Sunday, September 4, 2022



পর্ব- দুই 
গল্প 



সম্পাদকের কথা

অতিমারি অতিক্রান্ত। জীবন আবার স্বাভাবিক গতিতে। তবে আগের সেই ছন্দ নেই আর। তাই নিউ-নর্মালের এই পুজো একেবারেই অন্যরকম এবার। প্রত্যাশিতভাবে সকলেই অপেক্ষা করে আছে তার। ইতিমধ্যে ইউনেস্কোর বিশেষ স্বীকৃতি পাওয়ায় বিশ্ববাসীর দৃষ্টি রয়েছে এই উৎসবের দিকে। তাই সব মিলে উৎসবের আবহ শুরু হয়ে গেছে। নিজের মতো করে পুজোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই। মুজনাই পুজোর আগাম শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। প্রার্থনা করছে, সকলের পুজো ভাল কাটুক। একই সঙ্গে আশা রাখছে, মা দুর্গার আশীর্বাদে অশুভ দূর হবে। শুভশক্তি সকলের মঙ্গলবিধান করবে। প্রতিনিয়ত যে টালমাটাল পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে মানবকূল, তা কেটে গিয়ে আসবে এক নতুন দিন।  


  

মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক) 

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই অনলাইন পূজা  সংখ্যা ১৪২৯


সূচি 

বিপ্লব তালুকদার, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, অম্বরীশ ঘোষ, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, বুলবুল দে, শক্তিশঙ্কর পানিগ্রাহী, মনোমিতা চক্রবর্তী, বিনয় বর্মন, কবিতা বণিক, চম্পা বিশ্বাস, সোমা দে, কাকলি ব্যানার্জী মোদক, মজনু মিয়া





গল্প 


বিসর্জন
 বিপ্লব তালুকদার

পুজো আসলেই রাজীবের মনটা খুব উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কত কথা কত স্মৃতি ভেসে আসে, ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারে নি। চা ওয়ালার হাঁক ডাকে ঘুম ভেঙে গেল, চলে এসেছে প্রায় নিজের গ্রামের কাছাকাছি। আর একটা স্টেশন পরেই নিজের গ্রাম।যখন সে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা পাড়ি দেয় তখন মিতা এসেছিল তাঁকে বিদায় জানাতে সবার সঙ্গে। সবাই জানতো তাঁদেরসম্পর্কের কথা, চাকরি পেলেই বিয়ে হবে। এই পুজোর সময় তাঁদের পরিচয়।
     "কি ব্যাপার দেখছেন না সামনে অনেকে আছেন, এভাবে ধাক্কাধাক্কি করলে কিভাবে অঞ্জলি দেবো? "রাজীবের উদ্যেশ্যে মিতা বলেছিলো । সন্ধ্যা বেলা আবার দেখা দুজনের, এবার রাজীবই সকালের ব্যাপারটা সামলে নিয়ে বলে পুজো দেখবেন তো চলুন একসঙ্গে দেখি।  ইস বয়ে গেছে আপনার সঙ্গে পুজো দেখতে ,আর তাছাড়া আপনার সঙ্গে তো সেভাবে পরিচয় হয় নি। "ও এই কথা..আমি রাজীব চ্যাটার্জি, ওই যে বড় গাছটা দেখছেন তার পাশেই আমাদের বাড়ি। মা ছাড়া আর কেউ নেই তিনকুলে। 
আমি মিতা ..ওই বড় দালান বাড়ির পাশেই আমাদের বাড়ি। আস্তে আস্তে পরিচয় গল্প ধীরে ধীরে প্রেম। ছেলে হিসেবে রাজীব খুব ভালো ,লেখাপড়ায় উচ্চ শিক্ষিত । আগামীতে বড় চাকরি পাবে এইসব ভেবে মিতাদের বাড়ি থেকেও কোনো আপত্তি উঠে নি। যখনই ছুটি মিলতো রাজীব আসতো বাড়িতে, দুজনে কত গল্প হতো। শেষবার যখন বাড়ি এসেছিল তখন রাজীবের চাকরি হয়ে গেছে। কত পরিকল্পনা দুজনের, পুজোর পরেই বিয়ে দুজনের। কিন্তু কোথায় যেন একটা কালো মেঘ করছিল। গ্রামে এসে হাজির একটা বাবার পয়সাওয়ালা ছেলে, টাকা ওড়াতেই জুটে গেলো গ্রামের কিছু চ্যালা। কোনো কাজ নেই সারাদিন শুধু গ্রামের লোকের ক্ষতি করে বেড়ানো,কার ক্ষেত নষ্ট করা, কারো বা পুকুরে বিষ ঢেলে মাছ নষ্ট করা। আর বিকেল হলেই স্কুল ফেরত মেয়েদের টোন করা । ধীরে ধীরে এসব নিয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ তৈরি হচ্ছিলো ,একদিন সবাই মিলে মোড়লের কাছে এর বিহিতের জন্য উপস্থিত হলো। সব শুনে মোড়ল এবারের মত ব্যাপারটা মিটিয়ে দিলো এবং সাবধান করে দিলো আর যেন এরকম না হয়, তাহলে কিন্তু গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। কিছুদিন ঠিকঠাক চলার পর আবার যে কে সেই, আবার সেই অত্যাচার শুরু হলো। একদিন স্কুলের মেয়েদের পেছনে ছেলেদের দল আসতেই রুখে দাঁড়ালো মিতা। সবাই মিলে একজোট হয়ে তারা করতেই ওরা পালিয়ে গেলো। কিন্তু মিতা পরে গেল তাঁদের নজরে।মিতা বুঝতেও পারলেও না ওর জন্য কি বিরাট ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। মহালয়ার রাতে সবাই পিকনিকে মশগুল ,এমন সময় মিতার এক বান্ধবী এসে বলল তাঁকে কেউ ডাকছে। মিতা বুঝতেও পারলো না বাইরে সব হায়নার দল অপেক্ষা করে আছে, ও বাইরে বেরোনোর সাথে সাথেই ওকে মুখে কাপড় গুঁজে তুলে নিয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর সবাই মিতার খোঁজ করতে লাগলো ,সারারাত খুঁজেও কেউ কোনও খবর পেলো না। পরদিন সকালে একজন খবর দিলো নদীর পাড়ে একটি দেহ পরে আছে, শুনে সবাই গিয়ে দেখলো এ যে মিতার মৃতদেহ।সারা শরীর ক্ষত বিক্ষত। সারা গ্রামের মানুষ আজ মিতাদের বাড়িতে । থানা পুলিশ হয়ে ময়নাতদন্তের পর দেহ এলো বাড়িতে। সবাই অপেক্ষা করছে কখন রাজীব আসবে। ওকে এসব কিছু বলা হয় নি, শুধু বলা হয়েছে তাড়াতাড়ি বাড়ী আসতে। 
      রাজীব ভেবেছিলো বোধহয় ওর মায়ের শরীর খারাপ, ট্রেন থেকে নেমেই তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখল তাঁর মা সুস্থ আছেন। তারপর সব শুনে ছুটে গেল মিতাদের বাড়ি। সব দেখে ভীষণ ভেঙে পড়ল,তারপর আস্তে আস্তে মিতার শেষ যাত্রা শুরু হলো। 
     তার আগে মিতার সিঁথিতে সিঁদুর ছুঁয়ে দিয়ে ওর কথা রাখলো। এ যেন বোধনের আগেই বিসর্জন ঘটে গেলো। 
    এরপর রাজীব ওর মাকে নিয়ে চিরদিনের মতো গ্রাম ছেড়ে কলকাতা ফিরে গেলো। পরে রইলো সব স্মৃতি । 




আত্মকেন্দ্রিক 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

বামুন পাড়ার দিঘির পাড়ে ঝুরি নামা বট গাছের পাশে, দোতালা বাড়িটার সামনে অনেক লোকের ভীড়। সুন্দর এই মস্ত  বাড়িটার সামনে কেউ কখনো এত মানুষ একসাথে  দেখে নি।সাত সকালে  ভিড় দেখে সবাই হামলে পড়েছে।  দু' একজন বাইক আরোহী একটু থেমে কি ব্যাপার জেনেই আবার সাই সাই শব্দে বাইক চালিয়ে চলে যাচ্ছে। উঁকি ঝুঁকি মেরে যতটুকু বোঝা গেল,  বাডির মালিক গতকাল রাতে  হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেছেন, না ফেরার দেশে।

 গাইঘাটা ব্লকের কলাসীমা এক শান্ত সবুজ গ্রাম। ইঁটভাটা ও টালির কারখানার জন্য কলাসীমা গ্রাম বিখ্যাত।  একরের পর একর সবুজ ধানের ক্ষেত। সবুজ, শিশু, গামারি, শেগুন  গাছের  ঘেরা যশোহর রোড। সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে বাস ট্রাক বনগ্রাম অভিমুখে। কিছু কিছু গাড়ি পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে চলে যায় বাংলাদেশ।  গ্রামে  দু- একটা ইঁটের পাকা বাড়ি থাকলেও,  টালি এবং টিনের চাল দেওয়া বাড়ির সংখ্যাই বেশি। 

সুরকি বিছানো বামুন পাড়ার রাস্তায়,  পথচারীরা তাদের  ব্যাস্ততার মধ্যেও উঁকি দিয়ে খোঁজ নিয়ে  যাচ্ছে।  কেন এত ভীড়। কারও কারও মোটেই সময় নেই, বাড়ির গেটে লোকজন দেখে দূর থেকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। হাতে যে তাদের একদমই সময় নেই। 

একদমই সময় ছিল না  ভব বাবুর । এই মস্ত বাড়িটার মালিক ছিলেন ভবেশ দাস। সারাজীবন বহু অর্থোপার্জন করেছেন।  সব সময় গ্রামের মানুষকে  পাশ কাটিয়ে গেছেন।  কখনো কোনো প্রতিবেশীর সাথে মিশতেন না।  সারাজীবন নির্বান্ধব এই মানুষটি, বিদেশ বিভুঁয়ে ঘুরে  বেড়িয়েছেন। অহংকারের বশে মানুষকে মানুষ জ্ঞান না করা তার চরিত্রের এক বিশেষ দিক ছিল। সেবার পাড়ায়  এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে পাড়ার ছেলেরা আমন্ত্রণ জানাতে গেলে, বাড়ির দোতালার ব্যালকনিতে  দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, " আমি চাঁদা দিই না, তোমরা আমাকে বিরক্ত করবে না।" একথা শোনবার পর গ্রামবাসীরা সবাই বিরক্ত হয়েছিলেন। তারপর থেকে   কেউই, বড় একটা ওনার বাড়ি মাড়াতেন না। 
কিছু দিন ধরেই ওনার স্ত্রী অবসাদে ভুগছিলেন।  সবাই বলেন,  ভববাবু অনেক বিষয়ই গোপন করতেন। তার বিষয় আসয় সম্পত্তির বিষয়ে স্ত্রী কেও ঘুনাক্ষরে জানাতেন না।সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, জাপান প্রভৃতি দেশ ঘুরে বেড়ালেও স্ত্রী 'র মনে শান্তি ছিল না। সেকথা রান্নার মাসি লাবন্যের মুখ থেকে সারা পাড়া রাষ্ট্র হয়েছিল। 

