Thursday, April 4, 2024


 

মুনা 

অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪৩০


অশ্রু সু 

শর্মিষ্ঠা



পেরিয়ে যায় কত কত দশ তারিখ! বছরের আবর্তে মাস! বয়স বেড়ে যায়, আয়ু গড়িয়ে চলে। অস্তমিত সূর্যের দেশে একে একে জ্বলে ওঠে মাটিতে জোনাক থেকে আকাশের তারা। পিক পিক আলো। কালপুরুষ, সপ্তর্ষীমণ্ডল। আরও কত কী! সবাই তো আর পরিচিত নয়! নাম-না-জানা অথচ বড্ড সহজ গল্পরা ফাঁকটাক খুঁজে টুক করে লুকিয়ে পড়ে। সহজ অচেনা হয়ে ওঠে। আড়াল হলো সহজ থেকে কঠিন রূপান্তরণের জ্যামিতিক বিচরণ। 


       এখন ধান রোয়ার কাজ চলছে। ক্ষেতের পাশে সোঁদা গন্ধ সর্বত্র। জমির গোড়ালি ডোবা জলে সাদা ধ্যানমগ্ন বক। দূর থেকে দেখলেও সনাক্ত করা যায়। মাঝে মাঝে কিছু কিছু জমিতে যেন সবুজ ভেলভেটি ওম ধরেছে। নদী শুকিয়ে উদোম চর। তার উন্মুক্ত বুকে শিবরাত্রির মেলা বসেছে। নদীর ওপর ব্রিজ যেন এখন পার থেকে দেখলে আকাশছোঁয়া মনে হয়। পারুলের বাবা জিলিপি ভেজে লোহার শিক দিয়ে তুলেই রসে ডুবিয়ে দিচ্ছে। গাঢ় আঠালো রস। রসের কড়াইতে লাভের পরিণামে আত্মহত্যা করেছে কয়েকটা ডাসা কালো পিঁপড়ে। তাদের নিয়ে কারোর কোনো মাথাব্যথা নেই। জিলিপি দাঁতে কাটলেই আঙুলের ফাঁক দিয়ে কব্জি বেয়ে গড়িয়ে নামে চিকন ধারা। চ্যাটচ্যাটে। চম্পা টাগরায় জিভের শব্দ তুলে চালতার আচার চিবিয়ে খাচ্ছে। চেবাতে চেবাতে অলীক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সার্কাসের তাঁবুর দিকে। ছোট তাঁবু। দু'চারটে বাঁদর, একটা হাতি আর কয়েকটা কথা বলা কাকাতুয়া। ওইই গরীব সার্কাসওয়ালার সম্বল। তার পাশে নৌটঙ্কি শুরু হবে। এসব বাইজির নব্য সংস্করণ। ওদিকে গোবিন্দ ঠিক তাক করে গাদাবন্দুকে লক্ষ্যভেদ করে ফেলেছে। সবুজ ফুলের মাঝের বেলুন থেকে ডানদিকের নীল বেলুন ঘেঁষা হলুদটা এবং সুতোয় ঝোলানো পেরেক আর পাঁচ পয়সা। খুশি ও। আহাঃ! পয়সা উসুল! শিবের ত্রিশূল কপালে এঁকে দিতে লালচন্দন নিয়ে ঘুরছে শিব ভক্তরা। আসলে স্টিলের প্লেটে কিছু নগদ পাওয়ার আশা। 


