Thursday, April 4, 2024


 

মুনা 

অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪৩০



বর্ষশেষ ও বর্ষশুরুর ভাবনা

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য


বর্ষশেষ আর বর্ষশুরুর সন্ধিক্ষণ এক ক্রান্তিকাল এমন সময়ে সাধারণত প্রতি বছরই যে চিরাচরিত স্বাভাবিক ভাবনাগুলো মনে নাড়া দিয়ে থাকে, যেমন, গত বছরটির তুলনায় এ বছরে যেন আরও একটু এগোতে পারি, তা সে ব্যক্তিগত সামাজিক কি কাজের জগৎ যে পরিসরেই হোক না কেন, অথবা, গত বছরে জীবনে যে ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত ভুল ভ্রান্তি ত্রুটিগুলো ঘটে গেছে, এ বছরে যেন কোনমতেই আর তার পুনরাবৃত্তি না হয়! এ বছরে হয়তো নতুন রকমের কোনও ভুল করতে পারি, কিন্তু পুরনো ভুলের থেকে শিক্ষা নিয়ে এই নতুন ভুলটি যেন তিলেকমাত্র হলেও গুণগত দিক দিয়ে গতবারের চেয়ে একটুখানি এগিয়ে থাকে! হাজার হোক, তিল তিল করে সামনের দিকে এগিয়ে চলার নামই তো জীবন!


