মুজনাই
অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪৩০
ভাঙা কুলো
হেমন্ত সরখেল
তাকে দেখতে চাওয়া জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল হ'ল। এতদিন ভেবে নেওয়া গেছিল, যা কৃতকর্ম সবই ভুল। তার ডিগ্রি নির্ধারণের চেষ্টাও করে ওঠা হয়নি। ভুল তো ভুলই, তার আবার ছোটো বড়ো কী! এইবার, তার সম্পর্কে নাক গলাতে এসে ভুলের একটা ডিগ্রি নির্ধারণের সময় এ'ল। ইস, যদি অন্ততঃ, তার একটা ছবি থাকতো!
তাকে কেউ চায় না। তাই, সে কোথাও থাকে না। থাকে না মানে, তার উপস্থিতি কেউ টের পায় না। মাত্র, বিয়েবাড়িতে নোংরা কোথায় ফেলা হবে, কাজের লোকেরা ছোট বাইরে পেলে কোন স্থানে যাবে, কুকুর কে তাড়াবে, গাড়ি কোথায় পার্ক করা হবে– এসবগুলো সে চুপচাপ সমাধা করে দেয়। সেদিন নবীনের বাবার ব্যাগের হ্যান্ডেল ছিঁড়ে সব্জিগুলো রাস্তায় পড়ে গেল। সে তার গেঞ্জির মধ্যে সব তরকারি ঢুকিয়ে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে এ'ল। দিলীপের মায়ের রক্ত লাগতো। অত রাতে কে দেবে! সে দু ইউনিট দিয়ে দিলো। তার 'ও পজিটিভ'। সে ব্যাপারটায় পজিটিভ হয়ে গেল।
মাখনের বড়দা বিদেশে থাকে। মাখনের মতো চেহারা। টোকা দিলে যেন শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে যাবে। ওদের মায়ের শ্মশান যাত্রায় হাতে ঝোলানো যে মাটির হাঁড়ি, যার মধ্যে ঘুঁটে জ্বালানো ছিল, তার তাপ লাগছিলো বড়দার হাতে। সোনার অঙ্গ পুড়ে যায় আর কি! মায়ের শেষ যাত্রা, কষ্টে প্রাণ যাচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। সকলেই হাঁটছে অথচ টের পাচ্ছে না। কোত্থেকে সে এলো আর, হাত থেকে হাঁড়ির দড়িটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো। সারাটা রাস্তা, তারপর সে হাঁড়িটাকে বয়ে নিয়ে চললো আর, বড়দা তার হাতটা ধরে থাকলেন। ছুঁয়ে থাকলেও একই ফল হয়, লোকে বলে। তার হাতে তাপ লাগলো না শ্মশান অব্দি।
সে রাতে কোথায় থাকে, কোথায় খায়, কোথায় ঘুমায় কেউ জানে না। যখন প্রচণ্ড দুপুরে সূর্য তা তা করে রোদ দেয়, পাড়ার সুনশান গলিতে জিভ বের করে কুকুর হাঁফায়, পিচের রাস্তা গলে ওঠে, ঝিলমিল করে বাতাসের ঢেউ সেই রাস্তার বুকে, যখন প্রিপেইড ট্যাক্সি গরমে সওয়ারীর কাছে মস্ত দাম হাঁকে তখন সে দুলুর দোকানের জল বাঁকে করে টেনে দেয়। রোদ পড়ে এলে দুলু দোকান খুলবে, জল তো লাগবে! বিকেলে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই আবার রাতে দোকান বন্ধ করার সময় সে আসে। হাতে হাতে গুছিয়ে দেয়। দুলু দোকান বন্ধ করার ফাঁকে আবার সে কোথাও গায়েব। দুলু জানে, সে সকালে আসবে, দোকান খোলার সময় সব বাইরে বের করে দিয়ে অশোকের পিসিমার দোক্তা পাতা কিনে দিতে ও পাড়ায় চলে যাবে। ঘুরঘুর করবে পাড়া থেকে বাজার, বাজার থেকে স্টেশন, স্টেশন থেকে রেশন দোকান। কারও কোন প্রয়োজন হলে সে সেখানে থাকবে। কেন থাকবে, কীভাবে পৌঁছে যাবে, জানবে কী করে, এসব অবান্তর কথা। এ না জানলেও চলবে। শুধু, সে থাকবে, থাকে, থাকেই। এটাই নিয়ম। এ আর বেশী কথা কী!
সেদিন তুমুল বৃষ্টি। কেমন?এক হাত দূরের মানুষ আবছা লাগে তেমন। তার মধ্যে বাবার পা স্লিপ করলো সিঁড়িতে। মাথা ফেটে, পা মচকে সে এক বিদিকিচ্ছিরি কাণ্ড। ঘরে মানুষ বলতে আমি, বোন আর বাবা। মা গেছেন কবেই। সেও এই সিঁড়ি থেকে গড়িয়েই। আমি সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরালাম। এই ঝুম বৃষ্টিতে কাকে পাই? বাবা রীতিমতো গোঙাচ্ছেন। মনে পড়লো, যদি তাকে পাই! সে তো সবার বিপদে সর্বত্রই। নীচের ঘরে বাবাকে বোনের জিম্মায় রেখে তাকে খুঁজতে ছাতা নিয়ে বের হলাম। অতি কষ্টে চুপচুপে ভিজে রাস্তার এ'মাথা ও'মাথা, দুলুর চায়ের দোকান, মাখনদের ছাদ তোলা রোয়াক, দেবেশদের গোয়ালঘর সব দেখে যখন ফিরলাম, বাবা মায়া কাটিয়েছেন, বোনের কোলে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। সুবুক সুবুক করে কেঁদে চলেছে বোন। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। যদি ওকে পেয়ে যেতাম তাহলে হয়তো ওর ডেকে আনা ট্যাক্সিতে অন্ততঃ বাবাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকু থাকতো। ইস, যদি সময়মতো ওকে পেয়ে যেতাম!
না। এর পর আর এ তল্লাটে ওকে কেউ দেখেনি। আমি বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সমস্যায় আবার বারবার ওকে খুঁজেছি। শুধু আমি কেন, সবাই খুঁজেছে। কেউ পায়নি। দুলু জবাব দিতে দিতে নাজেহাল হয়েছে। ও ও ওকে দেখেনি। ও কোথায় কেউ জানে না। কেউ কোথাও ওকে দেখেছে বলেও শুনিনি। কতদিন ওকে দেখি না! দেখতে খুব মন চায়। কোথায় হতে পারে ও! যদি জানতাম ঠিক যেতাম। পেপারে দেব? ছবি চাই তো! তা ও তো নেই! এবার উপায়?
No comments:
Post a Comment