Wednesday, March 2, 2022


 


সম্পাদকের কথা 

এ কোন বসন্ত? বসন্ত মানে তো সৃষ্টি, বসন্ত মানে তো সৃজন। কিন্তু সারা বিশ্ব আজ এমন এক খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে যেখানে বসন্ত নিয়ে এসেছে মৃত্যুমিছিল। প্রত্যেকে সন্ত্রস্ত, এই বুঝি শুরু হয় আর একটা বিশ্বযুদ্ধ! এত জীবনহানি, এত ধ্বংস প্রত্যক্ষ করে মনে প্রশ্ন জাগে, এই কি সভ্যতা? এই কি প্রগতি? মন থেকে যদি বিভেদ মুছতে না পারি, যদি শান্তিকে আহ্বান করতে না পারি, যদি সৌভ্রাতৃত্বের হাত না এগিয়ে দিতে পারি তবে কীসের সভ্যতা, কীসের প্রগতি!

ইতিমধ্যেই আমরা হারিয়েছি দেশের এক সন্তানকে। কেউই জানি না নিরীহ সেই সন্তানটি কার দোষে জীবন শুরুর আগেই চলে গেল পরপারে। যুদ্ধ তো এটাই করে। সে কোনও পক্ষ জানে না, মানে না। জানে শুধু একটাই কথা- ধ্বংস। কিন্তু সেই পৃথিবী তো আমরা চাই না! চাই না অচিরে ঝরে যাক প্রাণ, শিশু হোক অভিভাবকহীন, সন্তানকে হারাক পিতামাতারা, প্রেমিকার চোখে নামুক অকাল বর্ষণ। 

দ্রুত স্বাভাবিক হোক অশান্ত পৃথিবী। থেমে যাক রোষানল। গেয়ে উঠুক বসন্ত পাখি জীবনের কথা নিয়ে।   

মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪২৮

আনন্দ বসন্ত সমাগমে.....


মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)


প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা,  প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন  সংখ্যা ১৪২৮



এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 

চিত্রা পাল, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, দেবদত্তা বিশ্বাস, বটু কৃষ্ণ হালদার, শ্রাবনী সেনগুপ্ত, অলকানন্দা দে, উত্তম দেবনাথ, বিজয় বর্মন, রীনা মজুমদার, প্রনব কুমার কুন্ডু (রুদ্র), সংগীতা মিশ্র, মজনু মিয়া, অদ্রিজা বোস, অমিতাভ দাস,  তানভী দাম



বসন্ত গদ্য 


বসন্ত তার গান 

চিত্রা  পাল                              

          বসন্ত আগত দ্বারে। শ্রী পঞ্চমী, সরস্বতী পুজোতেই ধ্বনিত হয় বসন্তের আগমন বার্তা। সেজে ওঠে অশোক কিংশুক তার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণে। পলাশ শিমূল রঙ লাগায় বনে বনে। করবী সাড়া দেয়, শিরীষে জাগে শিহরণ। পুলকিত আম্রকুঞ্জ তার নব মুকুলের উচ্ছ্বাসে। নব পত্র শাখায় দোলা দেয় দখিন বাতাস। পৃথিবী আবার সেজে ওঠে তার মায়াময় নবীন সাজে। সে মায়ার পরশ লাগে আমাদের হৃদয়তলে।

     এমনভাবেই চলেছিলো প্রকৃতির আবর্তন। মাঝে এলো সব তচনচ করা করোনা মহামারি। সে মহামারীতে জীবনের জয়গানের পরিবর্তে বেজে উঠলো মরণের জয়গান।চারদিক থেকে ধেয়ে আসে দুঃসংবাদ। এখন আবার তাকে সরিয়ে  আমরা জেগে উঠেছি বসন্তের গানে। বসন্ত তার গান দিয়ে আবার আমাদের কোন মন্ত্রবলে জাগিয়ে তোলে,জানি না। তবে ধূলির পরে তার পরশে যে প্রাণ জেগে ওঠে সেই পাওয়াতে ধন্য হয় ধরা, ধন্য আমরা।    