সেবার ইউরোপ ভ্রমণ শেষে দিল্লি এয়ারপোর্টে নামার আগে ভববাবু কোমরে ব্যাথা অনুভব করেন। রাজধানীর ডাঃ রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালের অর্থপেডিক্স সার্জেন ডাক্তার এস কে আতরওয়ালা   সব দেখেশুনে ভববাবুকে আর  এয়ার ট্রাভেল করতে নিষেধ করে দেন। সেবার  সিদ্ধান্ত হয় শিয়ালদহ রাজধানীতেই তিনি গ্রামের  বাড়িতে ফিরবেন।  

দীর্ঘদিন ট্রেনে যাতায়াত না করবারর ফলে,  ট্রেন ছাড়লে ট্রেনের  হালকা দুলুনিতে ভব দা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সরমা বৌদি জানালার ধারে বসে বাইরের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে বুঝতেই পারেন নি কখন রাত দশটা বেজে গেছে।   খাবার জন্য ভবদা কে ডাকতেই, একলাফে ভবদা বার্থের উপর উঠে বসেই উন্মাদের মতো চিৎকার করতে থাকেন। বোধকরি তিনি  কোন স্বপ্ন দেখছিলেন। ঘুম ভাঙতেই  সব বার্থে সারি সারি সাদা চাদর জড়ানো যাত্রিদের মৃতদেহ ভেবে ভয় পেয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে থাকেন। সেই অবকাশে ভবদার মাথার পরচুলা খুলে সুবিশাল টাকমাথা বেরিয়ে পড়ে।  সেই ঘটনায় সরমা বৌদি ও তার স্বামীর অচেনা মুখ দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।

সরমা বৌদি ইউরোপ থেকে ফিরে কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। তার পর দীর্ঘ অবসাদে ভুগতে ভুগতে গত কোজাগরী পূর্ণিমাতে ঘুমের মধ্যেই পাড়ি দেন না ফেরার দেশে। 
ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে গ্রীলের গেট, দরজার তালা ভাঙতেই দেখা গেল ভববাবুর নিথর দেহ। 

দীর্ঘদিনের অব্যাবহারের ফলে বাড়িটার দেওয়ালে ছত্রাক গজিয়েছে। বাড়ির উঠোনে সাজানো ফুলবাগানে বড়ো বড়ো আগাছা জন্মেছে।আজও পথচারীরা বামুন পাড়ার সুরকি বিছানো রাস্তা দিয়ে যাবার সময়, ঝুরি নামা বটগাছের পাশে "ভবভিলা" র দিকে একবার তাকিয়ে যায়।





মানুষ মানুষ
অম্বরীশ ঘোষ 

          নীতু আর নিধি । বন্ধু  নয় , প্রথমজন মালকিন আর দ্বিতীয়জন বাড়ির কাজের মানুষ । দিন বারো-তেরো ধরে নিধি কাজ করছে । সারাদিন কাজ করে , সন্ধ্যায় ফিরে যায় ।  নিতু সর্বত্র ধোয়ামোছা করতে দেয় নিধিকে , শুধু ঠাকুরঘর বাদে । নীতুর অতি মালকিন ভঙ্গিটা নিধিকে কষ্ট দেয় মনে । কিন্তু ভাগ্য জীবনে এমনটাই লিখেছে । ও কিইবা আর করতে পারে ! নীতুর হঠাৎ শারীরিক সমস্যা হলো ‌।  চার-পাঁচদিন ঠাকুর ঘরে ঢোকা বন্ধ । অন্য সময় চোদ্দ  বছরের মেয়ে রিমি সামলে নেয় পুরোটা । কিন্তু দিন তিনেক অসুস্থ দাদুর দেখাশোনার জন্য ও দাদুর বাড়িতে । সকাল থেকেই পুজো নিয়ে নিতুর মনটা ছটফট করছে । অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের পুরনো ধোয়া পোশাক বের করে দিল নিধিকে । নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে নিধি ঠাকুরঘরে ঢুকলো । মন খারাপ করে নিতু টিভি রিমোট হাতে নিলো ।  পুজো শেষে বেরিয়ে এল নিধি । নিতু বাধ্য হয়ে প্রসাদ নিল । পরবর্তী তিনদিনের রুটিনও নিধির একই থাকল ।  নীতু শুধু অপেক্ষায় রইলো  পুজোর ঘরের পবিত্রতা ফিরিয়ে আনার । চার দিন পার করে নিতু সকাল-সকাল স্নান সেরে বালতি আর মপস্টিক নিয়ে ঢুকলো পুজোর ঘরে । অস্থিরভাবে ভেতরে ঢুকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো নিতু । অসম্ভব একটা পবিত্রতা আর পরিচ্ছন্নতার আচ্ছাদনে যেন পুজোর ঘরটা ঢেকে আছে । এর পেছনে কি বিজ্ঞান , কি দর্শন ও সেটা বুঝলো না । শুধু এটুকু মনে হল যে ঈশ্বরের কাছে বিগত দিনগুলোর পূজা ও প্রার্থনা পৌঁছেছে । বেলা দশটার দিকে যথারীতি নিধি এল ।  প্রথমেই এঁটো বাসনপত্র ধুতে বসল । নীতু একটু দূর থেকে একমনে দেখতে লাগল নিধিকে । স্পষ্টভাবে বোঝা গেল যে ব্যাংক ব্যালেন্স আর বিলাসবহুল সুবিধা ছাড়া ওর আর নিজের মধ্যে মানুষ হিসেবে কোন পার্থক্য নেই ।  নীতুর পরিবর্তিত ব্যবহারে নিধি অবাক হয়ে গেল ।





ইচ্ছেডানা 
 অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী


এদিক- ওদিক বেশ কিছুক্ষণ সুবর্ণাকে খুঁজে একরাশ বিরক্তি নিয়ে রণজয় আবার ফুডমার্টের দিকে পা বাড়ালো। মার্চ মাসের রৌদ্রতপ্ত দুপুর। বইমেলায় এসে পৌঁছেই রূপসা মেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চের একেবারে সামনে গিয়ে হাজির হয়েছে।  মঞ্চে কোনো এক ব্যান্ডের কিছু গায়কের সমবেত গায়কী এখন সপ্তমে। মাথা থেকে মুখ বেয়ে নেমে আসা লম্বা চুলগুলো দুলিয়ে শরীরের বিভঙ্গ তুলে প্রাণপনে, প্রাণ খুলে গাইছে ওরা। আরও কিছু দর্শক শ্রোতার মতো রূপসাও কখনো গলা মেলাচ্ছে ওদের সমবেত গায়কীতে আবার কখনো মুঠোফোনের দামি ক্যামেরায় ধরে রাখছে এই বিশেষ মুহূর্তকে। 'অসহ্য'....মনে মনে ঠিক এই শব্দটি উচ্চারণ করে সেদিকে কটমট করে একবার তাকিয়ে অর্ধেক খাওয়া এগরোলটিতে সযত্নে কামড় বসালো রণজয়। 
রূপসা.. হ্যাঁ, এই রূপসা- ই যত নষ্টের গোড়া। কটাদিন বিয়েবাড়ির ঝক্কির পর সবকিছু একটু শান্ত হতে বেশ একটা ভাতঘুম দেওয়া যেত আজ। তা না,  প্রণব অফিসে বেরিয়ে যেতেই বইমেলা আসবার প্ল্যান করে বসল রূপসা।পিসতুতো দাদার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে দিন সাতেকের জন্য কলকাতায় আসা।প্রণব আর রূপসা সেই পিসিরই আরেক ছেলে আর ছেলের বৌ।'কী উল্লাস!!'.... আর একবার রূপসার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকালো রণজয়। আর সুবর্ণা? বইমেলার নাম শোনা থেকেই তো তিনি হাওয়ায় ভাসছিলেন.. এখানে এসে এই জনসমুদ্রে ভেসে কোথায় যে হারিয়ে গেলেন কে জানে!!  বিরক্তিকর!!মোবাইলের নেটওয়ার্কও কাজ করছে না বইমেলার এই চত্বরে। যাক গে..  আপাতত  খাওয়াতেই মনোনিবেশ করা শ্রেয় মনে করল রণজয়। 
                          সত্যিই, হাওয়ায় ভাসছিল সুবর্ণা।নতুন নতুন বইয়ের গন্ধমাখা নেশাতুর খুশির হাওয়ায়, এক টুকরো স্বাধীনতার হাওয়ায় ভেসে ভেসে বইয়ের স্টলগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল একরাশ আগ্রহ আর রোমাঞ্চ নিয়ে। আজ ইচ্ছে করেই হারিয়ে গেছে সে। বইয়ের গন্ধ নিতে, নিজের মতো করে সবচাইতে ভালো লাগার এই জায়গাটিতে কিছুটা সময়  কাটাতে, ইচ্ছে করে এই লুকোচুরি খেলা ওকে অনেকটা আনন্দ,  অনেকটা অক্সিজেন দিয়ে যাচ্ছিল।এই বিয়ে বাড়িকে উপলক্ষ করে বহুদিন পর বেরোনো হলো চার দেওয়ালের গন্ডি থেকে।কলকাতায় আসা হলো।মায়ের সঙ্গে দেখা হলো অনেকগুলো দিন পর।বিগত দুটো বছর নয় কোভিড থাবা বসিয়েছিল সর্বত্র; কিন্তু তার আগেও বা রণজয়কে নিজের মতো করে পেয়েছে কোথায়! স্বভাবের আশ্চর্য রকম অমিল সুবর্ণা আর রণজয়কে সেভাবে কাছাকাছি করতে পারেনি এতগুলো বছরেও। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা শুধুমাত্র বাঁচিয়ে রেখেছে সুবর্ণাকে। কোল আলো করেও আসেনি কেউ।এই শূন্য জীবনে সুবর্ণার একমাত্র আশ্রয় তাই বই। 
                               সেই ছোট্টটি থেকেই বই ওর সবসময়ের সঙ্গী।যখন যেমন পেরেছে, লাইব্রেরী থেকে হোক, কিনে হোক প্রচুর বই ওর সঙ্গী হয়েছে জীবনের নানান ধাপে। বছরের সবচাইতে আনন্দের সময় সুবর্ণার কাছে বরাবর ছিল শীতকালীন বইমেলা আসবার সময়টি।বিয়ের পর উত্তরবঙ্গ স্থায়ী ঠিকানা হলেও সুবর্ণার জন্ম,বেড়ে ওঠা সবটাই কলকাতায়।বাবার হাত ধরে রঙিন সব বইয়ে ঝুলি ভরিয়ে বইমেলা থেকে বাড়ি ফিরবার আনন্দই ছিল আলাদা।তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইমেলার আসা যাওয়ার  ঋতুবদল ঘটেছে, জায়গা বদলও।ময়দান বা বাইপাসের বদলে সেন্ট্রাল পার্কে এবার বসেছে বইয়ের পসরা। ঋতুর পালাবদল ঘটেছে সুবর্ণার নিজের জীবনেও। বিয়ের পরেও এক আধবার রণজয়ের সঙ্গে  তাদের বসবাসের নিরিবিলি জেলাটির বইমেলাতে গেছে ।তবে বই নিয়ে কোনদিনই বাড়তি কোন উৎসাহ বা আগ্রহ  দেখেনি রণজয়ের মধ্যে। সেখানে গিয়ে তাই সুবর্ণাকে নিজের মতো করে খুব বেশি সময় কাটাতেও দেয়নি সে। 
সুবর্ণার কাছে যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানের সেরা উপহার মানেই বই। বাবা যতদিন ছিলেন, প্রতিটি জন্মদিনে, নববর্ষে,  পুজোয় সুবর্ণাকে বই উপহার দিতেন। বাবার নিজের হাতের লেখায় ছোট একটু করে  'রুমি কে বাবা' কথাটি লেখা থাকত বইয়ের সামনের পাতায়। ওই বইগুলো কাছে নিলে এখনও বাবার অস্তিত্ব টের পায় সুবর্ণা। সে নিজেও কাউকে কিছু দেওয়ার ব্যাপারে বই দেওয়াই সবচাইতে পছন্দ করে। 
                                 আরও সমস্ত বইপ্রেমীদের মতোই বড় বড় করে নাম লেখা, রঙিন সব বইয়ের সাজে সেজে ওঠা প্রকাশনী গুলির প্রায় প্রতিটি স্টলেই পা রাখছিল সুবর্ণা। হাতে সময় কম, তাই চোখ বুলিয়ে একটু আধটু দেখে পছন্দের তালিকার লেখকদের কিছু কিছু বই সংগ্রহ করছিল বেশ দ্রুততার সঙ্গে। ভাবতে বড় অবাক লাগে সুবর্ণার..  যাদের কখনো চোখে দেখেনি, দেখবার কোনো সম্ভাবনাও নেই, শুধুমাত্র তাঁদের নিজেদের লেখার মধ্য দিয়ে তাঁরা এক আশ্চর্য অদৃশ্য যোগসূত্র তৈরি করেন পাঠকদের সঙ্গে। চিরস্থায়ী জায়গা করে নেন পাঠকদের মনে। এমন চিরস্থায়ী আসন পাতা থাকে আরও কিছু ভালোবাসার মানুষের জন্য।   যেমন সুবর্ণাদের পাশের বাড়িতে বছর তিনেক আগে বৌ হয়ে আসা তমা , যে সুবর্ণার দমবন্ধ করা জীবনের জানলার বাইরের একমুঠো খোলা আকাশ।স্বচ্ছন্দে যার কাছে নিজেকে উজার করা যায়।ওর খুব প্রিয় একজন লেখকের সদ্যপ্রকাশিত একঝলক টাটকা বাতাসের মতো সমকালীন ঝরঝরে একটি উপন্যাস হাতে তুলে নিল তমার জন্য।আর বিন্দি.. যে কিছুদিন হলো মায়ের হাত ধরে সুবর্ণার কাছে আসে.. ওর মা বাড়ির কাজগুলোতে কিছুটা সাহায্য করে সুবর্ণাকে.. বিন্দির মায়াবী মুখটি ভেসে উঠল সুবর্ণার চোখের সামনে। বই পড়তে বড় ভালোবাসে বিন্দি। ওর জন্য নিল একটি রূপকথার বই। বিন্দি রাজকন্যা এই রূপকথার বই নিয়ে কল্পনার রাজ্যে পাড়ি দিক..বাঁক ঘুরে তার চোখেই নয় হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট রুমিকে দেখে নেবে সুবর্ণা।মনটা খুশিতে ভরে উঠল। মায়ের সেই কোনকালের সঞ্চয়িতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল প্রাণের ঠাকুরের পরমপ্রিয় বইটি।
                     বসন্তের দুপুর রোদে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল  ওরা। কলকাতা বইমেলা এখন আলোয় আলোয় সন্ধেবেলার উর্বশী হয়ে সেজে উঠেছে। কিছুটা আন্দাজ করতে করতে অজস্র প্রকাশনীর ভিড়ে, অগনিত মানুষের ভিড়ে  মিশে যেতে যেতে এগিয়ে চলল সুবর্ণা। বইয়ের মলাটের ছবি আর গন্ধের ঘোর থেকে হঠাৎ হোচট খেল মাইকের আওয়াজে ভেসে আসা কথাগুলোয়।  'সুবর্ণা বসু, আপনি যেখানেই থাকুন,আমাদের অফিসের কাছে চলে আসুন। আপনার বাড়ির লোকেরা আপনার জন্য এখানে অপেক্ষা করছেন।'.....  
                           হাওয়ায় ভেসে আসা কথাগুলোকে ঢেকে দিয়ে  বইমেলার প্রাণচঞ্চল হাওয়ায় তখন ভেসে বেড়াচ্ছে বইমেলার গান। বইভরা ব্যাগটিকে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে ,  আবারও এমন এক স্বপ্নের মতো, নিজের মতো করে বাঁচবার একটি সুন্দর দিনের প্রতীক্ষায় সুবর্ণা কানপেতে শুনছিল সেই গান। প্রাণভরে আগামীর রসদ করে নিচ্ছিল এই অভিজ্ঞতাকে।বাতাস তখন গাইছে......
'মুঠো ভরা বই আর একমুঠো ধুলো
ফি বছর চলে আসে বইমেলা গুলো...... 
......... আবার আসব ফিরে বইমেলা ভিড়ে.... 
বইমেলা.. হইমেলা.. বইমেলা.. চইমেলা.... 



