Thursday, April 4, 2024


 

মুনা 

অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪৩০


অবসাদ সমস্যাতে স্বামীজি

জয়তী ব্যানার্জী

       
প্রতিদিন প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে জয় করার খেলায় নেশাগ্রস্ত আমরা প্রায় সবাই। মহাবিশ্বের এই আদিগন্ত দিগ্বিদিক্ পরিমণ্ডলকে অতিক্রম করে আজ ব্রহ্মাণ্ডেও প্রসারিত হচ্ছে মানবতার পদচারণা। নিজেকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে নিযুক্ত সবাই। অজস্র নিরন্তর চেষ্টার মধ্যে কখনো পাওয়া যায় অমৃত, কখনো বা গরল। সফলতা থেকেই অনুপ্রেরণা তৈরি হয়। ব্যর্থতা প্রসব করে নৈরাশ্য অবসাদ বা ডিপ্রেশন। অবসাদ মানুষকে ক্রমশ মৃত্যুর সঙ্গে করমর্দন এ বাধ্য করে, যেটা বর্তমান সমাজের একটা প্রজ্জ্বল্যমান সমস্যা। তবে হতাশাগ্রস্ত মানুষটিও পারে তার এই মানসিক সংকট থেকে মুক্ত হতে।
আকাশে বাতাসে ভেসে ওঠে
      যা আসে আসুক
       যা হবার হোক
  যাহা চলে যায় মুছে যায় যাক
গেয়ে যায় দ্যুলোক ভুলোক
       প্রতিটি পলকের রাগিনী----
     
অবসাদ সমস্যাটির সমাধানে সফল ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে বিজ্ঞান। সমস্যাটির প্রকৃতি লক্ষণ সন্ধানে  শিক্ষার্থীর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে দেশে-বিদেশে। নির্দিষ্ট পদ্ধতির সাহায্যে বিজ্ঞান সুনিশ্চিত ও সার্বজনীন জ্ঞান উপস্থাপন করে আর এই জ্ঞান ব্যাপকতা ও সার্বিকতা প্রাপ্ত হলে তা দর্শন নামে অভিহিত হয়।

Plato তার Republlic গ্রন্থে বলেছেন----

     The philosopher one who loves not a part of knowledge but the whole ,his passion is for truth....
            
প্রতিটি মানুষের উপাস্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে এক বিচক্ষণ মনস্তাত্ত্বিকের মনীষা নিয়ে আজও মানুষকে পরিচিত করিয়ে চলেছেন প্রকৃত মানব দর্শনের সঙ্গে। তাঁর অমৃত বাণী আশীর্বাদী ফুলের মতোই মানুষের যেকোনো সমস্যার বলিষ্ঠ উপশম। স্বামীজীর ভাষায় সর্বাগ্রে কাম্য হল আত্মশক্তির অনুভব। তিনি প্রথম বোঝাতে চেয়েছিলেন-

জীবনের পরম সত্য : এই শক্তিই জীবন ;দুর্বলতাই মৃত্যু; শক্তিই সুখ আনন্দ : শক্তি অনন্ত অবিনশ্বর জীবন; দুর্বলতাই দুঃখ ও উদ্বেগের কারণ, দুর্বলতাই মৃত্যু। শক্তি হলো আত্মশক্তি বা আত্মবিশ্বাস। আমাদের প্রত্যেকের উচিত এই শক্তিকে অন্তরে উপলব্ধি করা।

 স্বামীজি বারবার বলেছেন,
        `তোমরা নিজ নিজ স্বরূপের চিন্তা করো এবং সর্বসাধারণকে ওই শিক্ষা দাও। ঘোর মোহনিদ্রায় অভিভূত জীবাত্মার নিদ্রা ভঙ্গ করো। আত্মা প্রবুদ্ধ হলে পবিত্রতা আসিবে, যাহা কিছু ভালো সকলি আসিবে।`
           
যেকোনো লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য দৃষ্টিভঙ্গি সদর্থক হওয়াই সমীচীন। ব্যর্থতাকে যদি ব্যর্থতা মনে না করা হয় তবেই আন্তরিক শক্তি সহজে স্ফূরিত হয়। এই জগত ভালো ও মন্দ দিয়ে প্রস্তুত; তবুও এর উপাদান হচ্ছে ভালো,তার চেয়েও ভালো এবং তার চেয়ে আরো ভালো... পরিস্থিতি মানুষকে শিক্ষা দেয়। যে কোন অবস্থাতেই একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়ার দরকার নেই ....যেকোনো মনোবৃত্তির নীতি বা ধর্মকে ওই ভাব--- যে অবস্থায় পায় সেই অবস্থাতেই সাদরে গ্রহণ করে এবং এই অবস্থাতেই আমাদের শেখায়-- এ পর্যন্ত সব ভালই হয়েছে এখন আরও ভালো করার সময় এসেছে। এটাই আমাদের বাস্তবে মেনে নিতে হবে যে,যদি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে দেখা যাবে যে সেই স্বর্গ রাজ্য আগে থেকেই বিদ্যমান; মানুষের যদি দেখার স্বাদ থাকে তবে সে দেখবে সে যে পূর্ব থেকে ই পূর্ণ।