আনন্দ বসন্ত সমাগমে
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

কোন এক অদৃশ্য হাত এক ঝটকায় লেপ, কাঁথা,কম্বল খুলিয়ে দিয়ে প্রকৃতি কে অপরূপ সাজিয়ে তোলে, সেটাই বুঝি বিশ্বের সব থেকে বড়ো বিস্ময়। শীতের আগমণী হিমেল বাতাসের স্পর্শ ঝরা পাতাদের সান্ত্বনা দেয়। হলুদ সরষের ক্ষেত ফুলে ফুলে ঋতুরাজ  বসন্তের অভিষেক মহাসমারোহে ঘোষিত হয়। 

গ্রামে দিঘির পাড়ে হরিতকী গাছের সবুজ কচিপাতার ফাঁকে সবুজ টিঁয়া পাখির লাল ঠোঁটের ঝিলিক,  দূর থেকে কোকিলের কুহুরব মন কে উদাস করে তোলে।  ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতির রঙ বদল এবং সাজসজ্জার আড়ম্বর মানুষের হৃদয় কে অন্তরের থেকে নাড়িয়ে তোলে। 

বসন্ত  পঞ্চমীর  প্রতীক্ষার  দিনগুলো  শেষ  হয়ে " খোল দ্বার খোল" এর আহবান ধ্বনিত হয়।
স্থলে জলে বনতলে দুলে ওঠে রঙিন বসন্ত দূর থেকে শিবচতুর্দশীর মন্দিরে বেজে ওঠে ঢাক। কচি কাচারা নেচে ওঠে কবিগুরুর গানের সাথে সাথে, 

 " নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগলো "।      

   


আজ বসন্ত দ্বারে দ্বারে
দেবদত্তা বিশ্বাস 

                 
                 আকাশ রঙা ওড়না গায়ে মেখে,মাথায় আগুন রঙা পলাশের গোছা ভরে সীমন্তিনী আজ বাসন্তী আবেগে ভাসতে চেয়েছিল সারাটা দিন। আজ বসন্ত পূর্ণিমার চাঁদে সোনালী রঙের আভা ছড়ানো বসন্ত উৎসব ,হোলিকা দহন শেষে অশুভ বিনাশের বসন্ত উৎসব, বাতাসের গায়ে আবিরের রঙিন পরত মাখানো বসন্ত উৎসব। কিন্তু সকাল থেকে উৎসবের সাথে কোনও ফোন আলাপ হয়নি সীমন্তিনীর। গতকাল গভীর রাতে ওদের গোপন প্রেমের গল্পে জমেছিল কালো মেঘের ঘনঘটা। ওদের রঙিন পৃথিবীটা রংহীন গাম্ভীর্যে এই বসন্তে আগাম কালবৈশাখীর ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে এসেছিল গভীর রাতে। সকাল হতেই তবু পেশার খাতিরে সীমন্তিনী পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে শহরের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে খবরের নেশায়।
               বসন্তের প্রেম রং গায়ে মেখে প্রেমাস্পদের ছোঁয়া মেশানো শিহরনে আজ  তরঙ্গায়িত অসংখ্য কপোত কপোতী মন। হাজার হাজার রামধনুর ভিড়ে কোথাও যেন উদাস মনে সীমন্তিনী আজ। মান অভিমানের পাল্লা নিজের দিকে টেনে নামিয়ে হয়তো বিজয়ীর শেষ হাসিটা হাসতে চায় সীমন্তিনী ও উৎসব উভয়ই। আগুন রঙা ফাল্গুনের হাসির যবনিকাপতন ঘটে এক টুকরো দমকা মেঘের হঠাৎ বারিপাতে। এদিক সেদিক ছোটাছুটিতে আজকের উল্লাসেরা হাত ধরাধরি করে কেউ কেউ ছাদ খুঁজে পায় মাথার উপর। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে এক অশক্ত পঙ্গু প্রেমিক। শক্ত হাতে তাকে আগলে রাখে প্রেমিকার প্রেমের উষ্ণতা। লাল, নীল ,হলুদেরা গা থেকে ধুয়ে জলে মিশে যায় এক এক করে। তবু ভালোবাসার আভা ওদের জড়িয়ে থাকে নিজের ইচ্ছে মতো। রঙিন ইচ্ছেডানায় ভর করে বসন্ত সাজায় ওদের মন।

