মুজনাই
অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১
ক্রোড়পত্র
রয়ে গেল না বলা যে কথা
অমলকৃষ্ণ রায়
চিঠি নং ১
(দেশভাগের সময়কার কাল্পনিক চিঠি। মাকে লেখা )
শ্রীচরণেষু মা,
এর আগে আমায় কখনও এতটা দূরে পাঠাওনি। তাই ছলছল চোখে মাথায় ছুঁয়ে বলেছিলে, সাবধানে যাস বাবা। চিন্তা করো না মা। আমি নিরাপদে ভারতে পৌঁছে গেছি। এখুনি ট্রেনটা পূর্বপাকিস্তান, আসাম, ভুটান, নেপাল পরিবেষ্টিত একটুকরো স্বাধীন ভারতবর্ষের করদমিত্র রাজ্যশহর কোচবিহারে পৌঁছলো। একঝলক দেখেই শহরটা ভালো লাগল। লাগবেই, রাজার শহর বলে কথা। বেশ সাজানোগোছানো। পাশে একটা নদীও আছে। ঠিক আমাদের পদ্মার মতোই, নাম তোর্সা।
বাবার কথাটা ভুলিনি মা— ‘দেশে কোনওখানে শান্তি নাই। কই গেলে যে শান্তিতে থাকোন যাইব, ক্যাডা জানে। শুনতাছি, কোচবিহার স্বাধীন রাজ্য, শান্তির জাগা। মনে হয় বাঁচতে অইলে ওহানেই যাওন লাগব।’ সত্যিই তাই, বাবা ঠিকই বলেছিল। জানো মা, ব্রিটিশ ভারতের পরাধীনতা এ রাজ্যের মাটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই এ মাটিতে পা রেখে একটা আলাদা রকমের একটা স্নিগ্ধতার ছোঁয়া অনুভব করলাম। এখানে ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি, অনুশীলন সমিতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এসব কিচ্ছু নেই। তাই দেশান্তরে একটুকরো নিরাপদ আস্তানার খোঁজে এখানে এসে মোটেই ভুল করিনি। নিশ্চিত থেকো, একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় না করে দেশে ফিরব না।
ট্রেনে আসার সময় এক সহযাত্রী একটা আদর্শ বাড়ির পরিবেশ কেমন হয় বলছিলেন— ‘পুবে হাঁস পশ্চিমে বাঁশ, উত্তরে গুয়া দক্ষিণে ধুয়া’। ব্যাপারটা তোমায় বুঝিয়ে বলছি শোন, হাঁস মানে হলো বাড়ির পুবে একটা পুকুর থাকবে। পশ্চিমে থাকবে বাঁশের ঝাড়। উত্তরে গুয়া মানে হলো সুপুরি বাগান। আরা দক্ষিণে ধুয়া মানে হলো ফাঁকা জায়গা থাকবে। আশীর্বাদ করো মা, এই রাজ্যে যেন সেরকমই একটা বাড়ি বানাতে পারি।
আজ আশ্বিনের সংক্রান্তি। এদিনে তুমি আগের দিন রাতে ভাত রান্না করে রেখে দাও। পরদিন সকালবেলা সে ভাত সবাই মিলে খাই। কারণ জানতে চাইলে বলো,
আশ্বিনে রাঁধে বাড়ে কার্তিকেতে খায়,
কাকভোরে খেলে পরে ভবব্যাধি যায়।
তোমার রান্না-করা সে ভাত আগামীকাল আর খাওয়া হবে না। কিছু করার নেই মা। জীবনে কিছু পেতে হলে তো কিছু ছাড়তেই হয়। একদিন একটা নিরাপদ আস্তানা এবং নিশ্চিত অর্থোপার্জনের খবর নিয়ে তোমাদের কাছে পৌঁছে যাব। আমাদের মতো মানুষের মোটা ভাত-কাপড় ছাড়া আর কী চাই মা।
ইতি তোমাদের
স্নেহের অমল
কোচবিহার রাজ্য, ভারত
চিঠি নং ২
(মাকে শূন্যতার অনুভূতি জানিয়ে চিঠি)
শ্রীচরনেষু মা,
কদিন ধরে বুকের ভিতরটা খা খা করছে। জানি না ঠিক কেন এরকমটা হচ্ছে। তোমাকে কতগুলো কথা বলতে পারছি না, সেই না বলতে পারার জন্যই, নাকি তুমি নেই বলে; ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার বন্ধু মলয় বললো, মা চলে গেল প্রথম প্রথম কিছুদিন ওরকম হয়। পরে ঠিক হয়ে যাবে। আমারও হয়েছি্ল। তুই যা বলছিস, সেটা হলো শূন্যতার অনুভূতি। একদিন সে শূন্যতা কোনও না কোনওভাবে পূরণ হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি প্রথমে সেটাই সত্যি ধরে নিয়েছিলাম। পরে দেখছি, যত দিন যাচ্ছে আমার এই উপসর্গটা তত বেড়েই চলেছে। তখন ধরে নিলাম, ওটা শূন্যতা নয়, কথার ভার। তোমার সঙ্গে রোজ রোজ যে কথাগুলো বলতাম, সেসব বুকের ভিতর জমে গিয়ে ভার অনুভূত হচ্ছে। কথারও বোধহয় একটা জড়বস্তুর মতো ভার আছে। যদিও সেটা ভৌতবিজ্ঞানে কোনওদিন পড়িনি। সে যাই হোক, শেষে ঠিক করলাম, কথাগুলো তোমায় লিখে আমার বুকের ভার লাঘব করব। জানি, তুমি এখন তারাদের দেশে রয়েছ। আমার চিঠি সেখানে পৌঁছাবে কিনা জানি না। তবুও চেষ্টা করতে দোষ কী! আসলে এরকমটা হতো না, যত দোষ তোমার। যাবার আগে একটা বারের জন্য বলে গেলে না, তোর যত কথা আছে বলে ফেল। আমার কিন্তু আর বেশিদিন সময় নেই। সেটা জানা থাকলে হয়তো কদিন অফিসে ছুটি নিয়ে তোমার পাশে দিনরাত বসে কথাগুলো সেরে নিতাম। যাকগে, যেটা হয়নি সেটা বলে আফসোস করে আর কী লাভ। আজ থেকে আমার চিঠি লেখা চলবে। তুমি আমার চিঠির উত্তর যদি লিখে দিতে না পারো, তো একটা কাজ করো। স্বপ্নে এসে আমার কানে কানে বলে যেয়ো। তাহলেই চলবে। ভুলে যেয়ো না কিন্তু। তোমার তো আবার ভুলো মন, মালা জপতে বসলে কোনও কিছুই মনে থাকে না।
মলয়ও বলেছে মা, মাসীমা ঠিক সময় করে একবার টুক করে স্বর্গ থেকে নেমে এসে তোর চিঠির উত্তর দিয়ে যাবে। দেবে তো মা, বলো।
ইতি
তোমার অমল
No comments:
Post a Comment