       তবে প্রকৃতিগত ভাবে মানুষের চিন্তা পরস্পরের থেকে আলাদা, সকলের ভাবনা সমান নয়। অনেক মানুষ কৃত্রিম-- ঈশ্বর অদৃষ্ট বা প্রকৃতির অধীন সাফল্য ও ব্যর্থতাকে এক মানদন্ডেই বিচার করে ।এজাতীয় চিন্তাও আত্ম বিশ্বাসকে প্রশমিত করে।

      স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার বোধ জাগ্রত করেছেন। তাঁর মতে মানব সত্ত্বা সর্বশক্তিমান ---মানুষের জন্ম প্রকৃতিকে জয় করার জন্য; তাকে অনুসরণ করবার জন্য নয়.... ঈশ্বর, প্রকৃতি ও অদৃষ্ট এই তিনটি বাহ্য মানদণ্ড নয় ,মানুষ তার কর্মফল নির্ধারণ করে নিজেই ।অন্তরের আত্মবিশ্বাসকে তার প্রিয়জনের মতো অবলম্বন করতে হবে যার উপস্থিতি মনোবল বৃদ্ধি করে, আস্থার আশ্বাস দেয়।  বাস্তব জগত যা প্রকাশ করে তা সত্য ।সত্যকে সহজে গ্রহণ করার সাহস মানুষের অন্তরেই বিদ্যমান। মানুষের উচিত নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করা যেখানে হতাশা নৈরাশ্য বা অবসাদের কোন স্থান নেই। 
       
মৃণালিনী বসুকে লেখা পত্রে স্বামীজি লিখছেন,
      'যখন হৃদয়ের মধ্যে মহাযাতনা উপস্থিত হয়, চারিদিকে দুঃখের ঝড় ওঠে বোধহয় যেন আলো দেখতে পাবো না,যখন আশা ভরসা প্রায় ছাড়ে ছাড়ে, তখনই এক মহা আধ্যাত্মিক দুর্যোগের মধ্য থেকে অন্তর্নিহিত ব্রহ্মজ্যোতি প্রকাশ পায়। ক্ষীর ননী খেয়ে, তুলোর উপর শুয়ে, ----এক ফোঁটা চোখের জল না ফেলে-- কেউ কি বড় হয়েছে,, কাঁদতে ভয় পেলে চলবে না ,কেঁদে কেঁদে তবে- তবে অন্তর্দৃষ্টি হয়.... প্রতিটি নেতিবাচক অবস্থায় প্রতিটি নারূপ পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাসের সাথে মানিয়ে নেওয়াটাই জীবন: তাই তো জীবনের সমস্ত রহস্যই হলো খাপ খাওয়ানো, মানিয়ে নেওয়া ,উপযোগী করা ---- এটাই হল প্রানের অন্ত:শক্তি এবং এর প্রভাবেই জীবন বিকশিত হয় ..শক্তির বিরুদ্ধে যুয্যুমান ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ই হলো সামঞ্জস্য বিধান।'
       
স্বামীজি বলেছেন, 'দৈহিক বলে উন্নয়নের চেষ্টা করিও না আত্মার শক্তিতে উদ্ধারের উপায় দেখো।' ক্রমাগত ব্যর্থতার সম্মুখীনতায় নৈরাশ্য বা অবসাদ কে প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ পরাজয়। নিরন্তর প্রয়াসই মানুষকে তার সাফল্যের নিকটবর্তী করে। মানুষকে তার লক্ষ্যে উপনীত হতে সাহায্য করে। এই নিশ্চিত সংগ্রামে স্বামীজি মানুষের জয় কামনা করেছেন। নিজের অন্তরের শক্তির শেষ কণাটুকুকেও জীবন সংগ্রামের প্রয়োজনীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, কারণ প্রয়াসের কোন বিকল্প নেই।
           
সাফল্য ও অসাফল্যের বুননে মানুষের জীবনচিত্র তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। মন থেকে সহজ ভাবে এই দুটি বিষয় গ্রহণ করতে হবে। ডিপ্রেশন বা অবসাদ মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তি বা আত্মশক্তির তুলনায় নগণ্য , আত্মশক্তির উদ্বোধনের সাহায্যে এই সমস্যার সমাধানও মানুষের অসাধ্য নয়।
      মনেরে তাই কহ যে
         ভালো-মন্দ যাহাই আসুক

            সত্যেরে লও সহজে।    

No comments:

Post a Comment