বাঁধন ছেঁড়া  
 বুলবুল দে

সচ্ছল, উছলে পরা পরিবারের উচ্ছল ছটফটে, ডাগর চোখ, টিকালো নাকের এগারো বছরের শ্যামবর্ণা মেয়েটির গুণপনার যেন শেষ নেই। এই বয়সেই মায়ের সাথে সাথে সংসারের কাজকম্ম ভালই আয়ত্ব করেছে সে। সেলাই ফোড়াই আরও কত রকম হাতের কাজ যে সে জানে তার গোনাগুনতি নেই। সময়টা উনিশশ বিশ সাল হবে। সেকেলের অজপাড়াগাঁয়ের নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত শুধু নয় উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়েদেরও লেখাপড়ার তেমন চল ছিলনা। কিন্ত সেই অত্যুুৎসাহী মেধাবী মেয়ে পাঠশালার বাইরে দাঁড়িয়ে দূর থেকেই অক্ষরের সাথে পরিচয় করে ফেলেছে। এমনকি যোগ বিয়োগ গুণ ভাগও তার নখদর্পণে। পাড়া প্রতিবেশীর চিঠিচাপাটি সেই লিখেপড়ে দেয়। এহেন মেয়ের কিনা বিয়ে হল তিন চারটে গ্রামের পরে, নুুন আনতে পান্তা ফুরায় এমনই এক কৃষক পরিবারের আঠারো বছরের ছেলের সাথে। কারণ সেই একঢাল ঘণ কাল চুলের মেয়ের গাত্রবর্ণ যে ঘোর কালো! শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পরদিনই সেই মেয়ের দুরন্তপনায় অস্থির শ্বশুরবাড়ির লোক তার বাপের বাড়িতে খবর পাঠাল যে পায়ে ক্ষুর লাগানো এ মেয়েকে তারা যেন ফেরত নিয়ে যায় এবং আরও একটু বড় হয়ে ধীরস্থির হলে তবেই যেন পাঠায় শ্বশুরবাড়িতে।   পনেরো বছর বয়সে মেয়েটি আবার পা রাখল শ্বশুরবাড়িতে। সে তখন আগের তুলনায় অনেকটা শান্ত হলে কি হবে ঐ যে কথায় বলে না,"স্বভাব যায়না ম'লে!" চঞ্চলতা যে তার হাড়ে মজ্জায়! গোমড়ামুখো নিরক্ষর স্বামীর কোনও সোহাগ ভালবাসা সে পায়না। স্বামীর কাছে সে শুধুই ভোগের সম্ভার। তাই তার যত ভাব বন্ধুত্ব ঐ মিষ্টি স্বভাবের হাসিখুশি ছোট দেওরের সাথে। কিন্তু তাদের নির্মল বন্ধুত্ব নিয়েও আশেপাশে চলে চাপা কানাঘুষা। একদিকে সেই মেয়ে লক্ষ্মীমন্তের মত মাটিতে একটা ভাত পড়লেও কুড়িয়ে তুলে খায়, আর একদিকে লক্ষ্মীছাড়ী উনুনে ভাত বসিয়ে চলে যায় পাশের বাড়িতে নতুন কোনও ফোড়ের নক্সা তুলতে। এদিকে ভাত গলে জাউ আর কপালে  জোটে ভয়ানক গঞ্জনা। 
           সারা দেশ তখন উত্তাল স্বাধীনতা সংগ্রামের   প্রবল তরঙ্গে, অজগাঁয়ের মেয়েটির কানেও প্রবেশ করে সেই সংগ্রামের কিছু কিছু বার্তা। রক্ত গরম হয়ে ওঠে তারও,বড় ইচ্ছে জাগে সেই সব সংগ্রামীদের চাক্ষুষ দেখার,তাদের বক্তৃতা শোনার। এরই মধ্যে মেয়ে একদিন পোয়াতি হল। কিন্তু কোনও বিধিনিষেধই যে মানার পাত্রী নয় সে। একদিন শুনলো স্কুলবাড়ির মাঠে এক বিপ্লবী আসবে। পোয়াতি বৌ স্বামী শ্বশুরের কথা অমান্য করে মাইল খানেক পথ হেঁটে জ্বালাময় বক্তৃতা শুনে
এল। সেই থেকে তার সারা শরীরে জ্বালা, মনটা বড়
অস্থির অস্থির করে---" ইস্ সে যদি ছেলে হত কিংবা সে যদি এখন পোয়াতি না হত, তাহলে ঠিক বিপ্লবী দলে যোগ দিত।" কিন্তু তাকে কিছু যে একটা করতেই হবে। তাই পাড়াপড়শীর ছেলেপুলে দেখলেই তাদেরকে সে বিপ্লবের পক্ষে উদ্দীপিত করে তুলতে লাগল। বেশ কয়েকজন সত্যিই বিপ্লবে
যোগদান করে বসল। গ্রামের কিছু লোকের রোষ গিয়ে পড়ল পোয়াতি বৌটার উপর। ডাইনি, সব্বোনাশী, রাক্ষসী, আরও নানা রকম আখ্যায় তাকে জর্জরিত করে তুলল। অবশেষে তার ঠাঁই হল গ্রামের প্রান্তে জঙ্গলের ধারে একঘরে হয়ে। 
           একদিন ঝড়জলের রাতে ঘুমের মধ্যে সে শুনতে পেল কে যেন দরজায় টোকা মারছে। কে বলে চিৎকার করে উঠতেই শুনতে পেল বাইরে থেকে হিসহিসে গলায় হাঁফাতে হাঁফাতে কে যেন ডাকছে----" বৌদি দরজাটা খোল তাড়াতাড়ি, আমাকে বাঁচাও বৌদি"।
  দরজা খুলতেই দেখে তার গ্রামের পাশের বাড়ির ছেলে দাশু, যে কিনা স্বদেশী করে।
    " একি দাশু এতরাতে তুমি?"
    "হ্যাঁ বৌদি পুলিশ পিছু নিয়েছে আমার, আজ রাতটা এখানেই লুকোতে হবে ।" বলে নিজেই কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে যেই না মুখে দেবে অমনি দরজায় আবার সশব্দে টোকা পড়ল।
     "ওরা এখানেও এসে পড়েছে, আর বুঝি নিজেকে বাঁচাতে পারলাম না!" হতাশায় ভেঙে পড়ল দাশু।
    "শক্ত হও ঠাকুরপো, বিপ্লবীদের এভাবে নিরাশ  হওয়া মানায়না। আমি একটা ব্যবস্থা করছি।"
বলে চোখের নিমেষে বৌটি পিছনের জানলার বাঁশের কঞ্চি গুলো খুলে দাশুকে বাইরে বের করে দিল। 
     এদিকে দরজার ধাক্কা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। দরজা না খুলে মেয়েটি কাতর কণ্ঠে কঁকিয়ে বলল,"তোমরা কেহে বাপু? আমি পোয়াতি মানুষ একা থাকি, এত রাতে তোমাদের কি দরকার?"
  বাইরের থেকে হুঙ্কার ভেসে এল----"তাড়াতাড়ি দরজা খোল্ নাইলে দরজা ভাঙব।" 
  পুলিশের রাগ তার ওপর এসে পড়বে জেনেও সে বৌ দরজা খোলেনা এই ভেবে যে যত দেরিতে পুলিশ ঘরে ঢোকে ততই মঙ্গল। দাশু ততক্ষণে আরও অনেকটা পথ পেরিয়ে যেতে পারবে। শেষে দরজা ভেঙেই ঢুকতে হল পুলিশকে। কিন্তু ঘরতো ফাঁকা! কয়েকটা হাঁড়ি কলসি কাঁথা চাদর ছাড়া আর কিছুই নেই। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সেগুলিই ভেঙে গুড়িয়ে তছনছ করতে লাগল তারা।
 " হারামজাদি শুয়ারকা বাচ্চি! গরিব বলে দয়া দেখানোটাই ভুল হয়ে গেছে আমাদের। প্রথমেই দরজাটা ভাঙা উচিত ছিল। শালা পাখি ঐ জানলা
দিয়েই ভেগেছে। তাড়াতাড়ি পিছু নাও ওর।" বলতে বলতে পুলিশগুলো মেয়েটিকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে চলে গেল।
        মাটিতে পড়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল পোয়াতি মেয়েটি,তারপর ধীরে ধীরে অজ্ঞান হয়ে গেল। রক্ত গঙ্গায় ভেসে গেল ছোট্ট কুটির আর সেই গঙ্গায় খাবি খেতে খেতে একটি পবিত্র, নিষ্পাপ, কোমল, স্পন্দিত নব জীবনের পেলব তীক্ষ্ণ চিৎকার ধিক্কার জানাতে লাগল ক্ষমতা লোভী, সাম্রাজ্যবাদী, শোষক, নিপীড়ক শক্তিকে--- 
        " উঁঙা -- উঁঙা -- উঁঙা---- ।"



