অন্যচোখে
একালের বাবা, সেকালের বাবা!
ড. কৃষ্ণ দেব
একালের বাবা'দের সঙ্গে আমাদের সময়ের বাবা'দের মনও মানসিকতার বিস্তর পার্থক্য ছিল। এক সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচারে 'হামদো হামারা দো ' খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, অনেকেই এই নীতি গ্রহণ করেছেন। যদিও এইসময়ের বাবা'রা 'আমাদের একটিই 'নীতি অনুসরণ করে চলছেন। এতসব সত্ত্বেও কোন হিসেব-নিকেশ ছাড়াই প্রকৃতিগত ভাবেই বোধহয় নারী-পুরুষের সমানুপাত দেখা যায়! আবার সবাই যে, 'আমাদের একটিই' নীতি নিয়ে চলেন এমনটা নয়, একশ্রেণীর বাবা প্রথম সুযোগেই যদি পুত্র সন্তান লাভ করেন, তাহলে অভিষ্ট পূরণ হয়েছে বলে দ্বিতীয় টির পথে পা বাড়ান না।এই বাবাদে'র কাছে 'ছেলে হচ্ছে অগ্রাধিকার'! আবার একশ্রেণীর বাবা আছেন, যাদের কন্যা সন্তান হলেই, দ্বিতীয় সুযোগ গ্রহণ করেন "পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষায়। আর আমাদের সেই কালের বাবা'রা অনেক সন্তানের জনক হতেন, কারণ তখন সমাজে সম্পদের প্রাচুর্য ছিল। ১০/১৫ টি মুখ সংসারে এলেও সে যুগে কিছু যায় আসতো না!
১২৫ বছর আগে জন্ম নেওয়া এক পরিচিত বাবা'র গল্প শুনেছি, যিনি একটি বিয়ে করেছিলেন, তাঁর সেই একমাত্র স্ত্রী ১৮ টি সন্তানের জননী হয়েছিলেন।
আমার এক মাসি এক- দেড় বছর অন্তর অন্তর আট'টি কন্যা সন্তান প্রসব করেছিলেন, একটি পুত্র সন্তান লাভের জন্য শিক্ষিত মেসো মশাই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন ,অষ্টম কন্যার নাম রাখেন ইতি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেসো মশাইয়ের ইচ্ছে পূরণ করতে নবম বারের জন্যে গর্ভধারণ করলেন মাসি। কিন্তু নবম বারেও মাসির কোল আলো করে জন্ম নিলো সমাপ্তি! গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে একই দিনে মাসির কোলে আশ্রয় নিল একটি পুত্র সন্তান। কি ভাবছেন যমজ সন্তান! না। মাসি যখন হাসপাতালে সন্তান প্রসবের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন, তখন তার পাশের শয্যায় আর এক প্রসূতি মা ভর্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন ভিন রাজ্যের এক সেনা জওয়ানের স্ত্রী। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়, কিন্তু বেঁচে যায় তার পুত্র সন্তানটি। ওই অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ওই ভিনদেশী সেনা জওয়ান কোন শর্ত ছাড়াই সদ্যোজাতকে মাসির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ফলে একই সাথে মাসির স্তন্য দুগ্ধ পান করে বড় হয়ে ওঠে আমার মাসতূতো ভাইটি। আমার আর এক মাসির আবার উল্টো কাহিনী! কন্যা সন্তানের আকাঙ্খায় একের পর এক তিনি পুত্র সন্তান প্রসব করেন, যে সংখ্যাটা দাঁড়ায় আটে। সর্বশেষ মাসি আবার গর্ভধারণ করে যমজ কন্যা সন্তান প্রসব করেন!
