন। আর তিনি তাঁর দলকে দিল্লি হয়ে আগ্রা যাবার নির্দেশও দিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু যখন সেই দলকে ফিরিয়ে তিনি চিতোরে পৌঁছলেন, তখন দেরী হয়ে গিয়েছে। রাজমাতা কর্ণাবতী জহর ব্রতে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন প্রাসাদের সব রমণীকে নিয়ে। যাই হোক জহর ব্রতের আগে তিনি রাজকুমার উদয়সিংহকে নিরাপদে বুন্দি ফোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ধাত্রী পান্নার হাত দিয়ে।
হুমায়ুন দুঃখ পেয়েছিলেন রাণী নেই শুনে, আর যখন শুনলেন রাজমাতা জহরব্রতে জীবন দিয়েছেন তখন ক্রোধে আগুন হয়ে বাহাদুর শা কে আক্রমণ করে তাকে পরাস্ত করলেন। এরপর প্রিন্স উদয় সিংকে বুন্দি থেকে আনিয়ে তাকে মহারাণা পদে অভিসিক্ত করলেন।
সম্রাট হুমায়ুন এদেশে এসেছিলেন ভারতের বাইরের দেশ থেকে। কিন্তু তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিতে ভাইবোনের পবিত্র সম্পর্কের কথা জানতেন। এক সময় তিনি অমরকোটের রাজপুত শাসক বীরশালের কাছে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। সে সময় বীরশালের পাটরাণী তাঁকে নিজের ভাই এর মতো দেখতেন। হুমায়ুনের ছেলে সম্রাট আকবর তাঁর অমরকোটে থাকাকালীন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেজন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন এই সম্পর্কের বোন রাণী কর্ণাবতীর রাখীর মূল্য দিতে।জাতি ধর্ম নির্বিশেষে একটি রাঙা রাখী হয়েছিলো সেই মর্যাদার রক্ষক। যে কাহিনী আজও ফেরে লোকমুখে।
স্মৃতিচারণা
রাখীবন্ধন -কিছু চিত্র
মনামী সরকার
অমর কথারা
অলকানন্দা দে
মন নিঙড়ালে যেসব স্মৃতির সুঘ্রাণ মেলে তাতে কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যায় নিমেষে। তাদের সাথে ভাব-ভাব সম্পর্ক ফিরিয়ে নিয়ে যায় প্রাক্তন দিনে যাকে রেখেছি ভালোবাসার ছাউনিতে, নিশ্চিন্ত আরামের নীচে কর্তব্য-বোধে। রোদে-জলে মলিন না হয় এতটুকু বর্ণ যেন তার! আজ অনুভবের দেরাজ খুলে বের করে আনলাম পূর্ণিমাময় সেই দিনটাকে। আলো-বিচ্ছুরণ করে যাচ্ছে একইভাবে দেখছি। রসদপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে ভাদ্রের রোদ্দুর মাখিয়ে নিচ্ছি সংরক্ষণের তাগিদে আরও একবার।
ছেলেবেলায় সোনা-সোনা এই ছুটির দিনটাকে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই। কারণ, রাখির হাত ধরে আসতো ঝুলন। যেন দুই ভাই বোন। তাকে তো সাজিয়ে গুছিয়ে প্রস্তুত করতে হবে উৎসবের ডাঙায়। তাই সারল্য সম্বল করে বারান্দাময় কাজ চলতো দিনরাত্রি একজোটে। নিজহাতে তিল তিল করে স্থাপত্য গড়ে তোলার সে কি অমল আনন্দ! পাহাড়ের পাদদেশে থাকতাম বলে পাহাড় গড়ার আর্দ্র ইচ্ছেটাই প্রশ্রয় পেতো বারবার। তাই আতিপাতি খুঁজে শ্যাওলা জোগাড় করে আনা যা নাকি পাহাড়কে দুর্দান্ত সবুজ করে, কি জমাট উল্লাসের কাজ ছিল! গাছের ছোট ছোট ডাল এনে তাকে সাজিয়ে সার সার পাহাড়ী পাইন তৈরী করা আনন্দ-ঘাম ঝরানো একটি গর্বের সৃষ্টি। এ পাহাড় ও পাহাড় সংযোগকারী ব্রীজ কিন্তু ভীষণ জরুরী। বস্তুত সেটি দেখাতো যেন কাঠের তৈরী। নির্মাণ হোত পিসবোর্ড সহযোগে। তলা দিয়ে বয়ে যেত সরু নদী-ধারা, বুকে থাকতো ছোট ছোট নুড়ি-পাথরের নক্সা। বেশ একটু উচ্চতায় পাত্র বসিয়ে তাতে জল ভরাট করে এবং আশেপাশে সবুজের ছোঁয়া দিয়ে লেক তৈরী করা হোত। আর থাকতো পাহাড়ের গা বেয়ে লতিয়ে ওঠা সরু পথ। যাত্রীদের অভ্যর্থনা ত্বরে ছোট ছোট ল্যাম্পপোষ্টগুলি প্রতিশ্রুতি দিতো সাধ্যমতো আলো ছড়ানোর। কাগজ কেটে তৈরী হোত আলোস্তম্ভ। সরু তারের সাহায্যে এ পোষ্ট ও পোষ্টে সংযোগ ঘটানো হোত। এই পথে কিন্তু ব্যবধানে গাড়িও চলতো। ছোট ছোট ঘর বানিয়ে মৃদু দূরত্বে বসিয়ে তৈরী হোত পাহাড়ী গ্রাম। যার উঠোন ঘর-দোরে দু একটি পুতুল মানুষ ঘরকন্না সেরে নিচ্ছে। একটি দুটি ফুলেল গাছ পাহাড়ের ঢালে সমৃদ্ধ করছে তার রূপ। ঘাসের তৈরী ফসলী জমিতে কাজ করতো মশগুল কৃষকেরা! এই ভালোবাসার রেপ্লিকাটি ভারী অহংকারে দাঁড়িয়ে থাকতো কিন্তু! স্বস্তির শ্বাস ফেলতাম তখন, যখন বড়রা দেখে বলতেন, ”ভীষণ সুন্দর বানিয়েছিস্ রে তোরা!”
পাঁচদিন ব্যাপী ঝুলন সাজানোর শেষের দিনটি ছিলো সেই সু-তিথি রাখির। উৎসব বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ক্লান্তি নেই। হাতময় রাখি নিয়ে নিটোল সুখের মুহুর্ত! কটা বড় রাখি কটা ছোট, গোনাগুন্তির পর্ব মিটতো না যেন! ইস্কুলে শেখানো হোত রবি ঠাকুরের রাখিবন্ধনের মর্মকথা! বুঝতে চাইতাম মশগুল হয়ে। এই শেষের দিনটিতে মা কাকিমারা খাবারের আয়োজন করতেন। চোঁ চোঁ খিদে নিয়ে সারি বেঁধে খেতে বসার আনন্দের যে অনুভূতি তা মনের মাটিতে আজও রাজত্ব করে! রাশ-টানিনা তার! চলুক না তল্লাট জুড়ে দহরম-মহরম! ফেলে আসা টুকরো টুকরো কথার দল আজকের বয়সের কিনারে দাঁড়িয়েও উইশ করে রমরমে জ্যোৎস্না রাতের! আলো-চলকানো রূপসী তিথিটা আজও যে বড় পুণ্যের সাড়া ফেলে মর্মজুড়ে!
তানভী দাম
No comments:
Post a Comment