বড়িশা
শক্তিশঙ্কর পানিগ্ৰাহী

---"ইয়েস! আমি পেরেছি"
দুপুর বেলা বাসে খুব ভিড় নেই, তার মধ্যে বছর সাত আটেকের একটা ফুটফুটে মেয়ে --হেডফোন কানে গুঁজে মুঠোফোন হাতে আঁকড়ে লাফিয়ে উঠলো সিট থেকে।বাসের মধ্যে অনেকেই নানান কথাবার্তা --রসালো আলোচনায় ব‍্যস্ত ছিল--মুহূর্তে সবাই যেন একটা ঝোর ঝাকুনি খেয়ে নীরব হয়ে গেল।মেয়েটির পাশে বসে থাকা এক বয়স্কা মহিলা একগাল হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললেন ---"আমার নাতনি, ---অনলাইন ক্লাস করছে তো।"
পেছনের সিটে বসে থাকা ভদ্রমহিলা বিরাট শরীরটা একটু এদিকে হেলিয়ে কোলগেটের হাসি দিয়ে বললেন--ও মা কী মিষ্টি, আমার ছেলে পুচুতো সারা বারান্দা ঘুরে ঘুরে অনলাইন ক্লাস করে।খুব ভালো করে যাও "
আমার বাঁপাশে বসে থাকা ভদ্রলোক  পান চিবোতে চিবোতে বললেন ---"এটা বেশ মজার ,বই ব‍্যাগের মতো ক্লাস রুম তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে।"
---"এই টে আপনে সাহি বোলা"--পেছনের সিট থেকে আঙ্গুল নাড়তে নাড়তে  হা হা করে হাসতে হাসতে বললো একজন।
---"আরে মশাই শুইন‍্যা যান আমার পোলা তো দেহি কানে গুঁইজা ঘুমাইয়া পড়ে, আমি কই  ---আর কেলাস বন্ধ কইর‍্যা ঘুমাও ক‍্যান।এর লগে ফোন খান দিছি ?পোলা কয়কি --মোষ্ট বোরিং ,ও তুমি বুঝবে না।"
---"-আরে পড়ালেখা আবার বোরিং হইবো ক‍্যান?"
----পোলা কয় --"পাপা ওটা বেঙ্গলী ক্লাস, কারক পড়াচ্ছেন ম‍্যাম।"
-----"ইস্ কী বিচ্ছিরি!"আমার ডান দিকের ছেলেটি বললো।
----"কি কিছু খাচ্ছিলে নাকি ?"জিজ্ঞেস করলাম
-----"না না ওই যে কারক --।"
----"ও কোন ক্লাসে পড়?"
-----"-ইঞ্জিনিয়ারিং ,শিবপুর --ফার্স্ট ইয়ার"
-----"ও তাহলে তো টপকে চলে এসেছ।"
------সামনের সিটের সিনিয়র সিটিজেন মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন --"এই কথা খান ঠিকই কইছ,বাংলা বড় খটমট,বিশেষ কইর‍্যা ঐ বানান --আমি আমার নাতনিটারে কিছুতেই শিখাইতে পারতাছি না।তিন খান 'শ' -'স' -'ষ' ,আবার দুইখান  'ণ'- 'ন'--তাছাড়া ধরেন ঐ র,ড় ,ঢ়।"
---"ভাবুন কাকে কোথায় বসতে দেবেন।" সামনের এক সুন্দরী মহিলা সমর্থনের সুরে জানালেন।
----"হক কথা, এই জটিলতার লগেই তো ইংরেজীর রমরমা।"
-----"আমার মেয়েটা বাংলায় বেশ লম্বর পায় --কিন্তু ঐ অনলাইনের টানাটানিতে আর পড়ালেখা হলো নি গো।পেরায় দিনমজুরি করে প‍্যাট চালাই কোথা পাবো বলেন ঐ বড় ফোন।দিদিমনিরা খুব ভালো বাসতো --হলে কি হব ,স্কুলে কেলাস হলি যায়া করতি পারতো--এই ছোটো ফোনে কথা কওয়া যায় --"দিদিমনি কইল পড়ালেখা হবেনে"।আধময়লা একটা হাফহাতা পাঞ্জাবি পরে একটা বড় ব‍্যাগ আঁকড়ে বসেছিলেন লোকটি।
----কোন ক্লাসে পড়তো ,---একসাথে অনেকেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো।
----ব‍্যাগটা একহাতে ধরে ,বুকের কাছে হাতটা ঠেকিয়ে বললো  --- "আজ্ঞে এইট কেলাস থেকে লাইনে উঠে ছেল।"
----ও না তাহলে পাবে না,বারো ক্লাসে সরকার থেকে দিচ্ছে--কোনো রকমে যদি ঠেলেঠুলে  নিয়ে যেতে পারতে তাহলে বারো ক্লাসে উঠলেই কেল্লা ফতে--একজন বললেও অনেকেই সম্মতি  জানালো।
----আমাদের গাঁয়ে ম‍্যালা লোক আছে গো, ঐ ফিরিতে বইখাতা দেচ্ছিলো , জামা দেচ্ছিলো তাই পড়ালেখা করছেলো।ফের দুকুরে ভাতটাও খেতি পেতো।তাবাদে প‍্যাটের ভাত জুটে না --কি করি পড়ালেখা হবে কন তো।একটা প‍্যালাস্টিক কারখানায় কামে লেগ‍্যে দিছি । আমার তো ঐ মুজুরী ---এখুন বাজার আর ভালো  নে গো।বাপ বেটি মিলে --আরো কটা পোলা পান আছে, বৌটার আবার রাজরোগ ধরিচে।চোখের জল গামছা দিয়ে আড়াল করলো।
কথাগুলো শুনে এ ওর দিকে তাকিয়ে আহা উহু করতে লাগলো।
পেছনের গেট থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো----"চলতি গাড়িতে এই যে যেনারা বসে বা দাঁড়িয়ে চলেছেন ,আপনেদের জন‍্যি একখান জবর খবর আছে"।
-----সবাই ঘাড় কাত করে টেরিয়ে তাকালো।
----চোখের সানগ্লাস টা খুলে হাতে নিয়ে একটা হিরোয়িক স্টাইলে ছাদ ধরেথাকা রডটায় ঠেস দিয়ে বললো---"অনলাইন ---অনলাইন ---অনলাইন চারদিকে আজ অনলাইন---পড়ালেখা, মুদিখানা,জুতোজামা-,কসমেটিকস---এমনকি খাওয়া দাওয়া ওঅনলাইনে,না অনলাইনে খাবেন কি করে --অনলাইনে অর্ডার করে বাড়ি বসে টপাটপ সাঁটিয়ে দিচ্ছেন।কিন্তু এই যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাড় গুঁজে বসে আছেন--তারপর কি হচ্ছে?বলুন কি হচ্ছে?আমি বলছি --মাথা যন্ত্রণা, ঘাড়ব‍্যাথা--চোখে জল।আর হবে না---কি হবে না? অনলাইনে সব কষ্ট ডিলিট মানে হাঁটিয়ে দিন----একবারে টা টা বাই বাই। বিশ্বাস হচ্ছে না পরখ করে দেখুন"।
--ব‍্যাগের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট পেটমোটা শিশি বের করে বাম হাতে ধরে ডান হাতে এককাবল তুলে সাপের ফণার মতো যেন ছোবল মারতে এগিয়ে আসছে---দাদা টেরাই করবেন, বৌদি দিদি----কপালে ঘাড়ে আলতো করে ঘসে লাগিয়ে নিন ব‍্যাস।
---হঠাৎ করে আমার পকেটে ফোন টা বেজে উঠল--হ‍্যালো ---"কি গো টুবাইয়ের অনলাইন ক্লাস তোমার মনে নেই ,তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো,আর আমার শাড়িটা না এসে গেছে অনলাইনে, কিন্তু দুজায়গায় কাটা ওটা ফেরৎ দিতে হবে"।
---হ‍্যাঁ ,ঠিক আছে --এই যে নামছি বাস থেকে, এসে গেছি।