              বৃষ্টিস্নাত সীমন্তিনী নতুন করে খুঁজে পায় নিজেকে। পলাশ রঙে মন রাঙিয়ে বৃষ্টির সাথে সাথেই ধুয়ে ফেলে যত অভিমান। মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি ঝুঁকি দেয় এক ফালি সূর্য। পৃথিবী আবার মাতে বসন্ত উৎসবে। সীমন্তিনীর মোবাইলে রিংটোন বাজে । পর্দায় ভেসে ওঠে উৎসবের নাম। সীমন্তিনী অসংখ্য রঙিন অবয়বের কলতানের মাঝে অনুভব করে আজ বসন্ত দ্বারে দ্বারে।





বসন্ত এলে মনটা আবির রঙে রঙিন হয়ে ওঠে
বটু কৃষ্ণ হালদার

"পলাশ ফুলে রং ধরেছে ভাসছে খুশির ভেলা/ ওই দেখো ভাই সময় এলো দোল পূর্ণিমার মেলা/নদীর জল শান্ত এখন নৌকা ভাসায় পাল/ বসন্তের রঙে রঙিন হলো নববধূর গাল"। করোনা ভাইরাস আতঙ্কে ভুগছে সমগ্র বিশ্ব। মৃত্যুর হাতছানি কে উপেক্ষা করেও পরিবেশ সেজে ওঠে তার আপন খেয়ালে।প্রকৃতির ঋতু বৈচিত্র্যর  খেলায় শিমুল পলাশের আগুন রাঙানো পথ ধরে বসন্তের আগমন ঘটে। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু ছোট্টবেলার সেই দোল খেলার অনাবিল আনন্দ আজ খুব মিস করি। দোলের আগের দিন ন্যাড়াপোড়া কে কেন্দ্র করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দ উচ্ছাস আজ অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। আমাদের সময়টা এমন ছিলনা। দোলের আগের দিন ন্যাড়া পোড়া নিয়ে উচ্ছ্বাস আর উন্মাদনার শেষ থাকতো না। সকাল থেকে বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করা হত কিভাবে রাতে পালন করা হবে। সবাই মিলে গাছের শুকনো ডাল জোগাড় করতে ব্যাস্ত থাকতাম তার সঙ্গে এর ওর বাড়ি থেকে নাড়ার গাদা থেকে শুকনো নাড়া চুরি করে ফাঁকা জায়গায় জড়ো করতাম এই ন্যাড়া পোড়ার বিশেষ আকর্ষণ ছিল সন্ধ্যা বেলা। সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয়ে যেতো এর ওর বাগান দিয়ে সব্জি চুরি করা। রাতে সেই শুকনো গাছ গাছালির ডাল জড় করে আগুন জালিয়ে,চুরি করা টমেটো, আলু, বেগুন আগুনে ফেলে দিয়ে পড়ানো হতো। পোড়ানো শেষ হলে আগুন দিয়ে বের করে মজা সহকারে খেতাম, এই মজাটাই ছিল অন্য রকম। রাত বাড়তেই শুরু হতো ডাব, নারকেল চুরি করার পালা। অনেকেই নারকেল গাছে খেঁজুরের কাঁটা দিয়ে বেঁধে দিতেন। কেউ বা কালো আলকাতর মাখিয়ে দিতেন গাছে। আমরাও নাছোড় বান্দা তক্কে তক্কে থাকতাম কখন পাড়া নিস্তব্দ হবে। রাতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে কানমলা খেয়েছি কত, আবার কাঁটার আঁচড় ও খেয়েছি।গাছ থেকে পড়ে গিয়ে নন্দর  হাত ও ভেঙে যায়। তাতে কি, এ অনাবিল আনন্দের ঢেউ বর্তমানে কেড়ে নিয়েছে মোবাইল, টিভি। কর্ম সূত্রে সবাই বিভিন্ন জায়গায় থাকে। তবে সেই দিন গুলি খুব মিস করি আজও। ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখে জল এসে যায় তা বুঝতেই পারি না।
ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত…।’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা কবিতার পংক্তি টি আরো একবার বসন্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আধুনিক কোনো কবি বলতে পারেন,মনে নিরানন্দ।তাতে কী? আজ বসন্ত, পহেলা ফাল্গুন।