          এসব ডালভাতের দৈনন্দিন সংলাপ আর ভীষণ সহজের ভেতর খুউব সহজ হয়ে যেতে ইচ্ছে হয় ডালিয়ার। সহজ হতে পারলে যতিহীন হাউমাউ করে কাঁদা যায়। শুধু হৃদয় আছে বলেই অনাবিল নিঃশর্ত ভালোবাসা যায়। 'কখনও কি নদী হতে পারবো! আমাকে ঘিরে খুশির মেলা বসবে!' নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে ডালিয়া এগিয়ে যায় মেলার নকশীকাঁথায়। ধুলো ওড়ে হাওয়ায়। কত বুনোট! নির্দিষ্ট দূরত্বে সবাই। ঘুরতে ঘুরতে হাওয়ামিঠাইএর দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো ও। এক 'বোঙ্গা' গোলাপি চিনি মাঝখানে ঢেলে দিচ্ছে যুবক ছেলেটা। গোল করে ঘুরছে স্টিলের বড় বাটি। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে গোলাপি জাল। মাকড়সার জালের মতো। একটা কাঠি গোল করে ঘুরিয়ে সেটাই ওতে আটকে নিচ্ছে। ডালিয়া একদৃষ্টে দেখছিল মিঠাই বানানো। জিভে পড়লেই যে অস্তিত্বহীন, তার অবয়ব তৈরিতে কত কায়দা! কত রঙিন কল্পনার মায়াজাল! কারুকার্য! কয়েকমাস আগেও ইন্দ্রজিৎকে ও কতবার বলেছে, অনুনয় বিনয়ের সুরে, 'আমাকে একটা মেলা দেখাতে নিয়ে যাবে ইন্দ্র? কত বছর দেখি না! সেই ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে চরকের পিঠ ফোটানো দেখতে যেতাম। তারপর বড় হয়ে সব যেন গল্প আর স্মৃতি হয়ে গেল! কাগজের প্লেট থেকে তালপাতার চামচে ঘুগনি তুলে খেতাম। ময়ূরের পালকে ছোট ছোট ফুল লাগিয়ে ওরা ফুলদানি বানিয়ে দিত। আমিও দুটো কিনেছিলাম। পুতুলের জন্য। কতদিন হাওয়ামিঠাই খাওয়া হয় না! ইন্দ্র...' পিছনে ফিরে ডাকতেই শুনতে পেয়েছে নিচের তলার দরজা খোলার শব্দ। গ্যারেজ থেকে সটান বেরিয়ে যায় কালো স্কর্পিও। ইন্দ্রর অত সময় কোথায়! ডালিয়ার বকবক শুনবে! তার চেম্বারে তখন ক্লায়েন্ট বসে। ততক্ষণে অফিস থেকে দুবার ফোন এসে সারা! 

― এই যে নেন।


ঘোর কাটলো দোকানের ছেলেটার ডাকে। হাত বাড়িয়ে গোলাপি হাওয়া মিঠাই নিয়ে যতটা সম্ভব হাঁ করে কামড় দিতেই কোথায় মিঠাই! শুধু মিঠাজল। আরেকবার, আবার... সববারই তাই। ডালিয়ার ঠোঁটের চারপাশে লেগে আছে গোলাপি আঁশ। ও প্রাণপণে শুষে নিচ্ছে ঈপ্সিত সুধা। সার্কাসের তাঁবুর ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা তারা। নক্ষত্র। সেদিকে তাকিয়ে ওর মনে হলো, 'বাবাই না!'


        সকালে প্রহ্লাদের মাকে রান্নার ফিরিস্তি দিয়ে ডালিয়া বেরিয়ে এসেছিল। টাঙন পারের শিবের মেলা দেখতে যাবে। এ বাড়িতে বাবা নেই প্রায় ছয় বছর। মা'ও গতবছর ডালিয়াকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছেন। শীতের রাতে ঠাণ্ডা বরফের মতো শক্ত শরীরটা একলা পড়ে ছিল লেপের তলায়। ডালিয়া কয়েকদিন আগেই ইন্দ্রকে আর্জি জানিয়েছিল যে মাকে ওর কাছে এনে রাখার। কারণ উত্তরবঙ্গের এ অঞ্চলে শীতের বড্ড দাপট! সে আর্জি মঞ্জুর হতে আরও চারদিন। তারপর ট্রেনের টিকিট পেয়ে অকুস্থলে এসে পৌঁছানোর আগেই মায়া কাটিয়ে ফেললেন ওর মা।