সুরভি মাখা স্মৃতি
 মনোমিতা চক্রবর্তী

স্কুল ছুটির পর তিলোত্তমা বাসস্ট্যান্ডে যাবার জন্য টোটো খুঁজছিল।এমন সময় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সুমনা বলল -"দিদিমণি আজ একটিও টোটো নেই । হেঁটেই যেতে হবে ।চলুন আমাদের সাথে ।"
  স্কুল থেকে বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটারের মতো । আকাশের যা অবস্থা ! টোটো পাওয়া মুশকিল আজ।তাই ছাত্রীদের দলটার সাথেই হাঁটা দিলো তিলোত্তমা।
 আকাশ বেশ গম্ভীর হয়ে আছে আজ । আকাশটাকে দেখে তিলোত্তমার মনে হচ্ছে যে কোন সময়ই বৃষ্টি নামবে।বৃষ্টির কথা ভাবতে ভাবতেই অমনি শুরু হয়ে গেলো টিপটিপ বৃষ্টি।
  বৃষ্টি শুরু হতেই সবার পায়ের গতিও বেড়ে গেলো।
হাফ কিলোমিটার যেতে না যেতেই হঠাৎ করে ঝমঝমিয়ে নেমে পড়ে বৃষ্টি। তাড়াহুড়োতে আজ ছাতা নিতে তো ভুলেই গেছে তিলোত্তমা।সাথে তার সাথে হাঁটতে থাকা ছাত্রীরাও ছাতা আনেনি। সবাই মিলে কোনমতে রাস্তার ধারের একটা বন্ধ দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেয়, বৃষ্টির থেকে রক্ষা পাবার জন্য।বন্ধ দোকানের বারান্দায় ঢুকতে ঢুকতে প্রায় অর্ধেক ভিজে যায় তিলোত্তমা।
 দোকানের বারান্দার টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ বড়োই ভালো লাগছিলো তিলোত্তমার ।
আশপাশটা খেয়াল করে দেখলো তিলোত্তমা, রাস্তার দু'পাশটা কি সুন্দর সবুজ ধান খেতে ভরা! তাতে বৃষ্টির জল পড়ে আরো অপরূপা হয়েছে প্রকৃতি ।গাছপালাগুলো যেন বৃষ্টি পড়ার আনন্দে নাচছে ।প্রকৃতি যেন বেজায় খুশি শ্রাবণের এই বর্ষণে।
 বেশ কিছু স্কুল ফেরত ছাত্র-ছাত্রী যারা ছাতা আনেনি ,তারা এই সময় এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাইকেল চালিয়ে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরছে দল বেঁধে। ছাত্র-ছাত্রীদের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি ফেরার দৃশ্য দেখতে দেখতে ,হঠাৎই তিলোত্তমার শৈশবে স্মৃতির বোতলের বন্ধ মুখগুলো এক এক করে খুলতে থাকে; যা এতদিন ধরে ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ ।
ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে তার একটার পর একটা সুরভি মাখা স্মৃতি ।
 শার্ট, স্কার্ট পরা কিশোরী তিলোত্তমা,এরকমই এক বৃষ্টির বিকেলে স্কুল ছুটির পর, বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করতে করতে, মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছে। সাথে ছোট ভাইটিও রয়েছে তার ।বাড়িতে পৌঁছেই বই খাতা কোন মত রেখে ভাই,পাড়ার দাদা ,দিদি ,বন্ধুদের সাথে গিয়ে পুকুরে শুরু করে দিয়েছে সাঁতারের প্রতিযোগিতা। বৃষ্টির মধ্যেই চলছে সেই প্রতিযোগিতা,কখনো ডুব সাঁতারের ,আবার কখনো চিৎ সাঁতারের। পুকুরের জলে সাঁতার কাটতে কাটতে চোখ গুলো সবার প্রায় রক্ত বর্ণ হওয়ার উপক্রম।তবুও কারো ওঠার নাম নেই জল থেকে।  
 মা লাঠি হাতে তেড়ে আসছে দেখে ,দৌড়ে বাড়ি গিয়ে জামা কাপড় ছেড়ে ,ব্যাগ থেকে বইপত্র বের করে চলছে ফ্যানের তলায় বই শুকোনোর পালা। 
এমন সময় বাবা এসে মাকে বলে-"রাতে কিন্তু গরম গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা করতে হবে। "
ভাই বলে-" দিদি আজ বেশ জমবে বল ?গরম গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা !চল তাড়াতাড়ি পড়তে বসি, পড়া হয়ে গেলে সবাই মিলে লুডু খেলবো। তারপর জমিয়ে ইলিশ মাছ ভাজা আর গরম গরম খিচুড়ি খাব ।বাবা, ঠাম্মি তোমরা তৈরি থেকো পড়া হয়ে গেলেই তোমাদের সাথে লুডু খেলবো দিদি আর আমি।"
এমন সময় মা এসে ভাইয়ের কানটা ধরে বলে-" আর আমি ?আমি খেলব না লুডু?আমি বুঝি সব সময় বাদ হ্যা?"
 ছাত্রী সুমনার ডাকে সম্বিৎ ফিরলো তিলোত্তমার
-" দিদিমণি বৃষ্টি থেমে গেছে। ওই দেখুন, একটা টোটোও আসছে। আপনি টোটোতে যান ।আমাদের বাড়ি তো কাছেই, আমরাও যাচ্ছি।"
স্মৃতির বোতলের মুখগুলো এক এক করে আবারো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তিলোত্তমার ।
টোটোওয়ালাকে থামিয়ে তিলোত্তমা গিয়ে উঠলো টোটোতে, রওনা দিলো বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।




অনির্বান , আমি এবং অলীক বাস্তব
        বিনয় বর্মন

অনির্বান মানে অনির্বান সরকার ও আমার ছেলেবেলার বন্ধু ছিল| পড়াশুনায় ভালো শান্ত, নম্র কিছুটা ভীতুও l যাকে বলে সুবোধ বালক| আমরা যখন খেলার মাঠের কোনায় লুকিয়ে সিগারেট খেতাম, ও লজেন্স খেত| আমরা যখন বেকার দশায় গার্লস স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যারম খেলার ছুতোয় মেয়ে দেখতাম, ও বাড়িতে বসে গল্পের বই কিংবা কেরিয়ার ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাত| তারপর কর্ম জীবনেও আমি এবং আমার মত আরো কেউ কেউ স্কুল থেকে ফিরে কুটির শিল্পের 'টোল ' শুরু করতাম, অনির্বান অফিস থেকে সোজা একটা অনাথ আশ্রমে যেত, কয়েকটি মেধাবী ছেলেকে ফ্রি কোচিং দিতে| আমার, সুদীপের, শ্যামলের, সুকান্তর - প্রায় সবারই মেটামফোসিস হয়েছিল - 'সংসার' এর অজুহাত দিয়ে আমরা লোভী, স্বার্থপর, সুযোগ সন্ধানী এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়েছি| কিন্তু অনির্বান আমাদের চলতি স্রোতে গা ভাসায়নি| অমল কান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল, কিন্তু অনির্বান রোদ হতে চায়নি| আবার বৃষ্টিও হতে চায়নি| বস্তুত ও যে ঠিক কি হতে চেয়েছিল তা আমরা বুঝতে পারিনি| 

আজকাল বিজ্ঞান প্রযুক্তির এত বাড়বাড়ন্ত যে কোন কিছুতেই আমরা আর কেউ বিশেষ অবাক হইনা| কিন্তু সেদিন চমকে উঠেছিলাম| অনির্বানের এতগুলো কপি এল কোথা থেকে? সেদিন ও যখন বাইকে যাচ্ছিল, তখন ওর পেছনে বসে ছিল যে লোকটা, সে নির্ঘাত অনির্বান | হুবহু এক| আবার সকাল বেলা মাংসের দোকানের সামনে যে দুজন দাঁড়িয়ে সিনা না ঠ্যাং ভাবছিল, তারা দুজনই যে অনির্বান এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই|

ভীড় বাসে পাশে দাড়ান তরুণীটির দিকে আড়চোখে দেখছিল যে , আর তার কাছেই জানালার ধারে বসে উদাস মুখে বাইরে তাকিয়ে ছিল যে লোকটা - দুজনেই হুবহু অনির্বানের জেরক্স কপি| গতকাল রাতে আমার সাথে একই মশারির নিচে শুয়েছিল যে, সেও অনির্বান | ওরকম বিচ্ছিরি ভাবে অনির্বান ছাড়া কেউ শুতেই পারেনা| ছোটো থেকেই ওকে চিনি আমি| নাকি চিনিনা? একসাথে থাকি মাত্র| অথচ আমরা এত ঘনিষ্ঠ ছিলাম যে দুজন দুজনের মনে কি ঘটছে সেটা পর্যন্ত জানতাম| নাকি জানতাম না, জানার ভান করতাম| তবে যে কখনো কখনো মনে হতো আমিই অনির্বান অথবা অনির্বানই আমি| কিন্তু অনির্বানের নাকি, হায় ভগবান, এতগুলো ডামি এল কোথা থেকে| আর কেনোই বা ওরা শুধু আমার চোখেই পড়ছে?

সন্ধ্যাবেলা পার্কে বসে আছি| পার্কের পাশের গাছপালায় ঢাকা আবছা আলোর পথটা যুগলদের লাভ লেন| হলদেটে পথবাতির আলোতে দেখা যাচ্ছিল কিভাবে সুক্ষ্ম জলকনার মত ঝরে পড়ছে কুয়াশা| হিমেল বাতাশ| আলো আঁধারি পথে হাঁটছিল দুজন - আধুনিক ইউনিসেক্স পোশাক ও কেশবিন্যাসের গুনে চট করে ছেলে ও মেয়ের বিভেদ করা না গেলেও কিছু অতিরিক্ত ভাঁজ ও জ্যামিতিক রেখার জন্য বোঝা যাচ্ছিল স্পষ্টতই ওদের একজন মেয়ে| টুকরো সংলাপ ভেসে আসে| বোঝা যায় ছেলেটি কিঞ্চিত ভীরু ও অপ্রতিভ| মেয়েটি তীক্ষ্ম ও সোজা সাপটা| পৌষের ঠান্ডায় নাকের ডগাটা পর্যন্ত বরফের মত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল| সুতরাং তাদের দুজনেরই একটি করে হাত পকেটে এবং অন্য দুটি হাত পরস্পরের হাতে ধরা ছিল| অলস মন্থর গতিতে পথ চলছিল তারা| মেয়েটি আগামীদিনের রঙ্গিন স্বপ্নের গল্প শোনাচ্ছিল| হটাৎ ছেলেটি মেয়েটির পাশ থেকে সামনে এসে দাঁড়ায়, দুহাতে তার বাহু ধরে মেয়েটির চোখে চোখ রাখে| অভ্যাস বসতই মেয়েটি চোখবুজে তার মুখটি তুলে ধরে, প্রত্যাশা করে এক গাঢ় চুম্বন বা দৃঢ় আলিঙ্গন| কিন্তু সেসব কিছু না ঘটায় সে একটু অবাক হয়| চোখ খুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়| ছেলেটি তখনও তার চোখের পানে তাকিয়ে ছিল| এবারে সে কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নেয়, হতাশা সূচক মাথা নাড়ে | স্পেস কম ! 
---- মানে?
---- সুইট হার্ট তোমাকে একটা পার্সোনাল কারের মত দেখাচ্ছে | শুধু তুমি,আমি আর আমাদের --------! কিন্তু ডার্লিং আমার নৌকায় যাত্রী যে অনেক ------! 
---- বুঝলাম! এবারে মেয়েটির মুখে একটি বাকা হাসি ফুটে ওঠে | Then buy a Caravan and roam in the hell with your uncultured folks! Good bye!!
মেয়েটি সোজা হাটতে থাকে | -- ধন্যবাদ| ছেলেটিও হাটা দেয় তার বিপ্রতীপে | স্ট্রিট লাইটের আলোয় দেখি এযে অনির্বান | কিন্তু কম বয়সের যুবক অনির্বান | যখন ও সদ্য চাকরী পেয়েছিল | তখন ওর চুল ঘন ছিল | এখন অনির্বানের মাথা ডুয়ার্সের অরণ্য | বাইরের দিকে ঘন ভিতরে ফাকা | 