কবির শঙ্কা থাকলেও এবারও ফুল ফুটেছে। দখিন হাওয়ার গুঞ্জরণও লেগেছে। ফাগুন হাওয়ার দোল লেগেছে বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতে। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে প্রকৃতির সবুজ অঙ্গন। মাঘের শেষ দিক থেকেই গাছে গাছে ফুটছে আমের মুকুল। শীতের খোলসে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্কন এখন অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ জানিয়ে দিচ্ছে বসন্ত এসেছে। এবং সত্যি সত্যি সে ঋতুর রাজা।বসন্তের সঙ্গে সেজে ওঠে পরিবেশ,মানুষের হৃদয় রঙিন হয়ে ওঠে,তার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ ঘন হয়ে ওঠে শান্তিনিকেতন।এই শান্তিনিকেতন হল বিশ্ব তথা বাঙালির বড় আবেগের স্থান,হৃদয়ের সঙ্গম স্থল।এখানের বসন্ত উৎসব হলো জগৎ বিখ্যাত। যার টানে বিশ্বের মানুষ ছুটে আসেন গুরুদেব তথা আপামর বাঙালির আবেগের স্থানে। এ সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে পশ্চিম বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য র ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে। যা বাঙালি হিসাবে অত্যন্ত গর্বের বিষয়।এই শান্তিনিকেতনের প্রাচীন ঐতিহ্য কে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে একদল শিক্ষিতের নামে অসভ্যের দালোদাস রা।যা বাঙালির অহঙ্কার তা কলুষিত করতে চাইছে একদল শিক্ষিত অথচ নির্বোধ,অপসংস্কৃতির দালাল রা।তবে গুরুদেব সবার হৃদয়ে ছিলেন,আছে,এবং যতদিন বিশ্বে সাহিত্য চর্চা হবে ততদিন গুরুদেব ও শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতি গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে।
দোল মানে হলি,যা সাহিত্যের চোখে প্রেমের মাস।কবির কবিতায়,পদ্যে,গদ্য, গল্প তে কল্প কাহিনী তে মাখামাখি হয়ে ওঠে।তাই তো এ সময় কবি জয় গোস্বামীর বসন্ত উৎসব কবিতা টি মনে পড়ে যায়_"কাকে  তুলে দিতে গেছি ভোরবেলা ট্রেনে/দোলের পরের দিন/গাছে গাছে তখনও আবির"। নেড়া পোড়ার পরের দিন দোল।অর্থাৎ আবিরে আবিরে মাখামাখি। সে সময় পয়সা ছিল না। কিন্তু ভীষন আনন্দ ছিল। রঙ ফিচকারির কথা বলতেই বাবা রেগে আগুন হয়ে যেত। তাই আগে থেকে ছোট বাঁশ কেটে জলে ডুবিয়ে রাখতেন দোলের দিন সকালে জল দিয়ে তুলে ছোট কাকা ফিচকারি বানিয়ে দিতেন। দিন বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয়ে যেত উদ্দীপনা। বালতি করে আবির কিম্বা লাল কালো রং গুলে  খেলা শুরু করে দিতাম। রঙ শেষ হয়ে গেলে কাদামাটি দিয়ে টা চলতেই থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা। এরপর শুরু হতো খালে কিংবা পুকুরে সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতা। চেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে উঠত। অন্যের দেওয়া রং মেখে ভূত হয়ে থাকতাম। জোকার তার দুটো স্পষ্ট বোঝা যেত। পুকুরে বসে সেই রং তুলতে তুলতে মুখের চামড়া উঠে যে। কারো কারো আবার স্নান করে জ্বর চলে আসত। সেসব দিনগুলো কি আজ ভোলা যায়?