আবার পুত্র সন্তান কামনায় ব্যাকুল এক বাবার কাহিনী জানি, যার স্ত্রী ছয়টি কন্যা সন্তান প্রসব করেছিলেন। কিন্তু ওই মায়ের নিস্তার ছিল না, পুত্র সন্তান কামনায় ওই বাবা এক জ্যোতিষীর কাছে হত্যে দিলেন। জ্যোতিষী নিদান দিলেন স্ত্রী গর্ভধারণ করার সময় থেকেই সন্তান প্রসব করার সময় পর্যন্ত তাদের নিরামিষ ভোজন করতে হবে। গাদা গুচ্ছের তাবিজ, কবজ, মাদুলি বাবাদুলি সব তার গলায় লোটকে দিলেন। তার স্ত্রী গর্ভধারণ করলেন। গ্রাম শুদ্ধ মানুষকে নেমন্তন্ন করে সাধ ভক্ষণের আয়োজন করলেন।
কঠোর কৃচ্ছসাধন শেষে সেই আকাঙ্ক্ষিত দিনটি এলো! বাড়ি শুদ্ধ লোক প্রসূতি কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করছেন। সদ্যজাত'র ক্রন্দন কর্ণগোচর হল, আনন্দে উজ্জল হল সকলের মুখমণ্ডল। যুদ্ধ শেষে যেন শান্তির সুবাতাস! সিস্টার কে দেখে এগিয়ে গেলেন সবাই, সিস্টার হাসিমুখে ওই বাবা'কে বললেন, মা ষষ্ঠীর কৃপায় আপনি যমজ কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছেন! এই কাহিনী আর বৃদ্ধি করলাম না, এরপর কি হতে পারে সবাই নিজের নিজের মত আন্দাজ করে নেবেন।
আজকের দিনে একটি বা দুটি সন্তানের বাবা মায়েদের অসহায়তার কথাও মাঝে মাঝে শুনি। সব সব বাবা মায়েরা তার সন্তান মানুষ হোক মনে মনে এ কামনা না করলেও, ছেলে ডাক্তার ,ইঞ্জিনিয়ার, আই এস, আই পি এস হোক এটা মনেপ্রাণে চান। ফলশ্রুতিতে ছেলে মানুষ হয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়, সল্টলেকের অভিজাত ফ্ল্যাটে পড়ে থাকেন গর্বিত বাবা মা। ইচ্ছে করলেই তো আর অতদূর থেকে বাড়িতে আসা যায় না! খোকাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে তাদের। খোকা বলে যদি বেশি ইচ্ছে করে দেখতে তাহলে "হোয়াটসঅ্যাপ কল করো", এত বেশি ব্যাকুল হলে মুশকিল!
কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেলে! দূরত্ব বাড়ে। একদিন বুড়োবুড়ির চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে। যুক্তিবাদী বাবা মাকে সান্তনা দেয়! হয়তো বিশ পঞ্চাশ লাখ টাকা জমা দিয়ে কোন বৃদ্ধাশ্রম বুক করে রাখতে পারে খোকা !এর চাইতে বেশি আর কি করবে তাদের খোকা!
প্রশ্ন হল এত লেখাপড়া শিখিয়ে, ছেলেকে 'মানুষ তৈরি করে' যদি বৃদ্ধাশ্রমেই যেতে হয় বাবা মা'কে তাহলে বাবা-মায়ে'র কৃচ্ছসাধনের মূল্য কি রইল? নতুন নতুন ব্যবসা পাতির দিগন্ত খুলে যাচ্ছে! বিভিন্ন ব্যবসার শ্রী বৃদ্ধির সঙ্গেই ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে 'বৃদ্ধাশ্রম' তৈরির ব্যবসাও! আমার এই আলোচনা শুনে পাড়ার পাঁচু খুড়ো খেঁকিয়ে উঠলেন "এই জন্যই বলি বাচ্চাকাচ্চা বেশি হোক'তাহলে আর এই সমস্যা থাকবে না। পাঁচুখুড়োর এই যুক্তি এই ডিজিটাল যুগে কি কেউ মেনে নেবে ?