           ডালিয়া টোটো রিজার্ভ করে নেয়। একলা খোলা বাতাসে ভরদুপুরে ঘুরতে ওর খুব ভালো লাগে। উচ্ছন্নে যাওয়া মন্দ মেয়েদের মতো! যা ও কোনওদিনই হয়ে উঠতে পারেনি। মন্দ হয়ে ওঠা ওর কাছে রহস্য। তার অন্তরালে কী কী থাকে বা প্রাপ্তিযোগ কী তা জানার তুমুল ইচ্ছে ওর সেই বয়ঃসন্ধি থেকেই। ডালিয়ার তকমা, খুব ভালো মেয়ে। হাইরোডের বাঁপাশ ঘেঁষে মধ্যগতিতে ছুটছে বাহন। হঠাৎই ডালিয়ার মনে হলো, সেই বিয়ের পরে শপিং মলে ইন্দ্র ওর জন্য হট-প্যান্ট কিনতে গিয়ে কেমন তছনছ করা দৃষ্টিতে ওকে মাপছিলো! স্ট্রবেরি প্রিন্টের গোলাপি প্যান্টটা ওকে দিয়ে বলেছিল একটা গোলাপি ব্রেসিয়ার কিনতে। সাথে নেটের ট্রান্সপারেন্ট নাইটগাউন। ইন্দ্রর একের পর এক অযাচিত আবদারে ডালিয়া বিস্ফারিত নেত্রে কুঁচকে উঠছিল। রাতের আঁধারটুকু শরীর খেলার পরে সকাল হলেই এ যেন অন্য ইন্দ্র! সেদিন ক্যালেন্ডারে জ্বলজ্বল করছিল দশ। বিবাহবার্ষিকী। ‘আজও তো দশ! কেন একবারও খোঁজ নিলো না ইন্দ্র! কেন একবারও শুনতে চাইলো না আমায়! একবারও ফোন এলো না!...’ দু’হাত দিয়ে নিজেকে প্রায় জাপটে ধরলো ডালিয়া। টোটোতে ফরফর করে বাতাস এসে লাগছে চোখে-মুখে। ছিটকে পড়ছে সামান্য চোখের জল। খুঁজে পাওয়া দায়!


      হলদিবাড়ী পেরিয়ে বাঁ দিকের ঢাল ধরে গাড়ি আলের পথ ধরলো। এবড়োখেবড়ো রাস্তা। এক মিনিট স্থির বসা যায় না। সমস্ত শরীরে ঝাঁকুনি। তলপেটের সেলাইয়ের জায়গাটা চিনচিন করে উঠলো ব্যথায়। প্রহ্লাদের মা অনেকবার বলেছিল, 'অহনও তো কাটা শুকায় নাই! ওই রাস্তায় এহন যাইস না মা! অত ঝাঁকুনি প্যাটে লাগব। ম্যালা তো থাকব পনেরদিন!...' ডালিয়া কথা শোনেনি। অবাধ্য হতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর। 'কখনও তো অবাধ্য হই! আমার কথাও তো কেউ রাখেনি! কেউ না! বাবাই, মা! ইন্দ্র! কেউই না! ডাক্তারবাবুও না! বাবাই তো ছেড়ে চলেই গ্যালো! কত কিছু বায়না না মিটিয়েই চলে গ্যালো! বলেছিল কাঁটাতার পেরিয়ে পদ্মা পারে আমরা দু’জন হাত ধরে জোৎস্নায় হাঁটবো! বলেছিল বাহিনের জমিদার বাড়ির ছাদে চুপিচুপি উঠবো! একদিন কালীর মোখা পরে রাতের অন্ধকারে তোর মাকে ভীষণ ভয় দেখাবো!...আরও কত কী! বাবাইএর সাথে তো আড়ি হয়নি কোনওদিন! তাহলে লুকিয়ে গ্যালো কেন! একবার শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি মাকে বেশি ভালোবাসো না আমাকে! সেও একবারই! একবারই রাগতে দেখেছিলাম বাবাইকে। তারপর আর কখনও জিজ্ঞেস করিনি। বুঝেছিলাম, ভালোবাসার পৃথক পৃথক সংজ্ঞা হয়।...' পেটের ব্যথাটা বাড়ছে। ডালিয়া ভাবলো, একবার টোটোওয়ালাকে বলবে দাঁড়ানোর জন্য। কিন্তু এখানে তো দূরদূরান্ত পর্যন্ত শুধুই জমি! জনমানবহীন! মেরুদণ্ড সোজা ও শক্ত করে বসলো ও। নিজেকে শক্ত করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। ফিরে যাওয়াটাও বোকামো হবে। কারণ শহর ছেড়ে বহুদূর এসে পড়েছে ও।