পটভূমি চা বাগানের বাবু বাংলো | জ্যোৎস্না রাত | চা বাগানের মাঝখানে একটা হাউস, বয়সের ছাপ পড়া কাঠের দোতলা বাংলো |শ্রীনাথপুর চা বাংলোর পরিবেশটাই ইতিহাসের গন্ধ মাখা | সামনে একপাশে সাজানো বর্তমানে যত্নহীনতায় আক্রান্ত লন | চারপাশ নানান গাছপালায় ঘেরা | বাঁশঝাড় সুপারি গাছের বাগানের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো চুঁইয়ে পরে দোতালার কাঠের বারান্দায় নানান নকশা ফুটিয়ে তুলেছে | দূরথেকে ভেসে আসা নিশাচর পাখি আর বন্য জন্তুদের ডাক আরো রহস্যময় করে তুলেছে পরিবেশটাকে | হালকা কুয়াশায় তাকে দেখাচ্ছে আরও কুহকী | হুইস্কির গ্লাস হাতে আমি আর অনির্বান, এইরকম একটা অপার্থিব পরিবেশ, এক অপ্রাকৃত নেশায়, এক অব্যক্ত ব্যাথায় প্রসব করার চেষ্টা করছি একটা কবিতা | ........ না, এবারেও সে এলোনা | বরং মনের কোন এক পরত থেকে ভেসে এলো সেই গান:
' হিম ঝরা চাঁদনি আলোতে
  হাত দুটি রাখলেনা কেন
   এই হাতে | ' 

হঠাৎ দেখি অনির্বান ছায়া হয়ে মিশে যাচ্ছে আমার মধ্যে!
আড্ডায় সুদীপ অনির্বানকে বলেছিল, এইসব বোহেমিয়ানা ছেড়ে এবারে থিতু হ তো! অনির্বান চুপ করে থাকায় আবার বলি, খ্যাপার মত কি এত খুঁজে বেড়াস বল তো?
------- জীবন |
ওর সংক্ষিপ্ত উত্তরে চমকে উঠি | শ্যামল রাগত স্বরে বলেছিল, জীবন মানে? আমরা যারা থিতু হয়েছি, তারা কি জীবিত নই? নাকি জীবন উপভোগ করছিনা ? এই যে আমাদের মাস পয়লা বেতনের নিশ্চিত জীবন, দশটা পাঁচটা অফিস, ঊনত্রিশ ইঞ্চি এল ই ডির অফুরন্ত বিনোদন, প্রেম করে বিয়ে করা সুন্দরী বউ ----- 
----- ও আমার সহ্য হবে না রে ! বেশ তো ভালোই আছি | 

আমি কি অনির্বানকে একটু ঈর্ষা করেছিলাম সেদিন ? সুখের জীবনে অস্বস্তির বকলসটা টের পেয়েছিলাম যেন | জানি ওটা আছে, তবুওতো কৃত্রিম হাসি, সামাজিকতা আর আয়েসের পালিশে সেটাকে ইগনোর করি প্রতিনিয়ত | তবুও কখনো কখনো নানান ঘটনা সূত্রে পুরনো ব্যাথা জেগে ওঠে | ঘটনাটা মনে পড়ে গেছিল | বিয়ের দিন পনেরো পরে হানিমুনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি | হোটেল বুকিং, টিকিট কাটা, সব শেষ | হটাৎই মা অসুস্থ হয়ে পড়ল | মৌমিতার মুড ভীষণ গরম | প্রেম করে বিয়ে | ওর মুড, মর্জি জানি | ধনাই পানাই না করে সোজা বলি, দ্যাখ মউ ট্যুর বাতিল করা ছাড়া উপায় নেই | পরে ---- 
---- ওই ডাইনিটা আর অসুস্থ হবার সময় পায়না| দিব্যি তো ছিলো দুদিন আগেও | যতসব ন্যাকাপনা | ছেলে বউয়ের বেড়ানোটা সহ্য হলোনা শয়তানীটার | সব বুঝি ------ 
ঠাস করে একটা থাপ্পর মারার ইচ্ছেটাকে দমন করার জন্য স্থান ত্যাগ করি |ছাদের কিনারায় দাড়িয়ে যখন চার নম্বর সিগারেটটা ধরাচ্ছি, হটাৎ কাধে কারো হাত | ফিরে দেখি অনির্বান |
---- তুই এত রাতে ? ছাদে উঠলি কিভাবে ? মেইন গেট তো বন্ধ ? 
মুখে সেই স্মিত হাসি অনির্বানের |
জীবন বড় জটিল, না রে ? অনির্বানের গলায় সহানুভুতি | হাল ছাড়িস না| হিসেব হয়তো একদিন মিলবে তোর | 
---- কেনো এমন হয় অনির্বান ? কেনো ? যারা সবচেয়ে প্রিয়জন তারাই কেনো সবচেয়ে বেশি দুঃখ দেয়? 
---- আমিও তো তার উত্তর খুঁজছি রে | খুঁজছি জীবনের মানে | নিশ্চই একদিন ----  
অনির্বান চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে | যেমনি করে নির্বাক তাকিয়ে থাকে তারারা | আর তাদের আবছা আলোয় দেখি ধীরেধীরে অনির্বানের মুখটা আমার বাবার মুখ হয়ে যাচ্ছে | বাবা বিচলিত স্বরে বলল, বাবু ঘরে চল | বৌমার কাছে যা | মেয়েটা কাদঁছে |



নারীর চোখের জলে সকলে বিচলিত হয় | কেউ কেউ শিভ্যালোরি দেখায় | তার ব্যাথা গল্প কাব্যের বিষয় হয় | এমনকি প্রসব বেদনাও গৌরবান্বিত হয় | পুরুষের চোখের জল ঘোরতর লজ্জার! তার বেদনা কাব্যের বিষয় কমই হয়েছে | প্রসব বেদনা যে কি তা অনির্বান জানেনা | জানার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনওদিন হবে না | কিন্তু কবিতার ব্যাথা সে জানে | সে ব্যাথা যেন তার কাছে লাতিন আমেরিকার নোভেলের ম্যাজিক রিয়ালিজম | বাস্তব, অতিবাস্তব, পরাবাস্তবের নানা স্তরে ভেসে বেড়ান| ডুবে যাওয়া| হাবুডুবু খাওয়া | ফের ভেসে ওঠা | অনির্বান কবিতা খুঁজে বেড়ায় | একটা অস্থিরতা তাড়া করে বেড়ায় অবিরাম | আইডিয়াটা যতক্ষন না প্রসব হয়, সেটা হণ্ট করে যায় | ..... কত ভাবনা ভেসে বেড়ায় মনের নানান পরতে | ধরার আগেই মিলিয়ে যায় | তবুও অনির্বান কবিতা খুঁজে বেড়ায় | 

অনির্বান এখন শহুরে বাবু | নলেন গুড় , খেঁজুরের রস, পিঠে আর বনভোজনের বার্তা নিয়ে যখন সংসারে ক্ষণস্থায়ী সুখের মত শীত আসে, তখন সে বড় মিস করে তার ফেলে আসা গ্রামটিকে |দৈনন্দিনতার ব্যাস্ততা ছুঁড়ে ফেলে পালিয়ে যেতে চায় কবিতার আশ্রয়ে | ওর ছোট্ট করে গড়ে নেওয়া গন্ডির বাইরে বয়ে যাওয়া বন্ধুরা, অভিমান আর ঈর্ষায় পর হয়ে যাওয়া সঙ্গীরা, যাদের সবার চোখেই সে ' পাখির 'নীড় ' খুঁজেছিল সেইসব মেয়েরা, প্রত্যাহিকতার নানা গল্প ও গ্লানি ...... হাতছানি দেয় কবিতার জন্ম দেওয়ার জন্য | ....... অধিকাংশ প্রচেষ্টাই সফল হয় না | মিসক্যারেজ হয়ে যায়! সুতরাং এই শীতেও অনির্বান একটি কবিতা খুঁজছে | একটিই, কিন্তু ঋজু ও পূর্ণ | তন্ময় ও তীব্র.......| 

কবিতার খোঁজে অনির্বান কত পথ চলে | হটাৎ দেখা পেয়ে যাওয়া একটি সুন্দরী তরুণী, দুঃস্থ একটি ভবঘুরে, পরিবহন কর্মী, একটি শিশু শ্রমিক ... .. এমনকি শীতের বাজারে নতুন সবজি ...... সবার মধ্যেই একটি কবিতা খোঁজে | চিকন ত্বকের বেগুন, লজ্জায় রাঙা টমেটো, সদ্য যুবতীর মত ফুটে ওঠা ফুলকপি থেকে কিশোরীর নরম বাহুলতার মত লাউডগা , কানের ঝুমকো দুলের মত সর্ষে ফুল থেকে টলটলে চোখের মত আমলকি..... সবকিছুতেই রূপক, উপমা কিংবা আখ্যান খোঁজে, কবিতার জন্য | 

অনির্বানের যে ডামিটা কবিতা লিখতে চায়, সেটাকে আমি কিছুটা চিনি | কিন্তু আর বাকিগুলো এল কোথা থেকে? অনির্বানের যে ডামিটা প্রোমোটার, ফাঁকা জমি দেখলেই স্কোয়ারফুট মাপে, যে ডামিটা সরকারি স্কুলের মাস্টার, টিউশন ফেরত ছেলেমেয়েদের দল দেখলেই ইন্টু থ্রি হান্ড্রেড হিসাব করে , যে ডামিটা ঠিকাদার, ভাঙ্গা রাস্তা দেখলেই ইনটু হান্ড্রেড বাই পার্সেন্ট খোঁজে ---- সবগুলো গোল হয়ে বসেছিল রমেশের চায়ের দোকানে। আমকে দেখা মাত্রই বিদ্রুপের হাসি হাসছিল । আমি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওঠা মাত্রই , আরে , চায়ের দোকান কোথায়, এ যে রুবিদের বাড়ির লন । 
আমি রুবি , রুবি , এই রুবি ---- বলে ডাকতেই বেরিয়ে এল ওর বাবা । কি আশ্চর্য ওর বাবাও অনির্বান ! 
----- কি দরকার? 
কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে আসি রাস্তায় । দেখি অনির্বান হাসছে , চেচিয়ে বলল , 'আরে অনির্বান যে, কি খুঁজছিস তখন থেকে ' !