আনন্দ বসন্ত সমাগমে
শ্রাবনী সেনগুপ্ত

শীতের পাতা  ঝরার দিনের শেষে তোমার আগমন।সবটুকু শুষ্কতা শুষে নিয়ে নিজের বুকের সরসতাটুকু ঢেলে সাজাও ধরিত্রীকে।একটু একটু করে আবার রং পায় সে।তাকিয়ে দেখি-নিষ্পত্র ডাল ভরে যায় কচি পাতায়-একটি দুটি করে একে একে আগুন ছড়ায় রুদ্র পলাশ। চোখ ধাঁধিয়ে যায়-আহা!আকাশের বুক চিরে সাদা মেঘের আনাগোনা,রাস্তায় খসে পড়া কৃষ্ণচূড়াকে সযত্নে পাশ কাটাই ,যেন পায়ের তলায় পিষে না ফেলি তার লালিমাটুকু।শীতের নিষ্প্রাণ প্রকৃতিকে দেখে ক্লান্ত চোখ আরাম পায় তোমার আগমনে।কবিগুরুর ভাষায় -নব আনন্দে জেগে ওঠে মন ,প্রাণ, প্রকৃতি।কোকিল কুহুরবে খোঁজে তার সঙ্গিনী।আমরাও মেতে উঠি হোরি খেলায়-ফাগুন রঙে রাঙিয়ে নিতে মন।মন আকুল হয় ভালোবাসার জন্য।তোমার কাজল কালো চোখে হারিয়ে যেতে চাই।তোমারও কি বসন্তের হওয়ায় মনে পরে আমায়?শঙ্খচিলের ডানায় ভর করে পাড়ি জমাই তোমার কাছে।আবির রাঙানো কপোলে ছুঁইয়ে দিই ভালোবাসা।আহা কি আনন্দ হৃদয়ের পেয়ালায় তুফান তোলে।তারপর রঙীন ফুলের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ,পাখিদের কলকাকলিকে সাথী করে পথ হাঁটি আমরা হাতে হাত রেখে মায়াভরা  পৃথিবীর বুক বেয়ে।এসব ই তো তোমার আসায়- বসন্ত!শিমুল,পলাশ ,রাধাচূড়া সবাই দু'হাত তুলে নাচে, আকাশ তাদের ডাকে।মধুময় পৃথিবী-এঁদো গলিতেও কামিনীর সুবাস।তুমি অসুন্দরকেও করে তোলো সুন্দর।মায়ায় ভরে ওঠে চতুর্দিক।কক্ষপথে অবিরাম ঘূর্ণায়মান পৃথিবী নবীন পল্লবে ফুলে ফুলে সেজে ওঠে ,ঈর্ষান্বিত হয় অন্য ভ্রাম্যমানেরা। ঋতুরাজ, তোমার আগমনে সমস্ত প্রকৃতিতে রঙ ভেজানো তুলি থেকে ঝরে পরে টুপটাপ ।।প্রতিদিন নতুন নতুন কুঁড়ির,নতুন প্রাণের জন্ম দাও তুমি।বসন্ত,তুমি আমাদের দাও ভালোবাসা-অপার আনন্দ-যার থেকে ভাল আর কিছু হয় না।