         দুটো বাঁক পেরোতেই মনে হলো একটা পাড়ায় ঢুকছে ও। হাতে সিমেন্টের খালি ব্যাগ নিয়ে বছর দশেকের এক মেয়ে গরুর চারিতে খড় ঢালছে। একবার মুখ তুলে দেখে নিলো ডালিয়াকে। এখানে বসন্ত এলেও শীত এক্কেবারে চলে যায়নি। শীত এখানে মিঠে রোদ্দুর বিছিয়ে দিয়েছে। লিচুগাছের ডালে কচিপাতা সুখ। রান্নাঘর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে সেদ্ধ ভাতের ঘ্রাণ। পুকুরঘাট থেকে দুয়ার পর্যন্ত ভেজা চুলের ডগা থেকে টপটপ করে পড়তে থাকা জলের ডটেড লাইন নিঃসঙ্গ পড়ে আছে। যেন প্রেয়সী তাকে ত্যাগ করেছে এইমাত্র। তারই ইশারার দিকে ঠাঁয় তাকিয়ে। থালা ভরা বিউলির ডাল গা-গরমে ব্যস্ত। হাফপ্যান্ট পরা দুটি ছেলে ফর্দাফাই করে দিচ্ছে আম-কাঁঠালের গাছের গোড়ায় চড়ুইদের খুনসুঁটি। ওদের হাতে খড়ির পাতলা লাঠি। মাঝে মাঝেই পুঁইএর লকলকে ডগা টালির ওপরে পড়ন্ত রোদ্দুরে চকচক করছে। ডালিয়ার মনে পড়লো একবার পুঁইএর বিচি হাতে ডলে এক্কেবারে ভির্মী খাইয়ে দিয়েছিল মাকে। ‘আর সব্বার মতো মাও তো কথা রাখলো না!’ ধুলো উড়ছে চারপাশে। নিঝুম পাড়া। শুকিয়ে গেছে পুকুরের জল। সামান্য অবশিষ্টতেই কাদার ভেতরে গুগলি খুঁজছে কয়েকটি হাঁস। 'ইন্দ্র কেন যে ডঃ সেনের কথায় রাজি হলো! কেন বললো না একটু রিস্ক নেওয়া যায়। শুধু টিউমারটা কেটে বাদ দিয়ে ইউটেরাসটা রাখলে কী হতো! এক-দুমাস তো দেখাও যেত! সঙ্গে সঙ্গে তো আর ক্যানসার হচ্ছে না! আর কিছুদিন তো চেষ্টা করা যেত! যদি...'


              বুকের ভেতরটা খালি হয়ে এলো ওর। মনে হলো ওর বদলে কোনও একটা অস্তিত্বহীন অবয়বকে বহন করে চলেছে টোটো। না, আর কোনও ঝাঁকুনি বোধ হচ্ছে না ওর। কোন ব্যথাও না! ধুলোর ভেতরে হালকা হাওয়ায় দুলে উঠছে ক্যালেন্ডার। আজকের তারিখ দশ। ‘শুভ বিবাহবার্ষিকী ডলি!’ নিজের মনে নিজেই বলে উঠলো ও। নাকি নিজেকে উইশ করলো! ‘এই নামেই তো ইন্দ্র ডাকত! কবে যেন শেষ ডেকেছিল!’ চৈত্রের রুখা-সুখায় জলদি শুকিয়ে যাবে তলপেটের সেলাই। ফসিলের মতো থেকে যাবে দাগ। ডালিয়া এতদিনে দাগরাজি হতে পেরেছে। একটু যেন হাসলো ও। মন্দ হতে আর বাঁধা কোথায়! ‘দিদি ম্যালা আইসা গ্যাছে। নামো! তুমি ঘুইরা আইসো। ঐদিকের অশত্থ গাছের তলায় আমি বইয়া থাকুম। তয় বেশি দেরি কইরো না!...’ টোটো থেকে নেমে দাঁড়ালো ডালিয়া। আর কিছুক্ষণ পরেই তো ধুলো জমে যাবে এই দশে। আবার অপেক্ষা অন্য কোনও দশের! ততক্ষণ না হয় একটু হুল্লোড় হয়ে যাক এই গন্তব্যহীন, লক্ষ্যহীন, বেনামি জীবনের সাথে! একা! বাবাইএর ‘ফুল’। মায়ের ডালিয়া আর ইন্দ্রর ডলি! ‘এক্কেরে নির্ভার!’...


No comments:

Post a Comment