মুজনাই সাপ্তাহিক
বিশেষ সংখ্যা
গান্ধী বাওয়ার অতিমানব হয়ে ওঠার আখ্যান
ডঃ রাজর্ষি বিশ্বাস
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে গান্ধীজি এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন। এই ভেনি-ভিডি-ভিসি কীভাবে সম্ভব হল ? গান্ধীজীর এই চমকপ্রদক উত্থানের পেছনে ভারতীয় সমাজে ফল্গু ধারার মত বহমান কল্প রাজ্যের ধ্যান ধারণা ও অলৌকিকতায় বিশ্বাস অনেকটাই সহায়ক হয়। বিদেশের মাটিতে আংশিক সাফল্য এদেশে তাঁকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যাতে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জন্মায় গান্ধীজিই হলেন প্রকৃত ত্রাতা। পূর্বেকার কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের বেশভূষা, চালচলন এবং সামাজিক ও আর্থিক প্রতিপত্তির সাথে আম ভারতবাসীর কোন মিল ছিলনা। সেই প্রেক্ষিতে এক অতি সাধারণ চেহারার ও ততোধিক সাধারণ বেশভূষার - অনেকটা সাধুসন্তদের সাথে তুল্য মানুষটি অশিক্ষিত ভারতবাসীর কাছে মেসিয়ায় পরিণত হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। উত্তর ভারতে তিনি যত না একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে, তার থেকেও অধিক একজন অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাই তাঁকে স্বচক্ষে দেখতে যে প্রবল উন্মাদনা তৈরি হত, তা বর্তমানের নেতা-নেত্রীদের কাছেও অকল্পনীয়।
গান্ধীজীর এই অতিমানবীয় প্যারাডাইম নির্মাণের পেছনে একাধিক গল্প প্রচার পেয়েছিল। এই কাজে ইন্ধন দিয়েছিল গান্ধীজীর অনুগামীবৃন্দ ও স্থানীয় একাধিক পত্রপত্রিকা। ইতিহাসবিদ শাহিদ আমিন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন এসব প্রচার মূলক নানা গল্পগাঁথা কী প্রবল ভাবে তাঁকে মহাত্মা বানিয়েছিল। এই গল্পগুলি যেন এক সুরে বাধা ছিল। যেমন একবার জনৈক এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রাতে স্বপ্ন দেখে পালাও পালাও চিৎকার করতে করতে ইংরেজ অফিসারের বাংলোর দিকে ছুটে যান। কারণ তিনি স্বপ্ন দেখেছেন গান্ধীজী ইংরেজদের ধ্বংস করতে ছুটে আসছেন অনেক মানুষজন নিয়ে। মধ্যরাতে সেই চিৎকারে যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় তাতে গোরক্ষপুরে সব সাহেবরা বিছানা ছেড়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় স্টেশনের দিকে ছুটে যায়। গান্ধীজিকে নিয়ে ইংরেজ সাহেবদের মধ্যে এই ভয়াবহ আতঙ্কের গল্পটি ছাপা হয়েছিল বেনারসের ' আজ ' পত্রিকায় এবং পরে 'স্বদেশ ' পত্রিকায়। শুধু এই গল্পটি নয়, গ্রামেগঞ্জে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে হাজারো অলীক গল্প। যেসবের মূল আধার ছিল গান্ধীজী এক অভূতপূর্ব অলৌকিক শক্তির অধিকারী। ছোটখাটো এরকম নানা গল্পের নমুনা পেশ করেছেন শাহিদ আমিন। যেমন জনৈক এক ব্যক্তি একবার এসে বললেন, গান্ধীজীর ওপর তার বিশ্বাস আসবে যদি আখের রস ভরা কড়াই দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায় - বলা মাত্রই কড়াইটি দু'টুকরো হয়ে যায়। এক কাহারের বক্তব্য ছিল যে সে তাঁকে বিশ্বাস করবে যদি তার বাড়ির চাল উপরে উঠে যায়। সকলে বিস্ময়ের সাথে দেখে যে তার বাড়ির চাল এক হাত উপরে উঠে গেছে। আর একজনের কথায়, গান্ধীজীর ক্ষমতা যদি সত্যি হয় তবে তাদের জমি সর্ষেতে ভরে যাবে এবং হলও তাই। এমনকি গুপী গাইন বাঘা বাইনের মত গান্ধীজীর নামে আকাশ থেকে মিষ্টি বর্ষণও হল। গোরক্ষপুরের গ্রামে গ্রামে গান্ধীজীর প্রতি এরকম অলৌকিক বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য এরকম বহু গল্প চলতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। তাইই নয়, শুরু হয় ভয় ভীতির সুকৌশল আখ্যান। যেমন গান্ধীজীর নামে গালিগালাজ দিলে এক ব্যাক্তির চোখের দুপাতা জুড়ে যায় বা আরেকজনের চার সের ঘি নষ্ট হয়ে যায়; আবার একজনের গায়ের থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখানেই গল্পের শেষ নয়। এরপর শুরু হয় গান্ধীজীর নামে মানত রাখার গল্প। যেমন ভাগলপুরের জনৈক এক মুসলমান ব্যক্তির একটি পাত্র কুয়ার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। গান্ধীজীর নামে মানত করায় সেই পাত্র আপনা থেকেই ভেসে ওঠে। একই ভাবে তাঁর নামে মানত করায় আজমগড়ে এক ব্যক্তির বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া বাছুর বাড়িতে ফিরে আসে। বার্নিয়া জেলার একজনের হারিয়ে যাওয়া টাকার সমেত থলি মানত করেই ফিরে পায়।