পলাশের মাস
অলকানন্দা দে


শীতের উপন্যাস শেষ হয়ে এলে সাংবাদিক হাওয়া খবর শোনায়  ঝাউবন শাল তমালের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে বিনীত বসন্ত বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে বিশুদ্ধ নিখিলের প্রতি। দিনলিপি বদলে যাচ্ছে অজান্তেই। খুব সূক্ষ্ম এক প্রেমের সিম্ফনি চুপেচুপে বাজে দৈনন্দিনে। ভালোবাসার নহবত বসে পলাশের সংসারে।বসন্তকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটাই তাই রেওয়াজ। নতুন ফাগুনে পুরোনো কোকিল সরব হয়,সুর মিলে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়। অদ্ভুত ছন্দটি তার নিজস্ব সৃষ্টি। কি নাম দেব এ গানের! মনে হয় জিজ্ঞেস করি এত ঢঙ্ তুমি শিখলে কোথায়? তোমার অভিমানে যে ভেসে যায় গেরস্ত ঘরবাড়ি! আটকে পড়ি সকালবেলার ছলাকলায়। সময়গুলো জমকালো খুব,সমৃদ্ধে ভরা! যেমন তেমন দুপুর হাওয়ায় কি যেন এক আকাঙ্ক্ষার গন্ধ ভাসে। ঠিক বুঝেও বুঝিনা, কিন্তু বড় চেনা চেনা। ইচ্ছেপূরনের লম্বা ফর্দটা সকাল নেই বিকেল নেই বুনোহাওয়ায় ঘোরেফেরে। নিজের মধ্যে থাকতে ভালোলাগে। মনে মনে কথা বলতে বলতে দিশেহারা হওয়া এক অন্য পর্যায়ের অনুভূতি।জড়িয়ে ধরা বিকেলবেলাকে জানলায় বসে উপভোগ সেও তো দৃষ্টির আনন্দ এক। দিক-হারানো নজর কৌতুক করে বলে, ”কবে যে কখন এগোলো বয়স নিঃশব্দে কাজের ফাঁকে,চাল-ডাল-নুন-তেলের গল্পে গল্পে হিসেব রাখেনি তোমার অঙ্কের করতল তাই না?” ন্যায্য কথাই তো, পাপ-পুণ্য মাথায় করে অনেক বসন্তই তো এলাম পেরিয়ে তবু বসন্তের কি যেন এক বিশেষ বিবেচনা আছে যা আর কারও নেই। ভালোবাসার অভিমান নিয়ে কড়া নাড়ে শুভময় সংসারে,চিরকাল বাড়ায় প্রেমের গতি। মোটকথা,জড়ো হয় উৎসব..আঁচলে লাবণ্য বেঁধে! একাত্ম হয় পৃথিবী। এই যে সবাই মিলে ভালো থাকা এরকমই বেশ নয়? বড় বেশী বিশ্বাসী ঋতু যার বাঁকে বাঁকে আছে প্রেমের পান্থশালা।

এই সমবেত ভালোলাগা কেঁপে ওঠে গানে-কবিতায়। হাওয়ায় কান পাতলেই শোনা যাবে “আমার আপনহারা প্রাণ আমার বাঁধনছেঁড়া প্রাণ..!!” শুধু অভ্যাসের আদেশে যাপিত দিনগুলো বাসন্তী শুভেচ্ছা পেয়ে খোঁপায়  সাজায় কাগজফুল। যত গল্প তাই সেরে নেব আজই। পাগলামির আদর্শ বেলা, বেহিসেবী না হলে কি মানায়? পালিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র আছে যে! আশার টুকরোগুলো মুক্তি পেতে চায়!




বসন্ত পদ্য 

ফিকে  রং
উত্তম দেবনাথ

বসন্ত এলে 
বুকের কোণে কী যেন জেগে ওঠে---
শিমুল ফুলের মতো অবহেলায় ঝরে পড়া
উপলব্ধি গুলো সবুজ ঘাসের মতো বেড়ে উঠতে চায়।

প্রশ্নপত্র শেষে
ব্যর্থ ব্যথা লেবু ফুলের মতো ফুটে থাকে,
কাঁটা দিয়ে ঘেরা ফুলের চারপাশে মৌমাছি
শুধু ওড়ে ওড়ে বেড়ায় অব্যক্ত যন্ত্রনা লুকিয়ে।




আজ ফাগুনে
বিজয় বর্মন

তুমি শুধু খুঁজে ফেরো উদাসী হাওয়া,
ভালো না থাকার বাহানা,
বারবার ফিরে দেখি তোমার মুখ।

এ দায় আমার নয়, খালি অসুখি ভাবনা,
আমি যে ভালো হতে চাই,
ভালোবাসতে চাই।

ফিরে পেতে চাই,সরস প্রান্তর,শিশির বিন্দু,
নদী গান ভাসি,
চলো সবুজ মাখি বনানী পাড়ে।

মহামারি, রকমারি, ওসব,
তোমারই দেওয়া নাম,
দেখো একবার, সেজে আছি বসন্ত বাহারে।

দহন আছে,সহন আছে,
চক্রাকারে পাতাঝরা, ডাল ভরা ফুল পাতা,
তুমি তো, শেষ জানো না।

পলাশ, শিমুলের রাঙা আভা,
নির্মল আকাশে বাতাসে,
একটি বার মুখ রাখো দর্পণে,চলো ভালো থাকি।



