Friday, May 3, 2024



 মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



মা

মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী


সেদিন গিরিবালা দিদা মাকে দেখিয়ে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ আপনার মেয়ে না ছেলের বউ? মা ঠাকুমাকে বাবার চেয়ে অনেক বেশি জোরে মা মা বলে ডাকতেন। তাছাড়া ঠাকুমার গায়ের রঙ পাকা সোনা, মায়ের দুধে-আলতা। বাবা শ্যামলবরণ, দাদু ঘোর শ্যামলবরণ। গিরিবালা দিদিমার পেত্যয় হয়েছে মা-ই ঠাকুমার মেয়ে আর আমার বাবা তাঁর জামাই। 
মামার বাড়ি ছিল অনেক দূরে। মায়ের সন্তান হওয়া, সন্তান হবার পর তাঁর যত্ন, সব ঠাকুমা করতেন। মা বলতেন, তোমাদের দাদু-ঠাকুমার মত কেউ ভালোবাসতে পারবে না গো! আহা, তোমাদের গায়ে পোকাটি পর্যন্ত বসতে দিতেন না তাঁরা।
সকাল হতেই সাজো সাজো রব একদিন। মা ঠাকুমাকে বললেন, মা, দুটো ভাত খেয়ে আমি বেরিয়ে পড়ব। সান্ত্বনাদির চাকরি হওয়াটা খুব দরকার। এত অল্পবয়সে স্বামী মারা গেছেন, একটা কিছু কাজকর্ম না হলে সারাজীবন কাটাবে কি করে? কোনও একটা কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে! ঠাকুমা দুটি গরম ভাত-ডাল-আলুসেদ্ধ বেড়ে দিলেন মায়ের সামনে। তিনি সেগুলো মুখে দিয়ে ছুটলেন সান্ত্বনাদিকে সহায়তা করবার জন্যে।
মা রান্নাঘরে কিছু করতে গেছেন। ভাই বেদম কান্না জুড়েছে, আমারে পড়াও, আমারে পড়াও বলে। ঠাকুমা বললেন, 
ওবা লক্ষ্মীমা, তুঁই ফড়াও, আঁই বেয়াগ্গিন কাম খরি ফেলাইয়ম। লেখাপড়া শিখ্যো,  হিতারারে শিখাও, কাম হই যাইব গুই। 
একজন পুত্রবধূর শাশুড়ির প্রতি বা তাঁদের পরস্পরের প্রতি যে নির্ভরতা ও বিশ্বাস আমি পারিবারিক জীবনে দেখেছি, তার কোনও তুলনা হয় না।
 মা এভাবে প্রায়ই সমাজসংস্কারমূলক কাজে বেরিয়ে পড়তেন। বাবা তো চাকরি নিয়ে বাইরেই। সংসার সামলাতেন দাদু-ঠাকুমা। কেউ হয়তো এসে নালিশ করেছে মায়ের কাছে, তার স্বামী তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, কখনও মারধোরও করে! সেখানে বন্ধুদের নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন মা এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কেউ অসুস্থ, ওষুধ কিনতে পারছে না, মা ওষুধ কিনে দিয়েছেন চাঁদা তুলে।
আমার সহপাঠিনী কৃষ্ণার মা এসে একদিন বললেন, আপনি একটু আপনার বাচ্চাদের সাথে আমার মেয়েটিকেও পড়িয়ে দিন না। সিক্সে উঠেছে, ইংরেজিটা ধরতে পারছে না ঠিক। মা হাসিমুখে বললেন, বেশ, সন্ধেবেলা পাঠিয়ে দেবেন। মেঝেতে মাদুর পেতে বসে মা আমাদের পড়াতেন। পাশের বাড়ির ঝা পরিবারের বাচ্চাটি বসে ইংরেজি শিখত। মা খোশমেজাজে এতগুলো বাচ্চার পড়া সামলাতেন। ঠাকুমাও তাঁর গড়গড়াটি নিয়ে বসে পড়া শুনতেন। শ্রুতিধর এই মানুষটির পড়াশুনোর প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল, শৈশবে তিনি পড়তে পারেননি। 