আজকাল চারিদিকে থেকে থেকেই দমকা চৈতি হাওয়ার ঝাপটা মনে করিয়ে দিচ্ছে আরও একটা গোটা বছর শেষমেষ পেরিয়েই গেল! ক’দিন বাদেই নববর্ষ! পুরনো সব অপ্রাপ্তি অক্ষমতা অসাফল্যের মনখারাপকে পেছনে ফেলে নতুন আশায় বুক বেঁধে আবারও একবার সামনের দিকে তাকানোর পালা। ব্যক্তিগত দিক দিয়ে দেখতে গেলে গত বছরটা দু’হাত ভরে অনেকটা যেমন দিয়েওছে, তেমনই এক ঝটকায় আশাতীতভাবে একান্ত এক প্রিয়জনের অসময়ের মৃত্যুর মতো অনেক বেশি কিছু জীবন থেকে ছিনিয়েও নিয়েছে এটাই যদিও জীবন, তবুও এ যেন কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না! মুশকিল হল ঈশ্বরের ইচ্ছের ওপর তো জোর চলে না, তাই কোনও কোনও ক্ষতি অপূরণীয় হলেও শেষ অবধি জীবনের সাথে একরকম সমঝোতা করে নিতেই হয় পাওয়া আর হারানোর দাঁড়িপাল্লার নির্দয় হিসেবটা তাই এবার বছরশেষে এসে বড্ড বেশি করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে যেন জীবনের সেই চিরকালীন অনিত্যতাকেই আবারও মনে করিয়ে দিয়ে গেল তবে জীবনের যাবতীয় কষ্ট গ্লানি শূন্যতা থেকে বেড়িয়ে আসার একমাত্র উপায় বোধহয় আবার সেই জীবনেই ফেরা। এবং সেই অমোঘ শর্তেই নানা কাজ অকাজের ব্যস্ততায় ডুবে থাকতে থাকতে চৈত্রের মাঝামাঝি হঠাৎই একদিন সুযোগ এসে গেল পাহাড়ে যাবার এমনিতেই সমতলে একটানা বেশিদিন থাকলে নিজের ভেতরেই হাঁফিয়ে উঠি আমি, এবং পাহাড়ে যাওয়ার অজুহাত খুঁজতে থাকি ফাঁক পেলেই, তবে এবারে সেই একান্ত মানসিক তাগিদের সাথে সাথে একটুখানি কাজেরও যোগাযোগ ঘটে গেল কাজটি ছোট এবং দুপুরের দিকে, ফলে দিনের প্রথম ভাগের অনেকটাই আমার হাতে এসব ক্ষেত্রে আমি ইচ্ছে করেই নিজস্ব গাড়ির বদলে শিলিগুড়ি জংশনে গিয়ে শেয়ারের গাড়িতে করে পাহাড়ে যেতেই বেশি আগ্রহী কত নতুন মুখ দেখা যায়, কত নতুন গল্প শোনা যায়, কত নতুন স্মৃতি জমে ওঠেএবং, এবারেও দেখলাম এ নিয়মের ব্যতিক্রম হল না। গাড়ির যাত্রীরা একান্তে বা নিজেদের মধ্যে মশগুল থাকলেও এ যাত্রাপথের এক আশ্চর্য আবিষ্কার আমাদের শেয়ার গাড়ির পাইলট মহাশয় স্বয়ং, কোঁকড়ানো সদা হাস্যময় মুখের পঞ্চাশোর্ধ প্রাণোচ্ছল যুবক প্রধানজী! কি ভীষণরকম ক্লান্তিহীন, আমুদে, আর, জীবনমুখী মানুষটাব্যক্তিগত সাংসারিক হাজারো সমস্যা, রোজকার এই মাকুর মতোন একঘেয়ে জীবনের ঘানি টেনে চলা আর প্রতিদিন পাহাড়ে ওঠানামার দারুণ ধকল সামলেও অনিশ্চিত সামান্য একটা নিয়মিত রোজগার, কোনও কিছুই তাঁর মুখের অনাবিল শিশুসুলভ হাসিটা কেড়ে নিতে পারেনিআগে দু দুবার গাড়ির কুলার খারাপ হয়ে যাওয়ার পর আর না কেনায় এখন জল ঢেলে ঠান্ডা করে করে গাড়ি চালাতে হয় তাতেও নো পরোয়া পাহাড়ি রাস্তার ধারের কোনও একটা খাবার দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জল নেবার সময়ে আবার অক্লেশে তাদের রান্নাঘরেও ঢুকে যান প্রধানজী তাঁর সহযাত্রীদের জন্য চা কফি বানাতে মুখের মিল থাকার দরুণ আবার এই আমাকেই নেপালি ভেবে খানিকক্ষণ তড়বড়িয়ে নেপালি বলার পর ওনার ভুল ভাঙিয়ে দিতে হেসেই অস্থির ভাষাটি না জানার অক্ষমতা আমি বারবার মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে নেবার পরও নিজে থেকেই জোর করে সারা রাস্তা আমাকে নেপালি শেখানোর কি আশ্চর্য নির্মল উৎসাহআবার কোনও দিন যদি ওঁর গাড়িতে আসি সেজন্যে ওনার ফোন নম্বর নিতে গেলেই পাল্টা দেখি আমার নামটি উনি সেভ করে নিলেন থাপা বৌদি বলেনইলে নাকি মনে থাকবে নাসময়মতো দার্জিলিঙ পৌঁছে ওঁকে ছেড়ে দেওয়ার পর বারবার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল, যেতে যেতে  বছরটা একটা বেশ আশ্চর্য শিক্ষা দিয়ে গেল কিন্তু! এই সময়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৈনন্দিনতার দারুণ জটিলতার মধ্যেও কিছু মানুষ কি অদ্ভুত জাদুবলে তাদের ভেতরের সরল শিশুমনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে! কতটা পারব জানিনা, তবে সময়বিশেষে অন্তত তাঁদের মতোন সহজ থাকার চেষ্টাটুকু আগামীতে নিশ্চয়ই করব, প্রধানজীকে বিদায় জানাবার আগে এই ছোট্ট প্রতিজ্ঞাটা নিজের সাথেই নিজে করে ফেললাম হঠাৎই ভালোর শক্তি বোধহয় এতটাই যা বহুদিনের জমে থাকা বিপুল খারাপের পলিকেও খুব সহজেই ধুইয়ে নিয়ে যেতে পারে!