নিরুপমা
কবিতা বণিক

"ওগো! নিরুপমা! করিও ক্ষমা,     তোমাকে আমার ঘরনী করিতে আমার মনের দোসর করিতে পারিলাম না।....." 
 গানের লাইনগুলো শুনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে ঠামি বললেন 'ওই টা লীলুর পোলাটা না? দেখাইতেসি দাঁড়া! হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই  লীলু! ও লীলু!' ছুটে আসে লীলু পিসি 'কি হয়েছে মা?'  'দ্যাখ লীলু!  তোর পোলা আমারে দেইখা কি গান গাইতে আছে রাস্তার রোয়াকে বইসা ! লোকে কি কইবো ক' তো!'  তোমার কি হয়েছে মা কি করেছে লালটু? ঠামি- কি কই ক' তো !আমারে দেইখা গান ধরসে ওগো নিরুপমা! লজ্জা রাখুম কোথায়?'  পিসির সাথে আমি আর নীলদাদাও হেসে উঠি। পিসি বললেন 'ওমা ওটাতো সত্যি সত্যি একটা গান। শুধু তোমার নামটা নিরুপমা মিলে গেছে বলে তোমার লজ্জা? তোমার নাম ক'জন জানে বলতো?' ঠামিও তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে ওঠেন, দেখো কি কান্ড! তাইতো কই, ও পোলা এমনতো নয়!তবে পোলাটা গায় কিন্তু ভালো!  হরেকৃষ্ণ!  হরেকৃষ্ণ!  বলে গোপালের সামনে গিয়ে বসলেন। হাসলে ঠামিকে ভারি সুন্দর দেখায়।ধবধবে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে ওঠে।এবারে নীলদাদা ও আমি চেপে ধরলাম ঠামি তোমার গল্প বলো।  আবার একটু হেসে  বললেন-- আমার তো নয় বছরে বিয়া হইসে গ্রাম, পুকুর, ধানক্ষেত এইসব শ্বশুরবাড়িতে আইসাই দ্যেখলাম!  আমরা তো পুকুরেই স্নান করতাম। একদিন পুকুরে স্নান করতে গেলাম জা , ননদেরা হগলেই আছিল। হঠাৎ আমি দেখি গোপাল ঠাকুর বইসা রইসে। কি সুন্দর! গোপাল! মিটমিট কইরা দেখতাসে। ডাক পারলাম দেইখ্যা যাও গোপাল ঠাকুর বইসা রইছে! কি সুন্দর! মিট, মিট কইরা  দেখতাসে! জা এ কইলো- ধইরা আনো তোমার গোপাল রে!'  ওমা! ধরুম বইলা যেই হাত বাড়াইসি, গোপাল তখন একলাফে পুকুরে।  আর হগ্গলে তো হাইসাই বাঁচে না।  এবারে ক'ও তো বইনদিদি! কি আছিল ওইটা? আমি বোঝার আগেই নীলদাদা  বলল ' সোনা ব্যাঙ তাই না,?'  এক ঝলক হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে ঠামি বললেন- হ! ঠিকই কইছস। আমি কইলাম কোনদিন ব্যাঙ দেখি নাইকা।  দ্যাখলাম  কি সুন্দর সোনা রঙের গোপাল বইসা রইসে! কেউ বোধ হয় রাইখ্যা  স্নান করতে নামসে। 
     আর একখান কই । বাবার লগে বাজারে গেছি। সেখানে কি সুন্দর সাদা ধবধবে দুইখান পীড়া! পীড়াখান  দেইখ্যা বড় লোভ হইল কইলাম ও  বাবা পীড়াখান  আমারে কিনা দিবা? বাবা কইল কি  যা  তো! গিয়া বস পীড়ার উপর, ভালো লাগলে কিনা দিমু। আমি বসতেই চিল্লাইলাম ও বাবা! কি ঠান্ডা! এবার ঠামির প্রশ্নের আগেই হাসতে হাসতে নীল দাদার উত্তর ওটাতো বরফের চাঁই!  তাই না? ঠামি- হ! ঠিকই কইছোস। এমন সময় লালটু দাদা ঘরে ঢুকতেই নীল দাদার প্রশ্ন ও লালটু দাদা ? তুমি বলতো আমাদের ঠাম্মির নাম কি? বলতে পারলে ঠামি তোমাকে এক্ষুনি চারটে নারকেল নাড়ু দেবে। হতভম্ব লালটু দাদা কে বসিয়ে সবটা বলা হলো । নাড়ু অবশ্য আমাদের সবার ভাগ্যেই দুটো করে জুটেছিল সেদিন।  'হরেকৃষ্ণ ' নাম গাইতে হয়েছিল আমাদের  সবাইকে। এটা ঠামির কাছে আমাদের অপরাধের  জন্য ক্ষমা পাওয়ার উপায়। জয় রাধে! 





সেকাল একাল
  চম্পা বিশ্বাস 
             
          বাপরে, কি গরম পরেছে! -- বলে বাইরে থেকে এসে এ.সির সুইচটা অন করে সোফায় গা এগিয়ে দেয় তিন্নি। তিন্নি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। ওর এই কান্ড কারখানা এতক্ষণ  চুপ করে বসে দেখছিলেন ওর ঠাম্মি । এবার বলে উঠলেন--দিদিভাই, এই টুকুতেই এত কাতর হলে চলে!  ভাবতো আমাদের সময়ের কথা , সবকিছু সহ্য করতে শিখতে হয় ,বুঝলে ! 
সাথে সাথে তিন্নির উত্তর-- আমাদের তো সব আছে , তবে কষ্ট করবোই বা কেনো ? 
না তা না , তবে শরীরকে এত নির্ভরশীল হতে দিও না , বুঝলে ! -- বলে মুচকি হেসে আবার বললেন -- আমাদের ছোটবেলায় তো বাড়িতে বৈদ্যুতিক লাইনই ছিল না । 
কৌতুহলের সুরে তিন্নি বলে ওঠে --কি করে থাকতে গো !
সবই অভ্যাস রে দিদিভাই -- ঠাম্মির উত্তর। 
         এবার তিন্নি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বসে ঠাম্মির কাছে পুরনো দিনের গল্প শোনার অবদার করে। 
ঠাম্মি বলেন -- আগে ফ্রেশ হয়ে টিফিন করে নে, তারপর একটা মজার ঘটনা বলবো। 
         এই শুনে তিন্নি ছোটবেলার মতো খুশি হয়ে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। ঠাম্মি মনে মনে ভাবেন মেয়েটি এখনও ছোটবেলার মতোই রয়েছে।
              কিছু সময় পর তিন্নি ফ্রেশ হয়ে টিফিন করে ঠাম্মির কাছে এসে বসে। নাও এবার শুরু করো --বলে ঠাম্মির আরও কাছাকাছি এসে বসে। ঠাম্মি মুচকি হেসে গল্প বলতে শুরু করে -- শোন, আমার ছোটবেলার কথা বলছি। আমি তখন খুব ছোটো , তাও ঘটনাটা ভালোই মনে আছে । আমাদের বাড়িতে বৈদ্যুতিক লাইন ছিল না। প্রতি রাতেই শোবার সময় ঘরে  হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কমিয়ে রাখা হত। আর আমাদের বাড়িও তখন ছিল টিনের চাল, মুলিবাঁশের বেড়া আর নীচটা মাটির। 
 বাপরে, কি কষ্ট ! --- বলে ওঠে তিন্নি।
মুচকি হেসে আবার ঠাম্মি শুরু করেন  ---ঠাকুমার ঘরের খাটের তলায় রোজ ছোটো পিসি হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রেখে দিতেন। একদিন মাঝরাতে সবাই যখন আমরা ঘুমিয়ে পরেছিলাম, চোর সিঁধ কেটে ঠাকুমার খাটের তলায় এসে বসেছিল।  সিঁধ কাটা মানে জানিস তো?
হুম জানি তো , তারপর বলো -- বলে ওঠে তিন্নি।
ঠাম্মি বলেন--- হ্যারিকেনের আলোয় চুরি করলে ঘরের কেউ যদি বুঝে যায় , সেই ভয়েই হয়ত চোর হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকে । আমার ঠাকুমা হঠাৎই খেয়াল করেন যে আলো কমে গেছে। নিভে যাবার ভয়ে সাথে সাথে পিসিকে ডাক দেন বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। 
ঠাকুমা পিসিকে বলেন--- আজ তেল ভরতে ভুলে গেছিস বুঝি !
পিসি বলেন---- না তো মা , ভরেছি তো। 
   এইভাবে বার কয়েক চোর হ্যারিকেন কমিয়ে দেয় আর পিসি উঠে বাড়িয়ে দেন আর ঠাকুমা বলে চলেন -- আজ তেল ভরতে নিশ্চয়ই ভুলে গেছিস।
শেষে চোর হয়ত বুঝতে পেরেছে যে এখানে চুরি করা সম্ভব নয় , তাই হয়ত চলে যায়। পরদিন সকালে উঠে পিসি দেখেন হ্যারিকেনে তো তেল আছে আর ঘরের সিঁধ কাটা । তখন বাড়ির সবাই ঘটনাটি বুঝতে পারেন এবং হাসাহাসি করেন। রাতেই যদি পিসি একটু ভালো করে খাটের তলা দেখতেন তাহলেই বুঝতে পারতেন ঘটনাটা কি। 
           এবার ঠাম্মি আর তিন্নি দুজনেই হেসে ওঠে।





কাটাকুটি
সোমা দে

স্নান ঘরের কৃত্রিম ঝর্নার নীচে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ভিজে চলেছে সৌমি । চোখ দিয়েও নোনা গড়িয়ে শরীর বেয়ে নেমে আসছে তাও অস্থিরতা কমছে না আসলে ঝড়টা তো মনের ভেতর চলছে । কি যে হচ্ছে ওর জীবনে নিজেও বুঝতে পারছে না কতোবার ভেবেছে চিরতরে ঘুমিয়ে যাবে পারেনি শুধু বাবা মায়ের মুখ চেয়ে দ্বিধা দ্বন্দ কাটিয়ে আবার শক্ত হয়েছে কিন্তু অতীত বর্তমান যেভাবে তার অনুভূতিগুলো নিয়ে কাটাকুটি খেলছে তা সহ্যের বাইরে।

রক্তিম ওর প্রাক্তন প্রেমিক আর মৃগাঙ্ক ওর বর্তমান সঙ্গী তবে কিছুতেই তাকে প্রেমিকের জায়গায় বসাতে পারছে না । দু'বছর আগে নির্লজ্জের মত রক্তিম মোটা টাকা যৌতুকের লোভে তাকে ছেড়ে বাড়ির পছন্দের অন্য মেয়ে কে বিয়ে করেছে। সৌমির জন্য একবারও বুক কেঁপে ওঠেনি ওর , পাঁচ বছরের সম্পর্ক , বিশ্বাস হেলায় ভেঙে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে । এরপর আর কোন যোগাযোগ করেনি বরঞ্চ নিজের বৈভব ঐশ্বর্য আর একটু বেশি বেশি করেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরে রোজ সৌমির এখন যদিও ওসব দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে।