গান্ধীজীর আশীর্বাদের গল্পও ইস্তক ছড়িয়ে পড়ে। এই গল্পই হোক বা গুজব তা শুধু যে নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে ছড়িয়েছিল এমন নয়, সমাজের শিক্ষিত অংশকেও প্রভাবিত করেছিল। যেমন গোরখপুর শহরের এক উকিলের বাগান বাড়িতে দুটো গাছ মরে গেলেও গান্ধীজীর আশীর্বাদে বেঁচে ওঠে। ক্রমে খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। আশেপাশের গ্রাম গঞ্জ থেকে হাজার হাজার মানুষ সেই গাছ দুটিকে দেখতে ছুটে আসে এবং ফুল, ফল, বাতাসা, টাকা, গয়না এসব প্রণামী দিতে শুরু করে। এসব ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়লে সেসব স্থানে প্রায়শই মেলা বসে যেত এবং গান্ধীজীর অলৌকিকত্বের নানা গল্প ও গুজব লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ত এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। আর তা স্থানীয় পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হত। সেসময়ে 'স্বদেশ' পত্রিকায় এরকম নানা স্থানীয় খবর প্রচারিত হত। তবে এগুলির সত্যাসত্য পরীক্ষার বলাই ছিল না। এই পত্রিকার অনেক খবরের মধ্যে একটি ছিল - একবার গোরখপুর সিভিল কোর্টের কাছে এক গ্রামে ভয়াবহ আগুন লাগলে লোক জলের জন্য গান্ধীজীর নামে মানত করে। সাথে সাথেই আশেপাশের যত কুয়ো ছিল সব জলে পরিপুর্ণ হয়ে যায়। যথারীতি সেখানেও বহু মানুষের সমাগম হয় এবং সেই জল পবিত্র মনে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়ে। এই সব জমায়েতে গান্ধীজীর মাহাত্ম্য প্রচারের পাশাপাশি স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে এসব প্রকাশিত হলে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে হাজার হাজার মানুষ নিয়ে এগিয়ে চলেছেন গান্ধীজী। ব্রিটিশের পুলিশ গুলি করছে, তা তাঁর গায়ে লেগে জল হয়ে যাচ্ছে অথবা তিনি আগুনের ওপর দিয়ে নির্বিকারে হেঁটে যাচ্ছেন - এসব মানুষকে এক গণ উন্মাদনায় ধাবিত করে।
সাধারণ মানুষের চৈতন্যে এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা গান্ধীজী দ্রুত সারাদেশের গণদেবতায় পরিণত হয়ে যান। শুধু উত্তর ভারতের গ্রামগুলিতেই নয়, গান্ধীজীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে। এমনকি প্রান্তিক রাজ্য কুচবিহারেও সেই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তখন রাজ্যে মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ ক্ষমতাসীন। সাধারণভাবে কুচবিহারবাসী মহারাজার অনুগত প্রজা হলেও, তাদের হৃদয়ে সেসময় গান্ধীজীই মহারাজার স্থান অধিকার করে নেন। পুন্ডিবাড়ি গ্রামে এক সভায় মহারাজা স্বয়ং হাজির হলে আয়োজক এক নেতা এসে বলেন, " হুজুর এ সভা গান্ধী মহারাজের কথা শুনিবার আর মানষিগুলাক শোনাইবার জন্য।" মহারাজার সমানে স্থানীয় কৃষকেরা যেভাবে গান্ধীজী প্রতি তাদের আনুগত্যের কথা বলেছিল তা শুনে মহারাজা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, " আমি তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজা থাকতে চাই না। তোমরা যদি গান্ধীজিকে রাজা করতে চাও, সেটা বল। আমি এখনই রাজ্য ছেড়ে চলে যাব। কোন ভয় নাই - তোমরা তোমাদের কথা পরিষ্কার করে বল।" রাজার রাজ্যেই যদি এই পরিস্থিতি হয়, তবে অন্যত্র গান্ধী বাবা বা বাওয়া, গান্ধী মহারাজ ও মহাত্মার প্রভাব কতটা ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
No comments:
Post a Comment