ঋতুর মেয়ে
     রীনা মজুমদার

ঋতুর মেয়ে খোঁপায় তার হলুদ ফুল

আমের মুকুলে ভ্রমরের গুঞ্জন 
 সুরের ঢেউয়ে তাল দিয়ে যায়
 নতুন পাতায় বসন্তের সকাল
    তুমি কান পেতে থাকো-

অরণ্যে ওড়ে শিমুলের পরাগ আবির
রাঙা অভিমান রাঙিয়ে নাও যত
টুপটাপ খসে পড়ে পলাশ তত
    তুমি আঁচল পেতে থাকো-

 চঞ্চলা দুপুর রোদের তীব্র তাপে
হৃদ প্রাঙ্গণে উত্তাল জলরেখায় শূন্যতা 
বসন্তের এলোমেলো হাওয়া চায় পূর্ণতা
   তুমি দরজা খুলে থাকো-

 উঠোন জুড়ে হলুদ গাঁদা ফুল

  ফুল তুলবার ছলে ঋতুর মেয়ে
 কোন অলক্ষ্যে কৈশোর ছুঁয়ে যায়.. 



দাঁড়াবো কোথায়?
প্রনব কুমার কুন্ডু (রুদ্র)

শীতার্ত অরণ্য ছেড়ে উষ্ণ বাতাস ঢুকেছে হৃদপালে
বৃক্ষের ক্যাবারে শেষে মতিচ্ছন্ন প্রেম বাঁধভাঙে
ভিতর বাহিরে শীলিত যাচনা, আনন্দ বসন্ত দ্বারে
অনিশ্চিত মিলনের বিরহী আবেগ বিচলিত ঘরে।

ধীর পায়ে রূপ-গন্ধে সে কি দাঁড়িয়ে দুয়ারে?
অবিমিশ্র প্রেমস্নেহ মায়াডোরে এসো নারী বন্ধ করি আলো
অপরিমেয় মূর্ছনায় তোমার নিঃশ্বাস এশ্বাস ভরে
অমৃতলোকের দিব্যসুখ মনে, পৌঁছে যাচ্ছি অন্য জন্মে।

দুই কূল যাতায়াতে আঘাত অসীমে মুখস্রাব ওঠে
আরণ্যক ঠুংরির রসে মহামারী, যুদ্ধরও দর বেশ
নারী, কতকাল এভাবে চোখের জল ছূঁয়ে যাবে দ্বেষ?
বিনাশ ধ্বংস খেলায় পরাণ জড় মাংসপিন্ডের স্তূপ।

উল্লাস ঢেউয়ে ট্যাঙ্কের চাকায় বারুদ নিপুণ ল্যান্ড করে
নারী, এ বসন্তে তোমার সঙ্গতে সুরাপাত হাতে-
বিবেক দুয়ার এঁটে আমি ঘুমিয়ে পড়তে পা-আ-আ-রি?



বসন্ত
সংগীতা মিশ্র

স্নিগ্ধ আলোর 
শান্ত কায়া হয়ে
বসন্ত এলো ভবনে
চিত্ত পুলকিত পলাশের 
সুখময় রঙ ছড়িয়ে
এই লাবণ্যময় জন-অরণ্যে 



লাগলো আগুন মনের বনে
মজনু মিয়া 

জোয়ার এলে নদীর জল ফোলে উঠে
দু'কূল ছাপিয়ে জলেরা চৌদিকে ছুটে।
মাছেরা যে খুব করে লাফালাফি করে
নয়া জলে আনন্দ হয় মন ঘরে।

পাখিরা ফুলে ফুলে ঘুরে মধুর সুরে
গান করে মন ভরে বসন্ত দোরে।
মাতাল বাতাস এলোমেলো শনশন
লাল হলুদ ফুলে ভ্রমর ভনভন।

প্রেয়সীর গাল হয় লাজুক রঙিন 
একা থাকা ভালো লাগে না চায় সঙিন। 



বসন্ত ছবি 


অদ্রিজা বোস 



















অমিতাভ দাস 























তানভী দাম

















মুজনাই অনলাইন ফাল্গুন সংখ্যা ১৪২৮

No comments:

Post a Comment