এই দেখো, কথায় কথায় নিজের বাবার কথা বলতেই ভুলে গেলাম! আমরা ছিলাম সাত ভাই বোন। ছোটবেলায় আমার বাবা তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন। ব্যবসা নিয়ে সদা ব্যস্ত বাবা'র ধর্ম মা গোপালদাসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেই আমরা বলতে গেলে মানুষ হয়েছি! তাঁকে আমরা কর্তামা বলে ডাকতাম। কখনো বুঝতে পারিনি তিনি আমার বাবার নিজের মা নন। তিনি একজন মহীয়সী নারী ছিলেন, সে যুগে তিনি মেয়েদের একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন, নিজে শিক্ষিকা ছিলেন। কর্তামার হাত ধরেই আমরা স্কুলে যেতাম। সকাল হতেই বাবা দোকানে চলে যেতেন । দুপুরবেলায় খেতে আসতেন। আর দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতেন রাত সাড়ে নটা নাগাদ।
ততক্ষণে হয়তো আমরা ভাই বোনেরা ঘুমে কাতর হয়ে পড়তাম। দোতলা মাটির বাড়ি ছিল। অদুরে ছিল বিশাল দীঘি, দিঘির পাড়ে ঘন জঙ্গল। সন্ধ্যে হতেই শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক শোনা যেত, আর রাত বাড়তেই হায়নার আনাগোনা। আমাদের কারো হাসপাতালে জন্ম হয়নি, বাড়িতেই জন্মেছিলাম, ধাইমা নাড়ি কেটেছিল। মূল ঘর থেকে কিছুটা দূরে ছিল আঁতুর ঘর। হয়তো স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আঁতুরঘর কে পৃথক রাখা হতো। সেই যুগে গ্রামবাংলায় হায়নার খুব উৎপাত ছিল। হায়না গভীর রাতে শিশুদের জঙ্গলে তুলে নিয়ে যেত, গলা ফুটো করে রক্ত খেত! আমাদের গ্রাম দেশে এক সময় আখছার এরকম ঘটনা ঘটতো । সন্তান প্রসব করলেই তার ঘ্রাণ হায়নার নাকে চলে যেত। আমি যখন মায়ের কাছে ওই আঁতুড় ঘরে ছিলাম, তখন নাকি হায়না বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিল সেই ঘরে ঢুকে আমাকে তুলে নিতে! শুনেছি হায়না কাঁথা সহ আমাকে টানাটানিও করেছিল! মায়ের বাঁধায় ও চিৎকারে নিতে পারেনি! তাই বলি হায়নার হাত থেকে যখন বেঁচে ফিরেছি, তাহলে অন্তত সহজে আমার মৃত্যু হবে না! আমার বাবা সকালে উঠেই সেই অস্থায়ী ঘরের জানালা শক্তপোক্ত ভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দুপুরবেলা বাবা বাড়িতে খেতে আসতেন, ঘন্টাদুয়েক বিশ্রাম নিয়েই দোকানে চলে যেতেন। দুপুর বেলা যখন বাবা বিশ্রাম নিতেন, আমাদের কাজ ছিল ছোট্ট ছোট্ট ঝিনুক দিয়ে বাবার পিঠের ঘামাচি মেরে দেওয়া। এর জন্য বরাদ্দ ছিল পাঁচ পয়সা, তখনকার দিনে এই পাঁচ পয়সার ভালই মূল্য ছিল, পয়সা পেলেই পাড়ার দোকানে গিয়ে চেনাচুর কিনে আনতাম, আবার কখনো ধানের সাহায্যে বাবা'র পাকা চুল তুলে দিত আমার ছোট বোন কাবেরী। এই পাকা চুল তোলার জন্যেও পয়সা বরাদ্দ ছিল।