হাস্যমুখী লাবণ্যে ঝলমল আমার সেই মাকে খুব মনে পড়ে।
মায়ের ইস্কুল ছিল কলকাতার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন। তারপর কলকাতার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। লেখাপড়া শিখেছিলেন কষ্ট করেই। মাতামহ অসুস্থ হয়েছিলেন, সংসার চালাতেন বড়মামা। এতগুলো ভাইবোন, তাঁর নিজের সংসার সব নিয়ে বেশ কষ্টেই চালাতেন বড়মামা তখন। মায়ের হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মত। কে একজন তাঁর লেখা দেখে হরিণঘাটা দুগ্ধ প্রকল্পে ডেকে চাকরি দেন। সে যে কে, কে জানে! মা নেই, বাবা নেই, বড়মামা নেই---বলবে কে?
কিছুদিন পর মা বাবার সঙ্গে বিয়ে হয়ে চলে আসেন আসামে। যেখানে থাকতেন সেখানে কাছাকাছি কোনও স্কুল ছিল না, অনেক দূরে স্কুল। মা আর তাঁর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে পরিত্যক্ত একটি রেল কোয়ার্টারে একটি স্কুল খুললেন। মা পড়াতেন ইংরেজি-বাংলা। কয়েকবছর সেখানে স্কুল চলার পর রেল ওই স্কুলটিকে অধিগ্রহণ করে এবং স্কুলটি পাকাপাকিভাবে শুরু হয়। তবে ততদিনে মা ইস্কুল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর খুব কাছাকাছি বয়সের দুটি সন্তান হয়েছে, তাঁদেরকে রেখে তিনি দীর্ঘসময় বাইরে থাকতে পারছেন না তখন। স্কুল তাঁর জন্য আসন রেখেছিল, তাঁর আর ফেরা হয়নি। অনেকদিন পর নিউ বঙ্গাইগাঁওতে এক আত্মীয় বাড়িতে আমাকে দেখে একটি বড় মেয়ে বলল, সন্ধ্যা দিদিমণির মেয়ে? দিদিমণির মত সুন্দর নয়। দিদিমণি গোলাপি শাড়ি পরে আসতেন, আমাদের ইংরেজি শেখাতেন, সবসময় হাসিমুখ! কোনো না কোনোভাবে মা চিরকাল পড়িয়েছেন। বাড়ির কর্মসহায়িকাকেও পড়িয়েছেন, তার ছেলেপুলেকেও। খুব উৎসাহ আর ধৈর্য নিয়ে তিনি পড়াতেন।
মা চলে গেছেন। যত বয়স বেড়েছে আমি শুধু এটাই দেখেছি যে চরম দুঃখের মধ্যেও হতাশ না হয়ে মনে প্রত্যয় রেখে তিনি চলতেন। তাঁর চোখেমুখে ঝলসে উঠত সেই প্রত্যয়ের আলো। ভারী সুন্দর দেখাতো তাঁকে। সব কাজে লিপ্ত থেকেও সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে এই যে আত্মদীপখানি তিনি জ্বালিয়ে রাখতেন, গভীর তমিস্রার মধ্যে একটি ক্ষীণ অথচ অতন্দ্র দীপশিখার মত, এইটে তিনি কিভাবে পারতেন আমার জেনে নেওয়া হয়নি।
 মা খুব ধার্মিক ছিলেন। তাহলে ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ তাঁকে কি সেই শক্তি দিয়েছিল যা মানুষকে সকলকে ভালোবাসতে শেখায়, সচ্চিদানন্দে রাখে? কে জানে! তিনি তো আমার গুরুও, জানিয়ে গেলেন না তো আমায় কিছু! নাকি নিজে আচরণ করে আমাকে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন সঠিক আচরণীয় ধর্ম। সেটা আর পালন করতে পারি কই! আমার অন্তরের দীপ জ্বালাবার মন্ত্র তিনি শিখিয়ে দেবেন নিশ্চয়ই, এই প্রত্যয় মনে রেখে রোজই তাঁকে স্মরণ করি।

No comments:

Post a Comment