তবুও প্রায়শই একলা হলেই মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে আগেকার স্মৃতি কিংবা মিথ্যে প্রতিশ্রুতির সাজানো সংলাপ। মৃগাঙ্কর সাথে পরিচয় অনেক দিনের তবে ঘনিষ্ঠতা বড়জোর মাস ছয়েকের , একাকীত্ব দূর করতে কখন যে তার কাছে চলে গেছে টেরই পায়নি সে সৌমির ভীষণ খেয়াল রাখে আর যথেষ্ঠ ভালোবাসে এটা অনেকবার প্রমাণ করেছে নানা ভাবে । দুই বাড়ির লোকজনও চাইছে যেন তারা খুব শীঘ্রই ঘর বাঁধে তবে কেন জানি সৌমির বুকের গভীরে তোলপাড় চলছে , কে যেন একটা বারবার বলে উঠছে নাহ্ এ হতে পারে না ভালোবাসা না জন্মালে তার কাছে কিভাবে নিজের সবটুকু সম্ভ্রম সঁপে দেয়া যায় ! পরিস্থিতি এমন যে নাতো তার থেকে বহুদূরে চলে যেতে পারছে নাতো খুব কাছে যেতে পারছে।

আজ বহুদিন বাদে সৌমি ও মৃগাঙ্ক লং রাইডিং এ বেড়িয়েছিল আর ওখানে মৃগাঙ্ক আদরের আবদারে খানিকটা কাছাকাছি এসেছিল কিন্তু সৌমি মুখে বারণ না করলেও এই যাত্রায় মানসিক ভাবে কোনমতেই আপন করে নিতে পারেনি তাকে। সৌমিকে স্পর্শ করবার অধিকার যেন এখন আর কারোরই নেই , শরীরটা এতো ধুচ্ছে তাও যেন ময়লা যাচ্ছে নাহ্ !

আসলে নারী শরীর স্পর্শের অধিকার একমাত্র তার প্রেম পুরুষের , তবে জীবন সঙ্গীনির অন্তরে জায়গা করে আত্মার সাথে মিশে থাকা যুদ্ধ জয়ের চেয়েও কঠিন । কি জানি কেন ! রক্তিমের মতো বেঈমানেরা ঈশ্বর প্রদত্ত নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সাম্রাজ্য ও সাম্রাজ্ঞী দুটোই হেলায় ত্যাগ করে ! আর সৌমির মতো মেয়েরা দুঃখিনী মীরা কিংবা রাধার এর মতো জীবন কাটিয়ে দেয় ... 



জ্যোতির্ময় 
কাকলি ব্যানার্জী মোদক

খোকন দেখ ,দেখি, সব প্রদীপ গুলো জ্বলছে নাকি? তাকিয়ে দেখলাম মায়ের হাতের প্রদীপগুলো প্রত্যেকটি জ্বলছে আধো অন্ধকার পরিবেশ ,আজ অমাবস্যা চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, অন্ধকার হলেও আজ রঙের বর্ণমালা মাঝে মাঝে রামধনুর মতন রঙিন আলো অন্ধকার ভেদ করে ঢুকে পড়ছে উঠানময়
              মা প্রতিবছরের মতোন কুলোতে প্রদীপ সাজিয়ে এসে দাঁড়াল উঠানে সাবলীল ভাবে উঠোনের চারপাশ ঘুরে ঘুরে চৌদ্দ প্রদীপ সাজাতে লাগলো 
কলাগাছের তলা, শিউলিতলা, তুলসীতলা সব জেনো  পা -মাপা আছে মায়ের। আজ ভূত চতুর্দশী  কাল শ্যামা পূজা, মায়ের লাল পাড় সাদা শাড়ি, কপালে লাল টিপ আর মাথাভর্তি সিঁদুর শ্যামা পূজার দিনে মা আমার দুর্গা রুপী। উঠোনের এক কোন থেকে অন্য কোনে প্রদীপের বর্ণমালা নিয়ে চলেছে দ্বিধা হীন ভাবে, আমি দাওয়ায় বসে অপলক দৃষ্টিতে দেখছি মাকে, হঠাৎ মা বলল "খোকন আয় দেখি , নে দেখি প্রদীপখানা দে দেখেনি তুলসীতলাতে" আমি ছুটে গেলাম তুলসী তলায় বসিয়ে দিলাম গঙ্গা মাটি দিয়ে তৈরি ঘিয়ের জ্বলন্ত প্রদীপখানা মা থুতনিতে  হাত দিয়ে বললেন দীর্ঘায়ু হও।
    আমার চোখের কোন থেকে টপটপ করে জল মাটিতে গড়িয়ে পড়ল মনেপড়ে 
গেল আজ থেকেই পাঁচ বছর আগেকার কথা।
ভবেন খুড়ো বাড়িতে শ্যামা মায়ের পূজা, উঠোন জুড়ে আলোর রোশনাই শ্যামা, কালু, পুটি ,চাঁপাদিদি, বিল্টু মেতেছে বাজি উৎসবে ,কত রং বে রঙের বাজি শব্দবাজি থেকে আলোর বাজি। আমি ঘর ছেড়ে এক ছুটে বেড়িয়ে পৌঁছালাম ভবন খুড়োর দাওয়াতে কালু এক ধাক্কা মেরে বলল "যা এখান থেকে হ্যাংলা কোথাকার" ভবেনখুড়োর দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য  আমার ভালো লাগলো না ,ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালাম বেড়ার ধারে যেখান থেকে কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। অপলক দৃষ্টিতে দেখছি শব্দবাজি ,আলোর বাজি রংমশাল, দোদোমা, কালীপটকা। হঠাৎ কাঁধে মায়ের হাতের স্পর্শ বলল বাড়ি চল খোকা ঠান্ডা লাগবে যে ,আমি মায়ের হাত সজোরে সরিয়ে দিলাম ,মা কাপড়ের  আঁচল খানা আমার মাথায় দিয়ে বলল দেখছিস তো কেমন হিম পড়ছে ঠান্ডা লাগবে যে। আমার প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো, একটাও বাজি নেই আমার ঘরে ,কেউ আমাকে একটাও বাজে কিনে দেয়নি সব রাগ এসে পড়ল মায়ের ওপর বিরক্ত বোধ করলাম কোন কথার উত্তর না দিয়ে মোহিত হয়ে দেখতে লাগলাম বাজি পোড়ানো কি সুন্দর তুবড়ি গুলো,আকাশ ছুঁতে চায় যেন ফুল্কি গুলো,একটা, দুটো তিনটে,চারটে, আনন্দে আত্মহারা সবাই । আমি ছুটে পৌঁছে গেলাম ভবেনখুড়োর উঠানে, উল্লাসে চেঁচাচ্ছে সবাই,কালু, বিল্টু শ্যামা আমি হঠাৎ ফেটে উঠলো তুবড়িটা বিকট শব্দে । আলোর ফুলকিগুলো ছিটকে পড়লো চারিদিকে, মা আমাকে সজোরে এক ধাক্কা মারলো ছিটকে পরলাম কাঁটা ঝোপে । তাকিয়ে দেখলাম  তুবড়ি র ফুলকি গুলো ঝরে পড়ছে মায়ের মাথা হয়ে চোখ ঘেঁসে । মায়ের গগণভেদী চিৎকার শব্দবাজি র শব্দ কে ও যেন শেলবিঁধল করছে। আমি বললাম আর কখনো চাইব না কিছু, কখন না মা, কখন না ,আমার এই কথা গুলো  তখন অতি মূল্যহীন শব্দ ছিল।   মায়ের দুচোখের  আলোর রশ্মি চিরতরে নিভে গেল চোখের পলকে । 
        আলো আঁধারি হাসপাতালে র  ঘরটার বিছানায় শুয়ে এতক্ষণ ধরে স্মৃতি মন্থণ করছিল জ্যোর্তির্ময়।এখন সাবালক  পাশের বিছানায় তার জগৎজননী  স্নেহময়ী মা, এখন ভালো করে জ্ঞান আসিনি ,আলো আঁধারি ঘরটার মধ্যে শুধু হৃদয়ের স্পন্দন শোনা যাচ্ছে ঢিপ,ঢিপ ঢিপ ।জ্যোর্তির্ময় মায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে  অনুভব করলো, এক চোখ দিয়ে ভালোই,স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাকে ।সূর্যের কিরণের মতো  নাইবা হলো আলোর রশ্মি, গোধূলি র আলোর আলোতে দেখবো না হয়  আমরা  পরস্পর পরস্পরকে । অনেক দিন পর এক বুক নিঃশ্বাস নিলো জ্যোর্তির্ময়।মনে মনে বলল ঈশ্বর মায়ের মঙ্গল করুক । বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দটা  সময়ের অপেক্ষায়....




রহিমুদ্দির মাছ ধরা নিয়ে
মজনু মিয়া 

রহিমুদ্দির বহুদিনের সখ মাছ ধরা,যেখানে মাছ ধরার খবর পায় সেখানেই যায়।
দু'একটা পেলেই খুব খুশি হয়,তাই মাছ ধরার জন্য যায়।
প্রচণ্ড শীত, খুব সকালে বিল বাইচ হবে তাই আযানের সময় উঠে সবাই মাছ ধরার জন্য বের হলো।
সবার সাথে রহিমুদ্দি নিজেও বের হলো। হেঁটে যেতে হয়,শীতের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে হাঁপাতে হাঁপাতে অবশেষে বিলের ধারে গিয়ে পৌছালো।

রহিমুদ্দির সাতটা পোলা, তারা মাছের নেশায় নেই। একেক জন কাজে ব্যস্ত থাকে। 
মাছ ধরার জন্য নামলো জলে, কোথাও কোমর জল কোথাও গলা জল, এভাবে মাঋ ধরতে লাগলো বেশ কটা ধরেছে কোমরে বেঁধেছে। এ দিকে মাছেড নেশায় গায়ে যে শীত লাগছে তার খেয়াল নেই। হাত কাঁপে গা কাঁপে তারপর আর পা চলে না!

সাথের বাইচের মানুষ দূরে চলে যায়,কিন্তু রহিমুদ্দি সামনে আসে না!  
পাশের পাড়ার একজন খেয়াল করে জলে মাথা জাগনা অবস্থায় ডুবে আছে নড়াচড়া করে না!
পাড়ার দু'চারজন ছিলো,সবাইকে ডেকে আনলো এসে দেখে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে কোনো রকম শ্বাস চলছে! আর ঠকঠক কাঁপছে! 
টেনে টানে তুলে এনে আগুন জ্বেলে তাপ দিতে লাগলো আর হাত পা ঘষতে লাগলো অনেক সময় পর একটু চেতন হলো। 

তারপর সুস্থতা লাভ করে কথা বলতেই বলে রহিমুদ্দি, আমারে মরতে দাও আমার এতো বিগার ক্যান আমার এতো আউশ ক্যান?  আমার সাতটা পোলা থাকতে মাছ ধরতে আইলাম ক্যা? সবাই তো তাজ্জব হয়ে মুখের দিকে চেয়ে রইলো!!!!


মুজনাই অনলাইন পূজা সংখ্যা ১৪২৯

No comments:

Post a Comment