আজকের যুগে ছেলে মেয়ের পরীক্ষা মানেই তো বাবা-মায়ের পরীক্ষা! পরীক্ষা তো নয়, যেন যুদ্ধ! আর আমাদের মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের সময় কখনোই বাবা-মায়েরা পরীক্ষা কেন্দ্রে ছোটেননি। স্কুলের স্যারদের কাছ থেকে নিয়মিত খবর নিতেন আমাদের পড়াশোনার। তবে বাবার একটা বদ গুন ছিল আমাদের নামে কোন অভিযোগ পেলে সত্যাসত্য যাচাই না করেই বেদম প্রহার করতেন। সেই সময় ছিল বেড়া চিতার গাছ, বেড়া চিতার শক্ত ডাল দিয়ে বহুবার বাবার হাতে মার খেয়েছি। সপ্তাহে একদিন বাবা কলকাতার বড় বাজারে যেতেন ব্যবসার কাজে। আমাদের বাড়ি থেকে কলকাতার দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার হলেও, শৈশবে কলকাতায় যেতে পারিনি। আমাদের শিশু মনে কলকাতা ছিল যেন ভিন্ন গ্রহের কোন শহর! বাবা বরাবর কেএম দাশের জুতো ব্যবহার করতেন, আমৃত্যু তাকে সেভাবেই দেখেছি। ধবধবে ধুতি আর কলার লাগানো পাঞ্জাবি পড়তেন। রাত সাড়ে ন'টার ট্রেনে বাবা কলকাতা থেকে ফিরতেন। সকাল বেলায় আমরা বাবার সেই জুতো উল্টিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম কলকাতার মাটি জুতোর সঙ্গে লেগে আছে কিনা! অর্থাৎ কলকাতার মাটি দেখতে কেমন! কিন্তু সেই কৈশোর কালে জুতোর নিচে কলকাতার মাটি কোনদিনই আমরা খুঁজে পাইনি।
সারাদিন সময় দিতে না পারলেও রাতের বেলায় খেতে বসে মায়ের কাছ থেকে সারা দিনের খোঁজখবর নিতেন। কার কি বই লাগবে, কার খাতা লাগবে, কার জামা বা প্যান্ট লাগবে, নির্দিষ্ট সময়ে সব কিছুই আমরা পেয়ে যেতাম। তবে আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা যেভাবে গাদা গুচ্ছের খেলনা খুব সহজেই বাবার কাছ থেকে পেয়ে যায়, আমাদের সময় এমনটা ছিল না, তার মানে এই নয় যে আমরা অভাবগ্রস্ত ছিলাম! বা বাবার কিনে দেবার সামর্থ্য ছিল না! যদিও বাবা বলতেন প্রত্যেকের জীবনে অভাবের প্রয়োজন আছে, না চাইতেই যদি সব পাওয়া যায় তবে সে মানুষ হবে না! সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো বাবার বলা এই কথা সঠিক বলে পরিগণিত হবে না, কিন্তু বাবার কঠোর অনুশাসনে থেকে আমরা চেষ্টা করেছি মানুষ হতে। আমরা খুব খুশি হতাম পুজোর আগে যখন বাবা কলকাতা থেকে আমাদের জন্য ধুতি আর পাঞ্জাবি কিনে আনতেন, সেই নতুন ধুতি পাঞ্জাবির গন্ধ শুঁকতাম। পুজো পুজো গন্ধ ছিল যেন সেই জামা কাপড়ে! আর পেতাম ক্যাপ বন্দুক, সেইসঙ্গে কয়েক বাক্স গুলি। এটুকুতেই আমরা খুব খুশি ছিলাম। আর প্রতিটি পহেলা বৈশাখ আর বিজয় দশমীর দিন বাড়িতে বহু মানুষকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন বাবা। মনে আছে পহেলা বৈশাখের আগের রাতে বাড়ির বিরাট উঠোনের এক প্রান্তে ভিয়েন বসতো, কারিগরেরা রসগোল্লা আর বোদে তৈরি করতো, সকালে ভাজা হত ফুলকো লুচি। অত্যন্ত রাশভারী স্বভাবের হলেও বাবার অন্তর ছিল শিশুর মতোই কোমল।
যখন আমি পিএইচডি পেলাম, তখন সেই থিসিস পেপারের মোটা বইটা কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করেছিলেন।আর আমার যত রকম সংগ্রহ তার সবকিছুর অনুপ্রেরণা ছিলেন তিনি, বিশেষ করে মুদ্রা সংগ্রহের।
No comments:
Post a Comment