দার্জিলিঙের কাজ সেরে একটু ঘুরে টুরে বাড়ি ফেরার পথে একবার কার্শিয়াং ট্যুরিস্ট লজে ঢুকলাম বিকেলের জলযোগ সারতে বেশি কিছু নয়, এক ঝলকে মেনুকার্ডে চোখ বুলিয়ে এক প্লেট ফিশ ফিঙ্গারের অর্ডার করলাম ঝটপট। রবিবার হওয়ায় সন্ধ্যে হলেও রেস্টুরেন্টে ভিড় বেশ ভালোই। অথচ সে তুলনায় বেয়ারার সংখ্যা একটু অপ্রতুল মনে হল আজ। মূল শহরের প্রধান রাস্তার ঠিক ওপরেই এই পুরনো আমলের সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি নয়নাভিরাম লজটি সরকারি তত্ত্বাবধানে হওয়ায় দৈনিক ঘরভাড়া যথেষ্ট সন্তোষজনক, ফলে লোকসমাগম বছরভর এই রাস্তা দিয়ে গেলে মাঝেমধ্যেই এখানে নেমে একটু আধটু জলযোগ করার অভ্যাস আমার বহুদিনের তবে আজ দেখলাম স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশিই দেরি হচ্ছে এদের সার্ভ করতে অস্থির হয়ে প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর তাই বেয়ারাকে ডেকে চেপে ধরতেই সত্যিটা জানতে পারলাম আভ্যন্তরীণ কিছু অসুবিধার কারণে গত দেড়দিন ধরে বাজার করতে পারেনি এরা, তাই মাছ নেই ফ্রীজে! অগত্যা বাধ্য হয়ে চিকেন ফিঙ্গারের ব্যবস্থা করছে আমি তো হতবাক! ব্যাপারটা আমাকে জানাবে তো! এতক্ষণ বসে আছি! বিরক্ত হয়ে দু’কথা শুনিয়ে উঠে যাব যাব করছি, হঠাৎই আমার উল্টোদিকের টেবিল থেকে এক ভদ্রলোক উঠে এলেন হাতে ওনাদের ওখানে সদ্য সার্ভ করা একটা ফ্রায়েড চিকেন মোমোর ডিশ। কাছে এসে আমাকে সম্পূর্ণ আশ্চর্য করে দিয়ে স্নেহভরা গলায় বলে উঠলেন,“ আপনার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি তবে আমরা তো এখানে ক’দিন ধরে আছি, তাই অবস্থাটা জানি কোনমতে চালাচ্ছে কাল সোমবার আবার বাজার হবে যতক্ষণ আপনার ডিশটা না আসে আপনি আমাদেরটা একটু টেস্ট করুন এদের মোমোটাও খুব ভাল!”


এরপর আর রাগ করে থাকা অসম্ভব ভদ্রলোক ও ওনার সঙ্গীদের সাথে বেশ আলাপ হয়ে গেল। ওনারাও শিলিগুড়ির লোক প্রায় সপ্তাহান্তেই এখানে আসেন সময় কাটাতে গল্প করতে করতেই প্রায় মিনিট দশেক পরে আমার চিকেন ফিঙ্গারের ডিশ এলে ওনাদেরও অফার করলাম সানন্দে গ্রহণ করে তারিফ করলেন মুক্তকণ্ঠে অতঃপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে এসে বাড়ির পথ ধরলাম আমি। মনে তখনও এক অদ্ভুত ভালোলাগার রেশ বিন বিন করছে। আর হ্যাঁ, আরেকটি কথা না বললেই নয়, যেহেতু আমার পছন্দের ডিশটি ওরা আমাকে তখন সার্ভ করতে পারেনিতাই চিকেন ফিঙ্গারের ডিশটি ছিল কমপ্লিমেন্টারিবর্ষশেষের মাত্র একটা সন্ধ্যের ঘটনা, কিন্তু সেটুকুই অভাবিতভাবে শিখিয়ে দিয়ে গেল চারপাশের এত অন্ধকারের মধ্যেও কোথাও কোথাও স্বাভাবিক মানবতাবোধ আর সৌজন্যবোধ আজও কি অমলিনভাবে বেঁচে রয়েছে! পুরনোকে ছেড়ে নতুনে পা রাখার প্রাক্কালে এর চেয়ে বেশি আশার ব্যাপার আর কিই বা হতে পারে!


ফিরতি পথে কার্শিয়াং পাহাড় থেকে নামতে নামতে হঠাৎ দূরে উল্টোদিকের পাহাড়ে চোখ পড়তেই আবারও সেই খণ্ড দৃশ্যগুলো চোখে পড়ল রাতের নিকষ কালো ভেদ করে কুচি কুচি পাহাড়ি ঘরবাড়ির চিকচিকে আলোর পাশাপাশিই কিছু জায়গায় প্রবল চৈতি হাওয়ার দাপটে লেগেছে ভয়ংকর আগুন। আজকাল অবশ্য বনবিভাগ থেকেই নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় এ আগুন লাগানো হয় যাতে পুরো পাহাড়ে না আগুন লেগে যায়! লেলিহান সেই দাবানলের উন্মত্ত শিখা পাহাড়ি জঙ্গুলে গাছের গায়ে ঘষা খেয়ে উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ছে দূর থেকে দূরে অদ্ভুত সুন্দর অথচ ভয়াল এই ছবি যেন সত্যিই সব পুরনোকে অগ্নিতাপে ভষ্মীভূত করে নতুনকে আহ্বান জানানোরই ঐশ্বরিক প্রতীক কিছু কিছু দৃশ্য কত গভীর অনুভূতি কি সহজেই না ব্যক্ত করে দেয়! বৎসরান্তে এবার সব পুরনো যাক নিঃশেষে ছাই হয়ে উড়ে, হে নতুন বছর, স্বাগত!


No comments:

Post a Comment